২১. মোহসিন একাই এসেছে

মোহসিন একাই এসেছে। তার চোখে সানগ্লাস, গায়ে হালকা নীল রঙের টি শার্ট। পরনের প্যান্টের রঙ ধবধবে শাদা, পায়ের জুতা জোড়াও শাদা চামড়ার। সে বজরার ছাদে পাতা চেয়ারে বসে আছে।

নীতু দেখতে পেয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামছে। ঘাটের মাথায় ইরতাজুদ্দিন দাঁড়িয়ে। তিনি কৌতূহলী চোখে ছেলেটিকে দেখছেন। মানুষের সবচে বড় পরিচয় তার চোখে। ছেলেটি তার চোখ কালো চশমায় ঢেকে রেখেছে, তারপরেও ইরতাজুদ্দিন বললেন, বেশ ছেলে তো!

নীতু লাফিয়ে বজরায় উঠে চেঁচিয়ে বলল, মিতু আপা কোথায়?

মোহসিন বলল, তোমার মিতু আপা আসেনি। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমাদের নিয়ে যাবার জন্যে।

আপনি কেমন আছেন মোহসিন ভাই?

ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?

আমি ভাল।

তোমার আপা, সে কেমন আছে?

খুব ভাল আছে। সমানে ডাক্তারি করে বেড়াচ্ছে।

ঘাটে যে বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন তিনিই কি তোমার দাদা।

হুঁ। দারুণ রাগী। নেমেই আপনি কিন্তু পা ছুঁয়ে উনাকে সালাম করবেন।

আর কি করতে হবে?

সানগ্লাস খুলে ফেলুন। দাদাজন খুব প্রাচীন ধরনের মানুষ। সানগ্লাসকে তারা অভদ্রতা মনে করেন।

ইরতাজুদ্দিন ছেলেটির ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। সে তার কাছে এসেই চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেছে–নিচু হয়ে কদমবুসি করেছে। ইরতাজুদ্দিন স্পষ্ট গলায় বললেন, কেমন আছ মোহসিন?

ভাল। খুব ভাল।

রাস্তায় অসুবিধা হয়নি তো?

জ্বি-না। শুধু নৌকা যখন হাওড়ে পড়েছে তখন ভয় পেয়েছি। একেবারে সমুদ্রের মত ঢেউ।

তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। বৃদ্ধ মানুষের নিমন্ত্রণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মিতু এল না কেন?

ওর কি জানি একটা পরীক্ষা। ও ফ্রেঞ্চ শিখছে–তারই ডিপ্লোমা পরীক্ষা।

বাঙালী মেয়ের ফ্রেঞ্চ শেখার দরকার কি? এখন ফ্রেঞ্চ শেখাটাই ফ্যাশন না-কি?

মোহসিন হাসল। বুড়ো ভদ্রলোককে যতটা প্রাচীনপন্থি বলে নীতু ভয় দেখিয়েছে ততটা বোধ হয় না।

ইরতাজুদ্দিন বললেন, শহরে থেকে অভ্যাস, গ্রামের বাড়িঘর তোমার পছন্দ হবে কিনা কে জানে। এসো মোহসিন, এসো।

 

বাড়ি দেখে মোহসিন হকচকিয়ে গেল। এ তো ছোটখাট প্যালেস। কাঠের এত বড় দোতলা বাড়ি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি আছে কি-না তার সন্দেহ হল। নীতু তাকে। বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে–

এটা হচ্ছে নামাজঘর। ঐ যে ছোট্ট পাটিটা দেখছেন ঐ টা হাতীর দাঁতের পাটি। ঐ যে ব্ল্যাক দেখছেন–র্যাক ভর্তি কোরান শরীফ। এর মধ্যে একটা কোরান শরীফ আছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিজের হাতের লেখা।

সত্যি?

অবশ্যই সত্যি। আসুন আপনাকে লাইব্রেরি ঘর দেখাই। লইব্রেরি ঘরজেখলে আপনার চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, এত বড় লাইব্রেরি কিন্তু বাচ্চাদের কোন বই নেই।

তোমার জন্যে তো দুঃখেরই। প্রতিদিন তিনটা করে বই নাপেড়লে তো তোমার ঘুম হয় না। ভাল কথা, শাহানা কোথায়?

কে জানে কোথায়। ঘুরছে মনে হয়। কোথায় ঘুরছে?

গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপার সুতিহঠন রোগ হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়ে হাঁটতে বের হয়–দুপুরে আর্জে)প্রথম দিকে দাদাজান একা বেরুতে নিষেধ করেছিলেন। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যার করে নেয়া হয়েছে।

আসুন, লাইব্রেরিটা দেখবেন না?

খানিকক্ষণ পরে দেখলে কেমন হয় নীতু? খুব ক্লান্ত লাগছে–সাবান মেখে গোসল সেরে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকব। তারপর তুমি যা দেখাবে তাই দেখব। গোসলের জন্য কেউ কি আমাকে একটু গরম পানি করে দিতে পারবে?

হ্যাঁ পারবে।

আমি কোন ঘরে থাকব একটু দেখিয়ে দাও।

আপনি থাকবেন দোতলায়। আসুন ঘর দেখিয়ে দেই।

মিতু তোমার জন্যে গল্পের বই দিয়ে দিয়েছে, চকলেট দিয়ে দিয়েছে। গরমে চকলেট গলে গেছে বলে আমার ধারণা।

চিঠি দেয়নি?

হ্যাঁ, চিঠিও দিয়েছে। এসো তোমাকে সব দিয়ে দিচ্ছি।

আপনি কি গোসলের আগে চা খাবেন।

শাহানার ক্ষত সেকেন্ডে সেকেন্ডে চা খাওয়ার অভ্যাস আম্মার নেই। আমি গোসল করেই শুয়ে পর। আঁটি বাঙালীর মত সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুব।

সে কি। দুপুঝে খাবেন না।

উহুঁ, ঠিক একনার সময় আম্মি সঙ্গে করে আনা স্যান্ডউইচ খেয়েছি, পনীর খেয়েছি, আপেল খেয়েছি। কাজেই আামার দুপুরের মিল অফ।

শুনালে দাদাজানোর খুব মন খারাপ হবে। আপনার কথা ভেবেই দাদাজান রাক্ষস সাইজের এক কাতালা মাছ এনেছেন।

কোন উপায় নেই নীতু। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি কঠিন নিম্ম মেনে চলি। আমার উপর দায়িত্ব হল আমার দাদাজানকে এটা বুঝিয়ে বলা। কলতে পারবে না?

হুঁ পারব।

তুমি খুব চমৎকার একটা মেয়ে নীতু। খ্যাংক য়্যু ফর অল দ্যা হেল্প।

 

শাহানা বাড়িতে ফিরল দুপুর পার করে। তার জন্যে না খেয়ে ইরতাজুদ্দিন সাহেব এবং নীতু দুজনই অপেক্ষা করছিল। শাহানা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি কিছু খাব না দাদাজান। আপনারা খেয়ে নিন।

ইরতাজুদ্দিন বললেন, খাবি না কেন?

ইচ্ছা করছে না।

শরীর খারাপ করেনি তো?

না, শরীর ভাল আছে।

মুখ এত শুকনা লাগছে কেন?

রোদে রোদে ঘুঝেছি এই জন্যেই মুশুকনা লাগছে।

কিছুই খাবি না?

না। তবে আপনার বিখ্যাত পেঁপে একটু খেতে পারি।

নীতু বলল, তোমার জন্যে সুসংবাদ আছে আপা। মোহসিন ভাই এসেছেন। গোসল করে তাঁর ঘরে ঘুমুচ্ছেন। সন্ধ্যার আগে তাঁকে ডাকা যাবে না।

মিতু আসেনি?

না, চিঠি পাঠিয়েছে। তোমার টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি।

শাহানা তার নিজের ঘরের দিকে রওনা হল। ইরতাজুদ্দিন লক্ষ্য করলেন, মোহসিন এসেছে এই সংবাদে তার নাতনীর চেহারায় কোন পরিবর্তন হয়নি। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ শুধু পড়েছে। বিরক্ত হলেই মানুষের কপালের চামড়া এভাবে কুঁচকে যায়। মেয়েটার কি কোন সমস্যা হয়েছে?

 

বাটি ভর্তি পেঁপে দিয়ে গেছে। পেঁপের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ, এক গ্লাস পানি। শাহানা তার কোন কিছুই স্পর্শ করল না। সে মিতুর চিঠি পড়ছে। যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে পাঠ্যবই পড়ে ঠিক একই মনোযোগের সঙ্গে সে মিতু চিঠি পড়ছে। মিতুর হাতের লেখা কাঁচা। প্রচুর বানান ভুল–কিন্তু চিঠিটা খুব গোছানো—

আপা,

তোমার চিঠি সব মিলিয়ে দশবার পড়লাম। আর কয়েকবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। কাজেই ঠিক করেছি আর পড়ব না। তোমার চিঠির জবাব পরে দিচ্ছি, আগে জরুরী খবরগুলি দিয়ে নেই।

জরুরী খবর নাম্বার ওয়ান–জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্টস এডভাইজার তোমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। তুমি ডরমিটরিতে থাকতে চাও না। নিজে বাসা ভাড়া করে থাকতে চাও তা তোমাকে অতি দ্রুত জানাতে বলেছেন।

জরুরী খবর নাম্বার টু–তোমার অতি শখের তিনটি ক্যাকটাসই মারা গেছে। আমি তাদের বাঁচিয়ে রাখার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। বলধা গার্ডেনের একজন এক্সপার্ট পর্যন্ত খবর দিয়ে এনেছি, লাভ হয়নি।

জরুরী খবর নাম্বার থ্রি–আমাদের বাড়িতে দুতের উপদ্রপ হচ্ছে। আমার বাথরুমটার কল আপনাআপনি খুলে যায়। ছরছর করে পানি পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় পানি দিয়ে কে যেন হাত-মুখ ধুচ্ছে। তুমি তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে নিশ্চয়ই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে–আমি পারছি না। আমি ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে বর্তমানে ছোট মামার বাড়িতে আছি। ছোট মামীর কথাবলা রোগ আরে বেড়েছে। তিনি ক্রমাগত আমার কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে যাচ্ছেন। এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভূতের বাড়িতে থাকাই ভাল ছিল। ভূতটা আর যাই করুক ক্রমাগত কথা বলে না। কল খুলে মাঝে মাঝে শুধু হাত-মুখ ধোয়।

যাই হোক আপা, এখন তোমার চিঠির জবাব দিচ্ছি। যদিও আমার জবাবের জন্য তুমি অপেক্ষা করছ বলে আমার মনে হয় না। তার প্রয়োজনও নেই। তোমার সমস্যা তুমি সবচে আগে টের পাবে এবং তোমার অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান করবে এটা আমি জানি। তোমার সমস্যা তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বলোনি।

অনুমান করছি, তুমি জনৈক গ্রাম্য গায়কের প্রতি তীব্র দুর্বলতা পোষণ করছ। দুর্বলতা গানের জন্য হলে সমস্যার কোন কারণ নেই–দুর্বলতা মানুষটির জন্যে হলে অবশ্যই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

আমার ধারণা গ্রামের পরিবেশ, প্রকাণ্ড হাওড়, শ্রাবণ মাসের আকাশের মেঘ এবং ঝর ঝর বৃষ্টি, দাদাজানের রূপকথার রাজা-বাদশার মত কাঠের বাড়ি–সব তোমার উপর একটা প্রভাব ফেলেছে। মনে উদ্ভট সব খেয়াল জাগছে। এসব খেয়ালকে প্রশ্রয় দেবার প্রশ্নই উঠে না। গ্রামের গায়ক গ্রামেই থাকুক–গান গাইতে থাকুক। তুমি চলে যাও তোমার নিজের জায়গায়।

মনের দেয়াল ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু করে ফেলার চিন্তা মেয়েরা ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সে করে। ঐ বয়স তুমি পার হয়ে এসেছ।

ঐ গায়কের গান শুনতে চাও খুব ভাল কথা, ক্যাস্টে ভর্তি করে গান নিয়ে এসো। যখন শুনতে ইচ্ছা করবে, শুনবে। তার জন্যে গায়ককে নিয়ে আসতে হবে কেন?

আপা, আশা করি, আমার এই ধরনের রূঢ় কথা তোমাকে আহত করবে না। কথাগুলি রূঢ় হলেও সত্যি। সত্যকে গ্রহণ করার সাহস তোমার আছে।

মোহসিন ভাইকে বলতে গেলে আমি জোর করে পাঠিয়েছি। বেচারার এখানে অনেক কাজ ছিল। কাকতালীয়ভাবে উনি যেদিন সুখানপুকুর পৌঁছবেন সেদিন পূর্ণিমা। যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা খুব সুন্দর হবার কথা! তুমি অবশ্যই পূর্ণিমার রাতে মোহসিন ভাইকে নিয়ে ছাদে বসবে। অনেক রাত পর্যন্ত দুজন গল্প করবে।

চিঠি প্রায় শেষ। এখন শুধু জরুরী খবর নাম্বার ফোরটা বলি–তোমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে ২৭শে শ্রাবণ। কাজেই চলে এসো।

ইতি
মিতু

মোহসিন সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে উঠল। নীতুই ঘুম থেকে তুলল–আর কত ঘুমুবেন? উঠুন, আপা আপনার সঙ্গে চা খাবে বলে চা না খেয়ে বসে আছে।

ম্যারাথন ঘুম দিয়ে দিয়েছি, তাই না নীতু?

হুঁ।

খিদেও লেগেছে মারাত্মক।

খিদে লাগলেও আপনাকে কিছু খেতে দেয়া হবে না। এখন খেলে রাতে আবার ভাত খাবেন না।

তুমি তোমার আপাকে বল–আমি আসছি। সেজেগুজে নিজেকে প্রেজেন্ট করি। তোমরা যে আসলে রাজকন্যা তা তো জানতাম না। এখানে এসে জানলাম। রাজকন্যার সামনে তো আর গেঞ্জি গায়ে উপস্থিত হওয়া যাবে না।

নীতু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমরা যে রাজকন্যা সেটা আমরাও জানতাম না। এখানে এসে জেনেছি।

মোহসিন হাসতে হাসতে বলল, তুমি এখন আমাকে একটা বুদ্ধি দাও। তোমার আপার সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন কি কুর্নিশ করতে হবে?

নীতু আবারো খিলখিল করে হেসে উঠল।

চা দেয়া হয়েছে বারান্দায়। শাহানা একা অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যা নামছে ঘন হয়ে। টেবিলে কেরোসিনের বাতি আছে কিন্তু নেভাননা। মোহসিনকে আসতে দেখে শাহানা হাসল। মোহসিন বলল, কেমন আছ হার হাইনেস?

ভাল।

চোখের কোণে কালি, মুখ শুকনো। কি ব্যাপার বল তে? শরীর ভাল তো?

ডাক্তারকে কখনো জিজ্ঞেস করতে নেই শরীর ভাল কি-না।

সরি। তুমি যে একজন ডাক্তার মনেই থাকে না।

শাহানা চা ঢালছে। মোহসিন বলল, শুধু চা দিচ্ছ? প্রচণ্ড খিদে লেগেছে।

খিদে লাগলেও উপায় নেই। দাদাজানের নির্দেশ–বিকেলে তোমাকে যেন কিছু না দেয়া হয়। দুপুরে কিছু না খাওয়ায় উনি রেগে আছেন। তাঁর কাতল মাছের গতি হয়নি।

রাতে গতি হবে। কাতল মাছের দুঃখিত হবার কিছু নেই।

শাহানা হাসতে হাসতে বলল, রাতে অন্য মাছ।

সে কি!

রাজবাড়ির কাণ্ডকারখানা অন্য রকম।

সিগারেট খাওয়া যাবে তো? না-কিবিগারেট খেতে দেখলে তোমার দাদাজান রাগ করবেন?

রাগ করবেন না, খাও।

মোহসিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মিতু আমাকে প্রায় জোর করে পাঠিয়েছে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া। মিতুর ধারণা, তোমাকে এই মুহূর্তে গ্রেফতার করে নিয়ে না গেলে তুমি আর যাবে না, থেকে যাবে।

মিতুর ধারণা ঠিক না, আমি যাব।

কবে যাবে?

তুমি যখন যেতে বলবে। তুমি কবে যেতে চাও?

আমি তো এক্ষুণি যেতে চাই। প্রচণ্ড সব ঝামেলা ফেলে এসেছি। যাই হোক, কাল দুপুরের দিকে রওনা হলে রাতে ঢাকা পৌঁছতে পারি। তোমার অসুবিধা আছে?

না, অসুবিধা নেই।

এই সময়ের মধ্যে হার হাইনেসের রাজত্ব যতটা পারি দেখে নের। দেখার কিছু কি আছে এখানে?

ছোট একটা দীঘি আছে। চারদিক কদমগাছে ঘেরা। শুধু যে অপূর্ব তাই না, মনে হয় জায়গাটা বেহেশতের একটা অংশ ছিল, ভুলে পৃথিবীতে চলে এসেছে। দীঘিটার নাম হল অশ্রুদীঘি।

বল কি! গ্রামের এক দীঘির এ রকম কাব্যিক নাম? কে রেখেছে এই নাম?

আমি।

তুমি?

হুঁ। আমি।

এত সুন্দর দীঘি যদি হয় তার নাম অশ্রুদীঘি হবে কেন?

দীঘিটা দেখলে আনন্দে চোখে পানি এসে যায়, এই জন্যেই তার নাম রেখেছি, অশ্রুদীঘি।

মোহসিন দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তোমার মধ্যে যেমন প্রবল কাব্য ভাব আছে তা জানতাম না।

শাহানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি নিজেও জানুতাগী এখানে এসে অনেক কিছু জেনেছি।

যেমন?

যেমন, আগে ভাবতাম আমার স্বপ্ন হচ্ছে পৃথিবীর বড় ডাক্তারদের মধ্যে একজন হওয়া। এখানে এসে মনে হল এটা ভুল স্বপ্ন। আমার আসল স্বপ্ন অন্য।

আসল স্বপ্ন কি?

আসল স্বপ্ন গ্রাম্য একটা গানের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পথে পথে গান গাওয়া–কে পরাইল আমার চউক্ষে কলংক কাজল।

মিতু ঠিকই বলেছে–দ্রুত তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া উচিত।

শাহানা অস্পষ্ট গলায় বলল, সব মানুষের মধ্যে নানান ধরনের স্বপ্ন থাকে। তার মধ্যে কোটা সত্যি স্বপ্ন কোটা মিথ্যে স্বপ্ন সে ধরতে পারে না। মানুষ সব সময়ই বাস করে একটা বিভ্রমের ভেতর।

মোহসিন হাসতে হাসতে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হওয়া উচিত।

শাহানা হাসল। মোহসিন বলল, যাক, অনেকক্ষণ পর তোমার হাসি দেখলাম।

আগে একবার হেসেছি, তুমি লক্ষ্য করনি।

মোহসিন বলল, তোমার কথাবার্তা খুব হাই ফিলসফির দিকে টার্ন করছে। সহজ কথাবার্তা কিছু বলা যায় না?

যায়। চকোলেট রঙের এই শার্টে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে এবং তুমি যে এত সুপুরুষ তা ঢাকায় থাকতে বুঝতে পারিনি।

থ্যাংকস। এই তো, এখন কথাবার্তাগুলি শুনতে ভাল লাগছে। চল, তোমার অশ্রুদীঘি দেখে আসি।

এখন না। আরেকটু পরে চল। আজ পূর্ণিমা। চাঁদ উঠুক, তারপর যাব।

অশ্রুদীঘির চারপাশে আমরা যদি হাত ধরাধরি করে হাঁটি তাহলে গ্রামের লোক কিছু মনে করবে না তো?

না। আচ্ছা, তুমি কি গান শুনবে?

কে গাইবে? তুমি?

না। আমি গান জানি না কি? এখানে একজন গায়ক আছেন–মতি–উনাকে খবর দিলে…।

কাউকে খবর দিতে হবে না। আমরা হাত ধরাধরি করে অশ্রুদীঘির চারপাশে হাঁটব। গানের দরকার হবে না। আমাদের সবার ভেতর গান আছে বিশেষ বিশেষ সময়ে সেই গান আপনাআপনি কানে বাজতে থাকে… দেখলে তো, দার্শনিক কথাবার্তা আমিও বলতে পারি।

মোহসিন আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠে গেছে–এখনো আলো ছড়াতে শুরু করেনি। শাহানা অপেক্ষা করছে।

মোহসিন বলল, রাজকন্যা তুমি কি আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে?

হাঁটু গেড়ে বস তারপর হাসব।

মোহসিন সত্যি সত্যি হাঁটু গেড়ে বসতে গেল। শাহানা হাত ধরে থামাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *