২১
আজাদ ভাইয়ের মা মারা গেছে, এই খবরটা সৈয়দ আশরাফুল হক পেয়েছে কদিন পরে ৷ খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক সুতীব্র বেদনাবোধ ব্লেডের মতো যেন তার কলজে কেটে চলে ৷ সে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ৷ কত স্মৃতি, কত কথা ৷ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সৈয়দ আশরাফুল হক ওরফে বাবু বয়সে আজাদের চেয়ে ছোট ৷ সেও ছাত্র ছিল সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ৷ আগে তাদের বাসা ছিল হাটখোলায়, সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে তারা চলে আসে ইস্কাটনে ৷ আজাদ ভাই বলতে সে ছিল অজ্ঞান ৷ আজাদের মা মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরে এই ক্রিকেটার দুঃসংবাদটা শুনতে পায় ৷ তার চোখ স্মৃতিজলে ঝাপসা হয়ে আসে ৷ আজাদ ভাইকে তার কাছে মনে হতো ওই সময়ের ঢাকার আদর্শ যুবক ৷ সে বিড়বিড় করতে থাকে, ‘আজাদ ভাই ছিল শহরের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল, সবচেয়ে সুদর্শন যুবক ৷ তার রুচি ছিল স্নিগ্ধ আর অভিজাত, সবচেয়ে ভালো পোশাক পরত সে, সবচেয়ে ভালো বই পড়ত, সবচেয়ে ভালো গান শুনত ৷ সে ছিল আমার গুরু ৷ তাকে আমরা ডাকতাম এলভিস প্রিসলি বলে ৷ আর তার মাকে আমি ডাকতাম মা বলে ৷ মা ছিলেন মাটির কাছাকাছি থাকা এক মহিলা ৷’
তবে আশরাফুল হক শুনতে পেয়েছিল, এক সময় আজাদের মাও অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন, ফ্যাশনেবল মহিলা ছিলেন ৷ কিন্তু সাফিয়া বেগমের এই রূপ আশরাফুল দেখেনি ৷ তাকে সে একবার বলেছিল, ‘মা, মা, তুমি নাকি আগে অনেক ফ্যাশনেবল আছিলা, ঠিক নাকি ?’
জবাবে সাফিয়া বেগম কিছুই বলেননি ৷ কেবল মিটিমিটি হেসেছেন ৷
সৈয়দ আশরাফুল হক বাবুদের সঙ্গে আজাদদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল ৷ আজাদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আশরাফুল হক বাবুর বাবা কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টি নেতা আজিজুল হক নান্না মিয়ার ৷ আজাদের মাও আসতেন তাদের বাসায় ৷
সৈয়দ আশরাফুল হক ক্রিকেট তো খেলতই ৷ বাস্কেটবলও খেলত ৷ আজাদ নিজে খেলত না, কিন্তু খেলোয়াড়দের পছন্দ করত খুবই ৷ সব সময় স্টেডিয়ামপাড়ায় আড্ডা দিতে যেত ৷
আশরাফুল হকের মনে পড়ে যায় তারুণ্যভরা সেইসব দিন, যখন ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৭/৮ ঘন্টা সে আড্ডা দিত আজাদের সঙ্গে ৷ বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে তাদের আড্ডাটা জমত ভালো ৷ অন্য ক্রিকেটার বাস্কেটবল খেলোয়াড়রাও যোগ দিত সেই আড্ডায় ৷ রাত ১টা-২টা পর্যন্ত চলত ম্যারাথন গল্পগুজব, রাতের বেলা মগবাজার মোড়ের ক্যাফে ডি তাজে বিরিয়ানি খেয়ে তারপর তারা ঘরে ফিরত ৷
আজাদের ব্যবহারও ছিল খুবই অমায়িক ৷ সে আশরাফুল হককে বলত, ‘বুঝলা, সব সময় মনে রাখবা, তুমি যদি অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার করো, অন্যরাও তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করবে ৷’
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় ঢাকায় আসার কথা ছিল এমসিসি ক্রিকেট দলের ৷ কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুবিধার নয়, এই অজুহাতে তাদের এ কর্মসূচি বাতিল করা হয় ৷ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকার ক্রিকেটার আর ক্রিকেটামোদীরা ৷ তারা নানা ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচি হাতে নেয় ৷ একটা কর্মসূচি ছিল ক্রিকেট ব্যাট পুড়িয়ে দেওয়া ৷ এইসব কর্মসূচিতে সৈয়দ আশরাফুল হক, জুয়েল প্রমুখ ক্রিকেটারের সঙ্গে আজাদও অংশ নিয়েছিল ৷