একবিংশ অধ্যায় – চন্দ্রের যক্ষ্মারোগমুক্তি
ব্রহ্মা কহিলেন; হে সুরগণ! তোমরা দক্ষ ভবনে গমন কর; চন্দ্র যাহাতে পূর্ণ হন, সেই জন্য গিয়া দক্ষকে প্রসন্ন কর। ১
চন্দ্র, পূর্ণ হইলে সমস্ত জগৎ প্রকৃতিস্থ হইবে। তোমাদিগের শান্তি এবং ওষধি সকলেরও পুনরুদ্ভব হইবে। ২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন; ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মার এই কথা শুনিয়া হৃষ্টচিত্তে দক্ষালয়ে গমন করিলেন। ৩
সকল দেবগণ, যথাযোগ্য বিনীতভাবে প্রজাপতি দক্ষসমীপে উপস্থিত হইয়া প্রণাম-পূর্বক মধুবচনে বলিতে লাগিলেন; ব্ৰহ্মন্! আমরা বহু দুঃখে অবসন্ন, আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন; হে মহামতে! আমাদিগকে রক্ষা করুন, শোকসাগর হইতে উদ্ধার করুন। ৪-৫
পরমাত্মার ব্রহ্মা নামে যে সৃষ্টিকারক মূর্তি, বিপ্ররূপী পরম জ্যোতি তাহারই অঙ্গস্থিত; হে জ্যোতিঃ-স্বরূপ-বিপ্র! আপনাকে নমস্কার। ৬
যিনি সৰ্ব্ব জগতের রক্ষক বলিয়া “দক্ষ”, আর প্রজাপালক বলিয়া “প্রজাপতি” নামে অভিহিত, আমরা তাহাকে নমস্কার করি।৭
সমস্ত জগতের পালন-কর্তা কুশলাদিগের রক্ষাকর্তা মহাত্মা দক্ষকে সত্বর আত্মহিতের জন্য নমস্কার করি। ৮
সংযতেন্দ্রিয় যোগিগণ যাহাকে সতত চিন্তা করেন, যিনি সেই সারবস্তু পরমাত্মার সারভূত, তুমি সেই দক্ষ। ৯
হে অতি তেজস্বিন্! তুমি যোগবৃত্তি অধ্বর্য্যু এবং পারগামীদিগেরও পরম গতি; তোমাকে বারবার নমস্কার করি। ১০
সেই সকল দেবগণের এই কথা শ্রবণপূর্বক দক্ষ, প্রাধান্য-প্রযুক্ত ইন্দ্রকে সম্বোধন করিয়া প্রসন্ন-বদনে বলিতে লাগিলেন; হে মহাবাহু ইন্দ্র। কি কারণে তোমাদিগের দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে? প্রভো! দুঃখের কারণ কি বল; আমি তাহা শুনিতে ইচ্ছা করি। ১১-১২
তোমাদিগের দুঃখ দূর করতে আমাকেই বা কি করিতে হইবে? আমার সাধ্যাতীত না হইলে আমি তোমাদিগের সম্পূর্ণরূপে হিত করিব। ১৩।
মার্কণ্ডেয় বলিলেন, মহামুনি ব্ৰহ্ম-তনয় দক্ষের সেই কথা শুনিয়া বৃহস্পতি, ইন্দ্র এবং অগ্নি, তাহাকে বলিতে লাগিলেন। ১৪
হে দ্বিজবর! শশধর ক্ষীণ হইয়াছেন, তাহাতে সকল ওষধিই ক্ষয় প্রাপ্ত হইয়াছে; ওষধি অভাবে এখন আর যজ্ঞ হইতেছে না। ১৫
যজ্ঞ বন্ধ হওয়াতে অনাবৃষ্টি হইয়াছে, তাহাতে সকল প্ৰজাই ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির, কতকগুলি প্রজা এইরূপ মহাদুঃখ পাইয়া প্রাণত্যাগও করিয়াছে। ১৬
ব্ৰহ্মন্! আপনার ক্রোধে এই যে চন্দ্রের ক্ষয় হইয়াছে, তাহাতে সমস্ত জগৎ বিনষ্ট হইবার সম্ভাবনা। ১৭
হে বিপ্রশ্রেষ্ঠ! সপ্তসমুদ্র–বল, পশু-পক্ষী বল, সুর-মণ্ডলী বল,–অধুনা ত্রিজগতে এমন কোন পদার্থ নাই, যাহা ক্ষুব্ধ বা বিলুপ্ত হয় নাই। ১৮
এখন আর যজ্ঞ হয় না; তপস্বী তপস্যা করেন না। প্রজাকুল ক্ষীণ ভয়াতুর এবং অন্নকষ্টে হতশ্রী। ১৯
হে বিপ্রবর! এইরূপ বিপ্লব প্রবৃত্ত হইয়াছে, এখন যাবৎ দৈত্যগণ রসাতল হইতে উত্থিত হইয়া আমাদিগকে পীড়া না দেয়, তন্মধ্যে উদ্ধার করুন। ২০
দক্ষ! চন্দ্রের প্রতি প্রসন্ন হউন, তপোবলে তাহাকে পূর্ণ করুন; চন্দ্র পূর্ণ হইলে, সমস্ত জগতই প্রকৃতিস্থ হইবে। ২১
মার্কণ্ডেয় বলিলেন; তখন ব্ৰহ্মনন্দন দক্ষ, দেবগণের এই কথা শুনিয়া তাঁহাদিগের হৃদয় হইতে শল্যোদ্ধার করত তাহাদিগকে বলিলেন; চন্দ্রের প্রতি আমার যে শাপ-বাক্য নির্গত হইয়াছে, আমি কোন নিদান ধরিয়াই তাহা মিথ্যা করিতে পারি না। ২২-২৩
কিন্তু আমার বাক্যও একান্ত মিথ্যা না হয়, অথচ চন্দ্রও বৃদ্ধি পাইতে থাকে এরূপ উপায় দেখ। ২৪।
তাহাতেও এইমাত্র উপায় আছে; চন্দ্র, সকল পত্নীর প্রতি সমান ব্যবহার করুক, তবে একপক্ষ ক্ষয় ও একপক্ষ বৃদ্ধি লাভ করিতে পারিবে। ২৫
হে দ্বিজগণ। দক্ষ এই কথা বলিলে, তাহার সেই কথা শুনিয়া এবং সেই প্রজাপতি দক্ষকে প্রসন্ন করিয়া সুরগণ, সকলেই চন্দ্রমা যথায় ছিলেন তথায় গমন করিলেন। ২৬
অনন্তর ভাৰ্যাগণ পরিবৃত চন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া সেই সুরবরসমূহ হৃষ্টচিত্তে ব্ৰহ্ম-সদনে গমন করিলেন। ২৭
মহাভাগগণ, তথায় গমন করিয়া দক্ষের কথিত সমস্ত কথাই পরমাত্মা ব্ৰহ্মার নিকট বলিলেন। ২৮
ব্ৰহ্মা, দেবগণের প্রমুখাৎ দক্ষের বাক্য শ্রবণ করিয়া সুরগণ সমভিব্যাহারে সুবিস্তৃত চন্দ্রভাগ পৰ্বতে গমন করিলেন। ২৯
সুরশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মা, তথায় গমন করিয়া প্রজাগণের হিত-কামনায় লোহিত নামক বৃহৎসরোবর-জলে চন্দ্রকে স্নান করাইলেন। ৩০
ভূত-ভবিষ্যৎ-বৰ্ত্তমানজ্ঞানসম্পন্ন জগৎপ্রভু পিতামহ, এইজন্যই পূৰ্বে এই স্থানে এই জলপূর্ণ সরোবর সৃষ্টি করেন। ৩১
সেই লোহিত নামক বৃহৎ সরোবরে স্নান করিলে, প্রাণী রোগ-শূন্য এবং চিরজীবী হয়। ৩২
তথা স্নান করিবামাত্র চন্দ্রের শরীর হইতে তৎক্ষণাৎ রাজযক্ষ্মা রোগ নির্গত হইল; তখন আবার তাহার পূর্বের ন্যায় রূপ প্রকাশ পাইল। ৩৩।
রাজযক্ষ্মা, নিঃসৃত হইয়া জগৎপতি ব্রহ্মাকে প্রণামপূর্বক বলিল,-আমি কি করিব? কোথায় যাইব? ৩৪
হে লোকেশ! আপনি ব্রিজগতের সৃষ্টিকর্তা, অতএব আপনি আমার অনুরূপ ভাৰ্য্যা, বাসস্থান এবং চিরন্তন কর্তব্যকাৰ্য্য স্থির করিয়া দিন। ৩৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর, ব্রহ্মা, রাজযক্ষ্মাকে চন্দ্রের শরীর-স্থিত অমৃতপানে পরিপুষ্ট এবং চন্দ্রকে ক্ষীণ দেখিলেন। ৩৬
বাহুযুগল দ্বারা তাহাকে ধারণপূর্বক বারংবার পৰ্বতে নিপীড়ন করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই রাজযক্ষ্মার দেহ হইতে অমৃত বাহির করিয়া লইলেন। ৩৭
লোকপালক ব্রহ্মা সেই বহিষ্কৃত অশুদ্ধ অমৃত, ক্ষীরোদসাগরে জলমধ্যে গোপনে নিক্ষেপ করিলেন। ৩৮
পূৰ্বে চন্দ্রের কলাসকল ক্ষীণ হইয়াছিল, এখন ব্রহ্মা সেই ক্ষীরোদসাগরে নিক্ষিপ্ত অমৃত হইতে তিল তিল কলাচূর্ণ গ্রহণ করিলেন। ৩৯
রাজযক্ষ্মারোগ-প্রভাবে কলামাত্রাবশিষ্ট চন্দ্রের যে অমৃতময়ী পঞ্চদশকলা ক্ষয় পাইয়াছিল, তাহা রাজ-যক্ষ্মারই গর্ভে ছিল। ৪০
এখন নিষ্পীড়ন বশে তৎসমস্ত চুর্ণ হইয়া যাইল। তেজ, জ্যোৎস্না এবং অমৃত এই তিন পদার্থময়। চন্দ্র-শরীর, তিনভাগে বিভক্ত হইয়া রাজ-যক্ষ্মার গর্ভে থাকে। ৪১-৪২
জ্যোতি চূর্ণ হইয়াছিল, জ্যোৎস্না রাজযক্ষ্মা-দেহে লীন হইয়াছিল, আর অমৃতরাশি দ্ৰবভাবে উক্ত রোগের উদরে ছিল। ৪৩।
ব্ৰহ্মা যখন রোগের উদর হইতে অমৃত বাহির করেন, তখন কেবল অমৃত নহে–জ্যোৎস্না, জ্যোতি এবং অমৃত, সকলই বাহির হইয়াছিল। ৪৪
তখন বিধি তৎসমস্তই ক্ষীরোদসাগরে নিক্ষেপ করেন। অনন্তর বিধাতা দেবগণকে পৰ্বতে ছাড়িয়া স্বয়ং সত্বর ক্ষীরোদসাগরে গমন করেন। ৪৫
তৎপরে অমৃত, কলাচুর্ণ এবং জ্যোৎস্না–এই তিন বস্তুই সমুদ্রে প্রক্ষালন পূর্বক গ্রহণ করিয়া সেই পৰ্বতে আগমন করিলেন। ৪৬
বিধি, ক্ষীরোদসমুদ্র হইতে চন্দ্রভাগ পৰ্বতে আসিয়া দেবগণের মধ্যে কলাচুর্ণ, অমৃত এবং জ্যোৎস্না স্থাপন করিলেন। ৪৭
ব্রহ্মা দেবগণের মধ্যে সেই তিন বস্তু রাখিয়া রাজযক্ষ্মার বাসস্থানাদি কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন। ৪৮।
যে ব্যক্তি, দিবা রাত্রি, সন্ধ্যা–সকল সময়েই রমণীতে আসক্ত হইয়া সুরতসেবা করে, হে রাজযক্ষ্মন্! তুমি তাহার শরীরে বাস করিবে। ৪৯
যে ব্যক্তি, প্রতিশ্যায় রোগ, শ্বাসরোগ, কাসরোগ বা শ্লেষ্মরোগযুক্ত হইয়া মৈথুনাসক্ত হয়, তুমি, তাহাতে প্রবেশ করিবে। ৫০
তৃষ্ণানাম্নী মৃত্যুকন্যা, গুণে তোমার অনুরূপা; সেই তোমার ভাৰ্য্যা হউক; সে তোমার সতত অনুগামিনী হইবে। ৫১
ক্ষীণতাই তোমার কর্তব্য কৰ্ম্ম; তুমি যথায় থাকিবে, তাহার ক্ষীণতা করিবে, এখন সত্বর যথেচ্ছ স্থানে গমন কর, চন্দ্রের প্রতি বিমুখ হও। ৫২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–মহারোগ রাজযক্ষ্মা ব্রহ্মার নিকট এইরূপ বিদায় পাইয়া সৰ্ব্বদেবগণসমক্ষে অন্তর্হিত হইল। ৫৩।
সেই মহারোগ অন্তর্হিত হইলে পর, লোক-পিতামহ ব্রহ্মা, কলামাত্রাবশিষ্ট চন্দ্রকে পঞ্চদশ কলার দ্বারা পরিপূর্ণ করিলেন। ৫৪
অর্থাৎ স্বয়ম্ভু, সেই সেই অমৃতরাশি জ্যোৎস্না এবং কলাচূর্ণ দ্বারা চন্দ্রকে পূর্ববৎ করিলেন। ৫৫
যখন চন্দ্র, যোল কলাপূর্ণ হইয়া পূর্ববৎ দীপ্তি পাইতে লাগিলেন, তখন দেবগণ, তাহাকে দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। ৫৬
অনন্তর পূর্ণচন্দ্র, পিতামহকে প্রণাম করিয়া সুর-সভামধ্যে অনতি-হৃষ্ট চিত্তে তাহাকে বলিলেন। ৫৭।
সোম বলিলেন,–ব্ৰহ্মন! আমার শরীরে এখন পূর্বের ন্যায় আস্থা নাই, বীৰ্য্য নাই, উৎসাহ নাই; অঙ্গসন্ধি সকল শিথিল হইয়া পড়িতেছে। ৫৮
আমি পূর্বের ন্যায় চেষ্টা (গমনাদি) করিতে পারিতেছি না; প্রত্যহ এইরূপে চেষ্টাহীন হইয়া থাকিব কিরূপে? ৫৯
ব্ৰহ্মা বলিলেন,–চন্দ্র! যক্ষ্মা-রোগ-গ্রস্ত হওয়াতে তোমার অঙ্গসন্ধি সকল শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, আজও তাহা পূর্ণ হয় নাই। ৬০
আমি, এখন, রাজ-যক্ষ্মার উদর হইতে তোমার যে দেহচূর্ণ, অমৃত এবং জ্যোৎস্না নিঃসারিত করিলাম। ৬১
সেই চূর্ণ, অমৃত এবং জ্যোৎস্নার প্রক্ষালনসময়ে যে কিছু অংশ জলে পড়িয়া গিয়াছে, তাহা তোমার শরীরে নাই। ৬২
এই জন্যই হে রাজন! এখন তোমার অঙ্গসন্ধি সকল অবসন্ন। যাহা হউক, যাহাতে তোমার কষ্ট দূর হইবে, তাহার উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি। ৬৩
যজ্ঞে প্রথমে প্রাজাপত্য, তৎপরে ঐন্দ্র, তৎপরে আগ্নেয় পুরোডাশ আহুতি দিবে; সকল যজ্ঞেই এই নিয়ম। ৬৪
তাহার পর, তোমার ভাগের পুরোডাশ; আমি এই নিয়ম করিয়াছি। সেই যজ্ঞীয় ভাগ নিত্য ভোজন করিলে তোমার পূর্ববৎ উৎসাহ, স্থিতিশক্তি এবং বীৰ্য ইহবে। ৬৫
ক্ষীরোদসাগরের জলে তোমার যে সকল অমৃতাংশ দেহচূর্ণ এবং জ্যোৎস্না কণা বর্তমান আছে, হে শশধর! তৎসমস্তই তোমার জ্যোৎস্নাসংসর্গে প্রত্যহ বাড়িতে থাকিবে। ৬৬।
স্বারোচিধ-মন্বন্তরের দ্বিতীয় সত্যযুগে শঙ্করের অংশ-সম্ভূত, প্রচণ্ড মার্তণ্ড সদৃশ উগ্র-স্বভাবসম্পন্ন দুর্বাসা নামে এক ব্রাহ্মণ হইবেন। ৬৭
তিনি দেবরাজের দুৰ্বিনয় বশতঃ তাহাকে নিদারুণ শাপ দিয়া সুরাসুর পরিবৃত ভুবনমণ্ডলীকে শ্রীহীন করিবেন। ৬৮
হে চন্দ্র! তোমার ক্ষয়ে এখন যেমন লোকবিপ্লব হইয়াছে, সমস্ত জগৎ শ্রীহীন হইলে, এইরূপ লোক-বিপ্লব হইবে। ৬৯
তৃতীয় সত্যযুগে এ ঘটনা হইবে; মনুষ্য-প্রমাণে চারি যুগ এইরূপ বিপ্লববস্থা থাকিবে। ৭০
অনন্তর চতুর্থ সত্যযুগ আসিলে, আমি শিব এবং বিষ্ণু–আমরা দেবগণ সমভিব্যাহারে ক্ষীরোদসাগর মন্থন করিব। ৭১
যজ্ঞভাগহীন হইলে আমরা দেবগণের জন্য মন্দরপৰ্বতকে মন্থনদণ্ড ও বাসুকিকে মন্থন-রজ্জু করিয়া দেব-দানব সমভিব্যাহারে ক্ষীরোদসাগর মন্থন করিব। ৭২
এই তোমার শরীরামৃত, যাহা ক্ষীরোদসাগরে রহিল; রাশীকৃত এই অক্ষয় সুধামন্থন করিয়া গ্রহণ করিব। ৭৩
চন্দ্র। তোমার এই দেহকে পুষ্ট করিবার জন্য সর্বৌষধি দ্বারা বেষ্টিত করিয়া ইহাকে সাগর-জলে নিক্ষেপ করিব। ৭৪
আমরা সাগরমন্থন করিয়া যখন অমৃত উত্তোলন করিব, তখন তোমার দেহ পূর্ববৎ হইবে। ৭৫
তখন তোমার দেহ, তেজো-বীর্য-সম্পন্ন, অক্ষয় সুধাময় এবং দৃঢ়সন্ধি-যুক্ত হইবে। ৭৬
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–লোক-পিতামহ ব্রহ্মা সুধাংশুকে এই কথা বলিয়া তাহার এক পক্ষে ক্ষয়, আর এক পক্ষে বৃদ্ধি–ইহার জন্য যত্নশীল হইলেন। ৭৭
চন্দ্র একপক্ষ ক্ষয় পাইবে, আর একপক্ষ বৃদ্ধি পাইবে, দক্ষ এই কথা বলিয়া ছিলেন, বিধাতা তাহা রক্ষা করিতে যত্নবান হইলেন। ৭৮
অনন্তর সুরশ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মা, চন্দ্রকে ষোলভাগে বিভক্ত করিলেন; বিভাগ করিয়া সমস্ত সুরগণকে এই উত্তম কথা বলিতে লাগিলেন। ৭৯
চন্দ্রের ষোলকলা; তন্মধ্যে এক কলা অদ্যাবধি শিবের মস্তকে থাক্; আর অন্য সমস্ত কলা, বিনা যক্ষ্মারোগে ক্ষয় পাইবে। ৮০
যদি চন্দ্র, দক্ষের বাক্যে, একপক্ষকাল, ক্ষয়রোগে পীড়িত হইয়া ক্ষীণ হয়, তাহা হইলে আর ইহার শান্তি হইবে না। ৮১
হে সুরবরগণ! প্রতিমাসের প্রতিপদ হইতে চতুর্দশী পর্যন্ত চতুর্দশদিনে ক্রমে ক্রমে চন্দ্রের চতুর্দশ কলার জ্যোৎস্না শিবমস্তকস্থিত শশিকলাতে গমন করিবে; অমৃত তোমরা পান করিবে। ৮২-৮৩
তেজোভাগ সূর্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইবে। কৃষ্ণপক্ষে, এইরূপ চন্দ্রক্ষয় হইবে। ৮৪
চন্দ্রের অবশিষ্ট এক কলা অমাবস্যাতিথির প্রথমভাগে হরিৎপত্রে লুকাইয়া থাকিবে। ৮৫
দ্বিতীয় ভাগে রোহিণীতে গমন করিবে; তৃতীয়ভাগে কলাবশিষ্ট বিধু-কলা সরস্বতী নদীতে স্নান করিয়া সমুজ্জ্বল হইবে। ৮৬
আর চতুর্থভাগে বলসম্পন্ন হইয়া নিজমণ্ডল ও রথ-ঘোটক-সমভিব্যাহারে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করিবে। ৮৭।
প্রথম কলার ক্ষয় যতক্ষণে হয়, ততক্ষণেই কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপৎ। কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া প্রভৃতির ক্ষয়-বৃদ্ধিও কলাক্ষয়ের সময়-তারতম্য অনুসারে হইয়া থাকে। এই জন্যই তিথিসকলের হ্রাসবৃদ্ধি শুক্ল, কৃষ্ণ–উভয়পক্ষেই হইয়া থাকে। ৮৮-৮৯
তৎপরে যে পর্যন্ত প্রথম কলা উদয় হইতে থাকে, দ্বিতীর কলার উদয় না হয়, তাবৎ শুক্লপক্ষের প্রতিপৎ, অনন্তর শিবশিরোভূষণ শশিকলাতে অবস্থিত দ্বিতীয় ভাগাদির জ্যোৎস্না ক্রমে পুনরায় আগত হইবে; তোমর কৃষ্ণপক্ষে প্রত্যহ যে অমৃত পান করিবে। ৯০-৯২
হে সুরশ্রেষ্ঠগণ! চন্দ্র শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াদি তিথিতে তৎসমস্ত দ্বারা এবং জ্যোৎস্নাযোগে পূর্ণ হইতে থাকিবে। ৯৩
যেমন কৃষ্ণপক্ষে প্রত্যহ শশিকলা ক্ষয় পাইতে থাকে, হে দেবগণ! সেইরূপ শুক্লপক্ষে প্রত্যহ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। ৯৪
শুক্লপক্ষে চন্দ্রের তেজোভাগ সূর্যমণ্ডল হইতে পুনরায় সমাগত হইবে। আর কৃষ্ণপক্ষে ক্রমানুসারে তাহা সূর্যমণ্ডলে সঙ্গত হইতে থাকিবে। ১৫
শিব-শিরো-ভূষণ-শশিকলা হইতে জ্যোৎস্না পুনরায় আসিবে। তেজোভাগ, সূৰ্য্যমণ্ডল হইতে আসিবে আর অমৃত স্বয়ং উৎপন্ন হইবে। ৯৬
শুক্লপক্ষে এইরূপ চন্দ্রের বৃদ্ধি হইবে। চন্দ্রের বৃদ্ধি-ক্ষয় অনুসারেই শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষ এই দ্বিবিধ নাম হইয়াছে। ৯৭।
যে ভাগ, যতক্ষণে ক্ষয় বা বৃদ্ধি পাইয়া চরমাবস্থাতে উপনীত হইবে, সেই ভাগ-সংখ্যানুসারে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত তিথির পরিমাণ ততক্ষণ হইবে। ৯৮
যদি শীঘ্র কলার বৃদ্ধি বা ক্ষয় হয়, অথবা যদি বিলম্বে কলার বৃদ্ধি বা ক্ষয় হয়, তাহা হইলে, শীঘ্ৰ ক্ষীণ বা বৃদ্ধ কলার অনুসারী তিথি অল্পপরিমাণ, আর বিলম্বে ক্ষীণ বা বৃদ্ধ কলার অনুসারী তিথি দীর্ঘ পরিমাণ হয়। ৯৮-৯৯
চন্দ্ৰব্যতীত হব্য-কব্য হয় না; অতএব হব্য-কব্যের বৃদ্ধির জন্য দেবগণ চন্দ্রকে রক্ষা করুন। ১০০
আর পিতৃগণ প্রতিমাসে অমাবস্যার অপরাহ্নে কলাবশিষ্ট চন্দ্রকে রোহিণী গৃহে ভোজন করিবেন। ১০৯
তদাস্বাদনে প্রত্যহ কব্য বৃদ্ধি হইবে; সেই কব্য দ্বারা পিতৃগণ পরম তৃপ্তি লাভ করিবেন। ১০২
মার্কণ্ডেয় বলিলেন– অনন্তর, দেবগণ সকলে লোকহিতের জন্য চন্দ্রের ক্ষয় বৃদ্ধি বিষয়ে ব্রহ্মার আদেশমত কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। ১০৩
দেবগণ ও ব্রহ্মা অত্যন্ত প্রার্থনা করিলে, মহাদেব পরমাত্মস্বরূপ শশিকলাকে মস্তকে ধারণ করিলেন। ১০৪
যে পরম তেজ জন্মমৃত্যুশূন্য এবং পরিবর্তনরহিত, এই শশিকলা, সেই তেজঃ স্বরূপ, এইজন্য তাহার আর ক্ষয় হয় না। ১০৫
যোগিগণ, যখন অক্ষয় পরমানন্দ জ্যোতিতে প্রবিষ্ট হন, তখন তাহাদিগের মন উক্ত শশিকলাতে বিলীন হইবে। ১০৬
“শিবশিরঃস্থিত শশিকলাতে চিত্ত লীন হইলে মুক্তি হইবে বলিয়া চন্দ্রের দ্বারা মুক্তি হয়” এইরূপ শ্রুতি আছে। ১০৭
মহাদেব, এই সকল বিবেচনা করিয়া ক্ষয়-বৃদ্ধি-শূন্য শশিকলাকে সৰ্ব্বলোক হিতার্থে মস্তকে ধারণ করিলেন। ১০৮
চন্দ্রের চন্দ্রিকাসম্পর্কে ওষধিগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল, ওষধিবৃদ্ধি হইলে, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল। ১০৯
যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইতে থাকিলে দেবগণ নিজ নিজ ভাগ এবং পিতৃগণ প্রচুর পরিমাণে কব্যগ্ৰহণ করিতে লাগিলেন। ১১০
যে সকল দেবতার যজ্ঞভাগ নাই, তাহারা দেবগণের জন্য ব্রহ্মার সৃষ্ট সেই অমৃত দ্বারা তৃপ্তিলাভ করিতে লাগিলেন। ১১১
যজ্ঞ-আপ্যায়িত সেই অমৃত জ্যোৎস্নাযোগে বৃদ্ধি পায়; জ্যোৎস্না ব্যতীত তাহা ক্ষয় পায়। ১১২
অতএব চন্দ্র, অমৃত এবং যজ্ঞের অসামান্য কারণ। দক্ষশাপ হইতে সেই চন্দ্রকে রক্ষা করিবার জন্য এতকাণ্ড করিতে হইয়াছিল। ১১৩
এখনও কৃষ্ণপক্ষে দেবগণ, চন্দ্রের সুধা পান করেন, তেজ-সূর্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হয়, জ্যোৎস্না শিব-শির-স্থিত শশিকলাতে গমন করে। ১১৪
পুনরায় শুক্লপক্ষে এককলা উদিত হয়, তখন, শিব-মস্তকের শশিকলা হইতে পূর্বপ্রবিষ্ট অপর জ্যোৎস্নাংশ আর সূর্য-মণ্ডল হইতে পূর্ব-প্রবিষ্ট তেজ আসিয়া উদিত কলাতে মিলিত হয়। চন্দ্রের ষোলকলা,–তন্মধ্যে এ, কলা শিবের মস্তকে; অবশিষ্ট কলাসকলের ক্ষয় বৃদ্ধি হয়; তাহাতেই শুক্ল ও কৃষ্ণ উভয় পক্ষ। ১১৫-১১৬
ব্রহ্মা সেই পৰ্বত-শ্রেষ্ঠোপরি যে কারণে যেরূপে চন্দ্রকে বিভাগ করেন এবং পৰ্ব্বতের নাম চন্দ্রভাগ হয়, যজ্ঞভাগ এবং কব্য (পিতৃভোজ্য অন্নাদি) থাকিতেও যে জন্য ব্রহ্মা চন্দ্রকে দেবগণের ও পিতৃগণের ভোজ্য করেন এবং যেরূপে তিথির ক্ষয়-বৃদ্ধি হয় তৎসমস্ত তোমাদিগকে এই বলিলাম। ১১৭-১১৮
এই পবিত্রতম উপাখ্যান যে ব্যক্তি একবারও শ্রবণ করিবে, তাহার বংশে কদাচ রাজযক্ষ্মা হইবে না। ১১৯
যে ব্যক্তি, যক্ষ্মা রোগগ্রস্ত হইয়া ব্রহ্মার এই সকল কথা শ্রবণ করে, সে ব্যক্তি অচিরে রোগমুক্ত হইয়া প্রাধান্য লাভ করে। ১২০
যে ব্যক্তি এই গুহ্য হইতে গুহ্য পরম-স্বস্ত্যয়নস্বরূপ পবিত্ৰ উপাখ্যান একান্ত চিত্তে শ্রবণ করে, সে অত্যন্ত পুণ্যভাগী হয়। ১২১
একবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। ২১