যথাসময়ে মালা উঠিল।
উমা অবনীবাবুকে বলিল,—“আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব, বাবা।” অবনীবাবু আকাশ হইতে পড়িলেন : “তুই! তুই আবার কোথায় যাবি?”
“কেন, কোর্টে। যেখানে তোমরা সবাই যাচ্ছ।”
শচীপ্রসাদ আগাইয়া আসিল : “তুমি যাবে মানে? তোমার একটা প্রেসটিজ নেই?”
—“নিশ্চয় আছে। বৌদিও ত’ তাঁর প্রেসটিজ বাঁচাতেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চলেছেন। আমি যাব বা, দীপ-দাকে তার জেলে যাবার আগে একটিবার দেখবো।”
নির্ভীক দুরন্ত মেয়ে। মুখে কিছু বাধে না।
শচীপ্রসাদের সহিল না : “দীপ-দাকে দেখবে? ঐ রাগামাফি, স্কাউণ্ডেটাকে? ওকে দেখলেও ত’ অশুচি হতে হয়।”
—“না হয় অশুচি একটু হ’ব। তারপর আপনাদের মুখের দিকে চেয়েই ত’ আমার সে-পাপ কেটে যাবে। দাঁড়াও ভাই বৌদি একটু, আমি কাপড়টা বদলে আসছি। দু’ মিনিটও লাগবে না—এই হ’ল বলে।”
উমা দ্রুতপদে অন্তর্ধান করিল এবং ফিরিয়া আসিয়া দেখিল নীচে তাহার জন্য কেহই আর বসিয়া নাই। হয় ত’ কাপড় বদলাইয়া আসিতে তাহার দু মিনিটের চেয়ে বেশি সময় লাগিয়াছে—ইহার মধ্যে ঘটা করিয়া চুল আঁচড়াইয়া সেফটিপিন আঁটিয়া জুতা পরিয়া তাহার বাবু না সাজিলে গোটা মহাভারতটা অশুদ্ধ হইয়া যাইত না।
কিন্তু এই বেশে বিছানায় লুটাইয়া অভিমানে ও দুঃখে সে গোঙাইবে —উমা ততটা নির্লজ্জ নয়। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত আছেন— তাহাকে এড়াইতে হইবে। একটিও শব্দ না করিয়া উমা অতি সন্তপণে খোলা দরজা দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। একটা ট্যাক্সি লইয়া চীফপ্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে যাইতে কতক্ষণ! .
আদালত লোকে লোকারণ্য, কোন প্রকারে ভিড় ঠেলিয়া উমা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। ম্যাজিষ্ট্রেট তখনো এজলাসে আসেন নাই, সমস্ত ঘরময় একটা চাপা গুঞ্জন চলিতেছে। আসামীর ডকৃটাও শূন্য; ম্যাজিষ্ট্রেট আসিলেই হয় ত’ প্রদীপকে হাজির করানো হইবে।
অবনীবাবুদের লক্ষ্যের বাহিরে উমা একটা বেঞ্চিতে একটু জায়গা করিয়া বসিল।
পাশের ছোরা উকিলটি চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। কথা না কহিয়া থাকিতে পারিলেন না : “ঐ মহিলাটি বুঝি আপনার কেউ হন্?”
উমা তাহার মুখের দিকে পৰ্যন্ত চাহিল না; খালি কহিল,-“না।”
—“কিম্বা আসামী?”
—“তাও না।”
উকিলটি বিস্মিত হইলেন : “তবু এসেছেন?”
—“আপনি এসেছেন কেন? আইন শিখতে না কৌতূহল নিবৃত্ত করতে? আমাদের কৌতূহল হয়, মশাই। মেয়েমানুষ নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শত্রুতা করে একজন নির্দোষ ভদ্রলোককে যদি জেলে। পাঠায়, সে একটা উপন্যাসের মতই থিলি। তাই দেখতে এসেছি।”
উকিলটি কহিলেন,—“আপনার কথায় কৌতূহল যে আরো বেড়ে গেল। কী ব্যাপার, খুলে বলুন। যদি পারি উপকার করব, বিশ্বাস করুন।”
উমা কহিল,—“কতদিন প্রাকৃটিস করছেন?”
-“কেন বলুন ত’?”
—“বলুন, দরকার আছে।”
—“প্রায় দু’ বছর।”
—“মোটে!” উমার মুখ ম্লান হইয়া উঠিল।
ভদ্রলোক হাসিয়া কহিলেন,—“কেন, আপনার কোনো কাজ আছে? বেশ ত’ বত্রিশ বছরের প্র্যাকটিস্করা এক বুড়ো-হাবড়া ধরে নিয়ে আসছি না-হয়।”
—“না, না, কি দেব কোত্থেকে? আপনি ঠিক উপকার করবেন?”
উমার ভাবাকুল দুইটি চোখের দিকে তাকাইয়া ভদ্রলোকটি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন,—“যদি পারি, নিশ্চয় করব। কেন করবো না?”
-“কেন করবেন না, তার কারণ অনেক থাকতে পারে। ফি পাবেন।
যে, কিন্তু সত্যি যদি দীপ-দাকে খালাস করে দিতে পারেন, একদিন নিশ্চয়ই নেমন্তন্ন করে খাওয়াব আপনাকে।” বলিয়া উমা নিজেই। হাসিয়া ফেলিল।
ভদ্রলোক ব্যবসার খাতিরে গম্ভীর হইয়া উঠিলেন : “কে দীপ-দা?”
—“এই মোকদ্দমার আসামী।”
—“আসামী? কেন, তার পক্ষে উকিল নেই?”
—“বোধ হয় না। দীপ-দা আমার এমন লোক নন যে কুৎসিত মিথ্যার বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে নিজেকে কলঙ্কিত করে’ তুলবেন! আমি তাকে চিনি না? বরং তিনি হাসিমুখে মিথ্যার অত্যাচার সইবেন, একটিও সামান্য প্রতিবাদ করবেন না।”
ভদ্রলোকটি ভীষণ অস্থির হইয়া উঠিলেন : “কী হয়েছে আমাকে সব খুলে বলুন দিকি শিগগির, দেখি আমি কী ব্যবস্থা করতে পারি। একটা জামিন পৰ্যন্ত চাওয়া হয় নি?”
উমা কহিল,—“শত্রুতা করে আবার বাবা আর শচীপ্রসাদ বলে। একটা ছেড়া—”
উকিল বাধা দিলেন : “আপনার বাবা! ঐ মহিলাটি আপনার কে হয?”
—“বল্ছি। মহিলাটি আমার বৌদি। সংসারের অত্যাচারে হোল্ক বা যার জন্যেই হোক্, পথে বেরোন, আর পথের মোড় থেকে আমার দীপ-দাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে এক ঘোড়ার গাড়ি করে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সব বুঝে নিন্ শিগগির। তারপর বাবার নালিশে পুলিশ গিয়ে ধরে—পুলিশের কাছে মোমের পুতুল আপনার ঐ মহিলাটিই এখন বলছেন যে দীপ-দা তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবার ছল করে ইত্যাদি ইত্যাদি।”
—“কিন্তু এসবের প্রমাণ?”
উমা কহিল,—“যদি ভগবানে বিশ্বাস করেন ত’ তিনি।”
—“আচ্ছা, আচ্ছা, আপনার বৌদির বয়স কত?”
উমা বোধকরি চটিয়া উঠিল : “ঐ চেয়ে দেখুন না। বয়েস দিয়ে আপনার কী হবে?”
কোনো কথা বলিবার আগেই ম্যাজিষ্ট্রেট আসিয়া কোর্টে প্রবেশ করিলেন। সবাই উঠিয়া দাঁড়াইল—উদ্বেল জনকোলাহল স্তব্ধ হইয়া। গেল।
এই দীপ-দার চেহারা হইয়াছে। পরনের কাপড়টা ময়লা, চুলগুলি শুক্ননা জট-পাকানো, পায়ে জুতা নাই—কোমরে দড়ি বাধা। কতদিন যেন ঘুমাইতে পারেন নাই, দাড়ি কামান নাই, গায়ের জামাটা পর্যন্ত ছিঁড়িয়া গেছে। এ দিকে একবার তাকাইতেছেন না কেন? তাহার কিসের লজ্জা যে গভীর অনুশোচনায় তাহাকে হেঁট হইয়া দাঁড়াইতে হইবে?
উমা সহসা নিতান্ত অবোধের মত উকিলটির দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া ব্যাকুল অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে কহিল,—“যে করে পারুন, আমার দীপ-দাকে এই কলঙ্ক থেকে বাঁচান্। ফি আপনাকে আমি পরে যেখান থেকে পারি জোগাড় করে দেব। যেখান থেকে পারি—আমার গয়না আছে। বৌদিকে দুটো জেরা করলেই সত্য কথা বেরিয়ে পড়বে। আপনি যদি না পারেন, অন্য কাউকে ডাকুন্। বৌদি সতী সেজে কাঠের ফ্রেমে-আঁটা ছবি পূজো করুন্ ক্ষতি নেই, কিন্তু দীপ-দাকে এমন করে’ মরতে দেবেন না কখনো।”
—“আপনার কিচ্ছু ভয় নেই।” বলিয়া ভদ্রলোক সস্মিত মুখে বেঞ্চি ছাড়িয়া একপাশে সোজা হইয়া পঁড়াইলেন। তাঁহার মুখের ঐ বন্ধুতাপূর্ণ হাসি ও দাঁড়াইবার এই দৃপ্ত ঋজু ভঙ্গিটি উমাকে যে কী আশ্বাস দিল বলা যায় না।
সরকারের পক্ষের কালো গাউন-পরা উকিল খাড়া হইলেন। নমিতা ধীরে ধীরে কাঠগড়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার দিকে চাহিয়া উমার দুই চক্ষু ঠিক্রাইয়া পড়িতে লাগিল—নির্লজ্জ, স্বেচ্ছাচারী! নমিতা দাঁড়াইল, কিন্তু তাহার সর্বাঙ্গে দুনমনীয় কাঠিন্য, মুখে নিষ্ঠুর সাহস,ঘোমটার ফাঁক দিয়া বিস্রস্ত বেণীটা নামিয়া আসিয়াছে—যেন সৰ্ববন্ধনহীনতার সঙ্কেত। উমা প্রদীপের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহারে মুগ্ধ দৃষ্টি সেই নিরাভরণা দেহাগ্নিশিখাকে বন্দনা করিতেছে।
সমস্ত ঘর মৃত হৃৎপিণ্ডেব মত স্তব্ধ।
সরকারের পক্ষের উকিল কথা পাড়িলেন—নমিতার নাম ধাম বংশপরিচয় সম্বন্ধে অবান্তর প্রশ্ন। তার পর :
—“তুমি ঐ আসামীকে চেন?”
—“চিনি।”
—“বেশ। ঐ লোক ১৭ই কার্তিক রাত্রি একটার সময় তোমার ঘরে এসেছিলো?”
—“না।”
-“না? তোমাকে এসে বলেনি যে তোমার মা’র মরণাপন্ন অসুখ, তোমাকে এক্ষুনি যেতে হবে?”
—“না। মিথ্যা কথা।”
—“এই বলে তোমাকে ভুলিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে এসে ট্রেনে করে ফুলহাটি গ্রামে নিয়ে যায় নি?”
—“কখনো না।”
অবনীবাবুর মুখে কে কালি মাখিয়া দিল; শচীপ্রসাদ সামনের টেবিলের উপর একটা ঘুসি মারিয়া বলিয়া বসিল : সুপিড। সরকারের পক্ষের উকিল কহিলেন,—“তবে, কী হয়েছিলো খুলে বল।”
নমিতার গলার স্বর একটু কাঁপিল না পৰ্যন্ত। ধীরে সংযত, গভীর কণ্ঠে সে বলিতে লাগিল : “কিছুই বিশেষ হয় নি। আমি স্বেচ্ছায় আপন দায়িত্বে ঘর ছেড়েছি—মুক্তি আমার নিজের সৃষ্টি। প্রদীপবাবু আমার বন্ধু, বিপদের সহায়। তাকে সঙ্গে করে আমার নিজের প্ররোচনায় আমি ফুলহাটি বেড়াতে যাই। এর মধ্যে এতটুকু সঙ্কোচ ছিল না, এতটুকু কলুষ নেই। আমি সাবালিকা, আমার বয়স গত আশ্বিনে কুড়ি পূর্ণ হয়েছে। জীবনের কোথায় আমার গন্তব্য, কে আমার সঙ্গী, কেন আমার যাত্রা—এ সবের বিচার করবার আমার বুদ্ধি হয়েছে। যদি ভুল হয়ে থাকে তার পরিণামও আমিই বিচার করূব। প্রদীপবাবু নির্দোষ, নিষ্কলুষ—আমার মুক্তি আমার নিজের রচনা।”
সবাই একসঙ্গে একেবারে থ হইয়া গেল। ঘরের ছাতটা ভাঙিয়া পড়িলেও বোধ করি শচীপ্রসাদের কাছে এত অস্বস্তিকর লাগিত না। সরকারী উকিল কর্কশ হইয়া কহিলেন,—“তবে পুলিশের কাছে এত সব উল্টো কথা বলেছ কেন?”
—“পুলিশের কাছে কি বলেছি আমার কিছু মনে নেই। উল্টো কথা কিছু যদি বলে থাকি, তবে এই জন্যেই হয় ত’ বলেছিলাম যে, এমনি একটা উন্মুক্ত সভায় সর্বসাধারণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুক্তি ঘোষণা করতে পাব। যা আমি নিজে সৃষ্টি করলাম, তা পরের সাহায্যে যে মোটেই লাত করিনি, সেইটে উঁচু গলায় বলবার জন্যে আমি একটা সুযোগ চেয়েছিলাম মাত্র। এর চেয়ে সোনার সুযোগ কী হতে পাত? নেপথ্যে বা স্বপ্নে বা পুলিশের কাছে আমি যা বলেছি তার মূল্য নেই, স্পষ্ট দিবালোকে সজ্ঞানে ধর্মাধিকরণের সামনে যা বলছি তাই আমার সত্য। উল্টো কিছু বলা বা প্রলাপ বকার জন্য যদি শাস্তির বিধান থাকে, তা আমি নেব; কিন্তু আহ্বান যদি কেউ কাউকে করে থাকে, তবে আমিই প্রদীপবাবুকে করেছি, উনি আমাকে নয়। উনি আমার বন্ধু, আশ্রয়দাতা। যদি এও শুনতে চান, আমি বলব, ঐ আসামীকে আমি ভালোবাসি।”
স্তব্ধ ঘর নিশ্বাস ফেলিল; দেয়ালগুলি পর্যন্ত কাপিয়া উঠিয়াছে। অবনীবাবু কহিলেন,—“চলে’ এস শচীপ্রসাদ। এর পর ঘাড়ের ওপর মাথা নিয়ে আর লোকসমাজে ফিরতে পাবে না। ছি ছি ছি।”
উমা ভিড়ের মধ্যে কোনরকমে আত্মগোপন করিয়া রহিল। উকিল বাবুটি কাছে আসিয়া স্নিগ্ধ-স্বরে কহিলেন,—“আমাকে কিছু বলতেও হ’ল না। মেয়েদের বয়েসই হচ্ছে বাঁচোয়া, বুঝলেন? কবে খাওয়াচ্ছেন বলুন।”
মুখ বিবর্ণ করিয়া উমা কহিল,—“আপনাকে আমি ভুলবো না। আপনি আমাকে খুব সাহস দিয়েছিলেন কিন্তু।”
কিন্তু উমার চেহারায় সাহসের এক কণাও ভদ্রলোকের চোখে পড়িল না। মুখ ছাইয়ের মত শাদা, দুই চোখে কেমন একটা নিরীহ, অসহায় ভাব। কপালের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিয়াছে। ভদ্রলোকটির কেন-জানি মনে হইল সৰ্বান্তঃকরণে মেয়েটি হয় ত’ ইহা চাহে নাই। কোথায় যেন একটু আশা-ভঙ্গের মনস্তাপ রহিয়াছে।
প্রদীপ ও নমিতাকে ঘিরিয়া তখনো ভিড় লাগিয়া আছে। দুইজনেই নির্বাক, সবাইর প্রতি সমান উপেক্ষা। শচীপ্রসাদেরই আফশোষ ঘুচিতেছে না; সে সক্রোধে দুইহাতে ভিড় ঠেলিয়া নমিতার সামনে আসিয়া কটুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল : “কেন এই কেলেঙ্কারি করে’ বসলেন বলুন ত’? আমাদের মুখ ঢাকবার আর জায়গা রইল না যে।”
অবনীবাবু দূর হইতে চেঁচাইয়া উঠিলেন : “ঐ হতভাগীর সঙ্গে কথা বলে না, শচীপ্রসাদ। যাক্ ও জাহান্নমে,—চলে এস, শচী।”
যাইতে যাইতে শচীপ্রসাদ কহিল,-“এর চেয়ে গলায় কলসী বেঁধে জলে ডুবে মরলেও যে ভালো ছিল!”
দুই জনে ধীরে ধীরে জনস্রোত সরাইয়া রাস্তার বাহিরে আসিয়া পঁড়াইল। প্রদীপ কহিল,—“এখন কোথায় যাবে, নমিতা?”
নমিতার মুখে অটল গাম্ভীৰ্য—যেন পরপার হইতে কথা কহিতেছে : “আমি কি জানি?”
—“সম্প্রতি একটা গাড়ি নেওয়া যাক্, নইলে এভিড় এড়ানো সহজ হবে না। দু’ দিন কিছু খেতে পাই নি নমিতা, পেট চো চেষ্টা করছে। কিছু না খেলে চলবে না যে।”
নমিতা উদাসীনের মত কহিল,-“বেশ, তবে গাড়ি করুন।”
—“গাড়ি ত’ করবে কিন্তু কে এখন আমার জন্যে আর ভাত বেড়ে রেখেছে বল?”
—“কেন, হোটেল। কলকাতা শহরে হোটেল নেই?”
—“তুমি আমার সঙ্গে যাবে হোটেলে?”
—“আপনার সঙ্গে যেতে আমার আর বাধা কোথায়?”
ড্যালহৌসি স্কোয়ারের পাশে আসিয়া ট্যাক্সিতে উঠিয়াছে—প্রায় ছুটিতে ছুটিতে উমা আসিয়া হাজির : “আমাকে চিনতে পারে, দীপ-দা?”
—“তুমি এখানে উমা?” প্রদীপের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না : “উঠে এস, উঠে এস শিগগির—”
নমিতা এক পাশে সরিয়া গিয়া উমাকে তাহাদের মধ্যখানে বসিতে দিল।
তবুও গাড়িটা তখনই ছাড়িতে পারিল না। কে একজন ডান হাতে ছাতা তুলিয়া গাড়িটাকে লক্ষ্য করিয়া চেঁচাইতে চেঁচাইতে ছুটিয়া আসিতেছে। নমিতা তাহার গভীর হৃদয়ের মধ্যে যেন কাহার ডাক শুনিয়া চমকাইয়া উঠিল। ইহাকেই সে যেন বিনিদ্র ব্যাকুল চোখে এতদিন প্রতীক্ষা করিয়া ফিরিতেছিল। কিসের বা তাহার মুক্তি, কী বা তাহার সত্য!
কোর্টে আসিতে গিরিশবাবুর দেরি হইয়া গিয়াছিল; দুর হইতে দেখিতে পাইলেন একটা ট্যাক্সিতে করিয়া নমিতা কাহাদের সঙ্গে চলিয়াছে। সামনে আসিয়া চোখে তাহার ধাঁধা লাগিল। চোখ কচলাইয়া নমিতাও চাহিয়া দেখিল—তাহার কাকা ছাড়া পিছনে আর কেহ নাই। গিরিশবাবু ট্যাক্সির গা ঘেঁসিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “কী হ’ল?”
কথা কহিল উমা : “কী আবার হবে? বৌদি জিতেছেন।”
—“জিতেছে?” গিরিশবাবু লাফাইয়া উঠিলেন : “কয় বচ্ছর জেল হ’ল গুণ্ডাটার?”
উমা তীক্ষ্ণস্বরে কহিল,—“গুণ্ডা আবার আপনি কাকে দেখলেন?”
—“গুণ্ডা নয়, একশো বার গুণ্ডা! ছোঁড়াটার মাথায় যেমন একরাশ চুল, চোখ দুটো ভাটার মত, হাতের মুঠো যেন বাঘের থাবা
ওটাকে আমি বরাবরই রাখতে চাইনি বাড়িতে। নেহাৎ ওর দিদির আবদারেই ছিলো, তা দিদিকে কি আর কম জ্বালিয়েছেন সোনার চাদ! ক’ বছর হ’ল?”
—“কা’র কথা বলছেন আপনি?”
—“কেন, অজয়ের। সে ইতিমধ্যে এসেছিলো একদিন আমার বাড়িতে; এসে বল্লে : নমিতা কোথায় আছে জানেন? শ্বশুরবাড়িতে তাকে খুঁজে পেলাম না। কী ভীষণ চটে উঠলাম যে কি বলব? বল্লাম : শিগগির আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও বলছি, নমিতা তোমার কে শুনি যে আদিখ্যেতা করবার আর জায়গা পাওনি?”
মুখের কথা কাড়িয়া নিয়া প্রদীপ হাসিয়া কহিল,-“দয়া করে একটু সরু, গাড়িটা যেতে পারছে না।”
নমিতা ধীরে প্রশ্ন করিল : “কতদিন আগে এসেছিলেন?”
-“এই ত’, দিন তিন-চার হবে। ও হরি! তখন কে জান্তো ছোঁড়াটা এত বড় হতচ্ছাড়া, এত বড় জানোয়ার। নমিতাকে নিজে সরিয়ে দিব্যি ন্যাকা সেজে কি না বলে গেল : নমিতার ঠিকানা কি। বলতে পারেন? ব্যাটা পাজিক বচ্ছর হ’ল ওর শুনি?”
উমা বিরক্ত হইয়া কহিল,—“ওঁর জেল হতে যাবে কেন? কী বলছেন আপনি?”
গিরিশবাবু হতভম্ব হইয়া কহিলেন,—“বা, এই যে বল্লে নমিতা মামলা জিতেছে?”
—“জিতেছেনই ত’? সমস্ত পৃথিবীর সামনে সোজা সত্য কথা স্পষ্ট করে বলে’ আসতে পেরেছেন। মানুষের এর চেয়ে আর বড় জয় কিছু আছে নাকি? কেউ বউদিকে ছিনিয়ে নিতে পারে নি, তিনি নিজের আত্মার শক্তিতে নিজের স্বাধীনতা সৃষ্টি করেছেন। যান, জেল-ফেল হয়নি কারুর কোনোদিন।”
গিরিশবাবু আকাশ হইতে পড়িলেন আর কি : “বল কি উমা? নমিতা নিজের ইচ্ছায় বাড়ির বার হয়েছে? তবে কার বিরুদ্ধে এই মালা? এ! কোথায় যাচ্ছ তবে তোমরা?”
নিতান্ত জ্ঞানীর মত মুখ করিয়া উমা কহিল,—“ কে কবে বলতে পারে বলুন, কোথায় কে যাচ্ছে?”
গাড়িটা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল, গিরিশবাবু, ধমক দিয়া উঠিলেন : “শোন নমিতা, কেন তবে ঘর ছেড়েছিলি শুনি? কার জন্যে?”
উমা বলিয়া উঠিল : “কার জন্যে আবার লোকে ঘর ছাড়ে? নিজের জন্যে।—চালাও জলদি।”
গিরিশবাবুকে আর একটি কথাও বলিতে না দিয়া ট্যাক্সিটা বাহির হইয়া গেল। ছাতা হাতে করিয়া গিরিশবাবু ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলেন।
নমিতা মুগ্ধচোখে উমার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। খানিকপরে তাহার একখানি হাত নিজের হাতের উপর টানিয়া আনিয়া কহিল, “এত কথা তুমি কোথেকে শিখলে, উমা?”
উমা হাসিয়া কহিল,—“তোমারই কাছ থেকে, বৌদি।”
অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। ট্যাক্সিটা যে কোথায় চলিয়াছে, যেন কাহারো কোনো দিশা নাই। প্রদীপ সহসা সচেতন হইয়া কহিল, “তুমি আমাদের সঙ্গে কোথায় যাবে, উমা?”
মানুষের মন, না পদ্মপাতায় জলবিন্দু। নিমেষে উমার সমস্ত উৎসাহ উবিয়া গেল; মুখোনি স্নান করিয়া সে কহিল,—“না, কোথায় আবার যাব? আমার আর কাজ কি আছে? এই, রোখো।”
গাড়ির গতিটা একটু কমিতেই দরজা খুলিয়া উমা নামিবার জন্য পা-দানিতে পা রাখিল।
প্রদীপ ব্যস্ত হইয়া কহিল,-“এখানে নামূবে কি? এখান থেকে তোমাদের বাড়ি যে ঢের দূর।”
—“হোক। আপনাদের সঙ্গে গিয়ে আমার আর কী হবে?” বলিয়া উমা সোজা ফুটপাতে নামিয়া আসিল।
প্রদীপ গাড়িটাকে চলিতে বলিতে পারিল না। বরং হাত তুলিয়া অভিমানিনী উমাকে ডাকিতে সুরু করিল।
নমিতা বাধা দিল : “ওকে ডেকে কোথায় নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে? ও বাড়ি যাক্। চলল।”
গাড়িটা গড়াইয়াছে, অমনি ছুটিয়া উমা ফের হাজির হইল। কহিল,—“তোমাকে প্রণাম করা হয় নি, বৌদি। মনে যদি কোনোদিন দুঃখ দিয়ে থাকি, ভুলে যেয়ো। আর কোনোদিন দেখা হয় কি না কে জানে।” বলিয়া দরজা খুলিয়া সে নমিতার পদধূলি নিল।
নমিতার দুই চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল; চোখ মুছিয়া ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, উমা পাশের কোন গলি দিয়া সহসা কখন অদৃশ্য হইয়া গেছে।