২১. কারফিউ-এর ভয়ে

একুশ

তখন শহরের পথে পথে কারফিউ-এর ভয়ে ঘরে ফেরা মানুষের ব্যস্ততা। বাইরে থেকে আসা মানুষেরা যত তাড়াতাড়ি হোক চেকপোস্টের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। এদের ঢালাও ছেড়ে দেবার আদেশ না আসায় ভিড় জমে জমে রাস্তা জ্যামজমাট। ভার্গিসের জিপের যখন উড়ে যাওয়ার কথা তখন সেটা সাধারণ গতিতেও এগোতে পারছিল না। জিপের সামনের সিটে বসে ছিলেন বাঁ হাতে নিজের চুল খামচে ধরে। এই রকমই তাঁর জীবনে বারংবার হয়। যখনই কোন সুখের সময় আসে তখনই ঈশ্বর নির্দয় হয়ে ওঠেন। এই যে একটু আগে ম্যাডাম তাঁকে মিনিস্টার হবার প্রস্তাব দিলেন, আগামী কাল সকালেই যার ঘোষণা সবাই শুনতে পেত তা যেন একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। যে করেই হোক বেলুনের ফুটো চাপা দিয়ে হাওয়া বের হওয়া বন্ধ করতে হবে। ভার্গিস চাপা গলায় হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘ড্রাইভার, জলদি!’

দোতলার বন্ধ ঘরে বসে আকাশলাল ঘড়ি দেখছিল। এখন বেলা তিনটে। সেই যে ওরা তাকে ধরে এনে হাতকড়া খুলে এই ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেছে তারপর থেকে সে একা। মাঝারি সাইজের এই ঘরে কোনও জানলা নেই। মাথার অনেক ওপরে একটা বড় ফুটো আছে বাতাস ঢোকার জন্যে। ঘরে একটা চেয়ার ছাড়া কোনও আসবাব নেই।

এতক্ষণ পর্যন্ত সব কিছু ভালয় ভালয় হল। ভয় ছিল তাকে দেখামাত্র এরা গুলি করতে পারে কিন্তু করেনি। সাংবাদিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল এরা ঝুঁকি নেয়নি। ভার্গিসকে সে যতটা চেনে তাতে মনে হয় ওরা সেই সুযোগ কখনই পাবে না। ক্যাপসুলটাকে জিভের ডগায় নিয়ে এল আকাশলাল। খুব কঠিন আবরণ। সাধারণ ক্যাপসুল হলে মুখের ভেতরের তাপে এতক্ষণে গলে যেত। এটাকে দাঁত দিয়ে ভাঙলেই কাজটা শুরু হয়ে যাবে। তিনঘণ্টার মধ্যে তার হৃদযন্ত্র বিকল হবে। চোখ বন্ধ করল আকাশলাল। হৃদযন্ত্র বিকল হলে যদি অপারেশনটা কাজ শুরু না করে? না, এখন আর কিছু করার নেই। ক্যাপসুলটাকে না ভাঙলে ভার্গিস তাকে আজ না হলে আগামী কাল দড়িতে ঝোলাবেই। আকাশলাল চোখ বন্ধ করল।

ওর কষের দাঁতগুলোর মাঝখানে এখন ক্যাপসুলটা। ধীরে ধীরে চাপ পড়ছে তাতে। খোলটা বেশ শক্ত। প্রথমবারে ভাঙল না। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করল আকাশলাল। আরও জোরে চাপ দিতে দিতে একসময় অনুভব করল খোলটা ভেঙে গেছে এবং নরম স্বাদহীন একটা কিছু জিভে জড়িয়ে গেল। হঠাৎ তার মনে পড়ল ডাক্তার বলেছিল ক্যাপসুলটার খোলটাকে মিনিট পাঁচেক মুখের ভেতর রেখে যেন সে বাইরে ফেলে দেয়। ওটাকে গিলে ফেললে কখনই হজম করতে পারবে না।

পাঁচ মিনিটেও একটা সুরাহা করতে পারল না আকাশলাল। ফেলতে হলে ভাঙা খোলটাকে ঘরেই ফেলতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হয়ে যাবে আকাশলাল আত্মহত্যা করেছে। হয়তো ভার্গিস খোলটাকে সাংবাদিকদের দেখাবে। আকাশলাল ভাবল, গিলে ফেললে কি ক্ষতি হবে! হজম করার দরকার কি! সেইসময় ফুটোটার দিকে চোখ পড়ল। অনেকটা ওপরে কিন্তু ওখানে ছুঁড়ে ফেলা যায় না? মুখ থেকে বস্তুটি বের করল আকাশলাল। ভেতরে যা ছিল তা এতক্ষণে শরীরে মিশে গেছে। খোলটা ফুটোটার দিকে ছুঁড়ে দিতেই ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। নাঃ, তার লক্ষ্য মোটেই ভাল নয়। শেষপর্যন্ত এটাই একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল। যতবার খোলটা ছোঁড়ে ততবার দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খায়। ফুটোটার খুব কাছে একবারই পৌঁছেছিল। যেহেতু অনুশীলনে ফল পাওয়া যায় তাই একসময় ওটা আর ফিরে এল না। ফুটোটার মধ্যে ঢুকে গেছে জানতে পারার পরই ওর মনে হল নিশ্বাস কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ছোঁড়ার সময় শরীরে আন্দোলন হওয়ায় এমনটা হতে পারে। ঘরের ভেতরে একটু হাঁটল আকাশলাল। মাত্র পনের মিনিট সময় গিয়েছে কিন্তু মাথাটা এরই মধ্যে একটু ঘুরছে বলে বোধ হল। আকাশলাল আবার চেয়ারে ফিরে গেল। নাঃ, এটা মনের ভুল। ডাক্তার বলেছে তিন ঘণ্টার আগে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হবে না। তিনঘণ্টা অনেক সময়। এখন ওরা যদি তাকে সাংবাদিকদের সামনে নিয়ে যায় তা হলে সে স্বচ্ছন্দে অনেক কথা বলতে পারবে। গোটা পৃথিবী জানবে তাকে সুস্থ অবস্থায় এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তার কিছুক্ষণ বাদেই সে মরে গেছে। এই মরে যাওয়ার খবরটায় দেশে এবং বিদেশে যে প্রতিক্রিয়া হবে তা বোর্ড পছন্দ করবে না। ভার্গিসকে এর জন্যে বড় দাম দিতে হবে।

একঘণ্টা পরে সমস্ত শরীরে অদ্ভুত ঝিমুনি এবং বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। ব্যথাটা বাড়ছে। বাঁ দিকের বুকের ঠিক তলায় ওজন বাড়ছে। আকাশলাল চোখ বন্ধ করল। ছাত্রাবস্থা তার কেটেছিল ইন্ডিয়াতে। তখন একবার বেড়াতে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে এক বাঙালি বন্ধুর সঙ্গে। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে এক বাউলের সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গিয়েছিল। লোকটার গানের সুর চমৎকার কিন্তু কথার মানে বুঝতে অসুবিধে হত। এমনকি বাঙালি বন্ধুও ঠিক বুঝতে পারত না। বাউলই গানের শেষে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিত। একটা গান এখনও মনে আছে। আট কুঠরি নয় দরজা কোনখানে তালা নেই আর সেই ঘর তিনতলা। আট কুঠুরি হল শরীরের আটটা গ্রন্থি। পিটুইটারি, থাইমাস, থাইরয়েড, প্যরা থাইরয়েড, অ্যালড্রিনাল, প্যারোটিড, প্যাংক্ৰিয়াস এবং টেসটিস অথবা ওভারিস্‌। এই শরীরটা বেঁচে আছে এই আটটি গ্রন্থির মধ্যে দিয়ে হর্মোন সিক্রিয়েশনের জন্যে। আর এই আটটি গ্রন্থির সঙ্গে শরীরের নয়টি দ্বার যুক্ত। তিনতলা হল, মস্তিষ্ক, কোমর থেকে শরীরের উর্ধ্বভাগ এবং নিম্নভাগ। নাক কান চোখ মুখ ইত্যাদি নটা দ্বার এই তিনতলায় ছড়িয়ে আবদ্ধ, যা স্নায়ুশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাউল বলেছিল এই দেহ রহস্যময়। পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য এর কাছে হার মেনে যায়। সেই হেস্যকে ব্যবহার করার সাধ্য কারও নেই। কিন্তু তাকে নিয়ে একটু লুকোচুরি করার চেষ্টা করলে দোষ কি।

এখন থেকে তার আট কুঠুরিতে তালা পড়ার আয়োজন শুরু হয়ে গেছে, আকাশলালের শরীর মস্তিষ্ককে জানিয়ে দিচ্ছিল। ইতিমধ্যে মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে তার প্রাপ্য অক্সিজেনে টান ধরেছে। শরীরে যত অক্সিজেন বরাদ্দ তার শতকরা বিশভাগ মস্তিষ্ক নিয়ে নেয়। প্রতি মিনিটে দেড় পাঁইট রক্ত মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হওয়া প্রয়োজন। যদি মস্তিষ্কের কোষগুলো তাদের প্রাপ্য থেকে পাঁচ মিনিটের জন্যে বঞ্চিত হয় তা হলে তারা মরে যায়। আকাশলাল জানে সব ঠিকঠাক চললে তার মস্তিষ্ক অন্তত আগামী চব্বিশঘণ্টা প্রাপ্য অক্সিজেন পাবে, মস্তিষ্ক কোষ মরে যাবে না। কিন্তু স্ক্যানিং ছাড়া তাদের সজীবতা বোঝা সম্ভব নয়। এখন এই শরীরটা একটু একটু করে আর নিজের থাকছে না।

প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছিল। সেইসঙ্গে বুকে যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছিল। আর তখনই দরজা খুলে গেল। দুজন সশস্ত্র প্রহরী দরজায় দাঁড়িয়ে। একজন এগিয়ে এসে আকাশলালকে কিছু বলল। কি বলল? আকাশলাল শোনার চেষ্টা করল। ওরা জিজ্ঞাসা করছে তার কোনও কিছুর প্রয়োজন আছে কি না! মাথা নাড়তে গিয়ে আকাশলাল টের পেল ওটা নাড়ানো যাচ্ছে না। আর তখনই অনুমান করল আগন্তুকরা। সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। স্ট্রেচারে শুইয়ে আকাশলালকে নিয়ে যাওয়া হল মেডিক্যাল রুমে। খবর পৌঁছে গেল ভার্গিসের জিপে।

আকাশলালের সঙ্গে একটা ইন্টারভিউ যে কোনও কাগজের পক্ষে বিষয় হিসেবে চমৎকার। মেলার মাঠ থেকে চলে এসে সাংবাদিকরা ভিড় করেছিল হেডকোয়ার্টার্সে। কিন্তু ‘দরবার’ কাগজের রিপোর্টার অনীকা সিং এদের সঙ্গে আসেনি। ভার্গিস সাহেব যদি শেষ পর্যন্ত আকাশলালকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেয় তা হলে সেই কথা সব কাগজের রিপোর্টরা একসঙ্গে শুনবে। আজ পরে ওদের কারও কাছে জেনে নিলেই হবে আকাশলাল কি বলল। লোকটাকে সে মেলার মাঠেই ধরতে পারত যদি ভার্গিস আগে থাকতে তাদের নো-এন্ট্রি করা রাস্তায় না পাঠিয়ে দিত।

মানুষজন জলস্রোতের মত ছুটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। সবাই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এবার উৎসবের কাজ নমো নমো করে সারা হল। ফুটপাতের ওপর কোমরে হাত রেখে অনীকা বিষয় খুঁজছিল। এরমধ্যে সে তিন চারজনকে প্রশ্ন করতে চেয়েছে কিন্তু কারও জবাব দেবার মত সময় হাতে নেই। চারটের সময় কারফিউ; তার আগেই চেকপোস্ট পার হতে হবে।

রিপোর্টার হিসেবে সে এখনও কিছুই করতে পারেনি। দরবার কাগজের সার্কুলেশন ভাল কিন্তু তার চাকরি পাকা করাতে গেলে ভাল কাজ দেখাতে হবে। নিউজ এডিটর তাকে এখানে পাঠানোর সময় বলেছিল, যাচ্ছ উৎসব কভার করতে কিন্তু তোমার কাছে বিপ্লবীদের সম্পর্কে খবর চাই। ওরা আদৌ কোনও দিন কিছু করতে পারবে কি না জেনে এসো। তবে হ্যাঁ, এমন কিছু লিখবে না যাতে ওদের সরকার বলতে পারে বিদেশি রাষ্ট্রের কাগজ বিপ্লবীদের মদত দিচ্ছে। সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেছিল কাঁঠালের আমসত্ত্ব। যাওয়া আসাই সার হবে।

আজ সকালে এখানে পৌঁছে প্রথমে টুরিস্ট লজে গিয়েছিল অনীকা। সে বিস্মিত হয়ে জানতে পেরেছিল একটি ঘর খালি আছে। সেখানে আস্তানা গেড়ে শহরে বেরুতেই আকাশলালের পোস্টার দেখেছিল সর্বত্র। লোকটা দেখতে মন্দ নয়। আর মুখের দিকে তাকালেই মনে হল লোকটা এখন পর্যন্ত প্রেম করেনি। চিবুকের ওপর দুটো হালকা আঁচড না থাকলেই ভাল হল। এই লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই লোকটাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে।

তারপর একের পর এক চমকের মধ্যে দিয়ে সকাল থেকে দুপুর গেল। অনীকার কেবলই মনে হচ্ছিল, বিশেষ করে আকাশলালকে দেখার পর, মানুষটা বোকা এবং কাপুরুষ নয়। এই যে স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে ধরা দিতে এল এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে।

ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছিল অনীকা। মানুষ পালাচ্ছে। খানিকটা এগোতে দুজন নারীপুরুষকে দেখল হেঁটে যেতে। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় ওরা এবারও রাস্তায় ছুটন্ত জনতার দিকে তাকাচ্ছে না। লোকটির পোশাক শিক্ষিত ভদ্রজনের মত, মাথায় পাহাড়ি টুপি, মেয়েটি কিন্তু আদৌ শহুরে নয়। দূর থেকেই দেখে অনীকার মনে হল ওরা এই শহরে থাকে অথচ এখানকার উত্তেজনা ওদের মধ্যে নেই। সে দূর থেকেই কয়েকবার ছবি তুলল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে ক্যামেরা তাগ করতেই বাঁ হাত বাড়িয়ে সেটাকে নিয়ে নিল লোকটা। ছিনিয়ে নিল কিন্তু হাঁটা থামাল না। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে অনীকা দৌড়াল। এই যে, এটা কী করলেন? ক্যামেরা ছিনিয়ে নিলেন কেন?’

হাঁটতে হাঁটতে লোকটা জবাব দিল, ‘আমি চাই না আমার ছবি কেউ তুলুক।’

‘আশ্চর্য! আমি রাস্তার ছবি তুলছি।’

লোকটা কোনও জবাব দিল না। সঙ্গে মেয়েটিও চুপচাপ হাঁটছিল।

অনীকা বলল, ‘দেখুন আমি একজন সাংবাদিক। রাস্তার ছবি তোলার অধিকার আমার আছে।’

‘নিশ্চয়ই আছে মিস। ক্যামেরাটা আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি কিন্তু ফিল্মের রোলটা আমি খুলে নেব। এক মিনিট।’ লোকটা এবার দাঁড়াল।

আঁতকে উঠল অনীকা, ‘আরে আরে খুলবেন না। ওখানে দারুণ দারুণ ছবি আছে। আজ আকাশলাল যখন আত্মসমর্পণ করেছিল তার ছবিও আছে ওখানে।’

‘আচ্ছা! আপনি কোথায় উঠেছেন?

‘কেন?’

‘সেখানেই আজ রাত্রে আপনার ক্যামেরা আর আমার ছবি বাদ দেওয়া ফিল্মটা ঠিকঠাক অবস্থায় পৌঁছে যাবে। আমার সময় নেই মিস, ঠিকানাটা বলুন।’

‘আমি অনীকা সিং, দরবার পত্রিকার রিপোর্টার। টুরিস্ট লজে উঠেছি।’ অনীকার কথা শেষ হওয়ামাত্র ওরা পাশের গলিতে ঢুকে গেল ক্যামেরা নিয়ে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কাটাল অনীকা। এরা কারা? এমন হুকুমের স্বরে কথা বলল কেন? সাধারণ গুণ্ডা বদমাস অথবা পুলিশ যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। লোকটা নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে ডার্করুমে নিয়ে গিয়ে নিজের ছবি বাদ দিয়ে তারপর সব ফেরত পাঠাবে। আর ফেরত যে পাঠাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই অনীকার। আসল কথা হল লোকটা কাউকে ছবি তুলতে দিতে রাজি নয়। কেন? ও কি বিপ্লবীদের একজন? যদি তাই হয় তা হলে নীচের দিকের কেউ নয়। অনীকা ঠোঁট কামড়াতে লাগল, কথাটা যদি একবারও আগে মাথায় আসত।

সে গলিটার দিকে তাকাল। দু-পা হাঁটল। ইতিমধ্যেই দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু হয়েছে। কিন্তু ওরা গেল কোথায়। গলির ভেতরে কয়েক পা হাঁটল সে। গলি বেশি দূরে গিয়ে শেষ হয়নি। তা হলে আশপাশের কোনও বাড়িতেই গিয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে।

অনীকা বড় রাস্তায় চলে এল। খানিকটা এগিয়ে সে একটা ল্যাম্পপোস্টের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল। চারটে বাজতে বেশি দেরি নেই। তার মধ্যে যদি লোকটা আবার বেরিয়ে আসে তা হলে সে ওকে অনুসরণ করবে। দরকার হলে সরাসরি ইন্টারভিউ চাইবে। মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর অনীকা দেখল সেই মেয়েটি একাই গলি থেকে বেরিয়ে এ দিক ও দিকে দেখে নিয়ে ডান দিকে হাঁটতে শুরু করল। মেয়েটিকে অনুসরণ করে কি কোনও লাভ হবে? কিন্তু লোকটা যদি আর বের না হয়, কারফিউ হয়ে গেলে তো আর সেই প্রশ্ন উঠবে না। অনীকা নিজে মেয়ে কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে তার কিছুতেই বন্ধুত্ব জমে না। কিন্তু এর কাছ থেকে একটা সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সে বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটতে আরম্ভ করল।

ক্রমশ খানিকটা নির্জন পথে চলে এল সে। মেয়েটি এবার একটা কবরখানার গেটে পৌঁছে ভেতরে ঢুকে গেল। অনীকা কি করবে বুঝতে পারছিল না। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। একে অচেনা শহর তার ওপর সে বিদেশিনী। তবু কৌতূহল প্রবল হওয়ায় সে এগিয়ে গেল। মেয়েটি গেটের সামনে নেই। মুখেই একটা অফিসঘর। সেখানে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে ভেতরে ঢুকল। অনেকটা জায়গা জুড়ে গাছপালার মধ্যে এই কবরখানা। অনেকদূরে সেই মেয়েটিকে হাঁটতে দেখল অনীকা। নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রেখে সে এগিয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল বিপ্লবীদের কেউ এখানে লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে থাকার পক্ষে জায়গাটা চমৎকার।

গাছের আড়াল থেকে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছিল। পাঁচিলের কাছাকাছি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছে। একজন বৃদ্ধকে এগিয়ে আসতে দেখল অনীকা। মেয়েটি বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলল। বৃদ্ধ আঙ্গুল তুলে মাটিতে কিছু দেখাল। মেয়েটি মাথা নেড়ে ফিরে আসছে এবার। ওকে যেতে হবে অনীকার পাশ দিয়েই। গাছের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনীকা। মেয়েটি ক্রমশ গেটের দিকে চলে গেলে সে আড়াল ছেড়ে বের হল। বৃদ্ধ তখন রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠা আগাছা পরিষ্কার করছে। অর্থাৎ মানুষটি কবরখানার কর্মচারী।

অনীকাকে এগিয়ে আসতে দেখে বৃদ্ধ সোজা হয়ে দাঁড়াল। অল্প সময়ের মধ্যে দুজন যুবতীকে বৃদ্ধ বোধহয় কবরখানায় কোনদিন দ্যাখেনি। অনীকা হাসল, ‘নমস্কার। আপনাদের এই কবরখানার পরিবেশ খুব সুন্দর।’

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা শান্তিতেই আছেন।’

‘আমি এই শহরে নতুন। একজন এখানে আসতে বলেছিল— !’

‘তিনি কি মহিলা?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটু আগে চলে গেলেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’

‘ও। কি বলল আপনাকে?’

বৃদ্ধ হাত ওল্টালেন, ‘এখানে এসে মানুষ উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে। মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ওখানে নতুন কবর খোঁড়া হলে ঠিক কোন জায়গাটা আমি পছন্দ করব? আসলে আমিই তো জায়গা ঠিক করে দিই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ওই পরিবারে কেউ মারা গিয়েছে নাকি? তিনি বললেন তেমন সম্ভাবনা আছে। ভাবুন। সম্ভাবনা আছে এই ভেবে কেউ কবরের জায়গা খুঁজতে আসে?’

অনীকা হাসল, ‘আমার বান্ধবীর মাথা ঠিক নেই।’

‘তাই মনে হল।’ বৃদ্ধ এগোল।

‘কোন জায়গাটা খুঁজছিল?

‘ওই তো। এখনও তিনজন পাশাপাশি শুয়ে আছে মাটির নীচে। আমাদের সরকার যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের পৈতৃক জায়গা ওটা।’

‘আপনি কি আকাশলালের কথা বলছেন? তিনি তো ধরা দিয়েছেন আজ।’

‘সেকি? সত্যি? যাঃ, হয়ে গেল। আমি কোনও খবরই পাই না, কেউ বলেও না। এখানে বাস করায় লোকে আমাকেই মৃতদের দলে ভেবে নিয়েছে।’ বৃদ্ধ চলে গেল।

জায়গাটার দিকে তাকাতেই অনীকার শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। মেয়েটা কেন আকাশলালের পারিবারিক কবরের জায়গাটা দেখতে এল? ওরা কি ধরে নিয়েছে পুলিশ আকাশলালকে মেরে ফেলবে। পৃথিবীর যে কোন দেশের পুলিশের পক্ষেই অবশ্য সেটা সম্ভব। সে ধীরে ধীরে জমিটার ওপর হাঁটতে লাগল। এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে। পাখিরা দল বেঁধে ফিরে আসছে কবরখানার গাছে গাছে। তাদের চিৎকারে কান ঠিক রাখা দায়। হঠাৎ পায়ের তলায় একটা কাঁপুনি অনুভব করল অনীকা। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। অথচ আশেপাশের গাছপালা সবকিছুই স্বাভাবিক। দ্রুত একটু সরে যেতেই কাঁপুনিটা বন্ধ হল। অথাৎ কাঁপুনি হচ্ছে বিশেষ একটি জায়গায়। মাটির নীচে যারা শুয়ে আছে তারা কি নড়েচড়ে বসছে? অনীকা দ্রুত কবরখানা থেকে বেরিয়ে এল। পরিবেশ এমন একটা চাপ তৈরি করে যে অবাস্তবকেও বাস্তব বলে ভাবতে মানুষ বাধ্য হয়, কিছুক্ষণের জন্যেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *