কাটুনিবউয়ের অন্তর্ধানের পর কয়েক দিন লখাই যেন অস্থিমজ্জাহীন স্থবিরের মতো পড়ে রইল। যখনই কাটুনিবউয়ের চলে যাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই মুহূর্তেই স্বামীর কাছ থেকে তার বিদায় নেওয়ার দৃশ্যটিও এসে হাজির হয়েছে সামনে। তবু তার মনে এক দারুণ দহন শুরু হয়েছে, কানু তাঁতিকে চটকলে খাটতে যাওয়ার বদলে তার মরতে বলার সেই কথা মনে করে। সেইসঙ্গে কাটুনিদিদির সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার বুরে মধ্যে শেলের মতো বিদ্ধ হয়ে রয়েছে। তার কেবলি মনে হচ্ছে, যে বিভীষণ বেগে আজ ইংরেজের কলকারখানা দেশে গড়ে বসছে তার সেই উদ্দাম বেগকে ঠেকিয়ে রাখতে কি সে পারবে? না কি কানুতাঁতির মতো আর যারা আজ দলে দলে জমির ঠাঁই হারিয়ে ফেলে যাচ্ছে তাদের সে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে? তবে কোন রোখে সে কানুতাঁতিকে বলেছিল মরতে! এ দুরূহ চিন্তায় এসেই আবার ভাবছে, কানুর নিজের মন প্রাণ বলে কি কিছুই ছিল না, ছিল না কি কোন মান-অপমান বা কষ্টবোধ! যে কানু অমন মনভোলানো কাপড়ের কারিগর, সে যাবে চট বুনতে তাই বা কেমন করে সহ্য হয়।…তবু বার বার সেজবাবুর কথাই তার মনে পড়ল, রাত্রির পর দিন আসার অদৃশ্য বেগের মতো আজ এ দেশের যুগ বদলাতে বসেছে, তাকে ঠেকিয়ে রাধা বোধ করি ঈশ্বরেরও দুঃসাধ্য। আর এও সত্য লক্ষ্মীন্দর, আমাদের পুরনো ঘর ভেঙে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জগতের কাছে তো আমরাও আর পেছিয়ে থাকতে পারিনে। নতুন ঘর বাঁধতে লাগবে আমাদেরও। তবুও…। হ্যাঁ, সেজবাবু সেই তবুও বলে যে বিলম্বিত টান দিয়েছেন সেই সুরে সুর মিলিয়ে লখাই বলেছে, নতুন ঘর বাঁধব কোথায় বাবু, আমার ভিটে, যদি অপরের দখলেই রইল। আমার যে দিনরাত, একাকার। সেজবাবু বলেছেন, সেটা জাতির উপর ভগবানের অভিশাপ। কবে তা খণ্ডাবে বলতে পারিনে, কিন্তু আজকের যুগকে আটকানো ঠিক হবে না, পারাও যাবে না।
যার দেশ নেই, তার আবার যুগ কীসের? আগে তবে সেই অভিশাপই খণ্ডন হোক। এই হল লখাইয়ের মনোভাব। তবুও কানুতাঁতির সংসারের ছারেখারে যাওয়ার যন্ত্রণা তার বুক থেকে গেল না। সেজবাবু থাকলে আজ তার কাছে গিয়ে দুদণ্ড মনের কথা বলতে পারত। কিন্তু সে নেই। পবন চাঁড়াল নেই, ভাটপাড়ার সেই দাদাঠাকুরকে পেলেও বকে বকে দুদণ্ড শান্তি পাওয়া যেত। কালীবউ একা এ সংসার ও শ্যামের ভার নিয়ে বেসামাল। লখাইয়ের গুম খাওয়া দেখে সে আরও ভেঙে পড়েছে। মধুও হঠাৎ দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। কানুতাঁতির মেয়ের জন্য দুদিন কেঁদেছে সে। কে জানত সে মেয়ে তার শৈশবের ভাবভালবাসার সাথী। আবার সে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে কাজেকর্মে মন দিয়েছে কিন্তু বাড়িতে তার পাত্তা থাকে না বড় একটা খাওয়া শোয়ার সময়টুকু বাদে।
আর কাঞ্চীবউ তো এখানে নেই। সংবাদ এসেছিল, সে যমজ পুত্রসন্তান প্রসব করেছিল। তার মধ্যে একটি পাঁচ দিন পরে মারা গিয়েছে, অপরটি জীবিত এবং ভালই আছে। সন্তানের জন্য নয়, কাঞ্চীবউয়ের জন্যই প্রাণটা ছটফট করে উঠছে লখাইয়ের। কয়েকবার ভেবেছে সে সোজা দেউলপাড়া চলে যাবে কি না কাঞ্চনের কাছে। কিন্তু কী মনে করে থেমে গিয়েছে। আজকের এ দুর্দশার দিনে কাঞ্চন কাছে থাকলে মুখ ঝামটায়, হাসিতে আদরে অভিমানে তাকে একরকম ভরে রাখতে পারত। শুধু তাই নয়, এ কদিনের সমস্ত ঘটনাগুলোর গতি তার মস্তিষ্কটাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। সে যত ভাবতে যাচ্ছে, তত তার চিন্তার দৌড় ঝিমিয়ে আসছে, এক অপরিসীম অবসাদে ভেঙে পড়া বুকটা তার বড় খালি হয়ে গিয়েছে। এই যে খালি এবং ফাঁকা ভাব, সেটাই তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে আরও। তাই বারবারই কাঞ্চনের কথা মনে পড়ছে তার, যার কাছে গিয়ে সে তার সব ভারটুকু নিশ্চিন্তে ফেলে দিতে পারে।
এর মধ্যেই মেঘের বুকে বিদ্যুতের মতো সারদার মুখটিও বারবার ঝিলিক মেরে উঠেছে তার মনে এবং এক বিচিত্র আবেগে বুকের মধ্যে ঝড় উঠেছে তার। বিশেষ করে, সারদার সেদিনের সমস্ত জীবনবৃত্তান্ত এবং কান্ত লখাইয়ের কাছে অতীত জীবনের অন্ধকারের কথা বলে বারবার তার নিজের গ্লানি প্রকাশ ও তাকে মর্মে ঘা দেওয়া—এ সবই তাকে অস্থির করে তুলছে মনে মনে। সেই সঙ্গে তার অবাধ ও নিঃসংশয়ে প্রেম নিবেদন, আকাঙ্ক্ষার গৌরবে তার সেই শান্ত মধুর জলভরা মুখ, অন্য দিকে প্রাণের অকপট স্বীকৃতি ও মানবীর রুদ্ধ বাসনার ব্যাকুলতা সমস্ত মিলিয়ে লখাইয়ের হৃদয়ে নিজেকে অঙ্কিত করে রেখেছে সে।
ইতিমধ্যে আখড়ার উচ্ছেদ কাজও শুরু হয়েছে। মনে এবং বাইরের এ দুঃসময়ে মুরলীদাদার লখাইয়ের সঙ্গ পাওয়ার ইচ্ছা থাকা খুবই স্বাভাবিক।
শেষ পর্যন্ত সারদার টানই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। সে আখড়ায় এসে হাজির হল।
সে এসে দেখল, আখড়ার বড় বিশৃঙ্খল অবস্থা। বহু জিনিসপত্র বাইরে ইতস্তত ছড়ানো। একটা গরুর গাড়িতে মাল ওঠানো হচ্ছে। মুরলীদাস বসে রয়েছে মন্দিরের সামনে। শুধু ঠাকুরের ঘরটিতেই এখনও হাত দেওয়া হয়নি এবং সে স্থানটি তেমনি পরিষ্কার ঝকঝকে রয়েছে।
সারদা শাড়িতে গাছকোমর বেঁধে গাড়িতে মাল তুলছে। লখাইকে দেখামাত্র তার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল হাসি। ক্লান্তি চাপতে ঠোঁটের উপর দাঁত চেপে মোহিনী হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করল সে লখাইকে। মনে হয় সে-রাত্রির বেদনার পাষাণ তার বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।
লখাই সোজাসুজি তার কাছে এসে দুর্বোধ্য চোখে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত, তারপর মুখ ফিরিয়ে মুরলীদাসের কাছে এল।
মুরলীদাস তাড়াতাড়ি হাত ধরে বিষাদভরা গলায় বলল, অ্যাদ্দিনে তোমার সময় হল কান্ত? রোজই ভাবি আজ আসবে। কালকে যে শেষদিন!
বলতে বলতে মুরলীদাসের চোখে জল এসে পড়ল।
লখাই নীরব। তার কোনও সান্ত্বনা নেই।
কেবল আজ চোখে জল নেই সারদার। সে যেমন তেমনি নীরব হাসিতে ভরপুর। আখড়া ত্যাগে ওর যেন কোনও দুঃখ নেই মাঝে মাঝে সে গুনগুনিয়ে উঠছে, ক্ষণে ক্ষণে চোখের কোণের বঙ্কিম কটাক্ষে লখাইয়ের মেঘভারাতুর বুকে এঁকে দিচ্ছে বিদ্যুতের রেখা।
লখাই জিজ্ঞেস করল মুরলীকে, আর সব কোথায় মুরলীদা?
মুরলী বলল, আর সবার মধ্যে পুনি গেছে নতুন আখড়ায়। কনি রান্না করছে। মালটা বোঝাই হলে আমিও সেখানেই যাব। তুমি সেখানে যাবে না কান্ত?
যাব বইকী, মুরলীদাদা। তোমরা তো সব গোছগাছ করো, তা পরে যাব।
বাইরের দরজার পাল্লা দুখানি গাড়িতে ওঠানোর পর গাড়ি ছাড়ল। মুরলীদাস বলে গেল, তুমি থেকো কান্ত, ও বেলা আমি আসব।
মুরলীদাস চলে গেলে সারদা কাছে এসে বলল, নেয়ে এসো, বেলা অনেক হয়েছে। তেল গামছা দিই?
কিন্তু লখাই কথা বলতে পারল না, অপলক-চোখে সে সারদার দিকে তাকিয়ে রইল।
সারদা সে চোখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। অ-মা গো! অমন করে চেয়ে আছ যে? বলেই সে তার ঘর্মাক্ত মুখোনি কাপড়ে মুছে দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে, ঘাড় বাঁকিয়ে লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠল :
হায় বড়াই, কে জানিত তোমার রাখালের এমন কুমতি,
লোকে ভরা পথবাঁকে, হাত দিয়ে ধরে রাখে,
ছাড়ালেও ছাড়ে না, আমি বুঝিনে এ পিরিতির রীতি।
লখাই শুনল রান্নাঘরে কনকের খুতি নাড়ার শব্দ। সে হঠাৎ উঠে এসে সারদাকে দুহাতে তুলে ঘরে নিয়ে একটা তক্তাপপাশের উপর বসিয়ে দিল।
হাসি ও ত্রাসে চঞ্চল সারদা বলে উঠল, কান্ত ছাড়ো, কান্ত!
লখাই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে সারদার কোমর বেষ্টন করে তার মুখের দিকে তাকাল।
হাসি ও লজ্জায় অপরূপ হয়ে উঠল সারদা। বিন্দু বিন্দু ঘামে আবার ভরে উঠেছে তার সারা মুখ। এলো চুল খুলে পড়েছে একপাশে হেলে! আঁট করে গাছকোমর বাঁধা শাড়ির রেখায় তার দীর্ঘজীবনের সঞ্চিত যৌবন মোহিনীময়ী হয়ে উঠেছে। কিশোরী বয়সের বর্ধিত যৌবন, যৌবনের লগ্নে আঁধারে উদ্দাম হয়ে উঠেছে।
কথা বলতে গিয়ে লখাইয়ের হেঁড়ে গলা কেঁপে গেল, সই, তোমার কাছেই এসেছি আমি।
সারদার চোখে রক্তের আঁচ, নিশ্বাস দ্রুত। বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পাওয়া যায়। তার জীবনে প্রথম পুরুষের আবির্ভাব। বিশাল ও শক্তিশালী কালো পুরুষ, একমাথা দীর্ঘ চুল, মনসার বরপুত্র, এক বিচিত্র মানুষ। চওড়া মুখে তার যেন বহু যুগযুগান্তের ঝড়ের চিহ্ন বর্তমান, গুহামানবের মতো যেন অন্ধ ও সরল।
সে দুই হাতে লখাইরে মুখ তুলে ধরে বলল ফিসফিস করে, কান্ত, আমি তোমারি জন্যে পথ চেয়ে বসেছিলুম। তুমি যদি দুঃখ না পাও—
মুহূর্তে লখাই পিষে ফেলল সারদাকে বুকের মধ্যে নিয়ে।
সারদা বলল তার কানে, এ যেন দিনমান।
.
দিন কাটল, রাত্রি এল। নিদ্রার অন্তরালে এক দারুণ উৎকণ্ঠা ও ভাবনা নিয়ে মুরলীদাস তার কুড়াননা সারদার মিলনের সাক্ষী রইল।
রাত্রি শেষে লখাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সারদা বলল লখাইকে, আজকের জন্য কোনও দিন দুঃখ পাবে না তো?
কী ভেবে সারদা বলল এ কথা লখাই হয় তো তা বুঝল না। সারদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দুঃখু ছাড়া জীবন নেই, নইলে আজ এত সুখ কেন?
লখাইয়ের মুখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সারদা বলল, তোমার দুঃখের দিনে আমার কাছে এসো।