কাবুলের রাস্তাঘাট, বাজারহাট, উজীরনাজির, গুরুচণ্ডালের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হল বটে, কিন্তু গোটা দেশের সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার আশা দেখলুম কম, আর নগর জনপদ উভয় ক্ষেত্রে যেসব অদৃশ্য শক্তি শান্তির সময় মন্দ গতিতে এবং বিদ্রোহবিপ্লবের সময় দুর্বার বেগে এগিয়ে চলে সেগুলোর তাল ধরা বুঝলুম আরো শক্ত, প্রায় অসম্ভব।
আফগানিস্থানের মেরুদণ্ড তৈরী হয়েছে জনপদবাসী আফগান উপজাতিদের নিয়ে, অথচ তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা, আভ্যন্তরিণ শাসনপ্রণালী, আচারব্যবহার সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনো কেতাব লেখা হয়নি; কাবুলে এমন কোনো গুণীরও সন্ধান পাইনি যিনি সে সম্বন্ধে তত্ত্বজ্ঞান বিতরণ করুন আর নাই করুন অন্তত একটা মোটামুটি বর্ণনাও দিতে পারেন। ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কাবুলীরা প্রায়ই বলেন, তারপর শিনওয়ারীরা বিদ্রোহ করল, কিন্তু যদি তখন প্রশ্ন করেন, বিদ্রোহ করল কেন, তবে উত্তর পাবেন, মোল্লারা তাদের খ্যাপালো বলে, কিন্তু তারপরও যদি প্রশ্ন শুধান যে, উপজাতিদের ভিতরে এমন কোন্ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উষ্ণ বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছিল যে, মোল্লাদের ফুলকি দেশময় আগুন ধরাতে পারল তাহলে আর কোনো উত্তর পাবেন না। মাত্র একজন লোক তিনিও ভারতীয় আমাকে বলেছিলেন, মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, বিদেশের পণ্য-বাহিনীকে লুটতরাজ না করলে গরীব আফগানের চলে না বলে সভ্যদেশের ট্রেড-সাইক্লের মত তাদেরও বিপ্লব আর শান্তির চড়াই-ওতরাই নিয়ে জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ। করতে হয়।
গ্রামের অবস্থা যেটুকু শুনতে পেলুম তার থেকে মনে হল শান্তি সময় গ্রামবাসীর সঙ্গে শহরবাসীর মাত্র এইটুকু যোগাযোগ যে, গ্রামের লোক শহরে এসে তাদের ফসল, তরকারি, দুম্বা, ভেড়া বিক্রয় করে সস্তা দরে, আর সামান্য যে দু-একটি অত্যাবশ্যক দ্ৰব্য না কিনলেই নয়, তাই কেনে আক্ৰা দরে। সভ্যদেশের শহরবাসীরা বাদবাকির বদলে গ্রামের জন্য ইস্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট বানিয়ে দেয়। কাবুলের গ্রামে সরকারী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই হয়। কতকগুলো ছেলে সকালবেলা গাঁয়ের মসজিদে জড়ো হয়ে গলা ফাটিয়ে আমপারা (কোরানের শেষ অধ্যায়) মুখস্থ করে এই হল বিদ্যাচর্চা। তাদের তদারক করনেওয়ালা মোল্লাই গাঁয়ের ডাক্তার। অসুখ-বিসুখে তাবিজ-কবচ তিনিই লিখে দেন। ব্যামো শক্ত হলে পানি-পড়ার বন্দোবস্ত, আর মরে গেলে তিনিই তাকে নাইয়ে ধুইয়ে গোর দেন। মোল্লাকে পোষে গাঁয়ের লোক।
খাজনা দিয়ে তার বদলে আফগান গ্রাম যখন কিছুই ফেরত পায় না তখন যে সে বড় অনিচ্ছায় সরকারকে টাকাটা দেয় এ কথাটা সকলেই আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বললেন, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
দেশময় অশান্তি হলে আফগান-গাঁয়ের সিকি পয়সার ক্ষতি হয় না–বরঞ্চ তার লাভ। রাইফেল কাঁধে করে জোয়ানরা তখন লুটে বেরোয়–বিধিদত্ত আফগানিস্থানের অশান্তিও বিধিদত্ত, সেই হিড়িকে দুপয়সা কামাতে আপত্তি কি? ফ্রান্স-জর্মনিতে লড়াই লাগলে যে রকম জর্মনরা মার্চ করার সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বলে, নাখ, পারিজ, নাখ, পারিজ, প্যারিস চলো, প্যারিস চলো, আফগানরা তেমনি বলে, বিআ ব্ কাবুল, ব্ রওম্ ব্ কাবুল, কাবুল চলো, কাবুল চলো।
শহরে বসে আছেন বাদশা। তাঁর প্রধান কর্ম আফগান উপজাতির লুণ্ঠনলিপ্সাকে দমন করে রাখা। তার জন্য সৈন্য দরকার, সৈন্যকে মাইনে দিতে হয়, গোলাগুলীর খর্চা তো আছেই। শহরের লোক তার খানিকটা যোগায় বটে কিন্তু মোটা টাকাটা আসে গাঁ থেকে।
তাই এক অদ্ভুত অচ্ছেদ্য চক্রের সৃষ্টি হয়। খাজনা ভোলার জন্য সেপাই দরকার, সেপাই পোষর জন্য খাজনার দরকার। এ-চক্র যিনি ভেদ করতে পারেন তিনিই যোগীবর, তিনিই আফগানিস্থানের বাদশা। তিনি মহাপুরুষ সন্দেহ নেই; যে আফগানের দাঁতের গোড়া ভাঙ্গবার জন্য তিনি শিলনোড় কিনতে চান সেই আফগানের কাছ থেকেই তিনি সে পয়সা আদায় করে নেন।
ঘানি থেকে যে তেল বেয়োয়, ঘানি সচল রাখার জন্য সেটুকু ঐ ঘনিতেই ঢেলে দিতে হয়।
সামান্য যেটুকু বাঁচে তাই দিয়ে কাবুল শহরের জৌলুশ।
কিন্তু সে এতই কম যে, তা দিয়ে নূতন নূতন শিল্প গড়ে তোলা যায় না, শিক্ষাদীক্ষার জন্য ব্যাপক কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা যায় না। কাজেই কাবুলে শিক্ষিত সম্প্রদায় নেই বললেও চলে।
কিন্তু তাই বলে কাবুল সম্পূর্ণ অশিক্ষিত বর্বর একথা বলা ভুল। কাবুলের মোল্লা সম্প্রদায় ভারতবর্ষ-আফগানিস্থানের যোগাযোগের ভগ্নাবশেষ।
কথাটা বুঝিয়ে বলতে হয়।
কাবুলের দরবারী ভাষা ফার্সী, কাজেই সাধারণ বিদেশীর মনে এই বিশ্বাস হওয়াই স্বাভাবিক যে, কাবুলের সংস্কৃতিগত সম্পর্ক ইরানের সঙ্গে। কিন্তু ইরান শীয়া মতবাদের অনুরাগী হয়ে পড়ায় সুন্নী আফগানিস্থান শিক্ষা দীক্ষা পাওয়ার জন্য ইরান যাওয়া বন্ধ করে দিল। অথচ দেশ গরীব, আপন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার মত সামর্থ্যও তার কোনো কালে ছিল না।
এদিকে পাঠান, বিশেষ করে মোগল যুগে ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য দিল্লী লাহোরে ইসলাম ধর্মের সুন্নী শাখার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল। শিক্ষাদানের মাধ্যম ফার্সী; কাজেই দলে দলে কাবুল কান্দাহারের ধর্মজ্ঞানপিপাসু ছাত্র ভারতবর্ষে এসে এই সব প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করল। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই; পূর্ববর্তী যুগে কাবুলীরা বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করার জন্য ক্ষশিলায় আসত আফগানিস্থানে যেসব প্রাচীন প্রাচীর-চিত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলো অজন্তার ঐতিহ্নে আঁকা, চীন বা ইরানের প্রভাব তাতে নগণ্য।
এই ঐতিহ্য এখনো লোপ পায়নি। কাবুলের উচ্চশিক্ষিত মৌলবীমাত্রই ভারতে শিক্ষিত ও যদিও ছাত্রাবস্থায় ফার্সীর মাধ্যমে এদেশে জ্ঞানচর্চা করে গিয়েছেন, তবু সঙ্গে সঙ্গে দেশজ উর্দু ভাষাও শিখে নিয়ে গিয়েছেন। গ্রামের অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের উপর এদের প্রভাব অসীম এবং গ্রামের মোল্লাই আফগান জাতির দৈনন্দিন জীবনের চক্রবর্তী।
বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত জগৎ ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের নিন্দায় পঞ্চমুখ। এরা নাকি সর্ব প্রকার প্রগতির শত্রু, এদের দৃষ্টি নাকি সব সময় অতীতের দিকে ফেরানো এবং সে অতীতও নাকি মানুষের সুখদুঃখে মেশানন, পতনঅভ্যুদয়ে গড়া অতীত নয়, সে অতীত নাকি আকাশকুসুমজাত সত্যযুগের শাস্ত্রীয় অচলায়তনের অন্ধ প্রাচীর নিরুদ্ধ।
তুলনাত্মক ধর্মশাস্ত্রের পুস্তক লিখতে বসিনি, কাজেই পৃথিবীর সর্ব ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের নিন্দা বা প্রশংসা করা আমার কর্ম নয়। কিন্তু আফগান মোল্লার একটি সাফাই না গাইলে অন্যায় করা। হবে।
সে-সাফাই তুলনা দিয়ে পেশ করলে আমার বক্তব্য খোলদা হবে।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে কর্ণধার ছিলেন মৌলবী-মোল্লা, শাস্ত্রী-ভটচায়। কিন্তু এরা দেশের লোককে উত্তেজিত করে ইংরেজের উচ্ছেদ সাধন করতে পারেননি অথচ আফগান মোল্লার কট্টর দুশমনও স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, ইংরেজকে তিন-তিনবার আফগানিস্থান থেকে কান ধরে বের করবার জন্য প্রধানত দায়ী আফগান মোল্লা।
আহা, আহা! এর পর আর কি বলা যেতে পারে আমি তো ভেবেই পাই না। এর পর আর আফগান মোল্লার কোন্ দোষ ক্ষমা না করে থাকা যায়? কমজোর কলম আফগান মোল্লার তারিফ গাইবার মত ভাষা খুঁজে পায় না।
পাশ্চাত্য শিক্ষা পেয়েছেন এমন লোক আফগানিস্থানে দুডজন হবেন কিনা সন্দেহ। দেশে যখন শান্তি থাকে তখন এদের দেখে মনে হয়, এরাই বুঝি সমস্ত দেশটা চালাচ্ছেন; অশান্তি দেখা গেলেই এদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের সঙ্গে আলাপচারি হল; দেখলুম প্যারিসে তিন বৎসর কাটিয়ে এসে এরা মার্সেল প্রস্ত, আঁদ্রে জিদের বই পড়েননি, বার্লিন-ফো ডুরারের নাম শোনেননি, রিলকের কবিতা পড়েননি। মিল্টন বাল্মীকি মিলিয়ে মধুসূদন যে কাব্য সৃষ্টি করেছেন তারই মত গ্যোটে ফিরদৌসী মিলিয়ে কাব্য রচনা করার মত লোক কাবুলে জন্মাতে এখনো ঢের বাকি।
তাহলে দাঁড়ালো এই:—বিদেশফের্তাদের জ্ঞান পল্লবগ্রাহী, এবং দেশের নাড়ীর সঙ্গে এদের যোগ নেই। মোল্লাদের অধিকাংশ অশিক্ষিত, যারা পণ্ডিত তাদের সাতখুন মাফ করলেও প্রশ্ন থেকে যায়, ইংরেজ রুশকে ঠেকিয়ে রাখাই কি আফগানিস্থানের চরম মোক্ষ? দেশের ধনদৌলত বাড়িয়ে শিক্ষাসভ্যতার জন্য যে প্রচেষ্টা, যে আন্দোলনের প্রয়োজন মৌলবীসম্প্রদায় কি কোনো দিন তার অনুপ্রেরণা যোগাতে পারবেন? মনে তো হয় না। তবে কি বাধা দেবেন? বলা যায় না।
পৃথিবীর সব জাত বিশ্বাস করে যে, তার মত ভুবনবরেণ্য জাত আর দুটো নেই; গরীব জাতের তার উপর আরেকটা বিশ্বাস যে, ভার দেশের মাটি খুঁড়লে সোনা রুপো তেল যা বেরবে তার জোরে সে বাকি দুনিয়া, ইস্তেক চন্দ্ৰসূর্য কিনে ফেলতে পারবে। নিরপেক্ষ বিচারে জোর করে কিছু বলা শক্ত কিন্তু একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি কিছু না বেরোয় তবে আফগানিস্থানের পক্ষে ধনী হয়ে শিক্ষাদীক্ষা বিস্তার করার অন্য কোনো সামর্থ্য নেই।
সত্যযুগে মহাপুরুষরা ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, কলিযুগে গণৎকাররা করে। পাকাপাকি ভবিষ্যদ্বাণী করার সাহস আমার নেই তবু অনুমান করি, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করে শক্তিশালী হওয়া মাত্র আবার আফগানিস্থান ভারতবর্ষে হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। কাবুল কান্দাহারের বিদ্যার্থীরা আবার লাহোর দিল্লীতে পড়াশুনা করতে আসবে।
প্রমাণ? প্রমাণ আর কি? প্যারিস-বাসিন্দা ইংরিজী বলে, ভিয়েনার লোক ফরাসী বলে না, কিন্তু বুড়াপেস্টের শিক্ষিত সম্প্রদায় এখনো জর্মন বলেন, জ্ঞানান্বেষণে এখনো ভিয়েনা যান ভিন্ন রাষ্ট্র নির্মিত হলেই তো আর ঐতিহ্য-সংস্কৃতির যোগসূত্র ছিন্ন করে ফেলা যায় না। কাবুলের মৌলবী-সম্প্রদায় এখন উর্দু বলেন, ভারতবর্ষ বর্জন করে এদের উপায় নেই। ঝগড়া যদি করেন তবে সে তিনদিনের তরে।।
উর্দু যে এদেশে একদিন কতটা ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পেলুম হাতেনাতে।