২১. ঋতুর বদলের সময়

একবিংশ পরিচ্ছেদ

ঋতুর বদলের সময় যখন এলোমেলো বাতাস বয়, ঘরের মধ্যে সূর্যের আলো কেমনভাবে যেন আসিয়া মেঝেতে পড়ে, চিরদিনের চেনা পৃথিবীকে অদেখা সৌন্দর্যের জগৎ বলিয়া মনে হয়, ফাগুন মাসের তেমনই এক উন্মনা দিনে তুলির প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করিল। কলিকাতায় বিমলেন্দু একা, কাজেই মাতুলালয়ে প্রথম সন্তান হইবার অলিখিত একটা প্রথা থাকিলেও এক্ষেত্রে তাহা সম্ভব হইল না। হৈমন্তীর তত্ত্বাবধানে হেমন্তবাবুর হাতে কাজলের পুত্র ভূমিষ্ঠ হইল।

কাজল একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। গৃহস্থবাড়িতে মাঝেমধ্যে সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে ইহা সত্য, কিন্তু সংবাদপত্রে পঠিত খবরের মতোই এ সত্যকে সে চিবকাল নৈর্ব্যক্তিক ভাবে গ্রহণ করিয়াছে। বড়ো বড়ো খবর সব অপরের জীবনেই ঘটিয়া থাকে। কিন্তু এ আবার কী! একটা সঠিক স্থানে হাত-পা-যুক্ত সত্যকারের মানবশিশু তাহাদের বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করিল যে। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে কাদে, ঘুমায় এবং অত্যন্ত সরল উপায়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিয়া থাকে। অদ্ভুত কথা বটে!

সেই সঙ্গে একটু ঈর্ষাও হইল। তুলি একান্তভাবে তাহার, তুলিকে পাশে বসাইয়া সে কবিতা পড়িয়া শুনাইবে, গল্প করিবে, বেড়াইতে লইয়া যাইবে—যেরূপ এতদিন হইয়া আসিতেছে। এ আবার কে একটা আসিয়া জুটিল, দিব্যি তুলির পাশে শুইয়া ঘুমাইয়া আছে। তাহার অধিকারবোধে ভয়ানক আঘাত লাগিল। ক্ষুদ্র মানবটির উপর প্রতিশোধ লইবার কোনো উপায় নাই, প্রতিহিংসার ইচ্ছাটা সে তুলির উপর অকারণ অভিমান করিয়া পূরণ করিতে লাগিল। ঘবে বেশি আসে না, আসিলেও কাঠকাঠ কথা বলে, কিছুক্ষণ উসখুস করিয়া উঠিয়া চলিয়া যায়। তুলি বুদ্ধিমতী বটে, কিন্তু সরল। তার বুদ্ধি সহজ বুদ্ধি, কোনো বিশ্লেষণ বা মারপ্যাচের ধার দিয়া যায় না। সে কাজলের আচরণের তারতম্য অনুভব করিল বটে, কিন্তু কারণটা ঠিকঠাক ধরিতে পারিল না। নিজের সহজ বুদ্ধি অনুসারে ভাবিল ছেলেকে স্বামীব কোলে দিলে হয়তো মেঘ কিছুটা কাটিবে। একদিন সকালে জলখাবার খাইবার পর কাজল তুলির ঘরে গেল। সন্তান হইবার পর তুলির শরীর এখনও ভালো করিয়া সারিয়া ওঠে নাই, ডাক্তারবাবু বলিয়াছেন কিছুদিন টানা বিশ্রাম লইতে। সে ছেলেকে বুকের কাছে লইয়া শুইয়া আছে, হালকাভাবে ছেলের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে।

আর ছেলেটা! নির্লজ্জ ছেলেটা সরল উপায়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিতেছে।

ইহাদের দুইজনের আহ্লাদী ভাব দেখিয়া কাজলের জ্বলিয়া গেল।

তাহাকে দেখিয়া তুলি বলিল–এসো, এইখানটায় বোসো। বাব্বাঃ, আজকাল তোমার কী হয়েছে, একেবারেই আসো না, কথা বলল না-কী এত কাজ তোমার?

কাজল কিছুটা অনিচ্ছুকভাবে সন্তর্পণে খাটের পাশে বসিল। তুলি বলিল–খোকনসোনাকে কোলে নাও না গো, কী রকম বাপ তুমি, হেলেকে আদর করতে ইচ্ছে করে না? নাও, কোলে নাও

কাজল চক্ষুলজার খাতিরে যথাসম্ভব সংস্পর্শ বাঁচাইয়া ছেলেকে কোলে লইয়া দু-একটা প্রথাগত আদরের মিষ্টবাক্য বলিল। তুলি খুশি হইয়া বলিল–বাঃ, বেশ দেখাচ্ছে।

কাজল রসিকতা করিবার চেষ্টায় বলিল–কাকে? আমাকে?

তুলি অম্লানবদনে বলিল–না না, আমি খোকনসোনার কথা বলছি–

তিক্তরসে কাজলের মন ভরিয়া গেল। হায়, তাহার জীবনের আনন্দের দিনগুলি বোধহয় ফুরাইল!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোলের কাছে একধরনের উষ্ণ এবং সান্দ্র অনুভূতি তাহাকে সচকিত করিল। দুই হাতে ছেলেকে তুলিয়া কোলের দিকে তাকাইয়া কাজল বুঝিল, এখনি তাহাকে কাপড় বদলাইতে হইবে।

প্রথমটা তাহার ভয়ানক রাগ হইল। সকালবেলা দিব্য ফিটফাট জামাকাপড় পরিয়া বসিয়া আছি, পাজি ছেলেটা সবকিছু ভিজাইয়া কী কাণ্ডই না বাধাইল! তাহার উপর ব্যাপার দেখিয়া তুলি মজা পাইয়া খুব হাসিতেছে। নাঃ, জীবনে আর সুখ বহিল না।

তাহার ঠিক পরেই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটিল। জীবনের দিকপবিবর্তনকারী ঘটনাটা।

তুলির কোলে ঝুপ করিয়া ছেলেকে নামাইতে গিয়া কাজলের চোখে পড়িল সন্তানের মুখ। যে উপলব্ধি ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বহির্জগতের সঙ্গে শিশুর যোগাযোগ ক্রমে বাড়িয়া ওঠে, সেই পর্যায়ে তাহার সন্তান এখনও পৌঁছায় নাই, কিন্তু বাহিরের সংবেদনের প্রতি সে সচেতন হইয়া উঠিতেছে। বাপের হাতে উপর হইতে নিচে দুইবাব দোলা খাইয়া তাহার খুব মজা লাগিয়াছে, নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় নিজেকে সমর্পণ করিয়া কী অম্লান হাসিই না সে হাসিতেছে!

কাজলের বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল। এই শিশুটির অম্লান হাসির সঙ্গে সৃষ্টির রহস্যময়তা মিশাইয়া আছে। সে ইহাব স্রষ্টা। সে এবং তুলি। অকস্মাৎ নিজেকে তাহার ঈশ্বরের মতো শক্তিমান বলিয়া মনে হইল, আর সেই সঙ্গে অনুভব কবিল সন্তানের প্রতি সুগভীর মমতাব ও স্নেহের অনুভূতি কিংবা আরও বেশি কিছু, কী তাহা সে জানে না।

পিতৃত্বের অনুভূতির জোয়ার নিজস্ব তীব্রতায় কাজলকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল।

মায়ের কোলে না দিয়া ছেলেকে সে বুকের কাছে ধরিয়া বলিল—দেখেছ তোমার ছেলের কাণ্ড? কেবল দুষ্টুমি, ঠিক তোমার মতো—দুষ্টু মায়ের দুষ্টু ছা–

হৈমন্তী আনন্দে দিশাহারা হইয়া গেল। কাজলকে সে একেবারে শিশু অবস্থায় পায় নাই, একটি শিশুকে সম্পূর্ণ নিজের হাতে মানুষ করিয়া তুলিবার যে সুপ্ত কামনা নারীর মনে সেই পুতুলখেলার সময় হইতে লুকাইয়া থাকে, হৈমন্তীর সে কামনা পূর্ণ হয় নাই। পৌত্রে মধ্য দিয়া এইবার তাহা সার্থকতা লাভ করিল। দুইমাসের শিশুর ভিতর সে এমন সব গুণ আবিষ্কার করিতে লাগিল বাস্তবে যাহার মাথামুণ্ডু কিছুই নাই। পৃথিবীতে আর কোনো শিশু এমন করিয়া হাসে না, এমন করিয়া হাতপা নাড়ে না, এমন বুদ্ধিমানের মতো তাকায় না! তাহার নাতি ছাড়া দুনিয়ার আর সব শিশুকে মালক্ষ্মীর বাহনের মতো দেখিতে! যে এইসব মতের বিরোধিতা কবে, সে ঈর্ষায় জ্বলিতেছে বলিয়াই সেইরুপ করে! ব্যাপার দেখিয়া কাজলের হাসি পাইত। তাহার মা গল্প লেখে, বাবার একখানা বড়ো জীবনী লিখিতেছে, উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করে, মা তো আর যে-সে লোক নয়—সেই মায়ের এমন কাণ্ড! নাঃ, স্নেহ সত্যই অতি বিষম বস্তু!

ছেলে একটু বড়ো হইবার সঙ্গে সঙ্গে কাজল তুলিকে আবার অনেকখানি ফিরিয়া পাইল, কারণ নাতির ভার প্রায় সবটাই হৈমন্তী নিজের হাতে তুলিয়া লইয়াছে। সকালবেলা ভালো করিয়া আলো ফুটিবার আগেই ছেলে জাগিয়া ভয়ানক চেঁচামেচি শুরু করে। পৃথিবী ভোরের আলোয় তখনও চোখ মেলে নাই, তুলিকে জাগাইতে কাজলের মায়া হয়, সে নিজেই ছেলেকে কোলে লইয়া বারান্দায় পায়চারি করে, বলে—ওই দেখ কেমন একটা পাখি, ওই নিমগাছের ডালে। কি পাখি জানিস? ওটা হল কাক–

ছেলে বড়ো বড়ো চোখ করিয়া অবাক বিস্ময়ে কাক দেখে। এই আলো-পাখি-গানের জগতে সে সদ্য আগত। সবই তাহার ভালো লাগে। পাঁচিলের ওপর দিয়া বিড়াল হাঁটিতেছে, উঠানের মাটিতে গাছের পাতার ফাঁক দিয়া আলোছায়ার খেলা, ছেঁড়া খবরের কাগজের একটা টুকরা বাতাসে উড়িয়া কোথায় ভাসিয়া গেল—সবই বেশ কেমন সুন্দর!

নাতির কোলাহলে হৈমন্তী বারান্দায় আসিয়া বলে-দে, আমার কোলে দে। তুই ঘুমুবি আর একটু?

–না মা, উঠেই যখন পড়েছি, বরং লেখাটা একটু এগিয়ে রাখি।

হৈমন্তী নাতিকে কোলে লইয়া উঠানের ছোটো বাগানে নামিয়া পড়ে। একধারে একটা আমগাছ আছে। অল্পবয়েসে কাজল আম খাইয়া আঁটি পুঁতিয়া দিয়াছিল। তাহা হইতে বেশ বড়ো গাছ হইয়াছে, গত বৎসর হইতে ফলও ধরিতেছে। পৌষের শেষ হইতে মঞ্জরী আসে, ফার্মুনের প্রথমে বউলের মাতাল করা গন্ধ পরিবেশকে আকুল করিয়া তোলে। একটা মাঝারি ধরনের কৃষ্ণচূড়া আছে। আর আছে রঙ্গন, টগর, কলাবতী, হৈমন্তীর শখ করিয়া পোঁতা বড়ো এলাচের ঝাড়। মাধবীলতা বারান্দার থামকে আশ্রয় করিয়া প্রায় কুঞ্জবন সৃষ্টি করিয়াছে। নাতিকে কোলে লইয়া হৈমন্তী শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর দিয়া বেড়ায়, কতরকমের ছড়া বলে।

ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখে ইতিমধ্যে তুলির ঘুম ভাঙিয়াছে, চায়ের জল চড়ানো হইয়াছে। কাজল মুগ্ধ দৃষ্টিতে কর্মরতা স্ত্রীর দিকে তাকাইয়া থাকে। কিছু কিছু মেয়েকে ঘুম হইতে উঠিলে দেখিতে ভালো লাগে না, কেমন যেন বিশ্বস্ত আলুথালু চেহারা হইয়া থাকে, কিন্ত তুলি সবসময়েই অপরূপা। বরং ঘুম ভাঙবার পর ঈষৎ নিদ্রা জড়াইয়া থাকা তাহার মুখের দিকে তাকাইলে অকস্মাৎ তাক লাগিয়া যায়। সদ্যনিদ্রোথিতা তুলিকে দেবীর মতো মনে হয়।

তুলি ঠোঁট টিপিয়া হাসিয়া বলিল কী দেখছ অমন করে শুনি?

–রাজকন্যা দেখছি। গরিব মানুষ, রাজকন্যে তো আগে কখনও দেখিনি–

–সাহস তো কম নয়। কোথাকার কে ঠিক নেই, লুকিয়ে রাজার মেয়ে দেখা হচ্ছে!

কাজল কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল—শুধু কি দেখা? একেবারে হরণ করে এনেছি।

—যাও, কী হচ্ছে! মা এক্ষুনি আসবে ঘরে।

জীবন বেশ সুন্দর। রোজ পোলাওকালিয়া-মাংস খাইতে হয় না, ভালো ভালো জামাকাপড় পরিয়া গাড়িতে চড়িয়া বেড়াইতেও হয় না, ডাল-ভাত খাইয়া সাধারণভাবে জীবনযাপন করাটাই বড়ো আনন্দের। রোজ সকালে যে সূর্য উঠিতেছে, পাখি ডাকিতেছে, কষ্ট দুঃখ উল্লাস মিলাইয়া জীবনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে, তাহা আশ্চর্যের নয়? শোক দুঃখ বঞ্চনা আছেই, বাঁচিতে গেলে তাহার বিরুদ্ধে লড়াইও করিতে হইবে, কিন্তু সমস্ত আঘাত আর বিরুদ্ধতার মধ্যেও জীবন আনন্দের। জীবনের জন্য লড়াই, যেন লড়াইটাই প্রধান হইয়া না দাঁড়ায়—তাহা হইলে গৃহকোণের এই সরল সুখ, শিশুর গায়ের ঘ্রাণ, প্রিয়ার উষ্ণ সান্নিধ্য সব মিথ্যা হইয়া যাইবে।

তুলি তাহাকে সেই সরল সুখের সন্ধান দিয়াছে।

চা আসিল। সকালের প্রথম চায়ের কাপটির গভীর প্রারম্ভিক মূল্য আছে। ধূমায়িত কাপ হাতে লইয়া কাজল বলিল–বোসো তুলি, চা খেতে খেতে গল্প করা যাক—

কাজের পৃথিবীটা তাহার বাস্তব চেহারা সইয়া পুরোপুরি জাগিয়া উঠিবার আগে যে একটা মিন্ধ অবকাশ থাকে, এখন সেই দৈবী সময়। কত কী মনে পড়ে, সারাদিন ধরিয়া অয়নপথে সূর্যের পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক হইতে রৌদ্র আসিয়া পৃথিবীর গায়ে এলাইয়া থাকে, বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দের জন্ম দেয়—সে কথা কাহাকেও ঠিকমত বুঝাইয়া বলা যায় না।

কোথায় যেন যাইবার কথা ছিল। সেখানে গেলে মনে শান্তি আসিয়ে, পরিপূর্ণতা ফিরিবে।

কাজল বলিল–চল, একবার নিশ্চিন্দিপুর থেকে ঘুরে আসি। সেই বিয়ের পরপরই যা গিয়েছিলে, আর তো যাওয়া হয়নি। যাবে? বড় মন কেমন করছে দেশের জন্য তুলি বলিল–তুমি বল কবে যাবে। ভালোই তো, অনেকদিন কোথাও বেরুনো হয়নি। কিন্তু সেদিনই তো আর ফেরা যাবে না, খোকা কি মায়ের কাছে থাকতে পারবে?

-কেন পারবে না? ও আমাদের চাইতে ঠাকুমার কাছে থাকাই বেশি পছন্দ করে–

হৈমন্তীও মত দিল, বলিল—যা, ঘুরেই আয়। খোকন আমার কাছে বেশ থাকবে। তাছাড়া ঊষা রয়েছে, ওকে আমার ঘরে বিছানা পেতে শুতে বলব এখন। একদিনের তো ব্যাপার—

–হ্যাঁ মা, আমরা পরের দিন সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসব।

হৈমন্তীর শরীর ইদানীং আগের চাইতেও ভাঙিয়া পড়িয়াছে। তুলি তাহাকে সংসারের সব কাজে সহায়তা করে, কিন্তু কাজও তো বাড়িয়া গিয়াছে অনেক, বিশেষ করিয়া কাজলের সন্তান হইবার পর। পরিচিত এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে ঊষা নামে একটি মেয়েকে পাওয়া গিয়াছে, সে ঘরের কাজকর্ম দেখে, খোকাকে দেখাশুনা করে, প্রয়োজন হইলে কোলে লইয়া ঘুম পাড়ায়। হৈমন্তীকে একেবারে একা থাকিতে হইবে না।

পরের সোমবার কী একটা পর্ব উপলক্ষে ইস্কুল ছুটি ছিল। রবিবার সকালে কাজল তুলিকে লইয়া নিশ্চিন্দিপুর রওনা হইল। সঙ্গে রানুর জন্য একটা ভালো শাড়ি লইয়াছে। গতবার রানুর সহিত দেখা হয় নাই, সে কোন এক অসুস্থ আত্মীয়াকে দেখিতে কৃষ্ণনগর গিযাছিল। বৌ দেখিতে পায় নাই বলিয়া অনেক দুঃখ করিয়া তাহার পর তিন-চারখানা চিঠি দিয়াছে। রানুপিসির সঙ্গে দেখা করাও কাজলের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

নিশ্চিন্দিপুরের সহিত বহু, বহুদিনের সঞ্চিত নানা স্মৃতি জড়াইয়া আছে। বসন্তের প্রথমে নাগরম না-ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে আরম্ভ করিলে, শুষ্কপত্রে গাছের তলা ভরিয়া থাকিলে মনের মধ্যে যে একটা কেমন করা ভাব জাগিয়া ওঠে, যাহার ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না, সেই রহস্যময় অনুভূতির সহিত প্রত্যেকবার নিশ্চিন্দিপুর যাইবার সময় তাহার যে মনোভাব হয় তার মিল আছে। ঠাকুরদা হরিহর, তাহার বাবা, পিসি দুর্গা, ঠাকুমা সর্বজয়া—সবার হাসিকান্না মাখানো জীবনযাত্রার ইতিহাস দিয়া গ্রামখানি যেন এক রূপকথার জালে জড়ানো। বাস্তব নিশ্চিন্দিপুরের চাইতে এই ভাবরাজ্যের গ্রামটিই তাহার বেশি পরিচিত। চারিদিকে জীবন দ্রুত বদলাইতেছে। কিছুই আর আগের মতো থাকিবে না। কিন্তু তাহাদের এই গ্রাম, যে গ্রামকে তাহার বাবা ভালোবাসিয়া বিশ্বসাহিত্যে অমর করিয়া গিয়াছে, তাহা থাকিবে। বাহিরে যতই পরিবর্তন ঘটুক না কেন, মনের ভিতরের একটি শান্তিপূর্ণ গহন, গভীর কেন্দ্রে নিশ্চিন্দিপুর এক অপরিবর্তনীয় আশ্রয়ের প্রতীক হিসাবে বিরাজমান। এ যুগে সেখানে আর পৌঁছানো যায় না, তবু জীবনের সকল পদযাত্রার শেষে নিশ্চিন্দিপুর অপেক্ষা করিয়া থাকে।

তুলিকে দেখিয়া রানু আনন্দে অস্থির হইল। এটা করে, সেটা করে, কীভাবে যত্ন করিবে ভাবিয়া পায় না। তাহার অবস্থা এখন একটু ভালো, সংসারের কর্তৃত্ব অনেকখানি তাহারই হাতে। ছেলে বড়ো হইয়া কী যেন ব্যবসায় ভালোই উপার্জন করিতেছে, কাজেই ভাইয়ের সংসারে আগের মতো জুজু হইয়া থাকিবার প্রয়োজন হয় না। ছেলের বিবাহ দিবার কথাও ভাবিতেছে। সতুরও আগের সে দাপট নাই, ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান দিয়া সে এখন দিদির মুখাপেক্ষী। ভাগ্যচক্র এইভাবেই আরর্তিত হয় বটে!

দুপুরবেলা রানু তুলিকে লইয়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বেড়াইতে যায়। কাজল একা গ্রামের পথে ঘুরিতে বাহির হয়। নীল আকাশের পটভূমিতে থোকা থোকা সাদা সজিনার ফুল ফুটিয়া আছে, ছোটবেলায় মতোই বিন্দুবৎ চিল ওড়ে। পথের পাশের জঙ্গল হইতে বন্য সুঘ্রাণ বাহির হয়। পৃথিবীটা একইরকম থাকে, কেবল মানুষ চলিয়া যায় কোথায়।

এই গ্রামের মাটিতে একজন জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার বাবা, যে নশ্বর দেহে না থাকিয়াও অনেকের অপেক্ষাই বেশি করিয়া বাছিয়া আছে। কাজল নিজে সাহিত্যের ছাত্র, সে নির্ভুলভাবে উপলব্ধি করিতে পারে একটু একটু করিয়া দেশের মানুষের হৃদয়ে তাহার বাবার আসন আরও পাকা হইয়া আসিতেছে। আজ হইতে অনেক বছর কাটিয়া যাইবে, শতাব্দী অতিক্রান্ত হইবে, তখনও তাহার বাবার লেখা লোকে পড়িবে।

কেন?

না, তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে যে, বাবার লেখা পড়িলে গঙ্গাস্নানের পবিত্রতা এবং তৃপ্তিলাভ হয়। কীভাবে লেখক এই অমরত্বের জাদু সৃষ্টি করেন তাহা কেহ বলিতে পারে কি? লেখে তো অনেকেই, অমর হয় কয়জন? দক্ষতা ও প্রতিভার রহস্য চিরঅভেদ্য।

একটা জিনিস সে উপলব্ধি করিতে শুরু করিয়াছে।

তাহার খুব বড়ো রকমের কিছু হওয়া ঘটিয়া উঠিবে না। লেখকের সন্তানের পক্ষে লেখক হওয়া নিতান্ত কঠিন। এমন কোনো আইন যে কোথাও লিপিবদ্ধ আছে তাহা নহে, কিন্তু সাধারণত ইহাই ঘটিয়া থাকে। সে পাহাড়ে চড়িতে পারিত, ফিলম তুলিতে, গান গাহিতে বা অভিনয় করিতে পারিত। কিন্তু সাহিত্যরচনার চেষ্টা করিলে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া সে উদ্যোগ নিভিয়া যাইবে। কাহারও দোষ নাই, দোষ বিশ্বের নিয়মের।

অথবা তাহার দুমুখ বন্ধু সঞ্জয়ের কথাই কি ঠিক? সঞ্জয বলিয়াছিল—ওহে, লেখা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করো। তোমার মধ্যে চেষ্টা বা প্রতিভা নেই তা বলছিনে, কিন্তু ইউ জাস্ট ডোন্ট হ্যাভ দি ফায়ার উইদিন ইউ। তোমার জীবনটা সফ। বিশেষ সংগ্রাম নেই, ক্ষোভ নেই, সামনের বড়ো কোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করার দায় নেইমোটামুটি খেয়ে পড়ে ভালোই আছ। ইউ হ্যাভ গন সফ্ট। তুমি বইয়ের জগতে, ভাবের জগতে বাস করো। কোনো সমস্যা থাকলেও তা ওই ভাবজগতেরই সমস্যা। আমি একথা বলছি বলে আমাকে শত্রু ভেবো না, নিজের মনের মতো কথা না বললেই মানুষ সচরাচর বক্তাকে শত্রু ভাবে। আমি এ কথা বলছি যাতে ভবিষ্যতে তোমার হতাশা না আসে।

সবটা না হইলেও সঞ্জয়ের কথা কিছুটা হয়তো ঠিক।

কী আসে যায়? অনেক লেখা প্রকাশিত হইতেই হইবে, খ্যাতি পাইতেই হইবে এমন কোনো মাথার দিব্য কেহ দেয় নাই। ভালো লাগে বলিয়া লিখিতেছে, না ভালো লাগিলে বা কেহ না ছাপিলে আর লিখিবে না। বিশ্বনিকষের প্রেক্ষাপটে তাহার চেতনার আলোকবিন্দু ফুটিয়া উঠিয়াছে, যতদিন তাহা স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে, জ্বলুক না।

সে জানে এই জীবনদর্শন বিরূপ সমালোচনা আমন্ত্রণ করিয়া আনিবে, সঞ্জয় আবার হাসিয়া বলিবে—সফট, সফট লাইফ। তাহাতে দুঃখ নাই। এমন নিজের মতো করিয়া বাঁচিবার সুযোগই বা কজন পায়? বিশেষ করিয়া সে তো অন্য কাহারও ক্ষতি কবিতেছে না। অনন্তপ্রবাহে কেবলমাত্র ভাসিয়া চলিবারই যে কী আনন্দ!

বিকালে চা খাইবার সময় বাড়ি ফিরিয়া কাজল দেখিল রানুপিসিদের বসিবার ঘরে বেশ কয়েকজন লোক তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ব্যাপার কী? তাহাদের মধ্যে একজন বলিল— আমরা আজই সকালে খবর পেয়েছি আপনি এসেছেন। আমাদের পল্লীমঙ্গল সমিতির ঘরে আজ সন্ধেবেলা অপূর্বাবুকে স্মরণ করার একটু ব্যবস্থা করেছি, মানে—আপনি এসেছেন শুনে সকাল থেকে লোকজনকে খবর দিয়ে সব আয়োজন করে ফেলুলম। আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে। শুনলাম বউদিও এসেহেন, ওঁকেও আনবেন সঙ্গে দয়া করে।

দুদিনের জন্য নিজগ্রামে আসিয়া একটা সম্পূর্ণ সন্ধ্যা আটকাইয়া পড়িবারাই কাজলের ছিল, কিন্তু তাহার জীবনে বাবার নাম সঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো কাজ করে। তাহার বাবার জন্য একদল লোক সভার আয়োজন করিয়াছে আর সে যাইবে না? নিশ্চয়ই যাইবে। সে বলিল—আপনারা রানুপিসিকেও যেতে বলুন, উনি বাবাকে খুব কান্থ থেকে দেখেছেন—

-হ্যাঁ, হ্যা-নিশ্চয়। আমরা ওঁকে বলে যাচ্ছি–

সন্ধ্যাবেলা তুলি আর রানুকে সঙ্গে লইয়া কাজল পল্লীমঙ্গল সমিতিতে উপস্থিত হইল। ওপরে লাল টালির ছাদ দেওয়া লম্বামতো ঘর। মেঝেতে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিবার জায়গা করা হইয়াছে, বেশ কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই জমা হইয়াছে। উদ্যোক্তা ভদ্রলোক, সকালে যাঁহার সঙ্গে কথা হইয়াছিল, বলিলেন—আসুন অমিতাভবাবু, আসুন বউদি। পিসিমাও এসেছেন তো? বসুন, বসুন এইখানে–

বাহিরে হেমন্তের শিশিরা সন্ধ্যা নিবিড় হইয়া আসিতেছে। বক্তাদের কথা শুনিতে শুনিতে কাজল মাঝে মাঝে বাহিরে তাকাইয়া দেখিতেছিল। জীবনটা কী অদ্ভুত! এই গ্রামের পথে পথে শৈশবে খেলা করিয়া বেড়াইবার সময় তাহার বাবা কখনও কি ভাবিয়াছে যে, একদিন ভবিষ্যতের এক হেমন্ত সন্ধ্যায় এই গ্রামেই তাহার স্মরণে সভা হইবে? বাবার, ঠাকুরদার সাহিত্যচর্চা আজ সার্থক হইল।

মায়ের কাছে রাখিয়া আসা সন্তানের কথা মনে পড়িল। খোকাকে নিশ্চিন্দিপুরে আনিয়া কিছুদিন রাখিতে হইবে। এই গ্রাম তাহার সন্তানের ন্যায্য উত্তরাধিকার, ইহা হইতে সে ছেলেকে বঞ্চিত করিবে না। যদিও সে গ্রাম আর নাই, তবু–

বক্তারা বেশিরভাগই এলোমেলো কথা বলিতেছে, তাহাদের উচ্ছ্বাস যতটা, গুছাইয়া বলিবার ক্ষমতা ততটা নহে। তবু কাজলের খারাপ লাগিল না। যাহাই হউক, ইহারা তাহার বাবাকে ভালোবাসিয়াই তো সভার আয়োজন করিয়াছে।

সভা শেষ হইলে অন্ধকার গ্রাম্য পথ দিয়া তাহারা বাড়ি ফেরে। চালতা আর জামরুল গাছের ফাঁক দিয়া অসংখ্য নক্ষত্রখচিত আকাশ চোখে পড়ে। বর্ষাকাল চলিয়া গিয়াছে, ধূলিমুক্ত আকাশ বিপুল বিস্তারে প্রসারিত হইয়া আছে। দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত আলোর নদীর মতো ছায়াপথ, যাহার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত অবধি আলোর গতিতে যাইতে সময় লাগে ত্রিশ হাজার বৎসর। এই দুর্বোধ্য বিশালত্বের মধ্যে সে, তাহার বাবা, তুলি, সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা-বিজ্ঞান এবং জীবনের আর যা যা কাম্য সার্থকতা। মানবসভ্যতা বাঁচিলেই বা কী, না বাঁচিলেই বা কী? এই অনাদ্যন্ত বিশ্বজগক্টা একইভাবে নৈর্ব্যক্তিক ঔদাসীন্যের সঙ্গে বর্তমান থাকিবে।

পরের দিন খুব ভোরে তুলিকে লইয়া সে নদীর ধারে গেল।

তখনও সূর্য ওঠে নাই। প্রভাতের দৈবী আলো পৃথিবীতে ছড়াইয়া আছে। নদীর জলে স্রোতের মৃদু টান। স্রোতাভিমুখী সরু সরু লম্বা জলজ শ্যাওলা জলের টানে সামান্য কাঁপিতেছে। যদি মানুষ লোভের বশে, হিংসা, ক্ষমতা বা হঠকারিতার বশে পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করিয়া না ফেলে, তাহা হইলে এই শান্ত, সুন্দর সকাল আরও অনেক আসিবে। সে যখন পাঁচশত বৎসর অতীত ইতিহাসের গর্ভে, তখনও আসিবে।

খেয়া পারাপার এখনও শুরু হয় নাই। পারের নৌকা জলের কিনারে নদীতে পোঁতা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে। জলের উপর দিয়া বহিয়া আসা বাতাস সমস্ত শরীর কেমন জুড়াইয়া দেয়। ওই যে ওখানে প্রায় জল ছুঁইয়া একটা পাখি ওপারের দিকে উড়িয়া গেল। কী পাখি ওটা?

আজ একটু পরেই স্ত্রীকে লইয়া তাহাকে শহরে ফিরিয়া যাইতে হইবে, কিন্তু তাহার সমস্ত চেতনা আর ভালোবাসা থাকিয়া যাইবে এই গ্রামের পথের বাঁকে। চিরদিন বসবাসের জন্য আর ফিরিয়া আসা হয়তো ঘটিবে না, কিন্তু মহীরুহ যত ঊর্বে মাথা তুলুক, তাহার শিকড় থাকিয়া যায় মৃত্তিকার গভীরে।

তুলি বলিল–কী সুন্দর, না?

—ভালো লাগছে তোমার?

–হুঁ।

-তাহলে এ সবই তোমাকে উপহার দিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *