পেট্রাপোল স্টেশান দিয়ে অনেক দিন কোনো ট্রেন চলাচল করেনি, রেললাইনে মর্চে ধরে গেছে, টিকিট কাউন্টারে মাকড়সার জাল। সেই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মই এখন লোকে লোকারণ্য, এক দিকে জ্বলছে সদ্য পাতা চারটি উনুন, তার ওপর বড় বড় হাঁড়িতে হচ্ছে খিচুড়ি। দুটি প্ল্যাটফর্মেই কয়েক শো উদ্বাস্তু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে, চতুর্দিকে চ্যাঁচামেচি, হৈ-হট্টগোল, তারই মধ্যে একদল পুলিশবাহিনী এসে দক্ষিণের প্ল্যাটফর্মটি খালি করে দিল। এই পুলিশদের হাতে লাঠি ও বন্দুক আছে বটে, কিন্তু সেগুলি উঁচিয়ে ধরতে হলো না, একজন অফিসার হাতজোড় করে বিনীতভাবে বললো, আপনারা দয়া করে এই দিকটা খালি করে দিন, আমরা অনুরোধ করছি, লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ান, সবাই দেখতে পাবেন!
কেউ আপত্তি করলো না। সকাল থেকেই রটে গেছে যে আজ একটা বিশেষ দিন। ছন্নছাড়া মানুষগুলোর চোখে মুখে উদ্বেগ ও প্রতীক্ষা। বাচ্চাকাচ্চারাও হঠাৎ কেঁদে উঠলে মায়েরা তাদের থামিয়ে দিচ্ছে। কোনো ট্রেন আসবে না, তাই লাইনের ওপর গিসগিস করছে মানুষ। একটু দূরে কারা যেন ঢাক বাজাচ্ছে, ঠিক দুর্গাপুজোর আগের আবাহনের বাজনা। উদ্বাস্তুদের মধ্যে কিছু ঢাকীও আছে নিশ্চিত।
যেটা এক সময়ে ছিল স্টেশন মাস্টারের-ঘর সেখানে এসে বসেছেন পশ্চিম বাংলা ও কেন্দ্রীয় সরকারের বড় বড় অফিসাররা। একটা ওয়্যারলেস সেটে অদ্ভুত ধাতব মনুষ্য কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। অল্প বয়েসী একটি ছেলে একটি অতিকায় কেটলি ও একসঙ্গে অনেকগুলো মাটির ভাঁড় হাতে নিয়ে এসে দিয়ে গেল চা।
বাংলাদেশ মিশানের কয়েকজন প্রতিনিধির জন্য সেই ঘরের বাইরে পাতা হয়েছে একটি বেঞ্চ, সেখানে দু’জন মাত্র বসে আছেন, তাঁদের পাশে এসে বসলেন মামুন ও প্রতাপ। দু’জনেরই হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, প্রচণ্ড গরমে এত তেষ্টা পেয়েছে যে গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু জল খাবার উপায় নেই। সবাই এখানে জল খেতে নিষেধ করেছে, কারণ এখানকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা শুরু হয়ে গেছে। একটু আগে সব জায়গায় ছড়ানো হয়েছে। ব্লিচিং পাউডার, তার তীব্র গন্ধের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে খিচুড়ি রান্নার গন্ধ।
বাংলাদেশ মিশানের একজন প্রতিনিধি গলাটা লম্বা করে ঝুঁকিয়ে মামুনের বদলে প্রতাপকে জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে হয়, বাংলাদেশের স্বীকৃতি আজ ডিক্লেয়ারড হবে?
প্রতাপ বিনীতভাবে বললেন, আজ্ঞে, আমি তো বলতে পারবো না, আমি সে রকম কেউ
বস্তুত এই প্ল্যাটফর্মে ঢোকবার মুখে দু’জন পুলিশ অফিসার প্রতাপদের আটকে দিয়েছিল। মামুনের কাছে বাংলাদেশ মিশানের ছাপ দেওয়া আইডেনটিটি কার্ড দেখে তাঁকে বিনা বাক্যব্যয়ে ছেড়ে দিলেও প্রতাপকে আটকেছিল। মামুন তখন অনুরোধ করেছিলেন, ইনি আমার পুরনো ফ্রেন্ড, আমার সঙ্গে এসেছেন! প্রতাপের তুলনায় মামুনের এখানে সম্মান বেশি।
দু হাঁড়ি খিচুড়ি নেমে গেছে, দেরি করে আর লাভ নেই, স্বেচ্ছাসেবকরা পরিবেশন শুরু করে–দিল। ক্ষুধার্তদের লাইন সামলাতে প্ল্যাটফর্ম থেকে নীচে নেমে গেল কয়েকজন পুলিশ। যদিও তেমন কিছু ঠ্যালাঠেলি, হুড়োহুড়ি নেই, আজ যেন সবাই নিজে থেকেই সুশৃঙ্খল।
হঠাৎ একগাদা ক্যামেরাম্যান ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়তেই বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রী এসে গেছেন। এই ফটোগ্রাফাররা সামনে তাকিয়ে পিছু হটে, নাচের ভঙ্গিতে লাফায় ও শরীর মোচড়ায়, কিন্তু কেউ পা পিছলে পড়ে যায় না।
শুরু হয়ে গেল কোলাহল, বাতাসে ছড়িয়ে গেল দারুণ বিমিশ্র এক শব্দতরঙ্গ। বেজে উঠলো শাঁখ, শোনা গেল উলুধ্বনি, গর্জে উঠলো স্লোগান, জয় বাংলা! ইয়াহিয়া হুঁশিয়ার, বাংলার মানুষ আছে তৈয়ার! ভারত সরকার জিন্দাবাদ!
মামুনদের সামনে দিয়েই হেঁটে গেলেন ইন্দিরা গান্ধী। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়েস, শরীরে এখনও পূর্ণ যৌবন, মুখের চামড়া মসৃণ, নাকটা ঈষৎ লম্বা, মাথার চুলের খানিকটা অংশ শুধু চমকপ্রদ ভাবে সাদা, একটা হালকা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে আছেন। গট গট করে হেঁটে এসে তিনি প্ল্যাটফর্মের একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়ালেন, একটুক্ষণ শুনলেন নানা রকমের স্লোগান, তারপর হাত তুলে শান্ত হবার ইঙ্গিত করলেন।
কিন্তু কেউ তাতে ভূক্ষেপ করলো না, ধ্বনি বাড়তেই লাগলো।
এদিকের প্ল্যাটফর্মে কোনো উদ্বাস্তুর থাকার কথাই নয়। তবু কী করে যেন ঢুকে পড়েছে এক বুড়ি। বয়েসের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে, মাথার চুল শনের মতন, ছেঁড়া ঝুলি ঝুলি একটা শাড়ি দিয়ে কোনোরকমে গা ঢাকা। কেউ তাকে লক্ষ করেনি কিংবা গ্রাহ্য করেনি, সে সোজা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ইন্দিরা গান্ধীর পায়ের ওপর। কেঁদে, ফুঁপিয়ে কী সব যেন বলতে লাগলো।
ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে চমকে গিয়ে পিছিয়ে গেলেন একটু। দু’জন সরকারী অফিসার বুড়িটাকে টেনে সরিয়ে দিতে গেল, ইন্দিরা গান্ধী তাদের নিষেধ করে বললেন, আপ উঠিয়ে, যো বোলনা হায়, আপ–
তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে, কৈশোরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে শেখা বাংলাভাষা স্মৃতিতে এনে ইন্দিরা গান্ধী নরম সুরে আবার বললেন, আপনি উঠুন, বুড়ি মা! ভয় নেই, কিছু ভয় নেই!
বুড়ি হাউ হাউ করে কেঁদে বললো, আমার পোলাডারে মাইরা ফালাইছে! রাইক্ষসেরা আমাগো গেরামে আগুন জ্বালাইয়া দিছে।
পাশ থেকে একজন ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়ে দিল, পোলা মিনস ছেলে। সান। হার সান ওয়াজ মার্ডার অ্যান্ড দেয়ার ভিলেজ ডেস্ট্রয়েড বাই আরসন।
ইন্দিরা গান্ধী মাথা নাড়লেন। বুড়ি আবার বললো, মাগো, তোমার চরণে আশ্রয় নিছি। ছোট ছোট বাইচ্চারা সাথে আছে, পুতের বৌ, মাগো রক্ষা করো।
পাশের লোকটিকে অনুবাদের সুযোগ না দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, বুড়িমা, আপনারা এ দেশের অতিথি, আর কোনো ভয় নেই!
জননী যেমন সন্তানকে আদর করে, কান্না থামিয়ে বুড়িটি সেইভাবে ইন্দিরা গান্ধীর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
সব স্লোগান, সব ধ্বনি স্তব্ধ হয়ে গেছে, সবাই দেখছে এই দৃশ্য। কিন্তু এতখানি নাটকীয়তা বোধহয় ইন্দিরা গান্ধীর পছন্দ হলো না, তিনি বুড়িকে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে! তারপর পেছন ফিরে দ্রুত হেঁটে গেলেন খিচুড়ির হাঁড়ির দিকে।
স্বেচ্ছাসেবকরা পরিবেশন বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দিরা গান্ধী একজনের হাত থেকে পেতলের বড় হাতাটি নিয়ে হাঁড়িতে ডুবিয়ে তুললেন খানিকটা খিচুড়ি। অন্য হাতে সেই গরম খিচুড়িই খানিকটা টিপে দেখে একজন স্বেচ্ছাসেবককে ভর্ৎসনার সুরে বললেন, নট পারফেক্টলি বয়েলড়।
অন্য একটি হাঁড়ি থেকে আবার খিচুড়ি তুলে টিপে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি নিজেই পরিবেশন করতে গেলেন লাইনের প্রথম লোকটিকে।
লাইনের প্রথমে যে দাঁড়িয়ে আছে সে একজন বাইশ-তেইশ বছরের যুবক, খালি গা, কালো। রঙের চকচকে শরীর, বাঁ হাতে একটা ব্যান্ডেজ। সে সেই আহত হাতটি উঁচু করে তুলে চেঁচিয়ে। বললো, আমাগো খাদ্য চাই না, আমাগো অস্ত্র দ্যান, আমরা ফিরা গিয়া দেশ স্বাধীন করবো!
ইন্দিরা গান্ধী তার চোখে চোখ রেখে বললেন, আগে খেয়ে নিন!
মামুন ফিসফিস করে প্রতাপকে বললেন, একটা ব্যাপারে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, ওনার কাছাকাছি কোনো সিকিউরিটির লোক নাই? এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি এরকম ভাবে লোকজনের ভিড়ে চলাফিরা করেন! পাকিস্তানে এটা চিন্তাই করা যায় না!
প্রতাপ বললেন, তোমাদের ওখানে আর্মি রুল, তারা সাধারণ মানুষের কাছে আসতে ভয় পায়। কিন্তু ডেমোক্রাসিতে সাধারণ মানুষকে ভয় পাবার তো কোনো কারণ নেই।
মামুন বললেন, ভদ্রমহিলা খুবই তেজস্বিনী, তবুও রিস্ক আছে। ধরো, এখানে কিছু পাকিস্তানী এজেন্টও তো ঢুকে পড়তে পারে? যদি কেউ একটা গুলি-টুলি ছোঁড়ে…পাকিস্তানীরা এখন ইন্ডিয়াতে একটা কমুনাল রায়ট বাধাবারও খুব চেষ্টা করবে, যদি তারা সাকসেসফুল হয়, তাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড়!
প্রতাপ কোনো মন্তব্য করলেন না।
মামুন প্রসঙ্গ বদলে প্রতাপকে একটু খোঁচা মারার জন্য বললেন, তুমি তো খুব গর্বের সুরে ইন্ডিয়ায় ডেমোক্রাসির কথা বললে। খাঁটি গণতন্ত্রই যদি হবে, তাইলে জওহরলাল নেহরুর মেয়ে প্রাইম মিনিস্টার হয় কী করে? দিল্লির মসনদে আবার একখান ডাইনাস্টি?
প্রতাপ বললেন, সেটা হয়েছে, তার কারণ, এ দেশে আর শক্ত মেরুদণ্ডওয়ালা কোনো পুরুষ নেই বোধহয়। অন্তত কংগ্রেসী নেতাদের মধ্যে নেই! মোরারজি একটু চেষ্টা করেছিলেন রুখে দাঁড়াবার, সাপোর্টার পেলেন না!
–ইন্দিরার সঙ্গে যে আর একজন মহিলা এলেন, উনি কে?
–উনি পদ্মজা নাইডু। এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের গভর্নর। সরোজিনী নাইডুকে মনে আছে তো, তাঁর মেয়ে।
–ও, সরোজিনী নাইড়, নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া! তাঁর মেয়ে! আর যে ভদ্রলোক ওনার সঙ্গে গল্প করছেন মাথা দুলায়ে দুলায়ে…
–শোনো, তোমাকে চিনিয়ে দিচ্ছি। অজয় মুখার্জিকে তো চিনতে পারছো, মাথায় পাকা চুল, এখন আমাদের চীফ মিনিস্টার, অবশ্য কতদিন থাকবেন তার ঠিক নেই। তার পাশে যে। হ্যান্ডসাম লোকটি, হেসে কথা বলছেন, উনি সিদ্ধার্থ রায়, সেন্ট্রালের শিক্ষামন্ত্রী। ইনি কে জানো তো? সি আর দাশ, মানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাতি।
–মতিলাল নেহরুর নাতনী আর সি আর দাশের নাতি?
–এককালের কংগ্রেসের সেই প্রো-চেইঞ্জার আর নো-চেইঞ্জারদের দলাদলির কথা মনে আছে? তখন মতিলাল আর চিত্তরঞ্জন হাতে হাত মিলিয়েছিলেন, এখন তাঁদের নাতি-নাতনীরা দেশ শাসন করছে।
–সুভাষবাবু-শরবাবুদের ফ্যামিলির কেউ লাইম লাইটে নাই?
কয়েকজনকে খিচুড়ি পরিবেশন করার পর ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সহচরদের অনুরোধে স্টেশন মাস্টারের ঘরে একটু বিশ্রাম করতে গিয়েছিলেন। মে মাসের অসহ্য গরম, আজ যেন রোদের আঁচ বেশী বেশী, তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে।
একটু পরেই খাদ্য পরিবেশন বন্ধ রইলো। ইন্দিরা গান্ধী আবার বেরিয়ে এলেন বক্তৃতা দিতে। মুহুর্মুহু শ্লোগান শুরু হলো আবার, রিপোর্টাররা নোট বই খুললো। মামুন-প্রতাপরাও কথা থামিয়ে উৎকর্ণ হলেন।
সদ্যস্থাপিত মাইক্রোফোনের সামনে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে বাংলায় বললেন, মা ও ভাই-বোনেরা! আপনারা আমাদের অতিথি, আমাদের বন্ধু! আমি বেশী কথা বাংলায় বলতে পারি না, সে জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আস্তে আস্তে হিন্দীতে বলছি!
তারপর তিনি বললেন, ভারত গরিব দেশ, তবু সে যথাসাধ্য অতিথিদের সেবা করবে। গত পঁচিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু এসেছে ৭০ লক্ষ, আবার পঁচিশে মার্চের পর মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই উদ্বাস্তু এসেছে প্রায় ২০ লক্ষ এবং প্রতিদিন আসছে। যারা অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে চায় তাদের একজনকেও ফেরানো হবে না। তবে সারা বিশ্বকে বুঝতে হবে, এই শরণার্থীদের খাওয়ানো-পানো ভারতের একার দায় নয়। এই উদ্বাস্তু সমস্যা একটা আন্তজাতিক সমস্যা! পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রগুলি এখনো চুপ করে আছে। কেন? …পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে আত্মমর্যাদার লড়াইতে নেমেছে, আশা করি তারা সার্থক হবে। অদূর ভবিষ্যতেই সকলে দেশে ফিরে যেতে পারবে…।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কোনো প্রসঙ্গই উঠলো না। বাংলাদেশ নামটাও তিনি একবারও উচ্চারণ করলেন না! তাঁর অন্যান্য আশ্বাসবাক্য ভরা বক্তৃতা শুনেও অনেকের মুখে নেমে এলো হতাশার ছায়া!
ইন্দিরা গান্ধী পেট্রাপোল স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেলেন ইটখোলা ক্যাম্পে। সেখানেও ঐ একই বক্তৃত। কয়েকজন চেঁচিয়ে সরাসরি বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি তুললেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।
সেখান থেকে তিনি এলেন বনগাঁ হাসপাতালে।
ছোট্ট, ঘুমন্ত শহর বনগাঁ যেন ভোজবাজিতে রাতারাতি বদলে গেছে। চতুর্দিকে শুধু মানুষ। আর মানুষ, অসংখ্য মানুষ। একদিকে যেমন উদ্বাস্তুদের স্রোত, তেমনই আবার কলকাতা থেকে আসছে নানান সেবা প্রতিষ্ঠানের লোক ও সরকারি কর্মচারীরা। এরই মধ্যে আবার দেখা যায়, অলিভ রঙের শার্ট পরা, মাথায় বড় বড় চুল তরুণ যুবকদের, তাদের কাঁধে ঝুলছে রাইফেল কিংবা কোমরে রিভলভার। হঠাৎ এক একটি দিকে সেইসব তরুণেরা গলা ফাটিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে চলে যায়। এই শহরে, গাড়ি ও ফেরিওয়ালার সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে।
হারীত, যোগানন্দ, নবা ও নেপুদের দলটি বনগাঁ হাসপাতালের কাছে এক ঝলক শুধু দেখতে পেল ইন্দিরা গান্ধীকে। একটা খোলা জিপে এসে তিনি হাসপাতালে আহত ও রোগার্তদের সান্ত্বনা দিতে চলে গেলেন। হারীতের খুব ইচ্ছে ছিল ইন্দিরা গান্ধীর সামনে গিয়ে দুটো কথা জিজ্ঞেস করার, কিন্তু এতই ভিড়ের চাপ যে সে কাছ ঘেঁষবার সুযোগই পেল না। সে হাত তুলে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো!
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কড়া পাহারা হরিদাসপুর থেকেই। পাকিস্তানী আর্মি নাকি সীমান্তের ওধারে এসে ঘাঁটি গেড়েছে, গত দু’দিন ওদিক থেকে কোনো উদ্বাস্তুও আসছে না, এদিক থেকে ওদিকে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। উদ্বাস্তুরা আসছে অন্যদিক থেকে, রাতের অন্ধকারে নদী পেরিয়ে।
কোনো উদ্বাস্তু শিবিরেও হারীতদের প্রবেশ অধিকার নেই। এবারের সব শরণার্থীদের আলাদা পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে এবং তাদের মধ্যে যাতে বাইরের কোনো লোক মিশে যেতে না পারে সেদিকেও নজর রাখা হয়েছে।
তবু বাজার এলাকায় কিছু কিছু যশোর-খুলনার মানুষদের সঙ্গে আলাপ হলো হারীতের। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ভেতরের খবর শুনলো। সকলের মুখেই প্রায় এক কথা। কোন অপরাধে এবং কিসের জন্য যে পাকিস্তানী আর্মি সাধারণ মানুষকে মারছে আর গ্রামে। আগুন লাগাচ্ছে, সেটাই তারা বুঝতে পারছে না! হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বেশী মারছে ঠিকই, কিন্তু মুসলমানদেরও তো রেয়াৎ করছে না? শেখ মুজিব ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন বলে এরা মেরে মেরে বাঙালীদের শেষ করে দেবে?
ফেরার পথে ট্রেনের কামরায় তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পেল হারীরা। একটা জানলার দু’ধারে তারা বসেছে, লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়েছে পা। মুখে অল্প অল্প দাড়ি, তাদের জুতোয় কাদা মাখা, প্যান্ট-শার্টও ঘেঁড়া-ময়লা, তবু দেখলে সচ্ছল ঘরের ছেলে মনে হয়। প্রকাশ্যে তারা কোনো অস্ত্র বহন করছে না, সিগারেট টানছে।
বিকেল হয়ে এসেছে, কামরায় বেশী ভিড় নেই। একজন টিকিট চেকার উঠে প্রথমেই অন্যদের পাশ কাটিয়ে তিনটি ছেলের কাছে এসে বললো, টিকিট!
ছেলে তিনটি কথা থামিয়ে চুপ করে গেল। ওদের মধ্যে যার বয়েস একটু বেশী, সে থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বললো, আমাদের কাছে টিকিট নাই।
চেকারটি বিদ্রূপের সুরে বললো, টিকিট নাই তো ট্রেনে উঠেছেন কেন? এটা কি বাড়ির বৈঠকখানা?
ছেলে তিনটি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। বড় ছেলেটিই আবার কৌতুকের সুরে বললো, বাড়ির বৈঠকখানায় বসি নাই অনেকদিন। আমরা ফ্রিডম ফাঁইটার। মুজিব নগরে যাবো, বডার থেকে বলে দিয়েছে যে পয়সা না থাকলে টিকিট না কাটলেও চলবে।
–ফ্রিডম ফাঁইটার? সঙ্গে কোনো আইডেনটিটি কার্ড আছে?
–দেখি কী আছে!
একটি ছেলে কাত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে প্রথমে বার করলো একটা সিগারেটের প্যাকেট, একটা দামী লাইটার, কয়েকটি বাংলাদেশী টাকা। একটা রিভলভার, কয়েকটা চিউয়িং গাম, গোটা পাঁচেক বুলেট…। ম্যাজিসিয়ানের ভঙ্গিতে সে একটার পর একটা জিনিস পাশে নামিয়ে রাখতে লাগলো। তারপর কৃত্রিম হতাশার সুরে বললো, নাঃ, আইডেনটিটি কার্ড তো কিছু নাই!
চেকারটি চোখ বড় বড় করে রিভলভার ও কার্তুজগুলো দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন, আপনাদের নাম কী?
লম্বা ছেলেটি বললো, এ হে হে, ফ্রিডম ফাঁইটারদের নাম জিজ্ঞাসা করতে নাই। ধরে ন্যান, আমাদের নাম রহিম, করিম আর রাম। নিবাস বাংলাদেশ!
চেকারটি এবার ওদের আরও কাছে এসে অত্যুৎসাহী মুখ করে বললো, জানেন আমাদের বাড়ি ছিল খুলনায়, বাগেরহাট। ওদিকের খবর কী? পাকিস্তানী আর্মিদের আপনারা হঠাতে পারবেন?
একটি ছেলে বললো, বাগেরহাট আমি চিনি।
আর একজন বললো, আপনাদের প্রাইম মিনিস্টার তো স্বাধীন বাংলাদেশকে এখনো রেকগনিশান দিচ্ছেন না। ঠিকঠাক আর্মস সাপ্লাই পেলে আমরা হানাদার বাহিনীকে দশদিনে সাবাড় করে দেবো।
–পারবেন? সত্যি পারবেন?
–ইন্ডিয়ার হেল্প না পেলেও আমরা পারবো। একটু বেশী সময় লাগবে, আরও কিছু মানুষ মরবে!
–আচ্ছা ভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমরা আমাদের বাড়িঘর দেখতে যেতে পারবো? তখন পাকিস্তানীদের মতন আপনারাও আমাদের মারতে আসবেন না তো?
–আপনাদের বাড়িঘর দেখতে যাবেন, নিশ্চয় যাবেন! তবে শুধু দেখতেই যাবেন, ফিরে আবার সব কিছু দাবি করলে মুশকিল হবে!
–না, না, থাকতে যাবো না, শুধু একবার দেখবো। আমাদের পুকুরের চারদিকে চারটে শিবমন্দির ছিল, এখনও সেসব আছে?
ট্রেন একটা স্টেশানে থেমেছে, কিছু যাত্রী ওঠা-নামা করলো এখানে, ওদের কথা আর শোনা গেল না। হারীত ভাবলো, চেকারটি চলে গেলে সে ঐ ছেলেটির সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু সেটাও সম্ভব হলো না। চেকারটি এবার চলে এলো তাদের দলটির কাছে। যেন সে এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারে, কাদের কাছে টিকিট নেই।
পশ্চিমবাংলায় সাধুর পোশাকের অত খাতির নেই। চেকারটি হারীতকে বললো, এই যে সাধুবাবা, টিকিট দেখি!
হারীত বললো, সার, আমরা রিফুজি। আমাগো পয়সা নাই!
চেকারটি বললো, রিফিউজি তো এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? ক্যাম্প ছেড়ে আপনাদের তো। বাইরে যাবার নিয়ম নেই। কলকাতায় গিয়ে ভিড় বাড়াতে কে বলেছে?
হারীত কোনো তর্ক করার সুযোগই পেল না। চেকারটি প্রায় ঘাড় ধরেই ওদের নামিয়ে দিল হাবড়া স্টেশানে। সত্যিই সে নবার ঘাড় ধরে ঠেলা দিয়েছিল।
ট্রেনটি চলে যাবার পর হারীত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বললো, যাঃ কয়লা! আমরা পুরানো রিফিউজি, তাই আমাগো কোনো খাতির নাই!
যোগানন্দ বললো, বড়কর্তা, এখন কী হবে? এ কোথায় নামাইলো?
নেপু বললো, কী আর হবে? আবার পরের ট্রেনটায় উইঠ্যা পড়বো। সব গাড়িতে চ্যাকার থাকে না।
হারীত বললো, জয় বাবা, কালাচাঁদ! ল্যাংটার নাই বাটপাড়ের ভয়! আমাগো আর কী হবে, যতবার নামাইবে, ততবার নামবো। আবার উইঠ্যা পড়বো! ঠিক কইছস, নেপু! আয় জিলাপি খাই! ট্রেনে টিকিট কাইট্টা পয়সা নষ্ট করোনের চাইয়া জিলাপি খাওয়া অনেক ভালো! কী কস, নবা?
আর বিশেষ কিছু ঝকমারি হলো না অবশ্য। পরের ট্রেন এলো শেষ বিকেলে, তাতে যাত্রী আরও কম। হারীত উঠে বসেই একটা গান ধরলো : “শ্মশান ভালোবাসিস বলে, শ্মশান করেছি হৃদি, শ্মশানবাসিনী শ্যামা নাচবি বলে নিরবধি…”
তেমন সুর নেই গলায়, কিন্তু জোর আছে। কয়েকজন ভক্ত জুটে গেল আশেপাশে। পর পর বেশ কয়েকটা গান গেয়ে গেল সে। এইরকম ভক্ত পরিবৃত অবস্থায় কোনো টিকিট চেকার কি তাকে নামিয়ে দিতে পারবে? আর এলোই না কেউ।
হারীতের দলটি নেমে পড়লো দমদম স্টেশানে। কাশীপুরের কলোনিতে পৌঁছোতে হলে এখান দিয়েই যেতে হবে, কিন্তু হারীত এখন যাবে পাতিপুকুরের আশ্রমে। যোগানন্দ আর নবাকে নেপুর সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে সে হাঁটতে শুরু করলো।
আজকের সীমান্তের অভিজ্ঞতা খুব আশাপ্রদ নয়। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এখনই ফিরে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, অদূর ভবিষ্যতেও কী হবে তা বলা যায় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কি ফেরা যাবে? সে তখন দেখা যাবে! এখন আর একটি কাজ করা যায়। পশ্চিমবাংলার রিফিউজি কলোনিগুলো ঘুরে ঘুরে একটা যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা অন্তত করা উচিত। যাদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়েছে, তাদের কথা কি এখানকার সকলে ভুলে গেছে? তারা মরলো কি বাঁচলো, সেই খবরও কেউ রাখবে না? এখানকার রিফিউজিদের মধ্যে শুরু কালাচাঁদের বাণী প্রচার করে তাদের বাঁধতে হবে এক সূত্রে।
সন্ধের পর হারীত এসে উপস্থিত হলো পাতিপুকুরের নারী কল্যাণ আশ্রমে। এখানে সবে আরতি শুরু হয়েছে, আশ্রমের বাইরে তিন চারখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভেতরে এসে হারীত দেখতে পেল দেবদেউলের সামনে উপবিষ্ট গেরুয়াবসনধারিণী চন্দ্রাকে। পিঠের ওপর খোলা চুল, চোখ দুটি ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন। যেন এখানে তার বিশেষ অধিকার আছে, এই ভঙ্গিতে হারীত চলে এলো একেবারে সামনে। ঘণ্টাধ্বনি ও নামগান অগ্রাহ্য করে সে বেশ জোরে বলে উঠলো, নমস্কার, দিদিমণি!
চন্দ্রা চোখ মেলে হারীতকে দেখলো, তার মুখে কোনো বিস্ময় বা চাঞ্চল্য ফুটলো না, সে মৃদু স্বরে বললো, হারীত এসেছো? বসো!
অর্থাৎ চন্দ্রা তার বাবার কাছ থেকে আগেই সব শুনেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই, তাই হারীত বসে পড়লো সিঁড়ির কাছে। ধুলোর ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বালা করে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে অন্য লোকগুলোর মুখ দেখার চেষ্টা করলো। সুচরিত কোথাও নেই।
আরতি শেষ হবার পর প্রসাদ বিতরণ হলো। এখানে কী শান্ত, ভাবগম্ভীর পরিবেশ! দুপুরবেলা হারীত সীমান্তে যে দৃশ্য দেখে এসেছে, লক্ষ অসহায় মুখ, ক্ষুধা, অসুখ, অনিশ্চয়তা, তার সঙ্গে এখানকার কোনো মিলই নেই। এরা যেন কেউ জানেই না, মাত্র পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে কী ঘটছে।
চন্দ্রা চলে গেল ভেতরে। হারীত ভাবলো, সেও চন্দ্রাকে অনুসরণ করবে কি না, কিন্তু কয়েকজন নারী ও পুরুষ বিনা পায়ের শব্দে ভেতর থেকে আসছে ও যাচ্ছে, তাদের ভঙ্গি দেখেই মনে হয় বিনা অনুমতিতে কেউ ভেতরে যায় না।
হারীত ঠিকই করে ফেললো, সে মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর চাচামেচি শুরু করবে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, এই আশ্রমের সবটাই ভণ্ডামি। ধনী ব্যক্তিদের ধর্ম বিলাসিতা।
একটু পরেই একজন বিধবা মহিলা এসে বললো, আসুন, আপনাকে চন্দ্রা-মা ডাকছেন!
তার সঙ্গে সঙ্গে হারীত একটা অফিস ঘর পেরিয়ে, উঠোনের পাশ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় চলে এলো। সেই ঘরের মেঝেতে একটি বাঘ-ছালের ওপর বসে আছে চন্দ্রা। ঘরের চারটি দেয়াল সাদা ধপধপে, কোনো আসবাব সেখানে নেই।
চন্দ্রার সামনে একটি পাথরের থালা ভর্তি ফল ও মিষ্টি। একটি শ্বেত পাথরের গেলাস ভর্তি জল। চন্দ্রা সুমিষ্ট স্বরে বললো, এসো, হারীত, বসো!
হারীত হাঁটু গেড়ে বসলো। তার নিজের অঙ্গেও সন্ন্যাসীর বেশ, সে অন্য কোনো সন্ন্যাসিনীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে না। সে হাত জোড় করে বললো, নমস্কার। ভালো আছেন। আপনি? আমি আমার ছেলেটার খবর নিতে আসছি!
চন্দ্রা বললো, হ্যাঁ, সব কথা হবে। আগে এগুলো খেয়ে নাও! হারীত একটুও দ্বিধা করলো না। ভালো খাবার পেলে সে অগ্রাহ্য করবে কেন? প্রথমেই এক চুমুকে জলটা শেষ করে বললো, আর একটু জল দিতে বলেন। তারপর সে একটা সন্দেশ মুখে ভরলো।
চন্দ্রা জিজ্ঞেস করলো তুমি কার কাছে দীক্ষা নিয়েছো, হারীত?
হারীত বললো, কাউর কাছে না। আমার পোশাকটাই শুধু রঙীন। আমি আপনেরে শেষ যখন দেখি, তখন আপনি অন্যরকম ছিলেন। আপনি কি শ্রীরামকৃষ্ণ-বেলুড় মঠের
চন্দ্রা বললেন, না, আমারও শুধু বসন রাঙানোই বলতে পারো।
–আপনি যোগিনী হইলেন কেন?
–সত্যি কি যোগিনী হয়েছি? ইচ্ছে করলেই কি হওয়া যায়?
–আমার ছেলেটা কি মরে গেছে?
–হারীত, তুমি যদি আমার নামে অভিযোগ জানাও, আমি মাথা পেতে নেবো। তোমার ছেলেকে আমি নিজের কাছে রেখেছিলাম, তাকে লেখাপড়া শেখাবো, দেশের কাজে লাগাবো, এই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি পারিনি। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। ভালো মাস্টার রেখে তাকে পড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু আকাশের চিলকে কি খাঁচায় পোষ মানানো যায়? সে থাকলো না।
–সে কিসে মরলো?
–কে বললো, সে মারা গেছে? সে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু সে কি সহজে হার স্বীকার করার ছেলে? সে উধাও হয়ে গেল বটে, কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে সে বেঁচে থাকবেই জানতাম। কিন্তু তার পরিণতি যে এই হবে–
–সে চোর-ছ্যাঁচ্চোড় হইছে?
–সবাই তাকে বলে গুণ্ডা। ল্যাঙা গুণ্ডা। সে নাকি কথায় কথায় ছুরি চালায়। এখন সে পলিটিক্যাল পার্টির হয়ে ভাড়া খাটে। তার একটা দল আছে।
থালাটা প্রায় চেটেপুটে শেষ করে হারীত দ্বিতীয় গেলাস জল খেল। তারপর পরিতৃপ্তির সঙ্গে বললো, আঃ! বড় ভালো লাগলো। ছেলেটা তাইলে মরে নাই? আপনের বাবার কথা শুনে মনে হইছিল… কোথায় গ্যালে তারে পাওয়া যাবে?
চন্দ্রা মুখ নীচু করে বললো, তা তো আমি জানি না। লোকে নানান কথা বলে। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। সে একা হঠাৎ এই আশ্রমে এসে হাজির হয়েছিল একদিন ভোরে। তখনও কেউ জাগেনি। আমি বাগানে ফুল তুলছি, হঠাৎ দেখি সামনে সুচরিত।
চন্দ্রা মুখ তুলে হারীতের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর খুবই দুঃখিত ভাবে বললো, আমার ওপর তার কেন যে এত রাগ তা জানি না। তাকে দেখে আমি খুব খুশী হয়েছিলাম, ফুলের সাজি ফেলে তাকে ধরে বলেছিলাম, সুচরিত, তুই? ওমা, এতদিন। কোথায় ছিলি? সে আমার কথার কোনো জবাব দিল না, খপ করে আমার হাত চেপে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল।
হারীত জিজ্ঞেস করলো, আপনাকে সে চিনেছিল? সে জানতো যে আপনি যোগিনী হয়েছেন?
–হয়তো সে জানতো না। কিন্তু আমাকে চিনবে না কেন? আমার কি কিছু বদল হয়েছে? সেই সকালবেলাতেই সুচরিতের চোখ টকটকে লাল, মুখে ভকভক করছে নেশার গন্ধ, বুঝলে হারীত, সে কোনো কারণে আমার ওপর খুব রেগে ছিল, আমাকে জোর করে টেনে আশ্রমের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, ভাগ্যিস সেইসময় আশ্রমের দারোয়ান দেখে ফেললো! কেন আমার ওপর তার এত রাগ থাকবে? তুমি কিছু বলতে পারো? সেদিনের কথা ভাবলেই আমার এত কষ্ট হয়। আর সে আসেনি।
হারীতের কোনো উত্তর দেওয়া হলো না। এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন অসমঞ্জ। হারীতের। দিকে না তাকিয়ে তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, চন্দ্রা, ডি সি নর্থ মিঃ চৌধুরী তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান, বলছেন খুব জরুরি!
চন্দ্রা ভ্রূকুটি করে বললো, পুলিশ? আশ্রমের মধ্যে পুলিশ আসবে কেন? না বলে দাও, দেখা হবে না!
অসমঞ্জ বললেন, তা হলে কি তুমি গেটের বাইরে যাবে?
–তার মানে?
–তোমার নামে ওয়ারেন্ট আছে। আমাকে দেখালেন।
–আমার নামে ওয়ারেন্ট? তুমি কী বলছো অসমঞ্জ? লোকটা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে!–আমি নিজে সেটা হাতে নিয়ে দেখেছি, চন্দ্রা।
–তা হলে তাকে ডাকো।
কয়েক মুহূর্ত বাদেই দু’জন পুলিশ অফিসার ঢুকলেন সেখানে। তাঁরা জুতো খুলে রাখলেন বাইরে। প্যান্ট পরা সত্ত্বেও তাঁরা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ভক্তি ভরে হাত জোড় করে প্রণাম করলেন চন্দ্রাকে। একজন চকিতে একবার দেখে নিলেন হারীতকে। অন্যজন নম্র গলায় বললেন, আমার নাম বিনায়ক চৌধুরী, আমি ডি সি নর্থ, আর ইনি এস বি ডিপার্টমেন্টের অমরেশ দাশগুপ্ত। আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে লজ্জিত। বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। আপনার কাছে।
মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ বলেই হারীতের মুখের বিবর্ণতা বোঝা যাচ্ছে না। বুক ঢিপঢিপ করছে। তার। পুলিশ দেখলেই তার হৃৎকম্প হয়। শেষ পর্যন্ত এখানেও পুলিশ।
নিজেকে খানিকটা সামলাবার চেষ্টা করে সে ঈষৎ কাঁপা গলায় বললো, আমি তা হলে উঠি, মা জননী?
অমরেশ দাশগুপ্ত মুখ ফিরিয়ে বললেন, না, আপনিও বসুন। আপনার সঙ্গেও কথা আছে। হারী বললো, আমি এনার সাথে শুধু দেখা করতে এসেছিলাম!
অমরেশ দাশগুপ্ত হেসে বললেন, জানি। আপনার নাম হারী মণ্ডল তো? সুচরিত মণ্ডল আপনার ছেলে?
চন্দ্রা বললো, আমি সুচরিতের কোনো খবর জানি না। সে অন্তত ছ’মাসের মধ্যে এখানে আসেনি!
বিনায়ক চৌধুরী বললেন, আমরা সুচরিতের খোঁজে এখানে আসিনি। অত সামান্য ব্যাপারে আপনাকে ডিসটার্ব করতাম না। আপনি বেশ ভালোই তো আশ্রম চালাচ্ছিলেন। এর মধ্যে আবার নকশালদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলেন কেন? আমরা ধর্মস্থানে এসে উৎপাত করতে একেবারেই চাই না, বিশ্বাস করুন। কিন্তু আপনার আশ্রমটা সার্চ করতে আমরা বাধ্য!
চন্দ্রা রেগে উঠে বললো, আমার আশ্রম সার্চ করবেন মানে? কী অধিকার আছে আপনাদের? কোর্ট থেকে অর্ডার এনেছেন?
বিনায়ক চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাধা দিলে আমাদের কাজটা আরও আনপ্লেজান্ট হবে। আমরা পাকা খবরটবর না নিয়ে তো আসিনি। আপনি বড় ভুল করে ফেলেছেন, চন্দ্রাদেবী।
তারপর তিনি পেছন ফিরে বললেন, অসমঞ্জবাবু, আমাদের বাকি লোকদের ডাকুন!