২১. আমি কী করছি

আমি কী করছি? আমি কেন এই বাড়িতে পড়ে আছি? এদের সঙ্গে আমার যোগটা কোথায়? জাহানারা নামের একজন মহিলা অসুস্থ, পাগলের মত আচরণ করছেন— শুধুমাত্র এই কারণে আমি থেকে গেছি। এটা আর যে-ই বিশ্বাস করুক আমি নিজেতো করছি না। আমার বাবা মারা গেছেন। মার এখন দিশেহারা অবস্থা। অথচ আমি দিব্যি থেকে গেলাম। সন্ধ্যাবোলা রাণীর মা চা দিয়ে গেল। আমি স্বাভাবিকভাবেই চা খেলাম। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, রাতে কী রান্না হবে? আমি তাও বললাম; রাতে শুভ্ৰ নামের মানুষটার গল্প শুনলাম। বৃদ্ধার ভালুকা যাবার গল্প। আমি উঠে যেতে চাচ্ছিলাম, শুভ্ৰ নামের মানুষটা হাত ধরে আমাকে বসাল। আমার তাতে কোনোরকম অস্বস্তি বোধ হল না, সংকোচ বোধ হল না। মনে হল এটাইতো স্বাভাবিক।

আমি কি আশা করে আছি। এই মানুষটার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? না, আমি কোনো কিছুই আশা করে নেই। যে পরিবারে আমার জন্ম, যে পরিবেশে আমি বড় হয়েছি সেখানে কেউ কখনো আশা করে না। স্বপ্ন দেখে না। বেঁচে থাকার চেষ্টাতেই আমরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি— আশাটা করব কখন? তবে আমার বাবা আশা করতেন। তিনি স্বপ্ন দেখার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন। এসএসসি’র রেজাল্ট বের হবার পরের এক মাস যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে তাকেই বলেছেন, আমার মেয়ে একটা বিরাট কিছু হবে। তার জীবনী লেখা হবে। বেগম রোকেয়ার জীবনী যেমন লোকে পাঠ করেছে, আমার মেয়েরটাও পাঠ করবে ইনশাল্লাহ।

সত্যি সত্যি যদি কখনো আমার জীবনী লেখা হয়। সেখানে নিশ্চয়ই আমার ছেলেবেলার কথা থাকবে। সেখানে কি উল্লেখ থাকবে অতি শৈশবে হাটবারে আমি এক হাটে যেতাম? সঙ্গে থাকতো হাঁস-মুরগির ডিম, পাকা পেঁপে। হাটের এক কোণায় পেঁপে এবং ডিম নিয়ে বসে থাকতাম খরিদ্দারের আশায়।

আমি এখন সুন্দর একটা ঘরে শুয়ে আছি। ঘরে বাতি জ্বলছে। জানোলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে বিছানায় পড়েছে। ইচ্ছা করলেই আমি চাঁদ দেখতে পারি। ইচ্ছা করছে না। নিজেকে কেমন যেন অশুচি এবং নোংরা মনে হচ্ছে; মনে হচ্ছে। আমি যেন কোনো দুষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এ বাড়িতে বাস করছি। পরিকল্পনার শেষ না দেখে আমি নড়তে পারছি না। অথচ আমার কোনোই পরিকল্পনা নেই। আমার কোনো স্বপ্ন নেই। আমার কিছুই নেই।

বাবা আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁর কত বড় বড় কথা— বিনু দেখবি তোকে তারা কত আদর করে। খানদানী ফ্যামিলি- এদের ব্যাপারই আলাদা। বড় মানুষদের মনও বড় হয়। যে গর্তে বাস করে তার মনটা হয়। গর্তের মত, যে রাজপ্রাসাদে বাস করে তার মন হয় রাজপ্ৰসাদের মত বড়। আমি বাবার সঙ্গে তর্ক করতে পারতাম। বাবাকে উদাহরণ দিয়ে বলতে পারতাম পৃথিবীর সব বড় মানুষরা অতি ক্ষুদ্র ঘরে জনেছিলেন। তর্ক করি নি। তর্ক করতে আমার ভাল লাগে না।

এই বাড়িতে এসে প্রথম দেখা হল বাড়ির কর্ত্রী জাহানারা নামের মহিলার সঙ্গে। বাবা বললেন, মাগো সালাম কর— তোমার চাচি। পায়ে হাত দিয়ে দোয়া নাও।

মহিলা কঠিন গলায় বললেন, পায়ে হাত দিও না। জার্নি করে এসেছি। শরীর নোংরা। তাছাড়া কেউ গায়ে হাত দিলে আমার ভাল লাগে না।

মহিলা এমনভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন যেন আমি সত্যি সত্যি নর্দমার ংরা মেখে উঠে এসেছি। আমার সমস্ত শরীর থেকে বিকট দুৰ্গন্ধ আসছে। মহিলা তাঁর নোকও খানিকটা কুঁচকে আছেন। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন- এই মেয়ে থাকবে কোথায়? আমরাতো দোতলায় কাউকে রাখি না। শুত্র পড়াশোনা করে অপরিচিত কাউকে দেখলে বিরক্ত হয়।

বাবা বোকার মত বললেন, অপরিচয় থাকবে না ভাবি সাহেবা। পরিচয় হবে। বিনু তার ছোটবোন। দুনিয়ার কোনো ভাইকে দেখেছেন বোনের ওপর বিরক্ত হয়েছে। হা হা হা।

চাচি বললেন, ভাই-বোন পাতাতে হবে না। কয়েকটা দিন থাকার দরকার— থাকবে। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, এই বন্দোবস্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না। পরের বার যখন ঢাকায় আসবেন— দয়া করে এই বাড়িতে আসবেন না। আর শোন মেয়ে, বাড়িতে কখনো স্যান্ডেল ফট ফট করে হাঁটবে না। খালি পায়ে হাঁটবে। স্যান্ডেলের ফটফট শব্দ আমার সহ্য হয় না।

বাবা আমাকে রেখে চলে গেলেন। বিশাল একটা ঘরে আমার জায়গা হল। সারা রাত এক ফোটা ঘুম হল না। সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি– রাজপুত্রের মত একটা ছেলে হাসিমুখে আমার দিকে আসছে। শুভ্র তাহলে ইনি। এত সুন্দরও হয় মানুষ! তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, বিনু তোমার দেখি সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। ভালই হয়েছে, যাওতো আমার জন্যে দুকাপ চা বানিয়ে আন। একটা কাপে কোনো চিনি থাকবে না, আরেকটা কাপে দুচামচ চিনি থাকবে। পিরিচে করে আলাদা চিনি নিয়ে এসো। এমনভাবে চা বানাবে যেন কারোর ঘুম না ভাঙে। এত সকালে মার ঘুম ভাঙলে ভয়াবহ ব্যাপার হবে। খুবই বদরাগী মহিলা।

আমি শুভ্ৰ নামের মানুষটার কথায় কী যে অবাক হলাম! নিতান্তই অপরিচিত একটা মেয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। অথচ কত স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছেন। শুরুতে তিনি বলতে পারতেন, তোমার নাম বিনু না? তা করেন নি, সরাসরি বিনু নাম দিয়ে কথা আরম্ভ করেছেন। যেন অনেক দিন থেকেই তিনি আমাকে চেনেন। তাঁকে চা বানিয়ে খাওয়াবার দায়িত্ব আমিই এতদিন পালন করে এসেছি।

এ বাড়ির রান্নাঘর কোথায়, চা-চিনি কোথায়— কিছুই জানি না। গ্যাসের চুলা কীভাবে ধরাতে হয় তাও জানি না। তারপরেও আমি ঠিকই দুকাপ চা বানিয়ে তার কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, যে কাপে দুচামচ চিনি সেই কাপটা আমাকে দাও। যে কাপে চিনি নেই সেটা তোমার। তুমি তোমার পরিমাণমত চিনি নাও। তারপর এসো চ খেতে খেতে গল্প করি।

সামান্য দুকাপ চা বানিয়ে আনতে বলার মত তুচ্ছ ঘটনাটাকে মানুষটা কত সুন্দর করে করল। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে, তারপরেও কিন্তু উনি না বলা পর্যন্ত বুঝতে পারি নি এক কাপ চা আনা হয়েছে আমার জন্যে।

বিনু তোমার চা ভাল হয়েছে।

আমি কিছু বললাম না। এই ক্ষেত্রে রীতি নিশ্চয়ই থ্যাংক ইউ বলা। আমার মুখ দিয়ে থ্যাংক ইউ বের হল না।

বিনু শোন, চা বানানোর ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। চায়ের পানি ফুটিয়ে চা বানানো হয়। পানি ফুটালে কী হয় জানতো— পানিতে যে ডিজলভড অক্সিজেন এবং অন্যান্য গ্যাস থাকে তা চলে যায়। চা তাতে টেষ্টলেস হয়ে যায়। ফুটন্ত পানি খেতে বিস্বাদ হয় এই কারণে। কাজেই আমার মতে চা বানাতে হবে পানি না ফুটিয়ে। পানির টেম্পারেচার কিছুতেই ৯৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর উঠতে দেয়া যাবে না। বুঝতে পারছি কী বলছি?

জ্বি।

আমার মা তোমাকে বকাঝকা কেমন দিচ্ছে? শোন বিনু, মার কথায় কখনো কিছু মনে করবে না। মার স্বভাব হল বকা দেয়া। কোনো আসমানী ফেরেশতাও যদি আমাদের বাড়িতে থাকতে আসেন, মা তাকে সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা তিনবেলা বকা দেবেন। স্যান্ডেল পায়ে হাঁটলে বলবেন স্যান্ডেল খুলে ফেলতে। খালি পায়ে হাঁটলে বলবেন স্যান্ডেল পরতে।

শুভ্ৰ নামের মানুষটা হাসছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর হাসি দেখছি। তার হাসি দেখতে দেখতেই আমার শরীর বিমঝিম করতে লাগল; আমি চোখের সামনে আমার সর্বনাশ দেখতে পেলাম। পরিষ্কার বুঝলাম, আমার পক্ষে কোনোদিনও এই মানুষটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব হবে না। মানুষটা আমাকে সারাজীবনের জন্যে কিনে নিয়েছেন। তিনি যদি এখন আমাকে বলেন, বিনু শোন, পত্রিকায় পড়ি মানুষ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। আমার খুব শখ ঘটনোটা দেখার। তুমি কি কাজটা করবে- আমি দেখব। উনার কথা শেষ হবার আগেই আমি বলব, ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছি। আপনি নিচে গিয়ে দাঁড়ান। তাহলে ভাল দেখতে পাবেন।

আমি এই মানুষটাকে নিয়ে অল্প কদিনে যত ভেবেছি তত ভাবনা কোনো কিছু নিয়েই কখনো ভাবি নি। মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। প্রথমে একটা ব্যাখ্যা দাঁড়া করাই, তারপর অন্য আরেকটা, আবার তৃতীয় কোনো ব্যাখ্যা।

যেমন শুরুতে ব্যাখ্যা করলাম– শুভ্ৰ নামের মানুষটা সরল প্রকৃতির। মনের ভেতর কিছুই রাখেন না। কোনো কিছু লুকাতে হবে এটা তাঁর প্রকৃতির ভেতর নেই, যে কারণে নিজের বদরাগী মা প্রসঙ্গে এত অবলীলায় কথা বলতে পারছেন। মার আড়ালে যে বলছেন তা না, মার সামনেও বলছেন। কেউ তার কথায় আহত হচ্ছে কি-না এটা শুভ্র কখনো ভেবে দেখেন না। শিশুদের সঙ্গে এইখানে তার মিল আছে। শিশুরাও অবিকল এ রকম।

তারপরই মনে হল ব্যাখ্যাটা ঠিক না। তিনি গোপন করেন। অনেক কিছুই গোপন করেন। তার মা আমাকে এক সময় চোর প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন। এই ঘটনা তিনি জানেন। কিন্তু আমাকে তিনি কখনো কিছু বলেন নি। যে কোনো কিছুই গোপন করে না সে এত বড় ঘটনা গোপন করবে না। সে হাসতে হাসতে বলবে, বিনু শোন, মার কী অদ্ভুত ধারণা! তুমি না-কি মার টাকা চুরি করেছি। উনি এই প্ৰসঙ্গটা চেপে গেছেন।

বাচ্চাদের স্বভাব যখন বয়স্ক মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। তখন ধরে নিতে হয়। যে মানুষটা হয় বোকা, আর তা যদি না হয় তাহলে সে ভান করছে। শিশু সাজার চেষ্টা করছে। শুভ্ৰ মানুষটা অবশ্যই বোকা নন, তাহলে তিনি কি ভান করছেন? যদি ভান করেন তাহলে ভানটা করছেন কেন? আশেপাশের মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্যে? আশেপাশের মানুষকে কে বিভ্রান্ত করতে চায়? যে নিজে বিভ্রান্ত সে করবে। শুভ্ৰ বিভ্রান্ত না। নিজের ওপর, নিজের বিচার বুদ্ধির ওপর তাঁর আস্থা সীমাহীন। তাহলে তিনি কেন বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন? কোনো স্বাৰ্থ সিদ্ধির জন্যে না মজা করার জন্যে?

উনার সম্পর্কে ভেবে ভেবে আমি কিছু বের করতে পারি না। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয়। কেউ যেন তাঁর সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা না পায় এই জন্যেই তিনি অদ্ভুত ব্যবহারগুলি করেন।

তাঁর এখন খুব দুঃসময় যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে আমি তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে দুঃসময়টা তিনি উপভোগ করছেন। যুদ্ধবাজ মানুষ যেমন যুদ্ধ করে মজা পায় তেমন মজা। জটিল কোনো সরল অংক ধীরে ধীরে করার মজা। ধাপে ধাপে অংকটা তিনি করছেন। তিনি জানেন সঠিক উত্তরটা তিনি বের করবেন। এটা জানেন বলেই অংকটা করতে তার ভাল লাগছে। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এক সময় অংকের উত্তর পেয়ে যাবেন— একারণেই কষ্টটা ভাল লাগছে।

মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি প্ৰতিশোধ নেবার চেষ্টা করছেন। বাবার ওপর প্ৰতিশোধ, মার ওপর প্রতিশোধ। প্রতিশোধ নেবার ভঙ্গিটা গ্ৰাম্য। তার মত মানুষ এই ভঙ্গিতে প্ৰতিশোধ নেবে তা ভাবা যায় না।

আমি তাঁর কেউ না। তারপরেও আমার খুব ইচ্ছা করে অংকের সমাধানে আমি তাকে সামান্য হলেও সাহায্য করি। জানি তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন নেই, তারপরেও পাশে থাকি। মাঝে মাঝে যখন রাতে তার ঘুম হয় না। তিনি আমাকে ডেকে তাঁর ঘরে নিয়ে যান। গল্প করেন। তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কোনো গল্প না। অন্য প্রসঙ্গ— ধর্ম-বিজ্ঞান। যার কোনোটাই আমি জানি না। ধর্ম বলতে আমি জানি বাবাকে দেখে যা জানা। আর আমার বিজ্ঞান হল স্কুল কলেজে পড়া বিজ্ঞানের বই। উনি বলতেন ভিন্ন কথা।

শোন বিনু, আমরা এক আল্লাহর কথা বলি না? একে বলে একেশ্বরবাদ। সর্ব প্রথম একেশ্বরবাদ কে প্রচার করেন জান? মিশরের এক ফেরাউন। তাঁর নাম ফারাও ইখনাইন। খুব জোরালোভাবে একেশ্বরবাদী ছিল হিব্রুরা। হিব্রুদের নবী কে বল দেখি।

জানি না।

জানবে না কেন! অবশ্যই জান। হযরত মূসা আলাইহেস সালাম। হযরত দাউদ, হযরত সুলায়মান আলাইহেস সালাম। আমরা মুসলমানরাও তাদেরকে নবী স্বীকার করি। আচ্ছা বল দেখি, এবার কঠিন প্রশ্ন, বল কোন ধর্মে আল্লাহ বা ঈশ্বর বলে কিছু নেই।

জানি না।

অবশ্যই জান, কেন জানবে না। বৌদ্ধ ধৰ্ম।

আচ্ছা এবার সহজ প্রশ্ন। গৌতম বৌদ্ধ এক পূর্ণিমার রাতে ঘর ছেড়ে বের হয়েছিলেন। কোন পূর্ণিমা?

জানি না।

আচ্ছা এখন বিজ্ঞান বল দেখি-বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে প্রথম কারা ভাগ করতে শেখে।

জানি না।

টাইগ্ৰীস নদীর তীরের শহর আশুর নগরের বিজ্ঞানীরা। এই কাজটা তারা করেন খ্রিষ্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে। আশুর নগর অতি সুসভ্য ছিল। এই সভ্যতাকে বলা হয় আশেরীয় সভ্যতা।

শুভ্ৰ মানুষটার এইসব গল্পকে তাঁর মা বলেন জ্ঞানী-গল্প। তিনি তাঁর পুত্রের জ্ঞানী-গল্প খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনেন। আমিও শুনি। গল্পগুলি শুনে উনি কী ভাবেন আমি জানি না। আমি ভাবি কেন তিনি গল্পগুলি করছেন? আমাকে মুগ্ধ করার জন্যে? না, তা হবে না। যে মুগ্ধ হয়েই আছে তাকে মুগ্ধ করার কিছু নেই। তাহলে তার উদ্দেশ্যটা কী?

জ্ঞানের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে তিনি কিছু ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলেন। জ্ঞানের গল্পের চেয়েও অনেক আগ্রহ নিয়ে আমি এই গল্পগুলি শুনি।

বিনু শোন, ঐ মানুষটাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।

কোন মানুষটা?

ভদ্রলোক মারা গেছেন। বুড়ো একজন মানুষ। আমাকে শুবরু বলে ডাকতেন।

যিনি মারা গেছেন তাঁকে খুঁজে বের করবেন কীভাবে?

ও আচ্ছা, তাইতো! তবে তাঁকে আমি খুঁজছি। তাঁকে মানে তাঁর ফ্যামিলির কাউকে। তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়ে।

কী জন্যে খুঁজছেন?

খুবই তুচ্ছ একটা কারণ। বলতে ইচ্ছা করছে না।

বলতে ইচ্ছা না করলে বলবেন না।

বিনু, তুমি কি লক্ষ করেছ মাঝে মাঝে তুচ্ছ ব্যাপারগুলি বিরাট কিছু হয়ে পড়ে।

না, লক্ষ করি নি।

শূন্য হচ্ছে শূন্য— অতি তুচ্ছ। সেই শূন্য কত বড় যে ব্যাপার তা শুধু জানেন গণিতবিদরা। আচ্ছা বিনু, বল দেখি ভারতবর্ষে একজন বিরাট গণিতজ্ঞ জন্মেছিলেন। পৃথিবীর প্রথম পাঁচ জন গণিতজ্ঞের নাম বলতে হলে তাঁর নাম বলতে হয়। বল উনার নাম কী?

রামানুজন।

বাহ চমৎকার! এই নামটা তুমি জানতে?

জানতাম। আপনি বলেছিলেন।

ও আচ্ছা আমি তাহলে আমার গল্প রিপিট করতে শুরু করেছি। খুবই খারাপ লক্ষণ। বুঝলে বিনু আমার মেন্টাল মেকাপ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। খুব খারাপ সময় আমার সামনে। আমি ভাঙতে শুরু করেছি।

উনি যে ভাঙতে শুরু করেছেন তা আমি দেখতে পাচ্ছি। কিছুক্ষণ আগেই তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি প্রচুর মদ্যপান করে দুদিন পর ঘরে ফিরেছেন। তিনি খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাবছিলেন তিনি স্বাভাবিক আছেন। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। এক পর্যায়ে আমাকে বললেন— বিনু তোমার কী ধারণা আমি মানুষ হিসেবে কেমন?

আমি বললাম, সত্যি জানতে চান?

তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সত্যি জানতে চাই।

আপনি মানুষ হিসেবে নিম্নশ্রেণীর।

তুমি এটা কি আমাকে আহত করবার জন্যে বললে? না-কি তুমি সত্যি বিশ্বাস কর মানুষ হিসেবে আমি নিম্নশ্রেণীর।

আমি আপনাকে আহত করবার জন্যে কখনোই কিছু বলব না। আপনি একটা সত্যি কথা জানতে চাচ্ছিলেন- আমি সত্যি কথাটা বললাম।

তুমি কেন বলছ? মানুষ হিসেবে আমি নিম্নশ্রেণীর— আচ্ছা ঠিক আছে, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। তোমার মত অনেকেই আমাকে এখন নিম্নশ্রেণীর ভাবছে। আচ্ছা একটা কাজ কর— তুমি তোমার কনসেপ্টে একজন উচ্চশ্রেণীর মানুষের কথা বল। আমি দেখতে চাচ্ছি। সে আমার চেয়ে কতটা আলাদা।

আমি শান্ত গলায় বললাম, আমার বাবা ছিলেন একজন উচ্চ শ্রেণীর মানুষ। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ তা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি আমাকে শেখাতে পেরেছেন। আপনি অনেক কিছু জেনেও আসল জিনিসটা জানেন না। আপনি ভাল মন্দ জানেন না। আপনার কাছে ভাল যা মন্দও তা। আপনি কিছু মনে করবেন না। অনেক কঠিন কথা বললাম।

শুভ্ৰ চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন। তিনি চোখ থেকে চশমা কেন খুলছেন আমি জানি। এই মুহুর্তে তিনি আমাকে দেখতে চাচ্ছেন না। তাঁকে মুখে বলতে হল না, বিনু, তোমাকে আমার অসহ্যবোধ হচ্ছে। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তিনি চশমা খুলে ফেলে আমাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন। কোনো কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার জন্যেই তিনি আলাদা। অন্য সবার চে আলাদা। এই বিশেষ ক্ষমতা ছাড়া তার আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *