২১. জগদীশ গুপ্তর কথা

আজ আমি আপনাদের কাছে এমন একজন লেখকের কথা বলতে বসেছি যিনি একদিকে রবীন্দ্র-প্রভাত-শরৎচন্দ্র ও অপর দিকে শৈলজা-প্রেমেন্দ্র অচিন্ত্যকুমারের মাঝখানে সেতু স্বরূপ বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হয়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছেন। আমি অসাধু সিদ্ধার্থ, রোমন্থন ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক জগদীশ গুপ্তর কথাই বলছি। এর রচনার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় অল্পবিস্তর থাকলেও থাকতে পারে, লেখকের সঙ্গে পরিচয় বোধ হয় নেই। থাকবার কথাও নয়। সাহিত্যের পীঠস্থান কলকাতা মহানগরী থেকে শত মাইল দূরে ক্ষুদ্র এক মফস্বল শহরে সাহিত্যের নিভৃত সাধনাই তিনি করে এসেছেন। নির্লজ্জ আত্মপ্রচারের যুগে সাহিত্যের সাধনায় এমন নিষ্কাম নিষ্ঠা সচরাচর দেখা যায় না। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এই যে, লেখক হওয়ার কোন প্রবল তাড়না ওঁর মধ্যে ছিল না, সাহিত্যিক খ্যাতি লাভের বাসনা তো নয়-ই। তবু তাকে লেখক হতে হয়েছিল আকস্মিক কারণে। লেখক-হওয়াটা ওঁর জীবনে একটা অ্যাসিডেন্ট ছাড়া আর কিছুই নয়, সেই কাহিনীই আজ আপনাদের বলতে বসেছি।

রামপ্রসাদের কথা আপনাদের নিশ্চয় অজানা নয়। জমিদারী সেরেস্তায় খাতা লিখতেন। হাতে কাজ নেই, অথচ নায়েব মশাইকে দেখাতে হবে বড় কাজে ব্যস্ত। অনন্যমনা হয়ে ঘাড় গুঁজে খাতা লিখে চলেছেন।

একদিন নায়েবের কৌতূহল হল। লোকটা এত কি হিসাব লেখে দেখা দরকার। খাতা তলব করলেন, বেরিয়ে পড়ল বিখ্যাত শ্যামা সংগীতআমায় দে মা তবিলদারি।

মপাসাঁ কোন কালেই হয়তো গল্প লিখতেন না। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটি গল্প লিখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এমিল জোলা তখন ফরাসী সাহিত্যের নবীন লেখকদের গুরুস্থানীয়। তাঁর নেতৃত্বে একটি সাহিত্যচক্র গড়ে উঠল, তখনকার নবীন সাহিত্যিকরা একে একে এই চক্রে যোগ দিলেন। মপাসাঁও ছিলেন এই দলের একজন সভ্য। বাস্তববাদী সাহিত্যিক নামে এই দলটি তখন ফ্রান্সে সবে শোরগোল তুলেছে।

তখন ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ চলেছে। মপাসাঁ ও তার কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধের প্রতি খুবই বিরূপ ছিলেন। যুদ্ধের বীভৎসতা মানুষকে অমানুষ করে দেয়, যুদ্ধকে তাই ঘৃণা করতেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে তো কাজ হবে না, দেশবাসীর সামনেও যুদ্ধের বীভৎসতার দিকটা তুলে ধরা দরকার। স্থির হল বন্ধুরা প্রত্যেকেই একটি গল্প লিখবেন। এই প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জোলা। তিনি নিজে তো গল্প লিখবেনই, বই আকারে প্রকাশের ভারও তিনি নিলেন। মপাসাঁকে প্রতিশ্রুতি দিতে হল গল্প লেখার। কিন্তু কি লিখবেন? গল্প তো কখনও লেখেন নি। মনে পড়ে গেল ওঁর কাকার কাছে শোনা একটি ঘটনা, স্থির করলেন সেইটি নিয়েই গল্প লিখবেন। যথা সময়ে লিখলেন গল্প। নাম দিলেন ব দ্য সুফ-বল্ অফ ফ্যাট। এই একটি গল্প লিখেই মপাসাঁ। সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পেলেন এবং গল্পটি আজও মোসর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পরূপে সমাদৃত।

অত দূরে যাবার দরকার কি। ঘরের কাছেই তো দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে, লেখক হওয়াটা যাদের জীবনে একটা অ্যাকসিডেন্ট। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুবোধ ঘোষের কথাই বলছি। মানিকবাবু তখন কলকাতার কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সের ছাত্র, থাকেন একটা মেস্‌-এ। একদিন মেস্‌-এর বন্ধুদের সঙ্গে জোর তর্ক চলছিল। বিষয়টা ছিল, পত্রিকাসম্পাদকরা অপরিচিত লেখকের লেখা ছাপে না। মানিকবাবু প্রতিবাদ করলেন। লেখার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুতি থাকে সম্পাদকরা নিশ্চয় সে-লেখা ছাপবে। মানিকবাবুর যুক্তি ছিল অপরিচিত লেখকের ভাল লেখা না ছাপাটা পত্রিকার পক্ষে সুইসিড্যাল পলিসি। বন্ধুরা মানিকবাবুর কথা মানতে রাজী নন, প্রমাণ চাই। মানিকবাবু বরাবরই একগুঁয়ে মানুষ। বললেন, প্রমাণ দেবেন। পাঁচ টাকা বাজি হয়ে গেল। সাতদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে তখনকার বিখ্যাত পত্রিকা বিচিত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। পরের মাসেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অতসী মামী প্রকাশিত হল। তার কিছুদিন পরে বিচিত্রার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ঠিকানা খুঁজে বার করে স্বয়ং মানিকবাবুর মেস্‌-এ এসে হাজির। গল্পের পারিশ্রমিক বাবদ পনেরোটা টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে আরও গল্প লিখবার অনুরোধ জানিয়ে গেলেন। মানিকবাবুর সাহিত্য-জীবনের সেই শুরু।

সুবোধবাবুর প্রথম লেখা গল্প অযান্ত্রিক-এর ইতিহাস তো সবারই জানা। কোন দিন লেখক হবেন, স্বপ্নেও ভাবেন নি সুবোধবাবু। হাজারিবাগের রুটির ব্যবসা গুটিয়ে ভাগ্যান্বেষণে এলেন কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় সাব-এডিটরের চাকরি পেয়ে গেলেন। মন্মথনাথ সান্যাল, অরুণ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ প্রভৃতি মিলে একটা পাঠচক্র করেছিলেন। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় নিয়মিত তারা একত্রে মিলিত হতেন এবং এক-এক শনিবার এক-একজনকে কিছু একটা লিখে এনে পড়ে শোনাতে হত। সুবোধবাবু শ্রোতারূপেই এই চক্রে যোগ দিয়ে আসছেন। একদিন বন্ধুরা ধরলেন, পরের শনিবার সুবোধবাবুকে কিছু-একটা লিখে এনে পড়ে শোনাতে হবে। সুবোধবাবুর মাথায় বজ্রাঘাত। জীবনে এক লাইন লেখেন নি, কী লিখবেন। বন্ধুরা নাছোড়বান্দা, লিখতেই হবে। নিরুপায় হয়ে কথা দিলেন। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরে এল, কিছুই লেখা হল না। শুক্রবারেও বন্ধুরা স্মরণ করিয়ে দিলেন লেখার কথা। সারাদিন আপিসের কাজকর্ম সেরে মার্কাস স্কোয়ারের কোণার মার্কাস বোডিং-এ ফিরে গেলেন, লেখার কথাটা বোঝার মত মাথায় চেপে আছে। রাস্তার পাশে এক তলার একটি ঘরে তখন  থাকতেন। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন, কিছু একটা লিখতেই হবে। লেখা যখন শেষ করলেন তখন ভোর চারটে। লেখাটা পকেটে করে অফিসে এলেন, বন্ধুরা লেখার কথা জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকেন। সন্ধ্যায় যথারীতি আসর বসল, সুবোধবাবু সঙ্কোচের সঙ্গে পকেট থেকে পাণ্ডুলিপি বার করে পড়লেন সেই বিখ্যাত গল্প অযান্ত্রিক। এই একটি গল্প লিখেই সুবোধবাবুর স্থান বাংলা সাহিত্যে পাকা হয়ে গেল। সুতরাং সুবোধবাবুরও লেখক হওয়াটা অ্যাসিডেন্ট ছাড়া আর কি। এদের তুলনায় জগদীশ গুপ্তর লেখক হওয়ার ঘটনাটা আরও কৌতুকপ্রদ।

 

প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্যে যে আলোড়ন দেখা দিয়েছিল তার প্রবর্তনে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন অন্যতম পুরোধা। শরৎচন্দ্রের পর নূতন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তার লেখা প্রবাসী-ভারতবর্ষ প্রমুখ বিশিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হতে লাগল, সে-লেখায় সমাজ-জীবনের বাস্তবরূপ রোষ-কষায়িত ভঙ্গীতে ব্যক্ত। পড়ে চমকে উঠতে হয়। তাঁর লেখায় শ্লেষ আছে, ব্যঙ্গ আছে, হাসি আছে আর আছে জীবন সংগ্রামে জর্জরিত একটি মানুষের দরদী দৃষ্টি। কল্লোল ও কালিকলমের একাধিক লেখক যে জগদীশ গুপ্তর কাছে ঋণী একথা অস্বীকার করবার নয়।

১৯৩০ সালের কথা। আমি তখন শান্তিনিকেতন কলেজে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। যে-সব পিরিয়ডে ক্লাস থাকত না, আমরা এসে জড়ো হতাম লাইব্রেরীর রীডিং রুম-এ, কলকাতা থেকে সদ্য-আসা মাসিক পত্রিকাগুলি ছিল আমাদের প্রধান আকর্ষণ। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, মানসী ও মর্মবাণী, বিচিত্রা তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল প্রগতি কল্লোল কালিকলম উত্তরা। যে-বয়েসে সাহিত্যের বাতিক সংক্রামক ব্যাধির মত অল্প-বিস্তর সব মানুষকেই আক্রমণ করে, আমার তখন সেই বয়েস। প্রবীণ ও নবীন পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত গল্প-উপন্যাস পড়ে ফেলা ছিল আমাদের নেশা। বিশেষ করে তরুণ কোন সাহিত্যিকের লেখায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর স্বাদ পেলে তো আর কথাই নেই। শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হত না। আর পাঁচজনকে পড়ানো চাই, তারপর শুরু হত তাই নিয়ে তুমুল আলোচনা।

আরেকটা নেশা আমাদের ছিল, সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হবার নেশা। কলকাতা থেকে মাঝে-মাঝে সাহিত্যিকরা আসতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, কিন্তু সংখ্যায় নিতান্তই অল্প। যারাই আসতেন, খবর পেলেই আমরা তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম পরিচয় লাভের আশায়। আমাদের কৌতূহল ছিল লেখকদের কাছ থেকে জানার-কি ভাবে তারা গল্প লেখেন; দিনে কয় ঘণ্টা লেখেন, কতদিন লাগে একটা গল্প লিখে শেষ করতে ইত্যাদি। এই সময়ে হঠাৎ লাইব্রেরি রুম-এ নতুন কি একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে গিয়ে একটা গল্পের নাম পড়ে চমকে উঠলাম। কলঙ্কিত সম্পর্ক। লেখকের নামটা সেকেলে, জগদীশ গুপ্ত। আগে এর কোন লেখা পড়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। তবু নামের আকর্ষণে গল্পটা আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম এই লেখকের লেখা আর কোন্ পত্রিকায় পাওয়া যায়। এমন নেশা ভদ্রলোক ধরিয়ে দিলেন যে, ওঁর লেখা গল্প উপন্যাস যেখানে পাই পড়ে ফেলি।

একদিন লাইব্রেরির নতুন বইয়ের তালিকায় জগদীশ গুপ্তর নোমন্থন বইয়ের নামটা দেখেই ছুটলাম লাইব্রেরিয়ান প্রভাতদার কাছে, রবীন্দ্রজীবনীকার শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

লাইব্রেরিতে তখন একটা নিয়ম ছিল—সব বই সব ছাত্রকে পড়তে দেওয়া হত না। বিশেষ করে অশ্লীলতা দোষে কলঙ্কিত বাংলা বইগুলি আমাদের দৃষ্টির আড্ডালে সযত্নে রক্ষিত হত। নতুন বই এলেই প্রভাতদা সর্বাগ্রে তা পড়ে দেখতেন এবং তিনিই স্থির করতেন সে-বই ছাত্রদের হাতে দেওয়া যাবে কি না। তার ফলে আজকের দিনের একাধিক খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকের সেদিনের লেখা আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস-পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। পরবর্তী জীবনে কলকাতায় এসে সেই সব উপন্যাস সংগ্রহ করে পড়তে গিয়ে পানসে লেগেছে।

প্রভাতদার কাছে ঝোমন্থন বইটা চাইতেই দেরাজ থেকে বার করে দিয়ে বললেন–এ বই তুই পড়তে পারিস। বড় ভালো লিখেছে রে। হাসিও যেমন, অশ্রুও তেমনি।

বইখানা পড়ে লেখককে দেখার প্রবল কৌতূহল দেখা দিল। দুদিন পরে বইটা ফেরত দিতে গিয়ে প্রভাতদাকে বললাম-এই লেখক কি কখনও শান্তিনিকেতনে আসেন না?

প্রভাতদা বললেন–কেন বল তো?

–আলাপ করার বড় ইচ্ছে।

–যে কোনদিন গেলেই তো পারিস।

অবাক হয়ে গেলাম প্রভাতদার কথা শুনে। শান্তিনিকেতনে হেন লোক নেই যাকে আমি চিনি না বা জানি না। আমাদের কোনও মাস্টার মশাই কি তাহলে ছদ্মনামে লিখছেন! পদবীটা যখন গুপ্ত, হলেও হতে পারে।

প্রভাতদাকে অনুনয়ের সঙ্গে বললাম-আপনি যখন জানেন লেখকটি কে তখন আমাকে বলতেই হবে।

প্রভাতদা বললেন—কেন বলব না। বোলপুরে আদালতে কাজ করেন। মুহুরীর কাজ। থাকেনও আদালতের কাছেই। যে-কোন রবিবার সকালে চলে যা। আদালতের কাছে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাড়িটা দেখিয়ে দেবে।

শান্তিনিকেতনে রবিবার কখনও ছুটি থাকে না, ছুটি থাকে বুধবারে। অথচ রবিবার দিন না গেলে জগদীশ গুপ্তর দেখা পাওয়া সম্ভব নয়।

এক শীতের রবিবার সকালে একটা সাইকেল যোগাড় করে চলে গেলাম বোলপুরে। স্টেশনের ডান দিকের রাস্তা ধরে আধ মাইল পথ দক্ষিণে এগোলেই আদালত। আদালতের এক চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ির হদিস পেয়ে গেলাম। বাড়িটার সামনে একটা প্রশস্ত উঠোন। সেই উঠোনে বোলপুরী মোড়ায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, একমনে একটা বই পড়ছেন। গায়ে ছাই রঙের তুষের আলোয়ান জড়ানো।

সাইকেলটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আস্তে আস্তে ভদ্রলোকের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কোনদিকে খেয়াল নেই, একমনে একটা মোটা ইংরেজী বই পড়ে চলেছেন। সন্তর্পণে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি, কি বই পড়ছেন দেখার আগ্রহ। আমার ছায়াটা দীর্ঘায়িত হয়ে বইটার উপর পড়তেই চমকে তাকালেন আমার দিকে। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম—আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আপনিই তো লেখক জগদীশ গুপ্ত?

আমার কথা শুনেই শিশুর মত সরল হাসি সারা মুখে-চোখে ফুটে উঠল। নিকেলের ফ্রেমের চশমার ভিতরে করুণাঘন দুটি চোখের দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ রেখে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঝুলেপড়া গোপের ফাঁকে সরল হাসিটি উকি-ঝুকি মারছে। সস্নেহে আমার কাধে হাত রেখে বললেন–আমিই জগদীশ গুপ্ত। তবে লেখক কিনা, সে বিষয়ে নিজেরই যথেষ্ট সংশয় আছে। তা আমার কাছে কি প্রয়োজন?

আমি বললাম-আমি শান্তিনিকেতনের ছাত্র। আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যেই এসেছি।

অবাক হয়ে জগদীশবাবু বললেন—সে কি কথা। সমুদ্রের স্বাদ তুমি পেয়েছ, হেজে-মজে যাওয়া ডোবায় তুমি কি পাবে। বোসো, আমি এখুনি আসছি।

ধীর পদক্ষেপে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। দীর্ঘাকার ক্ষীণদেহটি ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। চেহারায় ইস্পাতের কাঠিন্য নেই, আছে জীবনসংগ্রামের ক্লান্তি। ঝঞ্চাবিক্ষুদ্ধ রাত্রির অবসানে পরিশ্রান্ত লতাবৃক্ষের মত। একটু পরেই একটা মোড়া হাতে বেরিয়ে এসে বললেন, শীতের সকালে স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে আলাপ জমবে না, রোদে পিঠ দিয়েই বসা যাক। কি বলো?

আমি তাড়াতাড়ি ওঁর হাত থেকে মোড়াটা নিয়ে ওর পাশে বসেই বললাম—আপনি এত কাছে থাকেন তবু শান্তিনিকেতনে আপনাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনেক লেখকই তো আসেন, আপনি কেন আসেন না।

চুপ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বললেন–প্রতিদিন ভোরে উঠে আমি প্রথমে সূর্য-প্রণাম করি। আসলে সে প্রণাম কবিগুরুর উদ্দেশ্যেই। তবে কি জানো, অতবড় একজন মহাপুরুষের কাছে আমার যেতে বড়ই সংকোচ। আমার মুখ দিয়ে তো কোন কথাই বেরোবে না।

আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম—আপনার এই সংকোচ কিন্তু অহেতুক। আপনার মত লেখক রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলে উনি খুশীই হবেন আপনার সঙ্গে আলাপ করে।

সলজ্জভাবে জগদীশবাবু বললেন–আসলে তো আমি লেখকই নই। লেখক হতে হলে যে নিষ্ঠা, যে সাধনা, যে অনুশীলনের প্রয়োজন আমি তার কিছুই করি নি। তোমার কাছে বলতে লজ্জা নেই, স্রেফ ফোকটে আমি লেখক হয়ে পড়েছি। আমার এই জোচ্চুরিটা পাছে ধরা পড়ে যায় সেই কারণেই কোথাও যেতে আমার এত ভয়।

জগদীশবাবুর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট যা আমার চোখে ধরা পড়েছিল তা হচ্ছে সাহিত্যিক সততা। সমাজের নিম্নস্তরের তুচ্ছ মানুষগুলিকে দেখেছেন অন্তরের গভীর সহানুভূতি দিয়ে। সে-দেথায় কোন ফাঁক বা ফাঁকি নেই এবং সেই সব চরিত্র নিয়ে ওঁর লেখার দৃষ্টিভঙ্গী যেমন তির্যক তেমনি খাঁটি সোনার মত উজ্জল। আমি তাই ওঁর কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম-আপনার লেখা আমি যতটুকু পড়েছি তাতে কিন্তু আপনার কথায় কোন রকমেই সায় দিতে পারছি না। আপনার লেখায় ব্যঙ্গ আছে, কষাঘাত আছে কিন্তু এ-সব ছাড়িয়ে যেটা বড় হয়ে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে অন্তর-মথিত দরদ আর সত্যদৃষ্টি।

মৃদুকণ্ঠে হতাশার সুর এনে জগদীশবাবু বললেন—আমার লেখা সাধারণ মানুষের যদি ভাল লেগে থাকে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু বিদগ্ধজনের কাছে এ-লেখা অপাংক্তেয়।

আমি বললাম-সাহিত্যে যারা মননশীল লেখককে খোঁজেন আমি তাদের দলে নই। সাহিত্যে সত্যদৃষ্টিই আমার কাছে বড় কথা।

এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে একটি সাঁওতালী বুড়ি ঝি একটা কাঁসার জামবাটি ভর্তি মুড়ি আর ঝোলা-গুড় এনে হাজির। জগদীশবাবু বললেন–শীতকালে খেজুরের গুড় আর মুড়ি বড় উপাদেয় খাদ্য। গিন্নী তোমার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে একটু নারকোল কুচি পড়লে আরও উপাদেয় হত। কি বল? বাড়িতে বোধ হয় আজ নারকোল নেই। তা না হলে গিন্নী এ-ভুল করতেন না।

আমি ততক্ষণে গুড়-মুড়ি ভাল করে মেখে বেশ খানিকটা মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে বললাম-বীরভূমের ঝোলা-গুড় আর মুচমুচে মুড়ির তুলনা হয় না।

হাসতে হাসতে জগদীশবাবু বললেন—তাই তো বলি সুকুমার রায় আবোল-তাবোল-এ পাউরুটি আর ঝোল-গুড়ের প্রশস্তি করেছেন। ঝোলাগুড় আর মুচমুচে মুড়ি তো খান নি।

যে প্রসঙ্গ আমাদের চলছিল সেই প্রসঙ্গেই আবার ফিরে আসার আশায় আমি বললাম—আপনার নিজের লেখা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাসের এই অভাবটা কিন্তু আমার মোটেই ভাল লাগছে না।

কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন জগদীশবাবু। ঝুকে পড়ে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা কিছু চিন্তা ওঁর মনকে আলোড়িত করছে তা অনুমান করলাম। একটু পরেই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই দেখি শিশুর মত সরল হাসিতে ওঁর মুখ উজ্জ্বল, দুটি চোখে কৌতুক মাখা। বললেন—আমার সম্বন্ধে তোমার যখন এতই কৌতূহল, তোমার কাছে কথাটা খুলেই বলি। লেখক আমি কোন কালেই হতাম না। লেখক হওয়াটা আমার জীবনে এমন একটা কিছু স্মরণীয় ঘটনা নয়, দুর্ঘটনা।

এটুকু বলেই বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গলার স্বরটা কিঞ্চিৎ মৃদু করে বললেন–আমার গিন্নীই আমাকে লেখক বানিয়ে ছেড়েছেন।

আমি হেসে বললাম-এ আর নতুন কথা কি। বহু লেখকের জীবনে শুনেছি স্ত্রীর ইন্সপিরেশনই তার লেখক হবার মূল কারণ।

-তবে আমার ক্ষেত্রে কিন্তু ইন্সপিরেশন নয়, পারসপিরেশন। এই পারসপিরেশন থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে লেখক হতে হয়েছে। বৃত্তান্তটা বলি শোন।

আদালতে সামান্য বেতনের চাকরি, আয় এবং ব্যয়ের দুই প্রান্তের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে গৃহিণী নাজেহাল। শেষে একদিন বিরক্ত হয়েই আমাকে জানালেন—রইল তোমার এ ঘর দুয়ার, তুমি আদালতের চাকরি নিয়েই থাক, আমি চললাম।

প্রমাদ গণলাম। ঝড়ের পূর্বাভাস। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে খুলেই বল না।

গৃহিণী বললেন–বলব আর কি। চোখে দেখতে পাও না? রোজ সকালে কুঁড়েমি না করে নিজে গিয়ে হাটবাজারটা করলেও তো দু-পয়সা সাশ্রয় হয়।

আমার মাথায় বজ্রাঘাত। ওই বাজার করাটা আমি বড় ভয় করি, ওটা আমার ধাতে সয় না। এখান থেকে বোলপুরের বাজারটা প্রায় এক মাইল পথ। ধুলো-ওড়া রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে বাজার করতে যাওয়ার বিড়ম্বনা কি কম। হাঁটুভর্তি ধূলো তো আছেই, তার উপর বাজারে লেপটালেপটি ভিড়। ওই ভিড় আমি কোন কালেই সহ্য করতে পারি নে বলেই এই মফস্বল শহরের এক প্রান্তে নিরিবিলিতে পড়ে আছি। তার উপর এক পয়সা সাশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দরাদরি করে বাজার করার চেয়ে ডাকাতি করা বোধ হয় অনেক সহজ। তাছাড়া কি জানো? সকাল বেলাটাই হচ্ছে আমার কাছে মৌজ করার উৎকৃষ্ট সময়। সারা দিন তো আদালতে দিনগত পাপক্ষয় করছি কলম পিষে। ও-সময়টা পেটের ভাত যোগাড়ের জন্যে জন্মাবার আগে থেকেই বিধাতা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। আর রাত্রিটা

এইটুকু বলেই জগদীশবাবু আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। অবশেষে গলার স্বরটা আরও একটু নিচু করে বললেন–পরের বাড়ির মেয়েকে বিদেশে বিভুইয়ে এনে রেখেছি। এখানে আবার সঙ্গীসাথীর বড়ই অভাব। থাকলেও তারা শুধু হাঁড়ির খবর নিতেই ব্যস্ত। গৃহিণী তাই ওদের বেশি পছন্দ করেন না, অগত্যা আমাকেই সঙ্গ দিতে হয়।

একমাত্র সময় এই সকাল বেলা। এ-সময়টা গিন্নী রান্নাবান্না, ঘর-সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, আদালতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সময়টা আমার নিজস্ব। একে আমি আমার ইচ্ছে মত শুয়ে বসে বই পড়ে অথবা সামনের ওই পথ দিয়ে লোকের আনাগোনা দেখে কাটিয়ে দিই। কিন্তু আমাদের এই কেরানী জীবনে সংসারটা এমনই জোয়াল যে একবার কাঁধে চড়লে আর নামতে চায় না, চব্বিশ ঘণ্টাই তোমাকে খাটাতে চায়। তখন রাম প্রসাদী গানে সান্ত্বনা খোঁজা ছাড়া আর উপায় কি।

জগদীশবাবু এবার থামলেন। বাটিভর্তি মুড়ি আর গুড় ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গিয়েছে, দু-পেয়ালা চা এসে হাজির। চায়ে চুমুক দিয়ে জগদীশবাবু আবার শুরু করলেন তার লেখক-হওয়ার কাহিনী।

কাছারির একটা বেয়ারা রোজ সকালে এসে কুয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যায়। গৃহিণী তাকে দিয়েই এতদিন চাল-ডাল-নুন-তেল বাজার থেকে কিনিয়ে আনেন, সপ্তাহে দুদিন হাটে গিয়ে কঁচা বাজারটাও ও-ই করে আনে। গৃহিণীর ধারণা, লোকটা নির্ঘাৎ পয়সা চুরি করে। শুধু তাই নয়, হাটের দিন যত রাজ্যের রদ্দি ঝড়তি পড়তি শুটকো আনাজ কিনে এনে দাম বলে বেশি। সুতরাং এখন থেকে ও-কাজটা আমাকেই করতে হবে।

আমি চিরকালই একটু আয়েশী লোক কিন্তু গিন্নীর ধারণা আসলে আমি নাকি কুঁড়ের হদ্দ। সুতরাং এই দুর্নাম ঘোচাবার জন্য পরদিন সকাল থেকেই বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে পড়লাম। তার কি পরিণাম হয়েছিল জান? গিন্নীর দু-চার পয়সা সাশ্রয় হয়েছিল ঠিকই, আমার বিড়ি-সিগারেটের পয়সায় টান পড়ে গেল। বাজারের ওই ভিড়ের মধ্যে তরিতরকারির দর নিয়ে দরাদরি করা কি আমার দ্বারা সম্ভব?

বাজার করে আসা মাত্রই গৃহিণী থলি উপুড় করেই বললেন—বেগুন কত করে সের আনলে?

—চার পয়সা করে।

চোখ বড় বড় করে গিন্নী বললেন–ও মা, কী কাণ্ড বল তো? এতদিন রামচরণ ছয় পয়সা করে বেগুন এনেছে, তা-ও বিচিভর্তি। কী পয়সাটাই না এতদিন ধরে সরিয়েছে।

জগদীশবাবু হাসতে হাসতে বললেন—এই ভাবে ঝঞ্জাট এড়াতে নিজের পকেট খরচার পয়সায় তো টান পড়লই উপরন্তু কাছারির নির্দোষ বেয়ারাটা মাঝখান থেকে বদনামের ভাগী হল। তার চেয়েও মারাত্মক কাণ্ড কি হল জানো? পাশের বাড়ির মোক্তার গিন্নীর কাছে আমার গিন্নী সগর্বে জানিয়েছেন দরাদরি করে কত সস্তায় আমি বাজার করে আনি। তার ফলে মোক্তার-গিন্নী তাঁর বাড়ির চাকরকে বরখাস্ত করে স্বামীকেই হাটে পাঠাচ্ছেন। তার অবস্থাটা একবার অনুমান করে দ্যাখ। একদিন মোক্তার বাবুর সঙ্গে বাজারে আমার দেখা। একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা। আমাকে দেখেই কঁদো-কাদো মুখে বললেন–আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি জগদীশবাবু যে আমার এই সর্বনাশটা করলেন।

সান্ত্বনা দিয়ে বললুম-দুঃখটা একা ভোগ করতে বেশি লাগে। ভাগ করে ভোগ করলে কষ্টের অনেকখানি লাঘব হয়।

ভদ্রলোক কি বুঝলেন জানিনা, তবে অনেক দিন বাক্যালাপ বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু আসল বিপদ দেখা দিল কখন জানো? আমার কেনা তরি-তরকারি গৃহিণীর আর পছন্দ হয় না। বাজার করে আনার পর থলিটা উপুড় করে বললেন—তোমাদের কাণ্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে। লাউ এনেছ যখন কুচো চিংড়ি কোথায়?

–বাজারে চিংড়ি আজ ওঠেই নি।

–ই বা কাতলা মাছের একটা মুড়ো আনলেও তো পারতে।

–মাছের মুড়ো সব সময় আলাদা না পাওয়া গেলে কি করব?

–ধনে পাতাও তো আনতে পারতে। বল, সেটাও বাজারে ওঠে নি।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে জগদীশবাবু আমাকে বললেন–বাজারে গিয়ে ফাকা জায়গা দেখে হাতের কাছে যা পাই কিনে আনি, গিন্নীর আর পছন্দ হয় না। এদিকে বিড়ি সিগারেট খাওয়া গেল কমে, ওদিকে বোজ সকালে এই গলদঘর্ম পরিশ্রম। উপরন্তু তরিতরকারির পছন্দ অপছন্দ নিয়ে বোজ একটা বচসা। জীবনে যখন প্রায় ঘেন্না ধরিয়ে দেবার উপক্রম হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

জগদীশবাবু টিনের একটা চ্যাপটা কৌটো থেকে বিড়ি বার করে ধরিয়ে বললেন—আরেক কাপ চা হয়ে যাক, কি বলে?

আমি তৎক্ষণাৎ সায় দিলাম। একে শীতের সকাল তার উপর জগদীশ বাবুর এমন সরস গল্প। চা-টা জমবে ভালো। আমার সম্মতি পেয়ে জগদীশবাবু ধীর পদক্ষেপে আবার বাড়ির ভিতরে গেলেন। একটু পরে বেরিয়ে এসেই বললেন–গিন্নী জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে বসে এত বকর বকর করছ আর বার বার চা খাওয়াচ্ছ। ছেলেটা কে? যেই বললুম শান্তিনিকেতনের ছেলে, আমার লেখা পড়ে যেচে আলাপ করতে এসেছে, গিন্নীর মুখে একগাল হাসি। সুতরাং চা-টা ভালই তৈরি হবে অনুমান করছি।

মানুষটির কথা-বার্তায়, আচার আচরণে সরল অন্তকরণের এমন একটা কোমল স্পর্শ আছে যা আমাকে এতক্ষণে অভিভূত করে ফেলেছে। আমি সংকোচের সঙ্গেই বললাম—আমি এসে আপনার কাজের কোন রকম ব্যাঘাত করলাম না তো?

জগদীশবাবু বললেন—খুব কাজের মানুষ ঠাওরেছ আমাকে। বৈষয়িক উন্নতির জন্য যারা কাজ করে তৃপ্তি পায়, আমি সে-দলের নই। তার চেয়ে তোমার সঙ্গে দু-দণ্ড বসে গল্প করায় আমি অনেক বেশি তৃপ্তি পাই।

দু-পেয়ালা চা এসে হাজির। চুমুক দিয়েই বললেন—অনুমানটা ঠিক কিনা বলল।

অনুমান যে মিথ্যে হবে না তা আগেই জানা ছিল। প্রথম কাপ চা-খেয়েই বুঝেছিলাম, পাকা হাতের তৈরি। গল্পের সুত্র ধরিয়ে দিয়ে বললাম—বাজার। করার বিড়ম্বনা থেকে কি ভাবে রেহাই পেলেন সেই ঘটনাটা বলুন।

উৎসাহিত হয়ে উঠলেন জগদীশবাবু। বললেন–মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। সে ঘটনার কথা ভাবলে আজও হাসি পায়। একদিন বিকেলে আদালত থেকে এক গাদা নথিপত্র বাণ্ডিল বেঁধে বাড়ি নিয়ে এলাম। গৃহিণী অবাক হয়ে সুধোলেন-এ সব খাতা পত্তর কিসের, উত্তরে বললামআদালতের কাজ। মামলা-মোকদ্দমা অনেক জমে গিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া হুকুম তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দেওয়া চাই।

গিন্নী জানতেন, রাত্রে আমি এসব কাজ করতে পারি নে, চোখে কম দেখি। একমাত্র সময় সকাল বেলা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা-জলখাবার খেয়ে আদালতের নথি-পত্র নিয়ে বসি মুহুরীর কাজে, বাজারে যায় কাছারির সেই বেয়ারা।

একটা দিক তো রক্ষা হল। সকালে আর এক মাইল ধুলো-কাদা ভেঙ্গে বাজারে যেতে হয় না। কিন্তু রোজ সকালে ঘণ্টার পর ঘন্টা আদালতের নথিপত্র ঘাটা, তারও তো মানসিক যন্ত্রণা কম নয়। শেষে বাধ্য হয়ে লিখতে শুরু করে দিলাম। বোজ সকালে বসে লিখি, গৃহিণী ভাবেন কর্তা আমার আপিসের কাজে কী খাটাই না খাটছেন।

লিখতে লিখতে একদিন নিজেই আবিষ্কার করলাম যে একটা ছোটো গল্প লিখে ফেলেছি। গিন্নীকে না জানিয়ে গোপনে লেখাটা পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকার সম্পাদকের নামে এবং তা যথা সময়ে প্রকাশিতও হল।

জগদীশবাবু, এইটুকু বলেই চুপ করলেন, আমিও নির্বাক। বেলা বেড়েছে, শীতের মিঠে রোদ তখন কড়া হয়ে উঠেছে। আমি ভাবছিলাম যে-মানুষ লেখক হবার জন্যে কোন সাধনাই কখনও করেন নি তার হাত দিয়ে এমন লেখা বেরলো কি করেহয়তো মনে মনে অনেককাল ধরে এ-লেখার প্রস্তুতি চলছিল নিজের অগোচরেই। বিরাট বিস্ময় নিয়ে সেদিন জগদীশবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসেছি। আর কখনও ওঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। পরবর্তী জীবনে যখন কলকাতায় এসে পত্রিকা-সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত হই তখন জগদীশবাবু কলম থামিয়ে দিয়েছেন। পরিমিতি বোধ ছিল তার অপরিসীম। পাঠকদের মন-যোগানো লেখা কোনদিন তিনি লেখেন নি। যে মুহূর্তে জানতে পারলেন যে তার স্পষ্টোক্তি পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে পারছে না, লেখা দিলেন থামিয়ে। শারদীয়া সংখ্যার জন্য একবার লেখা চেয়ে ওঁকে চিঠি দিয়েছিলাম। উত্তরে কম্পিত হস্তাক্ষরে প্রায় অস্পষ্ট ছোট্ট একটি চিঠি এল—সাহিত্য কর্ম হইতে অনেক দিন হইল বিদায় লইয়াছি। পুজি ফুরাইয়াছে, দৃষ্টিশক্তিও হারাইয়াছি। ভগবান যাহা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ইতি।

১৯৫০ সালে জগদীশবাবুর ছোটগল্পের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। প্রকাশকের অনুরোধে সে-গ্রন্থের একটি ভূমিকা তিনি লেখেন। তার এক জায়গায় নিজের রচনা সম্বন্ধে যে কথা লিখেছেন তা এখানে উদ্ধৃত করে দিলাম :-

নিজের সম্বন্ধে আমি যতই ফেনাইয়া ফাঁপাইয়া ফলাইয়া লিখি না কেন কোন সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি তাহা গ্রহণ করিবেন না; হয়তো হাসিবেন এবং হাসাহাসি করিবেন। আর, অনুপস্থিত লোকের হঠাৎ আসিয়া গাম্ভীর্যের সঙ্গে বাগাড়ম্বরপূর্বক সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা, কার্যকারিতা, দায়িত্ব, স্থায়িত্ব উদ্দেশ্য প্রভৃতির ব্যাখ্যা করা হইবে ততোধিক হাস্যের কারণ।

তবে একেবারেই যে খবর নাই কিম্বা সব খবরই যে বলিতে আমি অনিচ্ছুক এমন নয়। একটি খবর দিব।

বোলপুর টাউনে গেলাম। কিছুদিন পরেই মাসিক পত্রের মাধ্যমে ক্রমে জানাজানি হইয়া গেল যে আমি একজন লেখক। দুটি বন্ধু পাইলাম। শ্ৰীভোলানাথ সেনগুপ্ত ও শ্রীশান্তিরাম চক্রবর্তী। তৎপূর্বেই ভোলানাথবাবু তার রচিত গোরুর গাড়ী কাব্য ছাপাইয়াছেন। ওই দুটি বন্ধুর মানুষের অন্তরের তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করার অসাধারণ শক্তি দেখিয়া এবং তাঁদের রসাল রসিকতায় মুগ্ধ হইয়া গেলাম। তাহারাই একদিন প্রস্তাব করিলেন : গল্পের বই করুন একখানা।

জানাইলাম, প্রকাশক পাইব না।

সেখানেই উপস্থিত ছিলেন সেখানকার কানুবাবু-শ্ৰীব্রজজনবল্লভ বস্তু। তিনি জানিতে চাহিলেন : ছাপিতে কত টাকা লাগিতে পারে?

বলিলাম—শ-আড্ডাই।

–আমি দিব। ছাপুন।

কানুবাবু যথাসময়ে টাকাটা দিলেন—বিনোদিনী গল্পের বই ছাপা হইল।

২০২৫ খানা বই একে-ওঁকে দিলাম। অবশিষ্ট হাজারখানেক বই, আমার আর কানুবাবুর বিনোদিনী, প্যাকিং বাক্সের ভিতর রহিয়া গেল; পরে কীটে খাইল।

লেখক এবং সামাজিক মানুষ হিসাবে আমার আর কোনও অনুশোচনা নাই, কেবল মানসিক এই গ্লানিটা আছে যে, কানুবাবুর শ-আড্ডাই টাকা নষ্ট করিয়াছি।

আমার নিজের সম্বন্ধে আর একটি কথা এই যে, আমি যদি এখন মরি তবে যাহারা আমাকে চেনেন তাহারা বলিবেন-বয়েস পেয়েই গেছেন।?

এই ভূমিকা লিখে দেবার কয়েক মাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে তারই অনুজ-সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র এক জায়গায় বলেছেন :

সময়ের স্রোতে সব কিছুই হারায়, তবু জীবনকে নির্ভীক নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখবার ও বুঝবার চেষ্টায় অসাধু সিদ্ধার্থের মত বই লেখবার জন্যে সারাজীবন রোগ শোক অভাব দারিদ্র্যের সঙ্গে অম্লান বদনে যিনি যুঝে এসেছেন, প্রত্যক্ষভাবে না হোক, তাঁর সাহিত্যিক সাধুতা পরোক্ষভাবে ভাবী কালের অনুপ্রাণনা হয়ে থাকবেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *