২১. বাকের একটা মোটর সাইকেল জোগাড় করেছে

বাকের একটা মোটর সাইকেল জোগাড় করেছে।

মটর সাইকেলটা মজিদের। তাকে বলেছে–দশ মিনিটের জন্যে দে তো গুলিস্তান যাব। আর আসব। মজিদ কিছুক্ষণ গাইগুই করলেও শেষটায় বিরসমুখে চাবি দিয়েছে। সেটা মঙ্গলবারের কথা। আজ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে মজিদ। দশবারের মত বাকেরের বাসায় এসেছে। নোট লিখে গেছে। জলিলের চায়ের দোকানে খবর দিয়েছে কোন লাভ হয়নি। বাকেরের কোন হদিস নেই।

মোটর সাইকেল জিনিসটা বাকেরের বেশ পছন্দ। কেনা সম্ভব নয়। এক সঙ্গে এতটা টাকা তার হাতে আসে না। ভাগ্যক্রমে মজিদেয় জিনিসটা যখন সঙ্গে আছে যত দূর সম্ভব ব্যবহার করা যাক। এর মধ্যে পেছনের একটা ল্যাম্প ভেঙে চুরমার। এটা ঠিক না করে মজিদের জিনিস তার কাছে ফেরত দেয়াও এক ঝামেলা। সে ল্যাম্প সারাতে দুশ টাকার মত লাগে। এও আরেক যন্ত্রণা। দুশ টাকা তার সাথে নেই। ইয়াদের কাছে চাওয়া যায়। কিন্তু ঐ শালা খচ্চরের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।

বাকের অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক করল। ইয়াদকে ধরতে হবে তার অফিসে। মিতিঝিল পাড়ায় অফিস। একবার এসেছিল, এখন কী খুঁজে বের করতে পারবে? জায়গা-টায়গা তার মনে থাকে না। দৈনিক বাংলার মোড়ে এসে সে একটা মজার দৃশ্য দেখল। হকার স্ট্যান্ডের সামনে মুনা দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে ম্যাগাজিন দেখছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টায় পুরুষেরা। একজন মেয়েও যেন এ রকম করতে পারে তা সে ভাবেনি। বাকের তার মািটর সাইকল রেখে এগিয়ে এল।

মুনা, কি করছ?

দেখতেই পারছেন কি করছি। পত্রিকা পড়ছি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছি মানে?

বসে বসে পড়ার কোন উপায় নেই। চেয়ার-টেবিল দেয়নি দেখছেন না।

মুনার এই জিনিসটা বাকেরের ভাল লাগে। চটাচিটা জবাব দিবে। এক সেকেন্ডও ভাববে না। যেন জবাবটা তৈরিই ছিল! বাকের এ রকম গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না;

মুনা, একটু এদিকে আসি তো জরুরি কথা আছে।

মুনা এগিয়ে এল।

বলুন কি ব্যাপার?

আইসক্রিম খাবে?

আইসক্রিম খাব কেন শুধু শুধু।

না মানে কড়া রোদ তো।

কড়া রোদ উঠলেই লোকজন আইসক্রিম খায়?

বাকের কি বলবে ভেবে পেল না। মুনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এটা কি আপনার জরুরি কথা?

না। ইয়ে শুনলাম। বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে — সত্যি নাকি?

হুঁ।

ডাক্তারের সাথে?

হ্যাঁ, ডাক্তারের সাথে। জহির উদ্দিন।

ভেরি গুড। ছোকরা খারাপ না ভালই। কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া নিয়েছ? না নিয়ে থাকলে নিও না। হাফ খরচে বাড়ির সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে ব্যবস্থা করে দেব। নো প্রবলেম।

মুনা হেসে ফেলল। বাকের অবাক হয়ে বলল, হাসছ কেন?

বেকার যুবকরা সামান্য একটা কাজ পেলে কেমন লাফিয়ে ওঠে তাই দেখে হাসছি।

বাকের মিইয়ে গেল। মুনা বলল, আইসক্রিম খাব না। তবে চা খেতে পারি। আশপাশে ভাল চায়ের দোকান আছে?

আশপাশে না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে মোটর সাইকেল আছে।

কি আছে?

মোটর সাইকেল। ভটভটি।

মোটর সাইকেলে আপনার পিছনে বসে চা খেতে যাব? পাগল হয়েছেন নাকি? আশপাশে কোথাও চায়ের স্টল থাকলে চলুন যাই।

তোমার অফিস নেই?

না ছুটি নিয়েছি।

কি জন্যে?

ঘুরে বেড়াবার জন্যে।

বাকের কিছুই বুঝতে পারল না। খুঁজে পেতে চায়ের স্টল একটা বের করল। মেয়েদের জেনা কেবিন আছে। মুনা ঠোট উল্টিয়ে বলল, কোন নরকে নিয়ে এসেছেন। আপনি?

কি করব, ভাল কিছু নেই এদিকে। উঠে পড়বে?

এসেছি। যখন চা খেয়েই যাই।

আমি একটা সিগারেট ধরালে তোমার অসুবিধা হবে মুনা?

না অসুবিধা হবে না।

বাকের খুব কায়দা করে সিগারেট ধরাল এবং এই সঙ্গে খুব সাবধানে মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা দেখল। চা খাবার পর যদি দেখা যায় মানিব্যাগ আনা হয়নি। কিংবা পকেট মারা গেছে তাহলে সর্বনাশ। মেয়েমানুষের কাছে হাত পাততে হবে। বেইজ্জাতি ব্যাপার হবে।

চাটা ভালই বানিয়েছে কি বল মুনা?

ভাল কি দেখলেন এর মধ্যে আপনি? বমি আসছে।

কফি খাবে? কফি পাওয়া যায়। এক্সপ্রেসো কফি।

না। যথেষ্ট হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি শেষ করুন।

বাকের কোনো রকম তাড়া দেখাল না। তার ইচ্ছা করছে অনন্তকাল এই ঘুপসি ঘরটাতে বসে থাকতে।

মুনা।

বলুন।

মামুন সাহেবের সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে নাকি?

ঝগড়া হবে কেন?

এমনি জিজ্ঞেস করছি। আগে তো প্রায়ই আসতেন তোমাদের বাসায় এখন আসতে দেখি না।

আপনি কী দিনরাত মানুষের বাসার দিকেই তাকিয়ে থাকেন? কে আসছে কে যাচ্ছে তাই দেখেন?

না তা না। তোমাদের বিয়ে কবে?

হবে শিগগিরই। হলে খবর পাবেন। সস্তায় কোথায় ডেকোরেটর পাওয়া যায়। এইসব খোঁজ তো আপনাকেই করতে হবে।

মুনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বাকের বলল, এখন কি বাসায় যাবে?

হুঁ।

চল একটা রিকশা করে দি।

রিকশা আমি নিজে নিয়ে নেব। আপনার যেখানে যাবার যান;

আমার তেমন কোন কাজ নেই। একটা অবশ্যি আছে সেখানে পরে গেলেও কোন ক্ষতি হ না। বকুলের বিয়ের তারিখ হয়েছে নাকি?

মোটামুটি ভাবে হয়েছে, তেসরা জ্বিলকদ।

জিলকদটা আবার কি?

আরবি মাসের নাম। মোহররমের আগের মাস হচ্ছে জিলকদ। বিয়েশাদিতে আরবি মাস ব্যবহার করা হয় জানেন না?

না জানি না তো।

রিকশায় উঠে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। বাকের মোটর সাইকেলে করে তার পেছনে আছে। ভাবটা এর রকম যেন পাহারা দিতে দিতে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা হল কড়া করে ধমক দেয়। কিন্তু ধমক দিতে মায়া লাগছে। চোখে চশমা পরে কেমন মহাকাপ্তান ভঙ্গি নিয়ে এসেছে চেহারায়। ঠোঁটে আবাবু একটা সিগারেট কামড়ে ধরা আছে। রিকশাওয়ালা একবার একটু বেশি স্পিড দিয়ে ফেলায় সে বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছে–থাবরা দিয়ে মুখ ভোতা করে দেব। একসিডেন্ট করে প্যাসেনজার মারতে চাস নাকি? অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থা। মাঝে মাঝে আবার দু’হাত ছেড়ে মোটর সাইকেল চালাবার চেষ্টা করছে। এটা বোধ হয় নতুন কোন কায়দা। মুনা ভেবে পেল না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কী করে মাঝে মাঝে এমন বির্বোধের মতো আচরণ করে? নাকি সে ঠিক বুদ্ধিমান নয়? বুদ্ধিমান মানুষ স্বার্থপর হয়। এটাই নিয়ম। টিকে থাকবার জন্যেই তাকে স্বার্থপর হতে হয়। বাকেরকে কী স্বার্থপর বলা যাবে? না বোধ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *