২১. তিন লাইনের একটা বিজ্ঞাপন

খবরের কাগজে তিন লাইনের একটা বিজ্ঞাপন উঠেছে। হোসেন সাহেব খুবই অবাক হলেন যে এটা কারো চোখে পড়ল না। লোকজন কি আজকাল বিজ্ঞাপন পড়ে না। নাকি? তাঁর ধারণা ছিল মেয়েরা বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়ে। কিন্তু ধারণাটা সত্যি নয়। নীলু, শাহানা, মনোয়ারা-এরা কেউ এই প্রসঙ্গে কিছু বলল না। মনোয়ারার চোখে না-পড়া ভালো। তিনি চান না মনোয়ারা দেখুক, কিন্তু অন্য দু জন কেন দেখবে না? বিজ্ঞাপনটা এ রকম–

শেষ চিকিৎসা

দুরারোগ্য পুরানো অসুখের হোমিওপ্যাথি মতে
চিকিৎসা করা হয়। যোগাযোগ করুন।
এম হোসেন
১৩/৩ কল্যাণপুর

ঢাকা

এক মাসের টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে দু বার করে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হবে। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে মনে হয় না বিজ্ঞাপনে কোনো লাভ হবে। কেউ তো পড়ছেই না।

সাহেব খবরের কাগজ হাতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। নীলু রান্না চড়িয়েছে। শ্বশুরকে দেখে সে বলল, কিছু বলবেন নাকি বাবা?

না, তেমন কিছু না। আজকের খবরের কাগজটা কি পড়েছ?

নীলু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। কেন?

একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম কাগজে, চোখে পড়ে নি?

তিনি খবরের কাগজ মেলে ধরলেন।

ভাবলাম, একটা বিদ্যা যখন শিখলাম, কষ্ট করে তখন কাজে লাগানো যাক। কি বল?

তা তো ঠিকই।

এটাও এক ধরনের সমাজসেবা, কি বল মা?

তা তো নিশ্চয়ই।

গরিব-দুঃখীদের কাছ থেকে পয়সা নেব না ঠিক করেছি। তবে অন্যদের কাছ থেকে নেওয়া হবে। বাসায় এলে দশ টাকা, আর কল দিয়ে নিয়ে গেলে কুড়ি টাকা। বেশি হয়ে গেল নাকি?

না, বেশি হয় নি, ঠিকই আছে।

হোসেন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, বাড়ির সামনে একটা সাইন বোর্ড দিতে হবে। ডাঃ এম হোসেন হোমিও-কী বল মা? লোকজন বিজ্ঞাপন দেখে আসবে, বাসা খুঁজে বের করতে হবে তো?

সাইন বোর্ড তো দিতেই হবে। আপনি রফিককে বলে দিন, ও সাইন বোর্ড করিয়ে নিয়ে আসবে।

হ্যাঁ, বলব। ইয়ে, আরেকটা কথা মা।

তোমার শাশুড়িকে কিছু না-বলাই ভালো। মানে, কিছু চিন্তা-ভাবনা না করেই রেগে যায় তো, সে জন্যেই বলছি।

না বাবা, আমি কিছু বলব না।

নীলুর কথার মাঝখানেই মনোয়ারা ঢুকলেন। হোসেন সাহেবকে দেখেই  রেগে উঠলেন।

রান্নাঘরে ঘুরঘুর করছ কেন? পুরুষমানুষদের রান্নাঘরে ঘুরঘুর করা আমার পছন্দ না। যাও, টুনীদের বই নিয়ে বসাও।

অন্য দিন হলে তিনি কিছু বলতেন। রান্নাঘরে পুরুষমানুষদের থাকা উচিত, না উচিত নয়-এই নিয়ে মোটামুটিভাবে একটা তর্ক বাঁধিয়ে বসতেন। আজ কিছুই বললেন না। টুনী এবং বাবলুকে নিয়ে পড়াতে বসলেন।

মনোয়ারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার শ্বশুরের কাণ্ডকারখানায় লজ্জায় মুখ দেখানো দায়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, দেখেছ? এম. হোসেন দেখেই সন্দেহ হয়েছিল, ঠিকানা দেখে বুঝলাম। তোমাকে বিজ্ঞাপনের কথাই বলছিল বোধহয়।

জ্বি।

লোকটা যে বোকা, তাও না। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে! সে এক মহা ডাক্তার হয়ে গেছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে। চিন্তা কর অবস্থা।

নীলু মৃদুস্বরে বলল, কিছু বলার দরকার নেই মা।

না বললে তো আশকারা দেওয়া হবে। এসব জিনিস আশিকার দিতে নেই।

টুনী এবং বাবলু পড়তে বসেছে। এদের পড়ানোর কাজটা হোসেন সাহেব নিজেই আগ্রহ করে নিয়েছেন। পড়াশোনা চলছে তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। প্রতিদিন একটি করে অক্ষর নানানভাবে শেখানো হচ্ছে। হোসেন সাহেব হিসাব করে দেখেছেন, এগারটি স্বরবর্ণ শিখতে লাগবে এগার দিন এবং ব্যঞ্জনবর্ণ শিখতে লাগবে আটত্রিশ দিন! মোট এক মাস উনিশ দিনে প্রতিটি বর্ণ তারা পড়তে এবং লিখতে শিখবে।

আজ শেখান হচ্ছে গ। হোসেন সাহেব প্রকাণ্ড একটা গ লিখে দেয়ালে বুলিয়েছেন। গ দিয়ে দু লাইনের একটি ছড়া তৈরি করা হয়েছে। টুনী এবং বাবলু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ছড়াটি পড়ছে।

গ তে হয় গরু
তার পা দুটি সরু।
গরুর শিং বাঁকা
গরু যায় ঢাকা।

বাবলু এমনিতে কথাবার্তা একেবারেই বলে না, কিন্তু ছড়া বলতে তার একটা আগ্রহ আছে। সে টুনীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে সুর করে ছড়া পড়ছে।

হোসেন সাহেব বললেন, এইবার লেখা। প্রথমে একটা গরুর ছবি আঁক। শিংওয়ালা গরু, যে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। এবং গরুর পাশে আঁক একটা গ। তারপর তোমাদের ছুটি।

টুনী বলল, না দাদু ছুটি না, তুমি গল্প বলবে।

আজ আর গল্প না।

উঁহু, বলতে হবে। শীত-বসন্তের গল্প বলতে হবে।

না, আজ আর কোনো গল্পটল্প হবে না।

বলতেই হবে, বলতেই হবে।

গল্প বলায় হোসেন সাহেবের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। গল্প বলতে না চাওয়া হচ্ছে তাঁর দাম বাড়াবার একটা কৌশাল। রোজই বেশ খানিকক্ষণ না-না করেন এবং শেষ পর্যন্ত লম্বা-চওড়া একটা গল্প শুরু করেন-যেটা শেষ হতে দীর্ঘ সময় নেয়। এক সময় টুনী এবং বাবলু দুজনের চোখই ঘুমে জড়িয়ে আসে, তবু তারা জেগে থাকে।

বাবলু। এ বাড়িতে মোটামুটিভাবে সুখেই আছে বলা চলে। কোনো এক বিচিত্ন কারণে শফিক বাবলুকে খুবই পছন্দ করে। সে যে আগ্রহ বাবলুর ব্যাপারে দেখায়, টুনীর ব্যাপারে তা দেখায় না। এটা নীলুকে বেশ পীড়িত করে। এর মধ্যে রহস্য আছে কিনা কে জানে!

অফিস থেকে ফিরেই শফিক ডাকবে, বাবলু সাহেব কোথায়? বাবলু যেখানেই থাকুক গলার স্বর শুনে ছুটে আসবে উস্কার বেগে।

তারপর বাবলু সাহেব, কেমন আছেন?

ভালো।

সারা দিন কী কী করলেন?

(একগাল হাসি)

কী, কিছুই করা হয়নি?

(না-বোধক মাথা নাড়া)

শফিক অফিসের কাপড় ছাড়বে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে পাশে। শফিক বাথরুমে যাবে হাত-মুখ ধুতে, সে দাঁড়িয়ে থাকবে দরজার পাশে। শফিক অফিস-ফেরত চা বারান্দায় বসে খাবে। সেও থাকবে বারান্দায়।

নীলু অনেক বার ধমক দিয়েছে, কী সব সময় বড়োদের সঙ্গে ঘুরঘুর করা? যাও, খেলতে যাও।

শফিক প্রশ্রয়ের সুরে বলেছে, আহ, থাক না। বিরক্ত করছে না তো।

ছুটির দিনগুলিতে শফিক দুপুরবেলা শুয়ে থাকে। বাবলু ঠিক তখন শফিকের পাশে বসে থাকে। এবং একটা হাত তুলে দেয় শফিকের গায়ে। এতটা বাড়াবাড়ি নীলুর ভালো লাগে না। কোনো কিছুর বাড়াবাড়িই ভালো th]।

নীলু প্রায়ই ভাবে এই প্রসঙ্গে শফিককে সরাসরি একদিন কিছু বলবে। বলা হয়ে উঠছে না। শফিক আজকাল আগের চেয়েও গভীর। অফিসের ঝামেলা নিশ্চয়ই অনেক বেড়েছে। অফিস সম্পর্কে শফিক কখনো কিছু বলে না, কাজেই আসলে কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। অবশ্যি সে এখন ঘরে ফিরছে। সকাল-সকল। টঙ্গি যাচ্ছে না। নীলুর ধারণা ছিল, টঙ্গির কাজ শেষ হয়ে গেছে বলেই যেতে হচ্ছে না। সে ধারণাও ঠিক না। টঙ্গির কাজ শেষ হয় নি। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্য এক জনকে। কেন, কে জানে?

 

আসবেন। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় এসে ঢাকা পৌঁছেছেন। তাঁর নাম মিঃ টলম্যান! এই জাতীয় নাম বিলেতিদের পক্ষেই সম্ভব। বাঙালি মুসলমান কত বৎসর পর তার ছেলের নাম রাখবে লম্বা আহমেদ, বা আদৌ এ-রকম নাম রাখার মতো সাহস কি তাদের হবে?

শফিক অবাক হয়ে লক্ষ করল, নতুন বড়ো সাহেবের আচার-আচরণ নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক গবেষণা হয়ে গেছে। এবং জানা গেছে। ইনি দারুণ কড়া লোক। অসম্ভব রাগী এবং অসম্ভব কাজের। মালয়েশিয়ার কোম্পানি যখন লাটে ওঠার মতো হল, তখন টলম্যানকে পাঠানো হল। এক মাসের মধ্যে সে সব ঠিকঠাক করে ফেলল।

বিলেতি সাহেব একজন আসবেন জানা ছিল। গতকালই তিনি এসে পৌঁছেছেন এটা শফিকের জানা ছিল না। সিদ্দিক সাহেব জানতেন। তিনি খবরটি অন্য কাউকে জানান নি। নিজেই গিয়েছেন এয়ারপোর্টে। সাহেবকে এনে প্রথম রাতে নিজের বাসায় ডিনার খাইয়েছেন। সিদ্দিক সাহেবের এই ধরনের লুকোচুরির কারণ শফিকের কাছে স্পষ্ট হল না। কানভাঙানির কিছু কি আছে তাঁর মনে? সিদ্দিক সাহেব বুদ্ধিমান লোক। একজন বুদ্ধিমান লোক এ ধরনের বোকামি করবে না। সিদ্দিক সাহেব এতটা কাঁচা কাজ করবেন, এটা ভাবা যায় না।

সিদ্দিক সাহেব খবর নিয়ে এলেন, মিঃ টলম্যান সাড়ে এগারটার সময় আসবেন। বারটা থেকে সাড়ে বারটা পর্যন্ত অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করবেন। কারখানা দেখতে যাবেন তিনটায়। সাড়ে চারটায় যাবেন জয়দেবপুর। সিদ্দিক সাহেবকে অত্যন্ত উল্লসিত মনে হল। শফিককে হাসতে হাসতে বললেন, জাত ব্রিটিশ তো, একেবারে বাঘের বাচ্চা!

শফিক ঠাণ্ডা গলায় বলল, হালুম হালুম করছিল নাকি? না, এখনো করে নি। তবে করবে। মালয়েশিয়াতে কি কাণ্ডটা করেছে। জানেন তো? চার জনকে স্যাক করেছে জয়েন করবার প্রথম সপ্তাহে। ইউনিয়ন গাইগুই করছিল। ইউনিয়নের চাইদের ডেকে নিয়ে বলেছে–যদি কোনো রকম গোলমাল হয়, কোম্পানি বন্ধ করে দিয়ে সে চলে যাবে। তাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যে কোম্পানি লস খাচ্ছে তাকে পোষার কোনো মানে হয় না।

কোনো রকম ঝামেলা হয় নি?

এ্যাবসলিউটলি নাথিং।

এখানেও কি এ-রকম কিছু হবে বলে মনে করেন?

হতে পারে। আমি জানি না।

জানবেন না কেন? তাঁর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার কথাবার্তা হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে আনলেন, ডিনার খাওয়ালেন।

আপনি কি অন্য কিছু ইঙ্গিত করছেন?

না, আমি অন্য কিছুই ইঙ্গিত করছি না। টলম্যানের আসার খবর আপনি চেপে গেছেন, এটাই আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়েছে।

এর মধ্যে রহস্য কিছু নেই।

না থাকলেই ভালো।

অফিসের সবাই ভেবেছিল নাম যখন টলম্যান, তখন নিশ্চয়ই বেঁটেখাট মানুষ হবে। কিন্তু দেখা গেল মানুষটি তালগাছের মতোই, স্বভাব-চরিত্রেও ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। শান্ত। কথাবার্তা বলে নিচু গলায়। মিনিটে মিনিটে রসিকতা করে। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসে প্রাণ খুলে।

অফিসারদের সঙ্গে মিটিংটি চমৎকারভাবে শেষ হল। টলম্যান বললেন, তিনি মনে করেন। এখানে চমৎকার স্টাফ আছে, যারা ইচ্ছা করলেই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথম শ্রেণীর একটি প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। তিনি এসেছেন এই ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে, এর বেশি কিছু নয়। যারা যারা সিগারেট খায়, তিনি তাদের সবাইকে নিজের প্যাকেট থেকে সিগারেট দিলেন এবং হরতাল ও স্ট্রাইক প্রসঙ্গে বিলেতি একটি গল্প বলে সবাইকে মুগ্ধ করে দিলেন। গল্পটি এ—রকম: লেবার পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালীন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এক বার ঠিক করলেন কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে এক দিনের জন্যে স্ট্রাইক করবেন। ইতিহাসে এ-রকম ব্যাপার আর হয় নি। সবার ধারণা, শেষ পর্যন্ত স্ট্রাঙ্গক হবে না। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা, চিঠি লেখালেখি। শেষ পর্যন্ত স্ট্রাইক হল। অদ্ভুত ধরনের স্ট্রাইক। প্রফেসররা ঠিকই ক্লাস নিলেন, কাজকর্ম করলেন, শুধু সেই দিনটির বেতন নিলেন না।

গল্প শেষ করে টলম্যান বললেন, এ ধরনের স্ট্রাইক তোমাদের দেশে চালু করতে পারলে বেশ হত, তাই না?

মিটিং শেষ করে নিজের ঘরে ফেরার পনের মিনিটের মধ্যে শফিক টলম্যানের কাছ থেকে যে চিঠিটি পেল, তার সারমর্ম হচ্ছে–তুমি দায়িত্বে থাকাকালীন এ অফিসে নিম্নলিখিত অনিয়মগুলি হয়েছে। আমি মনে করি এ দায়িত্ব বহুলাংশে তোমার। এক সপ্তাহের মধ্যে তুমি প্রতিটি অভিযোগ প্রসঙ্গে তোমার রক্তব্য লিখিতভাবে জানাবে। তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পরের পৃষ্ঠায় আছে। বেশ খুঁটিয়ে লেখা।

দুপুর দুটোর দিকে সিদ্দিক সাহেব এসে বললেন, শফিক সাহেব, আপনার চিঠির প্রসঙ্গে আমি কিছুই জানি না, আপনি বিশ্বাস করেন। এত ছোট মন আমার না। আমি ভদ্রলোকের ছেলে। এই টলম্যান ব্যাটার সঙ্গে আপনার ব্যাপারে আমার কোনো কথা হয় নি।

শফিক শান্ত স্বরে বলল, আপনার কথা বিশ্বাস করছি। কাগজপত্র সাহেব হেড অফিস থেকেই তৈরি করে এনেছে।

আমি টলম্যানকে আপনার কথা গুছিয়ে বলব।

না, কিছু বলার দরকার নেই।

শফিক অসময়ে বাড়ি ফিরে এল।

কবির মামা এসেছেন। টেবিলে পা তুলে সোফায় বসে আছেন গম্ভীর হয়ে। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। মেজাজ খারাপ হবার মতো কারণ ঘটেছে। টেনে আসার সময় একটা ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। টেন মোটামুটি ফাঁকা ছিল। পা তুলে আরাম করে সিটে বসে ছিলেন। তেজগাঁ স্টেশনে নামতে গিয়ে দেখেন চটি জুতো জোড়া নেই। পুরানো চটি—এমন কোনো লোভনীয় বস্তু নয়। মানুষ কি দিন দিনই অসৎ হয়ে যাচ্ছে? কোথাও যেতে হলে সারাক্ষণ নিজের জিনিসপত্র কোলের উপর নিয়ে বসে থাকতে হবে? তাঁকে বাসায় আসতে হয়েছে খালি পাযে।

শফিক কবির মামাকে দেখে সালাম করবার জন্যে এগিয়ে এল।

কি রে, ভালো আছিস?

জ্বি।

মুখ এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন?

মাথা ধরেছে।

অফিস থেকে চলে এসেছিস?

জ্বি।

সামান্য মাথা ধরাতেই অফিস ছেড়ে চলে এসেহিংস, বলিস কি?

শফিক কিছু না— বলে ভেতরে চলে গেল। কবির মামা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি অসম্ভব বিরও হয়েছেন। সমগ্র জাতির তে৩রই কাজের প্রতি একটি অনীহা এসে গেছে। টঙ্গিতে এক জন টিকিট চেকার উঠল। পাঁচ-ছ জন যাত্রীর টিকিট দেখেই সে যেন ক্লান্ত হয়ে গেল দু বার হাই তুলল। কবির সাহেবের কাছে এসে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল, যেন সে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়বে। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই সে বলল, থাক থাক, লাগবে না।

তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, লাগবে না কেন, দেখেন।

আরে না, দেখতে হবে না।

দেখতে হবে না কেন? এক শ বার দেখতে হবে।

টিকিট চেকার এ-রকম ভাবে তাকাল, যেন সে এমন অদ্ভুত কথা এর আগে শোনে নি। বড়োই আশ্চৰ্য কাণ্ড।

কবির মামা সোফায় হেলান দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেন–কেন দিন দিন জাতি এমন কর্মবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। কাজে কেউ কোনো আনন্দ পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর কারা জানেন? সমাজবিজ্ঞানীরা? জাতি হিসেবে বাঙালি কর্মবিমুখ, এটা তিনি মানতে রাজি নন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেখেছেন, কী অসম্ভব খাটতে পারে না-খাওয়া শরীরের রোগা মানুষগুলি। তখন পেরেছে, এখন কেন পারবে না? এখন কেন জোয়ান বয়সের এক জন টিকিট চেকার তিনটা টিকিটে টিক মার্ক দিয়েই বোয়াল মাছের মতো হাই তুলবে।

 

মনোয়ারা বললেন, গোসল করে নিন। ভাত দিয়ে দিই।

একটু অপেক্ষা করি। বৃষ্টি আসবে আসবে করছে। বৃষ্টির পানিতে গোসল করব।

বৃষ্টির পানিতে করবেন কেন? ঘরে কি পানির অভাব?

কবির মামা থেমে থেমে বললেন, বয়স হয়ে যাচ্ছে, বেশি দিন বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো যাবে না, তাই সুযোগ পেলেই লাগিয়ে নিই। সরিষার তেল আছে ঘরে?

জ্বি, আছে।

নিয়ে আসা। তেল মেখে নিই। ঠাণ্ডা লেগে গেলে মুশকিল।

মনোয়ারা বসলেন পাশেই। কবির মামা বললেন, তারপর বল, তোমার খবরাখবর বল।

আমার কোনো খবর নেই।

খবর নেই কেন? মনে হচ্ছে সবার উপর তুমি বিরক্ত।

বিরক্ত হব না কেন? কে আমার জন্যে কী করল খুশি হবার মতো।

কে কী করল সেটা জিজ্ঞেস করবার আগে বল, তুমি অন্যদের জন্য কী করলে?

মনোয়ারা অবাক হয়ে বললেন, কী করলাম মানে! সংসার চালাচ্ছে কে?

তুমি এমন ভাবী করছ, যেন তুমি না থাকলে সংসার আটকে যাবে।

আটকাবে না?

না, আটকাবে না। কারো জন্যেই কিছু আটকে যায় না! মুশকিলটা হচ্ছে-সবাই মনে করে, তাকে ছাড়া জগৎ-সংসার অচল। বৃষ্টি নামল বোধহয়। সাবান দাও, গামছা দাও। হোসেন আসবে কখন?

জানি না। কখন।

কোথায় গিয়েছে বললে?

জানি না কোথায়?

তুমি কি আমার উপর রেগে গেলে নাকি? রাগ হবার মতো কিছু বলি নি।

গামছা সাবান নিয়ে তিনি ছাদে চুলে গেলেন। ভালো বৃষ্টি নেমেছে। ছাদে পানি জমে গেছে। তিনি খানিকক্ষণ শিশুদের মতো সেই জমে-থাকা পানিতে লাফালেন। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন সব বয়স্ক মানুষরাই বোধ হয়। খানিকটা শিশুর অভিনয় করতে ভালোবাসে।

কবির মামা গায়ে সাবান মাঝতে মাঝতে লক্ষ করলেন, খাঁচায় দুটি কবুতর চুপচাপ ভিজছে। আনিসের ম্যাজিকের কবুতর। তাঁর বিরক্তির রইল না। প্রথমত খাঁচায় পাখি আটকানোই একটি অপরাধ। তার চেয়ে বড়ো অপরাধ বন্দি পাখিগুলি ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ফেলে রাখা। তিনি আনিসের ঘরে উঁকি দিলেন, আনিস আছ?

আনিস ঘরেই ছিল। সে অবাক হয়ে উঠে এল।

তোমার কবুতর ভিজছে। পশুপাখিকে এভাবে কষ্ট দেবার তোমার কোনো রাইট নেই। এটা ঠিক না। অন্যায়।

আপনি বৃষ্টির মধ্যে কী করছেন মামা?

গোসল করছি। আর কী করব?

আপনি কি মামা কবুতর দুটি ছেড়ে দিতে বলছেন?

তোমার ম্যাজিকের যদি কোনো গুরুতর ক্ষতি না হয়, তাহলে ছেড়ে দাও।

আনিস হাসিমুখে বৃষ্টির মধ্যে নেমে এল। খাঁচা খোলার পর কবুতর দুটি উড়ে গেল না। ছাদের রেলিংয়ের উপর বসে রইল। আনিস বলল, দেখলেন মামা, বৃষ্টিতে ভিজতে ওদের ভালোই লাগছে।

আনিস হুসহুস করে ওদের তাড়াতে চেষ্টা করল। ওরা গেল না। উড়ে উড়ে বার বার রেলিংয়েই বসতে লাগল।

কবির মামা গম্ভীর গলায় বললেন, উড়তে ভুলে গেছে।

আনিস বলল, ভুলে গেলেও শিখে নেবে। ওদের নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না মামা।

তুমি ভিজছ কেন?

আনিস হেসে বলল, ভিজতে ভালোই লাগছে।

তোমার ম্যাজিক কেমন চলছে?

ভালোই।

যে শাস্ত্রটা তৈরিই হয়েছে মানুষকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে সেটা লোকজন এত আগ্রহ করে কেন শেখে বল তো আমাকে?

আপনি মামা শুধু ফাঁকিটা দেখলেন। ফাঁকির পেছনে বুদ্ধিটা দেখলেন না? আমি যদি এই বৃষ্টির ফোঁটা থেকে একটা গোলাপ ফুল এনে দিই, আপনার কেমন লাগবে?

বলতে বলতেই আনিস হাত বাড়িয়ে একটি গোলাপ তৈরি করল। কবির মামা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

কেমন লাগল মামা?

চমৎকার!

শুধু চমৎকার?

অপূর্ব! আমি মুগ্ধ হলাম আনিস।

আপনার কি মামা মনে হয় না যে, সত্যিকার ফাঁকিগুলি ভুলে থাকার জন্যে এ জাতীয় কিছু ফাঁকির দরকার আছে?

তুমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছি।

আনিস হাসতে লাগল। কবির মামা বললেন, তোমাকে আমি নীলগঞ্জে নিয়ে যাব। গ্রামের লোকজনদের তুমি তোমার খেলা দেখাবে!

নিশ্চয়ই দেখােব। আপনি যখন বলবেন, তখনি যাব। অনেকক্ষণ ধরে ভিজছেন। নিচে যান, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ফুলটা নিয়ে যান মামা।

তিনি গোলাপ-হাতে নিচে নেমে এলেন।

রাতের বেলা তাঁর জ্বর এসে গেল। রফিককে যেতে হল ডাক্তারের খোঁজে। শাহানা কপীনা টিপে দিতে বসল।

শাহানা শাড়ি পরেছে। মনোয়ারা কামিজ পরার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। দু দিন পর বিয়ে হচ্ছে যে-মেয়ের সে ফ্রক পরে ধেইন্ধেই করবে। কেন?

শাড়িতে শাহানাকে অপূর্ব লাগছে। ঘরে আলো কম! কবির মামার চোখে আলো লাগছে বলেই বাতি নেভানো। খোলা দরজা দিয়ে সামান্য কিছু আলো এসে পড়েছে শাহানার মুখে। কী সুন্দর লাগছে তাকে! যেন এক জন কিশোরী দেবী।

শাহানা বলল, এখন কি একটু ভালো লাগছে মামা?

লাগছে। তোর বিয়ের ব্যাপারে কত দূর কি হল?

জানি না।

খামোকা এটা ঝুলিয়ে রেখেছে কেন বুঝলাম না। এসব তো ঝুলিয়ে রাখার জিনিস না।

শাহানা কিছু বলল না। কবির মামা বললেন, ছেলেটিকে পছন্দ হয়েছে তো?

শাহানা জবাব দিল না। খুব লজ্জা পেয়ে গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, লজ্জা পাস কেন? এক জন মানুষকে পছন্দ হয়েছে কি পছন্দ হয় নি, এটা বলার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই।

পছন্দ হয়েছে।

ভালো। যে কথাটা মনে আসে, সে কথাটা মুখেও আসতে পারে। এবং আসাই উচিত। তোর বরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ভালো ছেলে। সব সময় হাসছে।

সব সময় হাসলেই বুঝি ভালো ছেলে হয়?

হ্যাঁ, হয়। কুটিল মনের মানুষ সব সময় হাসতে পারে না। গম্ভীর হয়ে থাকে।

তুমিও তো সব সময়, গম্ভীর হয়ে থাক। তুমি কি কুটিল মনের মানুষ?

গম্ভীর হয়ে থাকি আমি?

হ্যাঁ।

কখনো হাসি না?

কবির মামাকে দেখে মনে হল, তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শাহানা হাসতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করল হাসির বেগ সামলাবার জন্যে, সেটা সম্ভব হল না। সে ছুটে চলে গেল বারান্দায়। বারান্দায় কিন্নরকণ্ঠের হাসি দীর্ঘ সময় ধরে শোনা গেল। টুনী যোগ দিল সেই হাসিতে, তারপর বাবলু। শিশুরা যাবতীয় সুখের ব্যাপারে অংশ নিতে চায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *