২১. ম্যানহাটান প্রজেক্ট
পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টা জিনিসের ভুল নামকরণ করা হয়েছে তার একটা হচ্ছে এটম বোমা। এর সঠিক নাম হওয়া উচিত নিউক্লিয়ার বোমা এবং মাঝে মাঝে এই নামটাও যে ব্যবহার করা হয় না তা নয় কিন্তু কীভাবে জানি এটম বোমা নামটাই অনেক বেশি ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়।
এটম বোমার (বা শুদ্ধ করে বললে নিউক্লিয়ার বোমার) সাথে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের যোগাযোগ দুই ভাবে। প্রথমত, এই বোমায় বস্তুর ভরকে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তর করা হয়। দ্বিতীয় যোগাযোগটি অনেক বেশি বাস্তব, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে আগে 1937 সালের 2 আগস্ট আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটা চিঠি লিখে বলেছিলেন হিটলার জার্মানিতে সম্ভবত নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর চেষ্টা করছে কাজেই আমেরিকারও এই ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার। তার কিছুদিনের ভেতরেই সেখানে ম্যানহাটান প্রজেক্ট নামে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির খুব গোপন একটি প্রজেক্ট শুরু হয়। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পৃথিবীর মানুষের উপর ফেলা বোমা দুটি এই প্রজেক্ট থেকে তৈরি করা হয়েছিল।
নিউক্লিয়ার বোমার শক্তিটুকু আসে পরমাণু বা এটমের মাঝখানে থাকা নিউক্লিয়াস থেকে এবং এরকম একটা নিউক্লিয়াস হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235, এখানে 235 সংখ্যাটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এর নিউক্লিয়াস প্রোটন এবং নিউট্রনের মোট সংখ্যা হচ্ছে 235 (এর মাঝে 92টি প্রোটন বাকি সব নিউট্রন)। এটি অনেক বড় নিউক্লিয়াস এবং বলা যেতে পারে এটা কোনোরকমে আস্ত অবস্থায় রয়েছে। যদি কোনোভাবে এর মাঝে আরো একটি নিউট্রন ঢুকিয়ে দেয়া যায় তাহলেই এটা আর আস্ত থাকবে না, ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যাবে–তার সাথে কিছু খুচরা নিউট্রনও বের হয়ে আসবে (21.1 নং ছবি)। নিউক্লিয়াস এবং তার মাঝে ঢুকে যাওয়া নিউট্রনের যে ভর ছিল দেখা যাবে যে ভেঙে যাওয়ার পর তার দুই টুকরো এবং খুচরা কিছু নিউট্রনের ভর কিন্তু তার থেকে কম। যেটুকু ভর কম সেটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc সূত্র মেনে শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র বা পারমাণবিক চুল্লি বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেখানে ঠিক এই প্রক্রিয়ায় শক্তি বের হয়ে আসে। সেখানে বাকিটাকে বের করা হয় নিয়ন্ত্রিতভাবে ধীরে ধীরে, যখন পুরো শক্তিটাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মুহূর্তের মাঝে বের করে আনা হয় সেটাকে বলে এটম বোমা (অথবা শুদ্ধ করে বললে নিউক্লিয়ার বোমা।)
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235 সংগ্রহ করা। কাজটা খুব সহজ নয়, প্রথমত এক গ্রাম ইউরেনিয়াম পাওয়ার জন্যে দরকার 500 গ্রাম ইউরেনিয়ামের খনিজ, সেখানে ইউরেনিয়ামের প্রায় পুরোটাই–শতকরা প্রায় নিরানব্বই ভাগ হচ্ছে ইউরেনিয়াম 238 যেটা দিয়ে বোমা বানানো যায় না। যে আইসোটোপ দিয়ে বোমা বানানো যায় সেটা হচ্ছে ইউরেনিয়াম 235 সেটা থাকে শতকরা এক ভাগ। শতকরা হিসেবে সেটা খুব বড় সমস্যা হবার কথা নয় কিন্তু সেটা বিশাল সমস্যা অন্য কারণে ইউরেনিয়াম 235 এবং ইউরেনিয়াম 238 দুটোই একই পরমাণুর আইসোটপ, অর্থাৎ রাসায়নিক পরিচয় হুবহু এক, পার্থক্য হচ্ছে নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের তিনটা সংখ্যায়! সে কারণে কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম 235কে ইউরেনিয়াম 238 থেকে আলাদা করা যায় না। সেটা আলাদা করতে হয় অত্যন্ত জটিল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। নিউক্লিয়ার রি-এক্টরে ব্যবহার করার জন্যে যেটুকু ইউরেনিয়াম 235 আলাদা করতে হয় তার থেকে অনেক বেশি আলাদা করতে হয় বোমা বানানোর জন্যে। তাই যখনই কোনো দেশ ইউরেনিয়াম 235 আলাদা করার চেষ্টা করে তখনই সারা পৃথিবী সতর্ক হয়ে যায়। ইরানকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো হইচই করছে ঠিক এই কারণে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নিউক্লিয়ার বোমা বানানো খুব সহজ, খানিকটা ইউরেনিয়াম 235-এর মাঝে কিছু নিউট্রন ছেড়ে দেয়া বাস্তবে কাজটা এত সহজ না। প্রথমত বোমা মানেই হচ্ছে মুহূর্তের মাঝে বিস্ফোরণ, কাজেই পুরো ঘটনাটা হবে এক সেকেন্ডের একশ কোটি এক কোটি ভাগ সময়ে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটা নিউক্লিয়াসে একই সাথে একটা করে বাড়তি নিউট্রন দিতে হবে, সেটা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। তবে আমরা আগেই বলেছি একটা ইউরোনিয়াম 235কে ভাঙতে পারলে শক্তির সাথে সাথে কিছু খুচরা নিউট্রন পাওয়া যায়, সেই নিউট্রনগুলো আবার অন্য নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে পারে সেখান থেকে আবার আরো নিউট্রন পাওয়া যায়। সব নিউট্রন আবার ব্যবহার করা যায় না–কিছু কিছু খোয়া যায়। কাজেই গবেষণা করে দেখা গেছে একটা নির্দিষ্ট ভরের ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলেই ইউরেনিয়াম 235 ভেঙে শক্তি পাওয়ার ব্যাপারটা একটানা চলতে থাকে। এই ভরটার নাম ক্রিটিক্যাল মাস এবং এই ক্রিটিক্যাল মাস বের করা হচ্ছে বোমা বানানোর প্রথম শর্ত। এক সময় এটা বের করা খুব সহজ ছিল না। আজকাল কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট যুগে এটা প্রায় ছেলেখেলার মতো হলেও পরিমাণটুকু গোপন রাখা হয়। কেউ ঘরে বসে হিসেব করে বের করলেও নিরাপত্তা কর্মীরা এসে এই কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে যাবে!
ক্রিটিকাল মাস বা ভরের সমান ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলেই তার ভেতর থেকে শক্তি বের হতে থাকে। বোমা বানানোর জন্যে দরকার সুপার ক্রিটিক্যাল মাস, যে ভরের ইউরেনিয়াম 235 একত্র করতে পারলে আসলে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ঘটনাটি অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে শুরু করে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়।
1939 থেকে 1945 সাল পর্যন্ত এই ছয় বছর প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমেরিকায় দুটি বোমা তৈরি করেছিল যার একটি ফেলেছিল হিরোশিমাতে 1945 সালের 6 আগস্ট। অন্যটি ফেলেছিল নাগাসাকিতে, তার তিনদিন পর আগস্টের 9 তারিখ–পরের দিন, আগস্টের 10 তারিখ জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই বোমাগুলো যেখানে ফেলা হয়েছিল তার নিচের আধ মাইল ব্যাসের পুরো এলাকাটা আক্ষরিক অর্থে ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল, এক মাইল ব্যাসের ভেতর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দুই থেকে আড়াই মাইল ব্যাসের ভেতর যা কিছু দাহ্য পদার্থ ছিল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বোমা বিস্ফোরণের মুহূর্তে মারা গিয়েছিল প্রায় সত্তর হাজার মানুষ আরো সত্তর হাজার মানুষ আহত হয়েছিল। বোমার পরে শুরু হয়েছিল তেজস্ক্রিয়তার কারণে মানুষের অচিন্তনীয় সর্বনাশ।
তেজস্ক্রিয়তা যে মানুষের জন্যে কী ভয়াবহ হতে পারে সেটি অবশ্য ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমা বিস্ফোরণের আগেই জানতেন একজন খ্যাপা ধরনের বিজ্ঞানীর জন্যে। তার নাম লুইস টিন, জন্মসূত্রে কানাডার মানুষ। আমরা আগেই বলেছি ইউরেনিয়াম 235 যদি একটা নির্দিষ্ট ভর বা ক্রিটিক্যাল মাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে সেটাতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং সেটা আর থেমে যায় না। কাজেই খুব সঙ্গত কারণেই ইউরেনিয়াম 235 কখনোই ক্রিটিক্যাল মাস করা হয় না–নিরাপত্তার জন্যে সেটাকে দুই ভাগ করে আলাদা রাখা হয়। আলাদাভাবে দুটোই ক্রিটিক্যাল মাস থেকে কম, একসাথে একত্র করলেই সেটা বিপজ্জনক।
বিজ্ঞানী লুইস টিন এই বিপজ্জনক কাজটা নিয়ে খেলা করতে পছন্দ করতেন। অর্ধেকটা ক্রিটিক্যাল মাসের উপর বাকি অর্ধেকটা পড়তে দিতেন এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে নিচে একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দুটো অংশকে আলাদা করে রাখতেন। এরকম খেলা করতে করতে হঠাৎ একদিন ক্রু ড্রাইভারটা সময়মতো দিতে পারলেন না এবং দুটো অংশ একত্র হয়ে মুহূর্তে পুরোটাতে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ঘরে যারা ছিল তারা সবাই দেখল ক্রিটিক্যাল ভরের সেই নিউক্লিয়ার জ্বালানি থেকে নীল আলো ঝলসে উঠেছে–মনে হলো ঘরের ভেতর একটা আগুনের হলকা ছুটে যাচ্ছে। লুইস টিন প্রাণপণ চেষ্টা করে ভেতরে ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে দুটো অংশ আলাদা করে বিক্রিয়াটি থামালেন কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লুইস টিনের মনে হলো তার হাতটি আগুনে ঝলসে গেছে, তিনি মুখে এক ধরনের টক টক স্বাদ অনুভব করলেন। লুইস টিন তখন ঘরের ভেতর দাঁড়ানো সব বিজ্ঞানীদের বললেন, “তোমরা কেউ নড়বে না, যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাকো, কে কতটুকু তেজস্ক্রিয় বিকীরণ পেরেছ জানা দরকার। আমি বাঁচব না, তোমাদের কেউ কেউ বেঁচে যাবে।”
দুই দিন পর লুইস টিন মারা গেলেন, সেই মৃত্যুর মতো যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মি তার সারা শরীরকে একেবারে ভেতর থেকে ঝলসে দিয়েছিল। একজন লুইস টিন যত কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিলেন জাপানের প্রায় এক লক্ষ মানুষ সেরকম কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছিল!
লুইস সুটিনের হাত ফসকে দুটো অংশ একত্র হয়ে ক্রিটিক্যাল ভর হয়ে গিয়েছিল। নিউক্লিয়ার বোমার ভেতরে সেটা করা হয় ইচ্ছে করে। লুইস টিন যে দুটো অংশ নিয়ে খেলা করছিলেন সেটা শুধুমাত্র বিক্রিয়াটা শুরু করেছিল, নিউক্লিয়ার বোমায় সেটা শুরু হয়ে মাত্রার বাইরে চলে যায় মুহূর্তে। নিউক্লিয়ার বোমার ভেতরে দুটো অংশ আলাদা রাখা হয়, যখন বিস্ফোরণের মুহূর্তটি আসে তখন দুটি অংশ প্রচণ্ড বেগে একটি আরেকটির দিকে ছুটে আসে। দুটি অংশ স্পর্শ করা মাত্রই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেটা বিস্ফোরিত হয় (21.2 নং ছবি)। হিরোশিমার বোমাটি ছিল এরকম একটি বোমা।
বোমা নিয়ে কথা বলার সময় শুধু ইউরেনিয়াম 235-এর কথা বলা হয়েছে কিন্তু শুধু যে ইউরেনিয়াম 235 দিয়ে বোমা তৈরি করা যায় তা নয়, প্লুটোনিয়াম 239 দিয়েও বোমা তৈরি করা যায়। জাপানের উপর ফেলা দ্বিতীয় বোমাটি ছিল প্লুটোনিয়াম 239 দিয়ে তৈরি, লুইস টিনের যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটাও ঘটেছিল প্লুটোনিয়াম 239 দিয়ে।
ম্যানহাটান প্রজেক্টের দ্বিতীয় বোমাটি তৈরি করার সময় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন সেটি দুটি অংশকে একত্র করে বিস্ফোরিত করা যাবে না। তার জন্যে দরকার একটা বড় গোলককে চাপ দিয়ে ছোট করে সুপার ক্রিটিক্যাল করে–চারপাশে বিস্ফোরক রেখে একই মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একত্র করে এটাকে বিস্ফোরণ করা হয় (21.3 নং ছবি।)
ম্যানহাটান প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুটো বোমা ফেলার আগে একটি বোমা তৈরি করেছিলেন পরীক্ষা করার জন্যে। 1945 সালের 16 জুলাই সেটা নিউ মেক্সিকোর একটা মরুভূমিতে বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। সেই বিস্ফোরণটি দেখে সকল বিজ্ঞানীরা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আতংকিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন সেটি যেন কখনোই কোনো মানুষের উপর ব্যবহার করা না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সেই অনুরোধ রক্ষা করে নি, তারা সেটা ব্যবহার করেছিল। একবার নয়–দুই বার।
ম্যানহাটান প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার নামে একজন বড় বিজ্ঞানী। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণ দেখে তিনি গীতা থেকে একটা শ্লোক আওড়ে বলেছিলেন, এখন আমি হচ্ছি পৃথিবীর ধ্বংসকারী–আমিই হচ্ছি মৃত্যু।
মানুষ নিজেই যখন নিজের মৃত্যু হয়ে দাঁড়ায় তাদের রক্ষা করা কী খুব সহজ কথা?