তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে
তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে বারান্দায় এসে বলল, লায়লা আমাকে চা দে।
চা তৈরিই ছিল। লায়লা চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। তারেক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোর অবস্থা কী?
লায়লা বিস্মিত গলায় বলল, আমার আবার কী অবস্থা?
পড়াশোনার অবস্থা।
পড়াশোনার অবস্থা খুবই খারাপ। এইবার পরীক্ষা দিলে পাস করতে পারব না।
তাহলে এ বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর দে।
ভাইয়া আর কিছু বলবে?
না। সিগারেটের প্যাকেট আর দেয়াশলাই এনে দে।
লায়লা সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই এনে দিল। তারেক বলল, টগর আর পলাশকে বই নিয়ে বসতে বল। আমি পড়া দেখিয়ে দেব।
তারেক চুকচুক করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নামাযের সময় সে মাথায় টুপি পরেছিল, সেই টুপি এখনো খোলা হয় নি। টুপি মাথায় তাকে শান্ত সমাহিত মনে হচ্ছে। চা খেতে খেতে সে পা নাচাচ্ছে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকালীন এই চায়ের আসর তার ভালো লাগছে।
একমাসের ওপর হলো রীনা নেই। তার অনুপস্থিতিতে বড় ধরনের যে সমস্যার আশঙ্কা করা গিয়েছিল এখন মনে হচ্ছে সে আশঙ্কা অমূলক। সে না থাকায় বরং কিছু সুবিধা হয়েছে। তারেক ঘুমাচ্ছে একা। বেশ হাতপা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারছে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খেতে পারছে। কথা বলার কেউ নেই। টুথপেস্টের মুখ লাগানো হয় নি, ব্রাশটা বেসিনে পড়ে আছে কেন এই নিয়েও বলার কেউ নেই। রীনা মশারি না খাটিয়ে ঘুমাতে পারত না। তারেকের কাছে মশারি ছিল অসহনীয় যন্ত্রণা। এখন মশারি খাটাতে হচ্ছে না। ফুলম্পিডে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থাকলে মশার কাছে ভিড়তে পারে না। মানুষের কাছে ফ্যানের বাতাসটা আরামদায়ক। মশাদের কাছে সেই বাতাস হলো টর্নেডো; প্রচণ্ড টর্নেডোর সময় মানুষ যেমন ডিনার খেতে বসে না, মশারাও তেমনি রক্ত খেতে আসে না। এই সহজ সূত্র সে রীনাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে–রীনা বুঝতে চায় নি। এখন আর বোঝাবুঝির কিছু নেই।
মনোয়ারা ছেলের ওপর রাগ করে চলে গেছেন। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার হয়েছে। তারেক তার মাকে খুবই পছন্দ করে। মার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা না বললে তার দমবন্ধ লাগে। মা না থাকার একটা ভালো দিকও আছে। মার ঘরটিকে তারেক বর্তমানে নামাযঘর করে ফেলেছে। পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় এখন শুধু দু ওয়াক্ত করে ‘ নামায পড়া হচ্ছে। শুরু হিসেবে এটা খারাপ না।
রানার অভাব লায়লা অনেকটা পূরণ করেছে। রান্নাবান্নার ব্যাপারটা দেখছে। টগরপলাশকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসার কাজও করছে। কলেজে যাচ্ছে খুব কম। মনে হয় এ বছর বি.এ. পরীক্ষা সে ড্রপই করবে। সংসারের জন্যে এটা ভালো। বি.এ. পরীক্ষার চেয়ে সংসার অনেক বড়।
টগর-পলাশের ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মা নেই কেন? কিবে আসবে?’ এ জাতীয় কথা তারা তারেককে এখনো জিজ্ঞেস করে নি। তবে লায়লাকে এবং হাসানকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করছে। তারা কী জবাব দিচ্ছে কে জানে। সময় এবং সুযোগমতো একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। অবশ্যি জিজ্ঞেস না করলেও হয়। এরা ঝামেলা করছে না। এটাই বড় কথা। এমন কি হতে পারে মা ঘরে না থাকায় তারা আনন্দিত? হতে পারে। খাওয়া নিয়ে তাদের বকাঝকা কেউ করছে না, চড় থাপ্নড় মারছে না। দেয়ালে ছবি আঁকছে। কেউ কিছু বলছে না। প্রায়ই স্কুল কামাই করছে। মা থাকলে সে উপায় ছিল না। স্কুলে যেতেই হতো।
তারেকের আজকাল প্রায়ই মনে হয় মানুষের সংসার না থাকাই ভালো। আর থাকলেও সে সংসার হবে সাময়িক ধরনের সংসার। সেই সংসারে স্ত্রী পুত্ৰ কন্যা সবই থাকবে। মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে যাওয়া, কয়েকদিন থেকে চলে আসা। সব পুরুষরা থাকবে হোটেলে। সবার জন্যে আলাদা আলাদা ঘর। ঘরে এটাচড বাথ থাকবে, টিভি থাকবে। খাবারের সময় হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যাবে। ছেলের জন্মদিন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সিরি এইসব উৎসবে সংসারে ফিরে যাওয়া! আবার ফিরে আসা।
রীনা চলে যাবার পর লাবণীর সঙ্গে তারেকের আর তেমন যোগাযোগ হয় নি। লাবণী একটা চিঠি লিখেছিল। কেমন আছেন, ভালো আছেন টাইপ চিঠি। চিঠির জবাব দেয়া হয় নি। তারেক রোজই একবার ভাবে চিঠির জবাব দেবে–শেষে আর দেয়া হয় না। রাতে ঘুম পেয়ে যায়। ইদানীং তার ঘুমাও খুব বেড়েছে। ভাত খাবার পর থেকে হাই উঠতে থাকে।
দুই পুত্রকে নিয়ে তারেক পড়াতে বসল। বাচ্চা দুটি বিছু হয়েছে। যমজ বাচ্চারা বিষ্ণু ধরনের হয় এটি সনাতন সিদ্ধ ব্যাপার। এরা দুজন যমজ না হলেও বিক্ষুর ওপরেও এক ডিগ্রি বিষ্ণু। হোমওয়ার্কের খাতায় ভূতের ছবি আঁকা। মাথা থেকে এইসব দুষ্টামি দূর করতে হবে। কঠিন হওয়া যাবে না। কাঠিন্য যে-কোনো সমস্যার বড় বাধা।
কেমন আছিস রে টগর?
গুড আছি বাবা।
পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
গুড হচ্ছে।
কথায় কথায় গুড বলছিস কেন?
মিস বলেছে বাসায় সব সময় ইংরেজি বলতে হবে।
হোমওয়ার্কের খাতায় এটা কীসের ছবি?
ভূতের ছবি। ভূতের গলা এত লম্বা থাকে নাকি?
এটা সাপভূত তো এজন্যে গলা লম্বা। সাপভূতদের গলা লম্বা হয়।
হোমওয়ার্কের খাতায় ছবি আঁকছিস কেন?
ছবি আঁকার খাতা শেষ হয়ে গেছে এই জন্যে।
মিস রোগ করবে।
মিস খুব এংরি হবে। রাগের ইংরেজি হলো এংরি।
এংরি বানান কী?
বানান জানি না।
পলাশ তুই জানিস?
জানি না।
গুড বানান জানিস?
জানি, কিন্তু বলব না।
বলবি না কেন?
তুমি তো আমাদের মিস না। মিস বানান জিজ্ঞেস করলে বলতে হয়।
আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় না?
না।
তারেক সিগারেট ধরাল। এদের পড়াশোনা করানো মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। একজন টিচার রেখে দিতে হবে। বাড়তি খরচ, তাতে অসুবিধা হবে না। সংসারে মানুষ কমে গেছে। লায়লার বিয়ে হলে আরো কমবে। তার বেতনও কিছু বাড়বে। খুব শিগগিরই প্রমোশন হবার কথা। পলাশ বলল, বাবা সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়।
কে বলেছে, মিস?
না, মা বলেছে।
মার প্রসঙ্গ চলে আসায় তারেক একটু শঙ্কিত বোধ করল। এই প্রসঙ্গ আলোচনায় না আসাই বোধহয় মঙ্গলজনক। টগর গম্ভীর গলায় বলল, যে সিগারেট খায় সে মারা যায়। আর সিগারেট খাবার সময় আশেপাশে যারা থাকে তারাও মারা যায়। তুমি সিগারেট খেলে আমরা মারা যাব।
কে বলেছে, তোদের মা না মিস?
মা বলেছে। সিগারেট যেমন খারাপ, চকলেটও খারাপ। চকলেট খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। এক রকম পোকা এসে দাঁত খেয়ে ফেলে। দাঁতের ইংরেজি হলো টুথ।
তারেক সিগারেট ফেলে দিল। মার প্রসঙ্গ চলে এসেছে–এখন কি সেই বিষয়ে দুএকটা কথা বলা ঠিক হবে? না পুরো বিষয়টা নিয়ে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
টুথের বানান কী?
ট-উ-কারে টু, থ—টুথ।
বাংলা বানান না। ইংরেজি?
জানি তোমাকে বলব না।
তারেক ইতস্তত করে বলল, তোর মা যে আসছে না। এ নিয়ে কী করা যায় বল তো?
টগর-পলাশ দুজনই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তারেক বাচ্চাদের দিকে না। তাকিয়ে বলল, তোর মা যে আসছে না, এ জন্যে নিশ্চয়ই তোদের মন খারাপ। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।
পলাশ বলল, দেখা হয় তো।
পলাশের এই কথা বলা মনে হয় ঠিক হয় নি। টগর চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলেছে। তারেক বিস্মিত হয়ে দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
মা’র সঙ্গে দেখা হয়?
হুঁ।
বাসায় আসে নাকি?
না। স্কুলে যায়।
স্কুলে যায়?
একদিন মা তার বাসায় নিয়ে গেল।
বাসায় নিয়ে গেল মানে–বাসা ভাড়া করেছে? বাসা কোথায়?
জানি না।
বাসাটা কেমন?
সুন্দর।
সে একাই থাকে না। আরো লোকজন থাকে?
জানি না।
জানিস না মানে কী? বাসায় আর কাউকে দেখিস নি?
উঁহুঁ।
তোদের মা যে তোদের দেখতে আসে, তোরা যে তার বাসায় গিয়েছিলি এটা এ বাড়ির আর কে জানে?
সবাই জানে। শুধু তুমি জান না।
মার বাসায় কীভাবে গিয়েছিল–সে এসে নিয়ে গিয়েছিল?
চাচু নিয়ে গিয়েছে। আবার নিয়ে এসেছে।
হাসান নিয়ে গেছে?
হুঁ।
তারেক অ্যাশট্রেতে ফেলে দেয়া আধা-খাওয়া সিগারেট তুলে নিল। তার দুই পুত্ৰ তার দিকে তাকিয়ে আছে। টগর বলল, ব্যাটম্যান মানে কী, তুমি জানি বাবা?
তারেক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, না।
ব্যাটম্যান মানে হলো বাদুরমানুষ। ব্যাট মানে বাদুর। ম্যান মানে মানুষ।
ও।
বাদুরমানুষ কিন্তু উড়তে পারে না। শুধু লাফ দিতে পারে। একটা বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটা বাড়ির ছাদে যায়। আর ঘোস্ট মানে কী জান?
হুঁ।
ঘোস্ট মানে ভূত। ভূত কিন্তু পৃথিবীতে হয় না। শুধু কার্টুনে হয়। আমাদের মিস বলেছে। অদৃশ্য মানব কাকে বলে তুমি কি জান বাবা?
না।
অদৃশ্য মানবকে চোখে দেখা যায় না। অদৃশ মানব কিন্তু ভূত না। মানুষ।
হুঁ।
অদৃশ মানব চোখে দেখা যায় না, এই জন্যে এদের ছবিও আঁকা যায় না। কিন্তু পলাশ তো বোকা–এই জন্যে সে অদৃশ্য মানবের ছবি এঁকেছে। ছবি দেখবে বাবা?
তারেক ‘হুঁ’ বলল। কিন্তু উঠে চলে গেল। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না-সবাই মিলে কি তাকে বয়কট করেছে? হাসানের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা দরকার; হাসানের সঙ্গে তার দেখা ইদানীং হচ্ছে না। হাসানের ব্যস্ততা খুব বেড়েছে। কোনো একটা কাজটাজ বোধহয় করছে। কী কাজ তা এখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। যে কাজই করুক খুব পরিশ্রমের কাজ নিশ্চয়ই। রোদে পুড়ে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। সস্তা সিগারেটও মনে হয় প্রচুর খাচ্ছে। হাসান পাশ দিয়ে গেলে মনে হয় তামাকের একটা ফ্যাক্টরি হেঁটে চলে গেল। জর্দা দিয়ে পানও খাচ্ছে–দাঁত লাল–মুখ দিয়ে ভুরিভুরে জর্দার গন্ধ আসে।
হাসান দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তারেক ধাক্কা দিতেই উঠে এসে দরজা খুলল।
ঘুমোচ্ছিলি?
না। শুয়েছিলাম।
দশটা বাজতেই শুয়ে পড়লি, শরীর খারাপ?
জ্বর জ্বর লাগছে।
রোদে রোদে ঘুরলে জ্বর তো লাগবেই-ভদ্রে মাসের রোদে তাল পেকে যায়, মানুষ তো পাকবেই। ভদ্র মাসে রাস্তাঘাটে মানুষ ঘোরে তাদের বেশির ভাগই পাকা মানুষ।
সিগারেট লাগবে ভাইয়া?
না সিগারেট লাগবে না। এক প্যাকেট কিনেছিলাম, সাতটা খেয়েছি। এখনো তেরটা বাকি আছে। এলাম তোর সাথে একটু গল্প-গুজব করি, বাতিটা জ্বালা।
হাসান অনিচ্ছার সঙ্গে বাতি জ্বালোল। তার জ্বর এসেছে। ভালো জুর। দুপুরে সে কিছু খায় নি। রাতেও খায় নি। ক্ষিধেয় নাড়ি পাক দিচ্ছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে কোনো খাবার সামনে আনলেই বমি হয়ে যাবে।
তারেক বসতে বসতে বলল, তোর ভাবি ঝোঁকের মাথায় ফট করে চলে গেল। এই নিয়ে কারো সঙ্গে কথাও বলা হয় নি।
কথা বলার কী আছে?
সেটাও ঠিক কথা বলার কী আছে? লজ্জাজনক ব্যাপার।
তোমার জন্যে লজ্জাজনক তো বটেই। যা ঘটেছে তোমার জন্যেই ঘটেছে।
তোর ভাবি কোথায় আছে কিছু জানিস?
শ্যামলীতে আছে। তার এক বান্ধবীর বাড়িতে।
ও আচ্ছা।
ঠিকানা চাও?
না ঠিকানা দিয়ে কী করব?
তুমি যদি মনে করা–ভাবির সঙ্গে কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনবে।
সেটা ঠিক না। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনো কাজের কথা না। আমি তাকে চলে যেতে বলি নি–সে চলে গেছে। আমি যদি তাকে চলে যেতে বলতাম তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার ছিল। যদি আসার হয় নিজেই আসবে।
হাসান হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাবি কঠিন জিনিস। নিজ থেকে আসবে না।
না এলে কী আর করা। বাচ্চাদের খানিক সমস্যা হবে–এই আর কী? সমস্যা তো পৃথিবীতে থাকেই। সমস্যা নিয়েই আমাদের বাস করতে হয়।
তুমি কি তোমার অফিসের ওই মহিলাকে বিয়ে করবে?
বিয়ের কথা আসছে কেন?
বিয়ে হচ্ছে না?
তারেক সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সহজ গলায় বলল, টগরের কাছে শুনলাম–ওদের মার সঙ্গে দেখা হয়–এটা ভালো। আর্লি ষ্টেজে মার ভালোবাসা দরকার। মায়ের ভালবাসা ভিটামিনের মতো কাজ করে। যাক।—সময়ে-অসময়ে ভিটামিনটা পাচ্ছে।
হুঁ।
ও কি চাকরি-বাকরি কিছু করছে?
জানি না। হয়তো করছে।
চাকরির বাজার খুবই টাইট–তবে মেয়েদের স্কোপ বেশি। বলিস ভালোমতো যোগাযোগ করতে। পত্রিকা দেখে এপ্লিকেশন করলে হবে না। সরাসরি উপস্থিত হতে হবে।
ভাইয়া আমার মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
দে একটা সিগারেট খাই। সিগারেটটা শেষ করে চলে যাব।
নিজের ঘরে গিয়ে খাও।
তোর এখানে খেয়ে যাই।
ভাইয়া তুমি কি ভাবিকে টেলিফোন করতে চাও? ভাবি যে বাড়িতে থাকে সেখানকার টেলিফোন নাম্বার আমার কাছে আছে।
টেলিফোন করে কী করব?
কী করবে তা জানি না। টেলিফোন নাম্বার আছে তুমি চাইলে দিতে পারি।
আচ্ছা দে রেখে দেই। তোর এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে রোদে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে গেছিস। ব্যাপার কী?
কোনো ব্যাপার না।
রোদে বেশি ঘুরবি না। চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রে খুব খারাপ। ঙ্কিনক্যানসার হয়।
হুঁ। ভাইয়া এই নাও ভাবির টেলিফোন নাম্বার। এখন চলে যাও। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরা–কথা বলতে ভালো লাগছে না।
হালকা ধরনের কথাবার্তা বললে বরং মাথা ধরাটা কমে। লাইট ডিসকাশন ওষুধের মতো কাজ করে।
ভাইয়া আমার বেলায় করে না। তাছাড়া আমাদের ডিসকাশন মোটেই লাইট হচ্ছে न्म।
তারেক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে আরেকটা জরুরি কথা ছিলএখন মনে পড়ছে না।
মনে পড়লে বলবে।
যখন মনে পড়বে তখন দেখা যাবে তুই পাশে নেই। আর তোর সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন আর জরুরি কথাটা মনে পড়বে না। মানুষের জীবন মানেই এই জাতীয় জটিলতা।
হুঁ।
মানুষের মনে যে বয়সে নানান ধরনের শখ হয় সে বয়সে টাকা-পয়সা থাকে না। বুড়ো বয়সে যখন টাকা-পয়সা হয় তখন আর শখ থাকে না।
তোমার কী শখ?
ব্যাংককে গিয়ে একবার একটা ম্যাসেজ নেয়ার শখ ছিল। এই বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমার পরিচিত কয়েকজন ম্যাসেজ নিয়েছে। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। বিরাট একটা কাচের ঘরের পেছনে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ইয়াং মেয়েরা সেগোগুজে বসে থাকে। প্ৰত্যেকের আলাদা আলাদা নম্বর আছে। তোর একটা মেয়ে পছন্দ হলো–ধর তার নাম্বার তিন শ তের। তুই তিন শতের নাম্বারে একটা কার্ড…।
ভাইয়া চুপ কর। তোমার কাছ থেকে এ সব শুনতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এইসব তুমি কী বলছ?
কী বলছি মানে? খারাপ কী বলছি?
কী বলছি বুঝতে পারছি না? তোমার জীবনের সবচে’ বড় শখ একটা বেশ্যা মেয়ে তোমার গা দলাই মলাই করবে।
বেশ্যা মেয়ে বলছিস কেন? ওরা সব কলেজ-ইউনিভার্সিটির মেয়ে। স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলির মেয়ে। তাছাড়া এটাই যে আমার জীবনের সবচে’ বড় শখ তাও না। অনেকগুলো শখের মধ্যে একটা…।
ভাইয়া আমার খুব মাথা ধরেছে, তুমি এখন যাও।
শ্যাস্পেনের এত নামধাম শুনেছি। খেয়ে দেখার শখ ছিল–একটা বোতলের দামই শুনেছি। দু-তিন হাজার টাকা…।
ভাইয়া প্লিজ আমি আরেকদিন তোমার শখের কথাগুলো শুনবো।
তুই এমন রেগে গেলি কেন?
রাগি নি। আমি তো বললাম, আমার খুব মাথা ধরেছে।
কমলার মাকে বল এক বালতি গরম পানি করে দিতে। গরম পানি দিয়ে হট শাওয়ার নিলে শরীরটা হালকা হবে, ভালো ঘুম হবে।
আচ্ছা আমার যা করার করব তুমি যাও।
ফট করে রেগে গেলি। আশ্চর্য!
তারেক নিজের ঘরে ঢুকল। হাসানকে যে জরুরি কথাটা বলার ছিল সে কথাটা তখনি মনে পড়ল। তাকে গিয়ে সেই কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। অকারণে সে যেমন রেগে গেছে–দরজায় ধাক্কা দিলে সে হয়তো দরজাই খুলবে না। কথাটা হচ্ছে তার অফিসে একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। মেয়েটার নাম চিত্ৰলেখা। সে হাসানকে খুঁজছে। খুব নাকি জরুরি। একবার না, মেয়েটা টেলিফোন করেছে। দু’বার।
ঘুমোতে যাবার আগে তারেক একটা কাগজে বড় বড় করে লিখল–চিত্ৰলেখা। সকালবেলা এই কাগজটা দেখলেই তার মনে পড়বে। হাসানকে খবরটা দেয়া যাবে।
সবচে’ ভালো হতো এখন দিতে পারলে।
রীনাকে টেলিফোন করার কোনো ইচ্ছা তারেকের ছিল না। অফিসে এসে রুমাল বের করার জন্যে পকেটে হাত দিয়ে দেখে রীনার টেলিফোন নাম্বার লেখা কাগজ। টেলিফোন করলে কে ধরবে? রীনার বান্ধবী? নাকি রীনাই ধরবে? তারেক টেলিফোন করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না। তারপরেও কী মনে করে করল। দুটা রিঙের ভেতর না ধরলে সে রেখে দেবে।
দুটা রিং বাজতেই রীনা ধরল। গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো কাকে চাচ্ছেন? তারেক বলল, কে রীনা?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
কোনো ব্যাপার না। কেমন আছ?
ভালো আছি।
ও আচ্ছা এইটা জানার জন্যে। বাসার খবর ভালো–টগর পলাশ দুজনই ভালো আছে।
আচ্ছা।
হাসানের শরীরটা মনে হয় খারাপ। কাল রাতে জ্বরটির মনে হয় এসেছে ভাত খায় নি। রোদে রোদে ঘুরে চেহারাটাও খারাপ হয়ে গেছে। আমি বলেছি রোদে কম ঘুরতে।
ভালো।
লায়লার বিয়ের কথা হচ্ছিল–বিয়েটা হয়ে যাবে মনে হয়। ছেলে ভালো। বয়স সামান্য বেশি। ডিভোর্সড।
ও।
রকিব এসেছিল। ও এর মধ্যে দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। ঘুরেটুরে এসেছে। দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। আমি তো জানতামই না। তাজমহল দেখে এসেছে। জয়সলমীরও গিয়েছিল। উটের পিঠে চড়ে ছবি তুলেছে। আমার জন্যে জয়পুরী পাঞ্জাবি এনেছে। তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে। আমি হাসানকে বলব তোমাকে দিয়ে আসতে। ও তো তোমার বাসা চেনে।
আর কিছু বলবে?
না।
চিটাগাঙের ওই মেয়ে–লাবণীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
ও দুটা চিঠি দিয়েছিল। আগে জবাব দেই নি–কাল একটার জবাব দিয়েছি।
এর মধ্যে চিটাগাং যাও নি?
না।
কবে যাবে?–ঘুরে আসছ না কেন? লাবণী আর তার মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসা। সমুদ্র দেখিয়ে আন।
তারেক কিছু বলল না। রীনা বলল, টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। তারেক বলল, আচ্ছা! পরে কথা হবে। তুমি ভালো থেকে।
আমি ভালোই থাকব। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আচ্ছা শোন, আমি টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। আমার অফিসের গাড়ি এসে গেছে। হর্ন দিচ্ছে।
অফিসের গাড়ি এসেছে মানে তুমি কি চাকরি করছ নাকি?
সামান্য চাকরি করছি।
রিসিপশনিস্ট? শোন, রিসিপশনিক্টের কাজে কোনো প্রসপেক্ট নেই–অন্য কোনো লাইনে ঢোকার চেষ্টা কর।
আমি এখন রাখলাম।
তারেকের একটু মন খারাপ লাগছে। অফিসের ব্যাপারটা আর ভালোমতো জানা হলো না। কোন অফিস–কত বেতন কিছুই জানা হলো না। অফিসের টেলিফোন নাম্বারটাও নিয়ে রাখলে হতো।