২১. দ্য হাউজ-এলফ লিবারেশন ফ্রন্ট
প্রথম টাস্কে ও ড্রাগনদের কাবু করতে পেরেছে, সেই খবরটা সিরিয়সকে চিঠি দিয়ে জানানোর জন্য, সেই দিন সন্ধ্যে বেলা হ্যারি, রন এবং হারমিওন আউলারিতে পিগওয়াইজিয়নের খোঁজে গেল। যাবার পথে কারকারফ সম্বন্ধে সিরিয়স ওকে যা যা বলেছিলেন তা ও রনকে বলল। কারকারফ সে এক ডেথইটার সে খবরটা এখন হ্যারিবললেও রনের গোড়া থেকে ওই রকম একটা সন্দেহ ছিল। ওরা আউলারিতে পৌঁছল। রন বলল–তোমারও সন্দেহ করা উচিত ছিল হ্যারি।
–তোমার কি মনে আছে হোগার্টে আসার সময় ট্রেনে ম্যালফয় কি বলেছিল? ম্যালফয় বলেছিল, কারকারফ ওর বাবার বন্ধু। ওরা মুখোস পড়ে ঘুরে বেড়ায়। ওয়ার্ল্ড কাপে ওরাই হয়তো মুখোশ পড়ে দৌড়াচ্ছিল। আমি তোমাকে একটা কথা বলছি হ্যারি… ওই কারকারফ তোমাকে বিপদে ফেলার জন্য গবলেটে তোমার নাম দিয়েছিল… এখন তাহলে নিজে কতটা যে মূর্খ ভাল করেই বুঝতে পারছে।… তাই না? তোমার কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি, শুধু তোমার কাঁধে সামান্য আঁচড় লেগেছে। দাঁড়াও, আমি চিঠি পাঠাচ্ছি।
পিগওয়াইজিয়ন চিঠি দিয়ে আসতে হবে জেনে দারুণ উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। হ্যারির মাথার ওপর ও ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে। বারবার ডাকতে থাকে। রন উড়ন্ত পিগওয়াইজিয়নকে খপ করে ধরে ফেলল; হ্যারি চিঠিটা ওর পায়ে বেঁধে দিল।
–আমার মনে হয় না অন্য কোনও টাস্ক প্রথম টাস্কের চেয়ে মারাত্মক হতে পারে। রন প্যাঁচাকে জানালার ধারে নিয়ে যেতে যেতে বলল–শোন আমি তোমাকে আগেই বলেদিচ্ছি–তুমি টুর্নামেন্টে জিতবেই জিতবে। আমার দৃঢ় ধারণা সিরিয়াসলি বলছি।
হ্যারি বুঝতে পারে হয়ত রন অপরাধ বোধ থেকে কথাগুলো বলছে, গত কয়েক সপ্তাহের ওর অদ্ভুত আচরণের কথা ভুলতে চায়। তাহলেও হ্যারির খুব ভাল লাগল। হারমিওন আউলারির দেওয়ালে হেলান দিয়ে দু হতে আড়াআড়ি করে বুকে রেখে ওদের কথা শুনতে লাগল।
হারমিওন ওদের কথার মাঝখানে বলল–হ্যারি টুর্নামেন্টের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ড্রাগন যদি প্রথম টাস্ক হয় তাহলে পরেরটা কত ভয়ংকর হবে ভেবে আমি আতঙ্কিত হচ্ছি। ভাবতেই পারছি না। এত বিশ্রী লাগছে।–তারপরও, একটু হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি–তাই না; রন বলল–তুমি প্রফেসর ট্রেলাওয়েনর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করে কথা বলবে।
ও পিগওয়াইজেয়নকে ভোলা জানালা থেকে আকাশে উড়িয়েদিল।… ওর পায়ে বাঁধা চিঠিটা শুধু আকারে লম্বা নয় ওজনেও ভারি। তাই ওর উড়তে বেশ বেগ পেতে হল। হ্যারি চিঠিতে সিরিয়সকে প্রতিটি ঘটনা জানিয়েছে। হটনেলের সঙ্গে আকাশে লড়াই থেকে সোনার ডিম সংগ্রহ পর্যন্ত।
একটু একটু করে পিগ অন্ধকার আকাশে অদৃশ্য হয়ে গেলে রন বলল–চল আমরা নিচে গিয়ে তোমার ইনারপ্রাইজ পার্টির অবস্থাটা দেখে আসি হ্যারি। ফ্রেড জর্জ মনে হয় কিচেন থেকে এবার খাবার–দাবার এনে রেখেছে।
সত্যি সত্যিই–ওরা যখন গ্রিফিন্ডরদের কমনরুমে গেল তখন ওদের গ্রুপের সব ছেলেমেয়ে প্রাণ খুলে হাসছে, নাচছে… হৈ হৈ রই রই করছে। হ্যারিকে দেখে আরও বেশি আননন্দে বে–সামলে হয়ে উঠল। টেবিলে পাহাড়প্রমাণ কেক, পামকিন জুস আর বাটার বিয়র বোতল। কোনও টেবিলে একটুও খাবার রাখার জায়গা নেই। লী–জোর্ডান নানা রকম ফায়ার ওয়ার্ক এনেছে–ফিলিস্টারের নোহিট আর ওয়েট স্টার্টের ফায়ার ওয়ার্কস। খাওয়া–দাওয়া শুরু হলে ঘর মুখরিত হবে ঘোট ঘোট তারা আর কূলিংগে। ডিন টমাস খুব ভাল ছবি আঁকে। নতুন নতুন চোখে পড়ার মতো ব্যানার তৈরি করে এনেছে… বেশিরভাগই আকাশে হ্যারির সঙ্গে হর্নটেলেদের লড়াই। সেডরিকও কিছু এঁকেছে। ও আগুনে মাথা গুঁজে রেখেছে।
হ্যারি এতদিন খাওয়া দাওয়ার কথা যেন ভুলে গিয়েছিল ভয় আর উত্তেজনায়। এখন তার সুস্বাদু খাবার দেখে প্রচন্ড ক্ষিধে, রন আর হারমিওনের সঙ্গে খেতে বসে গেল। রনকে পাশে বসিয়ে খেতে বসে যে কি আনন্দ তা কাকে বলবে! রনকে আবার ফিরে পেয়েছি, প্রথম টাস্ক ভালভাবে উতরে গেছে… দ্বিতীয় টাস্ক হতে অনেক দেরি আছে। এই তিনটের বেশী খুশি আর কি থাকতে পারে! তিন মাস তো কম সময় নয়। দ্বিতীয় টাস্ক তিন মাস পরে…।
হর্নটেলের সোনার ডিম হ্যারি টেবিলের ওপর রেখেছে। লী–জোড়ান ডিমটা তুলে বলল–হায় ঈশ্বর, দারুণ ভারি। হ্যারি তুমি এর মুখটা খোল। দেখা যাক এর ভেতরে কি আছে।
হারমিওন বলল–না–না খুলো না, ও নিজেই সমস্যার সমাধান বের করবে খেলার এটাই নিয়ম–কানুন।
–আমায় একাই খুঁজে বের করতে হবে ড্রাগনদের কাবু করার পদ্ধতি। ওর কথা হারমিওন ছাড়া কেউ শুনতে পেল না। হারমিওন বোকার মতো হাসল। লী হ্যারির দিকে ডিমটা এগিয়ে দিল। হ্যারির কানে এল সমবেত কণ্ঠস্বর–হ্যারি ডিমের মুখটা খোল।
হ্যারি নখ দিয়ে মুখটার চারপাশে দাগ কাটল। ভেতরটা শূন্য–কিছুই নেই মনে হল। কিন্তু যে মুহূর্তে হ্যারি মুখটা খুলল বিকট এক শব্দে ঘরটা পূর্ণ হয়ে গেল।… এত বিকট শব্দ অনেকেই কখনো শোনেনি। তবে হ্যারি একবার প্রায় মাথাবিহীন নিক-এর ডেথডে পার্টিতে ভূতদের বাদ্য শুনে সারারাত ঘুমোতে পারেনি, এমন তার বীভৎস সুর ও শব্দ। কিন্তু এই বিশ্রী শব্দ ওটাকে ছাড়িয়ে গেছে।
ফ্রেড কানে আঙ্গুল পুরে বলল–বন্ধ কর! বন্ধ কর মুখটা হ্যারি। হ্যারি বন্ধ করে দিল। সিমাস ফিনিগ্যান বলল–কিসের শব্দ! অনেকটা ব্যানশির মতো (পরীর বিলাপ কান্না–পরী পরিবারের কারও মৃত্যু হলে ওই রকমভাবে বীভৎস বিলাপ করে)
নেভিল বলল, মনে হয় কাউকে যেন নির্যাতন করা হচ্ছে… তার কান্না।
জর্জ বলল–নেভিল বোকার মতো কথা বলবে না। চ্যাম্পিয়নদের ওপর কখনই কেউ ক্রসিয়াটাস কার্স প্রয়োগ করবে না। শব্দ শুনে মনে হয়েছিল পার্সি ওর ঘরে বসে গান গাইছে। মনে হয় তুমি ওকে স্নানের সময় আক্রমণের কথা ভেবিছিলে।
সকলেই তারপর হৈ হৈ করে খাওয়া–দাওয়া শুরু করল। ফ্রেড বলল–জ্যাম টারট খেতে হবে। হারমিওন বলল, ফ্রেড মনে হচ্ছে, এই এলাহি খাবার–দাবার কিচেন থেকে এনেছো?… এলফরা মনে হল আমাদের জন্য জীবন দিতে পারে। সব সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছে।… যাকগে একটু মাংসের রোস্ট দাও।
হ্যারি যখন রন, নেভিল, সিমাস, ডিনের সঙ্গে ডরমেটরিতে শুতে গেল… তখন রাত একটা বেজে গেছে। ওর চারটে পোস্টার ঢাকা দেবার জন্য পর্দা টানার আগে হ্যারি পকেট থেকে হ্যাঙ্গরিয়ন হটেলের মডেলটা বের করে মাথার কাছে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়িয়ে পর্দাটা টেনে দিল। তারপর মনে হল হ্যাগ্রিড আগে–ভাগে ওকে বিকট ড্রাগনগুলো দেখিয়ে ভালই করেছিল।
***
ডিসেম্বরের শুরুতেই হোগার্টে বরফশীতল হাওয়া বইতে আর তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। অবশ্য বছরের সব সময় ক্যাসেলে দারুণ শীত!… হ্যারি যখনই ডারমস্ট্রাংগদের জাহাজের সামনে দিয়ে যায় জাহাজের কালো পতাকা ঠাণ্ডা হাওয়াতে পৎ পৎ করে উড়তে দেখলে ভাল লাগে। আরো ভাল লাগে জাহাজটি গরম রাখার ফলে তার একটু উষ্ণ হাওয়া যখন ও যেতে যেতে অনুভব করে। ও মনে মনে ভাবে বক্সবেটনের ক্যারাভ্যানের ভেতরটা হয়ত আরও বেশি ঠাণ্ডা। ও লক্ষ্য করল হ্যাগ্রিড মাদাম ম্যাক্সিমের ঘোড়াগুলোকে বেশ যত্নের সাথে রেখেছে। সময় মতো ভাল ভাল খেতে দেয়–ড্রিঙ্ক, সিদল মল্ট হুইস্কি। ভাল ভাল দানা।
হ্যাগ্রিড খোলামাঠে ওর ক্লাস নিচ্ছিল। দারুণ ঠাণ্ডা হাওয়াতে ছেলেমেয়েরা ঠক ঠক করে কাঁপছিল।
হ্যাগ্রিড বলল–আমি ঠিক বলতে পারি না উিটদের কেমন শীতকালে শীত লাগে। ওদের আজ মাঠে নিয়ে এসে দেখছি।
এখন মাত্র দশটা উিট এসে ঠেকেছে। ওরা সুযোগ পেলেই একে অপরকে খেয়ে ফেলে। এক একটা এখন প্রায় দু ফিট লম্বা। গায়ের ধূসর শক্ত চামড়া, দ্রুত ছুটে যাবার মতো শক্তিশালী পা, তীক্ষ্ণ দাঁত… ওই রকম বীভত্স প্রাণী হ্যারি জীবনে দেখেনি। বিরাট বিরাট বাক্সের ভেতর ওদের বন্দি করে নিয়ে এসেছে। তাতে রয়েছে বালিশ, আর নরম কম্বল।
–আমি এখন বাক্সের ঢাকনা খুলে দেব… তারপর দেখি ওরা কি করে।
কিন্তু স্ক্রিউটরা ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে বাক্সের মধ্যে লেপ–তোষক–বালিশে লুকিয়ে পড়লো না। বরং বাক্স থেকে বের হয়ে ওরা কুমড়ো–সজি বাগান ধ্বংস করতে শুরু করল। ওদের তাণ্ডব দেখে বলতে গেলে ছাত্র–ছাত্রীরা হ্যাগ্রিডের কেবিনে পালাল। তাদের মধ্যে ম্যালফয়, ক্র্যাব, গোয়েল তো আছেই। হ্যারি, রন, হারমিওন অবশ্য পালায়নি। ওরা হ্যাগ্রিডকে ক্রিউট ধরার জন্য সাহায্য করতে লাগল। নটা ক্রিউটকে ওরা অতিকষ্টে বাক্সে ভরতে পারলো। ওদের শরীরের নানা অংশ কেটে গেল–ওদের আক্রমণে। ল্যাজের আগুনে চামড়াও খানিকটা পুড়ে গেল। কিন্তু একটা তখনও বাইরে থেকে গেল।
বাকি জন্তুটাকে ঠাণ্ডা করার জন্য হ্যারি আর রনকে জাদুদণ্ড বের করতে দেখে হ্যাগ্রিড বাধা দিয়ে বেশ জোরে জোরে বলল–ওকে তোমরা কিন্তু ভয় পাইয়ে দিও না।… একটা দড়ি দিয়ে ওকে বাঁধার চেষ্টা কর… তবে সাবধানে, যেন আঘাত না পাও।
ওরা দেখল রিটা স্কীটার এ সময়ে হ্যাগ্রিডের বাগানের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। গায়ে ম্যাজেন্টা রং-এর আলখেল্লা… উঁচু কলার। হাতে কুমিড়ের চামড়ার ব্যাগ। হ্যাগ্রিড তখন ক্রিউটটাকে ধরতে ব্যস্ত। ল্যাজের শেষাংশ থেকে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে… ইতোমধ্যে ক্ষেতটা তছনছ হয়ে গেছে।
হ্যাগ্রিড দড়িতে একটা ফাস করে ক্রিউটের গলায় কোনও রকমে পরিয়েছে।
–আপনি? হ্যাগ্রিড রিটা স্কীটারকে দেখে জিজ্ঞেস করল।
–রিটা স্কীটার! ডেইলি প্ৰফেটের সংবাদদাতা, রিটা বলল, হাসার সময় ওর সামনের সোনা বাধান দাঁত দুটো চকচক করে উঠল।
–মনে রাখবেন, ডাম্বলডোর বলেছেন, আপনি কখনও স্কুল চত্বরে আসবেন। হ্যাগ্রিড বললেন। বলার পর ফ্রিউটাকে টানতে লাগলেন।
রিটা এমন এক ভাব করল যেন হ্যাগ্রিডের কথা শুনতে পায়নি।
-এ সুন্দর সুন্দর জীবগুলোর কী নাম? রিটা আরও বেশি করে হেসে বলল।
–ব্লাস্ট এন্ডেড স্ক্রিউট, হ্যাগ্রিড গম্ভীর হয়ে বললেন।
–সত্যি? রিটা বলল–যেন ওর কত আগ্রহ জানার!-এর আগে তো নাম শুনিনি। কোথায় এদের পাওয়া যায়?
হ্যারি লক্ষ্য করল হ্যাগ্রিডের কাল দাড়ির আড়ালে মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করছে হ্যাগ্রিড স্ক্রিউট কোথা থেকে পেয়েছেন?
হারমিওন একই সময়ে একই কথা ভাবছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলল–দারুণ লোভনীয়, তাই না? হ্যারি তুমি কি বল?
–কি বললে? ও হাঁ হাঁ দারুণ, হ্যারি বলল।
–আহ–হ্যারি তুমি এখানে? রিটা চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল–তো আপনি ম্যাজিক ক্রিয়েচার পুষতে ভালবাসেন? আপনি এ সম্বন্ধে ছাত্র–ছাত্রীদের পড়ান?
–হাঁ ঠিক ধরেছেন, হ্যারি জোর দিয়ে হ্যাগ্রিডের হয়ে বলল। হ্যাগ্রিড ওর দিকে তাকালেন।
–বাঃ বাঃ সুন্দর রিটা বলল–সত্য অতি সুন্দর… অনেকদিন থেকে পড়াচ্ছেন?
হ্যারি লক্ষ্য করল রিটা শুধু ডিনের (ওর গালে একটা বড় কাটা দাগ আছে), ল্যাভেন্ডর (ওর রোবে ছাপা) ও সিমাসের (ওর পোড়া–আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা) দিকে এবং পরে ও হ্যাগ্রিডের কেবিনটা আড় চোখে খুঁটিয়ে দেখছে।
–বছর দুই হল, হ্যাগ্রিড বললেন।
–সুন্দর… আপনি কী আপনার এই পড়াশুনা সম্বন্ধে আমাকে একটা সাক্ষাৎকার দিতে ইচ্ছুক?… আমাদের কাগজের পাঠকদের কিছু জানাতে চান? প্রতি বুধবারে প্রফেটে জুলজিক্যাল (প্রাণি বিদ্যা) সম্বন্ধে একটা কলাম ছাপে–আশা করি আপনি নিশ্চয়ই জানেন… আপনি চাইলে আপনার সম্বন্ধে কিছু লিখতে পারি।
–ব্লাস্ট এন্ডেড স্ক্রিউট সম্বন্ধে? অবশ্যই পারেন, হ্যাগ্রিড খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন।
হ্যারির রিটা আর হ্যাগ্রিডের কথাবার্তা একটুও পছন্দ হল না। কিন্তু রিটার সামনে কেমন করে বলবে সে কথা!… চুপ করে ওদের থ্রিমস্টিকে মোলাকাৎ করবার কথা শুনল।… রিটা সাক্ষাৎকার চায় এই সপ্তাহের শেষে। তারপর ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা বেজে উঠল ক্যাসেল থেকে।
-আচ্ছা অশেষ ধন্যবাদ, গুডবাই হ্যারি! রিটা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে হ্যারিকে বলল। হ্যারি, রন আর হারমিওনের সঙ্গে ক্যাসেলে চলল। তারপর রিটা বলল আচ্ছা আগামী শুক্রবার সন্ধ্যায় দেখা হবে মিঃ ত্যাহ্যাগ্রিড।
হ্যারি যেতে যেতে বলল–হ্যাগ্রিড ভুল করলেন ওর ফাঁদে পা দিয়ে। রিটা যা ইচ্ছে তাই লিখবে।
হারওমিন বলল–বেআইনিভাবে হ্যাগ্রিড যেন উিট না নিয়ে আসে। ওদের ধারণা হ্যাগ্রিড এই রকম একটা কিছু করতে পারেন।
–অতীতে হ্যাগ্রিড অনেক বে–আইনি কাজকর্ম করেছেন, তা সত্ত্বেও ডাম্বলডোর ওকে ছাড়িয়ে দেননি, রন বলল, সবচেয়ে ভাল হবে যদি হ্যাগ্রিড ক্রিউট সম্বন্ধে কিছু উৎসাহ না দেখান।
হ্যারি ও হারমিওন হো : হো : করে হেসে উঠল।
রন আবার হ্যারির ভালো বন্ধু হয়ে গেছে।
সেইদিন বিকেলে ওরা ভবিষ্যৎ কথনের ক্লাস খুব মজাসে উপভোগ করল। প্রফেসর ট্রেলা ওদের কাজকর্ম দেখে খুব খুশি। আরও খুশি হলেন ওরা যখন ওদের মৃত্যু কবে হবে তার ভবিষ্যৎ বাণী করল। সাধারণ মৃত্যু নয়, ভয়ার্ত মৃত্যু!… তারপরই ওদের পুটো (প্রাচীন গ্রীকদের পাতাল দেবতা সমরাজ) সম্বন্ধে চাপাহাসি শুনে রেগে গেলেন। (প্লটোর মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাত আছে)।
–আমি মনে করি, ট্রেলা রহস্যমূলকভাবে বললেন এবং বলার মধ্যে তার বিরক্তি প্রকাশ পেল আমাদের মধ্যে কেউ কেউ–হ্যারিকে গতরাতে আমি যা দেখেছি ক্রিস্টাল গেজিং দিয়ে সে–ও তা দেখে থাকতে পারে। আমি এখানে বসে কাজ করছিলাম… গোলাকার একটা কিছু আমাকে বলতে পার শক্তিহীন করেছিল। আমি চমকে উঠে, সেই গোলাকার বস্তুর সামনে চুপ করে বসলাম… আমি স্ফটিক তুল্য গভীরতম অংশ থেকে দেখলাম… বলত কী দেখলাম?
রন খুব আস্তে বলল–বিরাট এক কুৎসিৎ বাদুড়। তাছাড়া আর কি। হ্যারি ওর মুখটা নামিয়ে রাখতে খুব কষ্ট করতে হল।
–না, আমার প্রিয়জনের মৃত্যু।
পার্বতী আর ল্যাভেন্ডার ভয়ে দু হাতে মুখ ঢাকল।
–হ্যাঁ, দেখলাম, ট্রেলা মাথা নামিয়ে বললেন,–সেই মৃত্যুদূত একটা শকুনের মতো আমার মাথার ওপর উড়তে লাগল… কাছে… আরও কাছে… ক্যাসেলের ওপর, ট্রেলা হ্যারির দিকে তীক্ষ্ণ ডাকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যারি তখন বিরাট এক হাই তুলল।
হ্যারি বলল-এর আগে যদি আটবার না দেখতেন তা হলে তার দেখাটা যথার্থ হত। ওরা ট্রেলার ঘর থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচল।
–আমাকে যদি আটবার মরতে দেখেন, বা আমি শিঘই মরব… তাহলে তো মেডিকেল মিরাকল বলতে হয়!
রন বলল–তুমি তাহলে বন্দিশিবিরে রাখার উপযুক্ত? সেই সময় ব্লাড়ি বেরনকে অন্যধার দিয়ে যেতে দেখল। ওর বড় বড় ফালা ফালা চোখ বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে যেন সবকিছু দেখছে–আমরা অন্তত: এর হোমওয়ার্ক করিনি। অবশ্য হারমিওনের কথা আলাদা… ও খুশিতে প্রফেসর ভিক্টরের দেওয়া গাদাগাদা হোমওয়ার্ক করে। ও যখন কাজ করে, তখন আমি করতে না পারলে খুব ভাল লাগে।
হারমিওনকে ওরা ডিনার খেতে আসতে দেখল না। লাইব্রেরিতেও না। লাইব্রেরিতে শুধু একজন বসে আছে–ভিক্টর ক্রাম। রন ভাবল, দারুণ সুযোগ। একা আছে ওর অটোগ্রাফ নেওয়া যাক। ভাবাই সার… ওর কাছে যাবে ঠিক সেই সময়ে চার–পাঁচটা মেয়ে ওকে ঘিরে ধরল। আর ওর কাছে যাওয়া হল না রনের।
রন গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে যেতে যেতে হ্যারিকে বলল–হারমিওন কোথায় গেছে। বলতো।
ফ্যাট লেডির কাছে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা দেখল প্রায় দৌড়তে দৌড়তে হারমিওন আসছে।
ওরা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ফ্যাট লেডি ভুরু তুলে দেখতে লাগল। হ্যারি।… হ্যারি এখনই তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে… যেতেই হবে… দারুণ একটা ব্যাপার ঘটেছে… প্লিজ চল।… প্লিজ চল।
ও হ্যারির একটা হাত ধরে… করিডলর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চলল। হ্যারি বলল–কী হয়েছে?
তাড়াতাড়ি, ওখানে গেলেই দেখতে পাবে।
হ্যারি আর রন দৃষ্টি বিনিময় করল।
–চলো দেখে আসি। হ্যারি হারমিওনের সঙ্গে চলল।
ফ্যাট লেডি বলল–ওহে আমার জন্য তোমরা চিন্তা করো না। তোমরা ফিরে আসা পর্যন্ত আমি জেগে থাকব।
–ধন্যবাদ! রন পেছনে তাকিয়ে বলল।
হারমিওন ছতলায় উঠে সেখান মার্বলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এনট্রেন্স হলের কাছে নিয়ে যাবার পর হ্যারি বলল–হারমিওন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
-এক মিনিট, এক মিনিট পর স্বচক্ষে দেখবে, হারমিওন বলল।
সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে যেখান দিয়ে সেডরিক ডিগরি গেছে সেই দরজার দিকে ওরা গেল। ওই খান দিয়েই সেডরিক গবলেট অব ফায়ার-এ ওর আর হ্যারির নাম উগরে দেবার পর রাত্রি বেলা বেরিয়ে গিয়েছিল সেই দরজার গোড়ায় উপস্থিত হল। হ্যারি এই প্রথম ওই দিকে এল। হারমিওনের পিছু পিছু কয়েকটা পাথরের সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। জায়গাটা মাটির তলায় স্নেইপের বরফের মতো ঠাণ্ডা আর অন্ধকার করিডলর নয়। গমগম করছে উজ্জ্বল টর্চের আলোতে চওড়া একটা করিডলর। করিডলরের দু ধারের দেওয়াল নানা রকমের সুস্বাদু ফলের ছবিতে সাজান।
–কোথায় যাচ্ছে…, হ্যারি করিডলর দিয়ে যেতে যেতে বলল-এক মিনিট দাঁড়াও হারমিওন।
–কেন? হারমিওন পেছনে তাকাল… ওর মুখে কিছু একটা বুঝতে পেরেছে তার ছাপ।
হ্যারি বলল–আমি জানি তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।
ও রনের দিকে ঘাড় ফেরাল, হারমিওনের ঠিক পেছনে একটা জীবন্ত পেন্টিং এর দিকে আঙ্গুল দেখাল।… পেন্টিংটা ফলভর্তি বিরাট ফল রাখার পাত্র!
–হারমিওন তুমি আবার আমাদের তোমার SPEW চক্করে নিয়ে চলেছ, রন বলল।
হারমিওন বড় বড় করে বলল, না–না মোটেই না… SPEWর ব্যাপার নয়।… রন বাজে কথা বলার সময় নেই।
–নাম বদলে ফেলেছ, রন বলল–তাহলে নতুন নাম হাউজ-এলফ লিবারেশন ফ্রন্ট?… আমি কিন্তু কিচেনে গিয়ে ওদের স্ট্রাইক করতে বলতে পারবো না।
–আমি তোমাকে করতে বলছি না, হারমিওন অধৈর্য হয়ে বলল। আমি সবেমাত্র এখানে এসেছিলাম ওদের সঙ্গে কিছু আলোচনার জন্য… কিন্তু দেখলাম, হ্যারি চল চল তোমাকে দেখাতে চাই।
ও আবার হ্যারির হাত টানছিল। সেই বড় ফলপাত্রের ছবিটার কাছে নিয়ে গিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বিরাট একটা সবুজ নাশপতি স্পর্শ করল। ফলটা পোকার মতো.কুঁচকে গিয়ে মুচকে হেসে উঠল।… তারপর সেটা হঠাৎ একটা বড়সড় সবুজ হ্যান্ডেলওয়ালা দরজা বনে গেল। হারমিওন হ্যান্ডেলটা ধরে টান দিতেই দরজাটা খুলে গেল। তারপর হ্যারিকে এক রকম জোর করে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল।
হ্যারি বড় বড় চোখ করে দেখল গ্রেটহলের চেয়ে আরও এক বড় ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাথরের দেওয়ালে সারি সারি পেতলের পাত্র ও প্যান কুলানো–আলো পড়ে চকচক করছে। ঘরের এক কোণে বিরাট আকারের সবুজ একটা ফায়ার প্লেস… হঠাৎ ঘরের মাঝখান থেকে ছোট মতন একটা কিছু ওর দিকে সবেগে এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল–হ্যারি পটার, স্যার। হ্যারি পটার!
পর মুহূর্তে চিষ্কার করে ডাকা এলফটা প্রচণ্ডভাবে হ্যারিকে বুকে জাপটে ধরলো। হ্যারির সেই চাপে মনে হল ওর বুকে আর এক ফোঁটা হাওয়া নেই। ফানুস ফাটার মতো সব হাওয়া বেরিয়ে গেছে। কিছুতেই এলটা ওকে ছাড়ছে না-এত জোরে চেপে ধরেছে যেন বুকের হাড়–পাঁজর সব ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাবে।
হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–ড–ডব্বি।
এলফটা যেন ওর নাভি থেকে বলে উঠল,–আমি ডঝি স্যার!… ডব্বি কতদিন থেকে হ্যারি পটারকে দেখার আশায় বসে আছে, আজ হ্যারি পটার নিজেই ডব্বির কাছে এসেছে।
ডব্বি হ্যারি পটারকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করল। হ্যারি দেখল টেনিস বলের মতো বড় বড় দুই চোখ জলে ভরে গেছে। দুঃখের নয় আনন্দের অশ্রু।
আগে যেমন ডব্বি দেখতে ছিল ঠিক তেমনই আছে, একটুও পরিবর্তন হয়নি। সরু পেন্সিলের মতো নাক, বাদুরের মতো কান, লম্বা লম্বা হাত পায়ের আঙ্গুল… শুধু পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে।
যখন ডব্বি ম্যালফয় পরিবারে ছিল ও… একটাই বালিশের কভারের মতো পোশাক পরত। একটাই পোশাক। এখন, যাই হোক সেই অদ্ভুত পোশাক পরে নেই।
কিন্তু এখন যেগুলো পরে আছে সেগুলো চকরা–বকরা! উইজার্ড কাপের সময় যা পরে এসেছিল তার চেয়ে অদ্ভুত। হ্যাটের বদলে মাথায় দিয়েছে চা গরম রাখার টুপি। টুপিতে নানা রকমের ব্যাজ পিন দিয়ে আটকান। বুকে ঘোড়ার খুরের নালের মতো টাই। পরনে বাচ্চাদের ফুটবল খেলার মতো ছোট প্যান্ট, বেঢপ মোজা। মোজা দুটোর মধ্যে একপাটি মোজা হ্যারি রেগে গিয়ে ডব্বিকে দেবার জন্য ম্যালফয়কে ছুঁড়ে মেরেছিল। সেটা ওর মনে আছে।… বলেছিল, এটা নিয়ে ডব্বিকে মুক্তিদিন। অন্য পাটিটা গোলাপি আর কমলা রং-এর স্ট্রাইপ।
হ্যারি একটা আশ্চর্য হয়ে বলল–ডঝি তুমি এখানে কি করছো?
–ডব্বি হোগার্টে কাজ করতে এসেছে স্যার। ডাম্বলডোর, ডব্বি আর উইঙ্কীকে এনেছেন স্যার।
–উইঙ্কী? হ্যারি বলল–ও কি এখানে আছে?
–হ্যাঁ স্যার হ্যা! ডবি বলল। তারপর হ্যারির একটা হাত ধরে চারটে লম্বা লম্বা টেবিলের মাঝখান দিয়ে কিচেনের দিকে টেনে নিয়ে চলল। হ্যারি লক্ষ্য করল টেবিলগুলো ঠিক গ্রেটহলে যেমন টেবিল পেতে রাখা হয়েছে তারই অনুরূপ। টেবিলগুলো দেখে মনে হল ডিনারের শেষে ও গুলো সাফ করা হয়েছে… খুব সম্ভব এক ঘন্টা আগে। তারপর বাকি খাবার ওপর তলায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডব্বির সঙ্গে হ্যারি কিচেনে গিয়ে দেখল কম করে একশ এলফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডব্বির সঙ্গে হ্যারিকে দেখে ওরা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে হ্যারিকে স্বাগত জানাল। হ্যারি দেখল সকলেই একই ধরনের ইউনিফর্ম পরেছে। সকলের কাছে একটা ছোট তোয়ালে তাতে হোগার্টের লোগো ছাপা।
ডব্বি ইটের ফায়ার প্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল–উইঙ্কী স্যার।
আগুনের ধারে উইঙ্কী একটা টুলের ওপর বসেছিল। ডব্বি মতো ও অদ্ভুত পোশাক পরেনি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোট স্কার্ট ব্লাউজ… ম্যাচ করা নীল হ্যাট। টুপিটা ওর প্রকাণ্ড দু কানের গর্তে বাঁধা। দেখতে অদ্ভুত হলেও প্রত্যেকের পোশাক পরিষ্কার, কোথাও নোংরা নেই। মনে হয় সদ্য কিনে এনে পরেছে। উইঙ্কী অবশ্য ওর পোশাকের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্লাউজে সুপের ছাপ, স্কার্ট কয়েক স্থানে পুড়ে গেছে।
হ্যারি বলল–হ্যালো উইঙ্কী।
কথাটা শুনে উইঙ্কীর ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠল। তারপরই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর পিঙ্গল বর্ণের দু চোখ ফেটে গাল দিয়ে ঝর ঝর করে চোখে জল পড়তে লাগল। কিডিচ ওয়ার্ড কাপে উইঙ্কীকে হ্যারি ওই রকমভাবে কাঁদতে দেখেছিল।
হারমিওন বলল, কেঁদো না। এরপর উইকী, ডব্বি, হ্যারি, রন আর হারমিওন চলল কিচেনে। যেতে যেতে হারমিওন উইঙ্কীকে বলতে লাগল, কেঁদো না উইঙ্কী।… কাঁদে না। আমি বলছি।
কিন্তু উইঙ্কীর কান্না থামে না… আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। ডবি হ্যারি পটারের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।
–হ্যারি পটার কী এক কাপ চা খাবেন? ডব্বি উইঙ্কীর কান্না ছাপিয়ে অনুরোধ করল।
–হ্যাঁ, খেতে পারি, হ্যারি পটার বলল।
হ্যারি দেখল ওর কথা শেষ হতে না হতে দুজন হাউজ-এলফ বড় একটা রূপালি ট্রেতে টিপট, কাপ ইত্যাদি তাদের তিনজনের জন্য নিয়ে দাঁড়াল। তাছাড়া মিল্ক, জগ, বড় প্লেটে বিস্কুট।
রন বলল–দারুণ সার্ভিস তো! হারমিওন ওর দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু কথাটায় এলফরা মনে হয় খুব খুশি। অনেকটা মাথানত করে ওরা চলে গেল।
হ্যারি বলল–ডঝি তুমি এখানে কবে থেকে কাজ করছ? ডব্বি হ্যারির হাতে এক কাপ চা দিল।
-এক সপ্তাহ হল হ্যারি পটার স্যার। ডব্বি আনন্দে অধীর হয়ে বলল।
–ডব্বি এসেছিল প্রফেসর ডাম্বলডোরের সঙ্গে দেখা করতে।… আপনি তো জানেন স্যার একবার যদি কোনও হাউজ এলফের কোনও বাড়ি থেকে চাকরি যায় তার অন্য কোনখানে নতুন কাজ পেতে খুব অসুবিধে হয়।
আবার উইঙ্কী হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কান্না থামানোর কোনও প্রচেষ্টা কেউ করে না। টোম্যাটোর মতো নাকের ডগা কাদার সময় ফুলে ফুলে ওঠে।
–ডব্বি দু–দুটো বছর স্যার কাজের জন্য ছুটে বেরিয়েছে। কিন্তু ডবি স্যার পায়নি। কারণ ডব্বি বিনাবেতনে কাজ করতে চায় না স্যার! যেসব এলফরা কিচেনে কাজ করছিল তারা সবাই ঘুরে তাকাল। মুখে–চোখে ভয়ের ছাপ! ডব্বি বোধহয় শক্তকণ্ঠে বেফাঁস কথা বলেছে।
হারমিওন বলল–তোমাদের সকলের ভালর জন্যই তো তুমি এই দাবি করেছ।
–আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ মিস। ডব্বি দাঁত বের করে হেসে বলল–মিস সকলেই কাজ দিতে চায়, কিম পারিশ্রমিক দিতে চায় না।
জাদুকররা হাউজ এলফদের পারিশ্রমিক দেয় না। পারিশ্রমিক চাইলে ডবির মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেয় মিস! ডব্বি স্যার কাজ করতে ভালবাসে, কাজ করে পারিশ্রমিক নিয়ে ভালভাবে বাঁচতে চায়। ডব্বি ক্রীতদাস হতে চায় না স্বাধীন হতে চায়, মুক্তি পেতে চায়!
হোগার্টের এলফরা এখন ভয়ে ডবির কাছ থেকে দূরে চলে গেল।… যেন ও সারা শরীরে মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে ঘুরছে। উইকী যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে, কান্না থামায় না।
-এখন ডব্বি, উইঙ্কীর খোঁজ করতে যেয়ে দেখে, উইকীও মুক্ত। ডব্বি দারুণ উৎসাহের সঙ্গে বলল।
ডব্বির কথা শেষ হবার সাথে সাথে উইঙ্কী ঘরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে শুয়ে মুখ–মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদতে লাগল।
হারমিওন উইঙ্কীর পাশে বসে ওকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। কিন্তু একটি কথাও বলল না।
ডব্বি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,-এমন কোনও পরিবার নেই যেখানে আমাদের দুজনকে কাজ দিতে পারে? পরিবারে দুজনের মতো কাজ নেই।… এই সব ভেবে ডব্বি স্যার উইঙ্কীকে নিয়ে প্রফেসর ডাম্বলডোরের কাছে এসেছিল। তিনি স্যার আমাদের দুঃখের কথা শুনে এইখানে এক সঙ্গে কাজ দিয়েছেন।
ডব্বি সে খুব সুখে আছে তা জানাবার জন্য খুব ধীরে ধীরে কাঁদতে লাগল।
–প্রফেসর ডাম্বলডোর বলেছেন তিনি ডব্বিকে কাজের জন্য পারিশ্রমিক দেবেন। যদি ডব্বি চায়। তো ডব্বি এখন মুক্ত, ক্রীতদাস নয় স্যার। প্রতি সপ্তাহে ডঝি গেলিয়ন পারিশ্রমিক পায়।… মাসে একদিন ছুটি!
হারমিওন অসন্তোষের সুরে বলল–খুব একটা বেশি নয়! না মিস, ডাম্বলডোর ডব্বিকে দশ গেলিয়ন প্রতি সপ্তাহে দিতে চেয়েছিলেন এবং সাপ্তাহিক ছুটি। ডব্বি বলেই কাঁপতে লাগল। ওর মনে হল অত বেশি আরাম, অর্থ ওর মতো হতভাগ্যের প্রাপ্য নয়। কিন্তু মিস ডব্বি অর্থ চায় না–ডব্বি স্বাধীনতা চায়। স্বাধীনতা সঙ্গে কাজ করতে চায়।
হারমিওন উইঙ্কীর পিঠে হাত রেখে আদরমাখা সুরে বলল–উইঙ্কী ডাম্বলডোর তোমাকে কত দেন?
আগে তো উইঙ্কী এমন এক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভাবেনি তাই কোনও জবাব দিতে পারলো না। বড় বড় চোখে ফ্যালফ্যাল করে হারমিওনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ কান্নায় ভেজা… সামান্য চুপ থাকার পর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
উইঙ্কীর বদনাম আছে… কিন্তু উইঙ্কী এখনও কোনও পারিশ্রমিক চায় না উইঙ্কী এখনও এতটা অধ:পাতে যায়নি! মুক্তি পাওয়ার জন্য উইঙ্কী লজ্জিত
–লজ্জিত? হারমিওন অদ্ভুত এক কথা শুনল। কিন্তু উইঙ্কী, শোন, লজ্জিত যদি কাউকে হতে হয় সে হবে ক্রাউচ। তুমি নও। তুমি তো কোনও অন্যায় করনি। ক্রাউচ তোমার ওপর প্রচুর খারাপ ব্যবহার করেছিল। কথাটা শুনে উইঙ্কী ওর হ্যাটের গর্ত দুটো চেপে ধরল। এমনভাবে কান চেপে রইল যেন হারমিওনের কথা কানে না ঢোকে। তারপর সশব্দে বলল–তুমি আমার মাস্টারকে অপমান করছ! মিঃ ক্রাউচ অতি সজ্জন জাদুকর মিস! মিঃ ক্রাউচ খারাপ উইকীকে তাড়িয়ে ভাল কাজ করেছেন!
ডব্বি বলল, উইঙ্কী এখনও নিজেকে সামলে নিতে পারেনি হ্যারিপটার স্যার। উইঙ্কী সে ক্রাউচের ক্রীতদাসী আর নেই সে কথাটা এখনও ভুলতে পারেনি। ও তাই যা মনে আসে তাই বলে, কিন্তু কাজে অন্যরকম।
হ্যারি বলল–হাউজ এলফরা তাদের মাস্টার সম্বন্ধে কিছু বলতে পারে না?
–না স্যার না, ডব্বি বলল। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।–হাউজ এলফরা ক্রীতদাস প্রথার একটা অংশ, স্যার। আমরা মাস্টারদের গোপন কথা জেনেও চুপ করে থাকি স্যার। তাদের পরিবারের মর্যাদায় আঘাত দিই না, তাদের বিরুদ্ধে কোনও খারাপ কথা বলি না–যদিও প্রফেসর ডাম্বলডোর ডবিকে কোনও প্রশ্ন করেননি, কিছু জানতেও চাননি। ডাম্বলডোর শুধু বলেছেন, আমরা মুক্তি পেয়েছি… একেবারে মুক্তি পেয়েছি।
ডব্বি হঠাৎ খুব দুর্বল হয়ে যায়, ভীত হয়। হ্যারির খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। হ্যারি নিচু হয়ে ওকে ধরে।
ডব্বি ফিস ফিস করে বলল–তিনি বলেন, চাইলে আমরা তাকে অদ্ভুত এক বুদ্ধিহীন বুড়ো লোক বলতে পারি।
কথাটা বলে ডব্বি ভয় পেয়ে হাসতে থাকে।
–কিন্তু স্যার ডব্বি কখনই তা চাইবে না হ্যারি পটার স্যার।… তারপরই নিজেকে শামলে নেয়। ডব্বি প্রফেসর ডাম্বলডোরকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।… তার সব গোপন জিনিস ঠিকঠাক রাখতে গর্ব বোধ করে।
হ্যারি হেসে বলল, তা হলে তুমি ম্যালফয় সম্বন্ধে তোমার মন যা চায় বলতে পার। ডবির চোখ দুটো ভয়ার্ত হয়ে গেল।
–পারে, পারে ডব্বি পারে, ইতস্তত করে–ডব্বি হ্যারিপটারকে বলতে পারে… ওর পুরনো মাস্টার ডার্ক উইজার্ড (কাল জাদুকর)
কথাটা বলে ডব্বি কাঁপতে থাকে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়। নিজের সাহস দেখে নিজেই ভয় পায়। তারপরই একটা টেবিলের কাছে গিয়ে মাথা ঠুকতে ঠকতে বলে খারাপ ডঝি, খারাপ ডব্বি!
হ্যারি ওর টাই ধরে টান দিয়ে সোজা করে দাঁড় করায়… টেবিলের কাছ থেকে সরিয়ে আনে ডব্বিকে।
–ধন্যবাদ, ধন্যবাদ হ্যারিপটার ডব্বি বলল।… মাথাটা টিপতে থাকল।
হ্যারি হেসে বলল–তোমার একটু প্র্যাকটিস দরকার ডব্বি।
উইঙ্কী ওধার থেকে বলল,–প্র্যাকটিস? তোমার মাস্টারের বিরুদ্ধে বলার জন্য তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত।
–ওরা আমার আর মাস্টার নয় উইঙ্কী! ডব্বি দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।…
–ডব্বি ওরা কি বলল, না বলল তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, উইঙ্কী।
–ওহ তুমি খারাপ লোক ডব্বি।… বেচারি ক্রাউচের এখন উইঙ্কী ছাড়া কেমন করে চলছে। ওনার আমাকে দরকার… আমার সাহায্য চান। আমি সারাজীবন তার দেখাশুনা করেছি… তার আগে আমার মা, নানী। তারা যদি জানতে পারে উইঙ্কী ছেড়ে চলে এসেছে… উইকী আর ক্রীতদাসী নয়…ওহ লজ্জার কথা… লজ্জার কথা!… কথাটা বলে উইঙ্কী দু হাতে মুখ ঢাকল।
–উইঙ্কী, হারমিওন অনমিত না হয়ে বলল–আমার দৃঢ় বিশ্বাস মি. ক্রাউচ তোমাকে ছাড়া ভালই আছেন। আমরা তো সেদিন দেখেছি… তুমি জান?
–তুমি আমার মাস্টারকে দেখেছ? উইঙ্কী এক নিঃশ্বাসে বলল।
–হ্যাঁ দেখেছি। ক্রাউচ আর বেগম্যান দুজনেই ট্রি–উইজার্ড টুর্নামেন্টের বিচারক।
–বেগম্যানও এসেছিলেন? উইকী থতমত খেয়ে বলল। হ্যারি–আশ্চর্য হয়ে দেখল উইঙ্কী আবার রেগে গেছে।–মি. বেগম্যান খুব খারাপ জাদুকর। ভীষণ খারাপ জাদুকর। আমার মাস্টার ওকে একদম পছন্দ করে না।… ওহ… একদম না!
হ্যারি বলল–বেগম্যান খারাপ লোক?
–হাঁ, সত্যই, উইঙ্কী বলল। ভীষণভাবে মাথা নাড়ল। আমার মাস্টার উইঙ্কীকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু উইঙ্কী সেসব কথা কাউকে বলে না। উইঙ্কী তার মাস্টারের গোপনীয়তা রক্ষা করে।… ও আবার কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে আমার মাস্টার, আমার মাস্টার। উইঙ্কী এখন নেই, কে সাহায্য করবে।
উইঙ্কীর কোনও কথা বোধগম্য হলো না। ও শুধু কেঁদে যেতে লাগল। কিছু খেল না।
ওরা চা খেতে খেতে ডব্বির কথা শুনতে লাগল।
–ডব্বি এবার একটা জাম্পার কিনবে, হ্যারিপটার! ডব্বি খুশি মনে হ্যারিকে খোলা বুকটা দেখাল।
–আবার বল, কী বললে ডব্বি, রন বলল। আমি তোমাকে একটা জাম্পার দেব। মা বড়দিনের জন্য (ক্রিস্টমাস) আমার জন্যে কিনে দিয়েছেন। প্রতিবছর মা আমাকে একটা দেন। লাল রং হলে নিশ্চয়ই তোমার খারাপ লাগবে না।
কথা শুনে ডব্বি অসম্ভব খুশি।
–তোমার জন্য ওটা হয়ত ছোট করতে হতে পারে, রন ডব্বিকে বলল–তুমি যে পোশাকটা পরে আছ তার থেকে সোয়েটারটা ভালই হবে।
ওরা যখন ফেরার চিন্তা করছে তখন অনেক এলফ ওদের ঘিরে ধরল। সকলেই ওদের জন্য কিছু না কিছু দিতে চায়… চা স্ন্যাকস। হারমিওন খেতে চাইল না। ও ভারাক্রান্ত চোখে এলফদের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের আন্তরিকতা দেখে খুশি ও ওদের জন্য মায়া হল। হ্যারি, রন যত পারলো ওরা যা দিয়েছে পকেটে পুরলো।
ডব্বি বলল–হ্যারিপটার স্যার ডব্বি কি কখনও আপনার সাথে দেখা করতে পারে?
হ্যারি বলল–নিশ্চয়ই যখন তোমার ইচ্ছে হবে।
হারমিওন বলল–ওদের ভাগ্য এমনই। তাই তো ওদের কথা ভাবি।… তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল–ডব্বি এখানে কাজ করছে… ওকে দেখে বাকি সব এলফরা বুঝবে স্বাধীনতা কী। ওরাও পেতে চাইবে।
হ্যারি বলল–বেগম্যান সম্বন্ধে বেশি ভাবতে হবে না… সেই রকম কিছু মনে হয় না, মানে উইঙ্কী যা বলল।
হারমিওন বলল–খুব সম্ভব বলতে চায় উনি কোনো বড় ডিপার্টমেন্টের প্রধান নয়।
রন বলল–আমার মতে কাউচের চেয়ে ভাল… যাই হোক না কেন বেগম্যানের রসবোধ আছে।
হারমিওন হেসে বলল–দেখো তোমার কথা পার্সি যেন শুনতে না পায়।
যাদের রসবোধ আছে তাদের সঙ্গে পার্সি কখনো কাজ করবে না। রন বলল, চকোলেট এ–ক্লেয়ারের দিকে তাকিয়ে–পার্সি জোক বোঝে না এমনকি ডব্বির মত কেউ টি–কজি পড়ে নাচেও।