গদ্য : নতুন সম্রাট
বাঙলা ভাষায় গদ্য উনিশশতকের শ্রেষ্ঠ উপহার। আজ চারদিকে গদ্যের জয়জয়কার, গদ্য ছাড়া আজ এক মুহূর্ত চলে না। গল্প, উপন্যাস, নাটক লেখা হচ্ছে গদ্যে; প্রবন্ধ গদ্য ছাড়া লেখাই যায় না; এমনকি কবিতাও আজকাল লেখা হচ্ছে গদ্যে, যেমন আগে প্রবন্ধ লেখা হতো কবিতায়। আধুনিক জীবন গদ্যশাসিত; বর্তমানের প্রভু হচ্ছে গদ্য। গদ্য আগেও ছিলো, বিকশিত হতে শুরু করে উনিশশতকের প্রথম দশকে। ব্যাপক হয়ে ওঠে পরবর্তী দশকগুলোতে। উনিশশতকের আগে গদ্য ছিলো, তবে গদ্য লেখা হয়েছে খুবই কম। বাঙলা ভাষার উদ্যমশীল গবেষকেরা অনেক গবেষণা করে উনিশশতকের আগে যে গদ্য ছিলো, তা প্রমাণ করেছেন। সে-গদ্য যেনো গদ্যের জন্মের আগের অবস্থা, তাকে অচেনা লাগে। সে-গদ্যের নমুনা রয়েছে মধ্যযুগের কিছু চম্পুকাব্যে, আছে কিছু দলিল ও চিঠিপত্রে। চম্পুকাব্য হচ্ছে গদ্যেপদ্যে লেখা কাব্য।
মধ্যযুগের কিছু দলিলে বাঙলা গদ্যের আদিরূপ পাওয়া গেছে, এবং পাওয়া গেছে কিছুকিছু চিঠিতে। এরকম একটি চিঠি হচ্ছে কুচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের। তিনি এ-মূল্যবান চিঠিটি ১৫৫৫ অব্দে লিখেছিলেন অহোমরাজ স্বৰ্গদেবকে। এ-চিঠি পড়লে মনে হয় যেনো যে-শিশু সদ্য কথা বলতে শিখছে, সে কারো কাছে চিঠি লিখেছে। একটি দলিল পাওয়া গেছে ১৬৯৬ সালে লেখা। এছাড়া আরো কিছু চিঠি এবং সাহিত্য নয়, এরকম গদ্য রচনা পাওয়া গেছে মধ্যযুগের। এসব রচনা দেখলে শুধু দুঃখ বাড়ে, কেননা পড়ে বুঝতে হলে ভীষণ কষ্ট করতে হয়।
বাঙলা গদ্যের বিকাশে বিদেশিদের অবদান অসামান্য। এটা স্বীকার করা ভালো। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কথা বলার সময় তা বোঝা যাবে। তবে আঠারোশতকেই বিদেশিরা মন দিয়ে বাঙলা গদ্য লেখা শুরু করেছিলেন। এ-বিদেশিরা ছিলেন পর্তুগিজ। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের লিসবন থেকে তিনটি বাঙলা গদ্যে লেখা বই মুদ্রিত হয়। বই তিনটির দুটি রচনা করেছিলেন একজন পর্তুগিজ। বইগুলো যদিও লেখা বাঙলা ভাষায়, কিন্তু এগুলো ছাপা হয়েছিলো রোমান অক্ষরে। আর ছাপাও হয়েছিলো বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত লিসবনে। বই তিনটির একটির লেখক দোম আনতোনিও। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার ভূষণা অঞ্চলের জমিদারের পুত্র। তাঁর বইয়ের নাম ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিকসংবাদ। অপর বই দুটির লেখক পাদ্রি মনোল দা আসসুম্পসাঁউ। পাদ্রি মনোএল-এর একটি বইয়ের নাম কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ, এবং অপর বইটির নাম বাঙলা-পর্তুগিজ অভিধান। কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ বইটি রচিত হয়েছিলো ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে, ভাওয়াল পরগণায়। তার অভিধানটিও রচিত হয়েছিলো ভাওয়ালেই।
এসব সত্ত্বেও বাঙলা গদ্য উনিশশতকেরই উপহার। এ-উপহার দানের গৌরব সবার আগে দাবি করতে পারে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এ-কলেজে গড়ে ওঠে গদ্য। তাই বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটি বড়ো অধ্যায়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ৪ তারিখে। ইংরেজরা এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে স্থাপন করে এ-কলেজ। ইংরেজরা তখন দেশের রাজা। বিলেত থেকে এদেশে আসতো তরুণ ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। যোগ্যতার সাথে শাসনের জন্যে তাদের পরিচয় থাকার দরকার ছিলো এ-দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ওপর ভার পড়ে রাজকর্মচারীদের এ-দেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার। তাদের শিক্ষা কেন্দ্র করে এ-কলেজে বিকশিত হয় বাঙলা গদ্য।
১৮০১ অব্দে উইলিয়ম কেরি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যোগ দেন বাঙলা ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপকরূপে। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগ দিয়ে মনোযোগ দেন গদ্যের বিকাশে। তাঁর সহায়ক হন কয়েকজন পণ্ডিত। এ-পণ্ডিতদের মধ্যে আছেন রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এবং আরো কয়েকজন। পণ্ডিতেরা কেরির পরিচালনায় বিকাশ ঘটাতে থাকেন গদ্যের। কেরি নিজেও বসে ছিলেন না, তিনিও গদ্যের সাধনায় নামেন। এর ফলে শুরু হয় বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ। এখানে অবশ্য সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা হয় নি, সিভিলিয়ানরা যাতে সহজে এ-দেশের নানা কিছুর সাথে পরিচিত হতে পারে, বই রচনার সময় তা লক্ষ্য রাখা হয়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে তাই রচিত হয় পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তককে নির্ভর করেই বেড়ে ওঠে গদ্য। এখান থেকে যে-সব বই প্রকাশিত হতো, সেগুলোর দাম ছিলো কিন্তু বেশ। তাই সবাই সে-বই কিনতে পারতো না। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতেরা বাঙলা গদ্যকে পূর্ণ বিকশিত করতে পারেন নি, তাঁরা শুধু ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৮০১ থেকে ১৮২৬-এর মধ্যে এ-কলেজ থেকে বেরোয় অনেকগুলো বাঙলা বই।
বাঙলা অক্ষরে মুদ্রিত বাঙালির লেখা যে-বইটি সর্বপ্রথম ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাপাখানা থেকে বেরোয়, সেটির নাম প্রতাপাদিত্যচরিত্র। বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে। বইটি লিখেছিলেন রামরাম বসু। তিনি ভাগ্যবান ব্যক্তি। তাঁর বই সবার আগে ছাপা হয়েছিলো, এজন্যেই তো আমরা তাঁকে চিরকাল মনে রাখবো। গদ্যলেখক হিশেবেও তিনি একেবারে ফেলনা নন। তিনি লিখেছিলেন আরো একটি বই। বইটির নাম লিপিমালা। এটি বেরিয়েছিলো ১৮০২ অব্দে। রামরাম বসুর জীবন খুব রোমাঞ্চকর। তিনি কেরিকে বাঙলা শিখিয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের যিনি ছিলেন পরিচালক, সেই উইলিয়ম কেরিও লিখেছিলেন কয়েকটি বই। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথোপকথন। এটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের দ্বিতীয় বই; প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮০১-এ। এ-বইটি কলকাতা ও শ্রীরামপুর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন। মানুষেরা নানা বিষয়ে কথা বলেছে এ-বইতে। তাই এ-বইটিতে সেকালের মানুষের মুখের ভাষার পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কেরি এ-দেশের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তার এ-বই পড়লে বোঝা যায় তিনি এদেশবাসীকে কেমন তীক্ষ চোখে দেখেছিলেন। এখানে নানা শ্রেণীর মানুষ কথা বলেছে; কথা বলেছে মেয়েরা, বুড়োরা, উঁচুশ্রেণীরা, নিচুশ্রেণীরা। কেরি যেনো তাঁর বইতে নিজে কিছু না লিখে সত্যিকার মানুষের কথাবার্তা অবিকল তুলে দিয়েছেন। কেরির কথোপকথন -এ সেকালের মেয়েরা কথা বলে এভাবে :
তোমার কয় যা।
আমি সকলের বড় আমার আর তিন যা আছে।
কেমন যায় যায় ভাব আছে কি কালের মতো।
আহা ঠাকুরাণী আমার যে জ্বালা আমি সকলের বড় আমাকে তাহারা অমুক বুদ্ধি করে না।
বেশ সহজ সরল নরম না কথাগুলো? কেরির আরো একটি বই হচ্ছে ইতিহাসমালা। বইটি বেরিয়েছিলো ১৮১২ অব্দে। এতে আছে কয়েকটি গল্প। সহজ সরলভাবে বলা।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি বই লিখেছিলেন, তিনি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার [১৭৬২-১৮১৯]। তিনি প্রতি মাসে বেতন পেতেন দুশো টাকা। তিনি লিখেছিলেন পাঁচটি বই, তার মধ্যে চারটি প্রকাশ করেছিলো ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। তাঁর বইগুলো হচ্ছে বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলি (১৮০৮), প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮১৩)। তাঁর আরেকটি বই বেদান্তচন্দ্রিকা (১৮১৭)। বাঙলা গদ্যকে সামনের দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বিদ্যালঙ্কার। তাঁর রচনায় একজন ভালো শিল্পীর হাতের ছোঁয়া লক্ষ্য করার মতো। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আরো যারা লেখক ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন গোলকনাথ শৰ্মা, তারিণীচরণ মিত্র, চণ্ডীচরণ মুনশি, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, রামকিশোর তর্কালঙ্কার, হরপ্রসাদ রায়। তারিণীচরণ লিখেছিলেন এশপের কাহিনী (১৮০৩), চণ্ডীচরণ লিখেছিলেন তোতা ইতিহাস (১৮০৫), রাজীবলোচন লিখেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫)। রামকিশোর লিখেছেন হিতোপদেশ (১৮০৮) এবং হরপ্রসাদ রায় লিখেছেন পুরুষপরীক্ষা (১৮১৫)। এসকল বই ব্যতীত উইলিয়ম কেরি দু-খণ্ডে সংকলন করেন বাঙলা ভাষার অভিধান। এর প্রথম খণ্ডটি বেরোয় ১৮১৫ অব্দে, এবং দ্বিতীয়টি বেরোয় ১৮২৫-এ। অসাধারণ এ-অভিধান।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তক লেখকেরা বাঙলা গদ্যের বিকাশে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে তাঁদের গদ্য পরিপূর্ণ বিকশিত নয়; পাঠ্যপুস্তকও পুরোপুরি পাঠ্যপুস্তক নয়। তাঁদের লেখা পড়ে বুঝতে কষ্ট হয়। এমন অনেক শব্দ আছে যা আজ আর কেউ ব্যবহার করে না। তাছাড়া এ-গদ্যে দাঁড়ি নেই, কমা নেই, সেমিকোলন নেই; নেই আরো অনেক কিছু। পণ্ডিতেরা ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত, তাই তাঁরা অনেক জায়গায় ব্যবহার করেছেন কঠিন কঠিন সংস্কৃত শব্দ। তবে এ-গদ্যের আলোতেই পথ দেখেছেন পরবর্তী গদ্যলেখকেরা। এরপরে এসেছেন অনেক বড়ো বড়ো গদ্যশিল্পী। যেমন, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তারা বাঙলা গদ্যকে ভেঙেছেন, নতুন করে গড়েছেন।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পর বাঙলা গদ্য লাভ করেছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লালনপালন। পত্রপত্রিকা গদ্যের প্রবাহকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে। উনিশশতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত হয়েছিলো সাময়িকপত্র, বাঙলা গদ্য এসকল পত্রপত্রিকা আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। পত্রপত্রিকাগুলোতে থাকতো নানা জ্ঞানের কথা, নানা রসের কথা, থাকতো নানা বাদপ্রতিবাদ। এর ফলে গদ্যের সীমাও যায় বেড়ে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গদ্যের পরিধি ছিলো সীমিত, কেননা সেখানে রচিত হয়েছে শুধু পাঠ্যবই। জীবনের সকল দিকের প্রতি তাদের লক্ষ্য ছিলো না। পত্রপত্রিকার লক্ষ্য জীবনের সবদিকে। তাই গদ্য বিস্তার লাভ করে।
বাঙলা ভাষায় প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। পত্রিকাটির নাম দিকদর্শন। এ-পত্রিকায় বাঙলা গদ্য বেশ সহজ সরলভাবে ব্যবহৃত হয়। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮-তে বেরোয় আরো একটি পত্রিকা। নাম সমাচার দর্পণ। এটি ছিলো সাপ্তাহিক পত্র। এর সম্পাদক ছিলেন জে সি মার্শম্যান। এপত্রিকায় চাকুরি করতেন পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত তারিণীচরণ শিরোমণি।।
বাঙালিদের প্রচেষ্টায় যে-পত্রিকাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো তার নাম বাঙ্গালা গেজেটি। এটি ছিলো সাপ্তাহিক পত্রিকা; প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮১৮ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে। পত্রিকাটি বেশিদিন বাঁচে নি। সব পত্রিকার মধ্যে সমাচার দর্পণ-এর অবদান উল্লেখযোগ্য। এ-পত্রিকাটিতে সাহিত্য-ভাষা-রাজনীতি-ইতিহাস নানাবিধ বিষয় ঠাঁই পেতো। এ-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশতকের প্রথম দিকের বিখ্যাত নকশা “বাবু উপাখ্যান”।
১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় শিবপ্রসাদ রায় ছদ্মনামে প্রকাশ করেন ব্রাহ্মণ-সেবধি নামে একটি মাসিক পত্রিকা। রামমোহন ভালো গদ্যলেখক ছিলেন; এ-পত্রিকাটিতে তাই মোটামুটি ভালো গদ্য স্থান পেতো। ১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো একটি পত্রিকা। নাম সম্বাদকৌমুদী। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পত্রিকাটি বের হতে প্রতি মঙ্গলবারে। ভবানীচরণ ছিলেন একজন ভালো লেখক। তিনি লিখেছিলেন একটি নামকরা বই—কলিকাতা কমলালয়। পরে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বের করেছিলেন আরেকটি পত্রিকা, সমাচারচন্দ্রিকা নামে। এ-পত্রিকার প্রধান কাজ ছিলো সতীদাহপ্রথা নিবারণের বিরুদ্ধে লেখা। ভবানীচরণ রক্ষণশীল ছিলেন; তিনি বিরোধিতা করেছিলেন সেকালের অনেক প্রগতিশীল আন্দোলনের। তবে তিনি রচনা করেছিলেন কয়েকটি বই। সেগুলো হচ্ছে কলিকাতা কমলালয়, নববাবুবিলাস, নববিবিবিলাস।
কিন্তু সব পত্রপত্রিকাকে ছাপিয়ে উঠেছিলো একটি পত্রিকা, সেটির নাম সম্বাদপ্রভাকর। এটির সম্পাদক ছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পত্রিকাটি সাপ্তাহিকরূপে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারিতে। ১৮৩৯ সালে এটি পরিণত হয় দৈনিক পত্রিকায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন নামকরা কবি, তাঁর গদ্যও বেশ ভালো। তিনি উনিশশতকের অন্তত দুজন মহৎ লেখককে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। একজন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অপরজন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। এ-পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বাঙলার সাহিত্যসংস্কৃতিকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন। তাই এতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো গদ্য-পদ্য এবং বিভিন্ন শ্রেণীর রচনা। ঈশ্বরগুপ্ত প্রভাকর-এর পাতাতেই প্রকাশ করেন প্রাচীন কবিদের জীবনী, প্রকাশ করেন কবি ভারতচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্যের পরিচয়। এভাবে জীবনের সকল দিক উন্মােচিত হওয়ার সাথে বিকশিত হয়েছিলো বাঙলা গদ্য। ১৮৮১ সালে বের হয় জ্ঞানান্বেষণ নামে একটি পত্রিকা। এ-সকল পত্রপত্রিকা আশ্রয় করে বাঙলা গদ্য অনেকখানি সবলতা লাভ করে। সবলতা আসে সবদিকে। ভাষা ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। গদ্যের প্রয়োজন তো সর্বত্র। তাই তার রূপও হওয়া দরকার বিচিত্র। গদ্য যখন ব্যবহৃত হয় প্রবন্ধে তখন তার রূপ এক, যখন গদ্য ব্যবহৃত হয় উপন্যাসে তখন তার রূপ আরেক। যখন গদ্য হালকা রচনায় ব্যবহৃত হয় তখন তা থাকে এক রকম, যখন তা ব্যবহৃত হয় গুরু রচনায়, তখন তা হয় অন্যরকম। সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় গদ্যে আসে এ-বৈচিত্র্য। তবে বাঙলা গদ্যকে সাবলীল করে তোলেন মহৎ গদ্যশিল্পীরা।