রানু অবাক হয়ে বলল, রাত এগারটার সময় তুমি আমাকে এই খবরটা দিতে এলে?
ওসমান সাহেব চুপ করে রইলেন। রানুর পেছনে পেছনে অপলাও এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে কৌতূহল। সে বলল, কী ব্যাপার দুলাভাই? রানু কাটাকাটা গলায় বলল, তোর দুলাভাই ইদানীং লিখতে পারছে না। এই খবরটা দিতে এসেছে।
দুলাভাই ভেতরে এসে বসেন।
ওসমান সাহেব বসবার ঘরে এসে ঢুকলেন। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বসলেন সোফায়। চাপা। গলায় বললেন, টগর কী ঘুমুচ্ছে? রানু বলল, হ্যাঁ।
ওর শরীর ভাল আছে?
ভালই আছে।
এক কাপ চা খাওয়াতে পার রানু? প্রচণ্ড শীত বাইরে।
রানু কিছুই বলল না। অপলা বলল, আপনি আরাম করে বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি। আপা তুমি খাবে?
कां।
খাও না একটু। তিনি কাপ নিয়ে আসি; গল্প করতে করতে খাব।
রানু কড়া চোখে তাকাল অপলার দিকে। অপলা সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল। দুলাভাইয়ের হঠাৎ করে এই রাতের বেলা উপস্থিত হওয়াটা তার খুব ভাল লাগছে। কেমন যেন উৎসব মনে হচ্ছে তার কাছে। সে হালকা পায়ে চা আনতে গেল।
ওসমান সাহেব বললেন, রানু এক গ্লাস পানি খাব। রানু বলল, তোমার কী হয়েছে?
আমার কিছু হয়নি।
তোমাকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। অকারণে তুমি এত রাতে এখানে আসবে না। তোমার অহঙ্কারে লাগবে। কী হয়েছে, বল।
বাবা মারা গেছেন।
কখন?
রাতে। ঠিক টাইমটা বলতে পারব না। খেয়াল করিনি।
রানু দীর্ঘ সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ওসমান সাহেব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সিগারেট টানতে লাগলেন। এক সময় বললেন,
হঠাৎ করে বেশ শীত পড়ে গেল, তাই না বানু? নাকি শুধু আমার একারই শীত লাগছে?
শীত পড়েছে।
রানু উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। খোলা দরজায় ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। ওসমান সাহেব বললেন, তুমি কী যাবে আমার সঙ্গে? বাবা, তোমাকে খুব পছন্দ করতেন। রানু ঠাণ্ডা গলায় বলল, একটা মৃত্যু সংবাদ দিতে এসে তুমি নিজের লিখতে না পারার খবরটা আগে দিলে। লেখাটা কী এতই
রুরি?
তিনি কিছু বললেন না। রানু তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, লেখকরা অন্য মানুষদের চেয়ে আলাদা এটা আর যেই বিশ্বাস করুক আমি করি না।
আমি আলাদা এটা কখনো দাবি করিনি।
দাবি করতে হবে কেন? আচার-আচারণ দিয়ে তুমি বুঝিয়ে দিতে চাও তুমি আলাদা।
তাই কী?
হ্যাঁ তাই। তোমার বাবা মারা গেলেন। এটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার। অথচ তুমি নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে এসে বললে, রানু, আমি লিখতে পারছি না। এর মানে কী?
মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
একজন লেখক লিখতে না পারলে বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো ক্ষতি হবে না।
বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি নিয়ে আমি ভাবি না। আমি আমার নিজের কথাই ভাবি।
এটা ঠিকই বলেছ। নিজেকে ছাড়া তুমি আর কিছুই ভাবতে পার না।
রানু উঠে দাঁড়াল। ওসমান সাহেব বললেন, চলে যাচ্ছ নাকি?
কাপড় বদলে আসি। যেতে হবে না? তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে?
আছে। মিলির গাড়ি নিয়ে এসেছি।
ওরা গাড়ি কিনেছে নাকি?
জানি না কিনেছে কী না।
তা জানবে কেন?
অপলা চায়ের কাপ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, দুলাভাই আমার খারাপ লাগছে। আমি বুঝতেই পারিনি। আপনি একটা মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছেন।
তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, তোমাকে অন্য রকম লাগছে কেন আপলা?
কী রকম?
একটু যেন অচেনা লাগছে!
শাল গায়ে দিয়েছি তো সেই জন্যে। আপনি আমাকে শাল গায়ে দেয়া অবস্থায় কখনো দেখেননি।
তোমরা কখন কোন পোশাক পরে কার সামনে গিয়েছ এটা কী মনে রাখ নাকি?
অপলা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল, হাসতে হাসতেই বলল, চা-টা ভাল হয়েছে দুলাভাই?
খুব ভাল হয়েছে। চমৎকার। বাস অপলা।
অপলা বসল। তার সামনে। তার মুখ হাসি হাসি। চোখ চিকমিক করছে। এর মানে হচ্ছে ওসমান সাহেবের চেহারায় কোনো দুঃখের ছাপ নেই। ছাপ থাকলে আপলা এমন খুশি খুশিভাবে তার সামনে এসে বসত না। একজনের দুঃখ অন্য জনের ওপর ছায়া ফেলে। ওসমান সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল।
অপলা তুমিও চল আমাদের সঙ্গে?
কোথায়?
আমাদের বাড়িতে। টগরকেও নিয়ে চল।
আপনি রানু আপাকে বলুন। আপা রাজি না হলে তো যাওয়া হবে না।
রানুকে কিছু বলতে হল না। সে এসে অপলাকে তৈরি হতে বলল। টগরের ঘুম ভাঙিয়ে কাপড়-জামা পরাতে বসল। টগর কিছুই বলল না। যেন রাত দুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে কাপড়-জামা পরানোটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। শিশু সুলভ কোন কিছুই তার মধ্যে নেই। এ রকম হচ্ছে কেন ছেলেটা?
রানু বলল, টগর আমরা তোমার দাদার বাড়িতে যাচ্ছি।
আচ্ছা।
তোমার দাদা মারা গেছেন।
টগরকে এবার কৌতূহলী হতে দেখা গেল। সে চোখ বড় বড় করে তোকাল। রানু বলল, মানুষ যখন খুব বুড়ো হয় তখন তারা মারা যায়।
বাচ্চারা মারা যায় না?
টগর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাচ্চারাও মারা যায়। আমি দেখেছি।
কোথায় দেখলে তুমি?
টগর কোন উত্তর দিল না। রানু তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কোথায় দেখলে তুমি বল শুনি।
বলব না।
বলবে না কেন?
বলতে ইচ্ছে করছে না।
তারা বাড়িতে পৌঁছল একটার দিকে। টগরের চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। সে অপলার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে দেখছে চারদিকে। মাঝে মাঝে ফিসফিস করে আপলার কানে কানে কি যেন বলছে এবং অপলা বিরক্ত হচ্ছে।
লোকজন বাড়িতে অনেক কম। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনই চলে গেছেন। যারা আছেন তাদের একটা বড় অংশ বসার ঘরে ঝিমুচ্ছে। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। আগের জমজমাট ভাব এখন আর নেই। চারদিকে মোটামুটিভাবে নিঃশব্দ। শুধু মওলানা সাহেব এখনো ক্লান্তিহীন। তিনি আগের মতই সুরেলা গলায় কোরান শরীফ পড়ছেন। সারা রােতই হয় তো পড়বেন।
ওসমান সাহেবের মনে হল এই মওলানা সাহেব এর আগেও নিশ্চয়ই অনেক মৃত মানুষের পাশে বসে কোরান শরীফ পড়েছেন। সমস্ত ব্যাপারটিতেই এখন তিনি অভ্যস্ত। এটা তার একটা রুটিন কাজ। অথচ মনে হচ্ছে কী গভীর আবেগ নিয়েই না। তিনি কোরান শরীফের আয়াত পড়ে যাচ্ছেন, একটির পর একটি। লেখকরাও তো অনেকটা সে রকম। রুটিন মত লিখতে বসেন। পাঠকরা সে লেখা পড়ে মনে করে কী গভীর আবেগ ও মমতা নিয়েই না লেখাগুলি লেখা হয়েছে। পাঠকরা হাসে ও কাঁদে।
ওদের ঢুকতে দেখে বীথি এগিয়ে এল। টগরকে বলল, বাবু তুমি আমার কোলে আসবে? টগর দুহাত বাড়িয়ে দিল; যেন এর জন্যেই অপেক্ষা করছিল। অথচ বীথির সঙ্গে তার পরিচয়
নেই। বীথি রানুকে বলল, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, বাবুকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। রাতটা নিশ্চয়ই থাকবেন?
হ্যাঁ থাকব।
আপনার জন্য একটা ঘর গুছিয়ে রেখেছি।
রানু বীথির সঙ্গে দোতলায় উঠে গেল। অপলা বলল, এই মেয়েটি কে দুলাভাই?
আমার বাবার সেক্রেটারি। বীথি।
আশ্চর্য এমন সুন্দর মানুষ হয়?
খুব সুন্দর নাকি?
হ্যাঁ।
অপলা খুব অবাক হয়েছে। ওসমান সাহেবের মনে হল সৌন্দর্য ব্যাপারটা পরিবেশ নির্ভর। গভীর রাতে অপলা একটি অপরিচিত বাড়িতে এসেছে। সে বাড়িতে একটি মৃতদেহ আছে। স্বভাবতই আপলার মনে ভয় এবং সংশয় ছিল। সে নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিল এ বাড়িতে এসে সে দেখবে চারদিকে সবাই কাঁদছে। এ রকম কিছু সে দেখেনি। সে দেখেছে বীথিকে। যার মুখে অন্য ধরনের একটি স্নিগ্ধতা আছে। যার কাধে হালকা নীল রঙের চাদর; পরনের শাড়ি সাদা রঙের। ছবিটি সুন্দর। কাজেই অপলার মনে হয়েছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রমণীটিকে দেখেছে। দিনের আলোয় এ রকম মনে হবে না। কিংবা হয়ত হবে। মনের ওপর প্রথম যে ছাপটি পড়ে তা দীর্ঘদিন থেকে যায়।
আপলা হাঁটতে লাগল ওসমান সাহেবের পিছু পিছ। একবার স্বাক্ষীণ স্বরে বলল, বিরাট বাড়ি আপনাদেরই দুলাভাই। রাজপ্রাসাদের মত। এটাও একটা আপেক্ষিক কথা। রাতের জন্যে বাড়িটি প্রকাণ্ড মনে হচ্ছে। দিনের আলোয় আর সে রকম মনে হবে না।
অপলা।
বলুন।
কাল আমি ডেডবডি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাব। ঐ বাড়িটিও খুব সুন্দর। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
আপলা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ দুলাভাই আমি যাব। তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মওলানা সাহেব এক মনে কোরান পাঠ করছেন। সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন এ বাড়িতে একটি মৃত্যু ঘটেছে।
টগরকে ঘুম পাড়িয়ে রানু নিচে আসছিল। সিঁড়ির গোড়ায় এসে থমকে দাঁড়াল। বারান্দার রেলিং ধরে অপলা দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই ওসমান। দুজনের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে অন্যরকম কিছু একটা আছে। রানুর বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগল।