২১. খাম খুলে চিঠির ওপর নজর

খাম খুলে চিঠির ওপর নজর বোলাতে বোলাতে দীপাবলীর মুখে অদ্ভুত সব অভিব্যক্তি খেলা করে যেতে লাগল তারই অজান্তে। এই মুহূর্তে মায়ার দুর্ঘটনার কথা সে একেবারে বিস্মিত। একদিকে প্রত্যাশা পূর্ণ হবার আনন্দ অন্য দিকে একটা আচমকা বিস্ময়। সে চিঠিটা দুবার পড়তেই একটি বউ দৌড়ে এল, উনি তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছেন। তাড়াতাড়ি এসো।

দীপাবলীর বাস্তবে ফিরে আসতে দেরি হল না, কে?

জেঠি।

দীপাবলী এবার মায়াদের শরিকের পুত্রবধূকে চিনতে পারল। একে সে খুব কমই দেখেছে। এই বাড়ি ভাগাভাগি হবার পর আর দেখার সুযোগ হয়নি। সে কথা না বাড়িয়ে মায়ার মাকে দেখার জন্য পা বাড়াতেই বউটি বলল, ওকে এখন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।

দীপাবলী বউটিকে অনুসরণ করল। এখানে আসার পর মায়ার মাকে সে একটি বছরের জন্যেও বাড়ির এই এলাকায় পা বাড়াতে দ্যাখেনি। বিপদ মানুষের ব্যবধান কমিয়ে দেয়। মাসীমা বসেছিলেন একটা তক্তাপোশর ওপর। তাঁকে ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। একজন বলে উঠল, ওই তো এসে গিয়েছে। এবার একটু শান্ত হন।

মাসীমা কাঁদছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে মনের অবস্থার প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কাঁপা হাত বাড়িয়ে তিনি দীপাবলীকে আঁকড়ে ধরলেন, কি হবে এখন?

দীপাবলী পাশে এসে বসল, আপনি নার্ভাস হবেন না। আমি একটু আগে সুদীপের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। ও আজ সন্ধের ট্রেনে দার্জিলিং-এ যাচ্ছে। আপনাকেও তৈরি হয়ে থাকতে হবে। যাওয়ার পথে সুদীপ আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।

কিন্তু তার খবর কি?

সেটা এখনই জানা যাচ্ছে না, গিয়ে জানতে পারবেন।

জানতে পারবেন মানে? তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছে না?

এত লোক গিয়ে ভিড় বাড়িয়ে কি লাভ?

যে সব মহিলা শুনছিলেন তাঁদের একজন বললেন, এত লোক কোথায়? জামাই আর শাশুড়ি। দুজনে গিয়ে সামলাতে পারবে কি করে?

দুজনে কেন হবে? শমিতের নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েও সামলে নিল সে, ওখানে শুটিং করতে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরাও নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়িয়েছেন।

হঠাৎ মাসীমা দীপাবলীর হাত আঁকড়ে ধরলেন, তুমি আমার সঙ্গে চল। তুমি কাছে না। থাকলে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ব। আমার মাথায় কিছু আসছে না।

সেই মহিলা বললেন, ঠিকই তো। রক্তের আত্মীয় না হোক একই বাড়িতে একই হাঁড়িতে তো মাসের পর মাস থাকা খাওয়া হচ্ছে, তার কোন দাম নেই? তাছাড়া তুমি তো মায়ার কতদিনের বন্ধু! সে হাসপাতালে আছে আর তুমি এ বাড়িতে একা থাকতে পারবে?

দীপাবলী মাসীমার দিকে তাকাল। তাঁর চোখ থেকে সমানে জল ঝরছে। ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিল সে। তার বাঁ হাতে ধরা খামটার কথা এখন এই পরিবেশে কাউকে বলা যাবে না। আর সেই খামের ভেতর ভাঁজ করা চিঠি বলছে সময় বেশি নেই। কিন্তু সে মায়ার কাছে ঋণগ্রস্ত। যাদবপুরের কলোনিতে যখন অসুস্থ বেশ হয়ে পড়েছিল তখন। মায়াই তাকে এই বাড়িতে তুলে এনে সেবা করেছে। এমন কি আশ্রয়হীন হয়ে এই পর্বে কলকাতায় এসে সে মায়ার সাহায্যেই এ বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। ব্যক্তিগত যে সমস্যাই থাকুক মানুষ হিসেবে সব উপেক্ষা করে দার্জিলিঙ-এ ছুটে যাওয়া উচিত। সে ভাঙা গলায় বলল, ঠিক আছে, মাসীমা, আপনি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন। আমরা স্টেশনে গিয়ে আর একটা টিকিট কিনে নেব।

দীপাবলী সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে ফিরে এল। দরজা খুলে সটান বিছানায়। টান টান সমস্ত শরীরে অদ্ভুত অবসাদ। তার খামটি হাতের মুঠোয় তখনও ধরা। অথচ শরীরে একটা ঝিমঝিমানি পাক খাচ্ছে। চিঠিটা হাতে পেয়ে যে আনন্দ এবং বিস্ময়ে একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত সত্ত্বায় তা আচমকা থিতিয়ে গিয়েছে যেন।

ওই চিঠির লেখাগুলো বলছে সময় বেশি নেই। মেডিক্যাল বোর্ড এবং মুসৌরি সার্ভিস কলেজে যোগ দিতে মাত্র দিন সাতেক সময় দেওয়া হয়েছে। এই সাতদিনের মধ্যে অন্তত দুদিন চলে যাবে পথেই। অর্থাৎ হাতে থাকল পাঁচ দিন। এর মধ্যেই তাকে সব গুছিয়ে নিতে হবে। কলকাতার পাট হয় তো পাকাপাকিভাবে চুকিয়ে দিতে হবে। অত দূরের পথ, রেলের রিজার্ভেশন আজকেই করা দরকার। মিনিট তিনেক শুয়ে রইল দীপাবলী। এবং তখনই তার মনে ভেসে উঠল অমরনাথ এবং সত্যসাধন মাস্টারের মুখ। সেই মুখ দুটিতে উজ্জ্বল হাসি। দীপাবলী চোখ বন্ধ করল, বাবা, আমি পেরেছি। অমরনাথ যেন তৃপ্তির হাসি হেসে সত্যসাধন মাস্টারের দিকে গর্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। সত্যসাধন এগিয়ে এলেন। চোখ বন্ধ করে তাঁকে দেখতে গিয়ে হঠাৎই যেন সেই ঘামের গন্ধ নাকে এল। সত্যসাধন মাস্টার বললেন, আমি কইছিলাম তুম পারবা। নাউ আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। গো অ্যাহেড। প্রথম তোমার প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হইল। ফাইট দ্যাট। ডোণ্ট লুক ব্যাক।

চোখ খুলে ফেলল। সে যে ছাদের ঘরে শুয়ে এটুকু বুঝতে সময় লাগল। এবং তারপরেই সবাঙ্গে কাঁপুনি এল। সে কি সত্যি এতক্ষণ মৃত মানুষের দেখা এবং কথাবার্তা। শুনেছে? আশ্চর্য। এখনও নাক থেকে নস্যির গন্ধটা দূর হয়নি। ধীরে ধীরে তার বুকে অদ্ভুত শক্তি জড়ো হল। এখন তোমার প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হইল। মাস্টারমশাই, তাহলে এতদিন আমি কি করেছি? ডোন্ট লুক ব্যাক! ঠিক আছে, পেছনের দিকে আর ফিরে তাকাব না। দীপাবলী খাট থেকে নামল। ঘড়ি দেখল। তাকে এখনই যেতে হবে ডালহৌসিপাড়ায়। দুটো টিকিটই একসঙ্গে কাটবে। যেমন করেই হোক দার্জিলিং থেকে ফিরে আসবে চারদিনের মধ্যে। আরও আগে ফিরলে খুবই ভাল। খামটাকে সটকেসে ঢুকিয়ে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের দিকে তাকিয়ে একটু ভাবল। এই হলাম আমি। কোন ভাল জিনিস নিরবচ্ছিন্নভাবে দিতে ঈশ্বর চিরকাল যার ওপর নারাজ। কেন? কেন সে এই চিঠি পেয়ে ধীরস্থির সুস্থভাবে চাকরিতে যেতে পারবে না? কেন তাকে তার আগে দার্জিলিং-এ ছুটতে হবে? মায়ার দুর্ঘটনা কি এখনই না ঘটালে চলত না? নিজের মুখের দিকে তাকাল সে। হ্যাঁ, সে লড়াই করবে। শেষতক। দেখা যাক জিততে পারে কিনা।

বিকেলে সুদীপ এল ট্যাক্সি নিয়ে। ততক্ষণে টিকিট কিনে বাড়ি ফিরে মাসীমাকে নিয়ে দীপাবলী তৈরী। সুদীপ তাকে তৈরী দেখে অবাক, সেকি? তুমি যাচ্ছ?

হ্যাঁ। মাসীমা চাইছেন আমি সঙ্গে যাই।

ও। ভালই।

সীমাকে বাড়ির বাইরে সে কখনও দ্যাখেনি। আজ দেখে অবাক। যে ভদ্রমহিলার ভালো পড়াশুনা আছে, বাঙালি মেয়েদের জাগরণের গল্প যার মুখ, অনেক ব্যাপারই যিনি উদার মানসিকতায় নিতে পারেন তিনি দরজার বাইরে পা দেওয়ামাত্র কেমন জড়ভরত হয়ে গেলেন। ঘোমটা নামল ভুরুর ওপরে, ট্যাক্সিতে বসে রইলেন পুঁটুলির মত। জামাই হিসেবে সুদীপ তো তার অনেকদিনের চেনা। বিয়ের আগেও গল্প করেছেন। অতএব তাকে দেখে লজ্জা পাওয়ার কথা নয়। হয়তো মেয়ের দুর্ঘটনার কথা শোনার পর থেকেই ওঁর নার্ভ ঠিক জায়গায় নেই। সুদীপও কোন কথা বলছে না।

ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি। মেয়েদের কামরায় দীপাবলী উঠল মাসীমাকে নিয়ে। সুদীপ যাওয়ার আগে অবশ্য জিজ্ঞাসা করে গিয়েছিল পথে তাকে আসতে হবে কিনা। মাসীমা মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলেছিলেন, না, ওকে বল কষ্ট করার দরকার নেই। গলা যত নিচেই থাক সুদীপ শুনতে পেয়েছিল। সে চলে যাওয়ার পর ট্রেন ছাড়লে দীপাবলীর মনে হল সমস্ত ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। সুদীপের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে তিনি কি ভাবে নিয়েছিলেন তা সে জানে না। তখন সে কলকাতার বাইরে। কিন্তু সুদীপের কাছ থেকে যখন মায়া চলে এল তখন যে তিনি মেয়েকে সমর্থন করেছেন এমন নজির সে পায়নি। মাঝে মাঝে মা মেয়েতে এই নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটিও হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই তার উপস্থিতিতে কখনও করেননি মাসীমা। মনে হয়েছিল সুদীপের সঙ্গে একটা সমঝোতায় মেয়েকে যেতে বলতেন তিনি। আর এই দুর্ঘটনার পর হঠাৎ কেন সুদীপ সম্পর্কে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। এখন বোঝা যাচ্ছে কেন তিনি একা সুদীপের সঙ্গে যেতে চাননি। এমন হতে পারে মেয়ের দুর্ঘটনার পরোক্ষ কারণ হিসেবে তিনি জামাইকে দায়ী করছেন। অন্তত সুদীপের সঙ্গে এতটা পথ ট্যাক্সিতে আসার সময় যিনি কথা বলেননি, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অথবা কামরায় বসেও যিনি নির্বাক ছিলেন তিনি নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর মন্দ লাগার। কথা। দীপাবলী প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কোন কৌতূহল দেখাল না। হঠাৎ ছুটন্ত দার্জিলিং মেলে বসে ছুটে যাওয়া উল্টোডাঙার দিকে তাকিয়ে তার খেয়াল হল এটাই জলপাইগুড়ি যাওয়ার পথ। কতকাল এই পথে এই ট্রেনে যাওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত সব নস্টালজিক অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে গেল সে।

হঠাৎ মাসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, দার্জিলিং-এ গিয়ে মায়া কি তোমাকে চিঠি লিখেছে?

চমকে উঠল দীপাবলী, না তো?

মাসীমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কেন বলুন তো?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাসীমা জবাব দিলেন, কে যেন বলল তোমার চিঠি এসেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু সেটা তো দিল্লি থেকে।

দিল্লি?

হুঁ। আমি ইন্টারভিউতে পাস করেছি। কথাটা না বলে পারল না সে।

চট করে মুখ তুলে ঘোমটার নিচ দিয়ে দীপাবলীকে দেখলেন একবার তারপর আবার মুখ নামিয়ে নিলেন মাসীমা। অনেকক্ষণ কোন কথা নেই। দক্ষিণেশ্বর স্টেশন ছাড়িয়ে বালি ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। গুম গুম শব্দ বাজছিল অন্ধকারে। যাত্রীরা অনেকেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের উদ্দেশে নমস্কার করছিল। দীপাবলী দেখল মাসীমা একটুও নড়লেন না। হয় তিনি ওখানে মন্দিরের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানেন না অথবা কোন উৎসাহ নেই। বেশ কিছুক্ষণ বাদে চারধার যখন শান্ত শুধু চাকার আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ বাজছে না তখন মাসীমা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে কবে যেতে হবে?

দিন পাঁচেকের বেশি সময় পাব না।

ও। এই যাওয়াই শেষ যাওয়া? শেষ যাওয়া বলছেন কেন? আমি কি ছুটি পাব না?

মানুষের পায়ের তলায় শেকড় আছে। পুরনো জায়গা থেকে শেকড় তুলে নিতে তার যেমন বেশি সময় লাগে না তেমনি নতুন জায়গায় সেই শেকড় বসে যেতেও দেরি হয় না।

ঠিক আছে, আপনি দেখবেন।

তোমার তাহলে আমাদের সঙ্গে আসা উচিত হয়নি।

দীপাবলী জবাব দিল না।

মাসীমা বললেন, যখন ওরা তোমাকে আসার জন্যে জেদাজেদি করছিল তখন তো তুমি এই চিঠিটার কথা আমাকে বলতে পারতে।

বললে আপনি নিশ্চয়ই নিষেধ করতেন। কিন্তু মায়াকে দেখতে যাওয়া আমার কর্তব্য।

কর্তব্য? আমরা গিয়ে ওকে দেখতে পাব না।

আঃ, মাসীমা, কি যা তা বলছেন আপনি?

আমার মন বলছে। ওর ঠিকুজিতেও ছিল। এই বয়সে একটা বড় ফাঁড়া আছে যা কাটানো খুব মুশকিল। ও তো কখনও বিশ্বাস করেনি এসব কথা, আমার মাথায় ছিল না।

মাসীমা, ঠিকুজিতে অনেক ভাল ভাল কথা লেখা থাকে। জাতক রাজা বাদশা না হোক রবীন্দ্রনাথ হবে। কজন হয়?

মন্দ কথা ভীষণ ফলে যায়। বয়স হলে বুঝতে পারবে।

দার্জিলিং-এর পথে জিপে বসে সুদীপ বলল, কোন রেফারেন্স সঙ্গে নেই, না?

কিসের রেফারেন্স?

কোন হাসপাতালে মায়াকে নিয়ে গেছে ওরা!

দার্জিলিং-এ নিশ্চয়ই কলকাতার মত এতগুলো হাসপাতাল থাকবে না।

এইটুকুই। সুদীপ আর কথা বাড়ায়নি। সুদীপ বসেছিল সামনের সিটে। পুরো জিপই। ভাড়া করেছিল সে। মাসীমা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন চুপচাপ। বাইরে প্রকৃতি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্যগুলো একের পর এক সাজিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোন ক্ষেপ নেই। প্রথমবার দার্জিলিং-এ যাওয়ার উত্তেজনাও দীপাবলীর নেই। সে পেছন থেকে সুদীপকে দেখছিল। না, তার বিন্দুমাত্র রাগ হচ্ছিল না সুদীপের ওপরে। বরং হঠাৎ ওর প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হল। সুদীপ জেনেশুনে দুঃখ কিনেছিল। বন্ধুর প্রতি আসক্ত কোন নারীকে যতই ভাল লাগুক আর যাই হোক বিয়ে করা মানে দুঃখকে পথ দেখিয়ে ঘরে ঢোকানো। মায়া ওকে কোনদিন ভালবাসেনি। শমিতের মনে যন্ত্রণা দিতেই সে সুদীপকে বিয়ে করেছিল। ধীরে ধীরে সুদীপ নিশ্চয়ই মোহমুক্ত হয়েছে। আর আজ এই যে সে যাচ্ছে। মায়াকে দেখতে তার পেছনে কতটা আবেগ আর কতটা কর্তব্য তা ঈশ্বরই জানেন। এইরকম মন নিয়ে যে যায় তার যাওয়াটা যেমন মর্মান্তিক যার কাছে যাওয়া হচ্ছে তারও তেমনি সুখের নয়। হয়তো এটাই সুদীপের জীবনে শেষ প্রায়শ্চিত্ত করা, নিজের ভুলের। মানুষ বড় হবার নেশায় এমনি ভুল করে যায়।

দার্জিলিং বাজারের গায়েই যে পুলিশ স্টেশন তার সামনে জিপ দাঁড় করাল সুদীপ। নেমে বলল, আগে এখান থেকে খোঁজ নিয়ে যাই।

ও চলে গেলে মাসীমা বললে, পুলিশের কাছে তো আসিনি, হাসপাতালে সোজা চলে গেলেই তো হত। মিছিমিছি সময় নষ্ট।

কথাগুলোয় যথেষ্ট বিরক্তি মাখানো, দীপাবলী কোন জবাব দিল না। মিনিট তিনেক বাদে সুদীপ বেরিয়ে এল পুলিশ স্টেশন থেকে। এসে ড্রাইভারকে বলল, হাসপাতাল।

সে গাড়িতে ওঠামাত্র দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কিছু শুনলে?

হূঁ। হেড ইনজুরি।

কণ্ডিশন কি রকম?

এরা বলতে পারল না।

হাসপাতালের দরজাতেইশমিত এবং আর একজন দাঁড়িয়ে। তাদের দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটে এল শমিত, এখানকার ডাক্তাররা খুব চেষ্টা করছেন, কিন্তু–!

কিন্তু কি? প্রশ্নটা করল সুদীপ।

চান্স কম। কলকাতায় রিম্যুভ করতে পারলে কিছু সুবিধে পাওয়া যেত। কিন্তু যা কণ্ডিশন তাতে নড়াচড়া করা অসম্ভব। শমিতের মুখে খোচা খোঁচা দাড়ি, শরীর বেশ কাহিল। দেখলেই বোঝা যায় নিঘুম রাত কাটছে।

দীপাবলী দেখল সুদীপের মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠছে। সে চটপট জিজ্ঞাসা করল, ওকে এখন দেখা যাবে? মাসীমাকে অন্তত একবার

শমিত দূরে দাঁড়ানোলোকটির উদ্দেশ্যে বলল, একবার মাসীমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা দেখুন। আপনার সঙ্গে তো ভাল আলাপ হয়ে গিয়েছে।

লোকটি মাথা নাড়ল, আসুন। সঙ্গে সঙ্গে মাসীমা দীপাবলীর হাত চেপে ধরলেন। অগত্যা তাকেও সঙ্গে যেতে হল। এবং দেখা গেল সুদীপ ওদের অনুসরণ করছে।

লোকটির পরিচয় থাকা সত্ত্বেও একজনের বেশি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি কর্তৃপক্ষ দিলেন না। প্রথমে তো তাও দিচ্ছিলেন না। অবস্থা খুবই খারাপ। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। অতএব মাসীমাকে একাই যেতে বলা হল। তিনি দুপা এগিয়ে থেমে গেলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, না, আমি যাব না। সুদীপ, তুমি ওকে দেখে এসো।

দীপাবলী হতভম্ব। সে দেখল সুদীপ তার দিকে তাকিয়েছে। তারপরেই যেন ঝটকা মেরে নিজেকে সচল করে এগিয়ে গেল ভেতরে। মাসীমা দাঁড়িয়ে থাকলেন গম্ভীর মুখে। দীপাবলী ওঁর পাশে চলে এল। এসে হাত ধরল। না, মানুষের মনের কোন চেহারাই তার আজ পর্যন্ত জানা নেই।

মিনিট তিনেক বাদে সুদীপ বেরিয়ে এল। থমথমে মুখ। দীপাবলী ওর দিকে এগিয়ে গেল। সুদীপ মাথা নাড়ল, কোন লাভ নেই গিয়ে সারা মুখমাথায় ব্যাণ্ডেজ করা। সেন্সও নেই।

যে লোকটি শমিতের অনুরোধে তাদের ভেতরে নিয়ে এসেছিল সে বলল, চলুন, বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। একটু বাদে ডাক্তারবাবু আসবেন। তার সঙ্গে কথা বলব।

ওরা বাইরে এসে শমিতকে দেখতে পেল না। লোকটি বলল, আমি অ্যাসিস্টেন্ট প্রোডাকসন ম্যানেজার। দিদি আমাদের ছবিতে কাজ করতে এসেছিলেন। দিদির। অ্যাকসিডেন্টের জন্যে দুদিন শুটিং বন্ধ ছিল। প্রত্যেকেরই মন খুব খারাপ হয়ে গেছে।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এটা ঘটল কি ভাবে?

লোকটি একটু চুপ করে থাকল। সুদীপ রাগী গলায় জিজ্ঞাসা করল, বলুন?

লোকটি বলল, কি বলব, ভাগ্য! আপনাদের শুনতে খারাপ লাগবে। দোষ দিদিরই।

তার মানে? সুদীপের স্বর চড়া হল।

লেবং-এর রাস্তায় শ্যুটিং হচ্ছিল। সিনটা ছিল, দিদি রাস্তা থেকে খানিকটা নেমে ফুল তুলতে যাবেন এমন সময় হিরো জিপ নিয়ে ওপরে ব্রেক করে দাঁড়াবে। ডিরেক্টর দিদিকে মাত্র দুপা নামতে বলেছিলেন। জায়গাটা মোটই খাড়াই নয়। কিন্তু দিদি তা না শুনে আরও নিচে নামতে চেষ্টা করতেই পা হড়কে পড়ে যান বিশ ফুট নিচে পাথরের ওপর। ওখান থেকে তুলে হাসপাতালে আনতে কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে আমাদের।

আমি বিশ্বাস করি না এ কথা। সুদীপ প্রতিবাদ করল।

মানে? লোকটা হাঁ হয়ে গেল।

অভিনয়ের ব্যাপারে মায়া খুবই ডিসিপ্লিন্‌ড। পরিচালক যা বলে তার বাড়তি নিজে করে না।

তাই তো দেখতাম। এবারই হঠাৎ। আসলে আগের রাত থেকে উনি খুব অফ মুডে ছিলেন।

অফ মুডে ছিলেন কেন?

তা আমি বলতে পারব না। আচ্ছা, আপনারা দিদির–?

দীপাবলী কথা বলল, উনি মায়ার মা আর ও স্বামী।

বাঃ, তাহলে কোন চিন্তা নেই। প্রোডিউসার অবশ্য বলেছেন ইউনিটের তরফ থেকে যতদূর সাধ্য সবই করা হবে। তবু আপনারা আসতে আমার স্বস্তি হচ্ছে। আমাকে এখন এই ডিউটিতে রাখা হয়েছে। অবশ্য শমিতবাবু ছিলেন, কিন্তু যা নার্ভাস মানুষ!

দীপাবলী মুখ ফিরিয়ে শমিতকে কোথাও দেখতে পেল না। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওই সময় শমিত কাছে ছিল, মানে, শ্যুটিং স্পটে?

হ্যাঁ। শমিতবাবুই তো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে আগে নিচে পৌঁছে দিদিকে তুলে ধরেন। উনিই তো ওঁকে ওপরে তুলে আনতে সাহায্য করেন। তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছেন। রাত্রেও হোটলে যাচ্ছেন না। প্রথম দিন কিছুই খাননি। তারপর আমিই জোর করে খাবার এনে খাওয়াচ্ছি। উনি যা করছেন তা নিজের মানুষও খুব কম করে।

দীপাবলী দেখল সুদীপের মুখ আরও শক্ত হয়ে গেল। সে খানিকটা এগিয়ে একটা সিড়ির ওপরে বসে পড়ল। মাসীমাও আর দাঁড়াতে পারছিলেন না। তাঁকে ভেতরের অপেক্ষাগৃহে বসিয়ে দিল দীপাবলী। হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার পরে হোটেলের ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিক প্রয়োজনেই হোটেলে যাওয়ার প্রয়োজন। ওই অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা দরকার। মাসীমাকে বসিয়ে রেখে দীপাবলী বাইরে এল। লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে ব্যাপারটা বলতেই সে মাথা নাড়ল, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। শমিতবাবু সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কাছেই, দুপা এগোলে সিঙ্গিং বাৰ্ড হোটেলে উনি আজ থেকে দুখানা ঘর রিজার্ভ করে রেখেছেন আপনাদের নামে।

ও কি করে জানল আমরা আসব?

তা তো জানি না। পুলিশকে খবরটা পৌঁছে দিতে রিকোয়েস্ট করার পরেই উনি বললেন আপনারা তিনজনে এসে যাবেন আজ দুপুরে।

ভাবনা কুল পাচ্ছিল না। সেই শমিত এতটা বাস্তবমুখী হয়েছে তা কল্পনাও করতে পারছে না দীপাবলী! অথচ এখন শমিত ধারে কাছে নেই।

সে জিজ্ঞাসা করল, এখানে এসে মায়া কেমন ছিল?

খুব ভাল। হইচই করতেন। অ্যাকসিডেন্টের আগের বিকেলে ওঁদের শ্যুটিং ছিল না। তাই ওরা হাঁটতে হাঁটতে চিড়িয়াখানার দিকে চলে গিয়েছিলেন। তারপর ফিরে আসার পর শরীর খারাপ বলে শুয়ে পড়েছিলেন। রাত্রে খাননি। ওঁর রুমমেট বেলাদি বলেছিলেন দিদির নাকি মুড খারাপ। তা ফিল্ম ইউনিটে এরকম হয়েই থাকে। একবার এই শিলিগুড়ি লোকেশনে এসে উত্তমবাবু–।

ঠিক আছে। অন্যদের কথা শুনতে চাইছি না। মেয়েরা কি আলাদা হোটলে থাকত?

এক হোটলে এত বড় ইউনিটের জায়গা হয় নাকি? আর্টিস্ট ডিরেক্টররা এক হোটলে আমরা অন্য জায়গায়। কেন বলুন তো?

এমনিই জানতে চাইলাম। শমিতের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে?

নাঃ, একদিনের বাকি ছিল। এই অ্যাকসিডেন্টের জন্যে।

এমন সময় ডাক্তারকে দেখে লোকটা ছুটে গিয়ে বলল, ওনার স্বামী, মা এসে গিয়েছেন। ডাক্তার দাঁড়ালেন। দীপাবলী কাছে গিয়ে নমস্কার করে বলল, আমি ওর বন্ধু।

পেশেন্ট খুব খারাপ কণ্ডিশনে আছে। অপারেশন করা উচিত। কিন্তু মাথার অবস্থা এমন যে আমরা অপারেশন করতে সাহস পাচ্ছি না। তাছাড়া আমাদের এখানে এত বড় অপারেশনের কোন ব্যবস্থা নেই। আপনারা কাল সকালে যদি হেলিকপ্টার ব্যবস্থা করে বাগডোগরা নিয়ে যেতে পারেন তাহলে দুপুরের ফ্লাইটে কলকাতায় পৌঁছে একটা চেষ্টা করা সম্ভব।

সেটা কি করে করবো?

এখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আর না পারলে কাল সকালে আমরা অপারেশনের চেষ্টা করব। আবার বলছি চান্স খুব কম। আমি শমিতবাবুকেও বলেছি। ডাক্তার এগিয়ে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ালেন, পুলিশের সঙ্গে দেখা করেছেন?

হ্যাঁ, ওর স্বামী গিয়েছিল।

পুলিশকে সাহায্য করবেন। এসব কেসে পুলিশেরও কিছু জানার থাকে।

হঠাৎ দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, এটা কি অ্যাকসিডেন্টাল কেস নয়?

যাঁরা স্পটে ছিলেন তাঁরাই বলতে পারবেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি ওঁর মাথার পেছনের স্কাল ভেঙে গিয়েছে। পাহাড় থেকে চিৎ হয়ে কি করে পড়লেন কে জানে। ডাক্তার মাথা নাড়লেন, হেলিকপ্টার পেলেন কিনা তা বিকেলের মধ্যে জানিয়ে যাবেন।

মাথার ভেতর ঝিমঝিম করতে লাগল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সে সুদীপের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল। চুপচাপ শুনল সুদীপ। তারপর বলল, শ্যুটিং-এর সময় অত লোকের সামনে কেউ খুন করার চেষ্টা করবে না। এটা হয় দুর্ঘটনা নয় সুইসাইড।

সুইসাইড? কি যা তা বলছ? ও সুইসাইড করবে কেন?

আমি জানি না।

কিন্তু–। এসব কথা থাক। হেলিকপ্টারের জন্যে চেষ্টা করা দরকার।

কি ভাবে করব? আমি তো কাউকে চিনি না।

চিনতে হবে। আমি শ্যুটিং পার্টিকে বলছি। এখানকার প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করো। চলো, আগে হোটলে যাই। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর এসব করা যাবে।

অ্যাসিস্টেন্ট প্রোডাকশন ম্যানেজার তাদের হোটলে নিয়ে এল। জানা গেল একদিনের টাকা আগাম দিয়ে রেখেছে শমিত। সুদীপ পার্স থেকে টাকাটা বের করে লোকটির হাতে দিল, এটা আপনাদের শমিতবাবুকে দিয়ে দেবেন। বলবেন আমরা খুবই কৃতজ্ঞ।

টাকাটা হাতে নিয়ে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। দীপাবলীর পছন্দ হচ্ছিল না। এসব। সে লোকটাকে বলল, আপনার প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ডাক্তার ওকে। কলকাতায় নিয়ে যেতে বলেছেন। কিভাবে নিয়ে যেতে হবে শুনেছেন। এই ব্যাপারে ওঁর সাহায্য চাই।

লোকটি মাথা নাড়ল, সেই চেষ্টা হয়ে গেছে দিদি। অ্যাকসিডেন্টের দিনই উনি চেষ্টা। করেছিলেন মায়াদিদিকে হেলিকপ্টারে বাগডোগরায় নিয়ে যেতে। লেবং রেসকোর্স থেকে হেলিকপ্টার ওড়ে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল সেটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। দিন সাতেকের আগে সারাবে না।

আশ্চর্য! এই কথাটা তখন ডাক্তারবাবুকে বললেন না কেন?

কোন লাভ নেই। আমি দুবার বলেছি, শমিতবাবুও বলেছেন কিন্তু ডাক্তারবাবুর ওই এক কথা। অন্য হেলিকপ্টার যোগাড় করুন। যেন ফিয়াট খারাপ হয়েছে অ্যাম্বাসার আনুন। মিলিটারির হেলিকপ্টার আছে কিন্তু তারা আমাদের দেবে কেন?

তাঁদের অনুরোধ করেছেন?

দার্জিলিং-এর হাসপাতালে এরকম কেস প্রায়ই হয়। সবাই অনুরোধ করলে ওরা রাখবে? মিনিস্টার ফিনিস্টার হলে কথা ছিল। আপনারা দেখুন না। প্রোডিউসার বলেছেন খরচের জন্যে চিন্তা করবেন না। লোকটি ঘড়ি দেখল, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। ওখানেই আমার থাকার কথা।

একটু পরিষ্কার হয়ে মাসীমাকে নিয়ে আবার হাসপাতালে এল ওরা। খাওয়া দাওয়া নামমাত্র। মাসীমা তো খেলেনই না। এবং সেখানে আসতেই দেখা হল শমিতের সঙ্গে। সুদীপ তাকে উপেক্ষা করে দীপাবলীকে বলল, আমি ডি এমের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। যদি তিনি কোন সাহায্য করতে পারেন।

শমিত মাথা নাড়ল, আমি ঘুরে এসেছি। ভদ্রলোক শিলিগুড়িতে গিয়েছেন।

সুদীপ অন্যদিকে মুখ ঘোরাল, সেটা আমি বুঝব?

সুদীপ। তুই এই অবস্থাতেও আমার ওপর রাগ করে আছিস?

সুদীপ কোন জবাব না দিয়ে হাসপাতালের ভেতর ঢুকে গেল। মাসীমা তাকে অনুসরণ করলেন। দীপাবলী শমিতের দিকে তাকাল। তার কর্মস্থলে গিয়ে যে লোকটা বেয়াদপি করেছিল তার সঙ্গে এই শমিতকে মেলানো যাচ্ছে না। সেই ঘটনার পর এই প্রথম তাদের দেখা হল। সে সহজ হতে চেষ্টা করল, তুমি এখানে বসো।

ওঃ, দিনরাত তো বসেই আছি। মানুষকে বসিয়ে রেখে ঈশ্বর তার খেলা খেলেন।

তাহলে ঈশ্বর মানছ?

শমিত ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দুটো হাত বুকের ওপর নমস্কারের ভঙ্গীতে এনে বলল, দীপা, আমি ক্ষমা চাইছি। তোমার ওখানে গিয়ে ওসব করেছিলাম স্রেফ জেদে। এখন সেই জেদটা কত হাস্যকর তা বুঝতে পারছি। আমি জানি না আমার জন্যে তোমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে কিনা।

দীপাবলী মাথা নাড়ল, না, তুমি কেন দায়ী হবে? ভেতরের তাগিদ থেকেই আমি চাকরি ছেড়েছি। এসব কথা থাক। মায়ার ব্যাপারটা কি করে হল?

সবাই দেখেছে। ও বেশি নিচে নেমে গিয়েছিল শেষপর্যন্ত সামলাতে পারেনি।

তুমি দেখেছ?

দেখতে হয়েছে। আমি সহ্য করতে পারছি না। হয়তো আমি রাজী হয়ে গেলে এটা ঘটত না।

রাজী? কি ব্যাপারে? আগের দিন বিকেলে তো তোমরা বেড়াতে গিয়েছিলে!

হ্যাঁ। দীপা, এখানে এসে ও আমাকে শুধু বলত অতীতের কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চায়। কিন্তু এখনও এক ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রী। ও ডিভোর্স নেয়নি। সুদীপের সঙ্গে যদি ওর মতবিরোধ থাকেও আমার সঙ্গে সেই ভদ্রমহিলার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আমি তাই বোঝাতে চেয়েছি ওকে।

দীপাবলীর শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল, ও কি আত্মহত্যা করেছে?

আমি জানি না, জানি না। শমিত মাথা নাড়তে লাগল।

সুদীপের তাই ধারণা।

সুদীপ হয়ত ওকে বেশি বঝে। তবে দীপা, এসব কথা কাউকে বলার দরকার নেই। আমি জানি মায়া বাঁচবে না। ওর সম্পর্কে কেউ অন্য ধারণা করুক আমি চাই না। গলায় কান্না এল।

শমিত, তুমি ভীষণ ভেঙে পড়ছ।

হ্যাঁ। আমি পারছি না। সম্পর্কের অধিকার নিয়ে সুদীপ যা এখন করবে আমি তা করতে পারব না। অথচ মায়া সজ্ঞানে থাকলে। এই সময় অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারকে ছুটে আসতে দেখা গেল হাসপাতালের ভেতর থেকে। শমিত এক পা এগিয়েই থেমে গেল। লোকটা এক মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর ঠোঁট চেটে বলল, উনি এইমাত্র চলে গেলেন। ইউনিটকে খবর দিতে হবে। বলেই দৌড়াতে লাগল।

শমিত আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করল। তারপর তার লম্বা হাত মুঠো করে। শূন্যে ঘুষি ছুঁড়ল। দীপাবলীর শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছিল। সে দেখল শমিত মাথা নিচু করে দার্জিলিং-এর রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। দীপাবলী টলতে টলতে ভেতরের দিকে পা বাড়াল।

একটা রাত, দার্জিলিং শহরের হিমমাখা রাত যে কতটা দুঃসহ তা সেইরাত্রে দীপাবলী বুঝতে পেরেছিল। সমস্ত ইউনিট চলে এসেছিল। তারাই মায়ার শেষ কাজ যত্ন নিয়ে করেছিল। গম্ভীর মুখে সুদীপ সঙ্গে ছিল। এবং আশ্চর্য, মাসীমা একটুও কেঁদে ভেঙে পড়েননি। এমনকি হোটেলে রাত কাটিয়েছেন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে। সামান্য ফোঁপানিও শুনতে পায়নি দীপাবলী। শমিতকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায়নি। যেহেতু এ যাত্রায় শ্যুটিং মুলতুবি ঘোষণা করা হয়েছে তাই সে নাকি ওই বিকেলেই নিচে নেমে গিয়েছে।

কে বেশি কষ্ট পেল কে কম এ বিষয়ে এ বিচার করা নিরর্থক কিন্তু পরদিন সকালে নিচে নামার সময় মাসীমা অদ্ভুত কথা বললেন, এখনও তো তোমার হাতে কটা দিন সময় আছে, না?

কিসের? ও হ্যাঁ, দীপাবলীর খেয়াল হল মায়ার মৃত্যু তাকে বাড়তি সময় দিয়েছে।

তাহলে, এতদূর যখন এসেছ, একদিন মা ঠাকুমার কাছে থেকে যাও। কোথায় চলে যাবে তা তো জানোনা, কিন্তু ওরা তোমাকে বড় করেছিলেন একদিন, এইটুকু মনে রাখ। মাসীমার কথায় চমকে উঠল দীপাবলী। এখন এই অবস্থায় এমন কথা বলতে কি শুধু মায়েরাই পারেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *