শিউলি গাছে আশ্বিন কার্তিক মাসে ফুল ফুটবে। এইটাই নিয়ম। কদম গাছে ফুল ফুটবে আষাঢ়ের পূর্ণিমায়, শিমুল ফুটবে চৈত্র দিনের উত্তাপে। অথচ মরিয়মদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটেছে। গাছের একটা ডাল দোতলার বারান্দায় এসেছে। ডাল-ভর্তি ধবধবে সাদা ফুল। গাছটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মানুষের মাথা খারাপ হতে পারলে গাছের হবে না কেন? গাছেরাও তো জীবন আছে।
চৈত্র মাসে শিউলি গাছে ফুল–এই খবরটা মাসুমাকে দিতেই সে বলল, ফুটুক। মরিয়ম বলল, আয় দেখে যা। মাসুমা বলল, বুরু, আমার ফুল দেখার শখ নাই।
সাফিয়াকে এই খবরটা দিতেই তিনি অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা। মরিয়ম বলল, মা, চল তোমাকে দেখাই। সাফিয়া বললেন, পরে দেখব। হাতের কাজটা সারি। অথচ তার হাতে কোনো কাজ নাই। তিনি বাবুর পাশে ঝিম ধরে বসে আছেন। মরিয়ম আরেকবার বারান্দায় গেল ফুল দেখতে। ডালটা উঁচুতে। হাতের কাছে থাকলে কয়েকটা ফুল পাড়ত। শিউলি ফুলের বেঁটা দিয়ে সুন্দর হলুদ রঙ হয়। এই হলুদ রঙ দিয়ে পায়েস রান্না করলে পায়েসে ফুল ফুল গন্ধ চলে আসে।
মরিয়ম মুগ্ধ চোখে আরো কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। এই খবরটা একজনকে দিতে হবে। সেই একজন কোথায় আছে, সে জানে না। তার কাছে খবর কীভাবে পৌছানো যাবে তাও জানে না। তারপরেও সে প্রায় রোজই একটা করে চিঠি লিখে খাতা ভর্তি করে ফেলছে। কোনো এক সময় চিঠিগুলি নিশ্চয়ই পৌছানো যাবে। মরিয়ম দরজা বন্ধ করে দিল। চিঠি লেখার সময় ইট করে কেউ ঘরে ঢুকলে তার বড় বিরক্তি লাগে। চিঠি লেখার সময়টা সম্পূর্ণ তার একার। তখন আশেপাশে কেউ থাকবে না।
চিঠির সম্বোধন নিয়ে মরিয়মের খুব সমস্যা হয়। কোনো সম্বোধনই তার পছন্দ হয় না। তার খুব ইচ্ছা করে নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই লিখতে। সে যদি মরিয়মকে সংক্ষেপ করে মরি ডাকতে পারে তাহলে মরিয়ম কেন নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই ডাকতে পারবে না। সমস্যা অবশ্যি আছেপ্রিয় নাই লিখতে যেন কেমন লাগছে। মনে হয় যাকে লেখা হচ্ছে সে নাই।
মরিয়ম লিখল—
এই যে,
তুমি কেমন আছ? জানো কী হয়েছে? আমাদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে। এটা অনেক বড় ঘটনা, কারণ শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটে না। আমার ধারণা গাছটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মানুষের যদি মাথা খারাপ হয়, গাছের কেন হবে না? গাছের জীবন আছে–জগদীশ বসু আবিষ্কার করেছেন।
তুমি কি জানো আমারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাতে আমি এক ফোটা ঘুমাই না। জেগে বসে থাকি। আমার ঘুম আসে। ফজরের নামাজের পর। আযান শুনে নামাজ পড়বার বদলে ঘুমিয়ে পড়ি। দশটা সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙে। দুপুরবেলা খেয়ে আবার ঘুমুতে যাই। ঘুম থেকে উঠি ঠিক সন্ধ্যায়। উঠি বলা ঠিক হবে না। আমাকে উঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ সন্ধ্যাবেলা ঘুমানো খুবই অলক্ষণ। পৃথিবীর কোনো পশুপাখি না-কি সন্ধ্যাবেলা ঘুমায় না। তারা তখন অস্থির হTে ছটফট করতে থাকে! আচ্ছা এটা কি সত্যি?
এখন তোমাকে জরুরি কিছু খবর দেই। এক নম্বর খবর–বাবার কোনো খোঁজ এখনো পাই নাই। উনি কোথায় কেউ বলতে পারছে না। বাবা বাড়িতে না থাকায় সবচে বড় সমস্যা হয়েছে মার। উনি সংসার চালাতে পারছেন না। বাবা তো মার হাতে বাড়তি কোনো টাকা দিতেন না। যা টাকা ছিল সব শেষ। চাল-ডাল-তেল কেনা ছিল বলে কিছুদিন চলেছে। এখন তাও শেষ। মা তার তিন মেয়ের যাকেই দেখেন তাকেই জিজ্ঞেস করেন, এখন কী কবি বল তো?
ব্যাংকে বাবার টাকা আছে। সেই টাকা আমরা তুলতে পারছি না। তবে তুমি এইসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ ঢাকা শহরে আমাদের আত্মীয়স্বজন আছেন, তারা কেউ-না-কেউ আমাদের খোঁজ করতে আসবে। দেশের বাড়ি থেকে দাদাজানও নিশ্চয় কাউকে-না-কাউকে আমাদের খোজে পাঠাবেন। যাত্ৰাবাড়িতে আমার ছোট নানার (যিনি আমাদের বিয়ে দিয়েছেন)। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। উনি যদি একবার আসতেন, তাহলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হতো।
মার এবং আমাদের তিন বোনেরই কিছু প্ৰণয়না আছে। প্রয়োজনে গয়না বিক্রি করা হবে। তুমি এইসব নিয়ে মোটেই চিস্তা করবে না। আমাদের সামনের বাড়ির বাড়িওয়ালা সবাইকে নিয়ে দেশে চলে গেছেন। বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে তার শালাকে রেখে গেছেন। তার নাম রতন। আমরা তাকে ডাকি বগা ভাই (দেখতে বকের মতো, এই জন্যে বগা ভাই)। মা ঠিক করেছে বগা ভাইকে দিয়ে গয়না বিক্রি করাবে। আমরা তিন বোন চাচ্ছি না বগা ভাই আমাদের বাড়িতে আসুক। তার ভাব-ভঙ্গি ভালো না। তার কিছু বিহারি বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের নিয়ে সে প্রায়ই তাদের বাড়িতে আডিডা বাসায়। সে নিজেও বিহারিদের মতো ঘাড়ে রঙিন রুমাল বাধে।
তুমি কি জানো বিহারিদের ভয়ে আমরা সবাই আতঙ্কে থাকি? রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ থাকে, এই সময় বিহারিরা না-কি মানুষের বাড়িতে ঢোকে। বিশেষ করে সেইসব বাড়িতে যেখানে অল্পবয়েসী মেয়েরা আছে। কী যে ভয়ঙ্কর অবস্থা!
রাতে আমরা সবাই একই ঘরে ঘুমাই। মা হাতের কাছে একটা বটি রাখেন। এখন তুমিই বলো–ওরা যদি দল বেঁধে আসে, মা বটি দিয়ে কী করবে?
যাই হোক, তুমি এইসব নিয়ে চিন্তা করবে না। আমরা ঠিক করে রেখেছি, পরিচিত কাউকে পেলেই আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাব; একবার দেশের বাড়িতে পৌঁছতে পারলে আমাদের আর কোনো ভয় নেই।
তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ব নিও। বেশি সাহস দেখানোর দরকার নেই। অন্যরা সাহস দেখাক, তোমাকে সাহস দেখাতে হবে না।
খুবই অন্যরকম একটা খবর তোমাকে দেই। মার ধারণা আমার সন্তান হবে। আমার চেহারায় না-কি মা মা ভাব চলে এসেছে। ঘটনা তা না। তবে আমি এমন ভাব করছি যে ঘটনা। তাই। দেখেছি আমি কেমন মজা করতে পারি?
আজ এই পর্যন্ত। কাল আবার চিঠি লিখব। আচ্ছা! শোন, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আয়াতুল কুরশি পড়ে তিনবার হাততালি দিয়ে ঘুমুতে যাবে। তালির শব্দ যতদূর যায়, ততদূর পর্যন্ত কোনো বালামুসিবন্ত আসতে পারে না। আমরা সবসময় তাই করি।
ইতি
তোমার মরি
চিঠি শেষ করে মরিয়ম আবার বারান্দায় গেল। অসময়ের ফুল আবার দেখতে ইচ্ছা করছে। ফুল পাড়তে পারলে চিঠিতে ফুলের বোটার হলুদ রঙ লাগিয়ে দেয়া মৃেত। বারান্দা থেকে বগা ভাইকে দেখা যাচ্ছে। বগা ভাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার সঙ্গে আরো তিনজন আছে। প্রত্যেকেরই পান খাওয়া লাল ঠোট। কাঁধে রুমাল বাধা। তারাও তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে। তাদের একজন হঠাৎ হাততালি দিতে শুরু করল। তার দেখাদেখি অন্য দুজনও হাততালি দিচ্ছে। শুধু বগা ভাই দিচ্ছে না। মরিয়ম ছুটে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে গেল।
সাফিয়া বললেন, কী হয়েছে?
মরিয়ম বলল, কিছু হয় নাই; কেন জানি ভয় লাগছে।
ভয় লাগছে কেন?
বারান্দা থেকে দেখেছি, বগা ভাই কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তাকিয়ে আছে। তোকানোটা ভালো না। মা চল আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাই।
কীভাবে যাবে? কে নিয়ে যাবে?
বোরকা পরে আমরা আমরা চলে যাব। ট্রেনে উঠব। ট্রেন থেকে নামব।
সাফিয়া কিছু বললেন না। ছেলে কাঁদছে, তিনি ছেলে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়ে তিনটিকে তার খুবই পছন্দ। ভালো মেয়ে, বুদ্ধিমতী, কিন্তু বেশি সরল। মনে কোনো প্যাচ গোছ নাই। তারপরেও তিন মেয়ের একটা ব্যবহারে তিনি মনে খুবই কষ্ট পেয়েছেন। তাদের বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে নাএটা নিয়ে তাদের মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা নেই। যেন তাদের বাবা মফস্বলে ইন্সপেকশনে গিয়েছে, কয়েক দিন পরে ফিরে আসবে। বাবার প্রতি মেয়েদের সামান্য মমতা থাকবে না? এই দুঃসময়ে একটা মানুষ নিখোঁজ হওয়া যে কত ভয়াবহ ব্যাপাব–এটা কি এরা জানে না? ধরে নেয়া গেল মানুষটা খারাপ। খুবই খারাপ। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সবসময় ধমকা-ধমকি। সবসময় মেজাজ খারাপ। তারপরেও তো বাবা।
একজনের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর চিন্তা তার মাথায়। অন্য কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। তার কথা বাদ দেয়া গেল। সে থাকুক শিউলি ফুল নিয়ে। অন্য দুজন? তাদের তো বিয়ে হয় নি। তাদের তো সম্পূর্ণ নিজের লোক নেই। তারা কেন বাবাকে নিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তাও করবে না? বাবা ঘরে ফিরছে না–এতে তারা যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত। প্ৰত্যেকেই স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে পারছে। গতকাল রাতে মাসুমা ছুটে এসে বলল, মা, আকাশবাণী থেকে খুব ভালো নাটক হচ্ছে। শুনবে?
সাফিয়া হতভম্ব। এই মেয়ে কী বলে! এখন কি নাটক শোনার সময়? মাসুমা উত্তেজিত গলায় বলল, অচিন্তকুমার সেনগুপ্তর উপন্যাস থেকে নাটক। উপন্যাসের নাম প্রথম কদম ফুল । সাফিয়া বললেন, মা, তোমরা শোন। আমার বাবুকে দেখতে হবে।
মাসুম বলল, মা, বাবু তো ঘুমাচ্ছে।
সাফিয়া বললেন, নাটক শুনতে আমার ভালো লাগে না, তোমরা শোন। তিনি গম্ভীর মুখে বাবুর পাশে বসে রইলেন। বাবুকে এখন আর ইয়াহিয়া ডাকা হয় না। তার বাবু নামই মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে।
বাবু ঘুমাচ্ছে, তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। এক সময় এই ছেলের ঘুম ভাঙবে। ঘুম ভাঙার পরেও তার জগতের অন্ধকার কাটবে না। সে হাত বাডিয়ে প্রিয়জনের স্পর্শ খুঁজবে। তার প্ৰিয়জন কে? সাফিয়া নামের একজন যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। বাবু যে চোখে দেখে না এবং কানে শোনে নাএই বিষয়ে তিনি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত। বোনদের এই ভয়ঙ্কর খবরটা তিনি দেন নি। কেন দেন নি তার কারণ তার কাছেও স্পষ্ট না।
সাফিয়া নিশ্চিত মেয়েরা এখনো বুঝতে পারছে না বাইরের জগতে কী ভয়ানক ওলট-পালট হয়ে গেছে। তারা তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে প্রায় চিন্তাহীন সময় কাটাচ্ছে। সব কিছুর মধ্যেই এক ধরনের মজা পাচ্ছে। রাতে একই ঘরে সবাই যখন ঘুমুতে আসছে, তার মধ্যেও যেন মজা আছে। তিন বোন পাশাপাশি শুয়ে থাকে। গুটুর গুটুর করে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ খিলখিল হাসি। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলবে, আস্তে হাসো, আস্তে, মিলিটারি শুনবো। ওমনি আরো জোরালো হাসি। সবচে ছোটটা একরাতে বলল, আপু, মিলিটারিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় কী জন্যে?
মাসুমা বলল, আদর করার জন্যে ধরে নিয়ে যায়। তোকে যদি ধরে নিয়ে যায় এমন আদর করবে…
মাসুমা কথা শেষ না করেই শুরু করল হাসি। মাসুমা হাসে, মরিয়ম হাসে। তাদের হাসির মাঝখানে মাফরুহ অবাক হয়ে বলে, তোমরা হাসছ কেন? তিন বোনের হাসি তখন আরো প্ৰবল হয়।
হাসির শব্দে সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। সুসময়ে হাসি সংসারে আরো সুসময় নিয়ে আসে। দুঃসময়ের হাসি আনে ভয়ঙ্কর কোনো দুঃসময়। মরা বাড়িতে লাশ কবর দেওয়ার আগেই যদি কেউ হাসে, অবশ্যই সে বাড়িতে আরো একজন কেউ মারা যায়। এটা পরীক্ষিত সতী।
মেয়েরা হাসে, সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। মেয়েরা বুঝতে পারছে না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন সামনের দিন ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর সেই দিনের কথা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। অনেক রাত পর্যন্ত এপাশি-ওপাশ করেন। চোখ যখন লাগে বিকট সব স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নগুলি বিকট শুধু না, নোংরাও। এত নোংরা যে ঘুম ভাঙার পর তার গা ঘিনীঘিন করে। মনে হয়। শরীর অশুচি হয়ে আছে। প্রায়ই স্বপ্লে তিনি তাঁর মৃত বাবাকেও দেখেন। বাবা যেন বাসায় এসেছেন। ছটফট করছেন। যেন খুব ব্যস্ততা। হুড়মুড় করে তিনি শোবার ঘরে ঢুকে বললেন, ও খুকি, তাড়াতাড়ি কর। লঞ্চ ধরতে হবে। (সাফিয়াকে তার বাব, সারাজীবন সাফি ডেকেছেন। কখনো খুকি। ডাকেন নি। অথচ স্বপ্নে কেন খুচুক ডাকেন কে জানে)। স্বপ্লের মধ্যেই সাফিয়া বলে, বাবা এত ব্যস্ত কেন? বললেই তো যাওয়া যায না। আমার ছেলে-মেয়ে আছে, স্বামী আছে, সংসার আছে।
বাবা মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, আরো রাখা রাখ। কিসের স্বামী কিসের ছেলেমেয়ে, লঞ্চ ছেড়ে দিবে; আয় খুকি–তাড়াতাড়ি আয়। বলেই তিনি সাফিয়ার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। তখন সাফিয়ার ঘুম ভাঙে।
এই স্বপ্ন সাফিয়া প্রায়ই দেখে, তবে সবসময় লঞ্চ থাকে না। মাঝে-মাঝে থাকে ট্রেন, নৌকা, বাস। স্বপ্নের মূল বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তির হাত ধরে টানাটানি খুব খারাপ। এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে জানের সদকা দিতে হয়। মাওলানা ডাকিয়ে তওবা করে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতিও নিতে হয়। সাফিয়া তার কোনোটিই করেন নি। একটা খতম পড়তে চেষ্টা করছেন–এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার দোয়া ইউনুস।
ইউনুস নবি যখন তিমি মাছের পেটে চলে গেলেন–তখন জীবনের সমস্ত আশা ছেড়ে এক মনে এই দোয়া পড়লেন–লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজাজোয়ালেমিনা। এই দোয়ার কারণে তিমি মাছ ইউনুস নবিকে উগরে ফেলে দিল। তাঁর জীবন রক্ষা হলো। দোয়াটার নাম হয়ে গেল। দোয়া ইউনুস। মাছের পেটে চলে যাবার মতো ভয়ঙ্কর কোনো পরিস্থিতিতে যদি মানুষ পড়ে, তাহলে এই দোয়া পাঠ করলে সে নাজাত পাবে।
সাফিয়ার ধারণা তিনি মাছের পেটেই আছেন। তিনি একা না। পুরো দেশটাই এখন মাছের পেটে। দেশের সব মানুষের উচিত দোয়া ইউনুস পাঠ করা।
শুক্রবারে আসরের নামাজের সময় মরিয়মদের বাড়ির দরজার কড়া কে যেন জোরে জোরে নাড়তে লাগল। মরিয়ম ভয় পেয়ে ছুটে গেল মার কাছে। মাসুমা গল্পের বই পড়ছিল। নাইমুল এই বাড়িতে অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিল। এখন বইগুলি মাসুমার দখলে। সে একটার পর একটা বই পড়ে যাচ্ছে। দরজার কড়া নাড়ার সময় মাসুমা যে বইটা পড়ছিল তার নাম জঙ্গম। লেখকের নাম বনফুল। কড়া নাড়ার প্রবল শব্দে সে বই ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে এলো মায়ের ঘরে।
সাফিয়া তিন মেয়েকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে মাস্টারলিক তালা লাগালেন। বাবুকে কোলে নিয়ে দরজা খুলতে এলেন। যদি মিলিটারি হয়, কোলে শিশুকে দেখে দয়া হতে পারে।
সাফিয়া ভীত গলায় বললেন, কে?
বাইরে থেকে কেউ একজন বলল, ভয়ের কিছু নাই, দরজা খুলেন।
আপনি কে?
নাম বললে আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম শাহ কলিম।
সাফিয়া বলল, কী চান?
দরজা খুলেন, তারপর বলি কী চাই। বললাম তো ভয়ের কিছু নাই। আমি বিহারি না। বাঙালি। আমি মিলিটারির কোনো লোক না। বিহারি বা মিলিটারি হলে এতক্ষণে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যেত।
সাফিয়া দরজা খুললেন। শাহ কলিম নামের লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। শাহ কলিম বলল, আপনার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিরাট পরিশ্রম হয়েছে। ঠিকানা ছিল ভুল। দুপুর একটা থেকে হাঁটাহাঁটি করছি, এখন খুব সম্ভব চারটা বাজে। এক গ্রাস পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে কি আপনি একা?
হ্যাঁ, আমি একা।
আপনি তো একা না, এই বাচ্চাটা ছাড়াও আপনার তিনটা মেয়ে আছে। আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যান, পানি নিয়ে আসেন।
সাফিয়া পানি আনলেন। লোকটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার মনে হলো, আসলেই ভয় পাওয়ার কিছু নাই। লোকটা বলল, আমি এসেছি আপনাদের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না তা জানার জন্য।
সাফিয়া বললেন, আপনি কে?
শাহ কলিম বলল, আমি কে সেটা তো বলেছি। আমার নাম শাহ কলিম। কবিতা লেখি। নানান পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়। আপনাদের কাছে এক ভদ্রলোক আমাকে পাঠয়েছেন। উনি আপনার স্বামীর বন্ধু মানুষ। আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করেন। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না জানার জন্যে পাঠিয়েছেন। এখন বলেন–আছে কোনো সমস্যা?
সাফিয়া আগ্রহ নিয়ে বললেন, মরিয়মের বাবা কোথায় আপনি জানেন?
শাহ কলিম বলল, আমি জানি না।
উনি কি বেঁচে আছেন?
আমি উনার বিষয়ে কিছুই জানি না।
উনার বন্ধু কি জানেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
শাহ কলিম বলল, উনার খন্ধুও কিছু জানেন না। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের কাছ থেকে খবর নেবার জন্য। এখন দেখি আপনারাও কিছু জানেন না। যাই হোক, অনেক কথা বলে ফেলেছি। গলা শুকিয়ে গেছে। এক কাপ চ্যা খেতে পারলে ভালো হয়। চা খাওয়াতে পারবেন?
চা খাবার সময় শাহ কলিমের দেখা হলো মরিয়ম এবং মাসুমার সঙ্গে। মাসুমাকে দেখে শাহ কলিমা খুবই বিস্মিত হলো। অতি রূপবতী মেয়ে। নাক সামান্য চাপা। এতেই যেন রূপ ফুটেছে। মেয়েটার কথাবার্তাও চমৎকার। কথা বলার এক পর্যায়ে সে ঘাড় কাত করে। চোখ পিটপিট করতে থাকে। দেখতে ভালো লাগে।
মাসুমা বলল, আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি সত্যি সত্যি একজন কবি।
শাহ কলিম বলল, আমি তো আসলেই কবি।
মাসুম বলল, যখন চাঁদ উঠে, তখন আপনি কী করেন? হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন?
আমি জোছনা দেখি। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো জোছনা দেখা যায় না। কোনো কবিই চাঁদ দেখেন না। তারা জোছনা দেখেন।
বলুন দেখি পূর্ণিমা কবে? যদি বলতে পারেন তাহলে বুঝব আপনি আসলেই কবি। জোছনার হিসােব আপনার কাছে আছে। আর যদি বলতে না। পারেন তাহলে আপনি ভু-কবি।
শাহ কলিম অবাক হয়ে বলল, ভু-কবি মানে কী?
মাসুমা বলল, ভু-কবি মানে ভুয়া কবি।
ও আচ্ছা।
আপনি কি রাগ করেছেন?
না।
রাগ করা উচিত ছিল, রাগ করেন নি কেন?
তুমি এমন একটি মেয়ে–যার উপর রাগ করা একজন ভু-কবির পক্ষে খুবই কঠিন।
কবি শাহ কলিম রাত আটটা পর্যন্ত থাকল। তার নিজের লেখা কবিতা মেঘবালিকাদের দুপুর গভীর আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করল। কবিতা আবৃত্তির মাঝখানে অবশ্যি মাসুমা দুইবার খিলখিল করে হেসে উঠল। এতে কবি হিসেবে শাহ কলিমের রাগ করা উচিত ছিল। সে রাগ তো করলেই না, বরং তার কাছে মনে হলো–এত সুন্দর শব্দ ও ঝংকারময় হাসি সে এর আগে কোনোদিন শুনে নি। তার মাথায় এক লাইন কবিতাও চলে এলো–
তার হাসি তরঙ্গ ভঙ্গের মতো শব্দময় ধ্রুপদী নদী
ধ্রুপদী শব্দটা যাচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না, তবে শব্দটা জুৎসই। ধ্রুপদীর শেষ অক্ষর দী, আবার নদীর শেষ অক্ষরও দী। মিলাটা ভালো।
কবি শাহ কলিম ঠিক করল, এই অসহায় পরিবারটিকে সে নিজ দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এখন সমস্যা না। শহরে রিকশা, ঠেলাগাড়ি সবই চলছে। শহর থেকে বের হলেই নৌকা। ট্রাক আছে, বাস আছে। সামান্য চেকিং মাঝেমধ্যে হয়, সেটা তেমন কিছু না।