২১. সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি

একবিংশ অধ্যায় সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি

সময়-ভিত্তিক মজুরি যেমন শ্রমশক্তির মূল্য বা দামের পরিবর্তিত রূপ, ঠিক তেমন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও হল সময়-ভিত্তিক মজুরির পরিবর্তিত রূপ।

সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় যেন শ্রমিকের কাছ থেকে ক্রীত ব্যবহার-মূল্য তার শ্রমশক্তির জীবন্ত শ্রমের কাজ নয়, তা হল উৎপন্ন দ্রব্যটিতে ইতিপূর্বেই রূপায়িত শ্রম; মনে হয় যেন এই শ্রমের দাম সময়-ভিত্তিক মজুরির মত একই ভগ্নাংকের দ্বারাঃ

শ্রমশক্তির দৈনিক মুল্য/একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার শ্রম-দিবস

—এই ভগ্নাংকটির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় উৎপাদকের কর্মক্ষমতার দ্বারা।[১]

এই আপাত রূপের উপরে ন্যস্ত যে বিশ্বাস, তা এই ঘটনা থেকে এক প্রথম প্রচণ্ড ধাকা খাওয়া উচিত যে শিল্পের একই শাখাসমূহে এই দ্বিবিধ রূপের মজুরিই পাশাপাশি, যুগপৎ প্রচলিত থাকে; যেমন লণ্ডনের কম্পজিটারের সাধারণ রীতি অনুসারে কাজ করে থাকে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি অনুযায়ী—সময়-ভিত্তিক মজুরি সেখানে ব্যতিক্রম মাত্র; অথচ মফস্বলের কম্পজিটারের কাজ করে থাকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি সেখানে ব্যতিক্রম মাত্র।[২]

লণ্ডনের একই ‘জিন তৈরির কর্মশালাগুলিতে ফরাসীদের দেওয়া হয় সংখ্যা ভিত্তিক মজুরি কিন্তু ইংরেজদের দেওয়া হয় সময়-ভিত্তিক মজুরি। যে-সমস্ত নিয়মিত কারখানায় সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই সর্বত্র আধিপত্য কয়ে, সেখানেও বিশেষ বিশেষ কাজ এই ধরনের মজুরির পক্ষে অনুপযোগী এবং সেইজন্য মজুরি দেওয়া হয় সময়ের হিসাবে।[৩] কিন্তু এটা স্বতঃস্পষ্ট যে মজুরি দেবার দুটি রূপের মধ্যে এই পার্থক্য কোনক্রমেই তাদের মর্মগত প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটায় না, যদিও একটি বিশেষ রূপ ধনতান্ত্রিক বিকাশের পক্ষে অন্য রূপটির তুলনায় বেশি অনুকুল হতে পারে।

ধরা যাক, একটি সাধারণ শ্রম-দিবস গঠিত হয় ১২টি ঘণ্টা নিয়ে, যার মধ্যে, ৬টি মজুরি-প্রদত্ত এবং ৬টি মজুরি-বঞ্চিত। ধরা যাক, তার মূল্য-ফল ৬ শিলিং, অতএব ১ ঘণ্টা শ্রমের মূল্য-ফল হবে ৬ পেন্স। আরো ধরা যাক যে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, একজন শ্রমিক—যে কাজ করে গছ-পরিমাণ তীব্রতা ও দক্ষতা সহকারে, অতএব, যে বাস্তবিক পক্ষে দেয় একটি দ্রব্য উৎপাদনে যতটা শ্রম সামাজিক ভাবে আবশ্যক, কেবল সেই পরিমাণ শ্রম—সে সরবরাহ করে ১২ ঘণ্টায় ২৪টি জিনিস; হয়, প্রত্যেকটি একক আলাদা আলাদা আর, নয়তো, একটি অখণ্ড সমগ্র সামগ্রীর খণ্ড খণ্ড ভাবে পরিমেয় অংশ। তা হলে, এই ২৪টি এককের মূল্য থেকে তাদের মধ্যে বিধৃত স্থির মূলধন বাবদ একটি অংশ বিয়োগ করে রাখার পরে তা দাড়ায় ৬ শিলিং এবং একটি এককের মূল্য দাঁড়ায় ৩ পেন্স। শ্রমিক প্রত্যেক একক-প্রতি পায় ১.৫ পেন্স, এবং এই ভাবে ১২ ঘণ্টায় আয় করে ৩ শিলিং। ঠিক যেমন সময়-ভিত্তিক মজুরির বেলায়, এতে কিছু এসে যায় না যে আমরা কি ধরে নিলাম—শ্রমিক নিজের জন্য ৬ ঘণ্টা এবং খনিকের অন্য ৬ ঘণ্টা কাজ করছে, নাকি, প্রত্যেকটি ঘণ্টার অর্ধেকটা করছে নিজের জন্য এবং অর্ধেকটা ধনিকের জন্য, ঠিক তেমনি এখানেও কিছু এসে যায় না যে আমরা কি ধরে নিলাম—প্রত্যেকটি এককের অর্ধেকটার জন্য মজুরি দেওয়া হয়, অর্ধেকটার জন্য দেওয়া হয় না, নাকি, ১২টি একক ধারণ করে কেবল শ্রমশক্তির সম-পরিমাণ মূল্য এবং বাকি ১২টি ধারণ করে উদ্বৃত্ত-মূল্য।

সময়-ভিত্তিক মজুরি যেমন অযৌক্তিক, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও তেমন অযৌক্তিক। যেখানে আমাদের উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, পরিভুক্ত উৎপাদন-উপকরণসমূহের মূল্য বিয়োগ করে রাখার পরে একটি পণ্যের দুটি এককের মূল্য-ঐ দুটি একক এক ঘণ্টার শ্রম-ফল হবার দরুন—দাড়ায় ৬ পেন্স, সেখানে শ্রমিক তাদের জন্য পায় দাম হিসাবে। ৩ পেন্স। সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি, বস্তুতঃ পক্ষে, কোনো মূল্য-সম্পর্ক স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করে না। সুতরাং, তার মধ্যে কতটা কাজের সময় বিধৃত আছে, তা দিয়ে একটি জিনিসের মূল্য নির্ধারণের প্রশ্ন এটা নয়; বরং, উটো, কতটা কাজের সময় শ্রমিক তার উপরে ব্যয় করেছে, তাকে তার উৎপন্ন জিনিসগুলির সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করার প্রশ্ন। সময়-ভিত্তিক মজুরিতে শ্রমকে পরিমাপ করা হয় তার তাৎক্ষণিক স্থিতিকাল অনুসারে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে শ্রমকে পরিমাপ করা হয় দ্রব্যসম্ভারের পরিমাণ দিয়ে, যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে শ্রম নিজেকে মূর্ত করেছে। [৪] শ্রম-সময়ের দাম নিজেই নির্ধারিত হয় এই সমীকরণের দ্বারা : এক দিনের শ্রমের মূল্য শ্রমশক্তির দৈনিক মূল্য। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হল সময়-ভিত্তিক মজুরির একটি উপযোজিত রূপ।

এখন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির স্বকীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলি আরো একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে বিবেচনা করা যাক।

শ্রমের গুণমান এখানে নিয়ন্ত্রিত হয় খোদ কাজেরই দ্বারা, একক-প্রতি দাম পুরোপুরি ভাবে পেতে হলে যাকে অবশ্যই হতে হবে গড় উৎকর্ষের অধিকারী। সুতরাং এদিক থেকে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হল মজুরি-দ্বাসের ও প্রতারণার সবচেয়ে ফলপ্রসূ উৎস।

সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ধনিককে যোগায় শ্রম-তীব্রতার একটি সঠিক পরিমাপ। কেবল সেই পরিমাণ কাজের সময়, যা বিস্তৃত হয় একটি পূর্ব-নিরূপিত ও পরীক্ষামূলক ভাবে নির্ধারিত পণ্য-পরিমাণে, সেই পরিমাণ কাজের সময়কেই ধরা হয় সামাজিক ভাবে আবশ্যিক শ্রম-সময় হিসাবে এবং কেবল তারই জন্য মজুরি দেওয়া হয়। এই কারণে লণ্ডনের দর্জিদের বৃহত্তর কর্মশালাগুলিতে একটি বিশেষ কাজকে, যেমন একটি ওয়েস্ট কোটকে বলা হয় একটি ঘণ্টা কিংবা একটি আধ-ঘণ্টা’—যেখানে ঘণ্টা-প্রতি মজুরি হল ৬ পেন্স। এক ঘণ্টার গড় উৎপাদন কত, সেটা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানা হয়ে যায়। নোতুন নোতুন ফ্যাশন, রিফুর কাজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়, একটা বিশেষ কাজ কি এক ঘণ্টা, না এক ঘণ্টা নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি শ্রমিক গড় কর্মক্ষমতার অধিকারী না হয়, যদি সে দৈনিক একটা ন্যূনতম পরিমাণ কাজের যোগান দিতে না পারে, তা হলে তাকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়।[৫]

যেহেতু এখানে কাজটির গুামান ও তীব্রতা খোদ মজুরির রূপের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই হেতু শ্রমের উপরে তদারকির ব্যাপারটা অনেকাংশেই বাহুল্য হয়ে পড়ে। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি উপরে বর্ণিত আধুনিক ‘ঘরোয়া শ্রম’-এর এবং সেই সঙ্গে শোষণ ও পীড়নের একটি ক্রমোচ্চ স্তরতন্ত্রের সংগঠিত ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এই সংগঠিত ব্যবস্থার দুটি মৌল-রূপ আছে। এক দিকে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি এবং ধনিক মজুরি-শ্রমিকদের মধ্যে পরগাছাদের জন্য স্থান করে দেয়, “ভাড়া-কর। শ্রমকে আবার ভাড়া খাটানোর (“সাব-লেট” করার সুযোগ করে দেয়। এই মধ্যস্থদের পুরো ভাড়াটাই আসে, ধনিক শ্রমের জন্য যে দাম দেয় এবং সেই দামের যে-অংশ তার কার্যতঃ শ্রমিকের হাতে পৌছুতে দেয়—এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য থেকে।[৬] ইংল্যাণ্ডে এই ব্যবস্থাটিকে তার চরিত্রানুযায়ী অভিহিত করা হয় “ক্ত জল-করা ব্যবস্থা (সোয়েটিং সিস্টেম) বলে। অন্য দিকে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ধনিককে সুযোগ করে দেয় প্রতিটি জিনিস-পিছু এতটা দামের ভিত্তিতে মুখিয়া শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে ম্যানুফ্যাকচারে কোন প্রমিক-গোষ্ঠীর প্রধানের সঙ্গে খনিতে কয়লা-আহকের সঙ্গে, কারখানায় খোদ মেশিন-শ্রমিকের সন্ধে; যে-দামে চুক্তিটি হয়, সেই দামে ঐ মুখিয়া শ্রমিক নিজেই দায়িত্ব নেয় তার সহকারী কাজের লোকদের সংগ্রহ করতে এবং মজুরি দিতে। এখানে ধনিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ সংঘটিত হয় শ্রমিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণের মাধ্যমে।[৭]

উৎপন্ন জিনিসের সংখ্যার ভিত্তিতে মজুরি দেওয়া হয় বলে, স্বভাবতই তার শ্রম শক্তিকে যথা সম্ভব তীব্রতা সহকারে প্রয়োগ করা শ্রমিকের নিজেরই ব্যক্তিগত স্বার্থ হয়ে ওঠে; এর ফলে ধনিক সুযোগ পায় শ্রমের তীব্রতার স্বাভাবিক মাত্রাকে আবো বৃদ্ধি করতে।[৮] অধিকন্তু, শ্রম-দিবসকে দীর্ঘায়িত করা হয়ে ওঠে শ্রমিকের ব্যক্তিগত স্বার্থ, কেননা সেই সঙ্গে তার দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিও বৃদ্ধি পায়।[৯] সময়-ভিত্তিক মজুরির মত, যা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, এই সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও ক্রমে ক্রমে ঘটায় এক প্রতিক্রিয়া; এমনকি সংখ্যাপিছু মজুরি যদি স্থির থাকে, তা হলেও শ্রম দিবসের দীর্ঘ-বৃদ্ধি যে আবশ্যিক ভাবেই শ্রমের দামে হ্রাস ঘটায়, এটা হিসাবে না ধরে।

সময়-ভিত্তিক মজুরিতে, সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, একই কাজের জন্য একই মজুরি চালু থাকে; কিন্তু সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে, যদিও কাজের সময়ের দাম মাপা হয় উৎপন্ন দ্রব্যের একটি বিশেষ পরিমাণের দ্বারা, তা হলেও দিনের বা সপ্তাহের মজুরি পরিবর্তিত হবে শ্রমিকদের ব্যক্তিগত পার্থক্যসমূহের দ্বারা; শ্রমিকদের মধ্যে একজন একটি নিদিষ্ট সময়ে সরবরাহ করছে কেবল ন্যুনতম পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য, আর একজন করছে গড় পরিমাণ এবং তৃতীয় জন করছে গড়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ। সুতরাং তাদের ব্যক্তিগত শ্রমিকদের বিভিন্ন দক্ষতা, শক্তি ও উদ্যম অনুযায়ী আয়ের ক্ষেত্রেও হয় বিরাট বিরাট পার্থক্য।[১০] অবশ্য, এর ফলে মূলধন ও মজুরি-শ্রমের মধ্যে সাধারণ সম্পর্কের পতন ঘটে না। প্রথমত, সমগ্র ভাবে কর্মশালাটির ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত পার্থক্যগুলি পরস্পরকে পুষিয়ে দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে, যার দরুন ঐ কর্মশালাটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে গড় পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়; এবং প্রদত্ত মোট মজুরি হবে শিল্পের ঐ বিশেষ শাখার গড় মজুরি। দ্বিতীয়ত, মজুরি ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের অনুপাতও থাকে অপরিবর্তিত, কেননা প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত শ্রমিক যে-পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য সরবরাহ করে, তা তার প্রাপ্ত মজুরি অনুরূপ হয়। কিন্তু সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ব্যক্তিত্বকে যে ব্যাপক অবকাশ দান করে, তা এক দিকে, সেই ব্যক্তিত্বের এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাধিকার, স্বাধীন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকাশ ঘটায় এবং, অন্য দিকে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতারও বিকাশ ঘটায়। সুতরাং সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির এই প্রবণতা আছে যে, যখন তা ব্যক্তিগত মজুরিকে গড়ের চেয়ে উপরে তোলে, তখন তা এই স্বয়ং গড়টিকেই নিচে নামিয়ে আনে। কিন্তু যেখানে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির একটা বিশেষ হার দীর্ঘকাল ধরে প্রথাগত ভাবে নির্দিষ্ট হয়ে আছে, এবং তাকে নামিয়ে আনতে গেলে বিশেষ বিশেষ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে, তেমন বিল ক্ষেত্রগুলিতে মালিকেরা সংখ্যাভিত্তিক মজুরিকে বাধ্যতামূলক ভাবে সময়-ভিত্তিক মজুরিতে রূপান্তর সাধনের আশ্রয় নেয়। এই কারণেই ১৮৬০ সালে কভেন্টির রিবন শ্রমিকদের মধ্যে এক বিরাট ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল।[১১] সর্বশেষে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি হচ্ছে ঘণ্টাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অবলম্বন, যে-ব্যবস্থার কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।[১২]

এতদূর পর্যন্ত যা দেখানো হল, তা থেকে অনুসরণ করে যে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ। যদিও কোন ক্রমেই নোতুন নয়-চতুর্দশ শতাব্দীর ফাসী ও ইংরেজ শ্রম-আইনে সময়-ভিত্তিক মজুরির পাশাপাশি এরও উল্লেখ আছে-তবু যথার্থ ভাবে যাকে বলা যায় ম্যানুফ্যাকচার-যুগ; সেই যুগেই কেবল সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি প্রথা এক বৃহত্তর কর্ম-পরিধিতে তার আধিপত্য বিস্তার করে। আধুনিক শিল্পের ঝঙ্কা-মুখর যৌবনে, বিশেষ করে ১৭৯৭ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি শ্রম-দিবস সম্প্রসারণে এবং মজুরি সংকোচনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। ঐ সময়কার মজুরি হ্রাস-বৃদ্ধির খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব মাল মশলা এই ‘ব্লু-বুক’গুলিতে পাওয়া যাবে : “শস্য আইন সংক্রান্ত আবেদনসমূহ প্রসঙ্গে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন ও সাক্ষ্য” (১৮১৩-১৪ সালের সংসদ-অধিবেশন) এবং “দানা-শস্যের বৃদ্ধি, বাণিজ্য ও ব্যবহার ও তৎসংক্রান্ত যাবতীয় আইন প্রসঙ্গে লর্ড কমিটির প্রতিবেদন” (১৮১৪-১৫ সালের অধিবেশন)। জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধের সূচনা থেকে মজুরি-হ্রাসের প্রামাণ্য সাক্ষ্য আমরা এখানে পাই। নমুনা হিসাবে, বয়ন শিল্পে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি এত কমে গিয়েছে যে, শ্রম-দিবসের দারুৰ বৃদ্ধি ঘটানো সত্ত্বেও দৈনিক মজুরি তখন দাঁড়িয়েছিল আগের চেয়েও কম। তুলো-তন্তুবায়দের আসল মজুরি এখন আগের তুলনায় অনেক কম; মামুলি মজুরের তুলনায় এক সময়ে তার অবস্থান ছিল অনেক উপরে; এখন তা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই লোপ পেয়েছে। বস্তুতঃ পক্ষে, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের মজুরির পার্থক্য এখন আগেকার তুলনায় চের কম।”[১৩] সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির মাধ্যমে শ্রমের তীব্রতা ও দীর্ঘতা বৃদ্ধি কৃষি-মজুর কত সামান্য উপকার করেছে, তা জমিদার ও কৃষকদের পক্ষের একটি বই থেকে উদ্ধত এই অনুচ্ছেদটি থেকেও বোঝা যাবে, “কৃষির অধিকাংশ কাজকর্মই করানো হয় দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া করা লোকদের দিয়ে কিংবা সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির হিসাবে, তাদের সাপ্তাহিক মজুরি প্রায় ১২ শিলিং এবং যদিও এটা ধরে নেওয়া যায় যে অধিকতর কর্ম-প্রেরণার দরুন সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি-হারে মানুষ সাপ্তাহিক মজুরির তুলনায় ১ শিলিং, হয়তো ২ শিলিং বেশি পায়, তবু তার মোট হিসাব করে দেখা যায় যে, সারা বছরে তার কর্মহানি-জনিত ক্ষতি তার লাভকে ছাড়িয়ে যায়। অধিকন্তু, সাধারণ ভাবে এটাও দেখা যাবে যে এই লোকগুলির মজুরির সঙ্গে জীবনধারণের উপায়-উপকরণের দামের একটা বিশেষ আনুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে, যার ফলে দুটি সন্তান সহ একজন মানুষ ‘প্যারিশ থেকে সাহায্য ছাড়াও তার পরিবার প্রতিপালন করতে পারে।”[১৪] পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যাদি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ম্যালথাস তখন বলেন, “আমি স্বীকার করছি যে, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির বিপুল বিস্তৃতিকে আমি সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখি। দিনের ১২১১৪ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময়, বস্তুতই কঠোর পরিশ্রম যে-কোন মানুষের পক্ষেই অসহনীয়।” [১৫]

কারখানা-আইনের অধীন কর্মশালাগুলিতে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিই হয়ে ওঠে সাধারণ রেওয়াজ, কেননা সেখানে কেবল শ্রমের তীব্রতা বৃদ্ধি করেই শ্রম-দিবসের ফলপ্রসূতা বাড়ানো যায়।[১৬]

শ্রমের উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একই পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন কাজের সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। অতএব, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিও পরিবর্তিত হয়, কেননা তা হল একটি নির্ধারিত কর্মকালের আর্থিক অভিব্যক্তি। আমাদের উল্লিখিত দৃষ্টান্তটিতে, ১২ ঘণ্টায় উৎপন্ন হয়েছিল ২৪টি জিনিস, আর ১২ ঘণ্টার উৎপন্ন ফলের মূল্য ছিল ৬ শিলিং, শ্রমশক্তির মূল্য ছিল ৩ শিলিং, শ্রম-ঘণ্টার দাম ৩ পেন্স এবং একটি জিনিসের দাম ১.৫ পেন্স। একটা জিনিসে বিস্তৃত ছিল অর্ধেক ঘণ্টার শ্রম। এখন যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণিত হবার দরুন,একই কাজের দিন এখন সরবরাহ করে ২৪টি জিনিসের বদলে ৪৮টি জিনিস, এবং বাকি সব কিছু থাকে অপরিবর্তিত, তা হলে সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি ১.৫ পেন্স থেকে কমে দাঁড়ায় ৩/৪ পেন্স, কেননা প্রত্যেকটি জিনিস এখন প্রতিনিধিত্ব করে একটি শ্রম-ঘণ্টার ১/২ ভাগের জায়গায় মাত্র ১/৪ ভাগ। ২৪x১.৫ পেন্স=৩ শিলিং এবং অনুরূপ ভাবেই ৪৮x৩/৪ পেন্স=৩ শিলিং। ভাষান্তরে বলা যায়, সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরি সেই অনুপাতে হ্রাস পায়, যে-অনুপাতে উৎপন্ন জিনিসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়[১৭] এবং, অতএব, সেই একই জিনিসে ব্যয়িত কর্ম-সময় হ্রাস পায়। সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরিতে এই পরিবর্তন, যা এখনো পর্যন্ত কেবল অর্থের হিসাবে, তা পরিণতি লাভ করে ধনিক ও শ্রমিকের মধ্যে নিরন্তর লড়াইয়ে। হয়; যেহেতু খনিক একে ব্যবহার করে শ্রমের দাম সত্যসত্যই কমিয়ে দেবার অছিলা হিসাবে অথবা যেহেতু শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সংঘটিত হয় শ্রমের বর্ধিত তীব্রতা। আর, নয়তো, যেহেতু ‘সংখ্যা-ভিত্তিক মজুরির আকৃতিকে সে গুরুত্বসহকারে নেয়, যথা, তার উৎপন্ন প্রব্যের জন্যই টাকা দেওয়া হচ্ছে, তার শ্রমশক্তির জন্য নয়, এবং, সেই জন্যই, পণ্যের বিক্রয়মূল্য না কমিয়ে মজুরি কমাবার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করে। শ্রমিকেরা কাঁচা মালের দাম এবং তৈরি মালের দাম সযত্নে লক্ষ্য করে এবং এই ভাবে তাদের মালিকের মুনাফার একটা সঠিক হিসাব করতে সক্ষম হয়।[১৯]

মজুরি-শ্রমের প্রকৃতি সম্পর্কে বিরাট বিভ্রান্তি বলে এই ধরনের দাবিকে মালিক সঠিক ভাবেই মাথার উপরে আঘাত হানে।[২০] শিল্পের অগ্রগমনের উপরে কর-আবরাপের এই দখলদারী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সে চেঁচিয়ে ওঠে এবং ঘুরিয়ে ঘোষণা করে যে, শ্রমের উৎপাদনশীলতা আদৌ শ্রমের ব্যাপারই নয়।[২১]

————

১. “টুকরা-কাজের (পিস-ওয়ার্ক’-এর) ব্যবস্থা শ্রমিকের ইতিহাসে একটা যুগের পরিচায়ক; এক দিকে ধনিককের মর্জির উপরে নির্ভরশীল নিছক দিনমজুর, অন্য দিকে সহযোগমূলক কারিগর যে অদূর ভবিষ্যতে নিজের মধ্যে কারিগর ও ধনিতের সম্মিলন ঘটাবার প্রতিশ্রুতি—এই দুজনের অবস্থানের মধ্যপথে তার অবস্থিতি। পিস ওয়ার্কাররা (জিনিস-পিছু মজুরির ভিত্তিতে যারা কাজ করে, সেই মজুরেরা) আসলে তাদের নিজেদেরই মনিব, এমনকি যখন তারা নিয়োগকর্তার মূলধনের উপরে কাজ করছে, তখনো। (জন ওয়াটস, “ট্রেড সোসাইটিজ অ্যাণ্ড স্ট্রাইকস, মেশিনারি অ্যাণ্ড কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ”, ম্যাঞ্চেস্টার, ১৮৬৫, পৃঃ ৫২, ৫৩)। আমি এই কুত্ত পুস্তিকাটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি, কারণ অনেক কাল আগেকার যাবতীয় বস্তাপচা বুলির এটা একটা ঝুড়ি-বিশেষ। এই একই মিঃ ওয়াটস এক সময়ে ‘ওয়েনবাদ নিয়ে ব্যবসা কেঁদেছিলেন এবং ১৮৪২ সালে আরেকখানা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকদের তথ্য ও গল্প; সেই পুস্তিকায় আরো অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “সম্পত্তি মানে লুণ্ঠন, সে অনেক দিন আগেকার কথা।

২. টি. জে. ভানিং: ‘ট্রড ইউনিয়নস অ্যান্ড স্ট্রটেকস, লণ্ডন, ১৮৬, পৃঃ ২২।

৩. কি ভাবে এই ধরনের মজুরির পাশাপাশি ও যুগপৎ প্রচলন মালিকদের প্রতারণার কাজকে সাহায্য করে : “একটা কারখানায় ৪ ০ ০ লোক কাজ করে, যাদের মধ্যে অর্ধেক কাজ করে ‘পিস’-এর ভিত্তিতে এবং দীর্ঘতর সময় কাজ করায় স্বার্থবান। বাকি ২০০ জন মজুবি পায় ‘রোজ হিসাবে, কাজ করে অন্যান্যদের মত একই দীর্ঘতর সময়, কিন্তু তাদের উপরি-সময়ের জন্য পায়না কোনো পয়সা।”এই ২০০ জন লোকের প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে কাজ একজন লোকের ৫৩ ঘন্টার কাজের সমান কিংবা এক সপ্তাহের ভাগ ও কাজের সমান, এবং তা সরাসরি নিয়োগকর্তার পক্ষে একটা অতিরিক্ত লাভ।” (“রিপোর্টস: ফ্যক্টরিজ, ১৮৬৩, পৃঃ ৯)। “উপরি-খাটুনি এখনো প্রভূত পরিমাণে চালু আছে; এবং চালু আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়া ও শান্তি পাবার বিরুদ্ধে সেই সব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সমেত, খোদ আইনই, যার সুযোগ রেখে দিয়েছে। আমি আমার আগেকার, অনেক রিপোর্টে দেখিয়েছি: যেসব শ্রমিকেরা ‘পিস-ওয়ার্ক’-এর ভিত্তিতে কাজ করে না, কাজ করে সাপ্তাহিক মজুরির ভিত্তিতে, তাদের কি ক্ষতি হয়।” ( লিন্নার্ড হনরি, “রিপোর্টস ফ্যাক্টরিজ”, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫, পৃঃ ৮, ৯)।

৪. “Le salaire peut se mesurer de deux manieres : ou sur la duree du travail, ou sur son produit.”‘ (“Abrege elementaire des principes de l’Economie Politique.” Paris, 1796, p. 32. ) অনামী বইটির লেখক : জি. গার্নিয়ার।

৫. “এতটা ওজন তুলল তাকে (সুতো-কাটুনিকে) দিয়ে দেওয়া হয়, তার বদলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার সূক্ষ্মতা-সম্পন্ন এতটা ওজন সুতো দিতে হয় এবং এই ভাবে সে যা ফিরিয়ে দেয় তার জন্য সে পায় পাউণ্ড-পিছু এত পরিমাণ পারিশ্রমিক। যদি তার কাজে খুৎ থাকে, তা হলে তার জন্য তাকে দণ্ড ভোগ করতে হয়; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ন্যূনতম যতটা করার কথা, তা থেকে কম করলে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং করতে সক্ষম এমন একজনকে সংগ্রহ করা হয়।

৬. ‘যখন কাজটি কয়েকজনের হাতের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, যাদের প্রত্যেকেই নিজের নিজের মুনাফার অংশ নেয়, অথচ কাজ করে কেবল শেষের লোকটিই, তখন মহিলা-কর্মীটির হাতে যে মজুরি গিয়ে পৌছায়, তা শোচনীয় ভাবে বেমানান।” (“শিশু নিয়োগ কমিশন, দ্বিতীয় রিপোর্ট, পৃঃ ৭০ নং ৪২৪)।

৭. এমন কি ধ্বজাধারী ওয়াটস পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, “পিস-ওয়ার্ক ব্যবস্থায় এটা হত একটা বিরাট উন্নতি, যদি একজন লোকের নিজের স্বার্থে বাকিদের উপরে খবরদারি করার বদলে, একটি বিশেষ কাজে নিযুক্ত সকলেই হত চুক্তিটির শরিক, প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী।” (ঐ, পৃঃ ৫৩) এই ব্যবস্থার জঘন্যতা সম্পর্কে দ্রষ্টব্য “শিশু নিয়োগ কমিশন,” তৃতীয় রিপোর্ট পৃঃ ৬৬নং ২২, পৃঃ ১১ নং ১২৪ পৃঃ ১১, নং ১৩, ৫৩, ৫৯ ইত্যাদি ইত্যাদি।

৮. এই স্বতঃস্ফুর্ত ফল-লাভে প্রায়শই আবার কৃত্রিম ভাবে সাহায্য যোগানো হয়, যেমন, লণ্ডনের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে একটা চলতি কৌশল হল এক-এক দল শ্রমিকের প্রধান হিসাবে এমন এক-একজন লোককে বাছাই করা যে-লোকটি অতিরিক্ত দৈহিক শক্তি ও তৎপরতার অধিকারী এবং তাকে এক-চতুর্থাংশ অতিরিক্ত মজুরি দেওয়া যাতে সে নিজে প্রাণপণ পরিশ্রম করে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে। ( ট্রেড ইউনিয়নে) লোকদের বিরুদ্ধে তৎপরতা, কুশলতা-বৃদ্ধি ও কর্মোদ্যম সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করার যে-সব অভিযোগ মালিকেরা করে থাকেন, এ থেকে, বিনা মন্তব্যেই, তার অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।” (ডানিং, ট্রেড ইউনিয়নস অ্যাণ্ড স্ট্রাইকস : দেয়ার ফিলসফি অ্যাণ্ড ইন্টেনশন’, ১৮৬০, পৃঃ ২২-২৩)। যেহেতু লেখক নিজেই একজন শ্রমিক এবং একটি ট্রেড ইউনিয়নের সম্পাদক, তাতে এটা একটু অত্যুক্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পাঠক জে সি মটনের “বহুমান্য” “সাইক্লোপেডিয়া অব অ্যাগ্রিকালচার”-এর অন্তর্ভূক্ত “লেবারার” শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন, যেখানে এই পদ্ধতিটির সুপারিশ করা হয়েছে।

৯. যারা সকলে ‘পিস-ওয়ার্ক-এর ভিত্তিতে মজুরি পায়, তারা সকলেই কাজের আইনগত মাত্রার লংঘন থেকে লাভবান হয়। উপরি-সময় কাজ করবার এই ইচ্ছা সম্পর্কিত এই মন্তব্যটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য সেই সব মহিলাদের ক্ষেত্রে যারা নিযুক্ত হয় বোনা বা সুতো গুটি করা কাজে। রিপোর্ট ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫৮, পৃঃ ৯। “এই ব্যবস্থা (পিওয়ার্ক’ ), নিয়োগকর্তার পক্ষে খুবই সুবিধাজনক অল্পবয়সী মৃৎ কর্মী (পটার’) চার-পাচ বছর ধরে যখন নিযুক্ত থাকে ‘পিস’-কাজের ভিত্তিতে কিন্তু সামান্য মজুরিতে, তখন এই ব্যবস্থা দারুণ উপরি-খাটুনি খাটতে তাকে সরাসরি উৎসাহ যোগায়।মৃৎ-কর্মীদের স্বাস্থ্য যে এত খারাপ, এটাকে তার একটা কারণ বলে ধরা উচিত।” (“শিশুনিয়োগ কমিশন”, প্রথম রিপোর্ট, পৃঃ ১৩)।

১০. “যেখানে কোন শিল্পে কাজের জন্য মজুরি দেওয়া হয় ‘পিস’-এর ভিত্তিতে, ‘এতটা কাজের জন্য একটা’-এই ভিত্তিতে সেখানে মজুরির পরিমাণ দারুণভাবে বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু বোজ হিসাবে মজুরির হার মোটামুটি অভিন্ন হয়—যে হারটিকে নিয়োগকর্তা ও নিযুক্ত ব্যক্তি উভয়েই সেই শিল্পের শ্রমিকদের জন্য সাধারণভাবে চালু মান হিসাবে মেনে নেয়।” (ডানিং, ঐ পৃঃ ১৭)।

১১. “Le travail des compagnons-artisans sera regle a la journee ou a la piece… Ces maitres-artisans savent a peu pres combien d’ouvrage un compagnon-artisan peut faire par jour dans chaque metier, et les payent souvent a proportion de l’ouvrage qu ils font; ainsi ces compagnons travaillent autant qu’ils peuvent, pour leur propre interet, sans autre inspection.” (Cantillon. “Essai sur la Nature du Commerce en general,” Amst. Ed., ‘1756, pp. 185, এবং 202). প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হয় ১৭৫৫ সালে; কেনে, জেমস স্টুয়ার্ট, অ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ সকলেই ক্যান্টিন-এর এই বই থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন। এই সংস্করণটিতে ‘পিস’-ভিত্তিক মজুরিকে দেখানো হয়েছে কেবল সময়-ভিত্তিক মজুরিরই একটা রকমফের হিসাবে। ক্যান্টিনের ফরাসী সংস্করণে বলা হয়েছে যে এটা ইংরেজি সংস্করণের অনুবাদ। কিন্তু ইংরেজি সংস্করণটি : লণ্ডন শহরের প্রয়াত সওদাগর ফিলিফ ক্যালিন-এর লেখা “দি অ্যানালিসিস অব ট্রেভ, কমার্স” ইত্যাদি কেবল পরবর্তী তারিখেই নয় (১৭৫৯), তার বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে সেখানা পরবর্তী সময়ের সংশোধিত সংস্করণ; যেমন, ফরাসী সংস্করণে হিউম তখনো উল্লিখিত হননি কিন্তু ইংরেজি সংস্করণে, পেটী ও স্থান পেয়েছেন কদাচিৎ। ইংরেজী সংস্করণটি স্বভাবতই কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাতে ইংল্যাণ্ডের বাণিজ্য বুলিয়ন ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে, যা ফরাসী সংস্করণে নেই। ইংরেজী সংস্করণের নাম-পত্রে লেখা এই কথাগুলি : “অত্যন্ত উদ্ভাবনশীল এক প্রয়াত ব্যক্তির পাণ্ডুলিপি থেকে প্রধানত সংকলিত ও সংশোধিত’ ইত্যাদি”। স্পষ্টতই বিশুদ্ধ কল্পকথা; এই ধরনের ব্যাপার তখন খুব প্রচলিত ছিল।

১২. “Combien de fois n’avons-nous pas yu, dans certains ateliers, embaucher beaucoup plus d’ouvriers que ne le demandait le travail a mettre en main? Souvent dans la prevision d’un travail aleatoire quelquefois meme imaginaire, on admet des ouvriers : comme on les paie aux pieces, on se dit qu’on ne court aucun risque, parce que toutes les partes de temps seront a la charge des inoccupes”. (H. Gregoir : “Les Typographes devant le Tribunal correctionnel de Bruxelles,” Bruxelles, 1855, p. 9.)

১৩. ‘রিমার্কস অন দি কমার্সিয়াল পলিসি অব গ্রেট ব্রিটেন, লণ্ডন, ১৮১৫।

১৪. এ ডিফেন্স অব দি ল্যাওনার্স অ্যান্ড ফার্মার্স অব গ্রেট ব্রিটেন, ১৮১৪,. পৃঃ ৪, ৫।

১৫. ম্যালথাস, ‘ইনকুইরি ইনটু দি নেচর অ্যাণ্ড প্রগ্রেস অব রেন্ট,লন, ১৮১৫।

১৬. “যারা ‘পিস’-ভিত্তিক মজুরিতে কাজ করে তারা সম্ভবতঃ কারখানামিক সংখ্যার পাচ ভাগের চার ভাগ।” (“রিপোর্ট…”ফ্যাক্টরিজ, ৩০ এপ্রিল, ১৮৫৮)।

১৭. ‘সুতো কাটার মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা সঠিকভাবে মাপা হয়, এবং তার উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে, যদিও সম-হারে নয়, কাজের মজুরি হ্রাস পায়। (উরে, ঐ পৃঃ ৩১৭)। এই সর্বশেষ কৈফিয়ৎ-মূলক কথাটি উরে নিজেই আবার খারিজ করে দেন। ‘মিউল’-এর দীর্ঘত-সাধনের দরুন শ্রম কিছুটা বৃদ্ধি পায় বলে তিনি স্বীকার করেন। অধিকন্তু এই বৃদ্ধির ফলে মেশিনের উৎপাদন-ক্ষমতা এক পঞ্চমাংশ বৃদ্ধি বর্ধিত হবে। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন সুতা-কাটুনি আগেকার হারে আর মজুরি পাবে না, কিন্তু সেই হারটি এক-পঞ্চমাংশ হ্রাস পাবে না, উন্নতিটি যে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘণ্টার জন্য তার আর্থিক উপার্জন বাড়িয়ে দেবে, কিন্তু এই পূর্ববর্তী বিবৃতিটির একটা সংশোধন দরকার। কাটুনিকে তার অতিরিক্ত কপর্দক থেকে কিশোর-কল্যাণের জন্য অতিরিক্ত কিছু দিতে হবে, যার সঙ্গে ঘটবে বয়স্কদের একটা অংশের স্থানচ্যুতি’ (ঐ পৃঃ ৩২১), মজুরি বাড়াবার কোনো রকমের ঝোকই যার নেই।

১৯. এইচ ফসেট, “দি ইকনমিক পোজিশন অব দি ব্রিটিশ লেবারার, কেজি অ্যাণ্ড লণ্ডন, ১৮৬৫, পৃঃ : ৭৮।

২০. ১৮৬১ সালের ২৬শে অক্টোবর তারিখে লণ্ডনের স্ট্যাণ্ডাড পত্রিকায় রকডেল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমক্ষে ‘জন ব্রাইট অ্যান্ড কোম্পানী’-র একটি আবেদনের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। ( আবেদনটি হল) “ভীতি প্রদর্শনের অপরাধে কার্পেট উইভার্স ট্রেড ইউনিয়নের এজেন্টদের অভিযুক্ত করবার জন্য। ব্রাইট কোম্পানীর অংশীদারেরা নোতুন মেশিনারি প্রবর্তন করেছে, যা আগে ১৬০ গজ কার্পেট তৈরি করতে যে সময় ও শ্রম লাগত, সেই একই সময় ও শ্রমের দ্বারা ২৪ . গজ কার্পেট উৎপাদন করবে। যান্ত্রিক উন্নতি-সাধনে মালিকের মূলধন-বিনিয়োগ-জনিত মুনাফায় শ্রমিকদের কোনো দাবি নেই। সুতরাং ব্রাইট কোম্পানি গজপ্রতি মজুরির হার ১৫ পেন্স থেকে কমিয়ে ১ পেন্স করবার প্রস্তাব করে—একই শ্রমের জন্য আগে শ্রমিকদের যা উপার্জন হত, ঠিক সেইখানেই তা বজায় রেখে। কিন্তু একটা নামমাত্র হ্রাস ঘটেছে, যে সম্পর্কে শ্রমিকরা বলছে তাদের আগে যথাচিত ভাবে সতর্ক করা হয়নি।” ২১, “মজুরি রক্ষা করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলি উন্নত মেশিনারিজনিত সুবিধার অংশ পেতে চেষ্টা করে (কী ভয়ানক কথা !): শ্রমের সংক্ষেপ সাধন করা হয়েছে বলে উচ্চতর মজুরির দাবি, অন্য ভাবে বললে দাড়ায়, যান্ত্রিক উন্নয়নের উপরে কর আরোপণ।” (“অন কম্বিনেশন অব ট্রেডস” নতুন সংস্করণ, লণ্ডন, ১৮৩৪, পৃঃ ৪২)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *