আপনি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন কেন? এখন তো আর শীতকাল নেই!
শীতকাল নেই? তবে এটা কী কাল?
ফাল্গুনের শেষ। এখন আর শীত কোথায়?
তাই বলো। আমারও কেমন হাঁসফাঁস লাগে আজকাল! চোখে ভাল দেখি না, বাইরে কি রোদের খুব তেজ?
খুব তেজ। কিন্তু চোখে ভাল দেখেন না কেন? ছোট ছেলে তো ছানিটা কাটিয়ে দিতে পারত।
চেয়েছিল কাটাতে। আমিই ভাবলাম, সে ছা-পোষা মানুষ। চোখ কাটাতে খরচ তত কম নয়। আর এ বয়সে চোখ নিয়ে আমি করবটাই বা কী?
চোখ কাটানোর নাম করে টাকা নিয়েছিল সেই গেলবার। শুনি দীপু ঠাকুরপোও টাকা দিয়েছিল। তা হলে কাটাল না কেন?
সে টাকা কি আর রেখেছে? গরিবের সংসার, কবে বোধহয় ভেঙে খেয়ে ফেলেছে।
খুব গরিব নয়। মাইনে তত খারাপ পায় না যতদুর জানি। থাকে অবিশ্যি গরিবের মতো। কিন্তু তা বলে নিজের বাবার চোখের ছানিটা পর্যন্ত কাটাতে নেই? অমন ছেলের কাছে ছিলেন কী করে এতদিন?
না, এমনিতে অযত্ন করত না। ডাক-খোজও করত খুব। বউমাটিও ভাল।
ভাল হলেই ভাল। কিন্তু চোখ যখন কাটায়নি, তখন টাকাটা আমাদের ফেরত দিয়ে দিক।
সে কি আর দিতে পারবে? পাবে কোথায়? ওদের সংসারে সারাদিন হা-টাকা যো-টাকা।
আপনার নিজেরও তো কিছু টাকাপয়সা ছিল শুনেছি। সেটাও খুব কম হবে না। সেটাও কি গিয়েছে নাকি?
আমার টাকা!
তা নয় তো কী? কিছু টাকা তো আপনার ছিল। অন্তত পনেরো-বিশ হাজার তো হবেই।
কে জানে! কোথাও আছে বোধ হয়। ডাকঘরে বা ব্যাংকে।
আছে ঠিক জানেন?
মনে নেই। আজকাল ভুলে যাই বড্ড।
শাশুড়ি-মায়ের কিছু গয়নাও ছোট কর্তার কাছে ছিল।
বুলুর কাছে? না, না, বুলুর কাছে থাকবে কেন? গয়না ছিল আমার কাছে।
ছিল মানে? এখন কি নেই?
কথাটা তা নয়। আসলে গয়নাগুলো আমি বউমাকে দিয়েছিলাম তার লকারে রাখতে।
তবেই হয়েছে। বউমা তার লকার বোধহয় আর জীবনেও খুলবে না।
মটরমালা একটা হার কিন্তু দিইনি।
সেটা তবে কোথায়?
সেটা বউমা স্যাকরাকে দেখাতে চেয়ে নিয়েছিল। বেশি দিনের কথা নয়। বলল, ওরকম একটা হার গড়বে। স্যাকরা প্যাটার্নটা দেখতে চেয়েছে।
ফেরত দিয়েছিল?
দিয়েছে বোধহয়। আমার বাক্সটা খুলে দেখো তো! বাঁ দিকে একটা বহু পুরনো সিগারেটের কৌটো আছে। ওপরে কয়েকটা পইতে, তার তলায়।
দেখতে হবে না। ধরেই নিচ্ছি ওটাও নেই।
না, না, দেখোই না ভাল করে। আমি লুকিয়েই রেখেছিলাম।
লুকিয়ে রাখতে গেলেন কেন? চোর-ডাকাত না ছেলের ভয়ে?
ভয়ে ঠিক নয়। তোমার শাশুড়ি যখন মারা যান তখন গলায় ওইটে ছিল। আমি খুলতে চাইনি। ভাবলাম যার জিনিস তার সঙ্গে যাক। সুরবালাকে মনে আছে তোমার?
ও মা। নিজের পিসশাশুড়িকে মনে থাকবে না কেন?
তা সেই সুরবালাই ওটা গলা থেকে খুলে আমার হাতে দিল। বলল, ওটা কাউকে দিয়ো না। এখনও রাঙা বউঠানের গায়ের তাপ এতে লেগে আছে। সেই থেকে হারটা ছিল। তোমার শাশুড়ির কথা খুব মনে পড়ত বলে হারটা দেখতাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে! কী যেন বলছিলাম!
বলছিলেন, হারটা লুকিয়ে রেখেছিলেন।
ঠিক তাই। পাছে কেউ চুরি করে সেই ভয়ে। ভেবেছিলাম একেবারে শেষ সময়ে যে সেবা করবে তাকে দিয়ে যাব। সময় করে একবার খুঁজে দেখো তো!
আমি দেখব কেন? আপনার জিনিস আপনিই খুঁজুন। আমার ওতে লোভ নেই। তবে এও জানি, খুঁজলেও পাবেন না।
তবে কি ফেরত দিতে ছোট বউমা ভুলে গেল?
ভুলে যাবে কেন? অত ভুলো মন তো ওর নয়।
তা হলে?
তা হলে আর কী? মনে মনে ওটা ছোট বউমাকেই দান করে দিন।
দান করাই যায়। ছোট বউমা আমার সেবা কিছু কম করেনি।
সেটা করেছে নিজের গরজেই। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই মাসে মাসে টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল যে! আমরা পাঠাতাম। দীপু ঠাকুরপো পাঠাত।
দীপু! বহুকাল দীপনাথকে দেখি না। সে কি তোমাদের এখানে মাঝে মাঝেই আসে?
না, বহুকাল বাদে ওই সেদিন এসেছিল, যেদিন আপনাকে সোমনাথ পৌঁছে দিয়ে গেল এখানে। তাড়া ছিল বলে চলে গেল একটু। সঙ্গে ওর বসের বউ ছিল!
কী করছে এখন?
চাকরিই করছে।
ভাল আছে তো! বহুদিন দেখিনি।
দেখবেন। আসতে লিখে দেব।
তোমাদের এই বাড়িটা খুব ভাল। বেশ খোলামেলা, হাওয়া-বাতাস আছে। আগেরবার দেখে গেছি, তখন এত দালান-কোঠা ওঠেনি।
এসব ঘর পরে হয়েছে।
মল্লিনাথের কি অনেক সম্পত্তি, বউমা?
খুব কম নয়।
আমার ছেলেদের মধ্যে মল্লিনাথই ছিল সবচেয়ে সাকসেসফুল। অথচ দেখো, তারই ভোগ করার কেউ নেই।
কেউ নেই কেন? এই তো আমরা ভোগ করছি।
সে ঠিক কথা। তবে তার নিজের তো কেউ নেই। পাঁচ ভূতে লুটে খাচ্ছে।
আমরা কি ভূত, বাবা?
তোমাদের কথা নয়। কী মুশকিল! আমার কি বুড়ো বয়সে সব কথা ঠিকঠাক আসে?
বললেন বলেই জিজ্ঞেস করলাম। সোমনাথ কী বলে? আমরাই সেই পঞ্চভূত?
বুলুকে তোমরা দেখতে পারো না কেন বলো তো? সে কিন্তু তার মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিল।
বেশি আদর দিয়েছেন বলেই তো এরকম।
ছেলেপুলেরা তো বাপ-মায়ের আদরেরই হয়। তুমি কি আদর দাও না?
দেব না কেন? তবে অন্যায় আদর দিই না!
দীননাথ চট্টোপাধ্যায় তার নিবিড় চুলে ভরা মাথাটা নাড়ালেন। বললেন, সবাই সেকথা বলে।
কী বলে?
বলে মেজো বউ খুব কড়া ধাতের। তা ভাল, আমরা সে আমলে সত্যিকারের ছেলেপুলে মানুষ করতে জানতাম না। ছেলেরা নিজেরাই যে যার মানুষ হত। এখনকার দিনের মা-বাবারা অনেক বেশি ছেলেপুলের যত্ন করে। তবে শাসনটা তেমন করে না। তুমি অবশ্য করো।
আপনারাও যদি ছেলেপুলেকে শাসন করতেন তবে এরকম হত না।
দীননাথ শঙ্কিত চোখ তুলে বলেন, কীরকম বলো তো? আমার ছেলেপুলেরা কি খুব খারাপ?
ভালও কিছু নয়।
কেউ নয়?
ভাশুর ঠাকুরকে ধরছি না।
দীননাথ খুশি হয়ে আবার মাথা নেড়ে বললেন, মল্লিনাথ ছিল ব্রিলিয়ান্ট। ওরকম ছেলে হয় না।
দীপুও বড় ভাল। আপনার ছেলেপুলেদের মধ্যে এই দু’জন অন্যরকম।
শ্রীনাথ কি খুব সৃষ্টিছাড়া? তাকে এখানে এসে অবধি ভাল করে দেখলামই না।
কখন দেখবেন? সেই সকালে বেরোন, রাত করে ফেরেন। কখনও ফেরেনই না।
ফেরে না? তবে রাতে কোথায় থাকে?
তা কে বলবে?
দীননাথ একটু ভাবেন। বলেন, ওর কি চরিত্র খারাপ?
খোঁজ নিয়ে দেখিনি।
খারাপ হতে দিয়ো না। এখনও আটকাও। স্বামী ছাড়া মেয়েদের কিছু নেই।
আমি ওসব মানি না।
আজকালকার মেয়েরা অবশ্য মানে না। পুরুষগুলোও তো যাচ্ছেতাই। একটা কথা বলব, বউমা?
বলুন।
আমি মরে গেলে বুলুকে একটু দেখো। যত খারাপ ভাবো ও তত খারাপ নয়।
দেখব কী, দেখার আছেই বা কী? সোমনাথ তো আর কচি খোকা নয়। বয়স হয়েছে, বিয়ে করেছে, নিজের এবং অন্যের ভালমন্দ ভালই বুঝতে শিখেছে।
ও ওর মায়ের খুব আদরের ছিল।
তাতে আমার কী? আমি তো মায়ের আদর দিতে পারব না।
তা বলিনি। বলছি, ওর বড় অভাব। ওকে একটু দেখো।
আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝেছি। বোধহয় সোমনাথই আপনাকে এসব বলতে শিখিয়ে দিয়েছে।
দীননাথ একটু লজ্জা পেয়ে বলেন, যত যা-ই হোক, ওর দাদারই তো সম্পত্তি।
সেটা দাদা বেঁচে থাকতে বুঝে নিল না কেন?
তুমি কি ওকে খুব অপছন্দ করো?
করলেই বা। ওর তাতে কী যায় আসে?
ও তোমারই দেওর।
তা হলেই বা কী? আমাকে তো বউদি বলে ভাবে না। ভাবলে এখানকার লোকদের আমার ওপর খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করত না।
ও কি তাই করছে?
হ্যাঁ।
দীননাথ তাঁর এই বয়সেও প্রচুর কালো চুলে ভরতি মাথাটা চুলকোন দু’ হাতে। তারপর বলেন, ওকে কি তুমি তোক দিয়ে মার খাইয়েছিলে?
ও তাই বলে নাকি?
ঠিক তা বলে না। তবে আন্দাজ করে। মরতে মরতে বেঁচে গেছে।
তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
দীননাথ তৃষার দিকে গভীরভাবে চেয়ে দেখছিলেন। ভাল দেখতে পান না বলে ভ্রু কোঁচকানো। বললেন, তবে এই কম্বলটা আর গায়ে দেব না বলছ?
না। শীত করলে পাতলা সুতির চাদর গায়ে দেবেন।
চাদর তো নেই।
আপনার যে কিছুই নেই তা আমি জানি। ওসব নিয়ে ভাববেন না। চাদর বিছানায় ঠিক থাকবে। আচ্ছা। খুব ভাল। তোমার বেশ চারদিকে চোখ।
চোখ ছিল বলে বেঁচে আছি। নইলে চিল-শকুনে খেয়ে যেত। কম্বল দিন, রোদে দিয়ে তুলে রাখব।
থাক না, বিছানাতে আছে থাক। এ কম্বল বিলেতে তৈরি। মল্লিনাথ দিয়েছিল। একটা স্মৃতির মতো।
ভয় নেই বাবা। আমি শমিতা নই যে, নিয়ে ফেরত দেব না।
ওই দেখো, কী কথা থেকে কী কথা!
কম্বলটা দিন। শীত এলে ফেরত পাবেন।
আর শীত কি আসবে আমার জীবনে? এটাই শেষ শীত বোধহয়।
তৃষা কম্বলটা নিয়ে চলে যায়। বিছানাটা একটু ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে দীননাথের। কম্বলটার জন্য বড় উদ্বেগ। নিয়ে গেল, আবার দেবে তো! ঠেকে ঠেকে শিখেছেন, একবার নিলে লোকে আজকাল আর কিছু ফিরিয়ে দেয় না।
দীননাথ আর শুয়ে রইলেন না। বসে বসে নিজের ছেলেপুলেদের কথা ভাবতে লাগলেন। দীপনাথ মানুষ হয়েছিল বেদবালার কাছে। বেদবালার প্রথম সন্তান বাঁচেনি। তাই দীপুকে নিয়ে গেল। পরে আরও ছেলেপুলে হয়েছিল বটে, কিন্তু দীপুকে খুব বুক দিয়ে মানুষ করেছিল। বলত, দীপ হল আমার মেজো ছেলে।… বিলুর বড় বিপদ চলছে। জামাইয়ের নাকি বাড়াবাড়ি অসুখ!… শ্রীনাথ রাতে ফেরে না মাঝে মাঝে, এ ভাল কথা নয়।… ওদিকে ছোট বউমা কী করছে কে জানে। সোমনাথ বলেছিল, রবিবারেরবিবারে আসবে। তা কত রবিবার চলে গেল। এল না তো! বউমার কি কিছু হল-টল?
খবর দেওয়া সত্ত্বেও বদ্রী এল না দেখে এক ছুটির দিনে বিকেলে নিজেই তার খোঁজে বেরিয়েছে শ্রীনাথ।
তাড়া নেই। বাজারের কাছটায় মাদারির খেল হচ্ছে, তাই দাঁড়িয়ে দেখল খানিক।
আবার রওনা হওয়ার মুখে পিছন থেকে রঘু স্যাকরা ডাকল, কে, শ্রীনাথদা নাকি?
আরে রঘুবাবু, খবর কী?
কোন দিকে চললেন?
যাই একটু ঘুরে-টুরে আসি।
খবরটা শুনেছেন নাকি?
কী খবর?
আপনার শালাবাবুর নামে যে শচীন সরকারের ভিটেটা কেনা হয়ে গেল।
সরিতের নামে? কে কিনল?
কোনও খবরই রাখছেন না আজকাল।
শ্রীনাথ বিরক্ত হয়ে বলে, ওসব খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই, রঘুবাবু।
রঘু শ্রীনাথের বিরক্তিটা গায়ে মাখল না। খুব জরুরি গলায় বলল, পুকুর আর বাঁশবন সমেত বিঘে সাতেক জায়গা। টাকাও নেহাত কম লাগেনি। বিঘেতে তিন হাজার, তার ওপর পাকা একতলা বাড়িটার জন্য আরও হাজার আষ্টেক। আপনার শালা কি ব্ল্যাক-ট্যাক করে নাকি?
কে জানে কী করে?
সবাই এ নিয়ে খুব গরম। শচীন সরকারের বউয়ের সঙ্গে বিনোদ কুণ্ডুর ব্যবস্থা হয়েছিল বিঘেতে দুই হাজার আর বাড়ির বাবদ পাঁচ। আপনার শালা চড়া দাম ছেঁকে কিনে নিল।
তার আমি কী করব?
বিনোদ সহজে ছাড়বে না। টাকাটা কোত্থেকে এল তার খোঁজ নিচ্ছে। বাগে পেলে জেলে ভরে দেবে। বিনোদের এক ভায়রাভাই সার্কেল অফিসার।
দিক। আমি ওসবের মধ্যে নেই।
তা আমরা জানি।
আপনারা মানে?
এ অঞ্চলের সবাই। আমরা বলি, শ্রীনাথ চাটুজ্জে কখনও কারও পাকা ধানে মই দিতে আসেনা। বলে থেমে গিয়ে রঘু গেলাসের ইঙ্গিত করে বলল, চলবে নাকি? এই কাছেই খালধারে আমার একটা ঠেক আছে।
না। কাজে যাচ্ছি।
আপনার বাবা এলেন শুনেছি! কদিন থাকবেন?
তা জানি না। আছেন তো এখন।
বাপ-মায়ের মতো জিনিস হয় না। গৃহদেবতা। যত্ন-আত্তি করবেন। ওঁদের আশীর্বাদেই সব।
তা বটে।
সোমনাথবাবু বাবাকে মাথায় করে রেখেছিলেন। ওই হল ছেলের কাজ।
ঠিকই তো।
যাই তা হলে। ডানদিকে এই কাছেই রামলাখন সিং-এর ঘর। চেনেন তো?
না। আসিনি কখনও।
ভাল জায়গা। সব ব্যবস্থা আছে।
কী ব্যবস্থা?
যা চান। সবই চলে ওখানে। দরকার হলে বলবেন।
রঘু খালধারের ধুলোভরতি রাস্তায় নেমে গেলে অনেকক্ষণ ভাবমাভরতি মাথা নিয়ে আনমনে হাঁটে শ্রীনাথ। বাজার পেরিয়ে রেললাইনের ধারে উঠে হাঁটাপথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একটু হাসে শ্রীনাথ। এরা তৃষাকে চেনে না।
তার মায়া হয়। ভাবে রঘু স্যাকরাকে ডেকে বলে দিয়ে আসে, শুনুন মশাই, তৃষা আপনাদের একদিন এখান থেকে উচ্ছেদ করে ছাড়বে। কোন দিক থেকে ওর মার আসবে তা টেরও পাবেন না।
বদ্রী ঘরে ছিল। ডাকতেই বেরিয়ে এসে খাতির করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।
ঘরটা পাকা হলেও ছোট আর গরম। পশ্চিম দিকে খোলা বলে রোদে তেতে আছে।
বদ্রী একটা হাতপাখা নাড়তে নাড়তে বলল, ক’দিন খুব ঝামেলায় ছিলাম বলে যেতে পারিনি। যাব-যাব করছিলাম।
তুই তো গিয়েছিলি শুনলাম।
কোথায়?—বদ্রী আকাশ থেকে পড়ে।
তৃষা তোকে ডেকে পাঠিয়েছিল না?
বদ্রী হেসে বলে, ওঃ, সে বহুদিন হল।
কেন ডেকেছিল?
রায়পাড়ার একটা জমি বেচতে চাইছেন।
তৃষা জমি বেচতে চাইছে?–শ্রীনাথ খুব অবাক হয়।
তাই তো বললেন।
মিথ্যে বলিস না, বদ্রী। তৃষাকে আমি জানি সে কোনওকালে এক ইঞ্চি জমিও বেচবে না। পারলে সে গোটা অঞ্চল, গোটা দেশ, মায় গোটা দুনিয়া কিনে নেবে।
বী ফঁপরে পড়ে বলে, আজ্ঞে, আমি যা জানি তাই বললাম।
তুই চেপে যাচ্ছিস। তৃষা তোকে অন্য কাজে ডেকেছিল।
আজ্ঞে না।
আর তারপর থেকেই তুই আমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করেছিস।
বললাম তো, ঝামেলায় ছিলাম খুব। আমার সম্বন্ধীর অসুখ গেল। ছোটাছুটি, ডাক্তারবদ্যি, হাসপাতাল অবধি হয়ে গেল।
তৃষা তোকে কী বলেছে?
আপনার ব্যাপারে কিছু নয়। জমি নিয়েই কথা ছিল।
আমার জন্য যে জমির খোঁজ এনেছিলি তার কী হল?
যেরকম চাইছেন সেরকম পাচ্ছি না।
বলেছিলি দূরের দিকে পাওয়া যাবে।
শেষতক হয়নি। সব জায়গায় হুড়োহুড়ি করে বর্গা রেজিস্ট্রি হয়ে যাচ্ছে।
ভাল দাম পেলে বর্গা ছাড়া জমিও লোকে বেচবে। আমি তো টাকায় পিছোচ্ছি না।
দেখব। কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে যাবেন।
না বদ্রী, খবর পাব না। খবর তুই দিবিও না।
আমার তাতে কী লাভ বলুন। খবর দিয়েই তো দু’পয়সা ঘরে তুলি।
তৃষা কি তোকে ঘুষ দিয়েছে?
কী যে বলেন!–বদ্রী জিব কাটে।
লুকোস না। তৃষা কি চায় না যে আমি কোথাও জমি কিনি, চাষবাস করি?
কোন স্ত্রীই বা চায় বলুন? কিন্তু কথাটা তা নয়।
তবে কী?
কথাটা হল, আপনি অন্য জায়গায় যেতে চাইছেন কেন? এদিকে তো আপনার জমিজায়গার অভাব নেই।
জমি কি আমার?
বদ্রী চোখ লুকিয়ে বলে, আপনার ছাড়া আর কার? বউঠান তো আর আপনার পর-মানুষ নন।
এসব কথা তোকে শেখাল কে? তৃষা?
না, না। কী যে বলেন!
বদ্ৰী, আমি জানি তৃষা তোকে হয় ভয় দেখিয়েছে, নয় তো ঘুষ দিয়েছে।
বীর মুখটা আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল। কেমন অসহায়, ফ্যাকাসে, ভয়ে ভরা।
হাতপাখা রেখে বদ্রী নিচু স্বরে বলল, দোষ ধরবেন না তো? তা হলে বলি।
বল, বদ্রী। আমি কাউকে কিছু বলব না। কিন্তু ব্যাপারটা আমার জেনে রাখা দরকার।
বউদিকে আমরা ভয় খাই। উনি চোখ রাঙালে সে কাজ করতে ভরসা হয় না।
তা হলে তৃষা তোকে চোখই রাঙিয়েছে?
ঠিক চোখ রাঙানো নয়। বরং ডেকে পাঠিয়ে অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথাই বললেন। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে জমির খোঁজ দিতে পেরেছি কি না।
তুই কি গাড়লের মতো সব বলে দিলি?
বললেও উনি ঠিকই খোঁজ রাখেন। চতুর্দিকে ওনার চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রমথবাবুর জমি কিনতে চেয়েছিলাম সেকথা প্রমথবাবুই বলে এসেছেন বউদিকে।
তোকে কী বলল তৃষা?
আমার কাছ থেকে সব কথা বের করে নিয়ে বললেন, উনি এখন অন্য জায়গায় জমি-টমি কিনলে এখানকার সব দেখাশোনার অসুবিধে হবে।
বাজে কথা। আমি এখানকার কিছুই দেখাশোনা করি না।
সে আমি জানি। বউদি যা বললেন তাই বললাম আপনাকে।
তারপর কী হল?
উনি বললেন, আর জমি-টমি তোমাকে দেখতে হবে না। নিজের কাজ নিয়ে থাকো। জমির যদি তেমন কোনও খবর পাও তা হলে আমাকে জানিয়ো। কাছেপিঠে হলে আমরা কিনব।
শ্রীনাথ একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বদ্রীর দিকে চেয়ে বলল, তুই আমার নিজের লোক ছিলি রে, বদ্রী। তৃষা তোকেও হাত করল।
বদ্রী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমার দোষ নেই দাদা, ছা-পোষা মানুষ।
শচীন সরকারের ভিটে কেনা হচ্ছে, সে খবর রাখিস?
রাখি। আপনার শালার নামে।
কেন?
ল্যান্ড সিলিং আছে না? জমি কিনে গেলেই তো আর চলবে না। আপনার নামেও বিস্তর জমি কেনা হয়েছে, আপনি কি জানেন?
না তো!–খুব অবাক হয়ে শ্রীনাথ বলে।
হয়েছে।
কিনলেই হল? আমার সইসাবুদ লাগবে না?
আপনার ওকালতনামায় অন্য লোক কিনছে।
ওকালতনামা আমি কাউকে দিইনি তো?
তার আমি কী বলব বলুন? যা জানি তাই বলছি।
জানিস যদি তবে খোলসা করে বল। আমার ওকালতনামা অন্যে পায় কী করে?
পেয়েছে। আমি ভাল করে জানি।
তবে কি বলছিস আমার সইও জাল হচ্ছে আজকাল?
আমি তাই বললাম নাকি? হয়তো কোনও সময়ে দিয়েছেন, এখন মনে নেই।
বাজে কথা বলিস না। আমার এখনও ভীমরতি ধরেনি।
বদ্রী জবাব দিল না। আস্তে আস্তে হাতপাখা নাড়তে লাগল। খুব আস্তে করে বলল, শুধু আপনি নয়। বৃন্দা, মংলু, এমনকী খ্যাপা নিতাইয়ের নামেও বিস্তর জমি কেনা হয়েছে।
সেই যে সেজোকাকা এসে গেছে তারপর থেকে সজলের প্রায়ই খুব সেজোকাকার কথা মনে পড়ে। সজলের হাত ধরেছিল সেজোকাকা। হাতটা দারুণ শক্ত। ধরলেই বোঝা যায় সেজোকাকার গায়ে খুব জোর। অত চওড়া কবজি আর কারও দেখেনি সে।
স্কুলে সে একদিন বন্ধুদের বলল, আমার সেজোকাকা একবার খালি হাতে বাঘ মেরেছিল।
খালি হাতে? যাঃ।
সেজোকাকার গায়ের জোর তো জানিস না। ঘুসি মেরে পাথর ফাটিয়ে দেবে।
তোর সেজোকাকা কুংফু জানে? ক্যারাটে?
ফুঃ। সেজোকাকা যখন শিলিগুড়িতে ছিল তখন একবার সিনেমাহলে মারপিট লাগে। একা পঞ্চাশজনকে মেরে ঠান্ডা করে দিয়েছিল।
গুল ঝাড়িস না।
আচ্ছা, আবার এলে তোদের দেখাব সেজোকাকাকে।
কীরকম দেখতে?
ইয়া লম্বা, অ্যায়সা গুল্লু গুলু মাসল্।
বুকের ছাতি কত?
ছেচল্লিশ।
আমার দাদারই তো বাহান্ন।
তোর দাদাকে আমি দেখেছি রে, কমল। মোটেই বাহান্ন হবে না।
তবে কত?
বিয়াল্লিশ হবে বড়জোর।
দাদা কার কাছে ব্যায়াম শেখে জানিস? বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়।
জানি। সেজোকাকা আমাকে কুংফু শিখিয়ে দেবে বলেছে। ক্যারাটেও।
আমার দাদাও ক্যারাটে জানেন।
আমার সেজোকাকার মতো নয়।
তোর সেজোকাকা যে বাঘটা মেরেছিল সেটা কত বড়?
দশ ফুট। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দেখিসনি?
আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ রাখাই হয় না।
বেরিয়েছিল। আসল রয়েল বেঙ্গল।
তোর বাবার গায়ে কিন্তু একদম জোর নেই।
সজল ফুঁসে উঠে বলে, কী করে বুঝলি?
একদিন দেখি স্টেশনের দিক থেকে আসছে তোর বাবা। চায়ের দোকানে কতকগুলো লোক বসে থাকে না সব সময়? সেই লোকদের একজন চেঁচিয়ে তোর বাবাকে আওয়াজ দিল, ওই যে শ্রীচরণনাথ যাচ্ছে, দেখ দেখ।
বাবা কী করল?
তোর বাবা মাইরি সব শুনতে পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালও। তখন সেই লোকটা না— হিঃ হিঃ—
সেই লোকটা কী?
সে যা অসভ্য কাণ্ড না!
বল না!
সেই লোকটা দু’হাতের আঙুল দিয়ে তোর বাবাকে খুব অসভ্য একটা জিনিস দেখিয়ে বলল, যাও যাও, এইটে করে গে।
লোকটা কে?
নাম জানি না। খুব মস্তানের মতো দেখতে।
বাবা কিছু বলল না?
কিছু না। মাথা নিচু করে চলে এল ভেড়ুয়ার মতো।
সজলের গা রি রি করে রাগে। সে বলে, ঠিক আছে, মামাকে বলে দেব।
তোর মামা কী করবে?
মামাকে তো চেনো না। কী করবে দেখো।
যাঃ, যাঃ, তোর মামাকে জানি। ওই তো মহাদেবের দোকানে বসে থাকে বিকেলের দিকে। লোকে যলে বেকার।
মালদায় মস্তান ছিল, জানো না তোর
বাড়িতে ফিরে সজলের নানা সময়ে বারবার কথাটা মনে পড়ে। স্টেশনের কাছে একটা লোক তার বাবাকে আওয়াজ দিয়েছিল।
বাবা যে কেন এরকম তা বোঝে না সজল। সে অবশ্য বাবাকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু সেই সঙ্গে এও জানে, বাবাকে সে ছাড়া আর কেউ ভয় পায় না। পাত্তা দেয় না কেউ।
বাবার জায়গায় সেজোকাকু হলে নিশ্চয়ই অন্যরকম হত। যেই মস্তানটা আওয়াজ দিত অমনি সেজোকাকু গিয়ে দুই চটকানে লোকটাকে মাটিতে ফেলে মুখ দিয়ে রক্ত বার করে ছেড়ে দিত। বাবা কেন সেজোকাকুর মতো নয়!
দাদু এসে সজলের কথা বলার আর-একটা লোক হয়েছে। নইলে মা, দিদিদের বা বাবাকে সে নাগালে পায় না কখনও। দাদুকে পায়।
দাদু!
বলল, ভাই। তুমি সেজোকাকুর ঠিকানাটা জানো?
না। তবে তোমার বাবা বোধহয় জানে। ঠিকানা দিয়ে কী করবে?
চিঠি লিখব। কাকু আমাকে একটা এয়ারগান দেবে বলেছিল।
এয়ারগান দিয়ে কী করবে?
লোককে ভয় দেখাব। আচ্ছা দাদু, সেজোকাকু কি কুংফু জানে?
কী ফু বলছিস?–বলে দীননাথ কানের পিছনে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়েন।
হি হি করে হেসে ফেলে সজল। দাদু এসব জানে না।