প্রহসনের এক বিচার শুরু হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মামলার নাম রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল গং’। কর্নেল তাহেরসহ অভিযুক্ত সর্বমোট ৩৩ জন। এর মধ্যে রহস্যমানব হিসেবে খ্যাত সিরাজুল আলম খান পলাতক।
মামলার প্রধান বিচারকের নাম কর্নেল ইউসুফ হায়দার। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা এই বাঙালি অফিসার বাংলাদেশেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খেদমত করে গেছেন।
মামলা চলাকালীন একপর্যায়ে কর্নেল তাহের প্রধান বিচারকের দিকে তাকিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, আমি আমার জীবনে অনেক ক্ষুদ্র মানুষ দেখেছি, আপনার মতো ক্ষুদ্র মানুষ দেখি নি। কর্নেল তাহেরের বক্তব্য শুনে আদালতে হাসির হল্লা ওঠে।
কর্নেল তাহের তাঁর বিরুদ্ধে আনীত কিছু অভিযোগ অস্বীকার করেন নি। যেমন, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা।
অভিযুক্ত আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোেগই দেওয়া হয় নি। ১৭ জুলাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
সবাই ধরে নেয় এই আদেশ কখনোই কার্যকর হবে না।
‘বীর উত্তম’ খেতাবধারী একজন সেক্টর কমান্ডার, যিনি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পা হারিয়েছেন, তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো যায় না। রায় ঘোষণার পরদিনই ফাঁসির মঞ্চ ঠিকঠাক করা শুরু হয়। খবর শুনে হতভম্ব তাহেরপত্নী লুফা প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। কর্নেল তাহের প্রাণভিক্ষার আবেদনে রাজি হবেন না তা লুৎফা তাহের ভালোমতোই জানতেন। ২০ জুলাই ক্ষমার আবেদন নাকচ করা হয়। পরদিনই তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
সাংবাদিক লিফসুলজের বিখ্যাত গ্রন্থ Bangladeh The Unfinished Revolution গ্রন্থে লুফা তাহেরের একটি চিঠি আছে। এই চিঠিতে তিনি কর্নেল তাহেরের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টার মর্মভেদী বর্ণনা দেন। এই চিঠি পড়ে অশ্রুরোধ করা কোনো বাংলাদেশি মানুষের পক্ষেই সম্ভব না।
২০ জুলাই ১৯৭৬ বিকেলে তাহেরকে জানানো হয় যে, ২১ তারিখ সকালে তার মৃত্যুর দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। তিনি তাদের সংবাদ গ্রহণ করেন এবং সংবাদ বাহকদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি তার রাতের ডিনার শেষ করেন, পরে একজন মৌলভীকে আনা হয়। সে এসে তাকে তার পাপের জন্যে ক্ষমা চাইতে বলে। তাহের বলেন, “তোমাদের সমাজের পাপাচার আমাকে স্পর্শ করতে পারে নি। আমি কখনো কোনো পাপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি নিষ্পাপ। তুমি এখন যেতে পার। আমি ঘুমাব।’ তিনি একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলেন। রাত তিনটার দিকে তাকে জাগানো হলো। কতক্ষণ সময় বাকি আছে, জিজ্ঞেস করে সে জেনে নিল। সময়টা জেনে নিয়ে তিনি তার দাঁত মাজলেন। তারপর সেভ করে গোসল করলেন। উপস্থিত সকলেই তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল। সকলকে মানা করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি আমার পবিত্র শরীরে তোমাদের হাত লাগাতে চাই না। তার গোসলের পর অন্যদের তিনি তার চা তৈরি করতে ও আমাদের প্রেরিত আম কেটে দিতে বললেন। তিনি নিজেই তাঁর কৃত্রিম পা-খানি লাগিয়ে প্যান্ট, জুতা ইত্যাদি পরে নিলেন। তিনি একটি চমৎকার শার্ট পরে নিলেন। ঘড়িটা হাতে দিয়ে সুন্দর করে মাথার চুল আঁচড়ে নিলেন। তারপরে উপস্থিত সকলের সামনে তিনি আম খেলেন, চা পান করলেন এবং সিগারেট টানলেন। তিনি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘হাসো। তোমরা এমন মনমরা হয়ে পড়েছ কেন? মৃত্যুর চেহারায় আমি হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাভূত করতে পারে না। তার কোনো ইচ্ছা আছে কি না জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন, আমার মৃত্যুর বদলে, আমি সাধারণ মানুষের শান্তি কামনা করছি। এরপর তাহের জিজ্ঞেস করেন, ‘আরও কি কিছু সময় বাকি আছে? তারা উত্তর দিল, সামান্য বাকি।’ তিনি তখন বললেন, তাহলে আমি তোমাদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাব।’ তিনি তখন তার কর্তব্য আর অনুভূতির উপর একটি কবিতা পাঠ করে শোনালেন। তারপর তিনি বললেন, ঠিক আছে, এবার আমি প্রস্তুত। সামনে চলো। তোমরা তোমাদের কাজ সমাধান করো।’ তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে আরোহণ করে দড়িটা তার গলায় নিজেই পরে নিলেন এবং তিনি বললেন, ‘বিদায় দেশবাসী। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’
মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী এবং মহাবীর ভাইদের উদ্দেশে বলেন, ‘এইভাবে যদি জীবনকে উৎসর্গ করা না যায় তাহলে সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবে কীভাবে?’
রাষ্ট্রীয় হত্যার দীর্ঘ ৩৫ বছর পর হাইকোর্টে এক রীট পিটিশন করা হয়। পিটিশনে বলা হয় কর্নেল তাহেরের বিচার ছিল অবৈধ।
হাইকোর্ট রীট পিটিশন আমলে নিয়ে ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। মহামান্য বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী তার রায়ে বলেন (২২ মার্চ, ২০১১), তাহের এবং তার সহযোগীদের বিচার অবৈধ। তাহেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।
জেনারেল জিয়াকে তাহের হত্যাকান্ত্রে জন্যে দায়ী করা হয়। রায়ে বলা হয়, জেনারেল জিয়া বেঁচে থাকলে তাহের হত্যাকাণ্ডের জন্যে তার বিচার হতো। বাংলাদেশের আইনে মৃত অপরাধীদের বিচারের বিধান নেই।
‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর