একবিংশ পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
‘শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার লোকের ঠিক অভাব ছিল না। রাঘব ঘোষালের ছেলে, দুই জামাই– হরিনাথ আর অভয়পদ এবং হেম। রাঘব ঘোষাল নিজেও আছেন। তবু কান্নার শব্দ পেয়ে পাড়ার অনেকইে এলেন। পাড়াটা কায়স্থ-প্রধান হলেও, দু’একটি ব্রাহ্মণ ছেলেও পাওয়া গেল। তারা নিজেরাই এসে সঙ্গে যেতে চাইল। এ পাড়ায় দীর্ঘদিন আছেন রাসমণি, ভোরভেলা তাঁর সদ্যগঙ্গাস্নাত তসরের থানপরা মূর্তি এ পাড়ায় অনেকেরই পরিচিত। চিরদিন দূর থেকে দেখলেই সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। এই নির্বিরোধী আত্মসম্ভ্রমসম্পন্না মহিলাকে সকলেই মনে মনে শ্রদ্ধা করতেন। সুতরাং তাঁর মৃত্যুতে অনেকেই আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন।
সাদিক মিয়া আজও বেঁচে আছেন। যদিও গত দুতিন বছর ধরে তাঁর স্মৃতিটা গেছে। কাউকে চিনতে পারেন না, কিছু বুঝতেও পারেন না। কিন্তু কি জানি কেন আজ এ বাড়িতে কান্নার রোল শুনে হঠাৎ কি ভেবে হাউ হাউ ক’রে কেঁদে উঠলেন– ‘নিশ্চয়ই আমার মেয়ে মারা গেল! আমার মেয়ে। আমাকে নিয়ে চল তোরা, আমি একবার শেষ দেখা দেখি।’
উমা একবার মাত্র কেঁদে উঠেছিল–মৃত্যুটা নিশ্চিত জানবার সঙ্গে সঙ্গেই। তারপর আর কাঁদেনি– বটে, মাথাও তোলে নি। সেই যে মাকে আঁকড়ে ধরে তাঁর বুকে মুখ গুঁজে পড়েছিল, আর তার মধ্যে কোন প্রাণলক্ষণ দেখা যায় নি। তার সেই কঠিন বন্ধনের মধ্যে থেকে রাসমণির মৃতদেহ উদ্ধার করবার প্রস্তাবে অনেকেরই মুখ শুকিয়ে উঠল।
কেবল বিচলিত হল না অভয়পদ; সে এতক্ষণ নির্লিপ্ত এবং উদাসীনভাবে একদিকে সরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে এল এবং পাশে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে ডাকলে, ‘মাসিমা!’
উমার দেহটা শুধু বারেক শিউরে উঠল—- আর কোন প্রা পন্দনই জাগল না সে
অনড় দেহে।
শাশুড়ীকে প্রণাম করা ছাড়া ছোঁয়ার রেওয়াজ নেই। অভয়পদও সামান্য একটু ইতস্তত করলে, তারপর হেঁট হয়ে উমার পায়ে হাত দিয়ে একটু নাড়া দিয়ে বললে,
‘মাসিমা, এবার আপনাকে সরতে হবে যে। আপনি ত সবই জানেন, আর ত ধরে রাখার উপায় নেই। ‘
উমা এইবার মাথা তুলল। কেমন একরকম বিহ্বল হয়ে চাইল চারিদিক– তারপর কেউ কিছু বোঝাবার আগেই অকস্মাৎ রাসমণির পায়ের কাছে মেঝেতে মাথা খুঁড়তে লাগল, সবেগে ও সজোরে।
এক লহমা–চকিতে ওর মাথাটা ধরে ফেললে অভয়পদ। দৃঢ় কণ্ঠে বললে, ‘ছিঃ, মাসিমা! আপনি বুদ্ধিমতী– এমন অবুঝ হলে চলে?’
ততক্ষণে কমলাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সে এসে জোর করে উমাকে টেনে নিলে বুকে। এইবার উমার বাঁধ ভাঙল। আবারও হাহাকার করে কেঁদে উঠল সে।
অভয়পদ ইঙ্গিত করলে বাকী সকলকে। মৃতদেহ সরাবার এই সুযোগ। রাঘব ঘোষাল কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘বড়দি, তোমাকেও ত যেতে হয়! মুখাগ্নি করবে কে?
কমলা যেন চমকে উঠল, ‘আমাকেই যেতে হবে? অন্য উপায় নেই?’
‘সন্তান থাকতে–! আচ্ছা গোবিন্দই চলুক। ওর কাছ থেকে নুড়োটা নিয়ে নিও শ্রাদ্ধের দিন।’
শবযাত্রীদের হরিধ্বনি গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতেই সহসা যেন তন্দ্রা ভাঙল উমার। সে একেবারে দাঁড়িয়ে উঠল।
কমলা একটু ভয় পেয়েই ডাকলে, উমা?’
সহজ কণ্ঠে উমা উত্তর দিলে, ‘আমি শ্মশানে যাবো দিদি।
‘না না, তোকে যেতে হবে না। গোবিন্দ ত গেছে।’
‘আমি ঠিক ফিরে আসব। আমার জন্য ভেবো না। এখানে বসে বসে
সে আমি পারব না। আমাকে ছেড়ে দাও —
না দিদি,
তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে সে নেমে এল একতলায়, এবং কমলা বা শ্যামা কোন বাঁধা দেবার আগেই রাস্তায় পড়ে হাঁটতে শুরু করলে। কমলা ব্যাকুল হয়ে বললে,
ওরে–অ গিরির মা, যাও যাও ভাই একটু সঙ্গে! এ আবার কী হল–’
গিরির মা ছুটেই বেরিয়ে গেল। কিন্তু একটু পরে ফিরে এসে বললে, ‘কাউকে যেতে হবে না বড়দি। যার জিনিস সে-ই সঙ্গে আছে।’
‘সে আবার কে রে? কার কথা বলছিস্?’
‘ছোট জামাইবাবু। তিনি যেন তৈরি হয়েই বাইরে দাঁড়িয়ে ছেল। তিনিই সঙ্গে যাচ্ছে।’ শরৎ অবশ্য তৈরি হয়ে আসে নি, নিজের কাজে বড় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ হরিধ্বনি শুনে চমকে চেয়ে দেখতেই নজরে পড়ল রাঘব ঘোষালকে, গোবিন্দকেও চিনতে পারলে সে।… বুঝতে দেরি হল না শবদেহটা কার। মিনিটখানেক সে সেইখানেই দাঁড়িয়ে ইতস্তত করলে। এখন এতদিন পরে এই সময়ে গিয়ে দাঁড়াতে তার লজ্জাই করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লজ্জার চেয়ে কর্তব্যবোধই প্রবল হয়ে উঠল– এবং এটাও বুঝতে পারলে যে প্রয়োজনটা তার শ্মশানের চেয়ে বাড়িতেই বেশি।
কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে হল না, তার আগেই বেরিয়ে এল উমা। শরতের সামনাসামনি পড়ে মুখ তুলে তাকালেও একবার উদাস বিহ্বল দৃষ্টিতে, তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল নিমতলার রাস্তা ধরে। স্বামীকে সে চিনতে পারলে কিনা, তা কিছুই বোঝা গেল না ওর মুখ দেখে।
শরৎ বিপন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুকাল। উমাকে ডাকবে কিনা তাও বুঝতে পারলে না। অথচ উমা বেশ দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। শেষে সেও উমাকেই অনুসরণ করলে।
শ্মশানে যতক্ষণ চিতা জ্বলল– উমা সেদিকে চেয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। শরৎ তার পিছনে দাঁড়িয়েছিল, খানিক পরে রাঘব ঘোষাল চিনতে পেরে এগিয়ে এসে আলাপ করলে, অন্য জমাইদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলে। অগত্যা শরৎকে ওদের কাছে গিয়েও দাঁড়াতে হয় খানিকটা। তবে সে বেশিক্ষণ নয়– একটু পরেই ফিরে সে উমার কাছেই এসে দাঁড়াল।
হয়ত সে কিছু সান্ত্বনার কথাই বলতে চেয়েছিল। হয়ত তার মনে হয়েছিল যে ওর হাত দুটো ধরে কিছু আশা ও ভরসার কথা শোনানো এ সময়ে তার উচিত। কিন্তু আজ এতকাল পরে সে প্রয়াস নিষ্ঠুর পরিহাসের মত শোনাবে বলেই বোধ হয় সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার গৌর ললাটে বার বার লজ্জার রক্তোচ্ছ্বাস ফুটে উঠলেও কণ্ঠ ভেদ করে কোন স্বর বেরোল না।
অবশেষে একসময় চিতা নিভল। রাসমণির শেষ চিহ্নটুকুও ভস্মাবশেষে পরিণত হল। চিতার আগুন নিভিয়ে একে একে সকলে গিয়ে নামল গঙ্গায়।
এইবার প্রথম মুখ খুলল শরৎ। মাথাটা নামিয়ে উমার মাথার কাছে এনে বললে, ‘তোমাকেও ত চান করতে হয় এবার!’
গঙ্গার অপর পারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বসেছিল উমা। সে চমকে উঠল না। কোন চাঞ্চল্যও দেখালে না। সহজ অকম্পিত কণ্ঠে বললে, ‘যাচ্ছি।’
>
উমার জন্য কেউ কাপড় আনে নি। উমারও সে কথা মনে ছিল না। এক বস্ত্রেই সে চলে এসেছে। সে জলে নামতে শরতেরই মনে পড়ল কথাটা। ছুটে গিয়ে সামনের একটা দোকান থেকে একখানা কোরা লালপাড় শাড়ি কিনে নিয়ে এল।
শাড়িখানা স্বামীর হাত থেকে সহজেই নিলে উমা। তার সে শোক-স্তম্ভিত পাষাণের মত মুখে কোন ভাবাবেগই ফুটল না, যেন এইটেই সে আশা করছিল।
ফেরার পথে পুরুষরা ইচ্ছে করেই এগিয়ে গেল। উমা যাওয়ার সময় যত জোরে গিয়েছিল, ফেরার সময় ঠিক তেমনিই যেন আস্তে হাঁটছে। কোন দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই, সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে কোন রকমে যেন শান্ত দুটি পা ফেলে এগিয়ে
চলেছে সে।
শরৎ তার পাশে পাশে তেমনি আস্তে আস্তে চলল। একেবারে বাড়ির দরজা পর্যন্ত। ততক্ষণে অগ্রগামীরা স্তব্ধ হয়ে ভেতরে চলে গেছে। ভেতরে আবার নতুন করে উঠেছে ক্রন্দনের কলরোল
উমা একেবারে দরজার বাইরে এসে একবার থমে
এসে
২৩৩
কাঠের আগুন জ্বলছে এক কোণে। লোহা, নিমপাতা ও মটর ডাল ছড়ানো। যন্ত্রচালিতের মত উমা নিয়ম কর্মগুলো সেরে নিল।
আরও কয়েক মুহূর্ত সেই ধূমায়িত কাঠটার দিকে চেয়ে চুপে করে দাঁড়িয়ে রইল সে। চোখ দুটো তার ঈষৎ লাল– এ ছাড়া সমস্ত মুখে শোকের আর কোন চিহ্নই নেই। একটা ধূসর বর্ণহীনতা তার শুধু দেহে নয়– যেন সারা মনকেও আচ্ছন্ন
করেছে।
শরৎ আর একটু কাছে এসে দাঁড়াল। খুব আস্তে আস্তে বললে, ‘আমাকে কিছু বলবে?’
এই প্রথম– একটা শিহরণ দেখা দিল উমার দেহে। সেটা শরত্ত অনুভব করলে পাশ থেকে।
কোন উত্তর দিলে না উমা। তেমনি ভাবেই আরও মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে থেকে নিঃশব্দে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
আকস্মিক আঘাত পেলে মুখের যেমন অবস্থা হয়, শরতের মুখখানাও নিমেষে তেমনি হয়ে উঠল। কিন্তু সে কোন ক্ষোভ প্রকাশ করলে না, শুধু নতমুখে সেইখানেই আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক সময় বাড়ির পথ ধরলে।
দুই
শ্রাদ্ধ পর্যন্ত কোনমতে ঠেকিয়ে রাখলেও, সব চেয়ে বড় প্রশ্নটাকে আর কিছুতেই এড়ানো গেল না। এবারে সে তার বীভৎস চেহারাটা নিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। এত বড় বাড়ি এবং দিনরাতের ঝি, এ দুটোর কোন বিলাসই আর তাদের চলবে না। কমলা ও উমার যা মিলিত মাসিক আয়, তাতে এভাবে তাদের এক সপ্তাহও
চলবার কথা নয়।
শ্রাদ্ধের দিন হঠাৎ নরেন এসে পড়েছিল কোথা থেকে। বোধ হয় পদ্মগ্রামে গিয়ে খবর পেয়েই এখানে এসেছিল। আহারে বসে সামনে কলাপাতায় রাশিকৃত লুচি দেখে মনটা অকস্মাৎ উদার হয়ে উঠেছিল নরেনের, আসনে দাঁড়িয়েই হাত নেড়ে বলেছিল, ‘না দিদি, লোকে বলে যজ্ঞির ভাত, কলার পাত আর মায়ের হাত। তা যজ্ঞির ভাত না হয় লুচি, আরও ভালো কথা–কলার পাত ত আছেই, মায়ের হাত না হোক, বড় শালী– ও মায়েরই সমান ধরো। আমোদ করেই আজ খাবার কথা। ভাবছি। শাশুড়ী মাগীত গেল– এখন তোমরা দাঁড়াও কোথা!
ম্লান মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল কমলার। বলেছিল, ‘তুমি খেতে বসো ভাই। তবু ভাল যে একজনও আছে আমাদের কথা ভাববার!’
আসনে বসে বিনা আচমনেই প্রকান্ড একখানা লুচি আস্ত মুখে পুরে প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে বললে নরেন, ‘ভাবব না! বলো কি? এ ত আমাদের কর্তব্য। বলি পর ত আর নই। কি বলব, মরমে মরে রয়েছি পয়সার অভাবে, নইলে কর্তব্য কাজ কি আর জানি না? কত বড় বংশ আমাদের!
GRO 208
পিছন থেকে অস্ফুট অর্ধস্বগতোক্তি শোনা গেল, ‘মুখে আগুন তোমার আর তোমার বংশের!’
নিমেষে জ্বলে উঠল নরেন, ‘শুনলেন, শুনলেন দিদি ও-মাগীর কথাগুলো! বলি আজ আমার এ অবস্থা হল কেন? ঐ মাগী আর ওর শুয়োরের পাল ছেলেমেয়ে নিয়েই ত আমার এই হাল! নইলে আমার ভাবনা কি? রোজগার কি কম করি? কী করব– বাইরে বাইরে সব উড়ে যায়। ঘরে সুখ থাকলে ত ঘরে ফিরব– ওদের জ্বালায় আমার বাইরে বাইরেই ঘুরে বেড়াতে হয়।’
আর একখানা লুচি খানিকটা কুমড়োর ডালনা মুখে পুরে নরেন একটু শান্ত হল। অপেক্ষাকৃত নিম্নকণ্ঠে বলল, ‘না দিদি, অনেক ভেবে দেখলুম এত বড় বাড়ি ত কোনমতেই রাখা চলবে না। ভাড়া টানবেন কোথা থেকে? তার চেয়ে এই পাশেই ত বস্তি রয়েছে, ওখানে একখানা খোলার ঘর-টর পাওয়া যায় না! দেখুন না খোঁজ করে। ভাড়াও কম হয়–আর ওখানে গেলে ঝিও লাগবে না। নিজেরাই হাতাপিতি করে কাজকর্ম সেরে নিতে পারবেন। কী বলেন, তাই ভাল না?’
‘বস্তি! আমরা বস্তিতে যাবো?’ স্তম্ভিত ভাবে অর্থহীন প্রশ্ন করে কমলা।
‘কি করবেন বলুন? যা কপাল! নইলে দাদাই বা যাবেন কেন আর উমিটারই বা অমন হবে কেন?’ বেশ নিশ্চিত সুরে উত্তর দেয় নরেন।
শ্যামা আর সহ্য করতে পারলে না। এগিয়ে এসে বললে, খৈতে হয় ত ছাইপিন্ডি মুখ বুজে খাও, নইলে উঠে চলে যাও। আমাদের বংশের কাউকে দরদ দেখাতে এসো না চামার কোথাকার! কথাগুলো মুখে আনতে একটু বাধল না?’
‘ঐ লাও!’ ছানার ডালনায় আলুটা ভেঙে লুচি দিয়ে জড়াতে জড়াতে উত্তর দিলে নরেন, যার জন্যে চুরি করি সে-ই বলে চোর! আমি খারাপটা বললুম কি? বলি যত্র আয় তত্র ব্যয় ত করতে হবে। শান্তরেই এ কথা লেখা আছে যে।’
‘পোড়া কপাল আমার, শান্তরের কথা তোমার কাছে শুনতে হবে! চুপ করে খাও দিকি, নইলে ঐ পাত টেনে ফেলে দেব আঁস্তাকুড়ে!’
‘থাম্ মাগী! মেলা ফ্যাচফ্যাচ্ করিস্ নি।’ বললে নরেন কিন্তু কণ্ঠে আর তেমন জোর ফুটল না। সে আশ্চর্যরকম শান্তভাবে আহারে মন দিলে।
‘এটা কি আনারসের চাটনী? দিব্যি হয়েছে ত! ও দিদি, আর একটু দিতে বলো। ল্যাংড়া আম আছে ত? গোটা তিন-চার বাছো ভাল দেখে–’
সমস্ত কাজ সেরে ছাদে এসে বসল তিন বোন। গভীর রাত, মল্লিকদের বাগানে সারস ডেকে থেমেছে এইমাত্র। প্রহরে প্রহরে ডাকে ওরা। রাত বারোটার কম হবে না। তবু সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরও ওদের চোখে যেন ঘুম নেই।
কিছুক্ষণ ঝিরঝিরে হাওয়ায় বসে থাকবার পর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কমলা বলে, ‘কানে যতই লাগুক শ্যামা, নরেন জামাই কথাটা তুলেছে ঠিকই। এ বাড়ি আমাদের এই মাসেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এ মাসের ভাড়াটা কোথা থেকে টানব তাই ত ভাবছি!’
‘কিন্তু তাই বলে সত্যিই ত আর খোলার ঘরে গিয়ে থাকতে পারবে না দিদি! এমনি ভদ্দরলোকের বাড়ি দেখে দুখানা ঘর ভাড়া করতে হবে।’
২৩৫
‘তাই ত ভাবছি, এত জিনিস কোথায় ধরবে– এই এক ভাবনা।
‘তা জিনিস বলো ত–’ একটু খানি ঢোক গিলে শ্যামা বলে, ‘কিছু কিছু আমার ওখানে নিয়ে গিয়েও রাখতে পারি। আবার যখন গোবিন্দ বড় হয়ে বাড়িঘর করবে তখন না হয় ফিরিয়ে নিও।’
‘তা সেটা মন্দ বলিস নি? উমা কি বলিস?’
ছোড়দিরও ত একখানা ঘর দিদি! আর সেও পরের বাড়ি। তা ছাড়া এখান থেকে নিয়ে যাওয়াই কি সোজা?’ আস্তে আস্তে উত্তর দেয় উমা।
‘না না, সে আমি নিয়ে যাবো এখন– যেমন ক’রে হোক! না হয় একখনা ঘোড়ারগাড়ি-টাড়ি ক’রে
এবার উমার কণ্ঠে আর একটু দৃঢ়তা দেখা দেয়, ‘না দিদি, জিনিসগুলো ছিল মায়ের প্রাণ। তিনি যা বলে গেছেন তার নড়চড় করতে পারবো না। ছোড়দিকে দেবার ইচ্ছে থাকলে তিনিই দিয়ে যেতেন।… আমরা যদি নিজেরা মাথা গুঁজে কোথাও থাকতে পারি ত ওগুলোর ব্যবস্থাও হবে।’
বাতাস অস্বাচ্ছন্দ্যকর হয়ে উঠছে দেখে কমলা অন্য প্রসঙ্গ পাড়ে, ‘শরৎ জমাই আজও এসেছিলেন উমি। বেলা চারটে নাগাদ এসে একটু মিষ্টি মুখে দিয়েই চলে গেলেন।
উমা ক্লান্ত কণ্ঠে বরলে, ‘জানি।’
তারপর একটু চুপ করে থেকে আবারও বললে, ‘কেন অকারণ টানাহেঁচড়া করছ দিদি!’
‘না, তা নয়–’ অপ্রস্তত কণ্ঠে বলে কমলা, ‘সেদিন শ্মশানে গিয়েছিল, আমাদেরও ত একটা কর্তব্য আছে। তাই হেমকে পাঠিয়েছিলাম ওর ছাপাখানায় নেমন্তন্ন করতে। তোর ঘাটের কাপড় অবিশ্যি ও আগেই পাঠিয়েছে!’
উমা উত্তর দিলে না। পুবের আকাশে মেঘ জমছে একটু একটু করে সেদিকে চেয়ে বসে রইল সে।
কমলা খানিকটা চুপ ক’রে থেকে বললে, ‘শরৎ জামাইকে বলছিলুম, খান দুই ঘর দেখে দেবার কথা। অভাবে একটা বড় ঘর-
বোধ করি উমার কাছ থেকে কোন সাগ্রহ প্রশ্ন আশা ক’রেই মাঝপথে থেমে গেল কমলা। কিন্তু উমা তেমনই বসে রইল। শ্যামাই বরং প্রশ্ন করলে, ‘তা কি জবাব দিলে সে?’
‘বলেছে তা দেখে দেবে। সন্ধানে আছে বুঝি কোথায়– কালই খবর পাঠাবে।’
‘তোমাদের দেখবে কে?’ বেশ কিছুক্ষণ অখন্ড নীরবতার পর শ্যামা প্রশ্ন করে। ‘ভগবান!’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় কমলা।
তিন
শরৎ পরের দিন সত্যিই খবর পাঠালে। বর আছে ব্রাহ্মণ পরিবারের মধ্যে, একতলায় দুখানা ঘর—দুখানা নামেই অবশ্য, দেড়খানাই বলা উচিত সাত টাকা
২৩৬
ভাড়া। এ ভাড়াও ওদের দেওয়া কষ্টকর। কিন্তু উপায়ই বা কি? এত জিনিসপত্র ধরে কোথায়? তবু ঠিক করা হয়েছে যে কিছু কিছু ডেয়ো-ঢাকা–যেমন জলচৌকি তক্তপোশ এমনি সব লোক ডেকে বেচে দেওয়া হবে। তৎসত্ত্বেও যা থাকবে– কমলার যা আছে সব জড়িয়ে ঐ দেড়খানা ঘরই গুদাম মনে হবে।
কমলা আর দেরি না করে ঐ ঘরই ঠিক করলে। বাড়িওয়ালাদের পুরুষ কম– মেয়েছেলে বেশি, বৃদ্ধাও আছেন একাধিক, সুতরাং আশ্রয় হিসাবে অনেক নিরাপদ। ঘরগুলো খুব স্বাস্থ্যকর হয়ত না– একতলার ঘর, আলোবাতাসও কম, তবু আর অপেক্ষা করার সময় নেই। সব সময় সুবিধা পাওয়া যখন সম্ভব নয়, তখন যতটা পাওয়া যায় ততটাই ভাল।
এ বাড়িওয়ালাদের বলে দেওয়া হল, ওঁদেরও অগ্রিম দেওয়া হয়ে গেছে। হেম আর অভয়পদ একটা রবিবারে এসে ওদের মালপত্র ও-বাড়ি সরিয়ে দেবে ঠিক হয়েছে। সময় আসন্ন। কিন্তু উমা যেন ক্রমশ পাথর হয়ে যায়। কি এক একান্ত নির্লিপ্ততা ওকে পেয়ে বসে। কেমন যেন অবসন্ন হয়ে পড়ে ওর হাত-পা। যেন এখনও ওর বিশ্বাস হয় না যে এ বাড়ি সত্যিই ছাড়তে হবে।
কমলা একাই সব করে। দীর্ঘদিনের সংসার। শিশি বোতলওলা ডেকে তিন-চার ঝুড়ি শুধু খালি শিশিবোতলই বিক্রি করে সে। পুরনো পাঁজি এক রাশ। এটা-ওটা কত কি তারের ফাইলে—চিঠি গাঁথা। চিঠি আর ভাড়ার রসিদ। কুলুঙ্গিতে কুলুঙ্গিতে জমে রয়েছে দীর্ঘদিনের জীবন-যাত্রার নানা স্মৃতি ও সাক্ষ্য। ভাঁড়ার ঘরের বড় বড় জালা আর কলসীগুলো কোন কাজেই লাগবে না। বেচাও যাবে না। ইদানীং কতকগুলো টিনে ঢাকনা করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে যেতে হবে। ছোট সংসার হ’লেও চাল ডাল ত রাখতেই হবে।
উমা এত বড় বাড়িটায় ঘরে ঘরে উদাসভাবে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটি ছোটখাটো জিনিসও ওর জীবনের সঙ্গে জড়িত। আশৈশব এই বাড়িতে, এই পরিবেশে কেটেছে তার। পরিবেশটা বরং আজন্মই বলা চলে। শ্বশুরবাড়িতে ত গোনা কটা দিন ছিল সে।
ভাঁড়ার ঘুরে ঢুকে ওর দুই চোখ জ্বালা করে জল ভরে আসে। রাসমণি গোছালো মানুষ ছিলেন। সারি সারি ইট সাজানো, তার ওপর নতুন চওড়া তক্তা পাতা। তার ওপর মোটা বিড়েতে সার সার জালা বসানো। জালার ওপর কলসী, কলসীর ওপর হাঁড়ি। এর কোন্টায় কি থাকে তা উমার আজও মুখস্থ। এর প্রতিটি জালা-কলসীর গায়ে আজও রাসমণির হাতের স্পর্শ মাখানো রয়েছে। নিয়মমত ন্যাকড়া দিয়ে এদের গা থেকে ধুলো মুছে নিতেন তিনি।
হাঁ হাঁ করে বাড়িটা। বিদায়ের হাওয়া উঠেছে। জানালা-দেওয়ালগুলো পর্যন্ত যেন করুণ মুখে অদৃশ্য চোখ মেলে চেয়ে আছে। এরা তার কৈশোরের স্বপ্নকল্পনা থেকে শুরু ক’রে যৌবনের চরম ব্যর্থতা– অন্তরের সমস্ত ইতিহাসেরই খবর রাখে। বহু গোপন অশ্রুর সাক্ষী এরা।
་་་་་་་་
গোটা বাড়ি আর পরিষ্কার করা হয় না। অনাবশ্যক বোধেই গিরির মা বৃথা পরিশ্রম করে না। ঘরগুলো ধুলো জঞ্জাল জমে উঠেছে কদিনেই। জানালা দরজা খোলাই থাকে— বাতাসে কপাটগুলো যখন আছড়াতে থাকে, উমার মনে হয় ওরা আর্তনাদ করছে। ময়লা ছেঁড়া কাগজগুলো উড়তে থাকে ঘরের ভেতরেই –ভুতে-পাওয়ার মত আচরণ যেন তাদের। মধ্যে মধ্যে উমা গিয়ে এক-একখানা কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে দেখে। নিতান্তই বাজে কাগজ– তবু এরা কবে কি কারণে এ বাড়ি ঢুকেছিল তা আজও মনে আছে উমার।
অবশেষে একেবারে ছেড়ে যাবার দিনটিও এসে যায়।
সেদিন উমা এক কান্ড ক’রে বসল। ভোরে উঠে নিজেই জল তুলে গোটা বাড়িটা ধুতে মুছতে শুরু করলে। শ্যামা ছুটে এসে বলেলে, ‘এ কী করছিস্ উমি? এ ভুতের ব্যাগার খাটছিস্ কেন? তাও ত গিরির মাকে বললেই হ’ত সে ত আজও আছে।’
‘থাক গে ছোড়দি। আমিই করি– নইলে শান্তি পাব না। যে আমাদের এতকাল আশ্রয় দিলে, তাকে এমনভাবে ছেড়ে যাওয়া ঠিক নয়।
শ্যামা ঠোঁট উলটে বলে, ‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’
,
শ্যামা এ কদিন আর যায় নি। একেবারে এদের নতুন বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে যাবে। তার যে দুঃখ হচ্ছে না তা নয়– হাজার হোক এইটেকেই সে বাপের বাড়ি জেনে এসেছে এতকাল। তাছাড়া এদের সম্বন্ধেও তার মনে একটি ব্যথার সুর আজও বাজে। তবু তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন তাকে নতুন আশা যোগায়।
হেমের একটু উন্নতি হলেই সে বিয়ে দেবে। খোকাটাকে লেখাপড়া শেখাবে। তরুকেও লেখাপড়া শেখাবার ইচ্ছে আছে তার। আজকাল মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার খুব চল হয়েছে, এমন কি তাদের পাড়াগাঁয়েও। স্বদেশী ছেলেরা নাকি উঠে- পড়ে লেগেছে, মেয়েদের জন্য স্কুল করবে।
আবার কখনও বলে, ‘সরকার-গিন্নীকে ধরে একটু জায়গা আমি বাগাবই। তারপর যদি মাটির ঘরও একখানা করতে পারি ত আমাকে পায় কে! মাটির ঘরই বা করতে হবে কেন, হেমের বিয়েতে মোটামুটি টাকা নেব আমি– তাতে পাকা ঘর হবে–’
উমা শোনে। একই মায়ের পেটের দুই বোন। যমজ বোন। একজনের জীবন উজ্জ্বল সার্থকতার দিকে প্রসারিত– আর তার? ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে কোথাও কোন আশা নেই, কোন সফলতার স্বপ্ন দেখ-বার মতও সূত্র একটুখানি নেই। ধূসর অন্ধকার চারিদিকে। জীবনের প্রভাতেই তার মনের আকাশ থেকে সমস্ত সোনালী রঙ মুছে গেল। এক-এক সময় হিংস্র হয়ে উঠতে চায় সে। উন্মত্ত অক্রোশে এই সৃষ্টির সব কিছু লন্ডভন্ড ক’রে জীবনের সমস্ত সুন্দর অস্তিত্বকে নখে চিরে ফেলতে ইচ্ছে করে তার।
খাওয়া-দাওয়ার পরই শ্যামা ছেলেমেয়ে নিয়ে ও-বাড়ি চলে গেল। সে আর হেম এদের ঘরকন্না সাজিয়ে দিয়ে যাবে। অভয়পদ রইল শুধু এদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
উমা যেন পালিয়ে বেড়াতে থাকে। ওর ভাব-ভঙ্গী দেখলে মনে হয় যে, এরা ওকে ধরে নিয়ে যাবে দেখা হলেই সেই ভয়ে সে এদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
গিরির মা বাসন কখানা মেজে দিয়ে একটা বস্তার মধ্যে পুরে দিলে। এই কখানা দুপুরের খাওয়ার বাসন, বালতি আর ঘটি– এই বাকী ছিল। সে আজ সকাল থেকেই কাঁদছে– তার কান্নার বিরাম নেই। বহুদিনের লোক সে। মধ্যে ঠিকে-ঝির কাজ ক’রে বেড়াত কিন্তু এ বাড়ি একেবারে ছাড়ে নি। রাসমণির অসুখের সময় আবার রাতদিনের কাজই ধরেছিল। তাকেও অন্যত্র চাকরি দেখে নিতে হয়েছে। নতুন বাড়িতে দেড় টাকা মাইনেতে ঠিকে-জি হয়েছে, সে শুধু বাসন মেজে দিয়ে যাবে। গিরির মা এখানেই অন্য কোন বাড়িতে রাতদিনের কাজ পেয়েছে– বেপাড়ায় গিয়ে ঠিকেকাজ করতে পারবে না।
অবশেষে একসময় সেও বিদায় নেয়। গলায় কাপড় দিয়ে কমলাকে প্রণাম করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বেগ একটু কমতে বলে, ‘বড়দি, আমাদের ছোড়দিকে
দেখেত পাবো না যাওয়ার সময়?’
একটু ইতস্তত ক’রে কমলা উত্তর দেয়, ‘থাক্ গিরির মা। সে আর সইতে পারছে না। দেখছিস্ না পালিয়ে বেড়াচ্ছে! তুই এখন যা– একদিন যাস্ ও বাড়িতে। দেখে ত এসেছিস্’
‘আচ্ছা’ বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বেরিয়ে যায়। কমলা তাকে নতুন একখানা তসরের থান কিনে দিয়েছে। দীর্ঘকালের মানুষ–মার মতই আগলে নিয়ে ছিল। গোবিন্দ বড় হয়ে চাকরি করুক, ততদিন যদি গিরির মা বেঁচে থাকে ত কাছে এনে রাখবে কমলা। বৃদ্ধ বয়সে কমলাই তাকে দেখবে।
অভয়পদ এসে বলে, ‘বড় মাসিমা, গাড়ি ডাকতে যাই?’
চোখ মুছে কমলা উত্তর দেয়, ‘যাও বাবা।’
কিন্তু উমাই বা গেল কোথা?
কমলা ওপরে উঠে এঘর ওঘর খুজঁতে লাগল। খালি ঘরগুলো ঢা ঢা করছে। কেমন যেন ভয়-ভয় করে। কমলা একবার নাম ধরে ডাকলেও; কিন্তু সাড়া পেলে না। কমলা উদ্বিগ্ন হয়ে তেতলার ছাদে উঠে গেল তাড়াতাড়ি।
ছাদের যে কোণটা থেকে বড় রাস্তার খানিকটা অংশ দেখা যায় সেই কোণে আলসের উপর উপুড় হয়ে পড়ে বড় রাস্তার দিকে চেয়ে আছে উমা। কমলার মনে পড়ল, থিয়েটারটা যখন তৈরি হচ্ছে, তখন এইখান থেকেই ও দেখত।
কাছে এসে আলতো মাথায় হাত রেখে কমলা সস্নেহে ডাকলে, ‘উমা–’
উমা চমকে উঠর। সে একাগ্র, তন্ময় হয়েই দেখছিল। পান্তির মাঠে সভা আছে, ছেলেরা দলে দলে যাচ্ছে সেই দিকে। পথে ভিড়। কিন্তু উমার চোখ সেদিকে থাকলেও দৃষ্টি কি সেখানে ছিল! দৃষ্টি চলে গিয়েছিল তার সুদূর অতীতে কিংবা অনাগত অন্ধকার ভবিষ্যতে–কে জানে!
‘উমা, ওঠ বোন।’ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কমলা।
‘তুমি যাও বড়দি, আমি যাচ্ছি।’
‘না, তুই আয়। আমার সঙ্গে আয়। অভয়পদ গাড়ি ডাকতে গেছে।’
‘চলো’ দীর্ঘনিশ্বাসটাও যেন ফেলতে পারে না উমা, সযত্বে চেপে যায়।
২৩৯
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে মোহাচ্ছন্নের মত। একতলার সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় উমা।
‘একবার মাকে প্রণাম ক’রে যাবো না, দিদি?’
কমলা উত্তর দিতে পারে না, নীরবে ঐ ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে। সেও যায় সঙ্গে সঙ্গে। রাসমণির ঘর। দীর্ঘকাল এই ঘরে ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের রোগশয্যাও পেতেছিলেন এইখানে। ঐ যেখানে পেরেক পোঁতা আছে মেঝেয়– ঐখানেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়েছে। এই ঘরের প্রতি অনুতে মায়ের স্মৃতি। আজও যেন উমা তাঁর গায়ের গন্ধ পায় এখানকার বাতাসে।
এতক্ষণ যা প্রাণপণে রোধ করে রেখেছিল, সেই চোখের জল আর বাধা মানে না উমার। হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করতে গিয়েই আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, ‘মা, মাগো, আমাকেও নাও মা। আর যে পারি না আমি।
কমলা সান্ত্বনা দেবে কি সেও কেঁদে আকুল হয়। নির্জন, নিচ্ছব্ধ বাড়িতে অসহায় অনাথিনী দুটি রমণীর কান্না দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে যেন বেরোতে পারে না। ওখানকার বাতাসেই গুমরে বেড়ায়।
সে কান্না থামে না। থামাতে পারে না ওরা। অভয়পদ এসে না পড়লে কখন থামত কে জানে! এমন কি অভয়পদও ওদের ডাকতে এসে একটু ইতস্তত করে। শেষে কোনমতে গলাটা পরিষ্কার করে ডাকে, ‘বড় মাসিমা, গাড়োয়ানটা বড় গোলমাল করছে, এবার ত উঠতে হয়।’
উত্তর দিতে পারে না কমলা কিন্তু কোনমতে নিজেকে যেন কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর উমাকে এক রকম টেনে এনেই গাড়িতে ওঠে।
অভয়পদ আর একটু দাঁড়ায়। একবার শেষ দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় ঘরগুলোয়। কিছু পড়ে না থাকে— দরকারী কিছু। তারপর রান্নাঘরের মেঝেতে এক ঘটি জল ঢেলে দিয়ে ঘটি বালতি নিয়ে সেও বেরিয়ে আসে। কপাটে তালা লাগিয়ে টেনে দেখে। এই চাবি আজই রাত্রে বাড়িওয়ালার কাছে পৌঁছে দেবার কথা। তাঁরা কেউ আসতে পারবেন না। তাকেই যেতে হবে।
চিরদিনের মত এ গলি থেকে ওরা বেরিয়ে গেল। এ বাড়ি থেকেও। বহুদিনের পুরোনো বাড়িটা আষাঢ়ের মেঘমেদুর বিষণ্ন অপরাহ্নে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল শুধু ওর অন্ধকার অভ্যন্তরে বহুদিনের বহু মলিন স্মৃতি নিয়ে। বাদলা বাতাসে খোলা জানালার কপাটগুলো আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল। আজ আর এ বাড়িতে আলো জ্বলবে না। আজ আর কেউ এ বাড়ির ছাদে অন্ধকারে অশ্রু বর্ষণ করবে না আলসেতে মাথা রেখে। আবার হয়ত নতুন ভাড়াটে আসবে কিছুকাল পরে, আবার শুরু হবে নতুন লোকের আনাগোনা। কিন্তু সে অন্য ইতিহাস।