শিবনাথ বিস্ময় কাটাইয়া তাহাকে প্ৰশ্ন করিল, তুমি এখানে কোথায়?
মাথার ঘোমটাটি অল্প বাড়াইয়া দিয়া মেয়েটি বলিল, কলকাতাতেই আমি থাকি বাবু, জমাদারনীর কাজ করি।
শিবনাথ একটু অধীরভাবেই প্রশ্ন করিল, কিন্তু কলকাতাতে তুমি এলে কেমন করে?
সলজ্জ হাসি হাসিয়া মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া সে বলিল, আমার নতুন পুরুষের সঙ্গে বাবু।
নূতন পুরুষ অর্থাৎ নূতন স্বামী।
আবার সাঙা করেছ বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু, শাশুড়ি-ভাসুরের জ্বালায় আমি মাসির বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেইখানেই–
সেইখানেই এই নূতন স্বামীর সহিত বিবাহ হইয়াছে। ইঙ্গিতে অৰ্থ বুঝিতে শিবনাথের ভুল হইল না। তাহার চিত্ত মেয়েটির উপর বিরূপ হইয়াই ছিল, এ কৈফিয়তে তাহার সেই বিরূপতার এতটুকু লাঘব হইল না। সে রূঢ়স্বরে বলিল, সাঙাই যদি করলে, তবে ভাসুরকে সাঙা করতে কি দোষ ছিল?
মেয়েটির মুখ মুহুর্তের জন্য উগ্ৰ দীপ্তিতে ভরিয়া উঠিল, পরমুহুর্তেই সে হেঁট হইয়া ঝাঁটাগাছটা কুড়াইয়া লইয়া ঝাঁট দিতে আরম্ভ করিয়া বলিল, সে কথা আপনি শুনে কী করবেন বাবু? মানুষের মন তো মানুষের হুকুমে ওঠে না মশায়!
শিবনাথ তাহার কথার আর জবাব দিল না বা আর কোনো প্রশ্ন করিল না, ক্ষুব্ধচিত্তে নীরবে। বসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। নূতন স্থান, জানালার বাহিরেও রাজপথের নূতন রূপ। সেখানে বাহিরের দিকে চাহিলেই নজরে পড়িত-পান-সিগারেটের দোকান, তাহার পাশে কাচের বাসনের দোকান, হাৰ্মোনিয়মের দোকান, ট্রাম মোটর ঘোড়ার গাড়ি, গতিশীল মানুষের ভিড়। এক এক সময় মনে হইত, দ্রুতবেগে বুঝি পথই চলিয়াছে সম্মুখের দিকে। আর এটি একটি ছোট চৌরাস্তা, এখানে ট্রাম নাই, চৌরাস্তার পাশে পাশে রিকশার সারি, দোকানের মধ্যে ওদিকের কোণে একটা ফলের দোকান, এদিকের কোণে একটা চায়ের দোকান। বিকিকিনির জঁাকজমক এখানে নাই, জীবনের গতি এখানে অপেক্ষাকৃত মন্থর, এখানে পথের উপর দাঁড়াইয়া মানুষ গল্প করিতে পায়; শিবনাথের এটা ভালই লাগিল।
বাবু! জামাইবাবু!
মুখ ফিরাইয়া শিবনাথ তাহার দিকে চাহিল, মেয়েটি বলিল, দেখুন, পরিষ্কার হয়েছে?
শিবনাথ ঘরখানির দিকে চাহিয়া দেখিল, নিপুণ সযত্ন পরিমার্জনায় ঘরখানি তকতক করিতেছে। সে মৌখিক সন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিল, বেশ হয়েছে, চমৎকার হয়েছে।
মেয়েটি খুশি হইয়া উঠিল। হাসিমুখে এবার সে বলিল, মা—পিসিমা ভাল আছেন বাবু?
সংক্ষেপে শিবনাথ উত্তর দিল, হ্যাঁ।
মেয়েটি আবার বলিল, আর গায়ে ব্যামো-স্যামো হয় নাই তো বাবু?
না।
আর একটা কথা শুধাব, রাগ করবেন না তো জামাইবাবু?
কী?–শিবনাথের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।
গৌরীদিদিমণি কেমন আছেন?
ভালই আছেন।
কত বড় হয়েছেন এখন?
শিবনাথ বিরক্ত হইয়া বলিল, সে শুনে আর তুমি কী করবে, বল? তুমি বরং আপন কাজ করগে যাও।
মেসের চাকরটি এটা-ওটা লইয়া যাওয়া-আসা করিতেছিল, এবার সে কুঁজায় জল ভরিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে করিতে শিবনাথের শেষ কথা কয়টি শুনিয়া রূঢ়স্বরে সেই কথারই প্রতিধ্বনি করিল, যা যা, আপনার কাজ করগে যা। ভদ্রলোকের ঘরে দাঁড়িয়ে ব্যাড়র ব্যাড়র করে বতে আরম্ভ করেছে।
মেয়েটি মুহূর্তে সাপিনীর মত ফোঁস করিয়া উঠিয়া বলিল, কী রকম মানুষ তুমি গো। তোমার আবার এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কেনে? আমার দেশের নোক, আমাদের বাবু, বলব না কথা, দেশের খবর নোব না?—বলিতে বলিতে মেয়েটি ঘর হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। মেয়েটির উপর প্রবল বিরূপতা সত্ত্বেও চাকরটির এই অনধিকার মধ্যবর্তিতা শিবনাথের ভাল লাগিল না, বরং মেয়েটির ওই শেষের কথাগুলি বেশ ভালই লাগিল—আমাদের দেশের লোক, আমাদের বাবু।
মেসটি কতকটা হোটেলের মত, নানা শ্রেণীর লোক এখানে থাকে; ছাত্রের সংখ্যা নাই বলিলেই চলে, চাকুরের সংখ্যাই বেশি। বেলা প্রায় পাঁচটা হইয়া আসিয়াছে, দুই-এক জন। করিয়া আপিস-ফেরত বাবু আসিয়া মেসে ঢুকিতেছিলেন। সারাদিন মুখ বন্ধ করিয়া খাটুনির পর এতক্ষণে বোলচাল যেন তুবড়ি-বাজির মত ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন মুক্ত দ্বারপথে শিবনাথের ঘরের দিকে চাহিয়া বলিল, বলিহারি বাবা, ব্ল্যাঙ্ক ফিল্ড আপ! এক রাজা যায়, অন্য রাজা হয়, ভারতের সিংহাসন খালি নাহি রয়! নিমাইবাবুর কপাল বটে বাবা!
নিমাইবাবু বোর্ডিঙের মালিক। শিবনাথ ওই মেয়েটার কথাই ভাবিতেছিল। মেয়েটা কুগ্ৰহের মত তাহার অদৃষ্টাকাশে আসিয়া জুটিয়াছে। গ্রামের ওই রটনার পর, আবার যদি কোনোরূপে এই সংবাদটা ঘামে যায়, তবে কি আর রক্ষা থাকিবে! মিথ্যা কলঙ্ক অক্ষয় সত্য হইয়া তাহার ললাটে চিরজীবনের মত অঙ্কিত হইয়া রহিবে।
অকস্মাৎ একটা তীব্র ক্রুদ্ধ চিৎকার-ধ্বনিতে মেসটা সচকিত হইয়া উঠিল। নারীকন্ঠের চিৎকার ও সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পুরুষের কণ্ঠে সমস্বরে উচ্চারিত প্রশ্নধ্বনি। শিবনাথও কৌতূহলবশে আসিয়া দেখিল, বারান্দার কোণে কয়েকজন বাবু ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। ভিড়ের ওপাশে সেই ডোমবধূ প্রদীপ্ত মুখে অকুণ্ঠিত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিতেছে, আপনাদের ওই চাকর মাশায়, আমাকে বলে কী, ওই নতুন বাবুর সঙ্গে তোর এত পিরীত কিসের? মাশায়, উনি আমাদের দেশের নোক, গায়ের নোক। তা ছাড়া ইনি আমার বাপ বল বাপ, মা বল মা, ভাই বল ভাই, সব। আমার মাশায়, সোয়ামি মল কলেরায়, তারপরে আমার হল কলেরা, কেউ কোথাও নাই, ঘরে শকুনি এসে বসে আছে আমার মরণ তাকিয়ে। আমার ময়লামাখা দেহ মায়ের মতন কোলে করে তুলে উনি যতন করে ওষুধ দিয়ে পথ্যি দিয়ে বাঁচিয়েছেন। একা কি আমাকে মাশায়? গাঁয়ে যেখানে যার রোগ হয়েছে, সেইখানে উনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাকে দেখে আমার হাসি আসবে না মাশায়? তাকে দেখে খবর শুধাব না মাশায়? বলেন, আপনারাই বলেন? তাকে পেনাম আমি করব না?
শিবনাথ আর সেখানে দাঁড়াইল না। প্রশংসার নম্রতায় যশোগৌরবের ভারে তাহার মাথা যেন নুইয়া পড়িতেছিল। মেয়েটি যেন তাহার জয়ধ্বজাই বহন করিয়া অকুণ্ঠিত উচ্চকণ্ঠে সমগ্র পৃথিবীকে তাহার জয়গান শুনাইতেছে। সে তাড়াতাড়ি আসিয়া ঘরে বসিল।
মেয়েটির প্রতি বিরূপতা সে আর অনুভব করিতে পারি না, তাহার প্রতি পরম স্নেহে তাহার অন্তর তখন পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
কালের অংশ কল্প; কল্পনায় কল্পলোক রচনা করিয়া তাই মানুষ করিতে চায় কালজয়।
ভবিষ্যতের ইতিহাস রচনা করিবার কল্পনা করিয়া বাংলার যে তরুণের দল ভারতের স্বাধীনতা-লক্ষ্যের সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধানে উন্মত্ত অধীর গতিতে নীরন্ধ্র অন্ধকার পথে ছুটিয়াছিল, এই সময়ে তাহাদের গতিবেগ তীব্র হইতে তীব্রতর হইয়া উঠিতেছিল। ভাবীকালের কোন মণিকোঠায় স্বাধীনতার দীপশিখা জ্বলিতেছে, কত দীর্ঘ সে দূরত্ব, কালের কালো জটাজালের অন্ধকার কত জটিল; সে বিবেচনা করিবার অবসর তাদের তখন নাই, পশ্চিমের রণাঙ্গনের রণবাদ্যের ধ্বনি, সৈন্যবাহিনীর পদক্ষেপের শব্দ, মারণাস্ত্রের গর্জনশব্দে উন্মত্ত হইয়া তাহারাও বর্তমানকালকে অতিক্ৰম করিয়া ভাবীকালকে জয় করিতে যাত্রা শুরু করিয়া দিল।
সুশীলকে দেখা যায় না। সে নাকি সমগ্র উত্তরাপথ-লাহোর হইতে কলিকাতা পর্যন্ত বিরাট একটা ব্যবস্থার চেষ্টায় ফিরিতেছে। শিবনাথ কথাটার আভাস মাত্র পাইয়াছে, সুস্পষ্ট সংবাদ সে কিছু জানে না। সে জানিবার অধিকারও তাহার হয় নাই। সৈনিকের মত আদেশ পালন করাই তাহার কাজ।
অসুখের ছলনায় বাড়ি যাইবার ভান করিয়া আসিয়াছে, কলেজ যাওয়া চলে না; পড়িতেও ভাল লাগে না। শিবনাথ বসিয়া বসিয়া কল্পনার জাল বোনে শুধু। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে আদেশের, সংবাদের। আজ কুড়ি দিনের উপর বাড়িতে চিঠি দিতে পর্যন্ত সে তুলিয়া গিয়াছে। এ কয়দিন তাহার বাড়ির কথা, তাহার মাকে পিসিমাকে মনে করিবার পর্যন্ত অবকাশ হয় নাই। সে কল্পনা করে, আকাশস্পর্শী প্রাসাদ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধুলার মত গঁড়া হইয়া আকাশ অন্ধকার করিয়া মিলাইয়া গেল। রেলপথের ব্রিজ ভাঙিয়াছে, টেলিগ্রাফের তার চিড়িয়াছে। ওদিকে ফ্রান্সের রণাঙ্গনে জার্মানবাহিনী দৃঢ় পদক্ষেপে ক্যালের দিকে অগ্রসর হইতেছে।
পাশের ঘরগুলিতেও যুদ্ধের সংবাদের উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলে। কয়জনে মিলিয়া সন্ধ্যার পর ম্যাপ খুলিয়া লাইন টানিয়া যুদ্ধের সংবাদ পড়িয়া থাকেন। যুদ্ধনীতির পদ্ধতির সমালোচনা গভীর হইতে গভীরতর হইয়া ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে তামাক ও সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরখানা ভরিয়া যায়। কোণের ঘরে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি একাই বাক্স হইতে হুইস্কির বেঁটে বোতল বাহির করিয়া বসেন; একটি গ্লাস ভরিয়া লইয়া গভীর অভিনিবেশ সহকারে শেয়ার মার্কেটের দরের পাতাখানা খুলিয়া নোট করেন, মধ্যে মধ্যে গ্লাসে এক-একটি চুমুক দেন; বা হাতের আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ঘনশুভ্ৰ ধোঁয়া অ্যাঁকিয়ার্বকিয়া উঠিতে থাকে। ম্যানেজারের সঙ্গে চাকরটার এখন রোজ বচসা হয় যুদ্ধ লইয়া। ম্যানেজার বলেন, যুদ্ধ হচ্ছে বিলেতে, তা এখানে শাকের দরটা বাড়বার মানে কী?
চাকরটা বলে, সে আপনি শুধান গিয়ে শাকওয়ালাকে। আমি কী করে সে জবাব দোব। কাল থেকে যাবেন আপনি নিজে বাজার করতে, আমি পারব নি।
সেদিন সকালে তাহাদের দুই জনের এই উত্তেজিত আলোচনাটা শিবু বসিয়া বসিয়া শুনিয়া উপভোগের হাসি হাসিতেছিল। বাহিরের বারান্দায় ডোেমবউ ঝাঁট দিতেছিল, শিবনাথের ঘরের সম্মুখে আসিয়া সে আবর্জনার বালতিটা রাখিয়া ঘরে ঢুকিয়া পড়িল।
জামাইবাবু!
শিবনাথ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, কী?
একটি কথা বলব আপনাকে?
কী?
ওই নিচে একটি নোক অহরহ দাঁড়িয়ে থাকে, আপনি দেখেছেন? ওই নোকটি আপনার খবর আমাকে শুধায়।
স্পাইটা! শিবনাথ চমকিয়া উঠিল। মেয়েটি বলিয়াই গেল, এই যে এখানকার চাকরটি, উ সুন্ধু ওই নোকটির সঙ্গে ফিসফাস করে। আমাকে বলে কী যে, আপনার ঘরে কী আছে দেখি, কাগজপত্র কুড়ায়ে এনে দিস। দিলে সরকার থেকে নাকি আমাকে বকশিশ দিবে। নোকটি নাকি গোয়েন্দা পুলিশওই চাকরটি আমাকে বলেছে।
এতক্ষণে শিবনাথ আপনাকে সংযত করিয়া লইয়াছিল, সে মৃদু হাসিয়া বলিল, রোজ তোমাকে আমি কাগজ বেছে দোব, তুমি নিয়ে গিয়ে ওকে দিও।
মেয়েটি বিচিত্র দৃষ্টিতে শিবনাথের দিকে চাহিয়া বলিল, আমরা যে টনোক বলে কি আমাদের ধম্মভয়ও নাই বাবু? আপনার ক্ষেতি যাতে হয়, তাই কি আমি করতে পারি?
কথার শেষের দিকে আসিয়া তাহার কণ্ঠস্বর যেন ভাঙিয়া পড়িল, চোখ দুইটিও সজল হইয়া উঠিয়াছে।
শিবনাথ বলিল, না না, তাতে আমার ক্ষতি হবে না, বরং ভালই হবে।
মেয়েটি সহসা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত ঘরের মেঝে ঝাঁট দিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল; ঝাঁট। দিতে দিতেই অতি মৃদুস্বরে বলিল, চাকরটা আসছে বাবু, পায়ের শব্দ উঠছে।
সত্য সত্যই প্রায় পরক্ষণেই চাকরটা আসিয়া দরজায় দাঁড়াইল; হাসিয়া শিবনাথের দিকে চাহিয়া বলিল, জমাদারনী আমাদের আপনার ভারি নাম করে বাবু, আপনার ওপর ভারি ভক্তি।
শিবনাথ উত্তরে তাহাকে প্ৰশ্ন করিল, আমার কোনো চিঠিপত্র আসে নি হে?
আজ্ঞে না, চিঠি এলে আমি তখনই দিয়ে যেতাম।
চিঠির প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াই শিবনাথ সত্য সত্যই চিন্তিত হইয়া উঠিল, আজ কয়দিনই। বাড়ির চিঠি আসে নাই; সে নিজেও চিঠি দেয় নাই প্রায় কুড়ি দিন। সপ্তাহখানেক আগে পিসিমার চিঠি আসিয়াছে; পিসিমার নাম দিয়া লিখিয়াছেন মা। সে চিঠির উত্তর সে দিতে পারে নাই, শুধু
তো কুশলবার্তা তাহারা চান নাই, চাহিয়াছেন অনেক কিছু জানিতে।
জামাইবাবু! চিঠি হয়ত ওই নোকটাই নিয়ে নিয়েছে। আপনি একটুকু সতর হয়ে থেকেন। মাশায়।
শিবনাথ মুখ তুলিয়া দেখিল, চাকরটা কখন চলিয়া গিয়াছে, ডোমবউ তাহাকে ওই কথা বলিয়া সতর্ক করিয়া দিতেছে। তাহার চোখে-মুখে অপরিসীম উদ্বেগের কাতরতা। সে বাহির হইয়া গেলে শিবনাথ সেই চিঠিখানা বাহির করিয়া বসিল।
তিনি লিখিয়াছেন, কলেজের মেস ছাড়িয়া তুমি অন্য মেসে কেন গেলে, তাহার কারণ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। তুমি যে কারণ লিখিয়াছ, তাহাতে আমাদের তৃপ্তি হইল না। তোমার সমস্ত চিঠিখানাই যেন কেমন আমাদের ভাল লাগিল না, মন শান্ত হইল না, তোমার জন্য চিন্তা আমাদের বাড়িয়া গেল। তোমার চিন্তায় আমার রাত্রে ঘুম হয় না। আকাশ-পাতাল ভাবনা হয়। তোমার মা কয়দিনই দুঃস্বপ্ন দেখিতেছেন, তোমার সর্বাঙ্গ যেন রক্তমাখা, ঘরের মেঝে রক্তে ভাসিয়া গিয়াছে।
শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তাহার জীবনের ভাবী রূপ, তাহারই অন্তরের কল্পলোকে যাহা লুকাইয়া আছে, তাহারই প্রতিবিম্ব এই দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্ৰম করিয়া মায়ের মনোদর্পণে প্রতিফলিত হইল কেমন করিয়া? চিন্তা করিতে করিতে তাহার মনে হইল, তাহার মায়ের অন্তরাত্মার দৃষ্টি ঊর্ধ্বতমলোকে অবস্থিত, পৃথিবীর সহিত সমগতিতে চলমান যুগল জ্যোতিষ্কের মত তাহারই মাথার উপর অহরহ যেন জাগিয়া আছে। সে জ্যোতিষ্কের রশ্মিদৃষ্টি জড়বস্তুর সকল আবরণইট কাঠ পাহাড় বন সমস্ত কিছুর অন্তর ভেদ করিয়া তাহার প্রতিটি কর্মের উপর প্রসারিত হইয়া আছে। চোখ তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। মনে মনে বারবার মাকে প্ৰণাম করিয়া বলিল, তোমার সন্তানগর্ব ক্ষুণ্ণ আমি করি নি মা। সে কাজ আমি কোনোদিন করব না, করব না। চোখ বুজিয়া মনে মনে সে তাহার মাকে পিসিমাকে কল্পনা করিবার চেষ্টা করিল। পিসিমা যেন চিন্তায় বাক্যহীন স্পন্দনহীন মাটির পুতুলের মত উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া আছেন। আর তাহার মা আপন চিন্তা উদ্বেগ সমস্ত অন্তরে চাপিয়া রাখিয়া বহ্নিগৰ্ভা ধরিত্রীর শ্যামল মিগ্ধ বাহ্য রূপের মত একটি স্নিগ্ধ হাসি মুখে মাখিয়া তাহাকে সান্ত্বনা দিতেছেন। দুরন্ত কলিক-ব্যথায় শয্যাশায়িনী হইয়াও তাহার মুখে যন্ত্ৰণাকার একটি শব্দ কখনও বাহির হয় না, মুখের হাসি নিঃশেষে মিলাইয়া যায় না। বিছানায় রোগশায়িনী মায়ের নীরব স্থির রূপ তাহার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল।
সে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিত, বড় যন্ত্রণা হচ্ছে মা? ডাকব ডাক্তারকে?
অতি মৃদুস্বরে মা উত্তর দিতেন, না, এই তো মরফিয়া মিক্সচার খেলাম। তুই আমার কাছে আয় বরং খুব কাছে।
অকস্মাৎ ভাবাবেগের আতিশয্যে সে আকুল হইয়া উঠিল, তাহার কল্পনার পটভূমির উপর পৃথিবীর কোনো ছবি আর দেখা যায় না; শুধু রোগশায়িনী মায়ের স্তব্ধ স্থির দেহখানি অন্ধকারের বুকে নিশ্চল আলোকের একটি শীর্ণ রেখার মত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে।
সমস্ত সকালটা অস্থির হৃদয়ে বিছানায় পড়িয়া থাকিয়া অবশেষে সে স্থির করিল, আজ। রাত্রেই অথবা কাল সকালেই সে একবার বাড়ি যাইবে। কিন্তু পরক্ষণেই মন তাহার হতাশায় ভাঙিয়া পড়িল। সে হইবার নয়, তাহার বাক্সের অভ্যন্তরস্থিত বস্তুগুলির কথা মনে পড়িয়া গেল, নিচে স্পাইটাকে মনে পড়িল, মেসের চারটাকে মনে পড়িল। ডোমেদের বধূটির কথা তাহার কানের কাছে এখনও যেন ধ্বনিত হইতেছে, এখানকার এই যে চারটি, উ সুষ্ঠু ওই নোকটির সঙ্গে ফিসফাস করে। তাহার অগোচরে যদি দ্বিপ্রহরের জনহীন বাড়িতে তালা খুলিয়া সন্ধান করিয়া দেখে! হতাশার অবসাদে সে যেন শ্ৰান্ত-ক্লান্তের মত বিছানায় শুইয়া পড়িল।
প্রায়-জনহীন বাড়ি, মেসের অধিবাসীরা যে যাহার কাজে বাহির হইয়া গিয়াছে; রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়ার পর চাকর বামুন সকলেই এ সময় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সম্মুখের পথটাও এখন জনবিরল; মাত্র দুই-চারিটা লোকের আনাগোনা; স্পাইটাও এ সময় গাছতলায় বসিয়া বসিয়া ঢুলিতে থাকে। মধ্যে মধ্যে দুই-চারিটা ফেরিওয়ালার ডাক আর দুই-একটা ভিক্ষুকের অভিনব ভঙ্গিতে ভিক্ষা-প্রার্থনার বিকট আর্তনাদ শোনা যাইতেছে।
বাহিরের দুয়ারে মৃদু কড়া নাড়িয়া কে ডাকিল, শিবনাথবাবু!
মুহূর্তে শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া শিবনাথ দরজা খুলিয়া বলিল, পূর্ণবাবু!
নীরবে ঘরে প্রবেশ করিয়া পূর্ণ দরজা বন্ধ করিয়া বলিল, আমার সঙ্গে আপনাকে কলকাতার বাইরে যেতে হবে—আজ রাত্রেই।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শিবনাথ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া এহিল। পূর্ণ বলিল, আমাদের একজন নেতা এই দারুণ প্রয়োজনের সময়ে আমাদের পরিত্যাগ করতে চাচ্ছেন। অসামান্য ব্যক্তি, সমস্ত জীবনই এই সাধনায় সন্ন্যাসীর মত ব্ৰতপালন করে এসেছেন। কলকাতার বাইরে একটা আশ্রম করে কর্মী তৈরি করেছেন। অনেক অস্ত্র ও অর্থ তার কাছে গচ্ছিত আছে। কিন্তু কী জানি কেন, তিনি হঠাৎ এখন সমস্ত দলের মতকে উপেক্ষা করে এ মতের বিরোধী হয়ে উঠেছেন। তার কাছে যেতে হবে।
শিবনাথ বলিল, যাব।
পূৰ্ণর অকম্পিত কণ্ঠ, ধীর মৃদু স্বরের দৃঢ়তা, চোখের দীপ্তি তাহার অন্তরে-বাহিরে ছোঁয়াচ বুলাইয়া দিল। সারা সকালের হৃদয়ের অস্থিরতা মুহূর্তে যেন বিলুপ্ত হইয়া গেল। পূর্ণ বলিল, আজ রাত্রেই সাড়ে দশটায় হাওড়ার দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দেখা হবে। টিকিট অন্য লোকে করে রাখবে।
শিবনাথ বলিল, কিন্তু আর্মসগুলো যে এখানে থাকছে, তার কী হবে? এখানকার চারটা মনে হচ্ছে স্পাই।
সচকিতের মত পূর্ণ বলিল, তাই তো; ওগুলো যে সরিয়ে ফেলতে হবে। সে আপনি না গেলেও হবে। সমস্ত কলকাতাব্যাপী সার্চ হবে—যে কোনো দিন, হয়ত কালই। পুলিশ তৈরি হচ্ছে।
শিবনাথ বলিল, কিন্তু বের করে নিয়ে যাব কেমন করে? এখানকার চাকরটা স্পাই। বাইরেও স্পাই অহরহ বসে রয়েছে। পূর্ণ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, আপনি ভেবে দেখুন, আমিও ভেবে দেখব; সন্ধের সময় খবর পাবেন। আমি চলি এখন, বেলা পড়ে আসছে, রাস্তায় লোক বাড়বে।
সে সন্তৰ্পণে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। শিবনাথ মনে মনে সমস্ত বাড়িটায় সন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল একটি নিরাপদ গুপ্ত স্থান। নাঃ, কোনো স্থান নাই। বাহির করিয়া লইয়া যাইবারও কোনো উপায় নাই। স্পাইটা সতর্ক দৃষ্টি মেলিয়া বসিয়া আছে, কিছু দূরে চারি জন পুলিশ আর এক জন সার্জেন্ট; এক উপায়, সশস্ত্র হইয়া ওই ব্যুহ ভেদ করিয়া যাওয়া।
কে?
সন্তৰ্পণে কে দরজা খুলিতেছিল। শিবনাথ চকিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কে?
ক্ষিপ্ৰ ভঙ্গিতে ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া ডোমবধূ। পরমুহূর্তেই সে শিবনাথের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া অতি কাতর মৃদুস্বরে বলিল, তোমার পায়ে পড়ি বাবু, জামাইবাবু, ওসব তুমি কোরো না।
শিবনাথের বুকখানা গুরগুর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। সে কম্পিত কণ্ঠেই প্রশ্ন করিল, কী?
আমি শুনেছি মাশায়। আমাকে বলেছে, ওই চাকরটা বলেছে, বাবুর তোর কী হয় দেখৃ! তোমার কাছে নাকি বোমা-পিস্তল আছে। তোমাকে নাকি জেলে দিবে, ফাঁসি দিবে।
শিবনাথ নীরব নিথর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মনের মধ্যে রুদ্ধ রোষ গর্জিয়া গর্জিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল। হতভাগ্য গুপ্তচরটাকে শেষ করিয়া দিলে কী হয়?
তোমার পায়ে পড়ি বাবু। তোমার কাছে কী আছে আমাকে দাও, আমি ময়লা ঢেকে বালতিতে পুরে নিয়ে যাই। এই সময় চাকরটা ঘুমাইছে, দাও মাশায় দাও।
আশায় আনন্দে, একটা অপূর্ব বিস্ময়ে শিবনাথ মুহূর্তের মধ্যে যেন কেমন হইয়া গেল। নিম্পলক বিচিত্র দৃষ্টিতে সে ওই নীচজাতীয়া অস্পৃশ্য-বৃত্তিধারিণী মেয়েটির দিকে চাহিয়া রহিল। ডোমবউ কাঁদিতেছে, ঊর্ধ্বমুখে তাহারই দিকে কাতর মিনতিভরা দৃষ্টিতে চাহিয়া কাঁদিতেছে। শিবনাথের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।
মেয়েটি আবার কাতরস্বরে বলিয়া উঠিল, দেরি করেন না জামাইবাবু, উঠে পড়বে সেই মুখপোড়া।
শিবনাথ এবার চেতনা লাভ করিয়া অবহিত হইয়া উঠিল; কিন্তু তবুও তাহার হাত-পা এখনও কাঁপিতেছে। কম্পিত হস্তে সে বাক্স খুলিয়া একে একে সর্বনাশা বস্তুগুলি ডোমবউয়ের আবর্জনা-ফেলা বালতিতে ভরিয়া দিল। মেয়েটি এক রাশ আবৰ্জনা তাহার উপর সযত্নে চাপাইয়া দিয়া স্তপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
শিবনাথ মৃদুস্বরে ডাকিয়া বলিল, সাবধান, ধাক্কা-টাক্কা লাগে না যেন, ফেটে গেলে খুন হয়ে যাবে তুমি।
মেয়েটির যেন পুলকের সীমা নাই। সে বলিয়া উঠিল, আপুনি পরানটা রেখেছিলেন, না হয়, আপনার লেগেই যাবে।
শিবনাথ আবার বলিল, আমার নাম করে তোক যাবে, তাকেই দিয়ে দিও, বুঝলে?
সে বলিল, না। গৌরীদিদির নাম করে পাঠায়ো; তোমার নাম করে তো এরা পাঠাতে পারে গো।—বলিতে বলিতে সে হেলিয়াদুলিয়া যেন রঙ্গ করিতে করিতে চলিয়া গেল। শিবনাথের চোখের সম্মুখে সমস্ত পৃথিবীতে যেন সোনার রং ধরিয়া গিয়াছে। এত সুন্দর পৃথিবী।
সে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল। সম্মুখেই ওদিকে ফুটপাতের উপর সেই স্পাইটার সহিত ততক্ষণে ডোমবউ রঙ্গ জুড়িয়া দিয়াছে। হাসিয়া ঢলিয়া পড়িতে পড়িতে মেয়েটা তাহার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি লোকটার নাকের সম্মুখে বারবার নাড়িয়া দিয়া ত্বরিত গমনে অপূর্ব এক লীলার হিল্লোল তুলিয়া চলিয়া গেল।
লোকটা একটা আবেশের মোহে হাসির আকারে আকৰ্ণ দন্তবিস্তার করিয়া তাহারই গমনপথের দিকে চাহিয়া রহিল।
শিবনাথও হাসিতেছিল। অকস্মাৎ তাহার হাসি স্তব্ধ হইয়া গেল, অকারণেই মনে পড়িয়া গেল গৌরীকে।