শ্ৰেষ্ঠ বাঙালি : রবীন্দ্রনাথ বনাম শেখ মুজিব
বছর তিনেক আগে একটি বিশ্ববেতার সম্প্রচার সংস্থা সৰ্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে, তা নিয়ে একটি জরিপ করেছিলো তাদের শ্রোতাদের মধ্যে। কয়েক হাজার শ্রোতা যো-জবাব দিয়েছিলেন, তাতে শ্ৰেষ্ঠ বাঙালি বলে নাম পাওয়া গিয়েছিলো শ দেড়েক ব্যক্তির–মীর জাফর এবং গোলাম আযমের নামও বাদ যায়নি। সুতরাং এ মতামতকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই জরিপের ওপরের দিকে অনেক বিখ্যাত বাঙালির নাম ছিলো; যেমন রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, নজরুল ইসলাম ইত্যাদি। কিন্তু সবার ওপরে নাম ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পরে–দু নম্বরে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শেখ মুজিবের তুলনা দেখে অনেকেই একে এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু প্ৰতিভার বিচারে যেমনই হোক না কেন, বাঙালির ইতিহাসে মুজিব কি রবীন্দ্রনাথের তুলনায় খুব নগণ্য? বিশেষ করে বাঙালিদের যে-ইতিহাস এখন থেকে শত বর্ষ পরে লেখা হবে, তাতে এই গুরুত্ব আজকের তুলনায় কি বৃদ্ধি পাবে না?
আমরা এক কথায় সংস্কৃতি বলে যে-ধারণাটাকে চিহ্নিত করি, তা হলো প্রধানত বৈদগ্ধ্যেরা। এলোমেলোভাবে গলা ওঠা-নামা করে চেচালে, তা থেকে কোলাহল সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু পরিশীলিত পদ্ধতিতে গলার ওঠা-নামা করে শব্দ বের করলে তা সঙ্গীতে পরিণত হয়। তেমনি তালে-তালে পরিশীলিতভাবে অঙ্গভঙ্গি করলে তা নাচে পরিণত হতে পারে। পেট ভরানোর জন্যে যা-তা রান্না করে হাপুসাহুপুস করে খেলে সেটা যা-ই হোক, রন্ধন এবং খাদ্য পরিবেশনাও শিল্পিত হতে পারে। মোট কথা, বিদগ্ধতাকেই আমরা অনেক সময়ে সংস্কৃতির সঙ্গে অভিন্ন করে দেখি। কিন্তু বৈদগ্ধ্যবর্জিত রাজনীতি সংস্কৃতির চেহারা আমূল বদলে দিতে পারে এবং তা পারে তুলনামূলকভাবে কম সময়ের মধ্যে। আমরা যাকে বাঙালি সংস্কৃতি বলি তার একটা প্রধান এলাকাই জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ— বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিক্ষা, রুচি ইত্যাদি বহু বিষয়ে। কেবল তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অবদানে এসব জিনিশকে এমন একটা উৎকর্ষ দিয়েছেন, যা তাঁর আগেকার অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা এখন তার ভাষায় কথা বলি, লিখি। অজানতেই তাঁর গান, তার কবিতা আমাদের মন এবং হৃদয়কে আলোকিত এবং মার্জিত করে। সেখানে শেখ মুজিবের কোনো অবদান নেই। এমন কি, তিনি নিজে রাবীন্দ্রিক বৈদগ্ধ্য কতোটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন, সেও প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু এখন বাঙালি সংস্কৃতি যো-পথে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে শেখ মুজিব জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বৈপ্লবিক অবদান রেখেছেন বলে আমার ধারণা!
বাঙালির যে-ইতিহাস এবং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে গত সাত-আট শতাব্দী ধরে, তাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এক ভদ্রলোক, যার নাম আমার পাঠকদের অনেকে হয়তো জানেনও না–শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। আমরা এখন যাকে বঙ্গদেশ বলে জানি, প্রাচীন কালে তা বিভক্ত ছিলো ছোটো ছোটো বেশ কয়েকটি দেশে–গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, বরেন্দ্রী, বঙ্গ, চন্দ্ৰদ্বীপ, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি। এসব দেশের শাসক এক ছিলেন না। এসব দেশ মিলে কোনো একটি অভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিটও ছিলো না। যিনি এদের একত্রিত করে এক অভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনেন অথবা আনার গোড়াপত্তন করেন। তারই নাম শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তাঁর মস্ত অবদান এই যে, তিনি চোদ্দো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসব দেশের বেশির ভাগ জায়গাই জয় করে এগুলোকে একটি মাত্র প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। সবগুলো দেশ এক বঙ্গদেশে পরিণত হয়।
বস্তুত, ইলিয়াস শাহের হাতে একবার একটা অখণ্ড বঙ্গদেশ স্থাপিত হওয়ার পর অখণ্ড বঙ্গীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠারও সম্ভাবনা দেখা দেয়। তার আগে, রবীন্দ্রনাথের মতে, এই দেশগুলোর সংস্কৃতি এক ছিলো না। “বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিলো তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজের মিলও ছিলো না।” কিন্তু এক বঙ্গদেশের আওতায় এসে ধীরে ধীরে একটা বঙ্গীয় পরিচয় গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হলো। সিকান্দার শাহ এবং হোসেন শাহের আমলে এই ভিত্তি আরও মজবুত হয়। এই প্রশাসনিক ইউনিট আরও সমন্বিত হয় মোগল যুগে। তারপর কয়েক শতাব্দী ধরে আমরা আঞ্চলিক পরিচয় কাটিয়ে বাঙালি হয়ে উঠি। ষোড়শ শতকে মুকুন্দরাম যাকে “বাঙাল’ বলেছিলেন, ভারতচন্দ্র সে পরিচয়কে আরও সম্প্রসারিত করে বঙ্গের তাবৎ অধিবাসীকে ‘বাঙ্গালী” বলে চিহ্নিত করেন, কারণ গোটা এলাকাই সুবোহ বাঙ্গালায় পরিণত হয়েছিলো।
তা ছাড়া, বাংলা ভাষাও রীতিমতো বাংলা হয়ে ওঠে আলোচ্য সময়ে। মনে রাখা দরকার, চর্যাপদের ভাষা খাটি বাংলা ছিলো না। তা ছিলো বাংলা, ওড়িয়া এবং অহমিয়ার জননী। শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তনের রচনাকাল এবং চর্যাপদের সঙ্গে তার ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্যের পরিমাণ বিবেচনা করলে বলতে হয় বাংলা ভাষা তার নিজের বৈশিষ্ট্য লাভ করতে শুরু করে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী থেকে। তারপর সেই বিবর্তিত ভাষাতেই শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হয়, মনে হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে। কিন্তু বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তখনো একটা অখণ্ড ভাষিক পরিচয় গড়ে উঠেছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আঠারো শতকের আগে পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের ভাষা “বাঙ্গালা” নামে পরিচিত হয়নি। এলাকা এবং ভাষা উভয় দিয়ে একটা অভিন্ন বঙ্গীয় পরিচয় গড়ে ওঠে কয়েক শতাব্দী ধরে। ভারতচন্দ্ৰ নিজেকে বাঙ্গালী বলেছিলেন বঙ্গের অধিবাসী হিশেবে। কিন্তু তাঁর দেড় শো বছর পরে রবীন্দ্রনাথের কাছে বাঙালির প্রধান ঐক্য মনে হয়েছে আঞ্চলিক নয়, ভাষিক ঐক্য। “এর মধ্যে এক ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।” অর্থাৎ বাঙালি সংস্কৃতিতে যেসব অভিন্ন উপাদান আছে, রবীন্দ্রনাথের মতে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলা ভাষা। সে কারণে যখন থেকে বাংলা ভাষার উন্মেষ, তখন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা।
ভৌগোলিক অনৈক্য ছাড়াও, বাঙালি সমাজের সবচেয়ে বড়ো বিভেদ হলো: এ সমাজ বহু কোঠায় বিভক্ত, জল-অচল কোঠায়। বহু প্ৰাচীর গড়ে উঠে এই সমাজকে ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত করেছে। সবচেয়ে দুর্লজম প্রাচীর হলো ধর্মের। সেনআমলে বৌদ্ধ আর হিন্দুরা পাশাপাশি বাস করতে পারেননি–একীভূত হয়েছিলেন। আবার হিন্দু-মুসলমান বহু শতাব্দী ধরে পাশাপাশি বাস করেও কাছাকাছি আসতে পারেননি। তাদের একত্রে খানাপিনা হয় না; বিয়েতো দূরের কথা। একটা সময়ে ছোয়াছুয়িও ছিলো বিরাট ব্যবধানের কারণ। এক বাংলা ভাষায় কথা বললেও তাদের ভাষায়ও স্বাতন্ত্র্য আছে। জল আর পানি–উভয় এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। কিন্তু হিন্দুরা পানি বললে তাদের জাত যায়; মুসলমানরা জল খেলে তাদের মুসলমানীত্ব চলে যায়। বাংলা ভাষার মতো ‘কুফুরী জবান’ (কাফেরদের ভাষা) তাঁদের মাতৃভাষা কিনা, তা নিয়েও এক শতাব্দী আগে মুসলমানরা বিতর্ক করেছেন। কাগজ-কলম, জামা-মোজা, জমা-খরচের মতো আরবি-ফারসি শব্দ হিন্দুরা ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু সন্তানের আরবি-ফারসি নাম রাখেন না। তবে গ্রামের অশিক্ষিত মুসলমানরা চাঁদ মিঞা, সুরুজ মিঞা, তারা মিঞা, কালা মিঞা, ধলা মিঞা নাম রাখেন। শহরের শিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক মুসলমানরাও তাদের বৈদগ্ধ্য প্রমাণ করার জন্যে নাম রাখেন। বাংলায়। কিন্তু তবু তাদের ভেদ ঘোচে না। জ্ঞাতে-জ্ঞাতে ধর্মীয় পরিচয় তাদের ভূতে পাওয়ার মতো সারাক্ষণ অধিকার করে থাকে। তেমন অবস্থা হলেই ভদ্র পোশাকের আড়াল থেকে ধর্মের লেজটা বেরিয়ে পড়ে।
দেবতাহীন ধর্মে বিশ্বাসী বাউলরা আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় পরিচয় অস্বীকার করে মনুষ্য পরিচয়কেই বড়ো করে তুলে ধরেছিলেন। ‘আমার পথ ঢাইকাছে মসজিদে মন্দিরে’ বলে মদন বাউল গান গেয়েছেন। লালন ফকির জাতের ভিন্নতা দেখতে পাননি। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে এঁদের প্রভাব পড়েনি। যাঁরা সাহিত্য-সৃষ্টি করে সমাজের আরও বৃহত্তর, পরিধিতে পৌঁছতে পেরেছিলেন, যেমন ধরা যাক, বঙ্কিমচন্দ্র, তারা আবার ধর্মের উর্ধে উঠতে পারেননি। যিনি নিজের বিচিত্ৰ সৃষ্টি দিয়ে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক পরিবেশ রচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্ৰনাথ। নজরুল ইসলামও খানিকটা। সে দিক দিয়ে সময়ের বিচারে বাঙালিত্বের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহ যেমাইলফলক তৈরি করেছিলেন, তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক রবীন্দ্রনাথ। তাদের অবদান ভিন্ন ধরনের। কাজেই সেই অবদানের কোনো তুলনা চলে না। ‘শাহে বাঙ্গালিয়ান’ অর্থাৎ বাঙালিদের শাহ উপাধি গ্রহণ করে ইলিয়াস শাহ নিজেকে গৌরবান্বিত করেছিলেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদের বিদগ্ধ রুচির মানুষে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টি দিয়ে, বস্তুত, বাঙালিকেই গৌরবান্বিত করেছিলেন তিনি। ইলিয়াস শাহ ভারতবর্ষে বাঙালিদের একটা স্বাধীন দেশের অধিবাসীতে পরিণত করেছিলেন। অপর পক্ষে, স্বাধীনতা দিতে না-পারলেও রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদের বিশ্বের কাছে একটা স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছিলেন। নজরুল ইসলামও সাম্প্রদায়িকতার সীমানা লঙ্ঘন করে মানুষকে মানুষ হিশেবে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। মদন বাউলের মতো তিনিও বলেছিলেন যে, দাঙার পরে মসজিদ-মন্দির টিকে থাকলো, কিন্তু মানুষ থাকলো না। তিনিও বলেছিলেন যে, মানুষের জন্যে ধর্ম, মানুষ ধর্মের জন্যে নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ঈশ্বরের কথা না-বলে, যিশু, কৃষ্ণ, মোহাম্মদ-প্রবর্তিত দৈবিক এবং আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, যদিও বিশেষ কোনো ধর্মকে তিনি অন্য ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেননি।
অল্পকাল আগে বাঙালি সংস্কৃতির একটি ইতিহাস লিখে তারপর তার নির্ঘণ্ট তৈরি করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ছিয়াশিটি পৃষ্ঠায়; আর শেখ মুজিব সম্পর্কে চারটি পৃষ্ঠায়। আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত নিঃসন্দেহে, তবে অন্ধভক্ত নই; কেবল তাই নয়, যারা অন্ধভক্ত তাদের আমি অপছন্দ করি। গুরুগিরিতে আমার বিশ্বাস নেই। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের কথা আমি বাড়িয়ে লিখিনি। এ ইতিহাসে তাঁর যতোটুকু কৃতিত্ব প্রাপ্য, আমি তার বেশি দিইনি বলেই মনে করি। তা সত্ত্বেও ংলা ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সঙ্গীত, মননশীলতা, ইতিহাস, নাটক, থিয়েটার, সিনেমা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্য, নারী ইত্যাদি বিষয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা বারবার আসতেই পারে। আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে রবীন্দ্রবিশ্বেই বাস করি। তা ছাড়া, আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার—রবীন্দ্রনাথ কেবল বঙ্গদেশে অথবা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা নন। তিনি বিশ্বেরই চিরকালের একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি। ধরা যাক, দা ভিঞ্চি। অসাধারণ প্ৰতিভার অধিকারী ছিলেন। বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো এতো বৈচিত্র তাঁর প্রতিভাতেও ছিলো না। রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে কবি, নাট্যকার ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্প লেখক, গীতিকার, সরকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী—কী না! কাজেই প্রতিভার মানে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
অপর পক্ষে, শেখ মুজিব ছিলেন একজন জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী রাজনীতিক। যখন তিনি হয়তো দেশকে আরও দিতে পারতেন, তার আগেই আততায়ীরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। সুতরাং তাঁর নাম আর কতোবারই আসবে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পৌনঃপুনিক উল্লেখ আর মুজিবের সীমিত উল্লেখ থেকে বাঙালির ইতিহাসে তাদের প্রভাবের পরিমাপ করা বোধ হয় সম্ভব নয়। অর্থাৎ মুজিবের প্রভাব এবং অবদান রবীন্দ্রনাথের ছিয়াশি ভাগের চার ভাগ নয়। বাঙালির ইতিহাসে তাঁর স্থান তার থেকে অনেক ওপরে, অনেক বেশি। তিনি বাঙালিদের চিরস্থায়ীভাবে একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন। কেবল তাই নয়, তিনি যে-দেশ তৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিত্বের বিকাশের সম্ভবনাও অনেক বেশি ছিলো। পিতা সাধারণত সন্তানের একটা নাম দিয়ে সেই নামের মধ্য দিয়ে একটা প্ৰত্যাশা ব্যক্ত করেন। এক সময়ে বৃহত্তর বঙ্গদেশের জনপ্রিয় নাম ছিলো বাংলাদেশ। শেখ মুজিব তাঁর স্বপ্নে দেশকে ভালোবেসে সেই পুরোনো বাংলাদেশ নামটাই দিয়েছিলেন। সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথেরই একটি গান–আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। অনেক সময়ে তিনি বক্তৃতায় বলতেন “আমি তোমায় খুবই ভালোবাসি।” এই নামের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রত্যাশার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বাংলাদেশের নাগরিকদের সরকারী নাম তিনি দিয়েছিলেন। “বাঙালি’ ৷ হয়তো তিনি আশা করেছিলেন তাবৎ বাঙালির দেশ হবে এই বাংলাদেশ। সব ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতে পারবেন। এখানে স্বাধীনভাবে। এখানে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে অবাধভাবে।
কিন্তু সন্তানের বাল্যকালে পিতার মৃত্যু হলে সে সন্তান যেমন অনেক সময়ে অভীষ্ট পথে যায় না, অথবা যেতে পারে না, শেখ মুজিবের স্বপ্নে-দেখা বাংলাদেশও তার প্রত্যাশিত পথে যায়নি। তার জন্যে দায়ী রাজনীতি। তিনি নিজে অসাধারণ জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী রাজনীতিক হলেও, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। অসীম সম্ভাবনা এবং জীবনীশক্তি নিয়ে যে-বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো, অচিরেই তা পাগলা ঘোড়ার মতো তার হাত থেকে ফসকে বেরিয়ে যায়–তিনি তার রাস টেনে ধরতে পারেননি। আসলে তিনি যতো বড়ো নেতা ছিলেন, প্রশাসক হিশেবে ততোটাই অযোগ্য ছিলেন। সে কেবল অভিজ্ঞতার অভাবে নয়, শাসক হবার মতো ক্ষমতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাঁর ছিলো না। সময়টাও তাঁর অনুকুল ছিলো না। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে তিনি আদৌ খাড়া করতে পারেননি। একদিকে, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো ভেঙে পড়েছিলো; অন্যদিকে, শিল্প-বাণিজ্য এবং প্রশাসন চালানোর মতো অভিজ্ঞ লোকের অভাবও ছিলো। তার ওপর দুনীতি ও দলবাজি মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ত্যাগাস্বীকারের স্পিরিটকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছিলো। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ভারতের দাদাগিরির মনোভাবও তাঁর। সহায়তা করেনি। হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের বহু শতাব্দীর অবিশ্বাসও এ সময়ে হাঁ করে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসাকে গিলে ফেলেছিলো। সর্বোপরি, মোশাহেবপরিবেষ্টিত মুজিব মুক্তচিন্তা এবং জনগণ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। ফলে সপরিবারে চরম মূল্য দিতে হয় তাঁকে। কিন্তু তার থেকে বেশি মূল্য দিতে হয় বাঙালিদের। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের যে-সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, তা একেবারে ধূলিসাৎ হয়। ক্ষমতালোভী ফৌজী-শাসকদের হাতে পড়ে এবং পেট্রো-ডলারের কল্যাণে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশই রুদ্ধ হয়নি, সেই সঙ্গে ‘বাঙালি’ পরিচয়ও ধুয়ে-মুছে যায়।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে যে-বাঙালি সংস্কৃতি রচিত হবে, তাতে একই সঙ্গে প্রাধান্য পাবে মুসলমানী এবং পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক উপাদান। স্বাধীন দেশ হিশেবে রাষ্ট্ৰীয় পৃষ্ঠপোষণায় সেই সংস্কৃতিই হবে অনেক জোরালো এবং ভবিষ্যতের মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতি। বাংলা ভাষাও এ প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে বলে আমি মনে করি না। অপর পক্ষে, ভারতের একটি রাজ্যের সংস্কৃতি হিশেবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি দুর্বল থেকে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তাতে প্রাধান্য পাবে হিন্দু উপাদান। তখন ইংল্যান্ডের ইংরেজি এবং মার্কিন ইংরেজির মতো বাংলা ভাষার দুটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হলে অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না।
তার অর্থ শেখ মুজিব নিজে রবীন্দ্ৰভক্ত হলেও ঠিক এক শো বছর আগে বঙ্গভঙ্গের সময়ে রবীন্দ্রনাথ যে-আশঙ্কা প্ৰকাশ করেছিলেন, মুজিব নিজের অজ্ঞাতে তাকেই বাস্তবায়িত করলেন। রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা ছিলো যে, বঙ্গদেশকে মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ এবং হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত করলে কালে-কালে অখণ্ড বাঙালি সংস্কৃতি, এমন কি, বাঙালি পরিচয়ও বিনষ্ট হবে। সেই বাঙালি সংস্কৃতি এবং পরিচয়কে আপাতদৃষ্টিতে রীতিমতো রাষ্ট্ৰীয় ভিত্তি দান করেন শেখ মুজিব। মনে হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবাংলাকে কেন্দ্র করে কালে-কালে অখণ্ড বাঙালিত্ব চিরকালের জন্যে খণ্ডিত হবে মনে হয়। সেদিক দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে শেখ মুজিব কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নন, এমন কি, এক অর্থে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে?
রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রসারিত এবং সমৃদ্ধ করেছিলেন–তাকে উৎকর্ষ দিয়েছিলেন। অপর পক্ষে, শেখ মুজিব যা করেন তার ফলে বাঙালি সংস্কৃতি খণ্ডিত হয় এবং তাঁর অভীষ্ট পথে না-গিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতো বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের স্থায়ী ব্যবস্থা করেন, যদিও কার্যকারণে তা এক ভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি। অদৃষ্টের পরিহাস এ সংস্কৃতি স্বাধীন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেদিকে যাচ্ছে এবং যাবে–তিনি তা কামনা করেননি। কিন্তু তবু তা অবশ্যম্ভাবী। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথের মতো “শ্রেষ্ঠ” না-হলেও, কম গুরুত্বপূর্ণ নন।
(দৈনিক স্টেটসম্যান, ২০০৫)