২১. মানবরূপী শয়তান

নির্বাচিত কলাম বেরিয়েছে একানব্বই সালে ফেব্রুয়ারিতে। আটানব্বই আর নব্বই সালে লেখা কলামগুলো নিয়ে। কলামগুলো নির্বাচিত না বলে প্রাপ্ত বলা যায়। খোকা যে কটি কলাম সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, সেগুলোই বইয়ে দিয়েছেন। অনেক লেখাই হারিয়ে গিয়েছে। আমি লেখাগুলো জমিয়েও রাখিনি, কারণ বই হয়ে কখনও বেরোবে এই স্বপ্নও তো কোনওদিন দেখিনি। বইটি বেরোবার পর যারা বইএর লেখার সঙ্গে এক মত হতে পারেননি, তাঁরা পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেছেন। কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহে গোটা বই লিখে ফেলেছেন। বইগুলোর কিছু কিছু হাতে আসে, কিছু আসে না। তিরানব্বইএর ফেব্রুয়ারিতে জ্ঞানকোষের প্রকাশক উচিত জবাব নামে একটি বই আমাকে দিলেন। লেখকের নাম মোঃ মোকাদ্দেস হোসাইন। নির্বাচিত কলাম পুরোটাই ছেপে, আমার প্রতিটি রচনার নিচে তাঁর নিজের মন্তব্য সেঁটে মোকাদ্দেস হোসেন বই বের করেছেন। নির্বাচিত কলাম তো বিক্রি হচ্ছেই, উচিত জবাবও নাকি কম নয়। নির্বাচিত কলামের চেয়ে উচিত জবাব দশ টাকা কম, বিক্রি না হবার কোনও কারণ নেই, পাঠক কম দামে আমার লেখাগুলো পাচ্ছে, বাড়তি একটি জিনিসও পাচ্ছে, সে মন্তব্য। এ বই যে কিনবে, তার আর নির্বাচিত কলাম কেনার দরকার নেই, কারণ এই বইএর ভেতরেই আমার পুরো বইটিই আছে, প্রকাশক বললেন। প্রকাশক ব্যবসার কথা ভাবলেন। আমি ব্যবসার কথা নয়, ভাবলাম মোকাদ্দেস হোসাইনের অসততার কথা। গ্রন্থসত্ত্র আইন বলে কোনও আইন এ দেশে আছে কি না সে ব্যাপারে আমার জানতে আগ্রহ হয়। নাহিদের কাছে জানতে চাই ও জানে কি না এ বিষয়ে। মেয়েটি আইন নিয়ে লেখাপড়া করেছে, আমার বাড়িতে প্রায়ই আসে। এমনি আসে। আমার লেখা ভাল লাগে বলে আসে। ওই নাহিদই একদিন অতি উৎসাহে বলল মামলা করার কথা। মামলা সম্পর্কে আমার চেয়ে কম জানোয়া আর কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যপারটিতে জড়াতে আমি গড়িমসি করি, কিন্তু নাহিদ বলে যে আমার কোনও সাতে পাঁচে না থাকলেও চলবে, সে নিজে রাবেয়া ভূঁইয়াকে দিয়ে মামলা করাবে। কিন্তু! কিন্তু কি! শুনেছি মামলায় নাকি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা যায়! নাহিদ রাবেয়া ভূঁইয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে আমাকে জানিয়ে দিল, ব্যারিস্টার কোনও টাকা নেবেনই না। রাবেয়া ভূঁইয়াকে লোকে চেনে। তিনি একসময় আইন মন্ত্রী ছিলেন। এমন নামী ব্যারিস্টার গ্রন্থস্বত্ত্ব আইন ভাঙার অপরাধে উচিত জবাবের প্রকাশকের বিরুদ্ধে লড়বেন, টাকা পয়সা ছাড়া লড়বেন, আর আমার মোটে কিμছু করতে হবে না, হোক না! রাজি হই। রাজি হওয়ার পর পরই অবশ্য নাহিদের অনুরোধ একটু একটু করে তীব্র হতে থাকে, একদিন দেখা অন্তত করুন, এ কাজে ও কাজে কেরানিকে টাকা পয়সা দিতে হবে, দিন। আমাকে নিয়ে রাবেয়া ভূঁইয়ার সঙ্গে একদিন দেখা করিয়েও আনল। গ্রন্থস্বত্ত্ব আইনের কথা তখন তাঁর মুখেই শুনি যে বই এর স্বত্ত্ব নিয়ে এ দেশে এ অবদি কেউ মামলা করেনি। হয়ত ইট কাঠ আম কাঁঠাল এমনকি আমস্বত্ত্বেরও স্বত্ত্ব থাকে, কিন্তু গ্রন্থের থাকে না। আইনত, বইএর প্রথম পৃষ্ঠায় যার নামই থাক গ্রন্থসত্ত্বাধিকারী হিসেবে, রচয়িতার রয়্যালটি সেই সত্ত্বাধিকারির হাতে কেউ পৌঁছোবে না যতক্ষণ না সত্ত্ব্বাধিকার নিবন্ধিভূক্তি হচ্ছে। রাবেয়া ভূঁইয়া আমাকে পাঠালেন শেরে বাংলা নগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সত্ত্বাধিকার আপিসে স্বত্ত্বাধিকার নিবন্ধিকরণের জন্য। মার্চের ষোল তারিখে আবেদন করলাম, নথিভুক্ত হয়ে বেরোল মে মাসের পনেরো তারিখে। রাবেয়া ভূঁইয়া এরপর মামলার আরজি লিখে নিজেই পুরোনো ঢাকার দায়রা জজ আদালতে যাতায়ত শুরু করলেন। আরজির বিষয়, নকল বইটির প্রকাশনা, পরিবেশনা, মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হোক। যুক্তির কথা, কারণ ওই লোককে আমি অনুমতি দিই নি নির্বাচিত কলামের অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত নতুন করে তাঁর বইয়ে ছাপতে। লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাও দাও, সমালোচনা করতে চাইলে থান ইটের আকারে পুরো সমালোচনার বই বের করা যায়, আহমদ ছফা এবং অন্যরা যেমন করেছেন। সমালোচনার নামে যে গালাগাল করা হয়েছে আমাকে, সেটি আমাকে আহত করেনি, অহরহই এমন গালাগাল ইনকিলাব জাতীয় পত্রিকার পাতা জুড়ে প্রকাশ হয়, এ নতুন কিছু নয়। আর গাল কারা দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে সে ব্যাপারে আমার ধারণা আছে বলেই আমার গায়ে পায়ে কোথাও কোনও দাগ পড়ে না, মনে তো নয়ই। কিন্তু আমার বইটি চুরি করবে কেন! মামলা নিয়ে নাহিদের উত্তেজনা এমনই লাগামছাড়া হয়ে ওঠে যে মামলার শুনানির দিন একবার আমাকে তার জোর জবরদস্তিতে যেতেই হল আদালতে। আদালত জুড়ে মহাদাপটে বিচরণ করছেন অসংখ্য টুপি দাড়িঅলা লোক। মোকাদ্দেস হোসাইন তাঁর সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে আদালতে উপস্থিত। বিবাদির পক্ষে ব্যারিস্টার কোরবান আলী লড়ছেন। ব্যারিস্টার কোরবান আলী তাঁর জীবনটি ইতিমধ্যে কোরবান করে দিতে চাইছেন আমার বিরুদ্ধে লড়ে। পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য বিবৃতি যখনই বেরোয়, ব্যারিস্টার কোরবান আলীর নামটি জ্বলজ্বল করে। যোগ্য ব্যারিস্টার বটে উচিত জবাবের জন্য। আমাকে উচিত শাস্তি না দিয়ে তিনি ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত যা হল তা দুঃখজনক। মামলা আমার পক্ষে যায়নি। আমার আরজিই বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। এরপর মোকাদ্দেস হোসাইন কেবল উচিত জবাব বইটি বাজারে পূনর্মুদ্রণ করে ক্ষান্ত হননি, দুপক্ষের আরজি আর আরজির জবাব ছেপে লিফলেটও বিলি করতে লাগলেন। একটি লিফলেটে লেখা, ‘ প্রিয় মুসলমান ভাই ও বোনেরা! মানবরূপী শয়তান হতে সাবধান!! উচিৎ জবাবের লেখক মুহম্মদ মোকাদ্দেস হোসাইন কী এমন জবাব দিলেন যে বিজাতীয় বিধর্মীদের কর্তৃক আনন্দ পুরষ্কৃত চরম ইসলাম ও পরম পুরুষবিদ্বেষী তসলিমা নাসরিনের সোঁচালো কলম এমনই ভোঁতা হয়ে গেছে যে তিনি লেখার জবাব লেখনীর মাধ্যমে না দিতে পেরে শেষে বাধ্য হয়েছেন উচিৎ জবাবের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিতে। উচিৎ জবাব এখন ফটোকম্পোজের চেয়েও নিখুঁত ঝকঝকে ও তকতকে টাইপে পরিবর্ধিত, পরিমার্জিত ও আরো অকাট্য যুক্তি নির্ভর জবাবে প্রকাশিত হয়েছে — যাতে পাবেন নির্বাচিত কলাম নামের বিতর্কিত বইটির প্রতিটি কলামের নিচে তার দাঁত ভাঙা উচিৎ জবাব..!!’ আমার আরজির জবাবে বিবাদিগণেরও পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার কোরবান আলী বলেছেন, ‘বিবাদিগণ বাদিনীর অশ্লীল, অশ্রাব্য, অসামাজিক, নোংরা, ধর্ম-বিরুদ্ধ, দেশদ্রোহী ও কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেদনে ঠাসা ভরপুর এহেন জঘন্য পুস্তক নকল করার হীন উদ্দেশ্যে কোনও গ্রন্থ রচনা করেন নাই, বরং এ জাতীয় ধৃষ্টতাপূর্ণ লেখার তীব্র সমালোচনা করিয়া চিরাচরিত রীতিতে জবাব দিয়াছেন। বাদিনী কপিরাইট অফিসকে ভুল বুঝাইয়া এই কুরুচিপূর্ণ পুস্তক এর কপিরাইট নিবন্ধন করিয়াছেন। এই ধরনের পুস্তক প্রকাশনা ও বিতরণ বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির লক্ষ্যে সভ্য সমাজকে বাদিনী অসভ্যতার দিকে নিয়া যাইতেছে। বিবাদির পরিচয়, ১ নং বিবাদি একজন প্রথিতযশা লেখক ও প্রকাশক, তিনি ছাত্র জীবনে একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেন। তিনি জীবনের শুরুতেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে বরাবরই সরকারি বৃত্তি লাভ করিয়া আসিয়াছেন। তিনি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ৫ টি লেটার সহ স্টারমার্ক ও স্কলারশিপ পাইয়া খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি দেশের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজ থেকে ১ম বিভাগে আই.এস.সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি লেখালেখি ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়াইয়া পড়েন। ১৯৮৭ ইং সন থেকেই বই লেখায় তিনি মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর নীহারিকা মাধ্যমিক ভূগোল গাইড, নীহারিকা মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান গাইড ১ম পত্র ও ২য় পত্র ইত্যাদি পুস্তক সমূহের তিনি সফলকাম রচয়িতা ও প্রকাশক। তাহার প্রকাশিত ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণীর বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের গাইড বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদল লাভ করিয়াছে। তিনি জাতি গঠনে গঠনমূলক ও সৃজনশীল লেখার দ্বারা কিশোর ও তরুণদের দিক নির্দেশনা দিয়া জাতির খেদমতে ব্যাপৃত আছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ সৃজনশীল লেখক পরিষদের সহকারী সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাংলাদেশের সৃজনশীল লেখক লেখিকাদের কল্যাণে নিয়োজিত আছেন।’

বাকি বিবাদিগণও বেশ সম্মানীয় বটে। তাঁদের বক্তব্য, ‘বাদিনী বিভিন্ন কলামে ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করিয়া কথা বলিতে দ্বিধা করেননি, এমনকি পবিত্র কোরান শরিফ ও হাদীস শরিফের বিকৃত ব্যাখ্যা পর্যন্ত করিয়াছেন। পবিত্র কোরান শরিফকে কটাক্ষ করিয়া ইহাকে স্বামীদলভুক্ত পুরুষ রচিত বলিয়াছেন, ইহার পাঠক ও অনুসারীকে তিনি বর্বর ও মূর্খ বলিয়া গালি দিয়াছেন। বাদিনীর হঠাকারিতার মাত্রা এতই ভয়ানক যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্প্রতি বাধ্য হইয়াছেন তাহার লজ্জা নামক বইটি বাজেয়াপ্ত করিতে। পাশাপাশি সমাজ সচেতন বিভিন্ন মহলের জনগণের নিকট হইতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দাবী উঠিয়াছে বাদিনীর নির্বাচিত কলাম ও শোধ গ্রন্থ দুইখানি বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য। সাম্প্রতিক সিলেট শহরে তথা দেশের সকল সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে সাত দিনের মধ্যে তাকে বন্দী করার ও তার সমস্ত কর্ম বাজেয়াপ্ত করার জন্য জোর দাবী উঠেছে। অন্যথায় সিলেট শহর সহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর প্রতিবাদে হরতালের ডাক পড়িয়াছে। বাদিনী তাহার বিভিন্ন কলামে নারী স্বাধীনতার নামে পুরুষের বিরুদ্ধে অযথা কটুক্তি ও লাগামহীন অশ্রাব্য ভাষা ব্যাবহার করিয়া শ্রেণী বিদ্বেষ সৃষ্টি করার যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, নারীদেরকে কোন অংশেই বা কোন কলামেই সম্মান না দেখাইয়া তাহাদেরকে কলুষিত করার চেষ্টা করিয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় মুসলিম পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিবর্গকে অসম্মান করিবার এক জঘন্য ও হীন চেষ্টা চালাইয়াছেন। বাদিনী তাহার লেখায় দেশিয় প্রচলিত স্বাভাবিক নিয়ম নীতি ভঙ্গ করিয়া শালীনতা, ভদ্রতা লংঘন করিয়া কুরুচিপূর্ণ ও নগ্ন যৌন বিষয়ে আলোচনা করিয়া পাঠক সমাজকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলিয়া দিয়াছেন। নির্বাচিত কলামের শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের সমাদৃত মুসলিম সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার করিয়াছেন বটে এবং যে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়া কল্পিত নারী ঘটিত এক উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনায় ভরপুর অসভ্য সমাজ রূপায়নের জন্য যথেষ্ট প্রয়াস চালাইয়াছেন। পুরুষের ধর্মীয় বিধান মোতাবেক একাধিক স্ত্রী অনুমতির প্রতি বাদিনী জঘন্যভাবে আক্রমণ করিয়াছেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একজন স্ত্রীর একাধিক স্বামীর উপস্থিতিও সমাজ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে থাকার দাবী করিয়াছেন। যাহা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে স্ত্রীর জন্য জেনা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে সকল মানুষের পিতৃ পরিচয় নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে তদোপরি সুন্দর মানব জীবন ও স্মরাণাতীতকাল হইতে প্রতিষ্ঠিত মানব সভ্যতা ধুলায় মিশিয়া যাইবে। যে ষড়যন্ত্রের হোতা বাদিনী নিজে। বাদিনী তাহার উক্ত গ্রন্থে জরায়ুর স্বাধীনতার উপরও জোরালো বক্তব্য রাখিয়াছেন। জরায়ু নেহায়েতই নারীদের শরীরে একটি বিশেষ অংশ যার মাধ্যমে মানব জনম ও মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়া আছে। উক্ত তথাকথিত স্বাধীনতার সাথে বাদিনী আল্লাহর স্বাভাবিক সৃষ্টির প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করিয়াছেন। যার মাধ্যমে বাদিনীর ধর্মচ্যূতি ঘটিয়াছে বিধায় কোরানের আলোকে মুরতাদ হিসাবে অভিশপ্ত সালমান রুশদির ন্যায় মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে।’

উচিত জবাবের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। উচিত জবাব বহাল তবিয়তে বিরাজ করে বাজারে। আদালতের মুরব্বীগণ আমার পক্ষে রায় দিয়ে উচিত জবাবকে একটি উচিত জবাব দেবার পক্ষে নন। আমি মানবরূপী শয়তান, তাঁরা আল্লাহর বান্দা, সৃষ্টির সেরা জীব। আমি কেন পেরে উঠব আল্লাহর দয়া যাদের ওপর, তাদের ব্যবসা নষ্ট করতে! আমার ওপর তো আল্লাহ তায়ালার করুণা বর্ষিত হয়নি।

উচিত জবাব হামেশাই দেওয়া হচ্ছে আমাকে। উচিত অনুচিত নিয়ে দুঃখ করে সময় নষ্ট করতে আমার আর ইচ্ছে হয় না। আমার সময়গুলো অন্যভাবে ব্যয় হতে থাকে। কারও জন্য কিছু করে। যা করতে চাই, যেমন করে করতে চাই তা করতে পারি না বলে লিখতে হয়। আমাকে আমূল তোলপাড় করা ভাবনা গুলোর কতটুকুই আর প্রকাশ করতে পারি লিখে! ভাবনা হবে না কেন, প্রতিনিয়তই মেয়েরা লাঞ্ছিতা হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে। দেশের ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেগুলো আমাকে নাড়ায়, কাঁদায়, ভাবায়, ক্ষুব্ধ করে, ব্যথিত করে সেসব নিয়ে লিখি। কোনও গভীর তত্ত্ব কথা নয়। তথ্যবহুলও কোনও প্রবন্ধ নয়। লেখাগুলো একধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। গবেষণা করে কিছু বার করা নয়। দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়, পরদিন সে পত্রিকার পাতা বাদামের ঠোঙা হয়ে যায়। সাপ্তাহিকী গুলোয় ছাপা হয়, সপ্তাহ গেলে সেসব কাগজ চলে যায় ময়লা ফেলার বাক্সে। পচা পুরোনো জিনিসের সঙ্গে মিশে যায়। আমার প্রতিদিনকার কলামের টুকরো টুকরো কিছু বাক্য.. .

‘শাহিদা নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটকে খুন করে ফেলল লিয়াকত ম্যাজিস্ট্রেট কারণ শাহিদা লিয়াকতের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। লিয়াকতের সঙ্গে হয়ত শাহিদার বন্ধুত্ব ছিল, এই সম্পর্কের ছুতোয় লিয়াকত জোর খাটিয়েছে। লিয়াকত ভেবেই নিয়েছে সে পুরুষ, সে যা বলবে শাহিদাকে তা-ই শুনতে হবে। শাহিদা শোনেনি সম্ভবত শোনেনি এই জন্য যে সে একজন শিক্ষিত স্বনির্ভর মেয়ে, তার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম সে দিতে চায়। কিন্তু তা মানবে কেন লিয়াকত, সে পুরুষ, সে তার গায়ের জোর তার ছুরির জোর তার পুরুষঅঙ্গের জোর না খাটালে সে আর পুরুষ কেন! পুরুষ এমনই জন্তু বিশেষ যে দাঁত নখ চোখের হিংস্রতা দিয়ে সে তার পুরুষত্ব জাহির করতে চায়। মনুষ্যত্ব, আমি সবসময়ই দেখেছি পুরুষের মধ্যে খুব কম। মনুষ্যত্বের সঙ্গে পুরুষত্বের বোধহয় চিরকালীন এক বিরোধ আছেই। লিয়াকত যদি বিয়ে করত শাহিদাকে, এরকম আঘাতে আঘাতে শাহিদাকে তিল তিল করে মরতে হত, কেউ দেখতে পেত না তার ভেতরের ক্ষরণ, লোকে ভাবত — কী চমৎকার জুটি! লোকে এখনও চোখে কালি পড়া নিরন্তর মার খাওয়া স্ত্রীদের নির্দ্বিধায় সুখী বলে বিবেচনা করে। লিয়াকত পুরুষের মত পুরুষ। সে পুরুষের যোগ্য কাজই করেছে। নারীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে।

প্রেম প্রেমই। এর আগে পরে পরকিয়া বা আপনকিয়া শব্দ ব্যবহার করলে প্রেমের মহিমাই নষ্ট হয়। ম্যাজিস্ট্রেট শাহিদা পরকিয়া প্রেম করত এবং সন্তানটি তার স্বামীর ঔরসজাত নয়, এ নিয়ে পত্রিকাগুলো এখন মুখর। প্রেম সে করতেই পারে, স্বামীর যদি স্পার্মলেস সিমেন থাকে অথবা সে উত্থানরহিত হয়, স্ত্রী তার প্রেমিকের সন্তান গর্ভে নিতেই পারে, মানুষ তার মনে এবং শরীরে কাকে বহন করবে বা না করবে সে একান্তই তার ব্যপার। শাহিদার প্রেম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা মানে তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ শুধু নয়, পদক্ষেপ করাও। অবশ্য জীবিত মেয়েদেরই যেখানে স্বাধীনতা নেই, সেখানে মৃত মেয়ের আবার স্বাধীনতা কি!

বাসাবোয় নিলুফার নামের এক মেয়েকে খুন করেছে তার স্বামী। সেই স্বামী এখন বহাল তবিয়তে আছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে কে আটকায়! তার আছে পয়সার জোর, সবচেয়ে বেশি আছে সরকারের জোর। সরকারের জোর যার আছে, সে যত বড় চোর ডাকাত বদমাশ খুনী হোক পার পেয়ে যায়। সরকার তার পেয়ারা বান্দাদের জন্য বড় শক্ত করে একটি সাঁকো বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালার পুলসেরাতের চেয়ে সরকারের সাঁকো বেশি মজবুত।

মহিলা পরিষদের সদস্যরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছে খুকুর ফাঁসি দেবার জন্য। মুনির তার স্ত্রীকে খুন করেছে। মুনিরের ফাঁসি হবে। কিন্তু মহিলা পরিষদের দাবি, খুকুকেও ফাঁসি দিতে হবে। কেন, খুকুকে কেন ফাঁসি দিতে হবে! কারণ খুকু নাকি চরিত্রহীনা ছিল। নিজে বিবাহিতা হয়েও খুকু মুনিরের সঙ্গে প্রেম করেছে, এই তার দোষ। মহিলা পরিষদএর মিছিল যখন আদালত প্রাঙ্গনে গিয়ে খুকুর ফাঁসির জন্য গলা ফাটাচ্ছে, আমি লজ্জায় মুখ ঢেকেছি। খুকুর কেন শাস্তি হবে, খুকুর অন্যায়টি কি? খুকু তো এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল না! অক্ষম অথর্ব স্বামী নিয়ে জীবন কাটাতো খুকু, স্বামী দ্বারা লাঞ্ছিত, প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত এই অসহায় মেয়েটিকে সারাদেশের মানুষ গাল দিল, জেলে ভরল, খুকু নামটিকে একটি নষ্ট মেয়ের নাম হিসেবে চিহ্নিত করল। খুকুর সঙ্গে মুনিরের ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, থাকতেই পারে। এটি খুকুর দোষ নয়। ভালবাসা কি দোষের জিনিস!

পটুয়াখালির এক লঞ্চযাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কোনও ডাকাত নয়, লঞ্চের মস্তান ছেলেরা নয়, মদ্যপ বদমাশরা নয়, ধর্ষণ করেছে ওই লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যে আনসারদের রাখা হয়েছিল, তারা। তারা পাঁচজন। কুড়ি বছর বয়সী মোসাম্মত বেগমকে জোর করে তাদের কেবিনে নিয়ে ধর্ষণ করে। লঞ্চ ভর্তি লোক, কিন্তু আনসারগুলো এই কাজটি করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। সেবকদের পুরুষাঙ্গ লঞ্চের ভিড়ের মধ্যে একটি যাত্রীর জন্য উত্থিত হয়েছে। উত্থিত হওয়ায় আমি কোনও আপত্তি করছি না। তারা সেবক হলেও পুরুষ তো, উত্থিত হবেই। মেয়েটি যদি তাদের উত্থানে সাড়া দিত, যদি এমন হত যে পাঁচজনের সঙ্গে সঙ্গমে মোসাম্মত বেগমের আপত্তি নেই তবে এ নিয়ে সারাদেশে কারওরই আপত্তি করবার প্রশ্ন ওঠে না। যে কারও অধিকার আছে যে কোনও সম্পর্কের গভীরে যাওয়া, অবশ্য পরস্পরের যদি সম্মতি থাকে। কিন্তু জোর করে কোনও সম্পর্ক স্থাপন হতে পারে না। হওয়া উচিত নয় যদি এই সমাজকে সভ্য বলা হয়। সভ্য বলেই তো দাবি করছে সবাই, তবে জোর করে সম্পর্ক সম্ভব হয় কী করে? কী করে একজন যাত্রীকে ধর্ষণের জন্য সেদিন রাষ্ট্র কতৃক নিয়োজিত কিছু আনসার, যে আনসার শব্দের অর্থ য়েচ্ছ!সেবক, উদ্যত হয়? কী করে যাত্রীদের সেবকরাই যাত্রীদের নিরাপত্তার সবচেয়ে অন্তরায় হয়? আনসারদের অপরাধের কোনও শাস্তি হয়নি। আমার ভাবতে অবাক লাগে দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, ভেবে আশ্চর্য হই এই দেশের বিরোধীদলের নেত্রী একজন নারী। তাঁরা কি এইসব ঘরে বাইরের ধর্ষণের কোনও সংবাদ পান না? নাকি পেলেও তাঁদের অন্তরে কোনও জ্বালা ধরে না, তাঁদের কাছে ধর্ষণ অত্যন্ত উপাদেয় জিনিস বলে মনে হয়, ধর্ষণের জন্য তেমন রুষ্ট হওয়ার তাঁরা দেখেন না কিছু! দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হওয়ার পরও দেশে অবাধে চলছে বধুহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড ছোঁড়া, যৌতুকের অত্যাচার, বাল্যবিবাহ। এখনও নারীর বিরুদ্ধে নানা জাতের আইন খড়গ উঁচিয়ে আছে। নারী হয়ে নারীর বেদনা বুঝবার ক্ষমতা যার বা যাদের নেই তাঁরা মানুষের আর কী সেবা করতে পারেন! তাঁরা যদি অত্যাচারিতের পক্ষেই না দাঁড়াতে পারেন, তবে তাঁরা কার পক্ষ নেবার জন্য মহান সেবকের দায়িত্ব নিয়েছেন? ধনীর, অত্যাচারীর, সুবিধাভোগীর, পাপীর? পাঁচ সেবকের ধর্ষণ এমন কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এমন ধর্ষণ হচ্ছেই গ্রামে গঞ্জে শহরে ফুটপাতে লঞ্চে ট্রেনে নৌকোয় জাহাজে। এসবের জন্য শাস্তি হবে না কারওর। এই দেশে ধর্ষণ কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। মহান সেবকের বন্ধুরা নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেবে, সেই ফতোয়া মহাসমারোহে পালন করা হবে। যে দেশে নারীর পক্ষে লেখার অপরাধে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, সেই দেশে ফতোয়ার রাজনীতিই বিরাজ করবে, এ আর আশ্চর্য কী! কিছুই অবাক করে না আমাদের। কিছুই আর হতবাক করে না আমাদের। খবরের কাগজে আমরা এইসব চমকপ্রদ সংবাদ দেখি পড়ি ভুলে যাই। কিছুই আমাদের আর কাতর করে না। আমাদের পিঠে কোনও চেতনার চাবুক পড়ে না। কারণ আমরা জেনেই গিয়েছি জনগণের সেবকেরা যখন ধর্ষকের ভূমিকায় নামে, মানুষের সাধ্য থাকে না তাদের শাস্তি দেবার। এদেশে সেবক পাল্টায়, সেবকের চরিত্র পাল্টায় না। সে নারী হোক কী পুরুষ হোক।

কলকাতার ফুলবাগানে ঘুমন্ত এক ফুটপাতবাসিনীকে জোর করে পুলিশ ভ্যানে তুলে থানার ব্যারাকে নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল নীলকমল সনাতন আর ভোলানাথ ধর্ষণ করেছিল। নীলকমলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। কিন্তু এ দেশে কোনও ধর্ষকের এরকম শাস্তি কল্পনা করা যায় না। পটুয়াখালির লঞ্চের যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিল আনসাররা, বলা হচ্ছে সে নাকি পতিতা ছিল। যেন পতিতা ছিল বলে আনসাররা তাকে ধর্ষণ করবার দাবি রাখে। পতিতা ছিল বলে আনসারদের সাতখুন মাপ। এখানে ফুটপাতবাসি হলে এরকমই অবস্থা হত, বলা হত ফুটপাতে পড়ে থাকা মেয়েকে ধর্ষণ করা এমন কোনও অন্যায় নয়। ধর্ষণ ঘটলে এখনও এদেশে ধর্ষিতাকেই দোষী ভাবা হয়। বলা হয় মেয়েটি প্রভোক করেছিল ধর্ষণ করতে, তার মিটিমিটি চোখের চাওয়া, অকারণ হাসি, উগ্র পোশাক সবই ধর্ষণের অনুকূলে ছিল। এসব যুক্তিকে সমাজে বেশ কদর করা হয়। একজন মেয়ে, তার যদি ইচ্ছে করে সে হাসবে, যেমন ইচ্ছে চলবে, যেমন খুশি তার পোশাক পরবে — এ কারণে তাকে ধর্ষিতা হতে হবে কেন?

আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আর সব স্বাধীনতার মত মানুষের এই স্বাধীনতাও প্রয়োজন। কিন্তু মানুষের শরীরে জোর জবরদস্তি চলবে কেন? সে ভিখিরি হোক কি পতিতা হোক কি স্ত্রী হোক — সে যদি অনুমতি না দেয় কারও কি অধিকার আছে তাকে স্পর্শ করবার? আমার বিচারে নেই। রাষ্ট্রের বিচারে বরাবরই ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। এতে রাষ্ট্রই নারীর নাগরিক অধিকারে থুতু ছিটোয়। এরপরও এ দেশের নারীরা যদি মুখ ফুটে ধর্ষণের বিচার যাবজ্জীবন করবার জন্য আন্দোলন না করে, আমি তবে সেই নির্বোধ নারীদের বলতে বাধ্য হব, তারা বোধহয় মনে মনে ধর্ষিতা হতেই চায়।

যায় যায় দিন পত্রিকায় আমার নিয়মিত কলামটির নাম আমার মেয়েবেলা। ওতে একবার লিখেছিলাম .. বাসে উঠলেও একটি একলা মেয়ে দেখলে কনডাকটর কোনও মেয়েকে পাশে বসায়, মেয়ে না পাওয়া গেলে বুড়ো পুরুষের পাশে, বড় জোর বাচ্চা কোনও ছেলের পাশে। কনডাকটর নিজে পুরুষ, সেও জানে পুরুষের স্বভাব। তাই সে অথর্ব বা অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পাশে মেয়েদের বসিয়ে স্বস্তি পায়। পুরোনো লেখা নতুন করে স্মরণ করবার কারণ হচ্ছে একটি চিঠি। চিঠি তো দিনে কয়েক শ আসে। সব চিঠি পড়বার সময়ও হয় না। হঠাৎ হঠাৎ কিছু চিঠি চমকে দেয়, কিছু চিঠি ভাবায়, কিছু আবার কাঁদায়ও। মৌ নামের এক মেয়ে কুমিল্লা থেকে আমাকে লিখেছে.. ‘আপনার চলতি সংখ্যার কলামের এক কোণে লেখা ছিল বুড়োরা অথর্ব। এতে আমারও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমার অবুঝ বেলার ছোট্ট একটা ঘটনা আপনাকে জানাতে ইচ্ছে করছে। প্রতিকারের আশায় নয় — শুধু বলবার জন্য মানুষের কেউ না কেউ তো থাকতেই হয়। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বুড়ো মতন এক লোক এলেন আমাদের মফস্বলে, শেক্সপিয়রের গল্প থেকে নৃত্যনাট্য করে ডোনেশন তুলতে। আমি ওতে একটা গানে অংশ নিয়েছিলাম। একদিন রিহার্সেলের পর রাতে জীপে করে সবাইকে পৌঁছে দিতে গিয়ে সবচেয়ে শেষে পৌঁছোলেন আমাকে — সর্বকণিষ্ঠ বলে এবং সেই সুযোগে উনি আঙুল দিয়ে আমার যৌনাঙ্গে চাপ দিতে লাগলেন। আরও বেশি কিছু হবার আশঙ্কায় সে রাতে শুধু মুহূর্ত গুনেছি কখন বাসার গেটটা চোখে পড়বে। পরের দিন বাসায় চলে এলেন ভাল করে গান শেখাতে। আমার মা ডিসটার্ব হবে ভেবে সে ঘরে আর এলেন না। উনি কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন, দাদু তোমার কাছে একটা ছোট্ট জিনিস চাইব, আমাকে ফিরিয়ে দিও না। এবং তারও অনেক পরে আতঙ্কিত আমার পা ফাঁক করে যৌনাঙ্গে একটা চুমু দিলেন। তারপর অনেকগুলো দিন আমার শুধু পানিতে ডুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে করত নিজেকে। একথা আমি কাউকে বলিনি, বাবা মা বন্ধু বান্ধবী কাউকে না, পাছে আমাকে সবাই অপবিত্র মনে করে। এবং আজও পাকা দাড়ি দেখলে আমার বমি আসে, আমি সব সময় তাদের ছোঁয়া বাঁচাতে ব্যস্ত থাকি, পাছে আশীর্বাদ করার ছলে ওরা আমার মনে আরও ঘৃণার জন্ম দেয়। মনে মনে ভাবি যেন আমার শুধু শাশুড়ি থাকে, কোনও ভদ্রবেশি শ্বশুর না থাকে। যখন বাসে চেপে কোথাও যাই, শুধুই খুঁজি একজন যুবককে, কোনও বৃদ্ধকে নয়। আমি লক্ষ্য করেছি যুবকেরা কিছুক্ষণ গল্প জমাবার চেষ্টা করে শেষে ক্ষান্ত দেয়, কিন্তু বুড়োরা কখনও ঘুমিয়ে, কখনও জেগে কেবলই শরীর চেপে বসে থাকে। আপনি সেইসব ছোট্ট কিশোরীদের নিয়েও কিছু লিখুন, যারা নিজেদের বাঁচাতে শেখেনি তথাকথিত দাদুদের কবল থেকে।’

চিঠিটি পড়ে মনে মনে ক্ষমা চাইলাম মৌ এর কাছে। বুড়োদের অথর্ব বলা আমার উচিত হয়নি। আসলে পুরুষ পুরুষই, সে খোকা হোক কি বুড়ো হোক। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা ওঠে না, পুরুষের চরিত্রও তেমন, থুত্থুড়ে হলেও এটি শুদ্ধ হয় না।

এদেশে উত্তরাধিকার আইনগুলো করা হয়েছে ধর্মমতে। মুসলমানদের উত্তরাধিকারের বৈষম্য দেখে আমরা নিশ্চয় ভাবতে পারি মাতা ও পিতা সমান নয়। কন্যা ও পুত্র সমান নয়, স্ত্রী ও স্বামী সমান নয়। বৈষম্য আছে। কিন্তু বৈষম্য কেন? কেন মাতা কন্যা ও স্ত্রী পিতা পুত্র ও কন্যার সমান মর্যাদা পাবে না? এই বৈষম্য জলজ্যান্ত রেখে যে পুরুষ বা নারী ভাবে যে তারা তৃপ্ত,তারা সুখী, তারা সন্তুষ্ট তবে তারা নিজেরাই নিজের কবর খুঁড়ছে আর চতুর দর্শক দাঁড়িয়ে তালি দিয়ে তাদের অভিনন্দিত করছে। আমি চতুর নই বলে সম্পত্তি বন্টনের নমুনা দেখে আর সব পুরুষের মত সুখে ও স্বস্তিতে গা এলাতে পারছি না। আমি সমাজের ধিকৃত, বঞ্চিত, ধর্ষিত, নিরীহ, নিরূপায় নারী। উত্তরাধিকারের এই আইন আমি মানি না। সম্পত্তি বন্টনের সুস্থ আইন চাই। আজ থেকে চাই। এই মুহূর্ত থেকে। দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর গায়ে কি এই চরম বৈষম্যের কোনও ছ্যাঁকা লাগে না? আমার তো লাগে, তাঁর লাগে না কেন? তিনি যদি মানুষ হন, নারী হন, বিবেকবান হন, বুদ্ধিমান হন, তিনি যদি সৎ হন, নিষ্ঠ হন, এই অসম ব্যবস্থার চাবুক তাঁর হৃদয়ে পড়বেই।

লোকে বলে বাবার সম্পত্তি যদি কন্যা নেয়, তবে কন্যার তা সয় না। ও কেবল পুত্রের সয়। যেন সব সওয়ার কাজ শিশ্ন করে। শিশ্ন যাদের নেই, তাদের গায়ে সম্পত্তির কাঁটা ফোটে, সে মারা পড়ে। এইসব বলে কন্যাকে বিমুখ করতে চায় ধূর্ত লোকেরা। শেষ অবদি কন্যাকে বঞ্চিত করে তারা।

মাতৃকূলের চেয়ে পিতৃকুল বেশি লাভবান হয় সম্পত্তি ভোগের ক্ষেত্রে। ঠকাবার নিয়ম তৈরি করেছে শরিয়া বিধি। শরিয়া বিধির নখ দাঁত উত্তরাধিকারের শরীর কামড়ে ধরেছে।

নারী কখনও কোনও সম্পত্তিরঅংশীদার নয়। সে অবশিষ্টাংশভোগী। অবশিষ্টাংশভোগীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর বৈধ উত্তরাধিকারী। অবশিষ্ট যা থাকে, তা পায়। বাড়ির পুরুষেরা খেয়ে দেয়ে যা থাকে, তা যেমন নারীরা খায়। তেমন সম্পত্তিও পুরুষ অংশীদাররা নিয়ে টিয়ে তলাঝাড়া যা থাকে, নারী পায়। স্ত্রী, কন্যা, মা, বোন, বৈপিত্রেয় বোন, সকলেই সম্পত্তির অবশিষ্টাংশ পায়। কেউই অংশীদার নয়। কেউই প্রথম শ্রেণীর উত্তরাধিকারী নয়। এই অবশিষ্টাংশ ভোগ করবার বেলায়ও সমাজের সাত রকম বাধা, বলা হয়, মেয়েরা সম্পত্তি নিলে সম্পত্তি সয় না।

সম্পত্তি সওয়াবার ব্যবস্থা করতে হবে। সয় না বলে সেগুলো পুরুষের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা চলবে না। পিতার সমান মাতাকে, পুত্রের সমান কন্যাকে, স্বামীর সমান স্ত্রীকে সমান উত্তরাধিকার দেবার ব্যবস্থা করা হলে সব সইবে। আর তা না হলে যে সরকার আমাদের আইনের মাথা, তাঁকে কিন্তু আমরা বেশিদিন সইব না।

হিন্দুর উত্তরাধিকার আইনটি আরও ভয়াবহ। কোনও নারীর চিহ্ন নেই উত্তরাধিকার তালিকায়। নারী কিছু পাবার বেলায় নেই, কেবল দেবার বেলায় আছে। লোকে ভাবে, নারীর আর কী দরকার সম্পদ সম্পত্তির! তাকে পিতা স্বামী ও পুত্রের অধীনে বেঁচে থাকতে হয়। তাকে পরাশ্রয়ী লতার মত আঁকড়ে থাকতে হয় পুরুষের শরীর। নারীকে স্বাধীন ও স্বাবলম্বী হতে দিতে সমাজ বড় নারাজ। সমাজ তাকে নিঃস্ব করেছে সর্বার্থে, তাকে অচল করেছে, অনাথ করেছে। হিন্দুরা এ দেশে আজও শাস্ত্র মতো চলে। মুসলমানরা খুব যে শাস্ত্রের বাইরে চলে তা কিন্তু নয়। . আসলে আইন কখনও হিন্দু মুসলমান বিচার করে হওয়া উচিত নয়। ধর্মের সঙ্গে সভ্যতার বিরোধ চিরকালীন। আইন যদি সভ্য না হয়, মানুষ সভ্য হবে না। আইনের হিন্দুত্ব আর মুসলমানিত্ব মানা অসভ্যতা ছাড়া কিছু নয়। মানুষকে সভ্য করতে হলে একটি আধুনিক সভ্য আইনের প্রয়োজন। আর এদেশের অসভ্য, অসংস্কৃত, অনাধুনিক, অধম মানুষদের জন্য যত শীঘ্র সম্ভব কঠোর কঠিন আইন করা প্রয়োজন যে উত্তরাধিকার হোক, বিবাহ হোক, তালাক হোক, সন্তানের অধিকার হোক কোথাও নারী পুরুষে কোনও বৈষম্য থাকবে না। মানুষ হিসেবে সকলেই সমান হবে, সে বিশ্বাসে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমানের উত্তরাধিকার আইন নিয়ে আমার লেখাগুলো পড়ে অনেকে বলেছে আমি নাকি খুব কঠিন জিনিস নিয়ে লিখছি। কঠিন কেন জিজ্ঞেস করলে কিছু মেয়ে বলল এসব বুঝিটুঝি না। বললাম, তা বুঝবে কেন, বুঝলে কি আর সব পেয়েছির হাসি ঝোলে ঠোঁটে! এত তৃপ্ত থাকে হৃদয়! ওরা আমার তিরস্কারও বুঝল কি না জানি না তবে ওরা অনুরোধ করে গেল উত্তরাধিকারের কাঠখোট্টা আলোচনা বাদ দিয়ে পুরুষদের কি করে পেটানো যায় তা যেন লিখি। উত্তরাধিকারের ঝামেলায় কেউ যেতে চায় না। এটি ঝামেলা ছাড়া আর কী! গজ ফিতে নিয়ে শতাংশ মাপা, আর নিজের ভাইদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করা ঠিক শোভন মনে হয় না। আপন ভাই ই তো, না হয় নিলই সব। আর বাপের বাড়ির জমি, এটির ভাগ চাইলে লোকে লোভী ভাববে। বাপ তো বিয়ের আগ অবধি খাওয়ালো পরালো, এখন স্বামী খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে, অসুবিধে তো কিছুতে নেই। খামোকা অসভ্যের মত বাপের দুকানি জমির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে কেন! এই হল আমাদের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের মানসিকতা। আর নিম্নবিত্তের তো জমিই নেই, যদিও বা থাকে তার ভাগ চাইতে এলে ভাইয়েরা ঠেঙিয়ে বিদেয় করে। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আর কদিন ঘটবে? কদিন আমাদের নিরীহ, নির্বোধ, প্রতারিত মেয়েরা ভাববে যে পিতার সম্পত্তি কেবল পুত্রদের জন্য, কন্যাদের জন্য নয়, আর কন্যাদের জন্য হলেও তা ছিটেফোঁটা। কবে তাদের বোধ হবে যে পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমান অধিকার থাকা উচিত! কারণ কন্যা একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, সে পুত্রের তুলনায় কিছু কম সন্তান নয়, কিছু কম মূল্যবান নয়, কিছু কম মেধাবী নয়। এই বোধ যখন হবে তখন সে নিজে উত্তরাধিকার আইনের মা বাপের হাতে গজফিতে দেবে এবং বলবে আমার যা কিছু প্রাপ্য তার সবই দাও, আমি কড়ায় গণ্ডায় সব হিসেব চাই। আমি এই জগতে একে ওকে দান দক্ষিণা করতে আসিনি। আমার যা, আমি তা একশ ভাগ চাই। আর পুত্র তৈরিতে একটি শুক্রাণু আর ডিম্বাণু যেখানে লাগে, কন্যা তৈরিতে সেখানে আধা শুক্রাণু বা আধা ডিম্বাণু লাগে না। তবে সম্পত্তির বেলায় আধা কেন! পুরুষ প্রগতিবাদীরা নানারকম আন্দোলন করে। কিন্তু উত্তরাধিকার আইন নিয়ে তারা কখনও রা শব্দ করে না। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তাদের একদম অপছন্দ। আমি অনেক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিককে জানি যারা মেপে মেপে জমি নিয়েছে বোনদের অর্ধেক দিয়ে অর্থাৎ ঠকিয়ে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনও হেরফের দেখলে তারা উত্তেজিত হন, কিন্তু জমি বন্টনে কোনও হেরফের বা বৈষম্য দেখলে তারা খুব শান্ত থাকেন, মোটেও উত্তেজিত হন না। যেন শরিয়ত মত আর কিছু না চলুক, উত্তরাধিকার আইন চলছে চলুক। বিয়ের ব্যবস্থাও চলুক। যেহেতু বহুবিবাহের সুবিধাদি আছে।

যা করবার তা নারীকেই করতে হবে। নারীর জন্য সুযোগ সুবিধা তৈরি করতে হবে নারীকেই। প্রতিবন্ধক সরাতে হবে তাকেই, তার পথ মসৃণ করবার দায়িত্ব তারই। আমাদের সমাজে সহজেই গোলাম আযম জন্মায়, ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর জন্মায় না। তাই বহুবিবাহও দূর হয় না। সম্পত্তির সমান অধিকারও জোটে না। মেয়েদেরই তাই এক একজন প্রীতিলতা, লীলা নাগ, বেগম রোকেয়া হতে হবে। মেয়েদের জলের মত হৃদয় শত বারুদে এবার দাউ দাউ জ্বলে ওঠা প্রয়োজন।

নতুন একটি কথা উঠছে যে পুরুষের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ বিবাহ করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে। আগে স্ত্রীর অনুমতি লাগত আর এখন আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। এতে নারীর কী লাভ হল শুনি! পুরুষের জন্য কি আদালত থেকে অনুমতি নেওয়া খুব দুরূহ কোনও কাজ যে এ কাজে তারা ভয় পাবে! আদালতও দুর্লভ নয়, আদালতের অনুমতিও দুর্লভ নয় এদেশে। কথা যখন উঠেছেই, পুরুষের শখের বহু বিবাহ বন্ধ করবার কথা কেন ওঠে না! নাকি সাহস হয় না! পুরুষকে খানিকটা খুশি করে বিল পাশ না করলে বুঝি চলে না? যদি বিল পাশ করতেই হয়, তবে অনুমতির ফাজলামো বাদ দিয়ে বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করবার বিলই পাশ করতে হবে। এইসব খুচরো সংশোধন আমরা মানব না, আমূল সংশোধন চাই। আমূল বদল চাই এই ঘুণে ধরা সমাজের। সভ্য আইন চাই, মানুষের আইন চাই; ধর্মের নয়, অসত্যের নয়, অপমানের আইন আর নয়। ভাতের ক্ষিধেকে একমুঠ মুড়ি মুড়কি দিয়ে মেটাতে চাইলে আমরা অনশন করব বলে দিচ্ছি। অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার দিন চলে গেছে, এবার প্রাপ্যটুকু চাই, এবার অধিকার সবটুকু চাই।

এই পৃথিবীতে এককালে পুরুষেরা নারীর সতীত্ব রক্ষার জন্য লোহার বেড়ি বানিয়েছিল। এই পুরুষেরা নারীর সতীত্ব প্রমাণ করবার জন্য নারীকে মরা স্বামীর চিতায় তুলেছে। এই পুরুষেরা এখনও বীভৎস সব পন্থায় নারীর সতীত্ব রক্ষা করে চলেছে। নানা নিয়ম কানুন নারীর ওপর চাপিয়ে নারীর সতীত্বের মজা তারা উপভোগ করছে। আগে লোহার বর্ম ব্যবহার করা হত, এখন সামাজিক অঙ্গুলী নির্দেশেই কাজ হয়। সমাজ নারীকে বলছে ঘরে থাকো, স্বামীর আদেশ ছাড়া ঘর-বার হয়ো না, পুরপুরুষের সঙ্গে মেশো না, মিশলে তালাক, মিশলে মরণ। .. নারীর দেহে গায়ে তালা লাগিয়ে চাবিটি কোনও পুরুষের নেবার অধিকার নেই, নারীর দেহের চাবি নারীর কাছেই থাকতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন নারীর প্রয়োজন, যৌন স্বাধীনতাও নারীর প্রয়োজন, যৌন স্বাধীনতা না থাকলে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক যত স্বাধীনতাই নারীর থাকুক, সত্যিকার স্বাধীন সে নয়। নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা শুনলে অনেকে নাক সিটকোবে, বলবে, ছিঃ ছিঃ নারীর আবার যৌন স্বাধীনতা কী? তাহলে তো সে বেশ্যা হয়ে গেল। নারীর সবটুকু স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সমাজ যদি তাকে বেশ্যা বলে, তবু বেশ্যা হওয়া ভাল পুরুষের দাসি হওয়ার চেয়ে। আসলে যৌন স্বাধীনতা নারীর আর সব স্বাধীনতার মত একটি স্বাধীনতা। নারী যে কোনও স্বাধীনতা পেলেই তাকে বেশ্যা বা নষ্ট বলা হবে এই ভয় দেখানো হয়। এসব পৌরুষিক চক্রান্ত ছুঁড়ে ফেলে নারীকে যদি মানুষ হতে হয়, তার শরীর ও মনের সবটুকু স্বাধীনতা তাকে অর্জন করতেই হবে।

কথায় কথায় ইনশআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, সোবহানআল্লাহ বলার চল শুরু হয়েছে। বুদ্ধি হবার পর থেকে এই শব্দগুলো কখনও উচ্চারণ করিনি আমি। আসসালামু আলায়কুম বলে কাউকে আমি সম্ভাষণ জানাই না, খোদা হাফেজও বলি না বিদায় নেবার সময়। এসব বিদেশি শব্দের পরিবর্তে আমি বাংলা শব্দ ব্যবহার করি। আল্লাহ খোদার নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে আজকাল। এতে আল্লাহর কোনও মঙ্গল হয় না। মঙ্গল হয় না তাদেরও, যারা বলে। আসলে সৎ হতে হয়, বিবেকবান হতে হয়, উদার, সহনশীল, যুক্তিবাদী হতে হয়, তবেই সত্যিকার মঙ্গল হয় মানুষের আর মানুষের মঙ্গল মানে মানবজাতির মঙ্গল।

যারা এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে, তাদের ধিককার দিই আমি। ধর্মহীনতা গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। এই শর্ত পূরণ না হলে গণতন্ত্রের নাম ধারণ করবার অর্থ জাতিকে বোকা বানানো। স্বৈরাচারের একটা সীমা আছে। এই সরকার সেই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এক স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে নব্বইএ যে গণ জাগরণ হয়েছিল, তেমন একটি জাগরণের প্রয়োজন এখন। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য আমাদের সবার এখন পথে নামা জরুরি। পঙ্গপাল যেমন শস্য নষ্ট করে, মাওলানারা তেমন সোনার বাংলার গ্রামগুলো নষ্ট করে ফেলছে। তাদের যদি এখনও নির্মূল করা না হয় তবে একদিন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে গোটা বাংলাদেশ। তখন হাহাকার করে লাভ কিছু হবে না। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে সবার।

ফতোয়াবাজেরা গ্রামে গ্রামে মেয়েদের, যে মেয়েরা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে, ফতোয়া দিয়ে সমাজচ্যুত করছে। সারাদেশে যত ফতোয়াবাজ মাওলানা আছে তাদের সমাজচ্যূত করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করুক নতুন প্রজন্ম। ফতোয়াবাজরা একদিন নির্মূল হবে এই বিশ্বাস আছে বলেই এখনও সম্ভবত বেঁচে আছি এবং এখনও এই দেশ নিয়ে গৌরব করি।

আমাদের প্রগতিবাদীরা বলেন, মৌলবাদ গেলেই সব সমস্যা ঘুচবে। তাঁরা এও বলেন, ধর্ম নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, মানুষ নীরবে নির্ভতে ধর্ম পালন করুক, রাষ্ট্রধর্মেও ইসলামটা বহাল থাকুক, কিন্তু দেশ থেকে যে করেই হোক মৌলবাদটা দূর করতে হবে। তাঁদের এই কথা আমি মানি না। আমি মনে করি, ধর্ম যতদিন থাকবে, মৌলবাদ থাকবেই। ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে ঘরের লোককে যদি কেউ সান্ত্বনা দেয় যে সাপকে বুঝিয়েছে সাপ ছোবল দেবে না সে কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? সাপ আজ ছোবল দিচ্ছে না, কাল দেবে। সাপকে বুঝিয়ে শান্ত করার কিছু নেই। সাপের কাজই ছোবল দেওয়া। বিষবৃক্ষ শরীরে বাড়ছে বলে ডাল পালা কেটে দিলে বৃক্ষ কি ডাল ছড়াবে না আর? বিষ ফলাবে না তার শত শাখায় পাতায়? ফলাবে। সুতরাং আমরা আশা করতে পারি না মৌলবাদ নামক বৃক্ষটি কেটে দিয়ে মৌলবাদ ঘোচাতে পারব। মৌলবাদের শেকড় যতদিন আছে, ততদিন মৌলবাদ গজাবেই। মৌলবাদের শেকড়টির নাম ধর্ম। যদি মৌলবাদ নির্মূল করতে গিয়ে মৌলবাদের শেকড়টি উপড়ে না ফেলি, তবে মৌলবাদ কোনওদিনই নির্মূল হবে না।’

ইদানীং বড় মামা প্রায়ই আসেন আমার বাড়িতে। সোভিয়েত দূতাবাসের চাকরিটি বড় মামার গেছে। অনেকদিন ভোরের কাগজ পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতাটি দেখার দায়িত্বে ছিলেন। এখন সেই দায়িত্বটিও নেই। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি যেভাবে বড় মামা ব্যাখ্যা করতে চান, পত্রিকার অন্যরা সেভাবে চান না। মার্কসবাদে বিশ্বাসী কট্টর কমিউনিস্টএর মতের সঙ্গে কাগজের লোকদের মত মেলে না। বড়মামা অনেকটা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের মত এখন। বেশির ভাগ লেখাই তিনি ছদ্মনামে লেখেন। আমার লেখার ঘরে একদিন তিনি একটি বই দেখেন, ব্‌ইয়ের নাম তসলিমা নাসরিনের ইসলাম বিদ্বেষ ও অপব্যাখ্যা। বইটির লেখক দুজন ইসলাম-বিশেষজ্ঞ। বইয়ের পেছনের পঈচ্ছদে বড় বড় করে মুসলমান হয়ে আল্লাহ এবং রসুলের নিন্দা করলে যে শাস্তির বিধানটি আছে সেটির বর্ণনা, পেছন দিক থেকে তলোয়ার দিয়ে অপরাধীর ডান হাত এবং বাঁ পা কেটে নিতে হবে, তারপর বাঁ হাত আর ডান পা। বড়মামা বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই আগ্রহ প্রকাশ করলেন পুরো বইটি পড়ার। বইটি একদিন নিয়ে যান তিনি, যখন ফেরত দিতে আসেন, সঙ্গে একটি দৈনিক সংবাদ পত্রিকা আনেন, যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে বড়মামার নিজের নামে লেখা বইটির সমালোচনা। বড়মামা নিজে ইসলামের পণ্ডিত। ইসলাম ব্যবহার করেই তিনি আক্রমণ করেছেন ইসলাম বিশেষজ্ঞদের, কেবল ইসলাম বিশেষজ্ঞদের নয়, সব ধরনের ধার্মিকদের, যারা কুরআন হাদিস মাথায় তুলে রাখছেন কিন্তু নিজেরা কুরআন হাদিসের আদেশ মেনে চলছেন না। বড়মামা দেশের রাজনৈতিক নেতা আর উপনেতাদের প্রসঙ্গে লিখেছেন যে তাঁরা প্রায়ই বলেন, ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান, ধর্মীয় জলসায় প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে তাঁরা জনগণকে কুরআন হাদিস অনুসরণ করে চলার উপদেশ দেন কিন্তু তাঁদের দৈনন্দিন চালচলনে, চিন্তাভাবনায় ও কাজকর্মে তার প্রমাণ তাঁরা দিচ্ছেন না। এমনিতে সার্ট প্যান্ট পরছেন অর্থাৎ বিধর্মীদের পোশাক পরছেন কিন্তু ইসলামি জলসায় গেলে তড়িঘড়ি ইসলামি পোশাক পরে নিচ্ছেন, মাথায় একটি টুপিও পরে নিচ্ছেন, কিন্তু গালটি কামানো। কেন গো! বুখারি হাদিস আর মুসলিম হাদিসে তো স্পষ্ট লেখাই আছে ‘দাড়ি রাখা ওয়াজিব আর কেটে ফেলা হারাম।’ তবে হারাম কাজটি করছেন কেন তাঁরা, এতই যদি ইসলাম পছন্দ তাঁদের!

‘রাষ্ট্রীয় পদাধিকার বলে তাঁরা আবার অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানেও প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে সেই ধর্মের প্রশংসা করেন। অথচ কুরআন হাদিস অনুসারে ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাতিল ও কুফর। অন্য ধর্মের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য কিংবা অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া কি ইসলাম অনুসারে বৈধ? কুরআন ও হাদিস তো বলে ‘যারা যায় তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদের সাথেই তাদের হাশর কবে।’ কুরআনে আল্লাহ নিজে মুমিনদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মুহম্মদ আল্লাহর রসুল, যারা তাঁর সঙ্গে রয়েছে তারা অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, এবং নিজেদের মধ্যে পরষ্পরের প্রতি দয়াশীল(৪৮.২৯)ঞ্চ, অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘তারা মুমিনদের প্রতি কোমল, কাফিরদের প্রতি কঠোর(৫.৫৪)’, আরও বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না (৪.১৪৪)। সমালোচকরা এ ব্যপারে নীরব কেন?’

বইটির এক জায়গায় লেখা, ‘তসলিমা নাসরিন নামাজ বলে যে শব্দের কথা উল্লেখ করেছেন তা একটি ফার্সি শব্দ। সমগ্র কুরআন মজিদ ও হাদিস শরীফে এ ধরনের কোনও শব্দ নেই। আল কুরআন ও হাদিসে যে শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে সালাত। হযরত মুহম্মদ (সাঃ) মিরাজের পর থেকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন।’ বড়মামা এর উত্তরে লিখেছেন, ‘খুবই সত্য কথাটি বলেছেন সমালোচক। নামাজ অবশ্যই একটি বিদেশী, বিজাতীয় উদ্ভট ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী শব্দ। সালাত শব্দটির বদলে নামাজ শব্দটি ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে কুরআন শব্দটি ব্যবহার করলেও অশুদ্ধ হত না, কারণ কুরআন মজিদে সালাত অর্থে একটি আয়াতে দুই দুই বার কুরআন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ফজরের সালাত বোঝাতে ফজরের কুরআন বলা হয়েছে ১৭ নং সুরার ৭৮ নং আয়াতে। কিন্তু বিজ্ঞ সমালোচকরা এতদিন কোথায় ছিলেন? হাজার বছর ধরে উপমহাদেশে, ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা তসলিমার মত ভুল করে সালাতকে নামাজ বলে আসছে, নামাজ শিক্ষা বই সহ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লাখ লাখ বই পুস্তকে নামাজ শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। টেলিভিশন ও রেডিওতে আজানের দোয়ায় প্রতিদিন কয়েকবার করে বলছে এই নামাজের তুমিই প্রভু, সাওমকে সাওম না বলে রোজা বলা হয় কেন? রোজা শব্দটি তো কুরআন বা হাদিসের কোথাও নেই। তাছাড়া কুলখানি, চেহলাম, ফাতেহায়ে দোয়াজদহম, ফাতেহাায়ে ইয়াজদহম, আখেরী চাহারশুম্বা ইত্যাদি কোথায় পেলেন? মুসলমান শব্দটিই কি কুরআন বা হাদিসে আছে? মুসলমান শব্দটি মুসলিম শব্দের বিকৃতি। মুসলিম শব্দটির অর্থ আত্মসমর্পিত, অনুগত, কিন্তু মুসলমান শব্দের অর্থ কি?’

বইটিতে এম এন রায়, এ জি আরবেরি, আর ও নিকলসন, ডঃ মরিস বুকাইলির খুব প্রশংসা করা হয়েছে, ওঁদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, এবং আমাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে ওঁদের বই যেন আমি পড়ি। বড়মামার মন্তব্য, ‘ইসলামের প্রশংসা করার পরও ওঁরা যে ইসলাম গ্রহণ না করে কাফেরই রয়ে গেছেন, বরং কথায় এক কাজে আরেক নীতি অবলম্বন করে ওঁরা যে দারুণ মুনাফেকিও করলেন, এ কথাটি তসলিমার বিজ্ঞ সমালোচকরা বেমালুম চেপে গেছেন।’

বইটিতে লেখা যে আমি আমার বইয়ে কিছু হাদিসের উল্লেখ করেছি কিন্তু হাদিসের রেফারেন্স দিইনি। এসব হাদিস সহি না জাল তার উল্লেখ করিনি। এসব কারণে আমার উদ্ধৃত হাদিস সম্পর্কে তাঁদের আলোচনা করা সম্ভব হল না। আরও লিখেছেন, হাদিস শাস্ত্র সম্পর্কে তেমন কোনও জ্ঞান আমার নেই। বড়মামা এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘কিন্তু দুই ইসলাম বিশারদের যদি হাদিস সম্পর্কে কোনও জ্ঞান থাকত, তাহলে তসলিমার উল্লেখ করা কোন হাদিসগুলো জাল বা বানোয়াট হাদিস তা তাঁরা ধরতে পারতেন।’

আমি যখন বইটি পড়ি, এই ছোটখাটো ব্যপারগুলো আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু বড়মামার নজর খুব কড়া। লিখেছেন —হাদিসের সূত্র উল্লেখ না করা যদি তসলিমার অ্যাকাডেমিক ডিসঅনেস্টি হয়, তবে বাংলাদেশের রেডিও টেলিভিশনে যে প্রতিদিন সনদ বা উৎস উল্লেখ ছাড়াই হাদিস সম্প্রচার করে যাচ্ছে, এই সমালোচকরা কি তার কখনও প্রতিবাদ করেছেন? প্রচার মাধ্যমে কেবল হাদিস নয়, কুরআনের বহু গুরুত্বপূর্ণ আয়াতকে পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত ব্ল্যাকআউট করে আসা হচ্ছে তারও কি কোনওদিন প্রতিবাদ করেছেন? রেডিও টিভিতে সাধারণ মানুষের কি করতে হবে না করতে হবে সে সম্পর্কিত আয়াতগুলো পুনঃ পুনঃ প্রচার করা হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের, আইনপ্রণেতাদের, শাসক এবং বিচারকদের কি করতে হবে না হবে সে সম্পর্কিত আয়াতগুলো প্রচার করা হয় না। যেমন, ‘চোর ও চোরণীর হাত কেটে ফেলো (৫.৩৮)’, ‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের দুজনের প্রত্যেককে একশটি চাবুক মারবে, আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে গিয়ে তাদের দুজনের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও, আর মুমিনদের একটি দল যেন ওদের দুজনের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে (২৮.২)ঞ্চ, ‘আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদনুযায়ী যারা হুকুম না করে তারা কাফির (৫.৪৪)ঞ্চ প্রভৃতি অনেক আয়াত কোনওদিন প্রচারিত হতে দেখি না এবং বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সমাজে আল্লাহর এসব বিধান কার্যকর করতেও দেখি না। এ সম্পর্কে অবশ্য আল্লাহ আগে থেকেই বলে রেখেছেন, ‘আমি যেসব স্পষ্ট বিধান ও পথনির্দেশ নাজিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবে, তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে লানত (অভিশাপ) দেন, এবং লানতকারীরাও তাদেরকে লানত দেয় (২.১৫১)।’

বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে বড়মামা কেবল বইয়ের লেখকদের যুক্তি খণ্ডন করে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তরে কঠিন প্রশ্ন করে ক্ষান্ত হননি। আজকের যুগে ধর্ম মানছি, কিন্তু আমি মৌলবাদী নই বলে অধিকাংশ মানুষ যে নিজেদের বেশ আধুনিক বলে দাবি করছে এবং কোরান থেকে ভাল ভাল কিছু বাক্যের উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ যে কত ভাল কথা বলেছেন তার উদাহরণ দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশেও বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা লিখেছেন বড়মামা। লিখেছেন, ‘কুরআনের কিছু কিছু অংশে বিশ্বাস করলে, মেনে চলতে বললে আজকাল কেউ মৌলবাদী হয় না, কিন্তু এই একই কুরআনের অপর কিছু অংশে বিশ্বাস করলে, মেনে চলতে ও কার্যকর করতে বললে সে মৌলবাদী হয়ে যায় এবং ইসলামের কোনও কোনও স্বঘোষিত রক্ষক আবার মৌলবাদী হতে রাজি নন, লজ্জা পান। অথচ ইসলামের ভেতর ভেজাল, নকল ও বিদআত আমদানি, প্রবর্তন ও লালন পালন করতে লজ্জা পান না, কারণ ওসব করলে কেউ মৌলবাদী বলবে না। কিন্তু কুরআনেই বলা হয়েছে, কুরআনের সমস্ত অংশই মানতে হবে। বলা হয়েছে, ‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? তাহলে তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে(২.৮৫)।’ কুরআনের কোনও একটি অংশকে তুচ্ছ করা বা না মানা পুরোটাই তুচ্ছ করা ও না মানারই সামিল। কুরআনেই এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘এরাই তারা যারা তাদের আচরণ ও কাজকর্মের মাধ্যমে বলতে চায় আমরা কতক অংশে বিশ্বাস করি ও কতককে প্রত্যাখ্যান করি, এবং চায় মধ্যবর্তী কোনও পথ অবলম্বন করতে। প্রকৃতপক্ষে তারাই কাফির (৪.১৫০,৪.১৫১)।’

বড়মামার বক্তব্য যে কোনও মৌলবাদীরই পছন্দ হবে। কিন্তু বড়মামার উদ্দেশ্য মৌলবাদিদের খুশি করা নয়, যারা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে মূলত তাদের অখুশি করা। আজকের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সমাজবিদ যেভাবে ধর্মের গুণগান গাইছেন এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের জন্য দোষ দিচ্ছেন মৌলবাদীদের, তাদের জন্যই লেখা এটি। তাঁরা আমার এবং বড়মামার দুজনেরই বিশ্বাস মৌলবাদীদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর, বেশি ভয়ংকর। ‘মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে কুরআন তো অভ্রান্ত, অকাট্য ও সন্দেহাতীতভাবে হুবুহু আছে এবং চিরদিন থাকবে, কুরআন অপরিবর্তনীয়, এর সুস্পষ্ট বিধানগুলো অপরিবর্তনীয়। কুরআনের কিছু কিছু অংশ ব্ল্যাক আউট করলে কিংবা কুরআনে আল্লাহর দেয়া স্পষ্ট আইনগুলোর বদলে পাশ্চাত্যের দেয়া আধুনিক আইনের মাধ্যমে কেউ শাসন ও বিচার কাজ চালালে সে যে মুসলিম নয় এটাতো কুরআনেরই কথা। কুরআনই তো বলে, সে কাফির(৫.৪৪), জালিম (৫.৪৫) এবং ফাসিক(৫.৪৭)।’

লেখাটি শেষ করেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, ‘পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়ার পর ১৯৭৫ থেকে এ যাবৎ ১৮ বছর নিয়ে মোট ৪২ বছরে ইসলামি বিধান চালু না করে শুধু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর নামে মুসলমানদের চোখে ধুলো দেওয়া হয়েছে। ইসলামি আইন ও ইসলামি বিধানের কথা যারা বলে তাদেরকে মৌলবাদী খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনকালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিল পাসের সময় সংসদে সমাপনী ভাষণে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মৌলবাদকে ঠেকানোর জন্য এই বিল আনা হয়েছে। এরা কি মুমিন মুসলিম না কি মুসলিম নামধারী আধুনিক পশ্চিমা ভাবধারার অনুসারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ, স্যার মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখের ভাবশিষ্য? তবে আর যাই হোক, এই আধুানতাকাবাদী ধর্মব্যবসায়ীরা মৌলবাদের আগা কেটে গোড়ায় পানি ঢালছেন, ফলে মৌলবাদের গাছটি কিন্তু ক্রমেই তরতাজা হয়েই বাড়ছে।’

বড়মামার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। তিনি নাস্তিক এ কথা আমি জানতাম, কিন্তু তাঁর আক্রমণ যে ধর্ম দিয়েই বকধার্মিকদের এমন আচ্ছ! করে পেটানো এবং হাতিয়ারটি যে বড়মামার এত ধারালো তা আমার জানা ছিল না। বড়মামার সঙ্গে আগে কখনও আমার ধর্ম নিয়ে কোনও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। ইদানীং আমার লেখা পড়ে বড়মামারও আগ্রহ জন্মেছে, বড়মামার লেখা পড়ে আমারও। বাড়িতে এলেই সোজা আমার লেখার ঘরে ঢুকে যান বড়মামা। কোরানের নারী নতুন একটি বই লিখছি আমি, কোরানে নারী সম্পর্কে যে সব আয়াত আছে, সেসবের উল্লেখ করে সেসব বিষয়ে মন্তব্য কেবল। লেখাটি, যেহেতু আরবি জানেন ভাল, তাঁকে দেখাই। কোরান বড়মামার নখদর্পনে। তিনি মুখস্ত আওড়ে যান কোরানের আয়াত এবং আয়াতের ব্যখ্যা। কোরানের প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ করেন। আমার পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়ে বড়মামা কয়েকটি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের বাংলা কোরান অনুবাদ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ইসলামি ফাউণ্ডেশন ট্রাস্টের কোরান, মাওলানা মওদুদির অনুবাদ সব তুলনা করে মিলিয়ে আমি আরবির অনুবাদ উদ্ধার করেছি, কিন্তু এই উদ্ধারের পরও আরও উদ্ধার করা যায় যদি ভাষাটি জানা থাকে ভাল। বড়মামা ভাষাটি জানেন বলে তিনি কোন আরবি শব্দকে ভাবান্তর করে কোন অনুবাদক কোনও একটি মোলায়েম অর্থ দাঁড় করিয়েছেন কোনও আয়াতের, সেগুলোও ধরে ফেলতে পারেন। মেয়েদের যখন মারবে তখন খুব আস্তে করে মারবে, মুখমণ্ডলে মেরো না — এরকম একটি অনুবাদ পড়ে বড়মামা হেসে বললেন, কোরানে আস্তে করে মারার কথা লেখা নেই, আস্তে করে শব্দদুটি অনুবাদক যোগ করেছে। যত পুরোনোকালের বাংলা কোরান পাওয়া যায়, তত সঠিক অনুবাদও পাওয়া যায়। দিন যত যাচ্ছে, যত আধনিক হচ্ছে সমাজ, মেয়েদের অধিকারের কথা উঠছে, ইসলামে নারীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এই দাবি করছেন ইসলামি পণ্ডিতরা, এই পণ্ডিতরাই কোরান অনুবাদের সময় নিজে থেকে আল্লাহর নিষ্ঠুরতা আড়াল করার দায়িত্ব নিয়েছেন। যেন আল্লাহ যদি আস্তে করে মারার কথা বলেন, আল্লাহকে খুব দরদী মনে হবে। আরবি ভাষাটি না জানলে আজকালকাল পণ্ডিতের আল্লাহর ওপর নাপতানিগুলো আবিস্কার করা যায় না। কোথাও কোন আয়াতের বাংলা অনুবাদে ভুল আছে কি না তা আরও সুক্ষ্ণভাবে দেখে দিতে বড়মামা আমার পুরো পাণ্ডুলিপি তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর কিছু কিছু শব্দের ভুল শুদ্ধ করে নিয়ে আসেন। পাণ্ডুলিপি হাতে নিতেই বুঝি তিনি বেশ পরিশ্রম করেছেন এর পেছনে।

শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা হতে থাকে বড় মামার সঙ্গে। সুরা আল নাজলএর একুশ আর বাইশ নম্বর আয়াত দুটো কোরান থেকে উড়িয়ে দিয়ে নতুন আয়াত বসানো হয়েছে। কারণ মোহাম্মদ যে আয়াত উচ্চারণ করেছিলেন, সেগুলো তিনি পরে বলেছেন যে শয়তানের ছিল। মোহাম্মদের কানে কানে শয়তান উচ্চারণ করেছে আয়াত দুটো। মোহাম্মদ বুঝতে পারেননি কোন কণ্ঠস্বরটি আল্লাহর, কোনটি শয়তানের, অথবা তাঁর জিভে ভর করেছিল শয়তান, অথবা মাথায়, তাই কাবা শরীফের সামনে বসে তিনি উচ্চারণ করলেন..। কী উচ্চারণ করলেন, বড় মামাকে জিজ্ঞেস করি। বললেন, ‘তোমরা কি আল লাত, আল উযযা আর তিন নম্বর আল মানাতএর ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করিয়াছো?’

‘এই টা কোরানে আছে, কিন্তু কোনটা বাদ দেওয়া হইছে?’

‘দিজ আর ইন্টারমিডিয়ারিস এক্সলটেড হুজ ইন্টারসেশন ইজ টু বি হোপড ফর। এইটা তো একুশ নম্বর, আর বাইশ নম্বরটা হচ্ছে, সাচ এস দে ডু নট ফরগেট। —এই আয়াত দুইটা পরে শয়তানের আয়াত বইলা বাদ দিয়া লেখা হইছে, আর ইওরস দ্যা মেইলস এণ্ড হিজ দ্যা ফিমেইলস? তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান আর আল্লাহর জন্য কন্যা? এটা তো তবে প্রতারণা পূর্ণ বণ্টন!’

আমি জিভ কাটি লজ্জায়।

বড় মামা বলেন, ‘লাত, উযযা আর মানাত কে কোরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর তিন কন্যা বলে বিশ্বাস করত। ওদের গডএর নাম তো আল্লাহ। আল্লাহ নামটা তো মোহাম্মদ ওদের কাছ থেকেই নিয়েছে, মানে মূর্তি পূজা যারা করত, যারা বহুঈশ্বরবাদী ছিল তাদের কাছ থেকে।’

‘মোহাম্মদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল আল্লাহর তিন মেয়েরে সম্মান দেখানোর?’ প্রশ্ন করি।

বড় মামা বলেন, ‘সেই সময় মানে সেই আটশ খ্রিস্টাব্দে যে ইসলামিক স্কলাররা মোহাম্মদের জীবনী লিখে গেছে, ইবনে জারির আল তাবারি, আল ওয়াহিদি, ইবনে সাদ, ইবনে ইসাক, তাদের ভাষ্য, যে, ওই সময় মককায় মোহাম্মদের তেমন কোনও অনুসারী ছিল না, যারা ছিল তাদের বেশির ভাগই মোহাম্মদকে ছেড়ে চলে গেছে। তখন কোরাইশদের দলে টানার জন্য সে তাদের তিন দেবীর কাছে মাথা নোয়াইছে। মোহাম্মদ এইটা বলার পর কোরাইশরা খুশি ছিল তার ওপর।..’

‘আয়াতটা পাল্টাইল কখন?’

এমন সময় মা মা ঢোকেন ঘরে। আমরা চুপ হয়ে যাই। মা দুজনের মুখে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী আলাপ করতাছ তোমরা?’

বড় মামা সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘এই তো ওর পিজিতে পড়ার কথা বলতেছি! পড়লে তো মেডিকেল কলেজের প্রফেসার হইতে পারতো!’

মার মুখটি মুহূর্তে প্রসন্ন হয়ে ওঠে, ‘চা খাইবা মেবাই?’

‘হ। এক কাপ চা দে।’

মা চা করতে চলে গেলেন।

ঘরে আবার শয়তানের আয়াত নিয়ে কথা চলতে থাকে।

‘সুরা হজ্জের বায়ান্ন আর তিপ্পান্ন আয়াতে তো আছে এই শয়তানের কথা। মোহাম্মদকে আল্লাহ বলতেছে, যে, আল্লাহ যত নবী রসুল পাঠাইছিল মোহাম্মদের আগে, সবাইরেই নাকি শয়তানে ধরছিল।’

হঠাৎ মার মুখটি দরজায়।

‘মেবাই তোমরা কী নিয়া কথা বলতাছ?’

আমি বলি, ‘না কিছু না, এমনি।’

‘আমি শুনলাম আল্লাহ মোহাম্মদ!’ বড়মামার দিকে তাকিয়ে মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি নাসরিনরে কী শিখাইতাছ?’

বড় মামা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান ঘর থেকে, আমি পেছন পেছন যাই বলতে বলতে ‘আমারে আবার কি শিখাবে? এমনি আলাপ করতাছিলাম।’

‘মেবাই, কী নিয়া আলাপ করতাছিলা তুমরা? কী বুদ্ধি দিতাছ আমার মেয়েরে?’ মা আগুন-চোখে তাকান বড়মামার দিকে। বড়মামা মার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালের চিত্রকর্মে, জানালার পর্দায়, দরজার হাতলে ফেলে রাখেন।

মার গলা চড়তে থাকে। ‘এত বড় সর্বনাশ করতাছ তুমি মেয়েটার? জানতাছ তো কী হইতাছে দেশে। অত বড় বড় মিছিল যায়, দেখতাছ না? পত্রিকায় পড়তাছ না কি হইতাছে? তারপরও তুমি ওরে আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখার পরামর্শ দেও? মেয়েডা বাইচা থাকুক তা চাও না? যে কোনওদিন তো ওরে মাইরা ফেলবে! নিজে যা বিশ্বাস কর, কর। আমার মেয়েরে তুমি নষ্ট বানাইও না। ওরে কুবুদ্ধি দিয়া যাও, আর ও এইসব লেখে। তুমি ওরে কুবুদ্ধি দিয়া দিয়া কোরানের বিরুদ্ধে, আল্লাহর বিরুদ্ধে লেখাইছ।’

আমি বলি, ‘আমি নষ্ট হইয়াই রইছি। আমারে নতুন কইরা নষ্ট বানানির কিছু নাই।’

বড়মামা মলিন মুখে বলেন, ‘আমি তো আল্লাহ সম্পর্কে খারাপ কথা কই নাই। যারা আল্লাহ নিয়া ব্যবসা করে, তারা কয় খারাপ কথা। তারা আল্লাহরে অসৎ কাজে ব্যবহার করে।’

সেদিন বড়মামার চা খাওয়া হয়নি। কথা ছিল ভাত খাবেন, ভাতও খাওয়া হয়নি। কাজ আছে বলে ভর দুপুরে বেরিয়ে গেলেন। এরপর বড়মামা এলে মা আগেই সতর্ক করে দেন যেন আমার সঙ্গে কোরান হাদিস বিষয়ে কোনও কথা না বলেন তিনি। একদিন বড়মামা এলেন শুক্রবারে। মাথায় একটি টুপি ছিল, সেটি খুলে, মার সামনে পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, ‘আজকাল মসজিদে নামাজ পরার জন্য জায়গাই পাওয়া যায় না। এত ভিড়।’

মা নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মসজিদ থেইকা আইলা?’

বড়মামা বলেন, ‘হ। জুম্মাহ পইরা আইলাম।’ শুনে মার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুখে মধুর একটি হাসি।

আমি জোরে হেসে উঠি। বড়মামা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘হাসস কেন? হাসির কি হইল? আমি তো পাঁচবেলা নামাজ পড়ি।’

এবার আরও জোরে হাসি।

মা বলেন, ‘নাসরিনডার যে কি হইব? ওর তো দোযখেও জাগা হইব না। মানুষ তো শুধরায়। মেবাইএর মত মানুষ যদি নিজের ভুল বুঝতে পাইরা তওবা কইরা নামাজ ধরতে পারে। তাইলে তুই কেন তওবা এখনও করস না?’

মা সেদিন বড়মামাকে বেশ আদর করে ভাত মাছ খাওয়ান। খাওয়ার পর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বড় মামা উঁকি দেন আমার লেখার ঘরে। ঢুকে জোরে জোরে বলেন, ‘কি, সারাক্ষণ লেখা নিয়া থাকলেই চলবে! স্পেশালাইজেশনের জন্য তো গাইনিটাই ভাল। ডাক্তারি বিদ্যাটা এমন একটা বিদ্যা যেইটা দিয়া মানুষের সেবা অনেক বেশি করতে পারবি!’

‘ওই লেখাপড়া আমার আর হবে না।’ বলে আমি উদয় হওয়া একটি প্রশ্ন প্রায় করতে নিচ্ছিল!ম যে, ‘মোহাম্মদ মককা জয় করার পর যে আবদুল্লাহ নামের একটা লোকরে কতল করছিল, সেইটা কি সেই আবদুল্লাহ যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদের আয়াত সংশোধন করত? আল্লাহর বাণী আবার সংশোধনের দরকার পড়ে কেন, এই প্রশ্নটা তার মনে জাগছিল বইলা যে পরে ইসলাম ত্যাগ করছিল?’ প্রশ্ন করার সুযোগ হয় না আমার। মা ঢোকেন। উদ্ভাসিত মুখ মার। বলেন, ‘মেবাই তুমি একটু নাসরিনরে বোঝাও ও যেন নামাজ শুরু করে।’

বড়মামা বলেন, ‘হ। নামাজ ত পড়া উচিত। এখন তো হাঁটাচলা বেশি হয় না ওর। নামাজ পড়লে শরীরের ব্যয়ামটা তো অন্তত নিয়মিত হয়।’

কথাটি মার পছন্দ হয় না।

মা আমাকে নামাজ পড়তে বলেন, কিন্তু কোরান যখন পড়ি, তিনি আঁতকে ওঠেন। টেবিলে ওপরে কোরান খোলা, এই একটু উঠে ও ঘরে গেলাম তো ফিরে এসে দেখি কোরান নেই, বিছানায় শুয়ে কোরান পড়ছি, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি, ঘুম ভাঙলে দেখি বিছানায় কোরানটি নেই। শেষ পর্যন্ত কোরান উদ্ধার করি মার আলমারি থেকে। তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

‘কোরান শরীফ লুকাইয়া রাখো কেন?’

‘কোরান শরীফ পড়ছ কেন এত?’ সংশয়াপন্ন মার কপালে দুটো ভাঁজ।

‘বাহ, কোরান পড়া তো ভাল। সওয়াব হয়।’

‘তুই তো আর সওয়াবের জন্য পড়ছ না।’ মা বিরক্ত-কণ্ঠে বলেন।

হাসতে হাসতে বলি, ‘ছি ছি আর কইও না। আল্লাহ যদি জানেন যে তুমি কোরান পড়তে কাউরে বাধা দিতাছ তাইলে তোমারে হাবিয়া দোযখে নিক্ষেপ করবেন তিনি।’

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘না হয় আমি হাবিয়া দোযখে যাই, তুই বেহেসতে যাওয়ার চেষ্টা কর।’

‘ওইটা চিন্তা কইর না। আল্লাহর সাথে কনটাক্ট হইছে আমার। বেহেসতের ব্যবস্থা পাককা। সেইদিন আল্লাহ আমারে জানাইলেন যে জান্নাতুল ফেরদাউসের লিস্টে চার নম্বরে আমার নাম।’

‘তাইলে তো ভাল। বেহেসতে যদি নাম থাকে।’

‘হ। তুমি তো দোযখের আগুনে পুড়তে থাকবা, আর আমি বেহেসতে। আল্লাহর কাছে তোমারে বেহেসতে আনার জন্য আমার তদবির করতে হবে।’

মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, বলেন, ‘নাসরিন তর পায়ে পড়ি কোরানের বিরুদ্ধে আর কিছু লিখিস না। কোরান তো তরে কিছু করে নাই। মোল্লারা করতাছে মোল্লাদের বিরুদ্ধে লেখ।’

আমি সরে যাই মার কান্নার কাছ থেকে।

মাকে প্রায়ই দেখি জায়নামাজে বসে মোনাজাতের হাত তুলে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে করতে ফুঁপোচ্ছেন। একদিন বিড়বিড়ের কাছে কান পেতে শুনি, বলছেন, ‘আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে কাফের বানাইও না। আল্লাহ তুমি আমারে মেয়েটারে কাফেরের সঙ্গ থেকে মুক্ত কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের বেহেসত নসীব কর। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েরে সুমতি দাও, জ্ঞান দাও। আল্লাহ তুমি আমার মেয়ের হৃদয় মোহর করে দিও না।’

মার জন্য মায়া হয় আমার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *