বিয়ের ঠিক দেড় বছর পর মহিলামণির ক্রোড়ে একটি পুত্র সন্তান এল। সে রাত্রে ভরত একা একা অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। বাড়ির উঠোনে বানানো হয়েছে আঁতুড় ঘর। প্রসববেদনা ওঠার পর মহিলামণিকে সে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়ার পরেও ভরতের আসন্ন-পিতৃত্ব সম্পর্কে কোনও অনুভূতি হয়নি। সে মহিলামণি সম্পর্কেই চিন্তিত ছিল। একজন দাই নিযুক্ত করা হয়েছিল আগে থেকেই, দৃজন প্রতিবেশিনীও কয়েকদিন ধরে মহিলামণিকে সাহায্য করছিল নানাভাবে। মহিলামণি যখন। যন্ত্রণায় ছটফট করছে, সেই সময় বৃষ্টি নামল হঠাৎ। দরমা ও কঞ্চি দিয়ে বানানো অস্থায়ী আঁতুড় ঘর। বৃষ্টির তোড় বাড়লে ভেতরে জল পড়বে, তাই নিয়ে ভরতের দারুণ উৎকণ্ঠা। আঁতুড় ঘরে পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ, বাইরে সে ছটফট করতে লাগল, বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল অকারণে।
তারপর একসময় শোনা গেল ট্যাঁ ট্যা করে একটি অচেনা প্রাণীর কান্নার শব্দ। অনেকটা রাতপাখির ডাকের মতন। পৃথিবীতে এল একজন নতুন মানুষ। সব মানুষই প্রথমে কাঁদতে কাঁদতে ভূমি স্পর্শ করে।
কিছুক্ষণ পরে দাই যখন কোলে করে দরজার কাছে এনে কাপড়ে জড়াননা শিশুটিকে এনে দেখাল , ভরত প্রথমে কোনও কথাই বলতে পারল না। মধ্যবয়স্কা দাইটি কলকল করে কত কথাই বলে যাচ্ছে, ভরত কিছুই শুনছে না। একটি মানুষের সে জন্ম দিয়েছে, এটা এখনও যেন তার কাছে অবিশ্বাস্য। সে এখন পিতা!
মহিলামণিকে আরও তিনদিন আঁতুড় ঘরে থাকতে হবে। ভরত তার কাছে যেতে পারবে না। সৌভাগ্যক্রমে বৃষ্টিও ধরে গেল একটু পরেই।
বাড়ির মধ্যে এসে মহিলামণির ঠাকুর ঘরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ভরত প্রণাম করল, তখনই তার চোখে এল অশু। হ্যা, ঈশ্বর আছেন, অশেষ করুণাময় ঈশ্বর এই দম্পতিকে একটি সন্তান উপহার দিয়েছেন। ভরত এতকাল তার জীবনটাকে অর্থহীন ভেবে এসেছে। নিয়তি তাকে বঞ্চনা করেছে বারবার। নিজের মাকে সে চেনে না। পিতা হিসেবে যিনি পরিচিত, তিনিই যে তার প্রকৃত জন্মদাতা তারও কোনও ঠিক নেই এবং সেই তিনিও পুত্র হিসেবে তাকে কোনও স্বীকৃতি দেননি। এ পৃথিবীতে ভরত সেই মানুষটিকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। আজ যে শিশুটি জন্মাল, সবাই জানবে ভরতই তার পিতা, ভরত তাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে, শত ঝড়ঝাপটা এলেও দু হাত দিয়ে আড়াল করে রাখবে তার প্রাণশিখা। নিজের জীবনে সে কখনও এক বিন্দু স্নেহ পায়নি, নিজের সন্তানের ওপর উজাড় করে দেবে বুক ভরা স্নেহ-মমতা।
ভরতের তত বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। তার মনে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে সেই রাত্রির কথা। সমস্ত শরীর মাটিতে গাঁথা, শুধু মুখানি বাইরে, যে-কোনও মুহূর্তে কোনও হিংস্র জানোয়ার তাকে শেষ করে দিতে পারত। দৈবাৎ আদিবাসীরা তাকে দেখতে পেয়েছিল। সেই আদিবাসীদের কি ঠিক সেই সময় ভগবানই সেখানে পাঠিয়েছিলেন ? নিশ্চয়ই তাই, ঈশ্বরের করুণা ছাড়া তার পক্ষে বাঁচা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আগে তাকে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল কেন, তখন কেন ঈশ্বর বাধা দেননি ? এমন নিষ্ঠুর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য কোনও অপরাধ কি সে করেছিল ? থাক, ঈশ্বরের অভিপ্রায় সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করতে নেই। বারবার কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে আজ তো ঈশ্বর তাকে আশাতীত পুরস্কার দিয়েছেন। সে একজন সার্থক পুরুষ।
ভরত এখন অনেক দিক থেকেই সার্থক। ব্যাঙ্কের চাকরিতে তার পদোন্নতি হয়েছে। স্ত্রী ভাগ্যেই এই উন্নতি বলা যেতে পারে। ব্যাঙ্কের এজেন্ট ফার্গুসন সাহেব ভরতের কর্মকুশলতায় সন্তুষ্ট ছিলেন। ভরত বিবাহ করেছে শুনে তিনি একদিন তাকে ডেকে বলেছিলেন, বাবু, তোমার এখন উপার্জন বৃদ্ধির প্রয়োজন আমি বুঝি। তোমাকে আমি কলকাতায় বদলি করে দিতে পারি, অথবা পুরীতে আমাদের ব্যাঙ্কের যে নতুন শাখা হচ্ছে, তুমি সেখানকার ভার নিয়ে ম্যানেজার হতে পারো।
ভরতের কলকাতা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই, সে পুরীতে যাওয়ার প্রস্তাবই বেছে নিয়েছিল। নতুন শাখা প্রতিষ্ঠায় পরিশ্রম বেশি, তাতে তার কোনও আপত্তি নেই, কাজের মধ্যে ডুবে থাকাতে সে তৃপ্তি পায়। স্বর্গদ্বারের কাছেই একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, বাড়ির সংলগ্ন জমি রয়েছে। অনেকখানি, গাছপালা বা বাগান নেই অবশ্য, কিন্তু বেশ ভোলামেলা পরিবেশ। দোতলা বাড়িটি ভারী সুন্দর করে সাজিয়েছে মহিলামণি। অকালবৈধব্যের জন্য কোনওদিন পিতৃগৃহ ছেড়ে বাইরে যাওয়ার আশা ছিল না তার, ভাগ্যের এক সুমধুর মোচড়ে সে একটা নিজস্ব সংসার পেয়ে গেছে। তার রুচিবোধ সূক্ষ্ম, বেশি আসবাবপত্রে না ভরিয়েও ঘরগুলিতে সে শোভন শ্রী এনেছে, অতিথিরা এসে মুগ্ধ হয়।
বিয়ের আগে এরা দুজনেই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল, কিন্তু ভরত সে ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ছাত্র বয়েসের নাস্তিকতা বোধ তাকে কখনও ছাড়েনি। ব্রাহ্মদের উপাসনা ও উপদেশের বাহুল্য সম্পর্কে একটা গোপন তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল তার মনে। দীক্ষা নিতে সে রাজি হয়েছিল প্রয়োজনের খাতিরে। ব্রাহ্মদের সক্রিয় সমর্থন না পেলে কটক শহরে বসে বিধবাবিবাহ সম্ভব ছিল না। মহিলামণি তারপর থেকে ব্রাহ্মদের সবরকম আচার-আচরণ মেনে চলে। পুরীতে ব্রাহ্মসমাজ নেই, সে একা একাই মাঝে মাঝে উপাসনায় বসে, চক্ষু বুজে বিভোর হয়ে রবীন্দ্রবাবুর শেখানো ব্রহ্মসঙ্গীত গায়। অবশ্য একটি পৃথক ঘরে সে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহও রেখেছে, সেখানেও প্রতিদিন সকালে ফুল-জল দেয়। এই বৈপরীত্যের মধ্যে যেন কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। মহিলামণির যুক্তি এই যে, বিয়ে করেছে বলেই তো সে তার বাবা-মা, ভাই-বোনেদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়নি, সুতরাং বাল্যকাল থেকে সে যে রাধাকৃষ্ণের মূর্তিকে পুজো দিয়ে এসেছে, সেটাই বা ছাড়বে কেন? আর ব্রাহ্মধর্মের মাধ্যমে সে তার স্বামীকে পেয়েছে। সুতরাং এ ধর্মকেও শ্রদ্ধা জানাবে। নিরাকারের ভঞ্জনা ও পৌত্তলিকতার এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।
ভরত এতদিন কোনও ধর্মেরই ধার ধারেনি। সে এখন পাক্কা সাহেবি পোশাক পরে অফিসে যায়, নইলে ম্যানেজার হিসেবে লোকে তাকে সমীহ করবে কেন? ইংরেজ কিংবা দো-আঁশলা ফিরিঙ্গিরাই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়, দিশি লোকের এই পদ পাওয়া দুর্লভ ঘটনা। বাড়িতেও লোকজন এলে ভরত পায়ে মোজা না দিয়ে কারুর সামনে বেরোয় না। মদ্যপানের প্রতি তার ঝোঁক না থাকলেও সে নৈশভোজনের সময় এক পাত্র শেরি পান করে। মহিলামণি যখন তন্ময়ভাবে ব্রহ্মসঙ্গীত গায়, সে দূরে বসে মাথা দোলায়, কিন্তু কখনও পরম ব্রহ্মের প্রসঙ্গ উঠলে সে মৃদু হাসোর সঙ্গে বলে, ‘পঞ্চ ভূতের ফাঁদে, ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে’, আমি ব্ৰহ্ম বিষয়ে এর বেশি কিছু জানি না। ভরত রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সামনেও কোনওদিন মাথা নত করেনি।
কিন্তু সন্তানম্মের রাতে কী যে হল তার, সে ঠাকুরঘরে শুয়ে থেকে বহুক্ষণ অবর্ষণ কবতে লাগল। হয়তো বাল্যস্মৃতি প্রবল আলোড়ন তুলেছিল তার বুকে। ত্রিপুরার রাজবাড়িতে সে রাধাকৃষ্ণের নিত্য পূজা দেখেছে, রাসলীলা দেখেছে, পদাবলী কীর্তন শুনেছে, সেই সব স্মৃতি ফিরে এসেছে অকস্মাৎ। রক্তের উত্তরাধিকার সে অস্বীকার করতে পারে না। তার সন্তান তার মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে বংশপরম্পরাবোধ।
পরদিন থেকে ভরত রীতিমতন আস্তিক হয়ে গেল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সে ঠাকুরঘরে প্রণাম না সেরে জলপান করে না।
কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠল মহিলামণি। শিশুটি এখন আর শুধু কাঁদে না, হাসতেও শিখেছে। দু চামচ অতি স্বচ্ছ সমুদ্রের জলের মতন তার টলটলে দুটি চোখ, মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে চতুর্দিক দেখে আর হঠাৎ হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। ভরত ভাবে, এইটুকু অবোধ শিশু পৃথিবীর কী দেখে এমন আনন্দ পাচ্ছে? অথবা ওর মনে পড়ছে গত জন্মের কথা? প্রতিদিন এই শিশুর পরিবর্তন গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে ভারত। ক্রমশ এর নাক, চোখ, কপাল, ও স্পষ্ট হচ্ছে, মুখের সেই রক্তাভ ভাবটা কেটে যাচ্ছে। তবু পুতুলের রূপ থেকে মানুষ হয়ে উঠতে যেন এখনও অনেক দেরি। ভরত দেখেছে গরুর যখন বাচ্চা হয়, বাছুরটা খানিকবাদেই লাফালাফি শুরু করে। ঘগলছানাগুলো জন্মের একদিন পরেই এদিক ওদিক ছুটে যায়। আর মানুষের বাচ্চার স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে এত সময় লাগে! দু মাস হয়ে গেল, এখনও তাদের ছেলেটিকে চিত করে মাটিতে শুইয়ে রাখলে অসহায় কচ্ছপের মতন হাত-পা ছোড়ে, নিজে নিজে উপুড় হতেও পারে না।
প্রতিবেশিনীরা এসে বলে ছেলেটির চোখ দুটি অবিকল মায়ের মতন, ঠোঁটও মায়ের মতন, কিন্তু থুতনির কাছটায় বাবার সঙ্গে খুব মিল। ভরত কিছুই বুঝতে পারে না। তার ব্যাঙ্কের ক্যাশবাবু একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, নিয়মিত পুজোআচ্চা করেন, তিনি একদিন দেখতে এসে বললেন, এ তো দেখছি মায়ের মুখ পেয়েছে, মাতৃমুখী সন্তান সুখী হয়, তবে এর কপাল বাবার মতন, লাটে রাজটিকা একেবারে স্পষ্ট।
এ কথাটা শুনে ভরত চমকে উঠেছিল। কিন্তু ক্যাশবাবু পর মুহূর্তেই বললেন, এ ছেলে ভবিষ্যতে নির্ঘাত জজ কিংবা ম্যাজিষ্ট্রেট হবে। তখন ভরতের হাসি পেয়েছিল। এ যুগে জজ-ম্যাজিষ্ট্রেটরাই রাজা।
ভরত নিজে যদিও কোনও মিল খুঁজে পায় না। কিন্তু অন্য কেউ যখন তার পুত্রের কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে পিতার মিল খুঁজে পায়, তখন তা শুনে সে গুপ্তসুখ অনুভব করে।
মহিলামণি যখন দোতলার বারান্দায় বসে ছেলেকে পুন্যপান করায় তখন ভরত মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে, তাকে কি কেউ কখনও অমনভাবে কোলে শুইয়ে বুকের দুধ খাইয়েছে? তার জননী তো তাকে জন্ম দিয়েই বিদায় নিয়েছে, তবু সে বেঁচে থাকল কী করে? কোনও রমণীর কোলে মাথা রাখার স্মৃতি তার নেই।
একদিন শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মহিলামণিকে সেই অবস্থায় দেখে দারুণ চমকে উঠল ভরত। যেন অবিকল ভূমিসুতা! ঠিক ভুমিকম্পেরই মতন কেঁপে উঠল ভরতের বুক। তার স্ত্রীর মুখের একটা পাশের সঙ্গে ভূমিসূতায় মুখের কিছুটা আদল আছে ঠিকই। কিন্তু এতখানি মিল মনে হয়নি কখনও। অথচ, বুকের জামা খোলা, একটি স্থানে সন্তানের মুখ, জননী মুখ নিচু করে চেয়ে আছে সন্তানের দিকে, এই ভঙ্গিতে ভূমিসূতাকে তো কখনও দেখেনি ভরত, তবু কেন এমন মনে হল? দু তিন বার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার চাইতেও সে ঘোর ভাঙল না, ভরত তখন সরে গেল সে জায়গা থেকে।
বিয়ের পর একাধিকবার স্ত্রীর কাছে ভূমিসূতার বৃত্তান্ত বলবে বলবে ভেবেও শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি ভরত। বলে ফেলতে পারলে ভরত অনেকখানি ভার মুক্ত হত। কিন্তু বলা উচিত কি না। সে সম্পর্কে মনস্থির করতে পারেনি। চিরতরে হারিয়ে গেছে ভূমিসূতা, জীবনের সে একটি লুপ্ত অধ্যায়, তার স্মৃতি আর জাগিয়ে রেখে কী হবে? মনে পড়লেই বরং অপরাধ বোধ জাগে। এমন সুখের দিনে কেন হানা দেবে সেই মুখ? মহিলামণিকে বলতে হবে, মাথার চুল যেন সে ঘুরিয়ে বুকের ওপর না আনে।
ঘুমন্ত সন্তানের মুখের দিকে অনেকক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে ভরত। শুধু কি মায়ের সঙ্গেই মুখের মিল এই শিশুর, নাকি ভূমিসূতা নাম্নী এক ভাগ্যহীনা রমণীরও কোনও ছাপ রয়েছে?
মহিলামণি ছেলেকে সোনা সোনা বলে ডাকে। কিন্তু তার তো একটা পোশাকি নামও দিতে হবে। মহিলামণি স্বামীকে বলেছে, আপনাদের আসামে পুরুষদের কেমন নাম হয়, আমি তো জানি না। আপনি সেইরকম একটি নাম দিন।
ভরত চুপ করে থাকে। এখানে সবাই জানে, ভরত এসেছে আসাম রাজ্য থেকে। তবে ভারতের জন্মদাত্রী ছিলেন আসামের রমণী, এ ছাড়া আসামের সঙ্গে ভরতের কোনও সম্পর্কই নেই, কোনওদিন সে সেখানে যায়নি। ত্রিপুরা থেকেও তাকে প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়েছে। বাংলা থেকেও সে একহিসেবে বিতাড়িত। শশিভূষণ বলেছিলেন, তিনি আর কোনওদিন ভরতের মুখ দেখতে চান না। শেষ পর্যন্ত এই ওড়িশাতে এসেই সে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এখানেই সে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন। তার সন্তান হবে ওড়িশারই মানুষ।
অনেক ভেবেচিন্তে ছেলের নাম রাখা হল জগৎপতি। জগন্নাথ রাখাই প্রায় স্থির হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এই নামে এখানে এত মানুষ আছে যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জগন্নাথ বলে ডাকলে একসঙ্গে চার-পাঁচজন মানুষ সাড়া দেবে। জগৎপতি আর জগন্নাথের অর্থ একই। কলেজে পড়ার সময় ভরত নিজের পদবি লিখিয়েছিল সিংহ, এখন থেকে সে সিং হয়ে যাবে, ভারতের বহু রাজ্যের মানুষেরই সিং পদবি হয়, তার পুত্র হয়ে যাবে সিংদেও। জগৎপতি সিংদেও, চমৎকার!
আগে ব্যাঙ্কের সব কাজকর্ম চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভরতের দেরি হত। এখন সে পাঁচটা বাজতে না বাজতে ঝাঁপ বন্ধ করে ছুটে আসে। অফিসের কাজের মধ্যে মধ্যেও স্ত্রী ও পুত্রের মুখ মনে পড়ে শতবার। বাড়ি তাকে টানে। কটক শহরে গান বাজনা থিয়েটারের একটা সাংস্কৃতিক জীবন ছিল, পুরীতে সেরকম কিছু নেই। ভরত তার জন্য অভাবও বোধ করে না। মাঝে মাঝে সমুদ্রের সামনে বেলাভূমিতে সন্ধে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে সে বেড়ায়, ছেলে এখন কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছে, কিন্তু তার কোনও মানে বোঝা যায় না, ভরত সেইরকম অর্থহীন ভাষাতেই ছেলের সঙ্গে গল্প করে।
বাড়ি ফিরে ভরত ছেলেকে তার মায়ের কোলে দিয়ে বলে, আমার জীবনটা ভরে গেছে মণি। আমি আর কিছুই চাই না।
জগৎপতির যখন দেড় বছর বয়েস, সেই সময় কটক থেকে খবর এল যে মহিলামণির বাবা খুব অসুস্থ, তিনি একবার নাতির মুখ দেখতে চান।
মহিলামণির বাপের বাড়ির লোকেরা তার বিবাহ নিমরাজি অবস্থায় মেনে নিয়েছিল। বিধবাবিবাহ এবং ব্রাহ্মধর্ম নেওয়ার জন্য অন্য আত্মীয়স্বজনরা রুষ্ট হয়েছিল, তাই বিয়ের পর এদের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করা হয়নি। মহিলামণির দুই দাদা অবশ্য এর মধ্যে একাধিকবার এসে দেখা করে গেছে, জগৎপতির অন্নপ্রাশনের সময় কটক থেকে অনেক উপহার সামগ্রীও এসেছিল। মহিলামণির এক মাসি পুরীতেই থাকেন, সে বাড়ির সঙ্গেও আসা-যাওয়া আছে। অর্থাৎ মহিলামণির বাপের বাড়ির দিক থেকে সম্পর্কটা না-গ্রহণ, না বর্জনের মতন।
বাবার অসুখের সংবাদ ও আমন্ত্রণ পেয়ে মহিলামণি কটকে যাওয়ার জনা বা হল। স্ত্রী ও পুত্রকে ভরসা করে অন্য কারুর সঙ্গে পাঠানো যায় না। ভরতকে সঙ্গে যেতে হয়। কিন্তু এজেন্টের অনুমতি ছাড়া ভরতের পক্ষে হুট করে পুরী ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ভরত হেড অফিসে অনুমতি চেয়ে তার পাঠাল।
এখানে কাজের দায়িত্ব দিয়ে যাওয়ার মতন বিশ্বস্ত লোকেরও খুব অভাব। বিশেষত ভাগ্যধর মিশ্র নামে অধীনস্থ একজন কর্মচারী আড়ালে শত্রুতা শুরু করেছে কিছুদিন ধরে। যাদের নিয়ে সে ভরতের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকায়, তাদেরই দু-একজন ভরতকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যধর লোকটি শক্তিশালী, সূতীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, কথার জাল বিস্তার করে মানুষকে বশীভূত করতে পারে, অনেক বিষয়ে খোঁজখবর রাখে। কিন্তু ব্যাঙ্কের চাকরির পক্ষে সে অযোগ্য। ভরত লক্ষ করেছে, অনেক মানুষই জগৎসংসারে সঠিক ভূমিকাটি পায় না বলে নিষ্প্রভ হয়ে থাকে। জলদস্যুদের সর্দার হলে যে-ব্যক্তিটি প্রভূত উন্নতি করতে পারত, সওদাগরি অফিসের কেরানি হিসেবে সে একেবারে ব্যর্থ। যার হওয়া উচিত ছিল যাত্রাদলের অভিনেতা, ধনী বাড়ির রান্নাঘরের পাচক হিসেবে তাকে মানাবে কেন? উকিল হিসেবে যে সার্থক হতে পারত, ইস্কুল মাস্টার হিসেবে সে বিরক্তিকর।
ভাগ্যধরের হওয়া উচিত ছিল কোনও জমিদারির নায়েব। সে জমিদার আর প্রজা, এই দু পক্ষকেই ঘোল খাইয়ে রাখতে পারত। তার এক প্রতিপত্তিশালী কাকার সুত্রে সে এই ব্যাঙ্কের চাকরি জোগাড় করেছে। সে ইংরিজি প্রায় কিছুই জানে না, ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তার আগ্রহও নেই। অঙ্কের ব্যাপারেও সে অমনোযোগী, কিন্তু নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেওয়ার মতন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ব্যাঙ্কের অন্যান্য কর্মচারীরা ভাগাধরকে ভয় পায়। ভরতের প্রতি তার যেন জাতক্রোধ আছে। সামনাসামনি মিষ্টি ব্যবহার করলেও আড়ালে কটুকাটব্য করে। ভরত দু একবার তার গুরুতর ভুল ধরে ফেলেছে। সে জন্য সে ভাগ্যধরকে বরখাস্ত করতে পারত, সে অধিকার তার আছে, কিন্তু এই বাজারে কারুর চাকরি খেতে চায় না সে। তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কী, ভাগাধরকে সে নিজেও একটু একটু ভয় পায়।
ভরতের আশঙ্কা হল, তার অনুপস্থিতিতে ভাগ্যধর একটা বড় রকমের গোলমাল পাকাতে পারে। সহকারী ম্যানেজার দীনবন্ধু পটনায় অতি মৃদু স্বভাবের মানুষ। ভাগ্যধরকে যেমন নায়েব হিসেবে মানাত, তেমনই দীনবন্ধুর হওয়া উচিত ছিল কোনও পাহাড়ের গুহায় নির্জন সাধক। ভাগ্যধর ধমক ধামক দিয়ে দীনবন্ধুকে দিয়ে যে-কোনও কাজ করাতে পারে। টাকাপয়সার যদি তছরূপ হয়, ভাগাধর কৌশলে হয়তো সে দায়িত্ব ভরতের ঘাড়েই ফেলে দেবে। ভরতের নিজস্ব কোনও সম্পত্তিই নেই, সঞ্চয়ও নেই, সে দায় সে মেটাবে কীভাবে? অথচ, ছুটি নিতে হলে, ব্যাঙ্কের কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে সে ব্যবস্থা তারই করে যাওয়া উচিত।
অনেক ভেবে-চিন্তে ভরত একদিন বিকেলবেলা দুটির পর অন্য কর্মচারীদের বিদায় দিয়ে ভাগ্যধরকে ডেকে বসাল নিজের কামরায়। ভাগ্যধর দু ফিটের ওপর লম্বা, জোয়ান পুরুষ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। অনবরত পান খায় বলে তার ঠোঁট সব সময় লাল, কশের পাশ দিয়ে একটু একটু রস গড়ায়। কথা বলার সময় সে সোজাসুজি, মর্মভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভরতের আবার মনে হল, ভাগ্যধর যদি হত কোনও জমিদারির নায়েব, আর সে হত প্রজা, তা হলে এরকম নায়েবের সামনে সে সব সময় তটস্থ হয়ে থাকত।
ভরত বলল, ভাগাধরবার, আপনাকে আমি একটা কথা খোলাখুলি জিজ্ঞেস কর, আপনি সোজাসুজি উত্তর দেবেন।
ভাগ্যধর বলল, আমি তো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে জানি না।
ভরত বলল, তা ঠিক। সেইজন্যই আপনার কাছে একটা বিষয় জানতে চাইছি। আপনার প্রতি কি আমি কখনও কোনও অন্যায় ব্যবহার করেছি? আপনার প্রতি কোনও অবিচার করা হয়েছে? আপনি আমাকে পছন্দ করেন না তা জানি। কেন? আমার চরিত্রে কোনও দোষ আছে?
ভাগাধর বলল, না। আপনি সচ্চরিত্রের মানুষ, বিনয়ী, ভদ্র। এসব তো স্বীকার করতেই হবে।
ভরত বলল, আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, একথাও তো ঠিক?
ভাগাধর বলল, তা ঠিক।
ভরত বলল, জানতে পারি কি, কেন?
ভাগ্যধর একটুক্ষণ ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু হেসে বলল, অনেকগুলি কারণ দেখানো যায়। এককথায় উত্তর দেব?
বলল, তাই দিন।
ভাগ্যধর সঙ্গে সঙ্গে একটা তীরের মতন উত্তর ছুঁড়ে দিল, কারণ আপনি বাঙালি!
ভরত দারুণ চমকে খানিকটা পিছিয়ে এল। আর যাই হোক, এরকম উত্তর সে আশা করেনি।
অস্ফুট স্বরে সে বলল, বাঙালি? কিন্তু আমার তো জন্ম আসামে।
ভাগ্যধর বলল, তা হোক। আপনি কলকাতায় লেখাপড়া শিখেছেন, সেখানে বাঙালি বনে গেছেন। আমাদের ওডিশার ছেলেরাও কলকাতায় লেখাপড়া শিখতে গিয়ে বাঙালি সাজে। বাপ-ঠাকুবাব ধর্ম ছেড়ে ব্রেহ্ম হয়, বাংলা গান করে, বাড়িতে বাংলা পত্রিকা রাখে।
—আমি ওডিশার মেয়ে বিয়ে করেছি, ওড়িয়া ভাষা জানি, ওড়িয়া পত্রিকাও পড়ি, তবু আমি
—দেখুন মশাই। কয়লা যেমন শতবার ধুলেও তার কালো রং ঘোচে না, তেমনই বাঙালিরা যেখানেই থাকুক, আর যে মেয়েই বিয়ে করুক, তাদের বাঙালিত্ব ঘোচে না।
—তাই? কিন্তু শুধু বাঙালি হওয়াটাই এত দোষের কেন?
–বাঙালিদের জন্যই তো আজ ওড়িশার এই দুর্দশা।
—ঠিক বুঝলাম না।
—আপনি বাঙালি-ভাবে চিন্তা করেন, তাই বোঝেন না। আমাদের কী আছে এখন ‘ ওড়িয়া নামে কোনও জাত আছে, না ওড়িশা নামে কোনও রাজ্য আছে? আমাদের সম্বলপুর জেলা জোড়া আছে মধ্যপ্রাদেশের সঙ্গে। গঞ্জাম জেলাটা একবার গেল মধ্যপ্রদেশে, একবার গেল মাদ্রাজে। বাকি ওড়িশা গ্রাস করে নিল বাংলা। বাংলার সরকার বাংলার উন্নতির জন্য যত চিন্তা করে, ওডিশাকে নিয়ে মাথাই ঘামায় না। আমরা পড়ে আছি অন্ধকারে।
—ভাগ্যধরবাবু, ওড়িশা টুকরো টুকরো হয়ে আছে তা জানি। কিন্তু তা কি বাঙালিরা করেছে?
–না, তা করেনি।
–তবে বাঙালিদের দোষ দিচ্ছেন কেন? ওড়িশাকে টুকরো টুকরো করেছে ইংরেজ সরকার। তারা ছুতো দেয়, শাসন কাজের সুবিধের জনা। আপনারা প্রতিবাদ করতে পারেননি? এখনও আপনারা সম্বলপুর, গঞ্জাম ছিনিয়ে আনাব জন্য…।
–কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব? ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে? তা আবার হয় নাকি? ইংরেজরা যুদ্ধে জয় করে নিয়েছে ওডিশা, এখন তারা রাজা, এখন তারা ইচ্ছেমতন এদেশটাকে যেমন খুশি ভাগ করবে, এতে আমাদের বলার কী আছে? নিরস্ত্র প্রজা কখনও রাজার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ জানাতে পারে?
—এ তো ভারী অদ্ভুত কথা। তবে বাঙালিদের ওপর আপনাদের রাগ কেন?
—তার কারণ, ইংরেজ সরকার ওড়িশাকে ছিন্নভিন্ন করে অন্ধকারে ঠেলে রেখেছে, আর বাঙালিরা তার সুযোগ নিয়েছে। আপনাদের বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর এখানে সূর্যাস্ত আইন, সেই সুযোগে একটার পর একটা জমিদারি কিনে নিচ্ছে বাঙালিরা। ডাক্তার-মোক্তার, মাস্টারব্যারিস্টার সব বাঙালি।
—এ তো প্রতিযোগিতার ব্যাপার। যোগ্যতার ব্যাপার। শুধু বাঙালি হলেই কি কেউ কাজ পায়?
–প্রতিযোগিতা আবার কী মশাই? আপনাদের ওখানে ইস্কুল-কলেজ খুলেছে, আপনারা দু পাতা ইংরিজি বেশি পড়েছেন। সেটাই যোগ্যতা হয়ে গেল? আপনি শ্যানেজারের চেয়ারে বসেছেন, আমি কেন টেবিলের এদিকে বসে থাকব? আপনি আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জিততে পারবেন?
ভরতের হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। পাঞ্জা লড়ে জেতাটাই যে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায়, এমন কথা কে কবে শুনেছে!
ভাগ্যধর প্রায় ধমক দেবার সুরে বলল, হাসছেন কেন? খানিকটা ইংরেজি বিদ্যা ছাড়া জীবনে আর কোন ক্ষেত্রে আপনি আমার সঙ্গে জিততে পারবেন?
ভরত বলল, তা হয়তো ঠিক। কিন্তু ভাগ্যধরবাবু, আমি যদি আজ পদত্যাগ করি, কিংবা কম্পানি আমাকে সরিয়ে দেয়, তা হলেও কি আপনি এখানকার মানেজার হতে পারবেন? দীনবন্ধুবাবুর দাবিই বেশি। ভাগ্যধর অম্লানবদনে বলল, দীনবন্ধুকে আমি ল্যাং মেরে ফেলে দেব।
—অর্থাৎ শুধু বাঙালি নয়, একজন ওড়িয়াও যদি আপনার মাথার ওপর থাকে, তাকেও আপনি সরিয়ে দিতে চান। কিন্তু শুধু ল্যাং মেরে কি মানেজার হওয়া যায়? ইংরিজিতে চিঠিপত্র লিখতে হবে যে!
–তলার কর্মচাবীবা লিখবে, আমি সই মারব!
—ভাল করে হিসেবপত্র বোঝার ব্যাপার আছে।
—দীনবন্ধুর মতন কেষ্ট তা বুঝবে!
—আপনি কিছু কাজ না করেও ম্যানেজার হতে চান?
–অনেক বাঙালিকে আমি দেখেছি, কিছুই কাজ করে না। শুধু ডিগ্রির জোরে আমাদের মাথার ওপর লাঠি ঘোরায়।
ভাগ্যধর যতবার বাঙালি শব্দটা উচ্চারণ করছে, ততবারই যেন দাঁতে দাঁত ঘষছে। বাঙালি বিদ্বেষের পরিচয় আগেও পেয়েছে ভরত। কটকে থাকার সময় ফকিরমোহনবাবুর কাছেও শুনেছে শিক্ষাক্ষেত্রে ওড়িয়াদের ক্ষোভের কারণ। কিন্তু ভাগ্যধরের মতন এমন তীব্র ও উগ্র ভাব আর কারুর মধ্যে সে দেখেনি। ওড়িশার মানুষ সাধারণত বিনীত ও নম্র হয়, ভাগ্যধরের মধ্যে সে সবের নামগন্ধও নেই।
তার মনে পড়ল, পটনায় খোদাবক্স নামে এক পুলিশ অফিসার তাকে বলেছিল, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিচ্ছেদ কীভাবে বাড়ছে। এখন সে বুঝল, শুধু হিন্দু-মুসলমান নয়, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও বিভেদ ঘটিয়ে দেওয়া ইংরেজদের নীতি। ওড়িশার খানিকটা অংশ কেটেকুটে বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ায় বাঙালি আর ওড়িয়াদের মধ্যে তিক্ততা বাড়তেই থাকবে। এটাই ইংরেজদের অভিপ্রায়, রাজ্য শাসনেব এই ভেদনীতি বুঝতে পারলেও সাধারণ মানুষ সুযোগসন্ধানী হবেই। আসামও একসময় বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিল, কুড়িবাইশ বছর আগে পৃথক হয়ে গেছে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরটাকে আসামকে দিয়ে দেওয়া হবে, তা যদি হয় তা হলে আসামের মানুষদের সঙ্গে বাঙালিদের ঝগড়া লেগে যাবে।
ভরত বলল, ভাগাধরবাব, আপনার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভাল লাগল। এমন অকপট, স্পষ্টভাবে কেউ মনের কথা খুলে বলে না। বাঙালি বলে আপনি আমাকে সহা করতে পারেন না। বেশ! এবার একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। আপনি যদি বাঙালি হতেন এবং এরকম একটি ব্যাঙ্কের মানেজার হতেন, তা হলে কি একজন কর্মচারীর ঈর্ষার কথা শুনে চাকরি ছেড়ে দিতেন?
ভাগাধর বলল, না। অবশ্যই না।
ভরত বলল, আমিও চাকরি ছাড়ছি না। সুতরাং আপনি চেষ্টা করে যাবেন কী করে আমাকে চেয়ার থেকে সরানো যায়, আমিও চেষ্টা করে যাব এই চেয়ার আঁকড়ে ধরে থাকার। আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই, আমি ছুটি নিতে যাচ্ছি। কাল কটকে আর একটা তার পাঠিয়ে জানাব, আমার অনুপস্থিতিতে সমস্ত কাজের ভার থাকবে দীনবন্ধুবাবু এবং আপনার ওপর। কোনও গোলযোগ হাসে সে দায়িত্ব আপনাদের দুজনকেই বহন করতে হবে। আমি ফিরে এলে পাইপয়সার হিসেব পর্যন্ত আমাকে বুঝিয়ে দেবেন।
ভাগাধর বলল, ন্যায্য প্রস্তাব। সিংহবাবু, আমি প্রথমেই বলেছি, মানুষ হিসেবে আপনি খারাপ নন, আমার নামে হেড অফিসে এ পর্যন্ত কোনও অভিযোগ পাঠাননি, ব্যক্তিগতভাবে আপনার ওপর আমার কোনও রাগ নেই।
ভরত হেসে বলল, আমি কটক থেকে ফিরে আসি, তারপর একদিন আপনার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে দেখতে হবে।
তিনদিন পর ভরত স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে কটক যাত্রা করল।
পুরী পর্যন্ত লাইন পাতা হয়নি, ট্রেন ধরতে হবে খুদা রোড়ে, সে পর্যন্ত যেতে হবে পাক্ষিতে। শীত পড়েছে বেজায়। তাই তীর্থযাত্রীর সংখ্যা ইদানীং খুব কম। পথের খানিকটা অংশ খুব নির্জন। অরণ্যপ্রায়, কখনও সখনও সেখানে ডাকাতের উপদ্রবের কথা শোনা যায়। তাই দুজন সশস্ত্র পাহারাদারও সঙ্গে নেওয়া হল।
চার বেহারার পাল্কিতে ভরত আর মহিলামণি বসেছে মুখোমুখি। শিশু পুত্রটি একবার বাবার কোলে একবার মায়ের কোলে যাচ্ছে। দুটো চারটে শব্দ সে এখন উচ্চারণ করতে পারে, সেই যৎকিঞ্চিৎ শব্দভাণ্ডাব দিয়েই সে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করে। ছেলেকে সুন্দর কবে সাজিয়েছে মহিলামণি। গায়ে একটা লাল মখমলের জামা, মাথায় সাদা উলের টুপি, পায়ে সাদা মোজা, দু হাতে দুটি সোনার বালা। মহিলামণির মাথায় এখন ঘোমটা নেই, চুড়ো করে বাঁধা চুলে ফুল গোঁজা, শীতের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে তার ফর্সা মুখ।
দুজনে গল্প করতে করতে যাচ্ছে, বিকেলের আগেই রেল স্টেশনে পৌঁছে যাবার কথা। এরই মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর কাণ্ড হল।
হঠাৎ পাল্কি বাহক আর্ত চিৎকার করে উঠতেই ভরত ভাবল বুঝি তারা কোনও হিংস্র জানোয়ার দেখেছে। মুখ বাড়িয়ে সে দেখতে যেতেই পাল্কিটা আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে, শোনা গেল ঠকাঠক লাঠির শব্দ। কোনও ক্রমে পাল্কি থেকে বেরিয়ে এসে ভরত দেখল পাল্কি বাহকরা জঙ্গলের মধ্যে দুটে পালাচ্ছে, তিনজন ভীষণকায় লোক ঘিরে দাঁড়িয়েছে পাল্কি। তাদের মধ্যে একজন একটা তলোয়ার ভরতের বুকে ঠকিয়ে বলল, চুপ করে দাঁড়া, চাচালে তোর গদান যাবে।
দিনেদুপুরে ডাকাতি! ভরত যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। পাল্কিবাহকরা মারামারি করতে জানে না, সেটা তাদের কাজের শর্তও নয়। অস্ত্রধারী পাইক দুজনের মধ্যে একজনের পাত্তা নেই, অন্যজন মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। ভরত একবার ভাবল, এ কি ভাগ্যধরের কাজ, সেই ডাকাত লেলিয়ে দিয়েছে? এইভাবে সে ভরতকে পর্যুদস্ত করতে চায়? বিশ্বাস করা শক্ত, তবু মনে হয়।
ভরত ফ্যাকাসে গলা, বলল, আমাদের প্রাণে মেরো না। যা আছে সব নিয়ে যাও।
একজন দস্যু কর্কশ গলায় মহিলামণিকে বাইরে এসে দাঁড়াতে বলল।
মহিলামণি এক হাতে ছেলেকে বুকে চেপে ধরে অন্য হাতে খুলতে লাগল শরীরের গহনা। দস্যুরা পোঁটলা-পুঁটলি সব নিল, মহিলামণির অলঙ্কার নিল, শিশুর হাত থেকে বালা দুটি খুলে নিতেও ছাড়ল। শিশুটি এতক্ষণ কিছু বোঝেনি, এবার সে কেঁদে উঠল।
দস্যুরা শুধু অর্থ-অলঙ্কার লুট করতেই আসেনি। একজন মহিলামণির বুক থেকে সবলে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ঝোপের মধ্যে। অন্য একজন মহিলামণির এক হাত চেপে ধরে হ্যাচকা টান মারল।
ভরত যেন পাথর হয়ে গেল। চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার সাময়িক সুখের সংসার। ঈশ্বর তাকে দয়া করে যা দিয়েছিলেন তাও তার ভাগো সইল না। তার জীবনে এরকম বিপদ আসে বারবার। আর কারুর জীবনে তো এমন ঘটে না, শুধু তার জীবনটাই বিড়ম্বিত। এবারের বিপদটাই চরম, এরপর আর তার বেঁচে থাকার কী মানে হয়?
মহিলামণি আকুল আর্তনাদ করতে করতে তাকাচ্ছে ভরতের দিকে, দুজন দস্যু তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ছ্যাচড়াতে লাগল। হঠাৎ ভরতের শরীরে যেন আবার প্রাণ ফিরে এল। সে লাফিয়ে উঠল।
যে দস্যুটি ভরতের বুকে তলোয়ার ছুঁইয়ে ছিল, সে একটু পিছিয়ে গেছে, যদিও তুলোয়ার তুলে আছে। ভরত প্রাণের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর, লোকটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তলোয়ারটি কেড়ে নিতে সমর্থ হল। এখন যেন ভরতের শরীরে অসুরের শক্তি। সে তলোয়ার উচিয়ে বলল, হারামজাদা, ছাড় ওকে, আজ তোরা মরবি!
ভরত কোনওদিন অসিচালনা শিক্ষা করেনি। শারীরিকভাবে লড়াই করার প্রবৃত্তিই তার হয়নি কখনও। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ওপরে যেন মন্ত্রশক্তি ভর করেছে। সে একা তিন ডাকাতকে প্রতিহত করে যেতে লাগল, তার শরীরে কোনও আঘাত লাগছে কি না সে সম্পর্কে কোনও ভুক্ষেপও করছে না। তার একটাই শপথ, স্ত্রী ও পুত্রকে রক্ষা করতে না পারলে সে আগে প্রাণ বিসর্জন দেবে। প্রত্যেকটি আঘাতের সঙ্গে সে এত জোরে চিৎকার করছে যে জীবনে সে কখনও তত উচ্চে গলা তোলেনি।
যতই পরাক্রম দেখাক ভরত, তার একার পক্ষে শেষ রক্ষা করা সম্ভব হত না, ডাকাতেরা অত্যন্ত বলশালী এবং হিংস্র। সৌভাগ্যক্রমে একটু পরেই আরও দুটি পাল্কি সেখানে এসে পৌঁছল, তাদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে, তাদের দেখে ডাকাতরা রণে ভঙ্গ দিয়ে ছুটে পালাল। ভরত তবু তাদের তাড়া করে গেল কিছু দূর। তারপর পেছন ফিরে যেই দেখল বিপদ কেটে গেছে, তখনই সে মুর্ভূিত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
অন্য যাত্রীদের সহায়তায় রেল স্টেশনে পৌঁছতে আর কোনও অসুবিধা হল না।
এই ঘটনার পর ভরত উপলব্ধি করল, সংসারে নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই। প্রেমময়ী স্ত্রী কিংবা স্বাস্থ্যবান সুন্দর সন্তান পেলেও মনের মতন জীবন কাটানো সম্ভব নয়। সবসময় বিপদের জন্য সতর্ক থাকতে হয়। তাকে লড়াই করতে হবে। ভাগ্যধরের মতন মানুষই হোক আর পথের মধ্যে দস্যুদলই হোক, যে-কোনও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি না রাখলে পায়ের উলার চোরাবালির মতন দুভাগ্য তাকে টেনে নেবে। ভরত ঠিক করল, কটকে গিয়ে সে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হিসেবে নিজের কাছে বন্দুক রাখার আবেদন জানাবে।
কিন্তু পরবর্তী বিপদটি অতর্কিতে এমনভাবে এল যে তার বিরুদ্ধে ভরতের লড়াই করার কোনও উপায়ই রইল না।
মহিলামণির পিত্রালয়ে দুতিন দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর বেশ সুস্থ হয়ে উঠল ভরত। এ বাড়িতে তাদের অভ্যর্থনার কোনও ত্রুটি হয়নি। মহিলামণির পুত্র সন্তানটিকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। সে-ই মন কেড়ে নিল সকলের। মহিলামণির অসুস্থ পিতা নাতির মুখ দেখে পাঁচটি মোহর উপহার দিলেন। এ পরিবারে অনেকদিন কোনও পুত্রসন্তান জন্মায়নি।
দস্যুরা যে মহিলামণির হাত ও চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে লাঞ্ছনা করেছিল, তাতে তার শরীরের চেয়েও মনে আঘাত লেগেছে বেশি। সেই আঘাত সে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তার স্বামী যে অসীম বীরত্ব দেখিয়ে তাকে রক্ষা করেছে, সে জন্য কৃতজ্ঞতার ভাষাও তার মুখে ফোটে না। সে কথা বলছেই খুব কম, যখন তখন চক্ষু দিয়ে জল গড়ায়। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে ভরতের হাত তার শরীরে ছোঁয়া লাগলে সে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। ভরত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ওটা ছিল দুঃস্বপ্ন! ভুলে যাও, মণি, অমন আর কখনও হবে না। আমি বেঁচে থাকতে আর কেউ তোমাকে ছুঁতে পারবে না।
শ্বশুরবাড়িতে নিজের থাকার ইচ্ছে ছিল না ভরতের। স্ত্রী-পুত্রকে এখানে রেখে সে জজসাহেবের বাড়িতে উঠতে পারত। কিন্তু ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে প্রথমে এখানেই আসতে হয়েছিল। শ্যালকদের অনুরোধে থেকে যেতেই হল। বাড়ির একটেরের একটি ঘর দেওয়া হয়েছে, কোনও অসুবিধে নেই।
মহিলামণির বাবার সঙ্কট কেটে গেছে, তিনি শয্যা ছেড়ে চলাফেরা করতে পারেন। নাতিটিকে এমন ভালবেসে ফেলেছেন যে কাছ ছাড়া করতেই চান না। ছুটি ফুরিয়ে গেলে স্ত্রী-পুত্রকে আরও কিছুদিনের জন্য এখানে রেখে ভরতকে হয়তো একাই ফিরে যেতে হবে।
ভরত পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বিহারীলাল গুপ্তর বাড়িতে গানবাজনার আসর এখনও বসে। মহিলামণি আর আগের মতন যখন তখন আসতে পারে না। তার মনের গ্লানি এখনও কাটেনি, মুখখানি এখনও মলিন।
ভরত একদিন তার প্রাক্তন ব্যাঙ্কে কথাবার্তা বলতে গেছে, একসময় শ্বশুরবাড়ির একজন ভূত্য হন্তদন্ত হয়ে খবর দিল যে তাকে এক্ষুনি যেতে হবে, তার স্ত্রী খুব অসুস্থ।
উঠোনে স্নানের ঘরে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল মহিলামণি, তারপর আর তার জ্ঞান ফেরেনি। একজন কবিরাজ এসে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেও জ্ঞান ফেরাতে পারেননি। দ্বিতীয় একজন কবিরাজ এসে বললেন, রোগ কঠিন, মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে গেছে।
এরপর তিনদিন কেটে গেল, মহিলামণির চেতনা ফিরল না। মৃদু হলেও নাড়ি আছে, শ্বাসপ্রশ্বাসের সামান্য চিহ্ন দেখে প্রাণের লক্ষণ টের পাওয়া যায়, কিন্তু চক্ষু বোজা। বাক্ রুদ্ধ। পবপর ডাক্তার কবিরাজ আসতে লাগলেন, কেউ কিছু করতে পারলেন না। সরকারি সিভিল সার্জন এ শহরের একমাত্র ইংরেজ চিকিৎসক, তাঁকেও ডেকে আনা হল। তিনিও বিশেষ ভরসা দিতে পারলেন না, কবিরাজাদের মত সমর্থন করে বললেন, মস্তিষ্কের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, এখন জ্ঞান ফিরে আসা কিংবা না-আসা ওর নিয়তির ওপর নির্ভর করছে।
ভরতের প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। মহিলামণি বাঁচবে না? মাত্র তেইশ বছর বয়েস, সে কী এমন অপরাধ করেছে, কেন তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে? এত মানুষ থাকতে ভরতই বা কেন সংসার রাখতে পারবে না? ঈশ্বরের এ কী বিচার? ভরত তার সর্বশক্তি দিয়েও মহিলামণিকে বাঁচাতে চায়, কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে সে কীভাবে লড়াই করবে? মহিলামণির শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে সে এমন ব্যাকুলভাবে তার নাম ধরে ডাকতে থাকে যে অন্যরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
চিকিৎসকরা জবাব দিয়ে যাওয়াব পর ভরত বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে পুজো দিতে লাগল। চোখ বুজে, জোড় হাতে সে সমস্ত অন্তর উজাড় করে ডাকে, হে ভগবান, হে মা কালী, হে মা চণ্ডী, মহিলামণিকে ফিরিয়ে দাও! আমার চাকরি যাক, আমার সংসার যাক, স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে আমি জঙ্গলে গিয়ে থাকব, আর কিছু চাই না, শুধু মহিলামণিকে বাঁচিয়ে রাখো।
কয়েকজন বলল, উদয়গিরির কাছে একটি গুহার মধ্যে থাকেন এক তান্ত্রিক, অলৌকিক শক্তিতে তিনি অনেককে বাঁচিয়ে তুলেছেন। তবে সেই সন্ত্রিকের দেখা পাওয়া যায় না সহজে। পরপর কয়েকদিন তাঁর গুহার কাছে ধর্না দিয়ে থাকতে হয়। ভরত ছুটে গেল উদয়গিরিতে। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও ঝরনায় স্নান করে শুধু ধুতির খুট গায়ে জড়িয়ে সে গুহার সামনে শুয়ে পড়ল। গুমরে গুমরে বলতে লাগল, বাঁচাও, মহিলামণিকে বাঁচাও, আমি মরি তাতেও ক্ষতি নেই, আমার সন্তানের জননীকে বাঁচিয়ে দাও। হে ভগবান, দয়া করো!