২১. সফল অভ্যুত্থান এবং বিপ্লবত্তোর পরিস্থিতি

একবিংশ অধায় – সফল অভ্যুত্থান এবং বিপ্লবত্তোর পরিস্থিতি

  • সেনা পরিষদকে অনেক জটিল বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছিল।
  • কেন্দ্রিয় কমিটির তরফ থেকে বিভিন্ন ইউনিটে পাঠানো দেশের সার্বিক অবস্থা, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত এবং লক্ষ ও উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে ইশতেহার।
  • ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান।
  • রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনাব খন্দোকার মোশতাক আমদের শপথ গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন।
  • মোশতাক সরকারের গৃহিত নীতি ও পদক্ষেপসমূহ।
  • ১৫ই আগষ্ট ছিল জাতীয় মুক্তির দিন।
  • নতুন সরকার গঠিত হবার পর খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে সেনা পরিষদকে
  • নিজস্ব উদ্দেশ্যাবলী বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হচ্ছিল।
  • জনপ্রিয় আগষ্ট বিপ্লব নৈতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থন পেয়ে।
  • নিজের এবং পারিবারিক ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ভিত্তি দেয়ার লক্ষেই বাকশালী
  • স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন শেখ মুজিব।
  • জাতীয় আশা-আকাংখাকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কোন ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

সেনা পরিষদকে অনেক জটিল বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছিল। বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিতে পারে সে সমস্ত সমস্যাবলীর সমাধান সম্পর্কেও ভেবে দেখতে হয়েছিল নেতৃবৃন্দকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহিত তথ্যাবলী ও খবরা-খবরের ভিত্তিতেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সর্বপ্রথম ঠিক করতে হয়েছিল- কবে বিপ্লব ঘটানো হবে, কি পরিসরে সংগঠিত করা হবে বিপ্লব? খবর ছিল, ১৫ই আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ এবং কেন্দ্রিয় নেতারা ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সব বাকশালী নেতারাই উপস্থিত থাকবেন। নব্য নিযুক্ত জেলা গভর্ণররা এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা ইতিমধ্যেই ঢাকা শহরে এবং শেরে বাংলা নগরের এমপি হোস্টেলে ভীড় জমিয়েছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ এবং স্পেশাল স্কোয়ার্ড। নেতাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ছাড়াও শেখ মনি ও শেখ কামালের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারীরাও থাকবে অনুষ্ঠানে। জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে ভার্সিটি এলাকায় টহল দেবার জন্য মোতায়েন করা হবে। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান এবং ডেপুটি ডাইরেক্টর কর্নেল সাব্বিউদ্দিন দু’জনেই ঘটনাক্রমে সেদিন দেশের বাইরে অবস্থান করবেন। ঐ দিনটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস বিধায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনন্দ উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ভারত সরকার। ১৪-১৫ তারিখ এর রাত ঢাকা ব্রিগেডের নাইট ট্রেনিং এর জন্য নির্ধারিত

১২ই আগষ্ট এক বৈঠকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিপ্লব সংগঠিত হবে ১৫ই আগষ্ট সুবেহ্ সাদেকে। যেহেতু বাকশালী নেতাদের প্রায় সবাই সেদিন ঢাকায় অবস্থান করবেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র ঢাকাতে অপারেশন চালিয়ে বিপ্লবকে সফল করে তোলা সম্ভব হবে। সীমিত পরিসরে বিপ্লব ঘটালে বিপ্লবের সফলতার জন্য অতি প্রয়োজনীয় তিনটি উপকরণ যথা:-

(ক) নূন্যতম শক্তির প্রয়োগ

(খ) গতিশীলতা

(গ) গোপনীয়তা

অতি সহজেই হাসিল করা যাবে। টার্গেট হিসাবে নির্ধারন করা হয় রাষ্ট্রপতি, শেখ ফজলুল হক মনি, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, তাজুদ্দিন আহমদ, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক। এদের বন্দী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রেডিও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টিভি, ওয়্যারলেস সেন্টার, টিএন্ডটি, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর, রক্ষীবাহিনীর সাভারের মূল ক্যাম্প, সংসদ সদস্যদের হোষ্টেল, এয়ারপোর্ট, সাভার ট্রান্সমিশন-রিলে সেন্টার প্রভৃতি স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সীমিত পরিসরে নূন্যতম শক্তি প্রয়োগ করে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হবে নির্ধারিত টার্গেটগুলোর উপর। একই সাথে দেশের অন্যান্য সেনা নিবাসের ইউনিটগুলোর সেনা পরিষদগুলোকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হবে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে; যাতে করে প্রয়োজনে যে কোন প্রতিবন্ধকতা কিংবা সীমান্তের ওপার থেকে কোন প্রকার সামরিক হুমকির যথাযথভাবে মোকাবেলা করা যায় জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

কেন্দ্রিয় কমিটি ‘৭১ থেকে ‘৭৫ সাল অব্দি দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং বিপ্লব সম্পর্কে একটি দলিল তৈরি করে সেনা পরিষদের সব ইউনিটে বিতরণ করে। দলিলের সারবস্তু ছিল নিম্নরূপ : –

রুশ সামাজিক সম্প্রসারণবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ১৯৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল আপোষকামী শ্রেণীর প্রতিভূ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যোগসাজসে বাংলাদেশকে তাদের একটি তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগের প্রতারণা ও ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়ে উঠেছে অর্থহীন। স্বাধীকার ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতীয় সংগ্রাম নিক্ষিপ্ত হয়েছে ব্যর্থতার অন্ধ গলিতে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ভৌগলিক স্বাধীনতা লাভ করে বটে কিন্তু জাতীয় মুক্তির পথ সুকৌশলে বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার ও তার বিদেশী প্রভুরা। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের শাসনামলের চার বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক চরম বিভীষিকাময় কাল। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, সম্প্রসারণবাদী নীল নকশা এবং ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠির ফ্যাসিবাদী স্বৈরতন্ত্র, অবিচার, অত্যাচার এবং অবাধ দুর্নীতি জাতীয় জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনের ফলে দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং দেশ আজ পৌঁছে গেছে চুড়ান্ত ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। জাতীয় রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে চরম নৈরাজ্য ও স্থিতিহীনতা। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব স্বভাবতঃই বর্তায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উপর। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালী শ্বেত সন্ত্রাস এবং সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মুখে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মুজিব সরকারকে উৎখাত করা তাদের পক্ষে আজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সরকারি নির্যাতন ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর অপারগতার মূল কারণ হল- তাদের অনৈক্য, তাত্ত্বিক জ্ঞানের দেউলিয়াপনা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের কোন্দল এবং নেতাদের স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিকতা। দেশ ও জাতি আজ এক চরম সংকটে নিমজ্জিত। স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে হতাশাগ্রস্থ জাতিকে মুক্ত করা আজ প্রতিটি দেশপ্রেমিকের নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমান অবস্থার পটভূমিতে সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া অন্য কোন উপায়ে স্বৈরাচারী একনায়কত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব নয় বলেই এ গুরুদায়িত্ব সম্পন্ন করার অভিপ্রায়ে একটি জনপ্রিয় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাবার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে সেনা পরিষদ। বিপ্লবের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণের উপর সামরিক শাসনের বোঝা চাপিয়ে দেয়া নয়। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অক্ষমতা ও অযোগ্যতার সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক শাসন কায়েম করা হয়েছে কিন্তু এভাবে সামরিক বাহিনীকে সরাসরিভাবে জাতীয় রাজনীতিতে জড়ানোর পরিণামে সে সমস্ত দেশে উচ্চভিলাসী সামরিক শাসকবৃন্দের গোষ্ঠিস্বার্থই চরিতার্থ হয়েছে: জাতি ও দেশের কোন কল্যাণ হয়নি। কোন বিশেষ, গোষ্ঠির স্বার্থ হাসিল করা আমাদের বিপ্লবের উদ্দেশ্য নয়। এই বিপ্লবের চরিত্র হবে অন্যান্য দেশে সাধারণভাবে সংগঠিত যে কোন ক্যু’দ্যাতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সেনা পরিষদ দেশবাসী এবং সারাবিশ্বে প্রমাণ করবে- বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর বৃহৎ অংশ দেশপ্রেমিক: ক্ষমতালিপ্সু, সুযোগ সন্ধানী নয়। অবস্থার সুযোগ নিয়ে জনগণের রক্ষক হয়ে ভক্ষক বনে যাবার অভিপ্রেত তাদের নেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় নির্ভীক, নিবেদিত প্রাণ সৈনিক তারা। জনগণের মৌলিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই বিপ্লব। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো হবে যাতে করে সুষ্ঠ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটাবার জন্য দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা সংগঠিত হতে পারেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায়। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব হবে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলসমূহের। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের। সেনা বাহিনী দেশ ও জাতীয় স্বার্থের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে নির্বাচিত সরকারের অধিনে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে যাবে আন্তরিক নিষ্ঠার সাথে। প্রমাণ করা হবে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সদস্যরা নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। জাতীয় স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য, ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠি স্বার্থ নয়। অনন্য এই বিপ্লব নিখাদ দেশপ্রেমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মূলক মাইলফলক হিসাবে স্থাপিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে।

আসন্ন বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলীঃ –

১। রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা।

২। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

৩। ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে বাকশাল ও মুজিব সরকারের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা।

৪। কৌশলগত কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সংসদকে বলবৎ রেখে সাংবিধানিকভাবে একটি দেশপ্রেমিক সর্বদলীয় অস্থায়ী / নির্দলীয় সরকার গঠন করা।

সর্বদলীয় অস্থায়ী / নির্দলীয় সরকারের দায়িত্বঃ

১। বাকশাল প্রণোদিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী. সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন, রক্ষীবাহিনী আইন, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আইনের পরিপন্থী শ্রমিক আইন ও অন্যান্য কালা-কানুন বাতিল করা।

২। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দেশে অবিলম্বে প্রকাশ্য রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

৩। সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া।

৪। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

৫। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলা।

৬। সমাজতন্ত্রের নামে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব ও সরকারি সহযোগিতায় জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও অবাধ দুর্নীতির ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিপর্যস্ত দেউলিয়া অর্থনীতির পূর্ণবিন্যাসের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৭। জাতীয় জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করা;

৮। প্রশাসন কাঠামোকে দুর্নীতিমুক্ত করা।

৯। রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে বাংলাদেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জীবনাদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা।

১০। পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা।

উল্লেখিত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই সংগঠিত করা হবে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান। ঐতিহাসিক বিপ্লবের চুড়ান্ত পরিকল্পনা ও নির্দেশাবলী যথা সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে কেন্দ্রিয় কমিটির তরফ থেকে জানানো হবে।

১৪ই আগষ্ট রাত ঢাকা বিগ্রেডের নাইট প্যারেড। এই অযুহাতে বিপ্লবের শেষ পর্যায়ের সব প্রস্তুতি শেষ করে ১৫ই আগষ্ট সুবেহ্ সাদেকে আল্লাহ্তা’য়ালার নাম করেই বিপ্লব শুরু করা হল। পূর্ব নির্ধারিত টার্গেটগুলোর উপর অভিযান চালানো হল। অতি সহজেই স্ট্র্যাটেজিক (Strategic) পজিশনগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হল। শেখ মুজিব, শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাড়ি থেকে বাধা এল। প্রথম গোলাগুলি শুরু করা হল বাড়িগুলো থেকেই। গুলিতে তিনজন বিপ্লবী শহীদ হলেন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কমান্ডাররা নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন পাল্টা আক্রমণ চালানোর। সংঘর্ষে নিহত হলেন শেখ মুজিব ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য। শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাড়িতে অবস্থানরত অস্ত্রধারীদের কয়েকজন মারা গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যে সব টার্গেটগুলোই নিউট্রেলাইজ করা সম্ভব হল। রেডিও বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হল, শেখ মুজিবের সরকারের পতনের কথা। একই সাথে ঘোষণা করা হল, খন্দোকার মোশতাক আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। মার্শাল’ল জারি করা হল দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। জনগণের কাছে আবেদন জানানো হল- বিপ্লবের সমর্থনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সেনা বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের পতন ঘটেছে জানতে পেরে সমগ্র জাতি সেদিন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিপ্লবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে ঢাকার রাস্তায় লোকের ঢল নেমেছিল। জনগণ সারাদেশ জুড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে। মসজিদে মসজিদে লোকজন সেদিন বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের জন্য বিশেষ দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছিলেন। মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল মহল্লায় মহল্লায়। শেখ মুজিব ও তার দোসরদের জন্য সেদিন বাংলাদেশের জনগণ ‘ইন্নালিল্লাহে রাজেউন’ পড়তেও ভুলে গিয়েছিলেন। সবারই এক কথা, ‘দেশ জালিমের হাত থেকে বেঁচে গেছে।’

আমরা জানতাম বাকশালী শাসনে জনগণ অতিষ্ঠ। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালী গোষ্ঠি যে এতটা ধিকৃত হয়ে উঠেছিল জনগণের কাছে সেটা উপলব্দি করতে পেরেছিলাম বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর জনগণের অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের বহিঃপ্রকাশে। বাংলাদেশের মানুষ জাতির ক্রান্তিলগ্নে অতীতে সবসময় সঠিক রায় দিয়ে এসেছেন সেটাই তারা আরেকবার প্রমাণ করলেন ১৫ই আগষ্টের বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়ে। সমগ্র জাতির প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অভিভূত করেছিল। জনগণের দেশপ্রেম দেখে জাতির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করেছিলাম আমি। নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম জাতি ও দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছিলাম ভেবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বৃহৎ স্বার্থে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সার্থকতা সেদিনই পেয়ে গিয়েছিলাম জনগণের দোয়া ও আন্তরিক অভিনন্দনে। জনগণের উপর বিশ্বাস ও প্রত্যয় বেড়ে গিয়েছিল। বুঝে নিয়েছিলাম বাংলাদেশের ৮কোটি মুসলমানকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না কোন অপশক্তিই। সব চক্রান্তের ব্যুহভেদ করে আত্ম মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজের স্থান করে নেবে একদিন বাংলাদেশের সচেতন সংগ্রামী জনতা। জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের জোয়ারে সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়ল রুশ-ভারত চক্র। গণবিচ্ছিন্ন দেশ বিরোধী বিশ্বাসঘাতকরা সেদিন প্রাণের ভয়ে লেজ গুটিয়ে আত্মরক্ষার জন্য গর্তে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সেখানেও রেহাই পায়নি তারা। জনগণ জাতীয় বেঈমানদের খুঁজে বের করে ধরিয়ে দিতে থাকে আইন-শৃঙ্খলা পালনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে। এ অবস্থায় বাকশালী চক্রের যে সমস্ত নেতারা জান বাঁচাবার চেষ্টায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই জনগণের কাছ থেকে কোন সাহায্য-সহযোগিতা না পেয়ে উপায়হীন হয়ে স্বেচ্ছায় সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন। জনাব তোফায়েল আহমেদ এবং জনাব আব্দুর রাজ্জাক তাদের মধ্যে অন্যতম। জনাব কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল থেকে একটি টেলিগ্রাম করে তাতে জানায়, সে রাষ্ট্রপতির কাছে আত্মসমর্পন করতে চায়। এ টেলিগ্রামের কোন জবাব না পেয়ে প্রাণের ভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের হাতে ক্রিয়াণক হয়ে দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সহযোগিতায় তার দ্বারা পরিচালিত এক সশস্ত্র হামলার মোকাবেলা করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর এক তরুণ অফিসার ও চারজন সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া সরকার দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিচার করে। বিচারে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দীর্ঘ মেয়াদী সাজা প্রদান করে। তখন থেকেই রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে হালে বাংলাদেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে আবার পুনর্বাসিত হয়েছে সেই কাদের সিদ্দিকী। কাদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রদ্রোহী কাদের সিদ্দিকী আবার বাংলাদেশের মাটিতে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেল এই রহস্যের উদ্ঘাটনও ঘটবে একদিন এই বাংলাদেশের মাটিতেই।

ফিরে যাওয়া যাক ১৫ই আগষ্টে। অপারেশন শেষ। রেডিওতে সরকার পতন ও শেখ মুজিবের নিহত হবার খবর ঘোষিত হয়েছে। আমি কিছু জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলাম হঠাৎ ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার এসে জানাল রক্ষীবাহিনীর তিনটি ট্রাক ও একটি জিপ টিএসসি-র দিক থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম এরা রক্ষীবাহিনীর টহলদার ইউনিট। শেখ মুজিবের বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন উপলক্ষ্যে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের মৃত্যু সংবাদ যদি শুনে থাকে তবে তাদের প্রতিক্রিয়া বিরূপ হওয়া স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সংঘর্ষ অনিবার্য। আর যদি না শুনে থাকে তবে তাদের খবরটা জানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে শাহরিয়ারকে বললাম, “আমি ওদের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য যাচ্ছি। ওদের সমর্থন না পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার জন্য তুমি তৈরি থেকো। জিপ চালিয়ে একাই বেরিয়ে এলাম গেট দিয়ে। পিজি হাসপাতাল এর সামনে পৌঁছতেই দেখলাম কনভয়টি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এসে থেমেছে। আমি জিপ থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম জিপে বসে আছে রক্ষীবাহিনীর একজন লিডার। লিডার আমাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে স্যালুট করে দাড়াল।

—তোমরা এখানে কি করছ? প্রশ্ন করলাম।

—আমরা টহল দিচ্ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। গোলাগুলির শব্দ শুনে এদিকে এসেছি জবাব দিল লিডার। বুঝলাম ওরা বিপ্লব ও মুজিবের মৃত্যুর খবরটা এখনও শোনেনি। লিডার জিজ্ঞাসা করল,

—ব্যাপার কি স্যার? বললাম,

—শেখ মুজিবের সরকারের পতন ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী : শেখ মুজিব মারা গেছেন বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে। এ পরিস্থিতিতে তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে : তোমরা এই পরিবর্তনের পক্ষে না বিপক্ষে। অল্পক্ষণ চিন্তা করে লিডার বলল,

—আমরা পরিবর্তনের সপক্ষে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ট্রুপসদের গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের সমস্ত ঘটনা খুলে বলে তাদের মতামত জানতে চাইলে সবাই একবাক্যে পরিবর্তনকে সমর্থন জানাল। এরপর সবাইকে সাথে নিয়ে ‘নারায়ে তাকবির; আল্লাহু আকবর’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই’ প্রভৃতি শ্লোগান দিতে দিতে রেডিওতে ফিরে এলাম। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝেছিলাম, ওদের সর্ম্পকে আমাদের মূল্যায়ন ছিল নির্ভুল।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল (অবঃ) তাহের, কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন, মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর, মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন, মেজর (অবঃ) রহমতউল্লাহ- ক্যাপ্টেন (অবঃ) মাজেদ এবং এক্স পিএমএ ক্যাডেট মোস্তাক ও সরাফত এসে হাজির হল রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছে তারা বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী ইতিমধ্যেই সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পকে নিরস্ত্র করে তাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। লেঃ কর্নেল রশিদ চলে গেছে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে নিয়ে আসার জন্য আর আমি গেলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বাহিনী প্রধানদের নিয়ে আসতে। ঘটনাগুলো ঘটছিল অতি তরিৎ গতিতে। ঢাকা সেনানিবাস তখন সম্পুর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে যারা ক্যান্টনমেন্টে। অতি প্রত্যুষে বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিপ্লবকে প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু বিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের পক্ষে তখন কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তিনি ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন বটে কিন্তু তার অধিনস্ত রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নগুলো সবই তখন সেনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে, বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে। শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (চীফ অফ জেনারেল ষ্টাফ) কে অনুরোধ জানান কিছু করার জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ জবাবে তাকে জানান, “Bangabandhu is dead. The army has revolted and whole army has celebrated.” এ পরিস্থিতিতে কারো কিছু করার নেই বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দোকার, নৌ বাহিনী প্রধান এমএইচ খানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম রেডিও বাংলাদেশে। রশিদ ফিরে এল জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে। আমিন ফিরে এল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল আবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে। বিডিআর প্রধানকেও ডেকে আনা হল। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ রেডিও-তে জাতির প্রতি তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানরা সবাই রাষ্ট্রপ্রধান খন্দোকার মোশতাক আহমদের আনুগত্য প্রকাশ করে বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন রেডিওতে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আওয়ামী-বাকশালী নেতারা অনেকেই গ্রেফতার হন। ঐ দিনই জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন জনাব মাহমুদুল্লাহ। মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয় সেদিনই।

মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ :

  • বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
  • অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী
  • ফনিভূষণ মজুমদার
  • মোঃ সোহরাব হোসেন
  • আব্দুল মান্নান
  • মনরঞ্জন ধর
  • আব্দুল মোমেন আসাদুজ্জামান খান ডঃ এ আর মল্লিক
  • ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী

প্রতিমন্ত্রী :

  • শাহ মোয়াজ্জম হোসেন
  • দেওয়ান ফরিদ গাজী
  • তাহের উদ্দিন ঠাকুর
  • অধ্যাপক নূরুল ইসলাম
  • নূরুল ইসলাম মঞ্জুর
  • কে এম ওবায়দুর রহমান
  • মোসলেম উদ্দিন খান
  • রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
  • ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল
  • সৈয়দ আলতাফ হোসেন
  • মোমিন উদ্দিন আহমদ

খন্দোকার মোশতাক সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল পরবর্তিকালে। বাকশাল সরকারের ১৮জন মন্ত্রীর ১০জন এবং ৯জন প্রতিমন্ত্রীর ৮জনই মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন ১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে। পাকিস্তান অভ্যুত্থানের প্রথম দিনই খন্দোকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। যে সৌদি আরব মুজিব সরকারকে দীর্ঘ সাড়ে চার বছর স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত ছিল সেই সৌদি আরবও অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিনে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। গণচীন শুধু মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতিই দান করেনি; পিকিং বেতার ও ভয়েস অব আমেরিকা অভুত্থানের সমর্থনে একই সাথে হুশিয়ার বাণী প্রচার করে, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন একটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার। সে দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপার বিদেশী কোন প্রকার হস্তক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন সহ্য করবে না। এ ধরণের হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে বিধায় গণচীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরণের হস্তক্ষেপে নিশ্চুপ থাকবে না। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই তারা গ্রহণ করবে।” শুধু হুশিয়ারীই নয়; গণচীনের সেনা বাহিনীকে ভারতের যে কোন আগ্রাসী হামলার মোকাবেলায় সীমান্ত অবস্থান জোরদার করে তোলার হুকুম দিয়েছিল গণচীনের সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীনের হুশিয়ারী এবং দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সরকার ১৭ই আগষ্ট বাংলাদেশে আগ্রাসী সামরিক অভিযান চালাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেও সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়; অভ্যুত্থানের ১২দিনের মাথায় জাপান, ইরান, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আরো ৩৯টা দেশের সাথে ভারতও মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে।

রেডক্রস এর চেয়্যারম্যান পদ থেকে কুখ্যাত গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারিত করে বিচারপতি বি.এ সিদ্দিককে তার পদে নিযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। মুজিব কর্তৃক দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে গভর্ণর নিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। দেশের ১৯টি জেলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জেলা প্রশাসকদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি, মুজিব সরকারের ৬জন মন্ত্রী, ১০জন সংসদ সদস্য, ৪জন আমলা এবং ১২জন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিচারের জন্য দু’টো বিশেষ আদালত গঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর ৩৬ জন দুর্নীতিপরায়ন অফিসারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য বিলুপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতার আবেদন জানানো হয়। সরকারি আদেশে মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় ২৫শে আগষ্ট। একই দিনে জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির নয়া সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অব ডিফেন্স ষ্টাফ হিসাবে এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। বিমান বাহিনীর চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব।

দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুইটি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৬ই আগষ্ট মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে এক বার্তা পাঠান। দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, নেতা এবং গণসংগঠনের সমর্থনও লাভ করতে সমর্থ হয় নতুন সরকার। তারা সবাই দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনীকে তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক ঘোষণা করেন, “১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হতে দেশে বহুদলীয় অবাধ রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী দেশে সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত করা হবে।”

এভাবেই উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নেবার ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা অতি অল্প সময়ে শুধুমাত্র স্বাভাবিকই হয়ে উঠেছিল তাই নয়; দেশের আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং কল-কারখানার উৎপাদনেও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। দেশে চুরি-ডাকাতি ও চোরাচালানের মাত্রা কমে যায় বহুলাংশে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে পূর্ণমাত্রায়। দেশে বিদেশে অস্থায়ী সরকারের নীতিসমূহ ও পদক্ষেপগুলি প্রশংসিত হয়। সার্বিক অবস্থার স্বাভবিকরণের পর সেনা পরিষদ বিপ্লবের অবশিষ্ট উদ্দেশ্যাবলী বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় ব্রতী হন। লোকচক্ষুর অন্তরালে আমরা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলি আমাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায়। পর্বত সমান প্রতিবন্ধকতার মুখে কাজ করতে হচ্ছিল সেনা পরিষদকে।

বস্তুতঃ শেখ মুজিব তার নিজের ও পরিবারের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী একটা ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন। এভাবেই যুগযুগ ধরে স্বৈরাচারী শাসকরা আর্বিভুত হয়। এরা একই নিয়মে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। জামার্নীর হিটলারের উত্থান ঘটেছিল এভাবেই। নাৎসী পার্টি তাকে মহামানব আখ্যায়িত করেছিল। বাকশালীরাও শ্লোগান তুলেছিল, “এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।” ফলশ্রুতিতে মুজিব পরিণত হয়েছিলেন, একজন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়কে ইটালীতে মুসোলিনির আবির্ভাবও ঘটেছিল একই প্রক্রিয়ায়।

জনাব হায়দার আকবর খান রনো ও আরো অনেকে মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ও লেখক বাকশাল ব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগের শাসনামল ছিল বর্বরতার নজীরে পূর্ণ। সংসদীয় গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে একদলীয় ব্যবস্থার প্রবর্তক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারসহ সকল রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। জাতি কখনোই এই কলংকিত ইতিহাসের কথা অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারে না। আওয়ামী- বাকশালী শাসনামল ছিল মূলতঃ হত্যার ইতিহাস, নারী নির্যাতনের ইতিহাস, লুণ্ঠনের ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস, চোরাচালানের ইতিহাস, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে দেবার ইতিহাস, জাতীয় অর্থনীতিকে বিকিয়ে দেবার ইতিহাস, রক্ষীবাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও লাখো শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানীর ইতিহাস। রাষ্ট্রীয়করণের নামে আওয়ামী লীগ ব্যাংক, বীমা, মিল, কল-কারখানায় হরিলুট করেছিল। দেশে সম্পদ পাচাঁর করার জন্য সীমান্তকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আওয়ামী শাসনামলে অবাধ লুটপাটের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে বিদেশী সাহায্যের বেশিরভাগ মালই ভারতের কোলকাতা ও বিশাখা পাওম বন্দরে খালাস পেতো। একাত্তরের যুদ্ধ আর ধ্বংসযজ্ঞের পর বাহাত্তরে কোন দুর্ভিক্ষ না হয়ে আওয়ামী লীগের শাসন ও শোষণের ফলে ‘৭৪-এ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। অনাহারে মারা গিয়েছিল লাখ লাখ আদম সন্তান। ডাষ্টবিনের উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছিল মানুষ আর কুকুরে। অনাহারে মৃত ব্যক্তিদের কলাপাতার কাফনে দাফন করতে হয়েছে। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বন্য লতা-পাতা, কচু-ঘেচু আর কলাগাছের কান্ড সংগ্রহে ব্যস্ত জাল পরা বাসন্তীরা আওয়ামী কুশাসনের ঐতিহাসিক সাক্ষী। বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সরকারিভাবে ভারত থেকে সুন্দরী ও সোহাগী নামের দেড় হাত প্রস্থ ও সাত হাত দৈর্ঘ্য শাড়ী আমদানি করে আওয়ামী লীগ বস্ত্রহীন, নিরন্ন ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাথে জঘণ্য মস্করা করেছিল। জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ কাপড়ের নাম দিয়েছিল ‘উলঙ্গ বাহার শাড়ী।

আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকার তাদের শাসনামলে এ দেশের জনগণকে গণতন্ত্রের নামে দিয়েছিল স্বৈরাচার; সমাজতন্ত্রের নামে শুরু করেছিল সামাজিক অনাচার; বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে জাতিকে করেছিল বিভক্ত; আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুগিয়েছিল ধর্মহীনতার ইন্ধন। স্বৈরাচারী মুজিব সরকার সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল। ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তন যদি না হত তাহলে গণতন্ত্রের বধ্যভুমিতে আজকের শতাধিক রাজনৈতিক দলকে একদলীয় বাকশালের ধ্বজা বহন করেই বেড়াতে হত। এমনকি আওয়ামী লীগ নামক কোন দলেরও পুর্ণজন্ম হত না। আওয়ামী-বাকশালীদের অনাসৃষ্টির জন্য বিধ্বস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ঘানি দেশবাসীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য টানতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, গোলাবারুদ, স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু, যানবাহন, মিল-কারখানার মেশিনপত্র, কাঁচামাল ভারতের হাতে তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতিকে প্রতিপক্ষ করে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট সেজে বসেছিল। এসবের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় দেশমাতৃকার অন্যতম সেরা সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল; প্রাণ হারাতে হয়েছিল বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ও হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে। লাঞ্ছণার শিকারে পরিণত হতে হয় অনেক দেশপ্রেমিককে। দীর্ঘমেয়াদী অসম চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখেছিল আওয়ামী লীগই। লালবাহিনী, নীলবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনীসহ ইত্যাকার নানা রকমের বাহিনী গঠনের দ্বারা দুঃসহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে বিনা বিচারে ত্রিশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীর প্রাণ সংহার করার কালো ইতিহাস আওয়ামী-বাকশালীদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করার পর শেখ মুজিব স্বয়ং সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতার দম্ভে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?” ২৩/১/১৯৯২ তারিখে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ‘৭২ থেকে ‘৭৫ সালের আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসন প্রসঙ্গে জনাব মওদুদ আহমেদ বলেন, “১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর দেশে জরুরী অবস্থা জারি করার পর ২৯শে ডিসেম্বর ভোরে আমাকে বিনা অপরাধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বন্দী করা হয়েছিল। অথচ সরকার আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আনতে পারেনি সেদিন। এই তোফায়েল সাহেবই রক্ষীবাহিনীর ইনচার্জ ছিলেন। আর এই বাহিনীর হাতেই এ দেশের ৪০ হাজার নিরীহ মানুষ জীবন হারিয়েছে। সিরাজ সিকদারের হত্যার কথা আজো এ দেশবাসী ভুলে যায়নি। ‘৭২ থেকে ‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট অব্দি আওয়ামী-বাকশালী শাসনকাল এ দেশের ইতিহাসে সবচাইতে কালো অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

জাতির আশা-আকাংখাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে ব্যবস্থা টিতে থাকেতে পারে না। জনসমর্থন ছাড়া কোন ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জাতীয় বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা যখন জাতির কাঁধে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাতন্ত্রের বোঝা চাপিয়ে দেয়, জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয়. ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থ হাসিলের জন্য মীরজাফর বা রাজাকার-আলবদরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তাদের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন থেকে জাতিকে বাঁচানোর জন্য তাদের দুঃশাসন উৎখাত করার জন্য দেশপ্রেমিকদের বিপ্লবের পথ অবলম্বন করতে হয়েছে যুগে যুগে। একই যুক্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বিপ্লব সংগঠিত করেছিল বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ। সেই বিপ্লব ছিল একটি সফল অভ্যুত্থান। দেশ ও জাতি মুক্তি পেয়েছিল দাসত্বের নাগপাশ ও স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে। বাকশাল সরকারের উৎখাত ও মোশতাক সরকারের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন এ কথাই প্রমাণ করেছিল জনগণের আশা-আকাংখার সাথে বাকশালের কোন সম্পর্ক ছিল না। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনসমর্থনও ছিল না। ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থন পেয়ে একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *