তা -কৈ য়েহ দপ্ত-গর্দী কব তক
য়হ্ খস্তগী;
ইস্ জিন্দগীসে কুছ তুমে হাসিল হ্যায়, মর কহীঁ।
(এই মাঠে ঘাটে ঘোরা আর কত দিন, কত দিন এই ছন্নছাড়া দশা?
এমনভাবে বেঁচে থেকে কী হবে, মরলেই পারো।)
যুবক রোহিত কে দেবরাজ ইন্দ্র যা বলেছিলেন, সে কথাই আপনাদের বলছি, ভাইজানেরা, মন দিয়ে শুনুন। এ হচ্ছে জীবনটাকে নিয়ে একেবারে পথে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা; কজন মানুষই। বা তা পারে? যদি কেউ একবার তা পারে, তবে তার চোখের সামনে থেকে সব পর্দা সরে যাবে, তখন বোঝা যায়, মান্টোভাই, কী লীলাখেলার মধ্যেই না আমরা এসেছি। হ্যাঁ, দেবরাজ ইন্দ্রের কথাই বলি। রোহিতকে তিনি বললেন, মনে রেখো, পথে যে বেরিয়ে পড়তে পারে না, তার জীবনে সুখ আসে না। মানুষের সমাজে বেশীদিন থাকলে ভাল মানুষও একদিন পাপী হয়ে যায়। তাই বলি, পথে গিয়ে দাঁড়াও, ভ্রমণের ভিতরে খুঁজে নাও জীবনকে। পথিকের দুই চরণ ফুলের মতো, তার আত্মাও দিনে দিনে বিকশিত হয়ে কত যে ফল ফলিয়ে তোলে। পথের ক্লান্তিই তার সব পাপকে সমূলে বিনাশ করে। তাই, ঘোরো, ঘুরে বেড়াও, রোহিত।
তিন বছরের মতো শাহজাহানাবাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে পেরেছিলাম বলেই কত যে ফুল-ফলে। ভরে উঠেছিল আমার জীবন। কষ্ট কিছু কম হয়নি, অপমানও অনেক হজম করেছি, শেষ পর্যন্ত পেনশনের টাকাও আদায় করতে পারিনি। তবু এই তিন বছর এক আজিব তসবিরখানায় ঘুরে বেড়িয়েছি। দিল্লিতে যখন ফিরে এলুম, তখন আমি অন্য এক মানুষ; কেন জানেন? তার আগে আমার দুর্ভাগ্যের জন্য নানা মানুষকে, এমনকী খোদার ওপরেও দোষ চাপিয়েছি। কিন্তু দেশে দেশে ঘুরে যে-গালিব দিল্লিতে ফিরে এল, সে বুঝে গিয়েছিল, জীবন তোমার কাছে যেভাবে আসবে, সেভাবেই তাঁকে গ্রহণ করো, যদি পোকার মত মরতে হয়, তা-ও মরবে, নালিশ জানিয়ে বাড়তি কিছু পাবে না।
না, না, উতলা হবেন না ভাইজানেরা, এবার আমার ভ্রমণের কিস্সাই আপনাদের শোনাব। এক-একসময় ভেবেছিলাম, এই দিনগুলোর কথা ফারসিতে লিখে রাখতে হয়। কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি। তার চেয়েও বড় কথা, দিল্লিতে ফিরে আসার পর সারা জীবনের জন্য এমন সব জালে জড়িয়ে গেলুম যে, লিখতে বসার কথা ভাবলে হাত নড়তে চাইত না। কিন্তু আমি জানি, সেই দিনগুলোর কথা লিখে রাখতে পারলে ফারসি গদ্যে আমি এক নতুন দুনিয়া খুলে দিতে পারতুম। আসুন, আপনাদের সঙ্গে মির্জার ভ্রমণবৃত্তান্তটা আমিও একবার ফিরে চোখে দেখি।
১৮২৭-এর বসন্ত। মির্জা গালিব শাহজাহানাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়ল তার ভাগ্যের খোঁজে। তার পূর্বপুরুষেরা বেরিয়ে পড়ত অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে; ধুলোর ঝড় তুলে, তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে, সে তো বীর সৈনিকদের যাত্রা। আর মির্জা গালিব তো কলকাতা চলেছে, তার পেনশনের জন্য দরবার করতে। সঙ্গে দু-তিনজন চাকর বই আর কেউ নেই। কখনও ঘোড়ায়, কখনও গরুর গাড়িতে চেপে তার টিকিয়ে টিকিয়ে চলা। রাতে কোন সরাইখানায় থাকো, যদি তা না মেলে, তবে পথেই তাঁবু খাঁটিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করে নিতে হবে। দিনের বেলা তবু একরকম, সামনে অনন্ত পথ, কিন্তু রাতগুলো তো একেবারে অন্ধকারে জমাট বাঁধা, পথের কোন হদিশ নেই, চাকরবাকরের সঙ্গে কতক্ষণ আর কথা বলা যায়, তাই নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলো। মির্জার একা-একা কথা বলার মানে কী জানেন তো,ভাইজানেরা। কথার পর কথায় আপনি কেবল নিজেকেই ঠকিয়ে যাবেন, কত স্বপ্নের মিনার বানিয়ে তুলবেন, পরের মুহূর্তেই সে মিনার চুরচুর করে ভেঙে পড়বে।
কানপুরে পৌঁছে মির্জার শরীরটা বেশ খারাপ হয়েছিল। এদিকে কানপুরে কোন হাকিমের দেখা মেলে না। তা হলে লখনউ না গিয়ে উপায় নেই। এ-যাত্রায় লখনউ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। মির্জার। তবে মির্জা কলকাতা যাচ্ছে শুনে লখনউয়ের বহু শরিফ আদমি জানিয়েছিলেন, পথে একবার আমাদের শহরটাও ঘুরে যান। লখনউ-এর প্রতি মির্জারও লোভ কম ছিল না। দিল্লি কবেই তার রোশনাই হারিয়ে ফেলেছে। মুঘল সংস্কৃতির যা-কিছু সবই লখনউতে। কবেই সওদা, মীরসাবের মত কবিরা দিল্লি ছেড়ে লখনউতে চলে গিয়েছেন। মির্জা ভেবে ঠিক করল, লখনউটা একবার ঘুরেই যাওয়া যাক। নবাবের কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু ইনাম মিলবে, দুএকটা মুশায়েরায় গজল শুনিয়েও রোজগার হবে; পথের খরচ কিছুটা জোগাড় হয়ে যাবে। পাল্কি ভাড়া করা হল, সেই পাল্কিতে চেপে গঙ্গা পেরিয়ে লখনউ পৌঁছল মির্জা।
কী বলব,ভাইজানেরা, সেই লখনউকে বুঝিয়ে বলার মতো ভাষা আমার ঝুলিতে নেই। শুধু একটা কথাই বলতে পারি, এ-শহর যেন হিন্দুস্থানের বাগদাদ। আর রাতের লখনউ-এর কথা কী বলব? তাকে তো পরতে পরতে আদর করতে ইচ্ছে করে, প্রত্যেকটা রাত যেন নতুন নতুন সুরতের রাত, প্রত্যেকটা চুম্বনের পরেও যেমন আরও অনেক চুম্বন বাকি থেকে যায়, তেমনই আকাক্ষা নিয়ে জেগে থাকার রাত। সেই শহরের সেরা কবি তখন কে জানেন? নাসিখসাব। গজল ছাড়া কখনও কিছু লেখেনে নি। আমার প্রথমদিকের গজলে নাসিখসাবের ছায়া খুঁজে পেলেও পেতে পারেন। নাসিখসাব তাঁর হাভেলিতে আমাকে দাওয়াত দিলেন। আমি তাঁকে বললুম, নবাবের কাছে একবার যাওয়া যাবে না নাসিখসাব।
-আগের সে দিন আর নেই মিঞা।
-মানে? নবাব আমার সঙ্গে দেখা করবেন না।
-এখন অনেক মই বেয়ে তাঁর কাছে পৌঁছতে হয়।
-কীরকম?
-নবাবের উজির-এ আজম হচ্ছেন মোতামিদদৌলা আগা মীর। তাঁর পরের উজির সুলতান সুভান আলি খান। সুভান আলিকে খুশি করে পৌঁছতে হবে আগামীর সাবের কাছে। তিনি খুশ হলে তবে গিয়ে পৌঁছবেন নবাবের সামনে। এ তো আর নবাব আসফ-উদ-দৌলার আমল নয়, তিনি সওদাসাবকে নিজে দরবারে ডেকে নিয়েছিলেন। বেগম শামসউন্নিসাও ছিলেন শায়রা। নবাবের এক গজলের উত্তরে বেগম কী লিখেছিলেন জানেন?
-শুনাইয়ে জনাব।
-খুশি দিল মে হম্ অপনে কম
দেখতে হ্যাঁয়
অগর দেখতে হ্যাঁয় তো গম দেখতে হ্যাঁয়
ন কহ কোই খুন কা বাকী হ্যায় দিল মে
ন আঁখো কো হম্ অপনী নম্ দেখতে হ্যায়।
তু আয়ে ন আয়ে য়হাঁ হম্ তো হর শব্
পড়ে বাহ্ তা সুবহুদম দেখতে হ্যাঁয়
-কেয়া বাত, কেয়া বাত। দিল কা এক টুকরা নিকল গয়া জনাব।
-মিঞা, আমাদের নবাব গাজি-উদ-দীন হায়দরের সময়ে দিল কা টুকরা নিকলতে নেহি।
–হায় আল্লা! তবু একবার চেষ্টা করে দেখুন। গরিবের কপালে যদি কিছু টাকা-পয়সা জোটে।
-জানি মিঞা, অনেক দূরের পথ যেতে হবে আপনাকে। চেষ্টা করি দেখি। আগে তো সুভান আলির কাছে যেতে হবে। সুভান আলির সামনে তো পৌঁছতে পারলুম। তাড়াহুড়োয় তাঁর জন্য কসীদা লিখে নিয়ে যেতে পারিনি, স্তুতি করে একটুকরো গদ্য লিখতে পেরেছিলুম। কিন্তু কী জানেন, কসীদা লিখতে আমার ভাল লাগত না; তবু লিখতে তো হয়েছে। সত্যি বলতে কী, জীবনে অর্ধেকটা সময় নবাব-বাদশা তাঁদের উজিরদের স্তুতি করে কবিতা লিখেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, মান্টোভাই। ওই গাধাগুলোর প্রশংসা করে কবিতা লেখার জন্য কি একজন কবির জন্ম হয়? তবু কী করব বলুন, পেটের ধান্দায় কবিতাকে কিচরে নামাতে হয়েছে। এ তো কবির ধর্ম হতে পারে না। কবির ইমানের পথ থেকে যে সরে গিয়েছি, তা আমি জানি। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন। কসীদার শুরুটা আমি যেমন মনপ্রাণ দিয়ে লিখেছি, স্তুতির অংশে এসে কিন্তু দায়সারা কয়েকটা কথা বলেছি মাত্র। সুভান আলি আমার গদ্যটুকু পড়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। একে-ওকে নানা কথা বলতে লাগলেন। আমার দিকে আর ফিরেই তাকান না।
-জনাব।
-আর্জি কি আছে মিঞা?
-নবাব বাহাদুরকে একবার সালাম জানাতে চাই।
-জানাইয়ে, ইয়ে তো নবাব বাহাদুরকাই দুনিয়া হ্যায়।
-একবার দরবারে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন হুজুর।
-দেখি, কী করা যায়।
-তবে দুটো কথা আছে জনাব।
-আবার কী?
-আমি শাহজাহানাবাদের শায়র। দরবারে সেই মর্যাদাটুকু পাব আশা করি। বুজুর্গ আদমিরা কবিদের কিভাবে আপ্যায়ন করেন, সে তো আপনি জানেনই।
-দেখি
-অওর
– আরও কথা আছে নাকি?
-নবাব বাহাদুরকে কিন্তু কোন নজরানা দিতে পারব না। ওটা মাফ করে দিতে হবে।
সুভান আলি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আয়েশ করে পান চিবোতে চিবোতে বললেন, বাড়ি ফিরে যান মিঞা। নজরানা দেবেন না, আবার নবাব বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করবেন, তা হয় নাকি? দরবারে আসার তারিকা জানেন না বুঝি?
নবাব গাজি-উদ-দীন হায়দরের সঙ্গে দেখা হল না মির্জার। অনেক আশা ছিল, নবাবের সামনে। একবার দাঁড়াতে পারলে, কিছু তো ইনাম মিলবেই। সুবান আলি সেই আশায় জল ঢেলে দিল। মির্জা তবু আরও কিছুদিন লখনউতে রয়ে গেল। লখনউয়ের মুশায়েরার রাতগুলো তো তাঁকে ফিরিয়ে দেয়নি, তার গজলের প্রশংসায় মেতে উঠেছে, সেইসব আলাপ-আলোচনায় মির্জা বুঝেছে, মরে যাওয়া দিল্লি তার কদর করতে না পারলেও, লখনউ-এর জান তার কবিতায় সারা দিয়েছে।
তারপর আবার বেরিয়ে পড়ো। বান্দা, ইলাহাবাদ হয়ে কাশীতে এসে পৌঁছলুম। বান্দার নবাব জুলফিকার আলি বাহাদুর পথখরচের জন্য কিছু সাহায্যও করলেন আমাকে। ইলাহাবাদকে আমি একদম সহ্য করতে পারিনি, মান্টোভাই। একেবারে লাওয়ারিশ শহর, কোনও তমদুন নেই। কাশীতে পৌঁছে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারলুম। এ এক আশ্চর্য আলোর শহর। মনে হল, এইরকম এক শহরেই আমি এতদিন পৌঁছতে চেয়েছি। সবাই বলে বেনারস, বেনারস; আমার ঘেন্না হয়, ইংরেজরা বলে বলেই আমাদেরও বলতে হবে না কী? হয় বারাণসী বলল, নয়তো কাশী। কাশী নামেই তো এ শহরের আসল পরিচয়। নওরঙ্গাবাদে একটা হাভেলিতে ঘর ভাড়া নিয়ে আমি মাসখানেক কাশীতে ছিলুম। দশাশ্বমেধঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাটে বসে। থাকতে থাকতে মনে হত, দেবাদিদেব মহেশ্বরের এই শহরেই যদি সারাজীবন থেকে যেতে পারতুম। তা হলে তো আর নবাব -বাদশার দয়ার ভিখারি হতে হত না, গজল লিখতাম না, শুধু কাশীর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, তবায়েফদের গান শুনে, সকাল-সন্ধ্যায় পূজো-আরতি দেখতে দেখতে আর ঘাটে বসে গঙ্গাপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে থেকে কেমন রাহীর জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত।
ভাইজানেরা বিরক্ত হবেন না, কাশীর কথাটা একটু খোলসা করে বলতে হবে। জীবনে যে একবার কাশী দেখেন নি, আমি মনে করি, তার এখনও জন্মই হয় নি। মান্টোভাই, আপনি কি কাশীতে গিয়েছেন কখনও? যাননি? তা হলে আবারও আপনার জন্ম হবে, কাশী একবার দেখে আসতেই হবে আপনাকে, তবেই না বুঝবেন এই দুনিয়াতে একদিন জন্ম হয়েছিল আপনার! কী বলছেন? আপনার আগের জীবনটা? না, না, ও তো একটা খোয়াব মান্টোভাই, শুনুন, আপনি এখনও জন্মাননি। কাশী দেখার পরেই না বুঝতে পারবেন জন্ম-মৃত্যুর অর্থ কী?
বলতে পারেন, কাশীই এই গোটা দুনিয়াটা। ভারতের সব তীর্থস্থান আর পবিত্র জল, সব মিলেই কাশী, আলোর শহর, ভাইজানেরা। দেবাদিদেব শিবের ঘরগেরস্থালি এখানেই। কাশী এমন এক আলো, যা আপনার চোখের সামনে সব কিছু ফুটিয়ে তোলে; না, না চমকদার কিছু দেখতে পাবেন, ভাববেন না; এই দুনিয়ায় যা রয়েছে সে সবই ওই আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাবেন আপনি। আবার দেখুন, কাশীতে যদি মৃত্যু হয়, তবেই এই জীবজন্ম থেকে মুক্তি পাব আমরা। কাশী মাহাত্ম্যের কত কথাই যে শুনেছিলুম; আমি দোজখের কীট, সে-সব কথা কবেই ভুলে গিয়েছি। তবে হ্যাঁ, মণিকর্ণিকার জন্মের কিস্সাটা ভুলিনি, মান্টোভাই। যেদিন কোঠায় না। যেতুম, বা কোঠায় গেলেও, সেখান থেকে বেরিয়ে আমি রোজ মণিকর্ণিকার ঘাটে গিয়ে বসতুম। মণিকর্ণিকা হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে এই পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধ্বংস এক হয়ে মিলে গিয়েছে। কেন জানেন? সময়ের একেবারে শুরুতে ভগবান বিষ্ণু এখানে তৈরী করেছিলেন পবিত্র কুণ্ড, আর এখানেই মহাশ্মশান, সময়ের শেষে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মণিকর্ণিকার জন্মের কথাটা শুনবেন নাকি, ভাইজানেরা? একমাত্র আমাদের দেশই বলতে পেরেছে, পুণ্যের কথা শুনলেও তোমার পাপ অনেকখানি লাগব হবে।
সে একসময় ছিল, না, না, ভুল বলছি, তখনও তো সময়ের জন্ম হয় নি, শুধুই ছিল অন্ধকার আর জলস্রোত। আকাশে সূর্য-চন্দ্র নেই; গ্রহ নক্ষত্রই বা আসবে কোথা থেকে? দিন-রাত্রী বলে কিছু নেই। শব্দ-গন্ধ -স্পর্শ -স্বাদ -আকার, কিছুই ছিল না। শুধু ছিলেন তিনি, অনাদি ব্ৰহ্ম, যাঁকে কোনও কিছু দিয়েই ধরাছোঁয়া যায় না। কিন্তু সেই অসীম নৈঃশব্দ্য, গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কতদিন তিনি একা একা থাকবেন? তাই তিনি সৃষ্টি করলেন একজন ঈশ্বরকে। তিনিই শিব। শিবের অংশ থেকে জন্ম নিলেন শক্তি, তিনি প্রকৃতি ও মায়া। তারা দুজনে মিলে তৈরী করলেন পাঁচ ক্রোশের ভূখণ্ড কাশী। একদিন শিব ও শক্তি ভাবলেন, যদি আরেকজন কাউকে সৃষ্টি করা যায়, যে তৈরী করবে পৃথিবী, তার রক্ষণাবেক্ষণও করবে। তখনই জন্ম হল বিষ্ণুর। শিব ও শক্তি পৃথিবীর সবকিছু তৈরি করার জন্য বিষ্ণুকে নির্দেশ দিলেম।
বিষ্ণু কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। সুদর্শন চক্র দিয়ে এক পদ্মকুণ্ড তৈরি করলেন, তার শরীরের ঘামেই ভরে উঠল পুকুর, চক্ৰপুষ্করিণীর তীরে পাথেরের মত বসে থেকে তপস্যায় ডুবে গেলেন। দেখতে দেখতে চলে গেল পাঁচ লক্ষ বছর। হাঁ করে আছেন কেন, ভাইজানেরা? ওদের কাছে লক্ষ কোটি বছর তো কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। এ এক অদ্ভুত মজা।
একদিন শিব ও শক্তি এই পথে এসে বিষ্ণুকে দেখতে পেলেন। তপস্যার প্রভাবে বিষ্ণু যেন অগ্নশিখার মত জ্বলছেন। শিব তাঁকে বরপ্রার্থনা করতে বললেন, বিষ্ণু বললেন, আর কিছু চাই না ভগবান, শুধু আপনার কাছকাছি থাকতে চাই। বিষ্ণুর ভক্তি দেখে শিব এমন আনন্দে মাথা নাড়লেন যে তার কানের অলঙ্কার-মণিকর্ণিকা গিয়ে পড়ল চক্ৰপুষ্করিণীর জলে। বিষ্ণুকে তথাস্তু বলে শিব আরো বললেন-এখন থেকে এই চক্ৰপুষ্করিণীর নাম হবে মণিকর্ণিকা। এই ঘাটের শ্মশানেই মানুষ তার পার্থিব শরীরটাকে তুলে দেয় মৃত্যুর হাতে, তারপর অন্য শরীর পেয়ে ঊধ্বলোকে চলে যায়। মান্টোভাই, মধ্যরাত অবধি আমি মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে থাকতুম, একের পর এক জ্বলন্ত চিতার লেলিহান শিখা দেখতুম, আর মনে হত, আবার যদি এক জন্ম পাই, তবে যেন আমার শরীর এমন চিতাতেই পোড়ানো হয়, আমি যেন অন্তরীক্ষে মিশে যেতে পারি। লোকের মুখে মুখে কত যে কিস্সা শুনেছি। একবার একজন বলেছিল, অন্য জায়গায় রাজা হওয়ার চেয়ে কাশীর রাস্তায় গাধা হয়ে ঘুরে বেড়ানো, আকাশে পাখি হয়ে ভেসে থাকা অনেক পুণ্যের।
না, ভাইজানেরা, শুধু মৃত্যুর কথা আপনাদের শোনাতে বসিনি। মৃত্যুর অন্যপিঠে যা, আমাদের কাম, সে-কথা না বললে তো কাশির বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ হয় না। কাম শুধু নারীর শরীরে থাকে না, সংগীতে-নৃত্যে-হাওয়ার স্পর্শে-সৌরভে, সবকিছুতেই রয়ে গিয়েছে কাম; আমাদের কামনা বাসনার কত যে কিস্সা। কাশীর তবায়েফদের কোনও তুলনা নেই, মান্টোভাই, সে সৌন্দর্য বলুন, আর ভালবাসার প্রকাশই বলুন। ভগবান বুদ্ধদেবের সময়ের একজন তবায়েফের কথা শুনেছিলুম। তিনি এক রাতে যে টাকা নিতেন, তা নাকি কাশির রাজার একদিনের রাজস্বের সমান ছিল। মৃত্যুর পাশাপাশি এ অন্য এক কাশী, তার শরীরে কামনার কত যে চন্দনপ্রলেপ। এই কাশী যেন নিজেই যেন এক নারী। না হলে কাশী ছেড়ে গিয়ে ঋষি অগস্তের ওই দশা কেন হবে বলুন? কাশী ছেড়ে অগস্ত্যকে দক্ষিণ ভারতে যেতে হয়েছিল। গোদাবরীর তীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেও কাশির জন্য বিরহ তিনি সহ্য করতে পারেননি। উত্তর দিক থেকে ভেসে আসা হাওয়াকে জড়িয়ে ধরে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, বলো তো আমার কাশী কেমন আছে? আমিও কাশীতে এসেই একজনের জন্য লিখেছিলুম,
ফির কুছ এক দিলকো বেকারারী হ্যায়,
সিনহ্ জুয়া-এ জখমকারী হ্যায়।।
(হৃদয় আবার অশান্ত
সে খুঁজছে কোনও আততায়ীকে।)
মাফ করবেন, মান্টোভাই, তার নাম আমার মনে নেই, কিন্তু গোরে যাওয়ার দিন তক্ সেই ছুরি। আমার হৃদয়ে বিঁধে ছিল। তার কাছে কত কিস্সা শুনেছি; সত্যি বলতে কী, শোওয়ার জন্য নয়, তার সৌরভ আর কিস্সা শোনার জন্যই তার কাছে যেতুম আমি। তার কাছে কুট্টনীমত কাব্যের কথা শুনেছিলাম। দামোদর গুপ্তের নাম শুনেছেন? কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড়ের প্রধানমন্ত্রী তিনি, অনেক বয়েসেই লিখেছিলেন কুট্টনীমত। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-এর পরে যেসব কামশাস্ত্র পাওয়া যায় তাদের মধ্যে প্রাচীনতম। এই কাব্যের কাহিনী লেখা হয়েছে। কাশীকে ঘিরেই। কেমন সে নগরী? ভাইজানেরা, মাফ করবেন, সে-নগরীর কথা আমাদের। ঘেয়ো ভাষায় বলা সম্ভব নয়; মনে করুন দামোদর গুপ্ত আজ আমাদের মাঝে এসে বারাণসী ও তার বারাঙ্গনাদের রূপবর্ণনা করছেন। এবার কবি দামোদর গুপ্তের মুখেই শুনুন :
-অনুরাগে রঞ্জিতা নারীর বাঁকাচোখের চাহনিতে যে কামনা বাসা বাঁধে, রতির পদ্মমুখে যে কামনা ভ্রমরের মতো বারবার চুম্বনে আগ্রহী সেই কামনার অধীশ্বর মদনদেবের জয় হোক।
নিখিল বিশ্বের অলঙ্কারস্বরুপ প্রভূত ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত নগরী বারানসী ব্ৰহ্মজ্ঞ পণ্ডিতদের সমাবেশে সমুজ্জ্বল। এই নগরীর মহিমা এমনই ঐতিহ্যমণ্ডিত যে সেখানকার মানুষ ঐশ্বর্যভোগে আসক্ত হলেও জটাজালে চন্দ্ৰশোভিত মহাদেবের সঙ্গলাভ তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য নয়। এই বারানসী নগরীর বারবনিতাগণ বহুস্ব- স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত থাকেন। তাঁরা ঐশ্বর্যশালিনী এবং সর্বদাই নাগর পরিবেষ্টিত হয়ে সময় কাটান। তাদের দেহসৌষ্ঠব পশুপতির মতোই কোমল ও সুন্দর। সেখানকার আকাশ্রুম্বি দেবালয়গুলির শিখরে চিত্রিত পতাকাসমূহ বাতাসে আন্দোলিত হওয়ায় নভোদেশ পুস্পিত উদ্যানের মতই সুন্দর শোভমান। বনিতাদের ইতস্তত ভ্রমণে ধরণীতল তাদেরই পদতলের রক্তরাগে রঞ্জিত। দেখে মনে হয়, ভূমিতল বুঝি স্থলপদ্মে ঢাকা। আকাশ-বাতাস মুখরিত তাদের ভূষণ-শিঞ্জনে, ফলে পাঠরত ছাত্রদের ঘটে পাঠস্থলন যা আচার্যগণ শোধন করতে অক্ষম দেবদেবী অধ্যুষিত স্বর্গের অমরাবতী নগরী যেমন নন্দন বনের সমারোহে শোভিত এবং বহু দেবসেনায় সেবিত, ঠিক সেইরূপ বারাণসী নগরীও বহু বিদগ্ধমানুষের অধ্যুষিত এবং প্রবাহমান গঙ্গার সেবায় তুষ্ট হয়ে বিশ্বস্রষ্টার নির্মিত জগতের মাঝে আর এক অমরাবতীর মতোই বিরাজমান।
এবার মালতীর কথা বলছেন দামোদর গুপ্ত, মন দিয়ে শুনুন ভাইজানেরা, এ-কাব্য কবেই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
-এই বারাণসীতেই বাস করত মালতী নামে এর বারবনিতা। কামদেবের ঈর্ষণীয় শরীরী শক্তির মতোই বারাঙ্গনাকুলের ঈর্ষাপ্রদ অলঙ্কারের নাম মালতী। গরুড়কে দেখে গর্তবাসী নাগিণীদের যেমন শোক জেগে ওঠে, তাঁকে দেখেও তেমনই বিলাসিনী বারাঙ্গনাদের হৃদয় ইর্ষায় কাতর হয়। হিমালয়-কন্যা পার্বতী যেমন দেবেশ্বর মহাদেবের হৃদয় আকৃষ্ট করেছিলেন, মালতীও সেইরূপ ধনপতিদের হৃদয় আকর্ষণ করত। সমুদ্র মন্থনকালে শেষনাগের মন্থনরঙ্কুতে মান্দার পর্বত যেমন আবদ্ধ হয়েছিল, ভোগীদের চোখও তেমনই সর্বদা মালতীর প্রতি আবদ্ধ থাকত। শিবের শূলের ওপর আসীন অন্ধকাসুরের দেহের মতোই মালতী ছিল গণিকাবৃন্দের শীর্ষস্থানীয়া। সে ছিল স্মিতভাষী, লীলাময়ী, প্রেমাশ্রয়ী, পরিহাসপ্রিয়া ও বাকচাতুর্যে পারদর্শী। একদিন ছাদে বিচরণ করতে করতে মালতী একটা গান শুনতে পেল–
দূরে ফেলে দাও কামিনী তুমি
রূপমহিমা আর মক্তযৌবন
কৌশল করো যতনে এবার
কামুকহৃদয় করিতে হরণ।
গান শুনে বিপুলজঘনা মালতীর মনে হল, যে ওই গান গাইছে, সে আমার বন্ধুর মতোই উপদেশ দিয়েছে। কামবিলাসী পুরুষগণ যার ঘরে দিন-রাত পড়ে থাকে, সংসারের সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞা সেই বিকরালার কেছেই এবার পরমর্শ নিতে হবে।
বিকরালা কে জানেন, মান্টোভাই? সে এক বুড়ি বেশ্যা। দাঁত নেই, চামড়া ঝুলে পড়েছে, স্তন শুকিয়ে গেছে, মাথায় কয়েকটা মাত্র সাদা চুল। কিন্তু তাঁকে ঘিরে থাকে সব গণিকারা। কেন? কীভাবে যোগ্য পুরুষ বাছবে, কেমনভাবে তার মন হরণ করবে, সেই পরমর্শের আশায়। শুনে আমার মনে হত, জীবন্ত কামনা-বাসনারা সব মৃত্যুর দরজায় এসে দাড়িয়েছে, একমাত্র মৃত্যুই যেন তাদের বলে দিতে পারে, কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। তাই মালতীর মতো বারাঙ্গনাকেও বিকরালার কাছে যেতে হল।
একদিকে কামনা-বাসনার কোঠি, অন্যদিকে মৃত্যুর মণিকর্ণিকা-একসঙ্গে শুধুমাত্র কাশীই ধারন করতে পারে। ঋষি নারদের এক আশ্চর্য কিস্সা শুনেছিলুম। এ হল গিয়ে ভৈরবী-যাতনার কথা। যেন স্বপ্নের মধ্যে পেরিয়ে এলুম অনেক জীবন। কামনা বাসনা মৃত্যু, সব সেখানে একাকার।নারদের গল্পটা না বললে ভৈরবী-যাতনার কথা বুঝতে পারবেন না, ভাইজানেরা। ব্রহ্মা একদিন নারদকে গঙ্গায় ডুব দিতে বললেন। নারদ ডুব দিয়ে উঠতেই কী দেখা গেল। জানেন? এক পরমাসুন্দরী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে। বিয়ে হল; ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিও হল, তারপর একদিন সেই কন্যার বাবা আর স্বামীর মধ্যে বাধল ঘোরতর যুদ্ধ, যুদ্ধে দুজনেরই মৃত্যু হল, কন্যার অনেক সন্তানও মারা গেল। সহমৃতা হওয়ার জন্য স্বামীর চিতায় গিয়ে উঠল কন্যা। জ্বলে উঠল আগুন, কিন্তু আগুনের ভেতর কী আশ্চর্য ঠাণ্ডা, যেন নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। নারদ দেখলেন, তিনি সবে ডুব দিয়ে উঠেছেন। এর মধ্যেই ঘটে গেল এতকিছু? এসবই কাশিমাহাত্মের কথা, মান্টোভাই। দেবাদিদেব মহাদেব পার্বতীকে কী বলেছিলেন জানেন? কাশীতে থেকে আমি যে আনন্দ পাই, তা কোন যোগীর হৃদয়েও পাওয়া যায় না, পার্বতী, এমনকী কৈলাস বা মন্দার পর্বতেও নয়। পার্বতী এই বিশ্বে দুই অনন্তস্বরুপকেই আমি। ভালবাসি। তুমি পার্বতী, গৌরি আমার, যে তুমি সব কলাবিদ্যা জানো, আর এই কাশী। কাশী ছাড়া আমার অন্য কোনও জায়গা নেই। কাশীতেই আনন্দ, কাশীতেই নির্বাসন। আমরা অনন্তকাল কাশিতেই থেকে যাব।
ওই আলোর শহর থেকে আমার একেবারেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমি তো বেরিয়েছি পেনশনের জন্য দরবার করতে, কলকাতায় যেতেই হবে আমাকে। না হলে খাব কী বলুন? শাহজাহানাবাদের হাভেলিতে কতগুলো মুখ আমার দিকে তাকিয়েই বসেছিল। আর ওপর পাওনাদাররা আছে। কাশীতে থেকে যেতে পারতুমই আমি। কিন্তু ওদিকে পাওনাদাররা তো। আমার পরিবারকে পথে নামিয়ে ছাড়ত। উমরাও বেগমকে হয়তো আমি ভালবাসিনি, কিন্তু তার ইজ্জতকে তো রাস্তায় এনে দাঁড় করাতে পারি না। এদিকে কাশীতে কোঠার সেই সুন্দরীও আমাকে ছাড়বে না, বার বার বলে, মিঞা আপনি থেকে যান, আপনার সঙ্গেই আমার। জীবনটাকে কেটে যাবে। কিন্তু কাশীতে টাকা কে দেবে আমাকে, মান্টোভাই? টাকা ফুরিয়ে গেলে মহব্বতও ফুরিয়ে যায়, সে আমি ভালভাবেই জানতুম। অত যে তার প্রেম, টাকা না থাকলে। সে-ও আমাকে লাথি মারতে একবার ভাববে না। শুধু একজন মানুষের স্মৃতি নিয়ে আমি কাশীকে বিদায় জানালুম। আজ বড় ঘুম পাচ্ছে ভাইজানেরা, পরে তার কথা বলব, সন্ত কবিরসাবের কথা কি অত সহজে বালা যায়? কাশীর মতোই অনন্তকাল ধরে যেন তিনি বেঁচে আছেন। নইলে তাঁর সঙ্গে তো আমার দেখা হওয়ার কথা নয়।