আড়ি পেতে কিছু শোনার মত মানসিকতা বিলুর নেই। তবু সে আড়ি পেতেছে।
একে আড়ি পাতা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। সে আনিসের ঘরের বাইরের দরজার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে। ভেতরের কথা-বার্তা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। আনিস তার পুত্ৰ-কন্যার সঙ্গে গল্প করছে। এমন কিছু গল্প নয়, তবু শুনতে চমৎকার লাগছে। রাত প্ৰায় নয়টা। ওরা বাতি জ্বালায়নি। ঘর অন্ধকার করে গল্পের আসর। জমিয়েছে। বিলুর ইচ্ছা করছে। হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলে, আমাকে দলে নিন আনিস সাহেব, আমিও গল্প শুনব। তা বলা সম্ভব নয়। সবাইকে অনেক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। মনের অনেক ইচ্ছা মনে চেপে রাখতে হয়। বিলুদের যে টিচার ফিজিওলজি পড়ান বিলুর খুব ইচ্ছা করে কোন একদিন তাঁকে বলতে- স্যার, আপনার পড়ানোর ধরন আমার খুব ভাল লাগে। আমি এই জীবনে আপনার মত ভাল টিচার পাইনি, পাব বলেও মনে হয় না। এমন কিছু কথা না যা একজন সম্মানিত শিক্ষককে বলা যায় না। অবশ্যই বলা যায়। অবশ্যই বলা যায়। বিলু একদিন সেই কথাগুলো বলার জন্যে স্যারের ঘরে ভয়ে ভয়ে ঢুকতেই স্যার বাঘের মত গর্জন করে উঠলে— কি চাই? বিলু থতমত খেয়ে বলল, কিছু না স্যার। এইবার তিনি গর্জন করলেন সিংহের মত,- কিছু না, তাহলে বিরক্ত করছ, কেন? গেট আউট।
বিলু কেঁদে ফেলেছিল। কি অসম্ভব লজ্জা। গেট আউট বলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া। ছিঃ ছিঃ।
বিলুর মনে হচ্ছে আজ যদি সে আনিস সাহেবের ঘরে ঢুকে বলে আপনাদের মজার মজার গল্পে অংশ নিতে এসেছি তাহলে তিনি হয়ত শুকনো গলায় বলবেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। এখন আমাদের পরিবারিক সেসন চলছে। বাইরের কেউ আসতে পারবে না। নিয়ম নেই। আবারো বিলুর চোখে পনি আসবে। ইনি অবশ্যি স্যারের মত গেট আউট বলবেন না। সবাই সব কিছু পারে না। ঐ স্যারটা ছিল পাগলা। ক্লাসের মধ্যে একবার একটি মেয়ে শব্দ করে হেসে উঠেছিল বলে তিনি চড় মারার ভঙ্গি করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ে ভয়ে অস্থির। ঠিক ঠক করে কাঁপছে। ভাগ্য ভালস্যার সেদিন নিজেকে সামলে নিলেন। চাপা গলায় বললেন, কামিজ পরিহিতা সুদৰ্শনা তরুণী! তোমার কি ধারণা আমি একজন গোপালভাড়? আমি তোমার সঙ্গে ভাঁড়ামি করছি? রিদার আর যেন হাসতে না দেখি। আরেকবার হাসলে সাড়শি দিয়ে টেনে তোমার উপরের পাটির একটা দাঁত তুলে ফেলব। উইদাউট এনেসথেসিয়া। এনেসথেসিয়া দেয়া হবে না।
আনিস সাহেবকে দেখলেই বিলুর ঐ স্যারের কথা মনে পড়ে। কেন পড়ে বিলু ঠিক জানে না। দুজনের মধ্যে কোনই মিল নেই। তবু যেন কি একটা মিল আছে। বিলু ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আনিস সাহেব বলছেন, আচ্ছ এখন তোমরা বলতো কোন প্ৰাণী অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়।
নিশা বলল, অন্ধকারে শুধু বিড়াল দেখতে পায়।
টগর বলল, বাদুর এবং পেচা দেখতে পায়।
এইসব প্ৰাণীদের মধ্যে সবচে ভাল কে দেখতে পায়?
জানি না বাবা।
প্রশ্ন করলেই চট করে জানি না বলা ঠিক না টগর। অনেকক্ষণ প্রশ্নটা নিয়ে ভাববে, তারপরেও যদি না পার তাহলে বলবে বলতে পারছি না।
নিশা বলল, আমার মনে হয় অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায় বিড়াল। আমারটা হয়েছে বাবা?
না হয় নি। অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায় মানুষ। কারণ সে অন্ধকারে বাতি জ্বালানোর কৌশল জানে। অন্য কোন প্ৰাণী তা জানে না। কাজেই মানুষ অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়।
টগর বলল, জোনাকি পোকাওতো অন্ধকারে বাতি জ্বালাতে পারে।
আনিস একটু হকচকিয়ে গেল। টগরের এই উত্তর সে আশা করেনি। আনিস বলল, জোনাকি বাতি জ্বালাতে পারে তা ঠিক। শুধু জোনাকি না। অন্ধকারে সমুদ্রের অনেক মাছ। যেমন ইলেকট্রিক ঈল বাতি জ্বালাতে পারে। কিন্তু এই বাতি প্রকৃতি তার শরীরে দিয়ে দিয়েছে। অন্ধকার হলে আপনাতে জ্বলে উঠে। প্রকৃতি মানুষের শরীরে এমন কিছু দিয়ে দেয় নি। বাতি জ্বালানোর কৌশল মানুষকে বুদ্ধি করে বের করতে হয়েছে। জোনাকি পোকা এবং ঈল মাছের সঙ্গে এইখানেই মানুষের তফাৎ।
নিশা বলল, প্রকৃতি কি বাবা?
আনিস আবার হকচাকিয়ে গেল। প্রকৃতি কি তার উত্তর তিন ভাবে দেয়া যায়। আস্তিকের দৃষ্টিকোণ থেকে, নাস্তিকের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এসকেপিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে। সে কোনটা দেবে? কোনটা দেয়া উচিত? আনিস বলল, গল্পগুজব আজকের মত শেষ। বাবারা এবার ঘুমুতে যাবার পর্ব। আমি এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে তোমরা পানি খেয়ে বাথরুম পর্ব শেষ করে ঘুমুতে যাবে। এক-দুই-তিন-চার-পাচ -ছয়…
বিলু, নিঃশব্দে নিচে নেমে এল। পথে পুতুলের সঙ্গে দেখা। সে ট্রেতে চা বিসকিট নিয়ে উপরে উঠছে। আনিসের চা। মনে হচ্ছে আনিসের সঙ্গে এই মেয়েটির এক ধরনের সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। প্রায়ই সে উপরে চা নিয়ে আসে। সহজ সম্পর্কের আড়ালে অন্য কিছু নেইতাে? বিপত্নীক তৃষিত এই পুরুষ, যৌবনের দুয়ারে এসে দাঁড়ানো সরলা একজন তরুণী। প্রকৃতি কি তার নিজস্ব নিয়মে এদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে না?
পুতুল
জ্বি আপা।
আনিস সাহেবের জন্য চা নিয়ে যাচ্ছ বুঝি?
জি। আপনে আমারে কিছু বলবেন আফা?
না কিছু বলব না। তুমি যাও।
বিলু, মুখে বলছে কিছু বলবে না। কিন্তু তার মন চাচ্ছে অনেক সময় নিয়ে পুতুলকে সে গুছিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের জটিল তার কথাগুলো বলে। এই জটিলতা ভয়াবহ জটিলতা। মানুষ তার সবটা জানে না। কিছুটা জানে। ভালবাসার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে শরীর। ভালবাসায় শরীর ছাড়াও অনেক কিছু আছে। সেই অনেক কিছু কি? কেউ কি জানে? আচ্ছা আনিস সাহেব নিজে কি জানেন? তাকে দেখেতো মনে হয় তিনি অনেক কিছু জানেন। অনেক কিছু নিয়ে ভাবেন। এই সব নিয়েও নিশ্চয়ই ভেবেছেন। একদিন হুট করে জিজ্ঞেস করে ফেললেই হয়।
বিলু একতলায় নেমে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে খানিক হাঁটল। তার মন বেশ খারাপ হয়েছে। কোন কিছুতেই মন বসছে না। ফরিদের ঘরে আলো জুলছে। বিলু মামার ঘরে উঁকি দিল।
মেঝেতে কাদের গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ফরিদ শুয়ে আছে বিছানায়। দুজনকেই খুব চিন্তামগ্ন মনে হচ্ছে। বিলু বলল, কি হয়েছে মামা?
কিছু হয় নি।
মন খারাপ?
না।
ভেতরে এস তোমার সঙ্গে কি খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করা যাবে?
ইচ্ছা করলে যাবে।
বিলু, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আচ্ছা মামা দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি। একটা ধাঁধার জবাব দাও তো। বলতো প্ৰাণীদের মধ্যে কোন প্ৰাণী অন্ধকারে সবচে ভাল দেখতে পায়?
ফরিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, মানুষ আবার কে? অন্ধকারে মানুষ ফস করে একটা টর্চ লাইট জ্বেলে দেয়। এইসব লো-লেভেল ইন্টেলিজেন্সের কথাবার্তা আমার সঙ্গে একবারেই বলবি না।
তুমি এত রাগ কেন মামা?
রাগ না। মনটা খারাপ।
বাবা আবার কিছু বলেছে?
হুঁ।
কি বলেছে।
কি হবে এই সব শুনে।
বল না শুনি।
ফরিদ কিছু বলল না। কাদের ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। বিলু বলল, বাবা কি অন্যায় কিছু বলেছেন?
অন্যায় তো বটেই। দুলাভাই আমার বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অতি কুৎসিত মন্তব্য করেছেন। দুলাভাই বলেছেন- আমার মাথায় ব্রেইন বলেই কিছু নেই। ব্রেইনের বদলে আমার মাথায় আছে শুধু ডাবের পানি। শুনে আমার মনটাই খারাপ হয় গেল। একটা লোক যদি কাকটিনিডিয়াসলি বলতে থাকে আমার মাথায় কিছু নেই তখন কেমন লাগে বলতো? তারপরেও কথা আছে- আমার মাথায় কিছু নেই ভাল কথা— তাই বলে ডাবের পানি থাকবে কেন? এটাতো অত্যন্ত অপমান সূচক কথা। ডাবের পানি বলায় যত মাইন্ড করেছি- মাথাভর্তি গোবর বললে এত মাইন্ড করতাম না।
বিলু হেসে ফেললো। ফরিদ ক্ষিপ্ত গলায় বলল, হাসছিস কেন? একজন ভাবছে আমি একটা ডাবের মধ্যে হাসি তামাশার কি আছে? না-কি তোরও ধারণা আমি একটা ডাব?
বিলু, লজ্জিত গলায় বলল, সরি মামা।
দুই অক্ষরে একটা শব্দ সিরি বললেই সব সমস্যার সমাধান? তুই ভাবিস কি আমাকে?
মামা তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি এবং তুমি নিজেও তা ভাল করেই জান।
পছন্দ করিস আর না করিস- কাল ভোর থেকে তোরা কেউ আমাকে দেখবি না। আমি পথে নেমে যাচ্ছি।
পথে নেমে যাচ্ছি মানে?
রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। বাড়িতে বসে এই অপমান সহ্য করব না। যথেষ্ট সহ্য করেছি। মানুষের সহ্য শক্তির একটা সীমা আছে। এই সীমা অতিক্রম করা হয়েছে। দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে বিলু।
কাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অখন দেওয়াল ভাঙা বাইর হওন ছাড়া আর উপায় নাই আফা।
তুইও যাচ্ছিস না-কি?
হুঁ-মামারে একলা ছাড়ি ক্যামনে।
ভাল। যা কিছুদিন বাইরে থেকে আয়।
ফরিদ পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, এই রাতাই এ বাড়িতে আমাদের শেষ রাত। দ্য লাষ্ট নাইট।
ফরিদের কথায় কোন গুরুত্ব এ বাড়িতে কেউ দেয় না। বিলুও দিল না। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা সত্যি সত্যি দেখা গেল ফরিদ এবং কাদের কাধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছে। সোবাহান সাহেবের সঙ্গে তাদের দেখা হল বারান্দায়। ফরিদ বলল, দুলাভাই চললাম। যদি কোন অপরাধ করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। যদিও জানি তেমন কোন অপরাধ হয় নি।
সোবাহান সাহেব বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
রাস্তায় আর কোথায়। আমার ঠিকানাতো দুলাভাই রাজপথে। তবে আপনি যদি এখনো নিষেধ করেন তাহলে একটা সেকেন্ড থট দিতে পারি। থেকে যেতে পারি।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন— তোমাকে যেতে নিষেধ করব কেন? আমি নিজেইতো তোমাকে যেতে বলেছি।
তাহলে যাচ্ছি দুলাভাই।
আচ্ছা।
খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ।
সুন্দর সকাল। —তাই না দুলাভাই?
হ্যাঁ সুন্দর সকাল।
তাহলে রওনা দিচ্ছি?
আচ্ছা।
কাদের বলল, বাম পাটা আগে ফেলেন মামা। চিরজন্মের মত বাইর হইতে হইলে বাম পা আগে ফেলতে হয়।
ফরিদ বাঁ পা আগে ফেলল। কুহু কুহু করে একটা কোকিল ডাকছে। এই বাড়ির বাগানে একটা পাগলা কোকিল আছে। বসন্ত কাল ছাড়া অন্য সব সময় সে ডাকে।
কোকিলের ডাকের কারণেই কি-না কে জানে ফরিদের বুক হু হু করতে লাগল। তার মনে হল মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করাটা উচিত হয়নি। তার উচিত ছিল পাখি হয়ে জন্মানো। সেসব পাখি যারা ঘর বাধতে পারে না। যেমন কোকিল। তাহলে ঘর ছাড়ার কষ্টটা পেতে হত না। যার ঘর নেই তার ঘর ছাড়ার কষ্টও নেই। পাগলা কোকিল ক্ৰমাগত ডেকে যাচ্ছে কুহু কুহু।
আধা ঘণ্টার মতো হয়েছে।
দুজন হাঁটছে সমান তালে। এক সময় কাদের শুকনো গলায় বলল, আমরা যাইতেছি কই?
ফরিদ থমকে দাঁড়িয়ে বিস্মত গলায় বলল, কি অদ্ভুত কেইনসিডেন্স। আমিও ঠিক এই মুহুর্তে এই কথাটাই তোকে জিজ্ঞেস করব বলে ভাবছিলাম।
আমারে জিগাইলে ফয়দা কি? আমি হইলাম। একটা চাকর মানুষ।
এই কথা ভুলে যা কাদের। এখন আমরা দুজনই সমান। তুই যা আমিও তা। দু জনই পথের মানুষ। রাজপথে আমাদের দুজনকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে।
জ্ঞানের কথা অখন আর ভাল লাগতেছে না। মামা। ক্ষিধা চাপছে।
ক্ষুধা-তৃষ্ণা এইসব স্কুল জিনিস এখন আমাদের ভুলে যেতে হবে রে কাদের। ম্যানিব্যাগ ফেলে এসেছি।
কন কি -সাড়ে সর্বনাশের কথা।
অবশ্যি নিয়ে এলেও কোন ইতর বিশেষ হত না। মানি ব্যাগে টাকা ছিল না। তোর কাছে কিছু আছে?
কাদের জবাব দিল না। সে একেবারে খালি হাতে আসেনি। তবে সেই কথা মামাকে বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না। ফরিদ বলল, তোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খালি হাতে আসিস নি। দ্যাটস ভেরি গুড। আয় আপাতত চা খাওয়া যাক।
চা খাইয়া টেকা নষ্ট করনের সার্থকতা কি মামা?
চা খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করব। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। রাতে কোথায় ঘুমুব এই নিয়েও ভাবতে হবে।
চলেন ফেরত যাই।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কি অদ্ভুত কেইনসিডেন্স। আমিও ঠিক এই মুহুর্তে এই কথাটাই বলব বলে ভাবছিলাম। এর ভেতর থেকে যে জিনিসটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হল সেটা কি জানিস?
কাদের বিরস মুখে বলল, জি না।
যে জিনিস স্পষ্ট হল তা হচ্ছে— পথের মানুষ সবাই একই ভাবে চিন্তা করে। ব্যাপারটা আমি চট করে বললাম, কিন্তু যা বললাম তা গভীর দার্শনিক চিন্তার বিষয়। চল চা খাই।
চলেন।
চা খেতে খেতে ফরিদ বলল, যাব কি ভাবে তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। রি এন্ট্রি কি ভাবে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে।
ভাবনের কিছু নাই। গিয়ে পরও ধরলেই হইব। পাওডাত ধইরা বলতে হইব মাফ চাই।
চুপ কর গাধা। পা ধরাধরির কিছুই নেই। গ্রেসফুল এন্ট্রির ব্যবস্থা করছি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে দে। আরেক কাপ চা দিতে বল- চিনি বেশি। রক্তে ক্যাফিনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ক্যাফিন চিন্তার সহায়ক।
ফরিদকে আরেক কাপ চা দেয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখে মৃদু হাসি দেখা গেল। কাদের বলল, কিছু পওয়া গেছে মামা?
অবশ্যই।
কি পাইলেন?
পারিবারিক সদস্যদের সাইকোলজি নিয়ে চিন্তা করে বুদ্ধিটা বের করেছি। আমরা চলে আসার পর বাসার পরিস্থিতি কি হয়েছে চিন্তা কর। প্রথমে দুলাভাইয়ের কথা ধরা যাক। উনার অসংখ্য ক্ৰটি সত্ত্বেও উনি যে একজন ভালমানুষ এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। উনার মনের অবস্থা কি? উনার মন হয়েছে। খারাপ। খুব খারাপ। মনে মনে বলছেন— এই কাজটা কি করলাম? কাজটা ঠিক হয় নি। এর মধ্যে বিলু এসে কান্না কান্না গলায় বলেছে— বাবা, তুমি মামাকে বের করে দিলে? বেচারা এখন কোথায় ঘুরছে কে জানে। বিলু যে এই কথা বলবে তা জানা কথা কারণ মেয়েটা আমাকে খুবই স্নেহ করে। করে না?
জ্বি করে! মিলি আফাও করে।
ইয়েস। এনাদার প্লাস পয়েন্ট। মিলিও বলবে- বাবা, মামার জন্যে আমার মনটা খারাপ লাগছে। এতে দুলাভাই আরও বিষগ্ন হবেন। ক্রমে ক্ৰমে দুপুর হয়ে গেল খাবার টাইম। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, আমার অভাব সবাই তীব্রভাবে অনুভব করছে। দুলাভাই, অপরাধবোধে আক্রান্ত। এর মধ্যে তোর অভাবও অনুভব করা যাচ্ছে।
সত্যি?
অবশ্যই। দোকান থেকে এটা ওটা আনা দরকার। হাতের কাছে কেউ নেই। দুলাভাই তামাক খাবেন- সেই তামাক সাজার কাজটা তোর চেয়ে ভাল কেউ পারে না।
কাদের হাসি মুখে বলল, কথা সত্য।
কি বলছি মন দিয়ে শোন। এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ ঘরের কলিং বেজে উঠল-ক্রীং ক্রীং ক্রং। সবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। সবাই ভাবছে আমরা বুঝি চলে এলাম। দরজা খুলে দেখা গেল তুই একা দাঁড়িয়ে আছিস।
আমি?
হ্যাঁ তুই। তুই গম্ভীর গলায় বলবি— আমাকে দেখে ভাববেন না যে আমরা ফেরত এসেছি। মামা কঠিন লোক, একবার ঘর থেকে বের হলে সে আর ফেরে না। মামা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি এসেছি মামার একটা বই নিতে। মামা বই ফেলে গেছেন। তোর কথা শেষ হওয়া মাত্র ঘরে খানিক নীরবতা। বিলু তাকিয়ে আছে বাবার দিকে, মিলি তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। তাদের দৃষ্টিতে নীরব অনুনয় ঝড়ে পড়ছে। দুলাভাই তখন বলবেন, যাই আমি ফরিদকে নিয়ে আসি। দুলাভাই বের হয়ে এলেন এবং হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকবেন। যাকে বলে গ্রেসফুল এন্ট্রি। বুঝতে পারলি?
পারলাম। আপনের বুদ্ধির কোন সীমা নাই মামা। আরেক কাপ চায়ের কথা কই?
আচ্ছা বল।
কাদের সত্যি সত্যি অভিভূত। এমন অসাধাণ বুদ্ধির একজন মানুষ জীবনে কিছু বলতে পারছে না কেন তা ভেবে এই মুহুর্তে সে কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করছে।
নিরিবিলি বাড়ির গেটের বাইরে ফরিদ হাঁটাহাঁটি করেছে। কাদের গিয়েছে বই চাইতে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ফিরে আসতে দেখা গেল। তার মুখ পাংশু বর্ণ।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কিরে?
ব্যাপার কিছু না। যে ভাবে বলতে বলেছিলাম বলেছিলি?
হুঁ।
দুলাভাই কি বললেন?
বললেন- বই নিয়ে বিদায় হ।
ফরিদ বিস্মিত হয়ে বলল, বলিস কি?
যা ঘটনা তাই বললাম। এই নেন আপনের বই।
কাদেরের হাতে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সবুজ মলাটের আধুনিক কবিতা।
ফরিদ নিচু গলায় বলল, সমস্যা হয়ে গেল দেখছি।
কাদের কিছু বলল না। তার খুবই মন খারাপ হয়েছে। ঐ ফাজিল কোকিলটা এখনো ডাকছে-কুহু কুহু। রাগে গা-টা জুলে যাচ্ছে।
ফরিদ বলল, কাদের কি করা যায় বলত?
কাদের থু করে একদলা থুথু ফেলল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
দুপুর এবং রাত এই দুবেলা খাবারের টাকা কি তোর কাছে আছে?
আছে।
তাহলে খামাখা এত দুশ্চিন্তা করছি কেন? রাতটা আগে পার করি। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কোন পরিকল্পনা বের করতে হবে। আমি এই মুহূর্তে কোন সমস্যা দেখছি না।
সমস্যা দেখা দিল রাতে। কোন সস্তা দরের হোটেলে রাতটা কাটানো যায় কিন্তু কাদের টাকা খরচ করতে চাচ্ছে না। কতদিন বাইরে বাইরে ঘুরতে হবে কে জানে। হাতে কিছু থাকা দরকার। মামার উপর এখন সে আর বিশেষ ভরসা। করতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে তার বুদ্ধিটাই ভাল ছিল— পায়ের উপর পড়ে যাওয়া এবং কান্না কান্না গলায় বলা— মাফ করে দেন।
ঠিক হল রাত কাটানো হবে কমলাপুর রেল স্টেশনে। খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর শুয়ে থাকা। এমন কোন কঠিন ব্যাপার না। তবে মশা একটা বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। পরে বলাটা ঠিক হবে না ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে। চারদিকে মশা। স্ত্রী মশারাই কেবল মানুষের রক্ত খায়। কাজেই ধার নিতে হবে যে মশাগুলো তাকে কামড়াচ্ছে তারা স্ত্রী জাতি ভুক্ত। এদের প্রত্যেককেই বেশ স্বাস্থ্যুবতী মনে হচ্ছে। ফরিদের ধারণা ইতোমধ্যে তার শরীর থেকে কোয়াটার কেজির মত রক্ত পাচার হয়ে গেছে।
কাদের।
জ্বি মামা।
মশার হাত থেকে বাচার জন্যে একটা বুদ্ধি বের করেছিরে —কাদের।
কাদের কিছু বলল না। সে অত্যন্ত বিমর্ষ বোধ করছে। মামার কোন বুদ্ধির উপরই সে এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না। ফরিদ উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমরা কি করব জানিস? আমরা মশাদের টাইম দেব। আমরা শোব। এমন জায়গায় যেখানে অনেক লোকজন শুয়ে আছে। কিন্তু এখন শোব না। এখন শুধু হাঁটাহাঁটি করব। ধর রাত একটা পর্যন্ত। ইতোমধ্যে মশারা তাদের প্রয়োজনীয় রক্ত অন্যদের কাছে থেকে সংগ্রহ করে রাখবে। আমরা যখন ঘুমুতে আসব তখন তাদের ডিনার পর্ব শেষ। বুঝতে পারলি ব্যাপারাটা?
পারছি।
সবই বুদ্ধির খেলা বুঝলি। সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে মাথায়। মশা সমস্যার কি সহজ সমাধান করে দিলাম দেখলি?
দেখলাম।
তোর মনটা মনে হচ্ছে খারাপ।
ঘরে বিছানা, মশারি, বালিশ থুইয়া মাটির মধ্যে ঘুম।
কিন্তু স্টেশনে গণমানুষের সঙ্গে শুয়ে থাকারও তো একটা আনন্দ আছে। ওদের কাতারে চলে আসতে পারছি এটা কি কম কথা? Have nots ব্দের চোখের সমনে খেতে পাচ্ছি। আশ্রয়হীনদের দুর্দশা দেখছি। ওদের সুখ-দুঃখে৷ অংশ নিচ্ছি- এটাওতো কম না।
মামা চুপ করেন তো।
তোর মেজাজ মনে হচ্ছে অতিরিক্ত খারাপ। এটাতো ভাল কথা না। জীবনকে দেখতে হবে। জানতে হবে। এদের নিয়ে আমি একটা ছবি করব বলেও ভাবছি। ছবির নাম তাহারা। ছিন্নমূল মানুষদের ছবি। অপেনিং শট থাকবে একটা শিশুর মুখ। ওকি চলে যাচ্ছিস কেন?
মেঝেতে খবরের কাগজ বিছায়ে ঘুমানো যতটা কষ্টকর হবে বলে ভাবা গিয়েছিল ততটা কষ্টকর মনে হচ্ছে না। মাথা নিচে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ দিয়ে ফরিদ বেশ আরাম করেই শুয়েছে— তারপাশে কাদের। কাদের ঘুমিয়ে পড়েছে। ফরিদের ঘুম আসছে না। সে চোখের উপর কবিতার বইটা ধরে রেখেছে। কবিতা পড়তে নেহায়েত মন্দ লাগছে না।
ফরিদের মাথার কাছে এক বুড়ো শুয়েছে। সে স্টেশনেই ভিক্ষা করে। সেও ফরিদের মতাই জেগে আছে। এক সময় বলল ভাইজান কি পড়েন?
ফরিদ বলল, কবিতা।
এট্টু জোর দিয়ে পড়েন— আমিও হুনি।
আপনার সম্ভবত ভাল লাগবে না।
লাগব। ভাল লাগব।
ভাল লাগলে শুনুন, এই কবিতাটা প্রেমেন্দ্ৰ মিত্রের লেখা।
হিন্দু?
জি হিন্দু।
মালাউনের কবিতা কি ভাল হইব? আইচ্ছা পড়েন।
কবিতার নাম, কাক ডাকে–
খাঁ খাঁ রোদ নিস্তব্ধ দুপুর;
আকাশ উপুড় করে ঢেলে দেওয়া
অসীম শূন্যতা,
পৃথিবীর মধ্যে আর মনে—
তারই মাঝে শুনি ডাকে
শুষ্ক কণ্ঠ কা কা!
গান নয়, সুর নয়,
প্ৰেম, হিংসা, ক্ষুধা— কিছু নয়,
সীমাহীন শূন্যতা শব্দমূর্তি শুধু।
কবিতা পড়তে পড়তেই ফরিদ ঘুমিয়ে পড়ল। কবিতা পাঠের কারণেই হোক, কিংবা সারাদিনের পরিশ্রমের কারণেই হোক খুব ভাল ঘুম হল। যাকে বলে একঘুমে রাত কাবার।
ঘুম ভাঙল কাদেরের চিৎকারে।
সব্বনাস হইছে মামা—উঠেন।
ফরিদ উঠল। তেমন কোন সর্বনাশের ইশারা সে দেখল না। কাদের চাপা গলায় বলল, চোর বেবাক সাফ কইরা দিছে।
সাফা করে দিয়েছে মানে?
ভাল কইরা নজর দিয়া দেখেন মামা।
আরো তাইতো!
ফরিদের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নেই। কাদেরের টিনের ট্রাংক নেই। শুধু তাই না, সবচেয়ে যা আশ্চর্যজনক হচ্ছে, চোর ফরিদের গা থেকে পাঞ্জাবী এবং কাদেরের শার্ট খুলে নিয়ে গেছে। এই বিস্ময়কর কাজ চোর কি করে করল কে জানে। অত্যন্ত প্ৰতিভাবান চোর। এটা মানতেই হবে। ফরিদ বলল, ভাল হাতের কাজ দেখিয়েছে রে কাদের, I am impresed.
কাদের শুকনো স্বরে বলল, অল্পের জইন্যে ইজ্জত রক্ষা হইছে মামা। টান দিয়া যদি লুঙ্গী লইয়া যাইত তা হইলে উপায়টা কি হইত চিন্তা করেন।
ফরিদ শিউরে উঠল। এই সম্ভাবনা তার মাথায় আসেনি। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার পরণে প্যান্ট। ব্যাটা নিশ্চয়ই প্যান্ট নিতে পারত না। কি বলিস কাদের?
যে শার্ট খুইল্যা নিতে পারে সে প্যান্টও খুলতে পারে।
তাওতো ঠিক। মাই গড। আমারতো চিন্তা করেই গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কি করা যায় বলতো? রেলওয়ে পুলিশকে ইনফর্ম করব?
কাদের অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলল, চুপ করেন তো মামা?
জিন্দেগীতে কোনদিন শুনেছেন পুলিশ চোর ধরছে? আল্লাহতালা পুলিশ বানাইছে ঘুস খাওনের জইন্যে।
বলিস কি?
দেশ থাইক্যা পুলিশ তুইল্যা দিলে চুরি ডাকাতি অর্ধেক কইম্যা। যাইব। গরিব একটা কথা কইছে। কথাটা চিন্তা কইরা দেখবেন।
চোর সবই নিয়ে গেছে। তবে কবিতার বই ফেলে গেছে। ফরিদ কবিতার বই হাতে নিল। তবে কবিতার পড়ার ব্যাপারে সে এখন আর কোন আগ্ৰহ বোধ করছে না। প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। খালি পেটে কাব্য, সংগীত এইসব জমে না কথাটা বোধ হয় ঠিকই।
কাদের।
জ্বি মামা।
খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায় বলতো।
আর খাওয়া দাওয়া।
নাশতা তো খেতে হবে।
দুই গেলাস পানি খান। পানি হইল ক্ষিধার বড় অষুধ।
ফরিদ পর পর তিন গ্রাস পানি খেল। তার ক্ষিধের তেমন কোন উনিশ বিশ ठूल •ा।
সোনালি ফ্রেমের চশমা পড়া প্রফেসর টাইপ এক যাত্রী যাচ্ছে। চিটাগাং থেকে এসেছে মনে হচ্ছে। ফরিদ কবিতার বই হাতে এগিয়ে গেল, নরম গলায় বলল, ভাই শুনুন আমার কাছে চমৎকার একটা কবিতার বই আছে। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত আধুনিক কবিতা। নাম মাত্র মূল্যে বইটি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি কি আগ্রহী?
লোকটি অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল, জবাব দিল না। তবে ফরিদ পরের এক ঘণ্টার মধ্যে বইটি পনেরো টাকায় বিক্রি করে ফেলতে সক্ষম হল। বইটি কিনেছে কাল চশমা পরা রূপবতী একজন তরুণী। কাদের তার হ্যান্ডব্যাগ এগিয়ে দিয়েও পাঁচ টাকা পেল।