দেইর-এল-বাহরির গুপ্তধন
একটা মানুষকে এই ক-মাস ধরে চিনি, আমরা দু-জনেই অনেকটা সময় কাটিয়েছি তাঁরর সঙ্গে। শুনেছি দারুণ দারুণ গল্প। ইজিপ্ট নিয়ে আমাদের কৌতূহলটাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন ভবেশদা। কিন্তু এত বড়ো একটা কিছু উনি চেপে যাবেন? কেন? কী জন্য ওঁকে যেতে হল মিশরে?
প্রশ্ন আমাদের দু-জনের মধ্যেই জমা হচ্ছিল। কিন্তু উত্তর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। উত্তরগুলো ভবেশদাকেই দিতে হত। সেই সুযোগটাও এসে গেল।
ভবেশদা নিজেই ওঁর বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন করলেন। আমি একটু হেজিটেট করছিলাম, কিন্তু পিজি বলল,
‘লোকটা তো এখনও অবদি আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি। একটা রিস্ক নিয়েই দেখি না?’
ভবেশদার বাড়ি সোনারপুরে। আনন্দপল্লি নামের একটা পাড়ায়। শিয়ালদা থেকে প্রথমে ট্রেন, তারপরে স্টেশনে নেমে রিকশাতে মিনিট পনেরো লাগল। বাড়িটা একটা সরু গলির মধ্যে। খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হত যদি না ভবেশদা গলির মোড়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেন।
‘একটু দেখে ঢোকো। স্পন্দন আবার যা লম্বা, মাথা না ঠুকে যায় ওর।’
ভবেশদার বাড়ির ঢোকার দরজাটা সত্যি একটু বেশিই নীচু। একতলা বাড়ি, দেখলেই বোঝা যায় শেষ তিরিশ বছরে এর গায়ে কেউ হাত দেয়নি। দেওয়ালের নীল রংটা কালচে হয়ে এসেছে। জানলার গ্রিলগুলোও জং ধরা। বাড়ির ভেতরের অবস্থাও একই রকমের। ভবেশদা অকৃতদার। একা মানুষ থাকেন এই বাড়িতে। তাই জিনিসপত্র একটু অগোছালো। একটা ছোটো বসার ঘর, একটা ডাইনিং স্পেস, তার গায়ে লাগানো একটা শোয়ার ঘর আর কিচেন। বাথরুমটা বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড। বসার ঘরে পেতে রাখা সোফাটায় আমি আর পিজি বসলাম। বসতে বসতেই একটা জিনিস খেয়াল করে অবাক হলাম একটু। ঘরের মলিন দেওয়াল, অতি সাধারণ আসবাবপত্রের মধ্যে দেওয়ালের সঙ্গে সেট করা শোকেসটা একদম মিসফিট। তার দুটো তাকে থরে থরে বই সাজানো। কী বিষয় নেই সেখানে! মিশর তো আছেই, আরও আছে মিডিভাল সময়ের ইউরোপের ইতিহাস, অর্থনীতি, ফিলোজফি, ফাইন আর্টসের ওপরে লেখা একগাদা বই। তাদের মধ্যে আবার ইউভাল হারারির লেখা স্যাপিয়েনস বইটাও নজরে পড়ল। সত্যি লোকটা একটা বইপোকা বটে।
পিজি এই সময়েই কনুই দিয়ে আমাকে সামান্য নাড়া দিল। ওর দিকে তাকাতে চোখ দিয়ে ইশারা করল শোকেসের একদম নীচের তাকের দিকে। সেখানে রাখা আছে অনেকগুলো শোপিস। বেশির ভাগই মিশরীয়। আনুবিস, হোরাস, স্ফিংসের মূর্তি, স্কারাব বিটলের অ্যামুলেট, কাঠের তৈরি আঁখ আরও কত কী। মূর্তিগুলো যেভাবে চকচক করছিল, ইচ্ছা করছিল হাতে নিয়ে দেখতে। কিন্তু সে-লোভ সামলিয়ে চুপ করে বসলাম।
‘এই নাও আমপোড়ার শরবত। নিজেই বানালাম, খেয়ে বলো দেখি কেমন হয়েছে।’
পিজি এবারে গ্লাসটা হাতে নিয়ে সন্দেহের চোখে একঝলক দেখল সবুজ শরবতটার দিকে। তারপরে গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে ভবেশদাকে বলল,
‘হ্যাঁ, খাচ্ছি। তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দিন তো দেখি।’
আমাদের সোফার উলটোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে ভবেশদা বললেন,
‘জানি, জিজ্ঞাসা করবে এই সময়ে কাঁচা আম কোথা থেকে পেলাম, তাই তো? আরে বাজারে এখন পাকা আম চলে এলেও আজকে একটা দোকানদারের কাছে…’
‘না, সেটা নয়।’
‘তাহলে কী?’
‘আমার হাতে-থাকা গ্লাসটার ওপরে চাপটা একটু বাড়ল। পিজি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
‘আপনি ইজিপ্টে কী করতে গিয়েছিলেন?’
কথাটা শুনেই ভবেশদা যেন চমকে গেলেন একটু। তারপরে সামান্য হেসে বললেন, ‘বুঝেছি, আগের দিন আমার ব্যাগটা চেক করেছিলে মনে হয়।’
‘হুঁ, সরি খুব ভুল করেছিলাম, কিন্তু আপনিও তো এত বড়ো একটা কিছু আমাদের থেকে বেমালুম লুকিয়ে গেছিলেন।’
‘আমি ইজিপ্টে গিয়েছিলাম এটা যখন জেনেই গেছ তখন আরেকটা কথাও বলি তোমাদেরকে। কয়েক মাস আগে ধর্মতলার এসবিআই-এর এনআরআই ব্রাঞ্চে গেছিলাম তোমাদের সঙ্গে, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে তো।’
‘সেদিন আমার কোনো ভাইয়ের কাজ করতে ওখানে যাইনি। আমার সেরকম কোনো ভাইই নেই। গিয়েছিলাম নিজের কাজে। একটা ফরেন ট্রানজাকশনের দরকার ছিল।’
পিজি এবারে টক করে একবার আমার দিকে তাকাল। মুখে কিছু না বললেও চোখ দুটো তখন বলছে, দেখেছিস তো, সেদিনও আমার সন্দেহটা ঠিক ছিল!
আমরা দু-জনেই যখন হতবাক হয়ে বসে আছি তখন ভবেশদা আমাদের দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন,
‘আমি জানি, তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে। উত্তর দিতে পারি। কিন্তু একটা কথা বলো তার আগে, তোমাদের ওপরে কি আমি আস্থা রাখতে পারি? যা বলব তা প্লিজ নিজেদের কাছেই রেখে দিতে পারবে?’
ভবেশ সামন্ত কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বিএ করে ১৯৮৯তে আর্কিয়োলজিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপরে বছর তিনেক আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে কাজ করে পাড়ি জমান ইজিপ্টে। সেখানে ছিলেন টানা পনেরো বছর। ২০০৭ সালে পাকাপাকিভাবে ফিরে আসেন দেশে।
‘কিন্তু, দেশে ফিরে কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের গুমটি দিলেন? এটা তো মিলল না।’
ভবেশদা এবারে স্বরটা আরও একটু নীচু করে বললেন,
‘এত কিছু যখন বললামই তখন আরও একটা কথা বলি তোমাদের। মিশরে থাকাকালীন আমি যা রোজগার করেছি তাতে আমার এ জীবনে আর অর্থের অভাব হবে না। কিন্তু সেই টাকার প্রতিফলন যদি আমি রোজকার জীবনে দেখাতাম তাহলে আমার প্রাণ সংশয় হত। কলকাতায় ফিরে এসে নিজেকে একটা লো প্রোফাইলে রাখতেই হত। তাই কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের দোকানটা নেওয়া। রোজ ঘণ্টা ছয়েক ওখানে কাটিয়ে চলে আসি।
‘কিন্তু, আপনাকে কে মারতে চাইবে?!’
‘তেমন লোকদের অভাব নেই এই দেশে, স্পন্দন ভাই। এই শহরেও এমন অনেকে আছে। যেসব আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে আমার কাজ ছিল তাদের এক একটার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। দেশে ফেরার পরেও সেই কাজ চলছে। তবে ইললিগালি আমি কিছু করি না এটুকু তোমাদের বলতে পারি। এদেশের অনেক প্রাইভেট কালেক্টর চেনেন আমাকে। তাঁররাই আসেন কোনো আর্টিফ্যাক্ট জেনুইন না ফেক সেটা যাচাই করাবার জন্য। ওই বইয়ের দোকানের আড়ালে এটাই আমার পেশা বলতে পারো। আজকেও এমন একজনের আসার কথা আছে। বিকেলের দিকে আসবে সে।’
‘তাহলে হঠাৎ ইজিপ্ট গেলেন কেন? এমনটা কি প্রায়ই যান নাকি?’
‘না ভাই, এগারো বছর আগে ফিরে আসার পরে ভাবিনি আবার কখনো যেতে হবে। কিন্তু হল তাও।’
‘কেন?’
‘সেটা আমি এখনই তোমাদেরকে বলতে পারব না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি আমার থেকে তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমার তিন কুলে কেউ জীবিত নেই। বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যাও শূন্য। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে কখন। সেখান থেকেই হয়তো বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। আজকে সেই বিশ্বাসের বশেই এতগুলো কথা বললাম তোমাদের।’
এই কথাগুলো বলতে বলতেই ভবেশদা আবেগের বশে আমাদের দু-জনের হাত ধরে ফেলেছিলেন। যে লোকটা জ্ঞানের পাহাড়, পেটুক, হেঁয়ালি করাতে মাস্টার তাকে এরকমভাবে কখনো দেখব বলে ভাবিনি। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হয়নি মিথ্যে বলছে বলে। আর আমি আর পিজি দু-জনেই যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক। এই ভবেশদার সিক্রেটটা নিজেদের কাছে রেখে দিতেই পারব। ঘরের বাতাসটা একটু ভারী হয়েছিল। পিজি মনে হয় সেটাকে হালকা করার জন্যই এবারে বলে উঠল,
‘উফফ, অনেক রাজ কি বাত জানা হল আপনার। করিতকর্মা লোক মশাই আপনি। তা, আজকে বাড়িতে ডেকে এনে শুধু এই আমপোড়ার শরবতই খাওয়াবেন, নাকি লাঞ্চে আরও কিছু আছে?’
মুরগির মাংসর ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে আমি ভবেশদাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আচ্ছা, আপনিও মিশরে অত বছর ছিলেন! চোরাকারবার নিশ্চয়ই ভালোই চলে ওখানে।’
‘তা আর চলবে না! সরকার যতই নিয়ম কড়া করুক না কেন। তার ফাঁক গলে এখনও প্রতিদিন কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে কোনো-না-কোনো প্লেন পেটের মধ্যে হাজার বছরের পুরোনো আর্টিফ্যাক্ট নিয়ে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্য দেশে। আবার কখনো কখনো এই চোরাকারবারিদের জন্যেই আর্কিয়োলজিস্টরা দারুণ দারুণ জিনিস আবিষ্কারও করেছেন।’
‘সেটা কীরকম?’
‘দেইর এল বাহরির গুপ্তধনের কথা শোননি?’
‘না তো!’
ব্যস, লাঞ্চের টেবিলে উঠে এল এক টুকরো মিশর।
‘১৮৭১ সালের কথা, লাক্সর শহরের পশ্চিমদিকে দেইর এল বাহরি নামের একটা জায়গা। ছোটো ছোটো চুনাপাথরের পাহাড়ে ভরতি। সেখানে দুটো ভেঙে-পড়া খ্রিস্টান মনাস্ট্রি ছাড়াও ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন মিশরীয়দের কবর। এর পাশেই ছিল একটা গ্রাম, নাম কুর্না। জনসমক্ষে কুর্নার বাসিন্দাদের পেশা ছিল চাষবাস আর মেষপালন। কিন্তু তার তলায় তলায় ছিল আরেকটা লুকোনো কারবার। সেটা হল ইজিপশিয়ান আর্টিফ্যাক্ট বিক্রি করা। রাতের অন্ধকারে কবর খুঁড়ে টুকটাক মূর্তি, অ্যামুলেট, পুরোনো প্যাপিরাস ইত্যাদি যা কিছু পাওয়া যেত তা-ই ওরা বিক্রি করত। ক্রেতা ছিল মূলত টুরিস্টরা, আর কিছু দালাল, যারা আবার সেইগুলোকে বিক্রি করত ইউরোপে আর আমেরিকায়।
দেইর এল বাহরি পাহাড় ও প্রাচীন মিশরীয় সমাধির গুপ্ত সুড়ঙ্গ
‘আহমেদ মোহামেদ আবদুল রসুল থাকত ওই গ্রামেতেই। একদিন ভোরবেলায় আহমেদ ভেড়া চরাতে বেরিয়েছিল। ফেরার সময় খেয়াল করল একটা ভেড়া কম। বেটা নির্ঘাত পাহাড়ের ওপরে উঠে বসে আছে। এরকম মাঝেমধ্যেই হয়। আহমেদ ভেড়াটার ডাক শুনে শুনে একটা ছোটো টিলার ওপরে উঠল, আগে কখনো আসেনি এখানে। টিলাতে পৌঁছেই আহমেদ একটা গুহা দেখতে পেল। হারিয়ে-যাওয়া ভেড়াটার ডাক আসছে ওখান থেকেই। বেটা ওখানেই ঢুকে বসে আছে।
‘আহমেদ গুহাতে ঢুকে ভেড়াটা নিয়ে বেরিয়ে আসতে যাবে এমন সময় ওর নজর পড়ল গুহার একটা কোণে। একটা গর্তমতো দেখা যাচ্ছে না? কাছে গিয়ে বোঝা গেল যে সেটা শুধু একটা গর্তই না। একটা সুড়ঙ্গের মুখ! বুকে ভয় নিয়েই আহমেদ ঢুকে পড়ল সেই সুড়ঙ্গে। কিন্তু একটু এগোতেই পথ শেষ হয়ে গেল।’
‘যাহ! ব্লাইন্ড এন্ড?’
‘সেরকমই ভেবেছিল আহমেদও। কিন্তু সুড়ঙ্গ যেখানে শেষ হল সেখানকার পাথর দেখে আহমেদের সন্দেহ হল। যেন কিছু একটাকে বালি আর ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো দিয়ে ঢাকা আছে। এর আগে ছোটোখাটো কবর খুঁড়ে চোরাকারবারিতে হাত পাকানোই ছিল ওর। তাই এবারেও ওর মনে হল এই বালি পাথরের পিছনে একটা লুকোনো সমাধি থাকতে পারে।
সুড়ঙ্গের মুখে আহমেদ রসুল
বর্তমান সময়ে দেইর এল বাহরি সমাধির সুড়ঙ্গের বাইরে ও ভেতরে
‘বাড়ি ফিরে আহমেদ ওর দুই ভাইকে এই কথা বলল, সেদিনই রাতের অন্ধকারে তিনজনে মিলে বেলচা হাতে চলল সেই টিলার দিকে। পাথর সরাবার পরে ওরা একটা ছোটো ঘর দেখতে পেল। সেই ঘর ফাঁকা হলেও তার উলটোদিকের দেওয়ালে একটা দরজা ছিল। সেই দরজা খুলতেই মিলল একটা লম্বা করিডোর। করিডোরের শেষে আরেকটা ঘর। এবারে এই ঘরে ঢুকেই তিনজনের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল।
‘ঘরের মধ্যে ঠেসে রাখা আছে চল্লিশটা মমি!!’
‘একটা কবরে চল্লিশটা মমি! বলেন কী! এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়।’
‘হওয়ার কথা নয়ই তো। কিন্তু অনেকটা বাধ্য হয়েই এদেরকে একসঙ্গে রাখা হয়েছিল। কোথা থেকে এল বলো তো এরা?’
‘কোথা থেকে?’
‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস। এই সবকটা মমি কোনো-না-কোনো ফারাও বা তাদের আত্মীয়র ছিল। আগেই বলেছিলাম তো তোমাদের, ভ্যালি অফ দ্য কিংসে অতগুলো সমাধি থাকলেও সবকটাই পাওয়া যায় ফাঁকা অবস্থায়। শুধু তুতানখামেনের মমিই ওর সমাধিতে মেলে। আর দ্বিতীয় আমেনহোতেপের সমাধিতে পাওয়া যায় গোটা চারেক মমি। বাকি কবরের মমিগুলোর জায়গা ছিল এই দেইর এল বাহরির লুকোনো টুম্ব।’
‘কিন্তু এখানে এদেরকে আনল কে?’
‘সে আরেক গল্প, বুঝলে। ফারাও নবম রামেসিসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মিশরের বিশতম ডাইনেস্টি শেষ হয়। গোটা দেশ জুড়ে তখন অরাজকতা চলছে। ডাকাতেরা ততদিনে ভ্যালি অফ দ্য কিংসের খোঁজ পেয়ে গেছে। লুঠ চলছে অবাধে। এরই মধ্যে ইজিপ্টের উত্তর আর দক্ষিণে দু-জন আলাদা রাজা তৈরি হয়। উত্তরের ফারাওয়ের নাম ছিল নেসবানেবজেদ, দক্ষিণে কার্নাকের মন্দিরে প্রধান পুরোহিতই নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা করে বসেন। তাঁরর নাম ছিল পিয়াখঁ। এঁর ছেলে পিনেদজেম যখন ফারাও হলেন তখনই তৎপর হলেন ভ্যালি অফ দ্য কিংসের ফারাওদের মমিগুলোকে বাঁচানোর জন্য। ওঁর নির্দেশেই সব ফারাওদের ওখান থেকে তুলে এনে জড়ো করা হয় ইনহেপ নামের এক রানির সমাধিতে। আর সেই সমাধিটাই খুঁজে পায় এই আহমেদ রসুল।’
‘তাহলে রসুল তো রাতারাতি বড়োলোক হয়ে গেল!’
‘তা আর বলতে! দেইর এল বাহরির সেই সমাধির ঘরে মমি ছাড়াও ছিল প্রচুর প্যাপিরাস আর পাথরের মূর্তি। তিন ভাই বুঝতেই পেরেছিল যে ওদের হাতে কী লটারি লেগেছে। কিন্তু অতগুলো আর্টিফ্যাক্ট একসঙ্গে বিক্রি করতে গেলেই লোকের চোখে লাগবে, তাই তাদের মধ্যে কয়েকটাকেই তুলে আনল। সমাধির মুখটা আবার পাথর দিয়ে বুজিয়ে সেই সুড়ঙ্গের মুখে একটা গাধাকে মেরে ফেলে রাখল, যাতে গন্ধের চোটে কেউ আর ওই জায়গার ধারেকাছে না ঘেঁষে।’
‘বাপ রে! হেবি চালাক ছিল তো!’
‘চালাক তো বটেই, তার সঙ্গে সাবধানিও। তিন ভাই মিলে শপথ নেয় যে এই গুপ্তধনের কথা আর কাউকে বলবে না। মিশরের অ্যান্টিকুইটি ডিপার্টমেন্ট তখন খুব কড়া। দেশ জুড়ে প্রচণ্ড ধরপাকড় চলছে, চোরাকারবারি দেখলেই সোজা জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে তাদের। তাই রসুল ভাইরাও খুব ভেবেচিন্তে ক্লায়েন্ট সিলেক্ট করত। কাউকে দুম করে আর্টিফ্যাক্ট দেখাতও না। তবে বিক্রি করত বেশ চড়া দামে। সত্যি কথা বলতে কী, অত কড়াকড়ির মাঝেও খদ্দেরের তো অভাব ছিল না, তাই বছর দশেকের মধ্যেই রসুল ভায়েরা বড়োলোক হয়ে ওঠে। এত বছরে ওরা কিন্তু ওই সমাধি গিয়েছিল মাত্র তিনবার। তাও শেষ রক্ষা হল না।’
‘ধরা পড়ে গেল?!’
‘হুম, সেইসময় মিশরে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যান্টিকুইটির হেড গ্যান্সটন ম্যাসপেরো লাক্সরের চারপাশে লুকিয়ে চলা অ্যান্টিকের কেনাবেচার কারবারিদের ধরার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এতে ওঁকে সাহায্য করছিল ওঁর এক আমেরিকান ছাত্র, তার নাম চার্লস উইলবার। চার্লসের মুখের মধ্যে একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল। সেইটাকে কাজে লাগিয়ে চার্লস একজন আমেরিকান ধনকুবেরের ছদ্মবেশে লাক্সর হোটেলে গিয়ে উঠল। ভালো খদ্দের এসেছে, এই খবরটা আবদুল রসুলের কাছে পৌঁছোতে দেরি হয়নি। রসুল নিজে থেকেই চার্লসের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওকে নিয়ে এল কুৰ্না গ্রামে নিজের বাড়িতে। হতদরিদ্র গ্রামের মধ্যে রসুল ভাইদের বিশাল বাড়ি দেখেই চার্লসের সন্দেহ হয়েছিল। তাই ওকে রসুল যখন একটা বেশ বড়ো প্যাপিরাস দেখিয়ে সাড়ে তিনশো পাউন্ড দাম চাইল তখন চার্লস বলল, ছোঃ, আমাকে আরও দামি কিছু দেখান। রসুল ভাইরা কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে বলে দিল তাদের কাছে এর চেয়ে দামি আর কিছু নেই।
‘চার্লসও ছাড়ার পাত্র নয়। এবারে বেশ বড়ো একটা অ্যামাউন্টের অর্থের লোভ দেখাল ওদের। সেই লোভে পড়েই তখন ওরা বের করে নিয়ে এল বেশ কয়েকটা স্ক্রোল। চামড়া আর কাপড়ের তৈরি। যেগুলোতে সেই বুক অফ দ্য ডেড-এর মন্ত্র লেখা থাকত। স্ক্রোল দেখেই চার্লস বুঝেছিল এটা কোনো ফারাওয়ের কবর থেকেই আসছে। সেই স্ক্রোলে একটা কার্তুজও আঁকা ছিল, কিন্তু সেটার পাঠোদ্ধার করতে না পেরে সেটাকে ও পাঠাল কায়রোতে ম্যাসপেরোর কাছে। কয়েকদিনের মধ্যেই একটা টেলিগ্রাম এল, কার্তুজে লেখা আছে ফারাও পিনেদজেম-এর নাম!! যাঁর নির্দেশে ভ্যালি অফ দ্য কিংস খালি করে মমিদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাহলে সেই গুপ্তধন এখানেই কোথাও একটা আছে!!
‘চার্লস এবারে নিজের আসল পরিচয়টা বলতেই রসুল ভাইরা ভয় পেয়ে গেল। ও ওদের এই বলে ভয় দেখাল যে ফারাওয়ের কবরে ওকে নিয়ে যেতেই হবে নাহলে ও পুলিশে খবর দেবে চার্লস উইলবারের এই হুমকির চোটে অবশেষে রসুল ভাইরা ওকে সেই সমাধিতে নিয়ে যেতে রািজ হল।
‘পাহাড়ের আড়ালে সমাধির ভিতরে চার্লস ঢুকল রসুল ভাইদের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে ছিল মাত্র একটা মমি।’
‘কিন্তু, আপনি যে বলেছিলেন চল্লিশটা মমি ছিল!’
‘চল্লিশটাই ছিল, কিন্তু রসুলরা তো প্রচণ্ড চালাক, তাই ওরা রাতের অন্ধকারে সেই সমাধি থেকে একটা মমিকে তুলে এনে অন্য একটা ছোটো সমাধিতে রেখে দেয়। তার আশেপাশে কয়েকটা প্যাপিরাস আর মূর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে চার্লসকে নিয়ে আসে সেই নকল কবরে।
‘ও কিন্তু বুঝতেই পেরেছিল যে রসুল ভাইরা ওকে ঠকাচ্ছে। কিন্তু সেইদিন মুখে কিছু না বলে চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসে। খুব জোর বেঁচে গেলাম, এটাই হয়তো তখন মনে মনে ভাবছিল রসুলরা।
‘কয়েক সপ্তাহ পরে স্বয়ং গ্যাসটন ম্যাসপেরো লাক্সরে এলেন। এসেই শহরে পুলিশ চিফকে নির্দেশ দিলেন আহমেদ রসুলকে গ্রেফতার করার। বেশ কয়েকদিন ধরে ম্যাসপেরো জেরা করলেন আবদুলকে। কিন্তু সে নির্বিকার চিত্তে জানিয়ে দিল যে তার কাছে আর গুপ্তধনের সন্ধান নেই। যা ছিল তা চার্লস উইলবারকে দেখানো হয়ে গেছে। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে পুলিশ ওর বাড়িতে সার্চও করতে পারে। তন্নতন্ন করে গোটা বাড়ি খুঁজেও কিচ্ছু পাওয়া গেল না। আবদুল রসুল হাসতে হাসতে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ওর গ্রামে ফিরে গেল।
‘সোজা আঙুলে ঘি যখন উঠছে না তখন এবারে আঙুল বেঁকাতেই হল ম্যাসপেরোকে। তিন রসুল ভাইকেই আবার অ্যারেস্ট করা হল। এবারে নিয়ে যাওয়া হল ‘‘কেনা’’ নামের একটা শহরের জেলখানাতে।’
‘বেলজোনির প্রথম সেতির টুম্ব আবিষ্কারের সময়ে এই শহরের নাম বলেছিলেন না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এই ‘‘কেনা’’ শহরের জেলখানাতে ওদের আনার একমাত্র কারণ ছিল পুলিশের চিফ দাউদ পাশা। আসামিদের জেরা করে খবর বের করতে ওর কোনো জুড়ি ছিল না।
‘দু-মাস ধরে তিন ভাইয়ের ওপরে প্রচণ্ড অত্যাচার চালাল দাউদ পাশা। আহমেদের পায়ের নখ একে একে উপড়ে ফেলা হল। আরেক ভাইয়ের পা ভেঙে দেওয়া হল। তাতেও তিনজনের কেউ মুখ খুলল না। দাউদ এবারে একটা চালাকি করলেন। হঠাৎ একদিন তিনজনকেই ছেড়ে দিলেন।
‘আহমেদরা বাড়ি ফিরে দেখল ওদের গোটা বাড়ি তছনছ করে দিয়েছে দাউদের পুলিশরা। বাড়ির বউ মেয়েরা ভয়ে কাঁপছে। নিজের প্রাণের মায়া না থাকলেও পরিবারের জন্য তো সবাইকেই চিন্তা করতে হয়। তিন ভাইয়ে মিলে সেইদিন রাতে অনেক আলোচনা করল। ওদের আর বুঝতে বাকি ছিল না যে এইভাবে আর পুলিশদের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না।
‘পরের দিনই আবার ‘‘কেনা’’ শহরের পুলিশ স্টেশনে দেখা গেল আহমেদকে। নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে সে। তবে তার শর্ত আছে কয়েকটা, ওর পরিবারের ওপরে অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। তিন ভাইয়ের ছেলেদের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। খবর গেল ম্যাসপেরোর কাছে। আহমেদের শর্ত মানতে কোনো অসুবিধাই ছিল না ওঁর।
‘গ্যাসটন ম্যাসপেরো এবারে নিজে না এলেও পাঠালেন ওঁর আর এক অ্যাসিস্ট্যান্টকে। নাম এমিল ব্রুজ। ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই ব্রুজ রসুল ভাইদের সঙ্গে ঢুকলেন দেইর এল বাহরির সেই সমাধিতে। সঙ্গে জনাকয়েক পুলিশ। টুম্বের বাইরে তখন ভিড় করে আছে গ্রামের লোকেরা। এত বড়ো একটা ঐশ্বর্যকে রাতারাতি সরাতে না পারলে ব্রুজের নিজেরই বিপদ। গ্রামের লোকেরা জেনে গেছে এর ঠিকানা। এবারে একবার যদি আক্রমণ করে বসে তাহলে ওই হাতে-গোনা কয়েকজন পুলিশ দিয়ে ওদের ঠেকানো যাবে না।
‘সেইদিনই কায়রোতে টেলিগ্রাম করলেন এমিল। বিশাল বড়ো একটা জাহাজ পাঠানো হল লাক্সর বন্দরে। অন্যদিকে মোটা টাকা দিয়ে ভাড়া করা হল গ্রামেরই তিনশো লোককে। তাদেরকে দিয়ে শুরু হল কবর খালি করার কাজ। মরুভূমির বালির ওপরে সাপের মতো লাইন দিয়ে চলল ওরা। কাঁধে চল্লিশটা কফিন বন্দি মমি, প্রচুর প্যাপিরাস, অগুনতি মূর্তি আর আসবাবপত্র। ১৪ জুলাই সেই গুপ্তধন বোঝাই জাহাজ ছাড়ল লাক্সর থেকে। জাহাজ যখন নীল নদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তখন অদ্ভুত একটা দৃশ্য দু-পাশের তীরেতে। সাধারণ মানুষের ভিড় জাহাজ দেখার জন্য। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাগ করে পাথর ছুড়ে মারছে। কেউ হতাশায় কাঁদছে। বিদেশিদের হাতে দেশের সম্পদ চলে যাওয়ার কষ্টে।’
‘এই একই হাল তো আমাদের দেশেও হয়েছিল। ইংরেজরা কত কিছু তুলে নিয়ে চলে গেছে বলুন তো!’
‘সেটা ঠিক কথা, কিন্তু ম্যাসপেরোকে দোষও দেওয়া যায় না। ও না থাকলে রসুল ভাইরা একে একে ওই সমাধির সব ঐশ্বর্যই বিক্রি করে দিত। মমিগুলোর তো কোনো দামই ছিল না ওদের কাছে। হয়তো নষ্টই করে দিত ওদের। তাহলে মিশরের ইতিহাসের একটা কত বড়ো অংশ অজানা থেকে যেত ভাবতে পারছ? ওহো, একটা মজার কথা বলা হয়নি, সেই জাহাজ যখন কায়রোর পোর্টে এসে পৌঁছোল তখন পোর্টের ক্লার্করা একটা ধন্দে পড়ল। ট্যাক্স তো নিতে হবে জাহাজে থাকা মালের বাবদ। কিন্তু মমির জন্য কত টাকা ট্যাক্স হয় সেটা তো কারোর জানা নেই। শেষে ওরা কীসের নামে ট্যাক্স নিল জানো?’
‘কীসের?’
‘শুঁটকি মাছ! শুকনো মমির নিয়ারেস্ট এটাকেই পেয়েছিল।’
বলেই ভবেশদা ঘর কাঁপিয়ে নিজেই হাসতে লাগলেন। সঙ্গে আমরাও।
হাসি থামতে আমি এবারে বললাম,
‘আচ্ছা ভবেশদা, তাহলে কার কার মমি পাওয়া গেল ওখানে?’
‘অনেক ফেমাস ফারাওদের মমি মিলেছিল ভায়া, প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় রামেসিস আর তুতমোসিস, প্রথম সেতি আর আমুনহোতেপ, রানি নেফারতারি তাদের মধ্যে কয়েকজন। এঁদেরকে এখন রাখা আছে কায়রোর মিউজিয়ামে। তবে একজন রাজপুত্রর মমিও রাখা আছে সেখানে, যাকে দেখতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়।’
এবারে আমাদের কোঁচকানো ভ্রূর দিকে তাকিয়ে ভবেশদা বললেন, ‘এক কাজ করো, গুগল ইমেজে সার্চ করো, ‘‘আননোন ম্যান ই’’।’
নেফারতারির মমি
ভবেশদার ঘরে দেখলাম মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুব ভালো নয়। ছবিটা ডাউনলোড হতে তাই কয়েক সেকেন্ড বেশি সময় লাগল। কিন্তু গোটা ছবিটা মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে ওঠার সঙ্গেসঙ্গেই আমি শিউরে উঠলাম। পিজির হাতে মোবাইলটাও কেঁপে উঠল।
এ কেমন মমি! ঘাড়টা অস্বাভাবিকভাবে পিছনের দিকে হেলানো। মুখটা বিশ্রীভাবে হাঁ হয়ে আছে। যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা ভয়ংকর মৃত্যু হয়েছিল এর!
‘দেখে ভয় পেয়ে গেলে তো, এমিল ব্রুজও ভয় পেয়ে গেছিলেন।’
‘মানে দেইর এল বাহরির সেই সমাধিতেই একেও পাওয়া যায়!?’
‘হ্যাঁ, তবে অন্যদের থেকে একদম আলাদা অবস্থায়। সাধারণ সিডার কাঠের তৈরি কফিনে। অন্যান্য মমির মতো এর গায়ে কোনো কাপড়ের ব্যান্ডেজ জড়ানো ছিল না। শরীরটা মোড়ানো ছিল ভেড়ার চামড়া দিয়ে, যেটা কিনা ইজিপশিয়ানদের কাছে খুব অপবিত্র একটা জিনিস। মমির শরীর থেকে নাড়িভুঁড়ি বা মাথার ঘিলুও বের করে নেওয়া হয়নি। গায়ে লাগানো হয়নি রেজিনের প্রলেপ, কফিনের শুকনো পরিবেশেই মৃতদেহ শুকিয়ে গিয়ে এমন বীভৎস রূপ নেয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে একে মমি বানানো হয়। আর ইচ্ছা করেই এর গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় ভেড়ার চামড়া, ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ একটা কফিনে, যার গায়ে বুক অফ দ্য ডেড-এর কোনো মন্ত্রই লেখা ছিল না।’
‘এরকমটা কেন করা হল?’
‘কারণটা খুবই স্পষ্ট, যে বা যারা ওকে কবর দেয় তারা চায়নি ও মৃত্যুর পরে অন্য জীবনে যাক। যে পাপ ও করেছিল তার শাস্তি তো ওকে পেতেই হত।’
‘কী পাপ?’
‘মিশরের টুয়েনটিয়েথ ডাইনেস্টির ফারাও ছিলেন তৃতীয় রামেসিস। ওঁর উপপত্নী ‘‘টিয়ে’’ ওঁকে খুন করার প্ল্যান করে। টিয়ের লক্ষ্য ছিল রামেসিসকে মেরে নিজের সন্তান পেন্টাওয়েরকে ফারাও বানানো। তা না হলে রামেসিসের পাটরানি ইসেতের সন্তানই ফারাও হত। এই চক্রান্তে নেতৃত্ব দেয় রাজকুমার পেন্টাওয়ের স্বয়ং। নিজের কয়েকজন চ্যালাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজার ওপরে। পরে রাজপুত্র আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের ধরে ফেলা হয়। রাজদ্রোহের একটাই শাস্তি তখন, মৃত্যু। পেন্টাওয়েরের সঙ্গে যারা ছিল তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলেও পেন্টাওয়েরের সঙ্গে সেটা করা যায়নি। ফারাওয়ের সন্তান তো, তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলে সে পরজন্মে যেতে পারবে কী করে? তাই ওকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু ওর মমিকে এমনভাবে বানানো হল যে ওর প্রাণ তো ফিরে আসবে। তবে গায়ে সেই অপবিত্র ভেড়ার চামড়ার জন্য অন্য জীবনে ও প্রবেশ করতে পারবে না। এই পৃথিবী আর মৃত্যুর পরের জগতের মাঝখানে আটকা থেকে যাবে ও।’
আননোন ম্যান ই
‘তাহলে এই পেন্টাওয়েরই…’
‘হ্যাঁ, পেন্টাওয়েরই যে এই ‘‘আননোন ম্যান ই’’ সেটা প্রমাণ হয় কয়েক বছর আগে। তৃতীয় রামেসিসের ডিএনএ-র সঙ্গে এর ডিএনএ-র অনেক মিল পাওয়া যায়।’
‘আচ্ছা ভবেশদা, যার জন্য পেন্টাওয়েরকে এই ভয়ানক শাস্তি পেতে হল সেই তৃতীয় রামেসিসের কী হল?’
‘রামেসিসের মমি সেই দেইর এল বাহরির সমাধিতেই পাওয়া যায়। ২০১২ সালে সেই মমির সিটি স্ক্যান হয় কায়রো ইউনিভার্সিটির রেডিয়োলজি ডিপার্টমেন্টে। তাতে দেখা যায় রামেসিসের গলায় গভীর ক্ষত। সেই ক্ষত এতটাই গভীর যে গলার সারভাইকাল স্পাইন অবদি পৌঁছেছিল।
‘রামেসিসকে খুনই করা হয়। রাজপুত্র পেন্টাওয়েরই সেই খুনি!’
তৃতীয় রামেসিসের মমি