জন্মদিনটা আনন্দের কেন, এই প্রশ্ন সোমনাথের আগে প্রায়ই মনে হতো। জন্মগ্রহণ করে শিশ, তো কাঁদে-তার সমস্ত জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণার সেই তো শুর। তবু সবাই বলে জন্মদিনে আনন্দ করতে হয়। অনেকদিন আগে মাকে এই প্রশ্ন করেছিল সোমনাথ। “জন্মদিনে আমি তো তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম, তবু তুমি ১লা আষাঢ়ে আনন্দ করো কেন?”
মা বলেছিলেন, “তুই চুপ কর। অন্যদিন হলে তোকে বকতাম।” জন্মদিনে ম কাউকে বকতেন না। বরং পায়েস রাঁধতেন।
তারপর এই বাড়িতে ১লা আষাঢ়ের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। জন্মদিনেই একদিন মৃত্যুর ঘন অন্ধকার নেমে এসেছিল যোধপর পার্কের বাড়িতে। ১লা আষাঢ় এখন শুধু সোমনাথের জন্মদিন নয়, মায়ের মৃত্যুদিবসও বটে।
আজ যে সোমনাথের জন্মদিন তা কে আর মনে রাখবে? ভোরবেলায় বিছানায় শুয়ে শয়েই ভাবছিল সোমনাথ। কবে কোনকালে উজ্জয়িনীর প্রিয় কবি আপন খেয়ালে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসকে কাব্যের মালা পরিয়ে অবিস্মরণীয় করেছিলেন। তারই রেশ তুলে বহু শতাব্দী পরে আজ ঘরে ঘরে বিরহ-মিলনের রাগিণী বেজে উঠবে। একই, পরে রেডিওতে মহাকবি ও তাঁর সষ্টি অমর চরিত্রের উদ্দেশে সংগীতাঞ্জলি শুরু হবে। কিন্তু কে মনে রাখবে, বেকার ব্যর্থ কবি সোমনাথ ব্যানার্জি ওই একই দিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিল? ছন্দের মন্ত্র পড়ে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসাকে সেও অমরত্ব দিতে চেয়েছিল।
জন্মোৎসবের আগের দিন থেকেই কত লোকের বাড়িতে অভিনন্দনের পালা শুরু হয়ে যায়। ফল আসে, ফোন আসে, রঙীন টেলিগ্রাম পৌঁছে দিয়ে যায় ডাকঘরের পিওন। কিন্তু সোমনাথের ভাগ্যে এসেছে দুঃসংবাদের ইঙ্গিত। হীরালাল সাহা যে দ-হাজার টাকা নিয়েছিল লাভ সমেত কালকেই তা ফেরত দেবার কথা ছিল। বউদিকে সোমনাথ একটা ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিল—১লা আষাঢ় তার একটা প্রীতি উপহার পাবার সম্ভবনা আছে। সোমনাথ এবার কোনো প্রতিবাদই শনবে না। কমলা বউদি বলেছিলেন, “বেশ। যদি সুখবর সত্যিই কিছু থাকে—নেবো তোমার উপহার। তোমার দাদাকেও শিক্ষা দেওয়া হবে। ভাবছেন, উনি ছাড়া আমাকে কেউ উপহার দেবার নেই।” কিন্তু গতরাত্রে হীরালালকে কিছুতেই খুঁজে পায়নি সোমনাথ। তিনবার অফিসে গিয়েও দেখা হলো না।
ভোরবেলায় বুলবুল একবার কী কাজে ঘরে ঢুকলো। সে কিন্তু কিছুই বললো না। সোমনাথের আজ যে জন্মদিন তা মেজদার বালিকাবধটি খবরও রাখে না। মেজদা যে সামনের সেপ্টেম্বরে অফিসের কাজে বিলেত যেতে পারে, সেই খবরটাই বুলবুল নিয়ে গেলো। বললো, “আমি ছাড়ছি না। যে করে হোক আমিও ম্যানেজ করবো বিলেত যাওয়াটা।”
সোমনাথ বললো, “চেষ্টা চালিয়ে যাও—প্রতিদিন দু ঘণ্টা ধরে ঘ্যান ঘ্যান করে দাদার লাইফ মিজারেবল করো।”
বিছানায় উঠে বসে ভীষণ বল মনে হচ্ছে সোমনাথের। এই বাড়ির সে কেউ নয়। যেন কিছুদিনের অতিথি হয়ে সে যোধপর পার্কে এসেছিল। নির্ধারিত সময়ের পরও অতিথি বিদায় নিচ্ছে না। এই ঘর, এই খাট, এই বিছানা, এই টেবিল, এই ফলকাটা চায়ের কাপ—এসবের কোনো কিছুতেই তার অধিকার নেই। ভদ্রতা করে গহস্বামী এখনও অতিথি আপ্যায়ন করছেন। সবাইকে সন্দেহ করছে সোমনাথ। ভয় হচ্ছে, কমলা বউদিও বোধহয় এবার ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।
দরজা খুলে সোমনাথ বাড়ির বাইরের বারান্দায় দাঁড়াতে যাচ্ছিল। এমন সময় রোগা পাকানো চেহারার এক বড়ো ভদ্রলোককে পুরানো অস্টিন গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেলো। দ্বৈপায়নবাবর খোঁজ করলেন ভদ্রলোক। বাবার সঙ্গে আলাপের জন্যে ওপরে উঠে যাবার আগে ভদ্রলোক আড়চোখে সোমনাথকে বেশ খুটিয়ে দেখে নিলেন।
ভদ্রলোক গত এক সপ্তাহের মধ্যে দু-তিনবার এলেন। বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কীসব কথাবার্তা বলেন।
বুলবুল মেজদার অফিস-টিফিনের জন্যে স্যান্ডউইচ তৈরি করছিল। সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “লোকটা কে?”
স্যান্ডউইচগুলো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মড়তে মড়তে বুলবুল ঠোঁট উল্টোলো। ওর মাথায় যে কোনো দুষ্টমি আছে তা সোমনাথ সন্দেহ করলো।
সোমনাথ বললো, “ঠোঁট উল্টোচ্ছ যে?”
আরও একপ্রস্থ ঠোঁট উল্টে বুলবুল বললো, “বারে! আমার ঠোঁট আমি উল্টোতে পারবো না?”
সোমনাথের এসব ভালো লাগছে না। বুলবুল বললো, “অধৈর্য হচ্ছো কেন? সময় মতো সব জানতে পারবে।”
সোমনাথ যে আরও রেগে উঠবে বুলবুল তা ভাবতে পারেনি। বেশ বিরক্ত হয়ে বলল এবার খবরটা ফাঁস করে দিলো। “অর্ধেক রাজত্ব যাতে পাও তার জন্যে বাবা কথাবার্তা চালাচ্ছেন, সেই সঙ্গে…বুঝতেই পারছো।” এই বলে বুলবুল রাগে গনগন করতে করতে নিজের শোবার ঘরে ঢুকে পড়লো।
রোগা বড়ো ভদ্রলোক আধঘণ্টা পরে বিদায় নিলেন। তারপরেই ওপরে বড় বউমর ডাক পড়লো। মিনিট দশেক পরে বাবার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা করে কমলা বউদি একতলায় নেমে এলেন। মেজদার সঙ্গে আড়ালে তাঁর কী সব কথাবার্তা হলো। বউদি আবার ওপরে উঠে গেলেন।
সোমনাথ বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে মেজদা ও বুলবুলের দাম্পত্য আলোচনা শুনতে পেলো। বুলবুল ফোঁসফোঁস করতে করতে বলছে, “তুমি কিন্তু এসবের মধ্যে একদম থাকবে না। বাবার যা ইচ্ছে করুন। ছেলে তো আর কচি খোকাটি নেই।”
স্নানের শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে সোমনাথ নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে। অনেকগুলো ১লা আষাঢ়ের সঙ্গে সোমনাথের তো পরিচয় হয়েছে-কিন্তু কোনো ১লা আষাঢ়কেই আজকের মতো নিরর্থক মনে হয়নি সোমনাথের। সোমনাথ এবার ছেলেমানুষী করে ফেললো। জলের ধারার মধ্যে চোখ খুলে হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে বসলো, “আমি কী দোষ করেছি? তোমরা বলো। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি-আমি শুধু একটা চাকরি যোগাড় করতে পারিনি।”
কিন্তু এসব প্রশ্ন সোমনাথ কাকে জিজ্ঞেস করছে? সোমনাথ তো এখন নাবালক নেই। এ-ধরনের প্রশ্ন করবার আধিকার তো একমাত্র বাচ্চা ছেলেদের থাকে। এর উত্তর কার কাছ থেকে সে প্রত্যাশা করে? ওপরের বারান্দায় মতদার দল যে-বন্ধটি বসে আছেন, তিনি উত্তর দেবেন? না আকাশের ওধার থেকে কোনো এক ইন্দ্রজালে মা কিছুক্ষণের জন্যে ফিরে এসে সোমনাথের সমস্যা সমাধান করবেন? কেউ তো এসব প্রশ্ন শুনবেও না। উত্তর দেবার দায়িত্ব তাঁর নয় জেনেও, বেচারা কমলা বউদি কেবল সোমনাথের হাত চেপে ধরবেন এবং ওর তপ্ত কপালে ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দেবেন।
সোমনাথ বাথরুম থেকে বেরোতেই কমলা বউদি খবর দিলেন, “বাবা তোমায় ডাকছেন।”
বাবা ঠিক যেভাবে ইজিচেয়ারের পূর্বদিকে মুখ করে ব্যালকনিতে বসে থাকেন সেইভাবেই বসেছিলেন। কোনোরকম গৌরচন্দ্রিকা না করেই তিনি বললেন, “তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা সুযোগ এসেছে। নগেনবাব এসেছিলেন—-ভদ্রলোকের অবস্থা ভালো। নিজের একটা সিমেন্টের দোকান আছে, ওঁর ছেলে নেই—তিনটি মেয়ে। তোমাকেই দোকানটা দেবেন—যদি ছোট মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ হয়।”
বাবার সামনে কথা বলার, বিশেষ করে প্রতিবাদের অভ্যাস, এ-বাড়ির কারার নেই। তবু সোমনাথ বললো, “নিজের পায়ে দাঁড়ানো হলো কই?”
বাবা এবার মুখ তুলে অবাধ্য পত্রের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “ওদের ফ্যামিলি ভালো। আমাদের পাটি ঘর। মেয়ের বাঁ-হাতে সামান্য ফিজিক্যাল ডিফেক্ট আছে। দেখতে খারাপ নয়। সলক্ষণা। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। আমি ভেবে দেখলাম তোমার সমস্যা এতেই সমাধান হবে। বউমার কাছে মেয়ের ছবি আছে, তুমি দেখতে পারো।”
কোনো উত্তর না দিয়েই সোমনাথ নেমে এলো। বুলবুল জিজ্ঞেস করলো, “ছবিটা দেখবে?”।
এক বকুনি লাগালো সোমনাথ’। “তোমাকে পাকামো করতে হবে না।”
ছেলের মতিগতি যে সুবিধের নয়, বাবা বোধহয় আন্দাজ করতে পেরেছেন। তাই আবার বড় বউমাকে ডেকে পরামর্শ করলেন।
এই ধরনের প্রস্তাবে দ্বৈপায়ন যে সন্তুষ্ট নন, তা কমলা জানে। প্রথমে বাবার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কোনোদিকে কোনো আশার আলো না দেখতে পেয়ে নিরপায় দ্বৈপায়ন মনস্থির করেছেন। এদেশে সোমনাথের যে চাকরি হবে না তা অনেক চেষ্টার পর এবার দ্বৈপায়ন বুঝতে পেরেছেন।
বড় বউমা ফিরে এসে সোমনাথকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর সস্নেহে দেবরকে বললেন, “রাজী হয়ে যাও ঠাকুরপো-বাবার যখন এতো ইচ্ছে।”
“এর থেকে অপমানের আমি কিছু ভাবতে পারছি না, বউদি!” সোমনাথের সামনে কমলা ছাড়া অন্য কেউ থাকলে সে এতোক্ষণ রাগে ফেটে পড়তো।
বউদির মুখে একটও উদ্বেগের চিহ্ন নেই। দেবরের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “কিছু, মনে কোরো না ভাই–বাবার ধারণা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার এইটাই তোমার শেষ সুযোগ।”
মোমনাথ বউদির চোখের দিকে তাকালো না। মুখ ফিরিয়ে নিলো। বউদি বললো, “কে আর জানতে পারছে, কেন তোমার এখানে বিয়ে হচ্ছে। এরপর বাবা যা বলতে বলেছেন, কমলা বউদি তা মখে আনতে পারলেন না। বাবা ইকুম করেছেন, “ওকে জানিয়ে দিও, এরকম সুযোেগ রোজ আসে না। এবং কথার বাধ্য না হলে এরপর এ-বাড়ির কেউ আর তার জন্যে দায়ী থাকবে না।”
এ-কথা না শুনলেও বাবা যে বউদির মাধ্যমে চরমপত্র পাঠিয়েছেন তা সোমনাথ আন্দাজ করতে পারলো। বউদির হাত ধরে সোমনাথ বললো, “তুমি অন্তত আমাকে নিজের কাছে ছোট হতে বোললা না।”
কমলা বউদি বেচারা উভয় সঙ্কটে পড়লেন। পাত্রীর ছবিখানা তাঁর হাতে রয়েছে। বাবার নির্দেশ, সোমের সঙ্গে আজই এসপার-ওসপার করতে হবে।
কমলা বউদি আবার ওপরে ছুটলেন বাবাকে সামলাবার জন্যে। বললেন, “হাজার হোক বিয়ে বলে কথা। দু-একদিন ভেবে দেখুক সোম।”
বাবা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। বললেন, “যেসব পাত্রের চাকরি-বাকরি আছে তাদের মুখে এসব কথা মানায়, বউমা। নগেনবাবর হাতে আরও দুটো সম্বন্ধ ঝলছে। আমাদের ফ্যামিলি সম্বন্ধে এতো শুনেছেন বলেই ওঁর একটু বেশি আগ্রহ।”
বেচারা কমলা বউদি! সংসারের সবাইকে সখে রাখবার জন্যে কীভাবে নিজের আনন্দটুকু নষ্ট করছেন।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জামা-প্যান্ট পরে, ব্যাগটা নিয়ে তৈরি হয়েছে সোমনাথ। মেজদা অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছেন। কমলা বউদি এবার সোমনাথের ঘরে কে পড়লেন। কী মিষ্টি হাসি কমলা বউদির।
সোমনাথের দিকে তাকিয়ে কমলা বউদি সস্নেহে বললেন, “আমার ওপর রাগ করলে, খোকন?”
সোমনাথ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর মনে মনে বললো, “পাপিঠ হলে তো তোমার ওপর রাগ করতে পারবো না, বউদি।”
বউদি এবার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। “আড়ি করতে নেই, ভাব করো—আজ তোমার জন্মদিন। মনে আছে, মা তোমাকে কী বলতেন? জন্মদিনে সবাইকে ভালোবাসতে হয়, কারুর ক্ষতি করতে নেই, নিজে খুউব ভালো হতে হয়, সবার মুখে হাসি ফোটাতে হয়।” সোমনাথ পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
বউদি এবার আঁচলের আড়াল থেকে একটা ঘড়ির বাক্স বার করলেন। একটা দামী সুইস রিস্টওয়াচ দেবরের হাতে পরিয়ে দিলেন কমলা বউদি। “অমর যখন সুইজারল্যান্ড থেকে এলো তোমার জন্যে আনিয়েছিলাম—জন্মদিনে দেবো বলে কাউকে জানাইনি।” বউদির ছোট ভায়ের নাম অমর।
সোমনাথের চোখে জল আসছে। সে একবার বলতে গেলে, “কেন দিচ্ছো? এসব আমাকে মানায় না। কিন্তু বউদির অসীম স্নেহভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সে কিছুই বলতে পারলো না। সোমনাথের বলতে ইচ্ছে করলো, “আগের জন্মে তুমি আমার কে ছিলে গে?” কিন্তু সোমনাথের গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না।
কমলা বউদি বোধহয় অন্তর্যামী। মুহূর্তে সব বুঝে গেলেন। বললেন, “তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, খোকন।”