বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধে লোকের বড়ো শ্রদ্ধা জন্মিল না, যেমন গর্জন হইয়াছিল তেমন বর্ষণ হয় নাই। অনেক তেলা মাথায় তেল পড়িল –কিন্তু শুকনা মাথা বিনা তৈলে ফেটে গেল। অধ্যাপকদিগের তর্ক করাই সার, ইয়ার গোছের বামুনদিগের চৌচাপটে জিত। অধ্যাপকদিগের নানা প্রকার কঠোর অভ্যাস থাকাতে এক্রোকা স্বভাব জন্মে –তাঁহারা আপন অভিপ্রায় অনুসারে চলেন –সাটে হাঁ-না বলেন না। ইয়ার গোচের ব্রাহ্মণেরা শহরঘেঁষা –বাবুদিগের মন যোগাইয়া কথাবার্তা কহেন –ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, তাঁহারা সকল কর্মেই বাওয়াজিকে বাওয়াজি তরকারিকে তরকারী। অতএব তাঁহাদিগের যে সর্ব স্থানে উচ্চ বিদায় হয় তাহাতে আশ্চর্য কি? অধ্যক্ষেরা ভালো থলিয়া সিঞাইয়া বসিয়াছিলেন –ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও কাঙালী বিদায় বড়ো হউক বা না হউক তাহাদিগের নিজের বিদায়ে ভালো অনুরাগ হইল। যে কর্মটি সকলের চক্ষের উপর পড়িয়াছিল ও এড়াইবার নয় সেই কর্মটি রব করিয়া হইয়াছিল কিন্তু আগুপাছুতে সমান বিবেচনা হয় নাই। এমন অধ্যক্ষতা করা কেবল চিতেন কেটে বাহবা লওয়া।
শ্রাদ্ধের গোল ক্রমে মিটে গেল। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালের বিজাতীয় খোসামোদ করিতে লাগিল। মতিলাল দুর্বল স্বভাব হেতু তাহাদিগের মিষ্ট কথায় ভিজিয়া গিয়া মনে করিল যে পৃথিবীতে তাহাদিগের তুল্য আত্মীয় আর নাই। মতিলালের মান বৃদ্ধির জন্য তাহারা একদিন বলিল –এক্ষণে আপনি কর্তা অতএব স্বর্গীয় কর্তার গদিতে বসা কর্তব্য, তাহা না হইলে তাঁহার পদ কি প্রকারে বজায় থাকিবে? –এই কথা শুনিয়া মতিলাল অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল –ছেলে বেলা তাহার রামায়ণ ও মহাভারত একটু একটু শুনা ছিল এই কারণে মনে হইতে লাগিল যেমন রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির সমারোহপূর্বক সিংহাসনে অভিসিক্ত হইয়াছিলেন সেইরূপে আমাকেও গদিতে উপবেশন করিতে হইবেক। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা দেখিল ঐ প্রস্তাবে মতিলালের মুখখানি আহ্লাদে চক্ চক্ করিতে লাগিল –তাহার পর দিবসেই দিন স্থির-করিয়া আত্মীয় স্বজনকে আহ্বানপূর্বক মতিলালকে তাহার পিতার গদির উপর বসাইল। গ্রামে ঢিঢিকার হইয়া গেল মতিলাল গদিপ্রাপ্ত হইলেন। এই কথা হাটে, বাজারে, ঘাটে-মাঠে হইতে লাগিল –একজন ঝাঁজওয়ালা বামুন শুনিয়া বলিল –গদিপ্রাপ্ত কি হে ? এটা যে বড়ো লম্বা কথা ! আর গদি বা কার ? এ কি জগৎসেটের গদি না দেবীদাস বালমুকুন্দের গদি ?
যে লোকের ভিতরে সার থাকে সে লোক উচ্চ পদ অথবা বিভব পাইলেও হেলে দোলে না, কিন্তু যাহাতে কিছু পদার্থ নাই তাহার অবস্থার উন্নতি হইলে বানের জলের ন্যায় টল্মল্ করিতে থাকে। মতিলালের মনের গতি সেইরূপ হইতে লাগিল। রাত দিন খেলাধুলা, গোলমাল, গাওনা-বাজনা, হো হা, হাসি-খুশি, আমোদ-প্রমোদ, মোয়াফেল, চোহেল, স্রোতের ন্যায় অবিশ্রান্ত চলিতে আরম্ভ হইল, সঙ্গীদিগের সংখ্যার হ্রাস নাই_ রোজ রোজ রক্তবীজের ন্যায় বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ইহার আশ্চর্য কি ? –ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নাই, আর গুড়ের গন্ধেই পিঁপড়ার পাল পিল পিল করিয়া আইসে। একদিন বক্রেশ্বরের সাইতের পন্থায় আসিয়া মতিলালের মনযোগানো কথা অনেক বলিল কিন্তু বক্রেশ্বরের ফন্দি মতিলাল বাল্যকালাবধি ভালো জানিত –এই জন্যে তাহাকে এই জবাব দেওয়া হইল –মহাশয় ! আমার প্রতি যেরূপ তদারক করিয়াছিলেন তাহাতে আমার পরকালের দফা একেবারে খাইয়া দিয়াছেন –ছেলেবেলা আপনাকে দিতে থুতে আমি কসুর করি নাই –এখন আর যন্ত্রণা কেন দেন? বক্রেশ্বর অধোমুখে মেও মেও করিয়া প্রস্থান করিল। মতিলাল আপন সুখে মত্ত –বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা এক একবার আসিতেন কিন্তু তাহাদিগের সঙ্গে বড়ো দেখাশুনা হইত না –তাঁহারা মোক্তারনামার দ্বারা সকল আদায়-ওয়াশিল করিতেন ও মধ্যে মধ্যে বাবুকে হাততোলা রকমে কিছু কিছু দিতেন। আর ব্যয়ের কিছু নিকেশ প্রকাশ নাই –পরিবারেরও দেখাশুনা নাই –কে কোথায় থাকে –কে কোথায় খায় –কিছুই খোঁজ খবর নাই –এইরূপ হওয়াতে পরিবারদিগের ক্লেশ হইতে লাগিল কিন্তু মতিলাল বাবুয়ানায় এমতো বেহুঁশ যে এসব কথা শুনিয়েও শুনে না।
সাধ্বী স্ত্রীর পতিশোকের অপেক্ষা আর যন্ত্রণা নাই। যদ্যপি সৎ সন্তান থাকে তবে সে শোকের কিঞ্চাৎ শমতা হয়। কুসন্তান হইলে সেই শোকানলে যে ঘৃত পড়ে। মতিলালের কুব্যবহার জন্য তাহার মাতা ঘোরতর তাপিত হইতে লাগিলেন –কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করিতেন না, তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন মতিলালের নিকট আসিয়া বলিলেন –বাবা ! আমার কপালে যাহা ছিল তাহা হইয়াছে, এক্ষণ যে ক-দিন বাঁচি সে ক-দিন যেন তোমার কুকথা না শুনতে হয় –লোকগঞ্জনায় আমি কান পাতিতে পারি না, তোমার ছোট ভাইটির, বড়ো বোনটির ও বিমাতার একটু তত্ত্ব নিও –তারা সবদিন আধপেটাও খেতে পাইয় না –বাবা। আমি নিজের জন্যে কিছু বলি না, তোমাকে ভারও দিই না। মতিলাল এ কথা শুনিয়া দুই চক্ষু লাল করিয়া বলিল –কি তুমি একশ-বার ফেচ্ ফেচ্ করিয়া বক্তেছ? –তুমি জানো না আমি এখন যা মনে করি তাই করিতে পারি? আমার আবার কুকথা কি? এই বলিয়া মাতাকে ঠাস্ করিয়া এক চড় মারিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। অনেকক্ষণ, পরে জননী উঠিয়া অঞ্চল দিয়া চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে বলিলেন –বাবা ! আমি কখন শুনি নাই যে সন্তানে মাকে মারে কিন্তু আমার কপাল হইতে তাহাও ঘটিল –আমার আর কিছু কথা নাই কেবল এইমাত্র বলি যে তুমি ভালো থাকো। মাতা পর দিবস আপন কন্যাকে লইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া বাটী হইতে গমন করিলেন।
রামলাল পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতার সঙ্গে সদ্ভাব রাখিতে অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন কিন্তু নানা প্রকারে অপমানিত হন। মতিলাল সর্বদা এই ভাবিত বিষয়ের অর্ধেক অংশ দিতে গেলে বড়োমানুষি করা হইবে না কিন্তু বড়োমানুষি না করিলে বাঁচা মিথ্যা, এজন্য যাহাতে ভাই ফাঁকিতে পড়ে তাহাই করিতে হইবে। এই মতলব স্থির করিয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার পরামর্শে মতিলাল রামলালকে বাটী ঢুকিতে বারণ করিয়া দিল। রামলাল ভদ্রাসনে প্রবেশকরণে নিবারিত হইয়া অনেক বিবেচনা করণান্তে মাতা বা ভাগিনী অথবা কাহারো সহিত না সাক্ষাৎ করিয়া দেশান্তর গমন করিলেন।