বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা বাঙালির সাকিন
১৯৪৭ সালের বহু আগে থেকেই পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এমনকি ধর্মীয়। পূর্ব বাংলা মুসলমানপ্রধান ও কৃষিভিত্তিক, এখানকার বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলামি উপাদান বেশি। পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুপ্রধান, সেখানকার সংস্কৃতিতে হিন্দুধর্মের উপাদান বেশি থাকাই স্বাভাবিক। পূর্ব বাংলার মানুষের কথাবার্তা, চালচলন ও মনমানসিকতা পশ্চিমবঙ্গীয়দের থেকে আলাদা। কোন দিকেরটা বেশি ভালো, তা নিয়ে তর্ক করা গ্রাম্যতা, যারটা তার কাছে ভালো।
পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে কুমিল্লায় ঘণ্টাকয়েক অবস্থানকালে বলেছিলেন : ‘পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সঙ্কল্প, সরলচিত্ত। এরা বুদ্ধির অভিমানে বিদ্রূপের দ্বারা বড় কথাকে ছোট করে দেয় না।’ ঠাকুর ছিলেন বাঙালির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কথাবার্তা দায়িত্ব নিয়ে বলতেন। কলকাতা থেকে কুমিল্লায় এসে এখানকার মানুষকে ‘খুশি’ করতে পামপট্টি দিয়ে কথা বলার পাত্র তিনি ছিলেন না। ১৯৭২ থেকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু লোক মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অনবরতই বলেন ‘দুই বাংলা এক’– এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি নিম্নমাঝারিদের পক্ষে করা সম্ভব, রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীর পক্ষে নয়। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, আমরা নিজেদের বাঙালি বলি কারণ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, অন্য কোনো কারণে নয়। অর্থাৎ তামিল, মারাঠি, পাঞ্জাবিদের মতো বাঙালিরা এথনিক বা নৃজনগোষ্ঠী নয়। বাঙালিরা একটি সংকর জাতি। একই রক্ত সবার মধ্যে প্রবাহিত নয়। তার সংমিশ্রণ ঘটেছে বহু জাতির রক্তের।
পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিক নবীনচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্র সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, গোবিন্দচন্দ্র দাস, কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের থেকে যথাযথ মর্যাদা ও উপযুক্ত স্বীকৃতি পাননি। দীনেশচন্দ্র সেন বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আশাহত হয়েছিলেন এবং গোবিন্দ দাস রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হতাশ হয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। জোড়াসাঁকো থেকে ফিরে এসে গোবিন্দ দাস লিখেছিলেন, ‘কবিবর রবীন্দ্রনাথের… সহিত প্রায় ঘণ্টাখানেক কথোপকথন হইয়াছিল। তাহার আলাপে সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম বটে কিন্তু একটু গর্বের গন্ধ পাইয়াছিলাম। গর্বটা বঙ্কিমবাবু বা রবিঠাকুর করলে মানায়, কিন্তু কলকাতার নিম্নমাঝারিরা করলে বিরক্তির উদ্রেক না করে পারে না।
পলাশীর যুদ্ধের পর ২০০ বছর বঙ্গের প্রাচীনতম নগরী ঢাকা ছিল অবহেলিত। ওই সময়কালেই কলকাতাকে ব্রিটিশ শাসকেরা গড়ে তোলে এশিয়ার একটি অতি আধুনিক মহানগরী হিসেবে। সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা চূড়া স্পর্শ করে। যেকোনো মহানগরীতেই স্থানীয়রা সুযোগ-সুবিধায় অগ্রাধিকার পায়, তাদের ভূমিকা পায় প্রাধান্য। দূরবর্তীরা বঞ্চিত হয় সুযোগ-সুবিধা থেকে। পূর্ব বাংলার মানুষের হয়েছিল সেই দশা। কলকাতার উঠতি বিত্তশালীদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতা দিয়ে পেরে ওঠা কঠিন ছিল। যদিও কলকাতা সমৃদ্ধি লাভ করে পূর্ব বাংলার কৃষকদের টাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলায় একটি নতুন আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে দেখা দেয় স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক। তাদের স্বশাসিত হওয়ার সেই স্পৃহাকে কেউ যদি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলে গালমন্দ করে আনন্দ পান, তাহলে বলার কিছু থাকে না। প্রতিটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের পেছনেই একধরনের সাম্প্রদায়িকতা কাজ করে।
১৯৪৭-এ ঢাকা পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পেলে এখানে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে এবং নবজাগরণ ঘটে। কলেজ পর্যন্ত পড়া শিক্ষিত শ্রেণির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নতুন রাষ্ট্রে সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আসে। কৃষক শ্রেণি ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ভেতর তৈরি হয় একটি মধ্য-শ্রেণি, যারা বই ও পত্রপত্রিকা পাঠ করত এবং সমাজ ও দেশ নিয়ে ভাবত। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তাদের মধ্যে যেমন ছিল দেশাত্মবোধ তেমনি সুবিধাবাদিতা।
পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন যাত্রা শুরু হয় অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, অতীতের ধারাবাহিকতায়। ১৯৫০ থেকে ঢাকায় তথা পূর্ব বাংলায় শিল্প সাহিত্যের যে চর্চা শুরু হয়, তার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা চলে জার্মানিতে ৪৭ গোষ্ঠী’র শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে। যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত জার্মানির তরুণ একদল লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন অতীতের ধারাবাহিকতায়ই নতুন শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, তবে তার বিষয়বস্তু, ভাষা ও চেতনা হবে একেবারেই নতুন। ওই গোষ্ঠীর বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে ছিলেন হাইনরিশ ব্যোয়েল, গুন্টার গ্রাস, সিগফ্রিড লেজ প্রমুখ।
১৯৪৭-এর পরে পূর্ব বাংলার শিল্প-সাহিত্যে তাঁদের মতোই ভূমিকা পালন করেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালামসহ বহু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক। তাঁদের সবার সৃষ্টিশীলতার শক্তি সমান ছিল না। তবে বেদনাদায়ক হলো পূর্ব বাংলার বহু উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমান হিন্দু পরিবার ১৯৪৭-এর পর স্বদেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য ভারতে চলে যাওয়ায় পূর্ব বাংলার সমাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের হিন্দুবিদ্বেষী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় হিন্দুরা নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেছেন। তারা খুব সংগতভাবেই মনে করেছেন নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সমাজে তারা যথাযথ মর্যাদা পাবেন না, যদিও এই মাটিতেই তারা মুসলমানদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করেছেন হাজার বছর।
পাকিস্তানি আমলেওকলকাতা থেকে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক পূর্ববাংলায় এসেছেন বিভিন্ন সভা-সম্মেলন উপলক্ষে অথবা ব্যক্তিগতভাবে বেড়াতে বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। ১৯৫৭-র ফেব্রুয়ারিতে মওলানা ভাসানী আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ভারত থেকে এসেছিলেন একদল খ্যাতিমান লেখক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও লেখক হুমায়ুন কবির, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আবদুল অদুদ, প্রবোধকুমার সান্যাল, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী প্রমুখ। দেবব্রত বিশ্বাসসহ অনেকেই অনেকবার ঢাকায় এসেছেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে।
পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক ভালো না থাকায় সেকালে দুই দেশের নাগরিক, বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের আসা-যাওয়া সহজ ছিল না। পূর্ব বাংলার প্রকাশিত বইপত্র কলকাতার ব্যবসায়িক কারণে আমদানিকারকেরা নিতে আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু কলকাতার প্রকাশিত বইপত্র প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ও চট্টগ্রামে আসত। সুতরাং, কলকাতায় কে কী লিখছেন, তা আমরা পড়তে পারতাম। কিন্তু পূর্ব বাংলার লেখালেখি সম্পর্কে সেখানকার বিদ্বানেরা থাকতেন অজ্ঞ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে দুই দেশের লেখকদের যাতায়াত ও যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু বেদনাদায়কভাবে লক্ষ করা গেল, ওপারের লেখকদের এ দেশের লেখকদের সম্পর্কে নির্ভুলভাবে জানার আগ্রহ কম। অনেকেই, বিশেষ করে যারা গৌণ, তাঁরা এখানকার সম্পর্কে আবোলতাবোল কথা বলেন। অনেকের নামটাও ঠিকমতো উচ্চারণ করেন না। বিখ্যাত কবি কায়কোবাদকে লিখতেন ‘কৈকোবাদ’, স্রেফ ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। একটি অতি সোজা নাম শামসুর রাহমান, তাও ঠিকমতো বলেন না; একটু প্রবীণ গোছের যারা তারা কেউ বলেন ‘শাস’, কেউ ‘সামশুর’ কেউবা ‘রহোমান’। একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও যারা নামটাই শুদ্ধ উচ্চারণ করেন না, তাঁরা তাঁদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করবেন, তা কী করে আশা করা যায়?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা ছিল না, বহু বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক বাংলাদেশে আসেন। এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, মনোজ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেক প্রবীণ ও নবীন, খ্যাত ও অখ্যাত কবি-লেখক। কবি জসীমউদ্দীনের বাসভবন ‘পলাশবাড়ী’ তখন ভারতীয় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সমাগমে প্রাণচঞ্চল। জসীমউদ্দীন আমাকে বললেন, মনোজ বসু ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঢাকা শহরের দর্শনীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে। কবির একটি নীল রঙের হিলম্যান বা সস্কোভিচ গাড়ি ছিল। মনোজ বসুকে আমি বলধা গার্ডেন, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল প্রভৃতি দেখাতে নিয়ে যাই। নজরুল, জসীমউদ্দীনের পুরোনো বন্ধু মনোজ বসুর সঙ্গে কথা বলে প্রীত হই। সরল-সোজা ধরনের মানুষ, মোড়লিপনার লেশমাত্র নেই। তাঁর ভুলি নাই, জলজঙ্গল, বন কেটে বসত, নিশি কুটুম্ব প্রভৃতি উপন্যাস; গল্পের বই বনমর্মর এবং ভ্রমণকাহিনি চীন দেখে এলাম প্রভৃতি ছাত্রজীবনে পড়ে আরাম পেয়েছি। মনোজ বসুর এক লেখায় পড়েছিলাম, ‘যশোরের রাজপুতুরের মতো কই মাছ’, সে কথাটি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেই জসীমউদ্দীন তাঁর স্ত্রী বেগম মমতাজ জসীমউদ্দীনকে বললেন, ‘ও মনি, মনোজকে তো তাহলে যশোরের বড় কৈ খাওয়াতে হয়। শিগগির তুমি বাজারে পাঠাও। জসীমউদ্দীন তাঁর স্ত্রীকে আদর করে মনি ডাকতেন।
জসীমউদ্দীনের বাড়িতেই প্রথম দেখি প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিংকে। অনেক পরে আমি দিল্লিতে তাঁর সুজন সিং পার্কের ফ্ল্যাটেও গিয়েছি আমার ছেলে সৈয়দ নাসিফ মাকসুদ সম্পাদিত ইংরেজি ম্যাগাজিন Padma-র একটি কপি এবং গান্ধীবিষয়ক আমার একটি বই তাঁকে দিতে। আমার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে বাহাত্তরে ঢাকায় সত্যজিৎ রায়ের একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আর দুই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছি। ঢাকা ও কলকাতায় মৃণাল সেনের ফ্ল্যাটে তার সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছে। কথা হয়েছে তিনজন বিদগ্ধ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বুদ্ধিজীবী ভবতোষ দত্ত, অম্লান দত্ত ও অশোক মিত্রের সঙ্গে। ঢাকার এক মাঠের ঘাসে বসে তিন ঘণ্টা গল্পসল্প করার সুযোগ পাই বলতে গেলে অলৌকিকভাবে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী পরিতোষ সেনের সঙ্গে। তিনি আমাদের ঢাকারই মানুষ। যাদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রেই যে সেরা, তাই নন, মানুষ হিসেবেও তাঁরা বড়। আদিখ্যেতা, ভণ্ডামি ও ফোপরদালালি তাঁদের চরিত্রে নেই। পূর্ব বাংলার মানুষ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোনো অশ্রদ্ধাবোধ লক্ষ করিনি।
অন্যদিকে কলকাতার অনেক লেখক এখানে এসে ঢাকা ক্লাব ও বনানী গুলশানের অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের চুটিয়ে প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁদের মনের ভাষা অন্য রকম। বাংলাদেশের শুধু মুসলমানদের নয়, এই ভূখণ্ডের হিন্দুদেরও চালচলন, ভাষার গ্রাম্যতা শুধু নয় তাদের দেশপ্রেম নিয়েও মশকরা ও কটাক্ষ করেন। সেখানকার একালের প্রবন্ধতে শুধু নয়, গল্প-উপন্যাসেও তা দেখা যায়। যেমন একজন লেখকের ভাষায় :
‘দেশ বিভাগের পর এ দেশে পূর্ববঙ্গের মানুষেরা চলে এসেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। জলস্রোতকেও হার মানানো সেই আসাটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মন থেকে মানতে পারেনি কোনোদিন। এই কিছুকাল আগেও এক জাতি-গোত্রের হলেও শুধু পূর্ববঙ্গীয় বলেই এপারের বাঙালি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে নারাজ ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা এই জনরাশিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।…..
‘স্বাধীনতার পর ১৯৪৭-এ যারা এদেশে এসেছিলেন, সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত তখন তাদের শিশুরা প্রতিনিয়ত শুনে এসেছে তাঁদের দেশ আছে ওপারে। সেই দেশে গোয়ালভরা গরু আর মাঠভরা ফসলের ছড়াছড়ি। সেই শিশু শুনেছে তার ঠাকুদা, ঠাকুর্মা যে ভাষায় কথা বলেন এখানকার মানুষ সেই ভাষায় কথা বলে না। সে দেখছে তার বাবা বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলেন বাইরে তা না বলার চেষ্টা করেন। তার রক্তে বুড়িগঙ্গা, পদ্মার জল খলখল করে ঠাকুর্মার সূত্রে। এই ছেলেটি যখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, তখন তার একমাত্র লক্ষ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। তার ঘঁটি সহপাঠীরা ব্যঙ্গ করে উচ্চারণের এবং সে মনে মনে ভাবে তার দেশ ছিল ওপার বাংলা।…..
‘দেশপ্রেম ইত্যাদি তার কাছে আশা করা যায় না। যে অর্থে মানুষ চাকরি বাঁচাবার জন্যে অফিসের প্রতি অনুগত সেই অর্থেই তার মানসিকতা এদেশের প্রতি কেন্দ্রীভূত। নিজের জায়গা বা বাড়ি মনে না করলে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ই। টানটা না থাকায়, মমতা না থাকায় ভালোবাসা জন্ম দিতে পারে না।…..
পরবাসীর কাছে স্বাদেশিকতাবোধ আশা করা যায় না।’
[সাকিন-নেই, সমরেশ মজুমদার]
সাতচল্লিশের পর পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা ভারতে গেছে, কিন্তু সবাই কি ‘প্রাণ বাঁচাতে’ গেছে? না গেলে তাদের কি এ দেশে মেরে ফেলা হতো? এই লেখাটির রচনাকাল নব্বইয়ের দশকের শেষ বা এই শতাব্দীর শুরুর দিক। পূর্ব বাংলা থেকে যেসব হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে গেছে, তাদের দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতাবোধ নেই, এই রায় দেওয়া তাদের প্রতি চরম অবিচার ও অসম্মান। তারা ভারত রাষ্ট্রটিকে ভালোবাসে না–তা ভাবাই যায় না। পার্টিশন ও উদ্বাস্তু নিয়ে বাংলা, হিন্দি, উর্দুতে বহু গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। সাদাত হাসান মান্টো লিখেছেন, ওয়ালীউল্লাহও লিখেছেন; ঋত্বিক ঘটকসহ অনেকে করেছেন অবিনশ্বর ছবি, কিন্তু এই তত্ত্ব বা মারাত্মক মতবাদ কেউ প্রচার করেননি।
মজুমদার পড়াশোনা করে অথবা গবেষণা করে দেখেছেন বাংলাদেশের কবি ও কথাশিল্পীরা ‘বেশ আরবি শব্দ প্রয়োগ করেন’ তাঁদের লেখায়। একজন ভাষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন ‘সাকিন’ শব্দটি এক শ এক ভাগ আরবি, এর মধ্যে অণু পরিমাণও সংস্কৃত নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়েও তিনি তাঁর রচনার। নামকরণ করেছেন একটি নিখাদ আরবি শব্দ দিয়ে– ‘সাকিন নেই’।
বাংলা ভাষার এই লেখকের এ রচনাটি থেকেই আমরা জানতে পারলাম, একালের পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষের কাছে ‘ঢাকার ভাষা যতটা অপরিচিত, হিন্দি তার দশ শতাংশও নয়। বাঙালি ছেলেদের একাংশ [মেয়েদের নয়] হিন্দিতে কথা বলে গর্বিত হয়, যদিও তাতে আমিতাভ বচ্চনের ভঙ্গি মিশে থাকে। হতভাগ্য বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ তাদের প্রিয় বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় কথা বলে না, বাংলায় কথা বলে তারা ‘গর্বিত’।