২১. আমরা সবাই অপেক্ষা করি

লীলাবতী মূল বাড়ির উঠানে বসে আছে। সে মজার একটা দৃশ্য দেখছে। তার সামনে হাত পঁচিশেক দূরে একটা কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের নিচে গর্তমতো হয়েছে। বর্ষার পানি জমেছে। গর্তে। সেই পানিতে একটা কাক গোসল করছে। গোসল সারছে অতি ব্যস্ততায়। ঠোঁটে পানি নিয়ে পালকে মাখছে। কাকের স্নান মুগ্ধ হয়ে দেখার কিছু না। অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্য না। সব পাখিই স্নান করে। তবে কাকের বিশেষত্ব তার তাড়াহুড়ায়। কাকের স্নান দেখলে মনে হয়, জরুরি কোনো কাজ ফেলে সে এসেছে, তাকে অতি দ্রুত চলে যেতে হবে। তারপরেও এই দৃশ্যটা লীলাবতী মুগ্ধ চোখে দেখছে অন্য কারণে। কাকের স্নান দেখার জন্যে অন্য আরেকটা কাক পাশে বসে আছে। সে ঘাড় বাঁকিয়ে আছে এবং মাঝে মাঝে কা কা করছে।

লোকমান এসে লীলাবতীর পাশে দাঁড়াল। লীলাবতী বলল, লোকমান ভাই, আপনি পুরুষ কাক কোনটা আর মেয়ে কাক কোনটা বুঝতে পারেন? যে কাকটা গোসল করছে সে ছেলে না মেয়ে?

লোকমান না-সূচক মাথা নাড়ল।

লীলাবতী বলল, মাথা নেড়ে। আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনি জানেন না?

জানি না।

আমার ধারণা যে কাকটা গোসল করছে সেটা মেয়ে কাক। দেখুন। সাইজে ছোট।

কিছু খাবেন আপা?

না।

আজি দুপুরে কি জঙ্গলে খাবেন?

তাও জানি না। এখন আপনি সামনে থেকে যান। আপনাকে সবসময় আমার চোখের সামনে থাকতে হবে না।

লোকমান সরে গেল। লীলাবতী আবার তাকালো কাকটার দিকে। প্রথম কাকটার গোসল হয়ে গেছে, এখন দ্বিতীয় কাকটা গোসল করছে। এটাও মনে হয় বিস্মিত হবার মতো ঘটনা। গর্তটা দুটা কাকের একসঙ্গে গোসল করার মতো বড় ছিল। তারা তা করল না কেন? তাদের মধ্যেও কি সৌজন্য বোধের কোনো ব্যাপার আছে?

লীলাবতী উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল স্নানরত কাকটার দিকে। তাকে দেখলে একসময় তারা দুজন ভয় পেয়ে উড়ে চলে যাবে। ভয়টা কখন পাবে এটা তার পরীক্ষা করার ইচ্ছা। সব পাখি মানুষকে সমান ভয় পায় না। কোনো পাখি হয়তো তার দশ গজের কাছাকাছি আসতে দেবে। আবার কেউ দেবে পাচি গজ পর্যন্ত। পাখিদের ভয়ের একটা স্কেল তৈরি করা যেতে পারে।

কাক ১০ গজ

শালিক ১৫ গজ

বক ২০ গজ

লীলাবতী কাক দুটার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এরা নড়ছে না। দুজনই বিরক্ত হয়ে তাকে দেখছে কিন্তু ভয় পাচ্ছে না। জংলা ভিটার পাখিরা তাকে ভয় পায় না। সেখানে লীলাবতীর জন্যে চেয়ার-টেবিল রাখা হয়েছে। চিঠি লেখার ব্যবস্থা। মাসে একটি চিঠি সে তার বাবাকে লিখতে পারে। চিঠি সে জঙ্গলের ভেতর সাজিয়ে রাখা চেয়ার-টেবিলে বসে লেখে। পাশেই বড় পাটিপাতা বড় চৌকি। শুয়ে বিশ্রাম করার জন্য রাখা। সে যখন চিঠি লেখে তখন চৌকিতে ধান ছিটিয়ে দেয়। দুনিয়ার পাখি নেমে আসে। লীলাবতীকে জঙ্গলের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় লিখতে হয়। লিখতে হয় বলা ঠিক হয় নি। সিদ্দিকুর রহমান কখনো মেয়েকে এই বিষয়ে কিছু লিখতে বলেন নি। লীলাবতী নিজ থেকেই লেখে। যে মানুষটা হাজতের অতি ক্ষুদ্র একটা ঘরে আটকা পড়ে গেছেন, তার কাছে একটা খোলা জানালা নিয়ে যাওয়া।

বাবা, মাছরাঙ্গা পাখি যে ফুল খায়— এই তথ্য কি আপনি জানেন? মাছরাঙ্গা পাখি মাছ খায়–এটাই আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমি নিজে ফুল খেতে দেখেছি। জঙ্গলের মাঝামাঝি ডোবার মতো যে জায়গা আছে, সেখানে ছোট ছোট লতানো গাছে ফুল ফুটেছে। ফুলের রঙ নীল। মাছরাঙ্গা পাখিকে দেখলাম শাঁ করে আকাশ থেকে নেমে ঠোঁটে ফুল নিয়ে উড়ে চলে গেল। আমি যে শুধু একবার ঘটনাটা দেখেছি তা না। অনেকবার দেখেছি। কচুরিপানার ফুল ছিড়ে নিতেও দেখেছি।

ফুলের বিষয়ে আরেকটা মজার কথা বলি। বনের একেবারে শেষ মাথায় যেখানে কয়েকটা তালগাছ আছে সেই জায়গায় ঝোপমতো জায়গায় কিছু সাদা ফুল ফুটেছে। ফুলগুলি লম্বাটে ধরনের। ফুলের গোড়ায় এবং গাছে প্রচুর কাঁটা। আমি ফুল ছিঁড়ে হাতে নিলাম। গন্ধ শুকলাম। মিষ্টি গন্ধ। অনেকটা খেজ্বর গুড়ের গন্ধের মতো। তারপরই সমস্যা শুরু হলো। যে সব জায়গায় ফুলটা লেগেছে। সে সব জায়গায় হঠাৎ চুলকানি এবং জুলুনি শুরু হলো। আমার হাত গেল ফুলে। গন্ধ শোকার সময় নাকেও ফুল লেগেছিল। নাকও ফুলে গেল। নিঃশ্বাস নিতে পারি না। এমন অবস্থা। ফুলটা আমি অনেককে দেখিয়েছি। কেউ নাম বলতে পারে না। আমি একটা বইয়ের ভেতর ফুলটা রেখে বই চাপা দিয়ে ফুল শুকিয়েছি। আপনাকে আবার যখন দেখতে আসব, ফুলটা সঙ্গে করে নিয়ে আসব। এই ফুলের নিশ্চয়ই কোনো নাম আছে, আমি নাম দিয়েছি বিষফুল ॥.’ লীলাবতীর চিঠি। দীর্ঘ হয়। সেইসব দীর্ঘ চিঠিতে অনেক কিছু লেখা থাকলেও তার নিজের কথা কিছুই থাকে না। সে লেখে না যে, আমি একটি বিশাল বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকি। আমাকে পাহারা দেবার জন্যে লাঠি হাতে লোকমান ভাই শুধু একা উঠানে বসে থাকেন।

এই বাড়িতে কেউ আসে না। সবাই ভয় পায়। বাড়িতে নাকি জিন-ভূতপ্ৰেত ঘুরে বেড়ায়। যে দু’তিনজন গ্রামের মহিলাকে লোকমান নিয়ে এসেছিল তারা সবাই চলে গেছে। তারা নাকি নিজের চোখে অনেক কিছু দেখেছে। নিশিরাতে সাদা কাপড় পরা লম্বা লম্বা মানুষরা নাকি উঠানে হাঁটাহাঁটি করে।

নিশিরাতের শূন্য বাড়ির বিশাল খাটের মাঝখানে বসে মাঝে মাঝেই লীলার মনে হয়, ঝোকের মাথায় হঠাৎ একদিন বাবাকে কিছুক্ষণের জন্যে দেখতে আসাটা কি ভুল ছিল? নাকি এটা ছিল পূর্ব নির্ধারিত? সে আসবে এবং মাকড়সার জালে পোকা আটকে পড়ার মতো আটকে যাবে।

লীলার যখন সাত বছর বয়স সে থাকত তার মামার বাড়িতে, তখন তাদের অনেকগুলি রাজহাঁস ছিল। এদের মধ্যে একটা কী কারণে যেন অন্ধ হয়ে গেল। হাঁটতে পারত না। মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেত। শুধু যখন কেউ তাকে ধরে পুকুরের পানিতে ছেড়ে দিত, সে স্বস্তি পেত। একা একা নিজের মনে সাঁতার কাটত। এখন লীলার মনে হয়, সে নিজেই অন্ধ রাজহাঁস। অন্ধ রাজহাঁসটা একা একা দিঘির শান্ত জলে ঘুরত, সে হয়তো অপেক্ষা করত কিছু একটা ঘটবে, বদলে যাবে তার পৃথিবী। লীলাও অপেক্ষা করে। আমরা সবাই অপেক্ষা করি। প্রকৃতি তার মানব সন্তান তৈরিই করেছে অপেক্ষা করার জন্যে।

1 Comment
Collapse Comments
হামিদুল November 20, 2021 at 3:52 pm

Good one

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *