একুশ
তিনটে শরীর উদ্দাম নেচে যাচ্ছে। তাদের লম্বা লম্বা চুল কিন্তু সরু লিকলিকে লেজের মত ঝাপটা মারছে সমানে। মোক্ষদাবুড়ির মত চুপসে যাওয়া বুক, ডাইনিদের মত মুখ আর বিশাল বিশাল নখ নিয়ে নাচতে নাচতে ঘিরে ধরেছে তাকে। স্পষ্ট সে শুনতে পাচ্ছে ওরা হাসছে, যেন হাসির সুরে বলছে, পেয়েছি পেয়েছি। কোথাও একটা বাজনা বাজছে খুব দ্রুত লয়ে। হিলহিলে সাপের মত তিনজনের হাত কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল নিচে। ক্রমশ গলা লক্ষ্য করে সেগুলো এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল অর্ক। দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে পৃথিবীতে যেন আর বাতাস নেই। সে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল কিন্তু শরীর এক ইঞ্চি উঠতে পারল না। বুকের ভেতর যেন একটা ভারী কিছু চেপে বসেছে এবং অর্ক সেটাকে কিছুতেই নড়াতে পারছে না। প্রচণ্ড চেষ্টার পর সে কোনরকমে যখন উঠে বসল তখন সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ভারী। অন্ধকারে চারপাশে তাকিয়েও বুঝতে সময় লাগল যে এখন ঘরের মেঝেয় শুয়ে। ওপাশে মা আর খাটের ওপর বাবা। সামান্য নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে খাট থেকে। অন্য সময় এই শব্দটায় ঘুম আসতে চায় না কিন্তু এখন খুব আরাম লাগল। যেন একটা পরিচিত অবলম্বন স্থিত হবার জন্যে।
দুহাতে মুখ মুছল অর্ক। আর তখনই মাধবীলতার গলা ভেসে এল, ‘কি হয়েছে? অর্ক কথা বলার চেষ্টা করেও পারল না। এখনও তার শরীর কাঁপছে। মাধবীলতা আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘উঠে বসলি কেন? স্বপ্ন দেখছিলি?’
অর্ক মুখ ফেরালো। তারপর কোনরকমে বলতে পারল, ‘মা—’
মাধবীলতা অবাক হল। এই গলা স্বাভাবিক নয়, আবছা অন্ধকারেও ছেলেটাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। সে দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে ছেলের পাশে এসে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে, কি হয়েছে?’ বলে ওর কাঁধে হাত রাখল।
অর্কর উত্তেজনা ততক্ষণে কমে এসেছে। সে ঘাড় নাড়ল, ‘কিছু না।’
‘কিছু না তো অমন করছিলি কেন? স্বপ্ন দেখছিলি?
‘হ্যাঁ।’
মাধবীলতা হেসে ফেলল। এতবড় ছেলেটা একদম শিশুর মত ভঙ্গী করছে। একটু ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি স্বপ্ন? ভূত প্রেতের?’
ততক্ষণে অর্ক চেতনা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সেই দম-বন্ধ-হওয়া অনুভূতিটাকে সে তখনও যেন টের পাচ্ছিল। স্বপ্নটার কথা মাকে বলা যায় না। কিন্তু এই যে মা তার কাঁধে হাত রেখে এত আন্তরিকভাবে কথা বলছে এটাকেও হারাতে চাইছিল না সে। ওর মনে হল অসুখের সময় ছাড়া সুস্থ অবস্থায় মা অনেকদিন তার কাছে এমনভাবে আসেনি। সে মায়ের পাশে বালিশটাকে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে বলল, তুমি আমার পাশে শোও। মাধবীলতা এবার সত্যিই বিস্মিত হল, ‘কেন?’
‘আমার খুব ইচ্ছে করছে।’ অর্ক একটা হাত মায়ের কোলে রাখল। মাধবীলতার মুখে এক মুহূর্ত কোন কথা এল না। হঠাৎ অর্ক এত ছেলেমানুষ হয়ে গেল কি করে তা সে বুঝতে পারছিল না। বুকের মধ্যে যে আবেগটা একটু একটু করে শুকিয়ে যাচ্ছিল সেটা এখন যেন প্রাণ ফিরে পেল। অর্ক আবার ডাকল, ‘শোও না। মাধবীলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, ‘শুতে পারি যদি তুই একটা প্রতিজ্ঞা করিস!’
‘কি প্রতিজ্ঞা।’ চিৎ হয়ে শোওয়া অর্ক একটুও নড়ল না।
‘তুই কখনও আর ওইসব খারাপ কথা বলবি না। ওগুলো শুনলেই আমার বমি পায়।
অর্ক সিঁটিয়ে গেল। মায়ের মুখ থেকে এইরকম কথা সে এই মুহূর্তে আশা করেনি। কোনদিন খিস্তি করবো না এমন প্রতিজ্ঞা সে কিভাবে করবে? বিলু কোয়াদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ওগুলো আপনা থেকেই জিভে চলে আসে। তাছাড়া ওরা যখন খিস্তি দিয়ে কথা বলবে তখন চুপ করে থাকা যায় না। সে একটু ভেবে নিয়ে মাধবীলতাকে বলল, ‘চেষ্টা করব।’
‘উঁহু! ওরকম ঘোরানো কথা আমি শুনতে চাই না। তোকে স্পষ্ট বলতে হবে।’
অর্ক অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকাল। এখন একা শুতে ভয় ভয় করছিল এটা ঠিক কিন্তু মা তার পাশ থেকে উঠে যাক এটা সে কিছুতেই চাইছিল না। সে যদি প্রতিজ্ঞা করার পরও ভুল করে বলে বসে! তৎক্ষণাৎ ওর চোখে তিন বুড়ির নৃত্যদৃশ্যটা ভেসে এল। শিউরে উঠে অর্ক চোখ বন্ধ করল। তারপর মাধবীলতার শরীরে মুখ রেখে বলল, ‘আমি জেনেশুনে আর খারাপ কথা বলব না মা।’
নিজের বালিশ অর্কর পাশে রেখে শুয়েছিল মাধবীলতা। খাটের ওপরে অনিমেষ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আজকাল ঘুমালেই নাক ডাকে অনিমেষের। শুধু সেই শব্দে ফের ঘুম আসছিল না তা নয়, মাধবীলতা আর একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করল। অর্ক সামান্য বড় হবার পরেই তার একা শোওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে ছেলেটাকে বড় হতে দেখেছে সে। কিন্তু এভাবে পাশাপাশি আর শোয়নি। অর্কর শরীর থেকে এক ধরনের পুরুষালি গন্ধ বের হচ্ছে। ছেলেটা তার পেটে হাত রেখে শুয়েছিল। যতটা না ওজন তার চেয়ে অস্বস্তিতে সে বলেছিল, ‘হাতটা সরা পেটে লাগছে। অর্ক যেন খানিকটা অনিচ্ছায় হাত সরিয়ে তার গা ঘেঁষে শুয়েছে এখন। মাধবীলতার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। যে ছেলেকে সে পেটে ধরেছে, এত কষ্ট করে বড় করেছে তার পাশেও সে স্বচ্ছন্দে শুয়ে থাকতে পারছে না কেন? কেন এত অস্বস্তি হচ্ছে? সেটা কি ছেলে একটা আস্ত পুরুষমানুষ হয়ে গেছে বলে? কথাটা ভাবতে গিয়েই হেসে ফেলল মাধবীলতা নিঃশব্দে। অর্ক যখন শিশু ছিল তখন ওর সামনে জামাকাপড় পাল্টাতে একটুও সঙ্কোচ হতো না তার। কিন্তু এখন তো মরে গেলেও পারবে না। এই শোওয়ার অস্বস্তিটা বোধ হয় সেই একই কারণে।
মায়ের গা-ঘেঁষে শুয়ে অর্ক সেই মিষ্টি গন্ধটাকে টের পেল। কোন পাউডার সেন্টের গন্ধ নয়, ছেলেবেলায় মায়ের শরীর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরিয়ে তার নাক জুড়ে থাকতো। গন্ধটা ক্রমশ বুক ভরিয়ে দিচ্ছিল তার। কিন্তু চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকেও কিছুতেই আর ঘুম আসছিল না। হঠাৎ তার মনে হল স্বপ্নের তিন বুড়িকে সে চিনতে পেরেছে। মিসেস সোমের তিন বান্ধবী যখন নাচছিলেন তখন তাঁদের ওই রকমই দেখাচ্ছিল। ওই তিনজনই স্বপ্নে ডাইনি হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর আবার দমদম করে উঠতেই মাকে ছুঁয়ে সে শান্ত হল। কিন্তু তখনই শরীর গুলিয়ে উঠল ওর। ওই তিনজন প্রৌঢ়া মহিলা কি কুৎসিত ভঙ্গীতেই না নাচছিলেন। তাছাড়া ওঁদের ভাবভঙ্গীর মধ্যে একটা কিছু রহস্য ছিল। তাকে গোপনে যেতে বলছিলেন কেন? গা ঘিনঘিন ভাবটা বেড়ে গেল অর্কর! ওই মহিলারা কেউ ভাল নয়। অথচ ওদের সঙ্গে থাকার সময় এটা একবারও তেমন করে মনে হয়নি তার। এই স্বপ্নটা দেখার পরে মনে হচ্ছে ওরা তাকে ব্যবহার করতে চায়। এই তিনজন মহিলা মায়ের মত নয়। এমন কি মিসেস সোমও। তা না হলে অন্ধকার বাড়িতে একা বিছানায় শুয়ে কাঁদছেন প্রায় বিবস্ত্র হয়ে অথচ পাশের ঘরেই বিলাস সোম অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। ওই তিনজন যার বন্ধু সে কিছুতেই ভাল হতে পারে না। অর্কর মনে হল সে যেন একটা মুরগি আর তিনটে শেয়াল তার তিন পাশে বসে জিভ কাটছে। কিছুদিন আগে বিলু একটা সিনেমার গল্প বলেছিল। সেটা এইরকম। বুড়ি মেয়েরা নাকি অল্পবয়সী ছেলেদের খেয়ে ফেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় একসময়। ব্যাপারটা যত ভাবছিল তত গা-বমি ভাবটা বাড়ছিল। তারপর একসময় আর না পেরে উঠে বসল।
মাধবীলতা ছটফটানিটা টের পাচ্ছিল। ছেলে উঠে বসতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’
‘বাইরে যাব।’ অর্ক চট করে উঠে দরজা খুলে অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। মাধবীলতা এরকম আচরণে অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি কাপড় সামলে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। এবং তখনই সে বমির শব্দ শুনতে পেল। অনুদের বাড়ি পেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল নর্দমার ধারে দাঁড়িয়ে অর্ক বমি করছে। তবে মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছে না সামান্য জল ছাড়া। মাধবীলতা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে ধরল। সে এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে ছেলেটা পাশে শুতে বলল। বেশ আবদেরে ভঙ্গীতে শুয়েই ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ এভাবে ছুটে এসে বমি করছে কেন? এবার সামান্য কিছু উঠল।
অর্ককে হাঁপাতে দেখে মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘আর হবে?’
চোখ বন্ধ অর্কর। মুখটা ওপরে তুলে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল, না। মাধবীলতা বলল, ‘ঘরে চল। ওহো একটু দাঁড়া। কল থেকে অসাড়ে জল পড়ছিল। মাধবীলতা আঁজলা করে তাই তুলে ছেলের মুখে ঘাড়ে বুলিয়ে দিল। তারপর ধরে ধরে নিয়ে এল ঘরে।
অনিমেষ তখনও ঘুমাচ্ছে। ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে পাখা নিয়ে এল মাধবীলতা। মৃদু বাতাস করতেই আবার বমির দমক এল। মাধবীলতা দ্রুত একটা খালি কৌটো ওর মুখের কাছে এগিয়ে ধরতেই সেটা ব্যবহার করল অর্ক। মাধবীলতা ওর বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে মনে হল গা-টা গরম গরম। সে অর্কর মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, ‘কিছু খেয়েছিলি বাইরে?’ অর্কর কষ্ট হচ্ছিল খুব। সে মাথা নাড়ল, না।
মাধবীলতা উঠে আলো জ্বাললো। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘অসুস্থ শরীর তবু বেরুনো চাই। কটা দিন ঘরে বসে থাকলে পৃথিবীটা যেন আর চলছিল না।’
অর্ক কিছুতেই গা গুলানি ভাবটাকে এড়াতে পারছিল না। চোখ বন্ধ করলেই তিনটি বীভৎস বুড়ি অশ্লীলভাবে নৃত্য শুরু করে দেয় চোখের পাতায়। আর তখনই বমি বমি বোধটা বেড়ে ওঠে। মাধবীলতা পাশে বসে বলল, ‘কেমন লাগছে?’ ‘বমি পাচ্ছে মা।’ অর্ক দু’হাতে মাধবীলতাকে আঁকড়ে ধরল।
মাধবীলতা অসহায় চোখে ছেলের দিকে তাকাল। হঠাৎ অর্ক যেন ছোট্টটি হয়ে গিয়েছে। সেই পুরুষালি গন্ধ এবং শরীরের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আলাদা হওয়া ব্যাপারটা এখন যেন উধাও। সে ছেলের শরীর হাতের বন্ধনে রেখে বলল, ‘একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর বাবা, আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু পরমুহূর্তেই অর্কর শরীরটা আবার কেঁপে উঠল, ‘বমি পাচ্ছে মা।’
মাধবীলতা কৌটোটা এগিয়ে দিল, কিন্তু কিছুই বের হল না। এবার প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল মাধবীলতা। অর্কর হাত এবং পা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে অথচ শরীরে উত্তাপ। সে অনিমেষকে ডাকল, ‘শুনছো! এই একটু উঠবে?
অনিমেষ ঘুমভাঙ্গা মাত্র উত্তেজনাটা ঠাহর করতে পারল না। কটা বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করামাত্র মনে হল মাধবীলতার গলাটা অন্যরকম লাগছে। সে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘কি হয়েছে?’
‘ছেলেটা কেমন করছে! তুমি দ্যাখো, আমি ডাক্তারকে ডেকে আনি।’ মাধবীলতা শাড়িটাকে ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল।
‘কটা বাজে?’
‘জানি না। দুটো তিনটে হবে হয়তো।’
‘এত রাত্রে তুমি একা বাইরে যাবে, পাগল হয়েছ?’
‘কে যাবে?’
‘কেন, খোকার কি হয়েছে?’
‘বমি করছে বারবার আর হাত পা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে।’
‘সেকি!’ অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ক্রাচ টেনে নিল, তোমার যাওয়া ঠিক হবে না, আমি যাচ্ছি। ঠিক কোন জায়গায় বলে দাও।
মাধবীলতা চমকে উঠল, ‘তুমি যাবে? পাগল!’
‘আঃ, বোকামি করো না। আমি যখন ট্রাম রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারছি তখন পাড়ার ডাক্তারকে ডেকে আনতে নিশ্চয়ই পারব।’ অনিমেষ টলতে টলতে মেঝেতে দাঁড়াল।
অনিমেষের গলায় যে জেদ তা মাধবীলতাকে দ্বিধায় ফেলল । বলল, ‘তুমি কি পারবে?’
‘কথা বাড়াচ্ছ শুধু শুধু। রাস্তায় এখন গাড়ি নেই অতএব মুশকিল কি আছে। আমি এখানে থাকলে খোকাকে ভাল করে দেখতেও পারব না। তোমারই থাকা উচিত।’
বেশ অনিচ্ছাতেই মাধবীলতা ডাক্তারের বাড়িটা বুঝিয়ে দিল অনিমেষকে। দরজা পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার মুহূর্তে অনিমেষ শুনল ছেলে ঘোরের মধ্যে বলছে, ‘বমি পাচ্ছে, মা।’
ঠুক ঠুক করে সরু গলি দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে অনিমেষ তিন চারবার দাঁড়ালো। কোমরে খচ খচ করছে। বেশ চিনচিনে ব্যথা! এটা আবার এল কোত্থেকে? দাঁড়ালে টের পাওয়া যাচ্ছে না, হাঁটলেই হচ্ছে। গলিতে একটাও মানুষ নেই। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন এখন ঘুমাচ্ছে। গলির মুখে কেউ একজন বসে আছে। একটা গোল পুঁটুলির মত। অনিমেষ পাশে আসা সত্ত্বেও সে মুখ তুলল না। মোক্ষদাবুড়ি। ‘কে যায়’ প্রশ্নটা আজ শুনতে পেল না অনিমেষ। নাতি মারা যাওয়ার পর থেকেই বুড়ি দিনরাত এরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকে গলিতে। অনিমেষ ফুটপাথে উঠে এল। খাঁ খাঁ করছে ঈশ্বরপুকুর লেন। এই দৃশ্য কখনও চোখে পড়েনি তার। রাস্তায় আলোগুলোকে বিবর্ণ দেখাচ্ছে। চায়ের দোকানটাও বন্ধ শুধু তার বাইরে গুঁড়ো কয়লা চাপা দেওয়া উনুনটা একটা লালচে আভা ছড়াচ্ছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু গা ছমছম করলেও অনিমেষের বেশ ভাল লাগছিল। হঠাৎ মনে হল, সমস্ত পৃথিবীটাই যদি এইরকম নিঃসঙ্গ, নির্জন হত। অনেক, অনেকদিন পরে স্বৰ্গছেঁড়া চা বাগানের নদীর ধারটার কথা মনে হল আজ।
বন্ধ দরজায় তিন, চারবার আওয়াজ করেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অনিমেষ এবার সজোরে কড়া নাড়ল। শব্দটা নিস্তব্ধ রাত্রে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল অনিমেষের। যেন ঈশ্বরের দরজায় বারংবার মাথা ঠুকেও তার দয়া পাওয়া যাচ্ছে না; সে এবার চিৎকার করল মরিয়া হয়ে, ‘ডাক্তারবাবু।’
কোন সাড়া নেই। অনিমেষ আবার চিৎকার করার পর ওপরের একটা ঘরে আলো জ্বলল, ‘কে?’ জানলায় একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। পেছনে আলো থাকায় মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না অনিমেষ। অনেকদিন বাদে এমন গলা খুলে চিৎকার করার পর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে। সে গলা তুলে বলল, ‘ডাক্তারবাবুকে ডেকে দেবেন?’
‘কি হয়েছে? ওঁর শরীর ভাল নেই।’
‘আমার ছেলে খুব অসুস্থ। একবার যদি দয়া করে আসেন।’ অনিমেষ বিনীত হল।
মহিলা জানলা থেকে সরে গেলেন। তারপর মিনিট দুয়েক জানলা ফাঁকা। অনিমেষ ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। লোকটা যদি না যায় তাহলে জোর করার তো কোন উপায় নেই। এই সময় খালিগায়ে লুঙ্গিপরা এক ভদ্রলোক জানলায় এসে দাঁড়ালেন, ‘কি হয়েছে?’
‘হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, শরীর গরম আর খুব বমি করছে।’ ওপর দিকে মুখ তুলে অনিমেষ নিবেদনের ভঙ্গীতে জানাল। এইসময় মহিলা আবার ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় বাড়ি?’
‘তিন নম্বরে।’
‘ওঃ, বস্তি! ডাক্তারের প্রতিক্রিয়া খুব সহজেই বোঝা গেল। বোধ হয় কোন অজুহাত দেখাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই মহিলা বলে ফেললেন, ‘খোঁড়া লোকটা নিশ্চয়ই খুব বিপদে পড়ে এসেছে। তোমার যাওয়া উচিত।’
লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি চাপিয়ে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, ‘রোগী আপনার কে হয়?’
‘ছেলে।’ অনিমেষ চেষ্টা করছিল ডাক্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে। কিন্তু একটু জোর পড়তেই চিনচিন ব্যথাটা শুরু হল। সে দাঁড়িয়ে যেতেই ডাক্তার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হল? অনিমেষ দেখল ডাক্তার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন?’
‘কিছু না, চলুন।’
‘হাঁটুতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, সামান্য।’
‘কি করে হল এরকম? আপনাকে কখনও এ পাড়ায় দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’ অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। নিজের ঘরের দরজা অবধি আসতেই ঘেমে নেয়ে গিয়েছিল অনিমেষ। ঘরে ঢুকে মাধবীলতাকে বলল, ‘ডাক্তারবাবু এসেছেন।’ তারপর খাটে প্রায় এলিয়ে বসল। শরীরটার যে কিছুই অবশিষ্ট নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। মাধবীলতা ডাক্তারকে অর্কর কাছে নিয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে বলুন?’ মাধবীলতা যা যা ঘটেছিল সবই বলল। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন। অর্কর জ্বর বেশ বেড়েছে। ঘোরের মধ্যে মাঝে মাঝেই বলছে, ‘বমি পাচ্ছে, মা। ডাক্তার সেটা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কখন শেষবার বমি করেছে? ওই কৌটোটা দেখি।’
‘ও যখন আপনাকে ডাকতে গেল তার একটু আগে। তারপর এক কথা মাঝে মাঝে বলছে কিন্তু আর বমি করছে না।’ মাধবীলতা কৌটোটাকে দেখালো। ডাক্তার বললেন, ‘কিছুই তো বের হয়নি। বাইরে কিছু খায়নি বললেন না?’
‘হ্যাঁ। তাই বলেছে।’ মাধবীলতা উদগ্রীব হয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বললেন, এখন তো কোন ওষুধের দোকান খোলা পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। শ্যামবাজারের মোড়ে—। না, থাক। ওটা বোধ হয় খোলা থাকে না। আমি দুটো ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। দু’ ঘণ্টা পর পর দুটো দেবেন। মনে হয় জ্বরটা কমবে। এভাবে কিছু না শুনে রোগ ঠাহর করা মুশকিল। কাল সকালে খবর দেবেন। ওষুধ বের করে সামনে রেখে ডাক্তারবাবু উঠলেন। মাধবীলতা ব্যাকুল গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন ভয় নেই তো ডাক্তারবাবু?’
ডাক্তার মাথা নাড়লেন, ‘মনে হয় না। পেটে উইণ্ড জমেনি। প্রেসার ঠিক আছে। মাথায় জলপট্টি দিয়ে যান যতক্ষণ জ্বর না কমে। এর আগে আপনি এই ছেলের জন্যে ওষুধ নিতে গিয়েছিলেন না?’ ডাক্তারবাবুর কপালে ভাঁজ।
‘হ্যাঁ।’ মাধবীলতা নিচু গলায় বলল।
‘এ যে আপনার ছেলে তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, আমি আসছি।’
‘একটু দাঁড়ান।’ মাধবীলতা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে এগিয়ে ধরল, ‘এতে হবে?’
‘ঠিক আছে। ডাক্তারবাবু পা বাড়াচ্ছিলেন মাধবীলতা কথা বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, ওকে আমার ছেলে বলে ভাবতে আপনার কষ্ট হচ্ছে কেন?’
ডাক্তারবাবু থতমত হয়ে গেলেন। তারপর কোনরকমে বললেন, ‘এই বস্তিতে আপনাকে বেমানান লাগে কিন্তু ওকে এই বস্তির ছেলে বলেই মনে হয়। কিছু মনে করবেন না।’
‘বমি পাচ্ছে, মা।’ অর্ক বিড়বিড় করল।
মাধবীলতা ছুটে এল ওর কাছে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুই ঘুমিয়ে পড়। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়ে গেছেন, ওষুধ খেলেই সেরে উঠবি।’
দরজা থেকে ডাক্তারবাবু ফিরে এলেন, ‘ওসব চাপা দেওয়ার কোন দরকার নেই। আপনি উঠুন। একটা ছোট বালতিতে জল আর তোয়ালে নিয়ে আসুন। ব্যাগটাকে মাটিতে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলেন ভদ্রলোক। মাধবীলতা এতটা আশা করেনি। সে চকিতে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বালতি আর গামছা নিয়ে ফিরে এসে দেখল ডাক্তারবাবু অর্কর শরীর থেকে সমস্ত চাপা সরিয়ে ফেলেছেন। এমন কি গেঞ্জিটা পর্যন্ত নেই। গামছাটা ভাল করে জলে ডুবিয়ে সেই ভেজা গামছা দিয়ে অর্কর বুক-গলা-মাথা মুছিয়ে দিতে লাগলেন ডাক্তার। মাধবীলতা বলল, ‘আমাকে দিন, আমি করছি।’ ডাক্তার ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ওষুধটা গুড়ো করে একটা কাপে জল মিশিয়ে আনুন।’
জলে গোলা ট্যাবলেট খুব সাবধানে বেঁহুশ অর্কর জিভে ঢেলে দিলেন ডাক্তার। তারপর আধ ঘণ্টা ধরে শুধু জলেভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া চলল। অনিমেষ ততক্ষণে কিছুটা স্থির হয়েছে। ও দেখছিল এই ঘরে দুটো মানুষ সমানে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তার নিজের ছেলে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে অথচ সে কোন কাজেই লাগছে না। এখন আর পায়ের ব্যথাটা নেই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ওটা চলে যাচ্ছে। সে বলল, ‘এবার আমাকে দাও, আমি হাওয়া করি খোকাকে।’
পাখা বন্ধ না করে মাধবীলতা বলল, ‘তুমি পারবে না, কষ্ট হবে।’
‘পারব।’ নিজের অজান্তে গলাটা চড়ে গেল অনিমেষের। অবাক চোখে মাধবীলতা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’ বলে পাখাটা মাটিতে রেখে সরে বসল।
ক্রাচে ভর করে নিচে নামল অনিমেষ। তারপর শরীরটাকে টেনে নিয়ে এল অর্কর মাথার কাছে, এসে পাখা তুলে নিল হাতে।
ডাক্তারবাবু এবার উঠলেন, মনে হচ্ছে আর চিন্তার কোন কারণ নেই। এখন অঘোরে ঘুমুবে ও যাহোক, কাল সকালে খবর দেবেন।
এইসময় বিড় বিড় করে উঠল অর্ক। তারপর পাশ ফিরে শুতে শুতে কিছু বলল। অনিমেষ তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ল ওর দিকে, ‘কষ্ট হচ্ছে? কিছু বলছিস?’
অর্কর চোখ বন্ধ। সেই অবস্থায় ঠোঁট কাঁপল, ‘বমি পাচ্ছে, মা।’ তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। ওর মুখ এখন বেশ শান্ত। মাধবীলতা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই এক কথা ডাক্তারবাবু, অথচ বমি করছে না।
ডাক্তারবাবু হাসলেন। তারপর চলে যাওয়ার আগে বললেন, ‘ভালই তো, বমি করুক। বমি করলে সব সাফ হয়ে যায়।’
ঝড় বয়ে গেল যেন সারারাত ধরে। ওরা দুজনে ছেলের পাশে চুপচাপ বসে। মাধবীলতা বলেছিল অনিমেষকে, ‘তুমি এবার শুয়ে পড়, আমি দেখছি।’
‘না, ঘুম আসবে না। অনিমেষ কাটিয়েছিল অনুরোধটা। মাধবীলতাকে সে আর হাওয়া করতে দেয়নি। অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধবীলতা বলল, ‘তুমি কষ্ট করলে আমি আরামে ঘুমুতে পারব? কি মনে হয় তোমার।’
হাত থামিয়ে অনিমেষ বলেছিল, ‘মুশকিল তো এইটেই। সমস্ত কষ্টের ইজারা যেন তুমি নিয়ে বসে আছ। যা কিছু ঝামেলা তা তুমি যেন জোর করে সামলাবে। আসলে দুঃখের মধ্যে না থাকলে তোমার আজকাল খারাপ লাগে! লোকে শুনলে বলবে মেয়েটা কত কষ্ট পাচ্ছে, আহা, এত দুঃখ চোখ চেয়ে দেখা যায় না।’
মাধবীলতা হেসে বলল, ‘তাহলে লোকের মুখ চেয়ে এখন তুমি খোকাকে বাতাস করছ?’
‘আমি তাই বলেছি?’ অনিমেষ উগ্র হতে গিয়েও পারল না।
মাধবীলতা হাত বাড়িয়ে অর্কর কপাল স্পর্শ করল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘এসবে আমার কষ্ট হয় না। তুমি ঠিকই বলেছ। কত মেয়ের তো কতরকম শখ থাকে। আমার ধরো এইটেই। তোমাদের জন্যে কিছু করছি। একটু আগে ডাক্তারবাবু বলে গেলেন খোকাকে নাকি আমার ছেলে বলে ভাবতে পারেননি। আচ্ছা, আমার ছেলে কিরকম হলে মানাতো?
‘মুশকিল! কে কি বলল তাই নিয়ে ভাবছ কেন?’
‘ভাবিনি। মাধবীলতা অন্যমনস্ক হয়ে বলল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ায় হেসে বলল, ‘খোকা আমাকে কথা দিয়েছে যে আর কখনও খারাপ কথা বলবে না।’
অনিমেষ অবাক হল, ‘কখন কথা দিল?’
‘প্রথম রাত্রে। তখন ও ভালই ছিল।’
‘হঠাৎ?’
‘কি জানি একটা স্বপ্ন দেখে খুব ভয় পেয়ে আমাকে শুতে বলেছিল পাশে। তারপরই আমার মনে হয় ও কোন মানসিক আঘাত পেয়েছে।’
‘মানসিক আঘাত? প্রেম ট্রেম?’
‘দূর! অন্য কিছু। কি সেটা তাই ধরতে পারছি না। এবার পাখাটা দাও।’ হাত বাড়ালো মাধবীলতা। অনিমেষ সত্যিই আর পারছিল না। এবার নিঃশব্দে পাখাটা দিয়ে দিল। মাধবীলতা বলল, ‘তাহলে কষ্ট করতে দিলে শেষ পর্যন্ত।’ হঠাৎ একটা আবেগ অনিমেষকে কাঁপিয়ে দিল। সে দুহাতে মাধবীলতাকে বুকে টানবার চেষ্টা করল। মাধবীলতা একটু হকচকিয়ে গেল প্রথমটা। তারপর একটু জোরেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ছি! খোকা রয়েছে না এখানে?’
অনিমেষ একটু অপরাধীর চোখে ঘুমন্ত অর্ককে দেখল। অঘোরে ঘুমাচ্ছে এখন। চোখ বন্ধ, ঠোঁটে তৃপ্তির ছাপ। এতবড় অসুস্থ ছেলের সামনে এরকম করা উচিত হয়নি বুঝতে পেরে সে মাথা নিচু করে শরীরটাকে খাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। মাধবীলতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মাধবীলতা তার বুকের ওপর হাত রাখল, ‘রাগ করলে?’
‘না।’ অনিমেষ কোনরকমে জবাব দিল।
মাধবীলতা একবার অনিমেষের বুকে মাথা রেখেই চট করে সরে এল। এসে ছেলেকে ধীরে ধীরে বাতাস করতে লাগল।