২১. আবার একদিন পীর বাড়ি

আবার একদিন পীর বাড়ি

পীরবাড়ি যাওয়া হয় আমার একদিন। এবার মার সঙ্গে নয়। তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে। হোস্টেলে মেয়েরা একটি মিলাদের আয়োজন করার ইচ্ছে করেছে। যদিও উদ্ভট শখ এটি, ডাক্তারি পড়া মেয়েদের আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা গাওয়ার সময়ও নেই বেশি, আর এটি গাওয়ার কারণ খুঁজেও তারা পাবে না কিছুই, তবু। উদ্ভট হলেও যেহেতু শখটি হয়েছে একজন মৌলবির দরকার তাদের। মৌলবি খুঁজছে মেয়েরা, এদিক ওদিক খুঁজে ব্যথর্ হয়ে শেষে আমাকে ধরলো, যেহেতু শহরের মেয়ে আমি, চেনা জানা থাকতে পারে কেউ। আমি কথা দিই মৌলবি যোগাড় করে দেব, আবেগে আবেগে আবার এও বলে ফেলি, দেব তো দেব মেয়ে-মৌলবি দেব একখানা। মেয়েদের হোস্টেলে মেয়ে-মৌলবি এসে মিলাদ পড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর কি হতে পারে। তবে আমি যেহেতু আল্লাহ রসুলে মিলাদে মসজিদে বিশ্বাসী নই, আমি মিলাদের মিষ্টি খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করব না। ওই আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা সাইয়েদেনায় শরিক হওয়ার কোনও রুচি নেই আমার। ঠিক আছে, তাই সই। আমার সঙ্গে রওনা হয় সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল। চারজন দুটি রিক্সা নিয়ে নওমহলের পীরবাড়ি পৌঁছই। বহু বছর পর পীরবাড়ি আসা আমার। ছোটবেলায় যেমন গা ছমছম করত এ বাড়ি ঢুকতে, এই বড়বেলাতেও সেই গা ছমছমটি যায়নি। যেন এ পৃথিবী নয়, পৃথিবীর বাইরে কোনও এক জগতে ঢুকছি। এই জগতের সবাই আমাদের দিকে বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিগুলো অতিক্রম করে অন্দরমহলে ঢুকি, খুঁজি ফজলিখালাকে। ফজলিখালা আমাকে দেখে, লক্ষ করি, খুব অবাক হননি, যেন কোনও একদিন এবাড়িতে আমার আসারই কথা ছিল। ফজলিখালাকে, যেহেতু তিনি আমার খালা, যেহেতু এ বাড়ির সবাই সবকিছু বেজায় অদ্ভুতুড়ে হলেও তিনি পুরোটা নন, বলি যে আমাদের একটি মেয়ে-মৌলবি দরকার, আজ বিকেলেই। মেয়েদের হোস্টেলে মিলাদ পড়িয়ে আসবে। এই আহবানে ফজলিখালার মুখে হাসি ফোটার কথা, কারণ গোটা শহরে এই একটি জায়গাতেই, এই পীরবাড়িতে, মেয়ে-মৌলবি পয়দা করা হয়, আর এই মেয়ে-মৌলবির চাহিদা আছে বাজারে, কেউ কেউ এসে মেয়ে-মৌলবি পাওয়ার জন্য তদবির করে অথবা করতে পারে। ফজলিখালার অ-বিস্মিত অ-খুশী মখু টির সামনে দাঁড়িয়ে তাড়া দিই, এক্ষুনি কোনও একটি মেয়েকে যেন আমাদের হাতে দেওয়া হয়, আমাদের সময় নেই বেশি। যে কোনও একটি মেয়ে, হুমায়রা বা সুফায়রা বা যে কেউ। আমার এই প্রস্তাব শুনেও অবাক হন না ফজলিখালা, কিন্তু হাসেন। সম্ভবত তাঁর দুটো কন্যার নাম উল্লেখের কারণে এই হাসিটি। ফজলিখালার মখু টি আগের মতই সুন্দর। হাসিটি সেই আগের মতই নির্মল। সেই হাসিটি যখনও মিলিয়ে যায়নি, হুমায়রা এসে উপস্থিত। আঁটসাঁট জামাটি থেকে হুমায়রার পেটের থাক থাক চবির্ প্রায় ফেটে বেরোতে চাইছে।বড় ওড়নায় ঢেকে রেখেছে মাথা। হুমায়রার ওড়না ঢাকা মাথাটি সামনে পেছনে নড়ে যখন আমরা বলি একজন মেয়ে-মৌলবি দরকার আমাদের। এই হুমায়রা, যে নিজের প্রেমিক প্রবর ফুপাতো ভাইকে মেদেনিপুর থেকে আনিয়ে হলেও নিজের বিয়ে ঘটিয়েছে, যখন পীরবাড়ির সব যুবতি মেয়েরা আল্লাহর পথে নিজেদের উৎসর্গ করে নিজেদের বিয়ে থা সংসার সন্তান ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়েছিল যেহেতু পীর নিজে ঘোষণা করেছিলেন এই শেষ জমানায় বিয়ে করার কোনও মানে হয়না। কিন্তু এই হুমায়রা, পীরের নাতনি হয়ে, পীরের ঘোষণার অবাধ্য হয়েছে প্রথম, অবাধ্য হয়েছে ঠিক বিয়ের বয়সে এসে। ওদিকে ঘোষণা পালন করতে গিয়ে হুমায়রার চেয়ে বয়সে বড় যুবতীকুল আইবুড়ি রয়ে গেছে। এই হুমায়রা, যার বিয়ের কারণে পীরের কাছে আসা শেষ জমানায় বিয়ে না করার জন্য আল্লাহর নির্দেশটি এক রাতেই পাল্টো যায়, পাল্টো গিয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ বলেছেন শেষ জমানায় সঙ্গী বেছে নাও খুব তাড়াতাড়ি, বান্দারা শেষ জমানায় বিয়ে করলে আল্লাহতায়ালা বড় খুশী হবেন। আল্লাহতায়ালা বড় ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টান। এই পীরবাড়ির সদস্যদের সুবিধে অসুবিধে অনুযায়ী সিদ্ধানগ্তুলো নেন তিনি। হুমায়রা আমাদের আকাঙক্ষাটি শুনে ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি, যা চাইছ তা পাবে বলে আমাদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে অন্দরমহলের অন্দরে চলে গেল। ফজলিখালাও অদৃশ্য। সম্ভবত হুমায়রা নিজে বোরখা পরে আসছে আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু ওভাবে প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর নিজে তো সে বোরখা পরে এলই না আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে যেতে, বরং আমাদের নিয়ে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর ঘরে ঢুকল। পীর আমিরুল্লাহ শাদা আলখাল্লায় শাদা টুপিতে বসেছিলেন বিছানায়। তাঁর মেহেদি লাগানো দাড়ি নড়ছিল যখন তিনি আমাদের দেখে মাথা নাড়ছিলেন আসুন আসুন ভঙ্গিতে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে রইল পাশে। পীর ছাড়াও পীরের কন্যা জোহরা ছিল ঘরে, আর কিছু আইবুড়ি। আমাদের এ ঘরে ঢোকানোর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অনুমান করি, মেয়ে-মৌলবি পেতে হলে কেবল ফজলিখালা আর হুমায়রার অনুমতি যথেষ্ট নয়, আমাকে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর কাছে আবেদন পেশ করতে হবে আমাকে, তাঁর অনুমতি মিললেই আমাদের কাজ হাসিল হবে। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর পীর আমিরুল্লাহ কিছু জানতে চাইলেন না আমরা কেন এসেছি, কি কারণ। আদৌ তিনি আমাদের এ বাড়িতে আগমনের উদ্দেশ্য জানেন কি না আমার সন্দেহ হয়। সম্পণূর্ অপ্রাসঙ্গিকভাবে, আর কাউকে না হলেও, আমাদের, আমাকে সাফিনাজকে, হালিদা আর পারুলকে হতবাক করে বলেন, তারপর বুঝলেন কি না আল্লাহর পথে আসা খুব সহজ কথা নয়, দুনিয়াদারির মোহ ত্যাগ যারা করতে পেরেছে, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা আখেরাতে সর্বোচ্চ সম্মানের আয়োজন করেছেন। ঘরের অন্যান্যদের মখু থেকে আহ আহ শব্দ ওঠে। সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য তৃষ্ণা সেই আহ শব্দে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া, দুনিয়াদারির সাময়িক সংসার, মায়ার জাল ছিঁড়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদের জন্য কি ধরণের সম্মান অপেক্ষা করছে পরকালে তার পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণনা করেন এবং দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকলে আল্লাহতায়ালা কি ধরনের শাস্তি লিখে রেখেছেন তারও ভয়াবহ বিবরণ দিতে তিনি ভোলেন না। বর্ণনা দীর্ঘ। বিবরণ অতিদীর্ঘ।সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল বার বার আমার দিকে কুঞ্চিত চোখে তাকাচ্ছে, বুঝে পাচ্ছে না কি ঘটছে এখানে, ফিসফিস করছে, চল চল। দেরি হয়ে গেল। আমিও ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কেন আমাদের এখানে দাঁড় করিয়ে আল্লাহতায়ালার শাস্তি এবং পুরস্কারের আদ্যোপান্ত জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। হুমায়রাকে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করি যে আমাদের সময় নেই সময় খরচ করার। মেয়ে-মৌলবির জন্য এসেছি আমরা, এসব শুনতে নয়। আমার ইশারার দিকে ফিরে তাকায় না হুমায়রা। বড় বিব্রত বোধ করি বান্ধবীদের সামনে। মেয়ে-মৌলবি যোগাড় করে দেবার লোভ দেখিয়ে এদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আটকে পড়েছি। পীর আমিরুল্লাহ আমাদের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকান, বাকি সময় তিনি মেঝে নয়ত সিলিংএর দিকে, উঠোনের গাছগাছালি নয়ত আইবুড়িদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন আল্লাহতায়ালার গুণাগুণ। যেন কোনও মানুষের মখু থেকে নয়, রবোটের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সব। কোরান হাদিসের প্রতিটি শব্দ আমিরুল্লাহ মুখস্থ ঠোঁটস্থ অন্তঃস্থ করে ফেলেছেন, পরীক্ষা সামনে এলে পরীক্ষার্থীরা যেমন মখু স্থ করে সিলেবাসের বইগুলো। শব্দগুলো আমিরুল্লাহর মখু থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকির মত, গায়ে এসে লাগছে ফুলকি। হঠাৎ মনে হয়, লোকটি আমিরুল্লাহ নন, লোকটি স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। এই ঘরটি ঘর নয়, এটি হাশরের মাঠ, এখানে চারজন পাপীর বিচার করছেন আল্লাহতায়ালা। বিরতিহীন বয়ানে পীর আমিরুল্লাহর মুখে ফেনা উঠে এলে হুমায়রা একটি ক্যাসেট চালিয়ে দেয়। ক্যাসেটে আমিরুল্লাহর কণ্ঠে কোরান হাদিসের কথা। ঠিক একই কথা যা তিনি বর্ণনা করেছেন মুখে। একই কথা একই ভাষায় একই সুরে। আমি এরমধ্যে অনেকবার ঘড়ির দিকে তাকিয়েছি। অনেকবার বলেছি আমি যাই। হুমায়রা চাপা কণ্ঠে ধমক দিয়েছে, আল্লাহর কথা শুনলে এত ধৈর্যহারা হও কেন? অসীম ধৈর্য নিয়ে শুনতে হয় আল্লাহতায়ালার কথা। আল্লাহর পথে এসেছো। এখন মন থেকে শয়তান ঝেড়ে ফেলতে হবে। শয়তানই আল্লাহ থেকে মন ফেরায় অন্যদিকে। এ কথায় স্পষ্ট হয় সে কি অনুমান করছে। সারা বাড়ির চোখ আমাদের দিকে, চোখগুলো জানে যে আমরা দুনিয়াদারি ফেলে আল্লাহর পথে চলে এসেছি, না এলেও এ বাড়িতে ঢুকেছি বলে আল্লাহর পথে নেওয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক ধোয়া হচ্ছে পণু ্যজলে। ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক ঘন্টা পেরেলো, দু ঘন্টাও। দেখছি সাফিনাজ আর হালিদার মুখে বিস্ময়, বিরক্তি আর বিষম বিষাদ। আমার গা ছমছম করে, ভূুতের ভয়ে এককালে যেমন করত। মনে হতে থাকে এ বাড়ির কোনও মানুষই সত্যিকার মানুষ নয়। এই ভূতুড়ে বাড়িটি থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকি। কিন্তু যতক্ষণ আমিরুল্লাহর কোরান হাদিসের ব্যাখ্যা শেষ না হচ্ছে ক্যাসেটে, আমাকে উঠতে দেবে না হুমায়রা। অদৃশ্য শেকলে আমরা বাধাঁ। এভাবে দিন ফুরিয়ে যাবে, রাতও, টের পাই। এক ক্যাসেট ফুরিয়ে গেলে আরেক ক্যাসেট চালানো হচ্ছে। আল্লাহতায়ালার এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে কানাগলি থেকে বেরোবার সবকটি রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষিধেয় আমাদের পেট জ্বলছে। বিকেল পার হয়ে যাচ্ছে, হোস্টেলে মিলাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আছে অনেকক্ষণ। শ্বাস দ্রুত হচ্ছে। এবার যান্ত্রিক বয়ানের মাঝখানে হঠাৎ উঠে দরজার দিকে পা বাড়াই, ভূতের রাজ্য থেকে যত শিগগির সম্ভব পালানোই যে মঙ্গল তা আমি যেমন জানি, আমার গতিময় পাদুটেও জানে। উঠোনের অনেকগুলো চোখ আমাকে হাঁ করে দেখতে দেখতে ফিসফিস করছে, হামিমা আপার মেয়ে আল্লাহর পথে এসেছে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া আর করতে চায় না, এখন থেকে নিয়মিত কোরান হাদিস শুনতে এখানে আসবে। শুনছি বিচিত্র উচ্চারণে বাক্যগুলো, কত সুমতি হয়েছে মেয়েদের। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, দুনিয়াদারি ছেড়ে দিয়ে যারাই আসে, কাউকে হুজুর ফিরিয়ে দেন না। হুমায়রার আদেশ উপদেশ উপেক্ষা করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরোই। পেছনে হুমায়রার চিৎকার, আল্লাহর পথে আসছে, অথচ ঘাড়ের ওপর শয়তান বসে আছে। সব ফাঁকিবাজি। উঠোনে ফজলিখালা সামনে পড়েন, তিনি তাজ্জব, চলে যাস কেন?

আমি তো মিলাদ পড়াইতে পারে এমন একজন মেয়েরে নিতে আইছিলাম, তা পাওয়া যাবে নাকি যাবে না তা বইলা দিলেই ত হয়!

কোনও উত্তর নেই। যেন মেয়ে-মৌলবি দিয়ে মিলাদ পড়াতে চাইছি কলেজের হোস্টেলে, এই বাক্যটি ফজলিখালা প্রথম শুনলেন, আগে শোনেননি, শুনলেও মাথায় ঢোকেনি, অথবা ঢুকলেও এ বাড়িতে আমাদের আসার সত্যিকার উদ্দেশ্য মেয়ে- মৌলবির,তা মনে করেননি। অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাপঁ ছাড়ি। বাঘের খাঁচায় ঢুকে বাঘের দধু আশা করার বোকামো হাড়ে হাড়ে টের পাই।

জঙ্গল সাফ করে যে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে আল্লাহর পথে আসা লোকদের, সেগুলোর একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন রুনু খালা। ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রুনখুালাকে দেখে প্রথম চিনতে পারিনি। তিনি এখন শাড়ি ছেড়ে এ বাড়ির মেয়েদের মত জামা পাজামা পরেন। বড় একটি ওড়না মাথা বুক ঢেকে রাখে রুনখুালার। পায়ে নপূুর পরে গান গেয়ে নেচে বেড়ানো,বিএ পাশ করা,প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা সেই রুনখুালা ই যে পীরবাড়ির ভেতরে এক শরীর শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রুনখুালা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এই রুনখুালাকে মনে হয় সারাজীবন কাটিয়েছেন অন্ধকার আল্লাহর গলিতেই, তাঁর কোনও অতীত ছিল না ঝলমলে। রাসু খালু ময়মনসিংহ পৌরসভায় হিশাব রক্ষকের চাকরি করতেন, চোখা প্যান্ট চোখা পাম্পশুর সেই রাসূ খালুর বিরুদ্ধে টাকা পয়সার গরমিল করা, প্রচুর টাকা হাওয়া করে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় আপিস থেকে, রাসু খালুর চাকরি চলে যায়। চাকরি যাওয়ার পর তিনি স্ত্রী কন্যা নিয়ে আল্লাহর পথে চলে এসেছেন। এখন চাকরি খোঁজেন, পান না। এখন বেগুনবাড়ি থেকে নিজের ভাগের জমি থেকে ধান চাল বিক্রির টাকা এনে শহরে আল্লাহর পথে বাস করেন। পাঁচ বেলা নামাজ পরেন। কপালে বড় একটি কালো দাগ, নামাজ পড়তে পড়তে মেঝেয় কপাল ঠুকতে ঠুকতে কালো এই দাগটি পড়েছে কপালে। মলি নামের যে মেয়ে আছে রুনখুালার, তার মলি নাম পাল্টো মতিয়া রাখা হয়েছে এই পীর বাড়িতে। নাম পাল্টানোর নিয়মটি বড় পুরোনো নিয়ম এ বাড়ির। মার ঈদুল ওয়ারা নাম ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে হামিমা রহমান করা হয়েছে, মা হামিমা নামেই পরিচিত এই পীরবাড়িতে। রুনু খালার ফ্রক পরা ছোট্ট সুন্দর মেয়েটি এখন শরীরের আগাগোড়া আবৃত করে। ইশকুলে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা মলিকে এখন পীরবাড়ির মাদ্রাসায় কোরান পড়তে দেওয়া হয়েছে। রুনখুালার একটি ছেলেও ছিল, ছেলেটির পেট ফুলে ঢোল হয়ে একদিন মারা গেল। কোনও পীরের ফুঁ কাজে লাগেনি, দুনিয়াদারির কোনও ডাক্তারের ওষধু ও নয়। রুনখুালা তাঁর ছোট্ট টিনের ঘরটিতে আমাকে যখন টেনে নিয়ে বলেন কিছু খাইবা? একটু সেমাই খাও! কইরা দিই। না বলি। বড় মায়া হয় রুনখুালার জন্য। পেছনে ফজলিখালার শ্বশুরবাড়িটির দিকে তাকাই। বাড়ির সামনের পুকুরটি বুজে ফেলা হয়েছে। লিচু গাছটিও আর নেই। জঙ্গল নেই, ভূত পেত্নীর ভয় নেই, কিন্তু তারপরও মনে হয় আগের চেয়ে আরও ভূতুড়ে হয়েছে বাড়িটি। হুমায়রা পীরের ডান হাত এখন। সুফায়রা পীরের এক মুরিদকে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। মুবা−শ্বরা তো নেই ই। মুবা−শ্বরার ছোট বোন আতিয়া বসন্ত হয়ে একদিন টপু করে মরে গেছে। আতিয়া দেখতে খুব সুন্দর ছিল। দুদিনের জন্য মা পাঁচ বছরের আতিয়াকে অবকাশে এনেছিলেন। ওই দুদিনে ওকে টুইস্ট নেচে মাই নেইম ইজ এটিয়া গিলবার্ট বলতে শিখিয়েছিলেন দাদা। আতিয়ার মস্তিষ্ক থেকে শয়তানি বিদেয় করা হয়েছে এ বাড়িতে ফেরত এনে। আতিয়ার ছোট আরও অনেকগুলো বোন আছে, আমি ওদের নাম কেবল শুনেছি মার কাছে, মখু চিনি না। এত কাছের আত্মীয় হওয়ার পরও আমাদের কোনও যোগাযোগ হয় না একটি কারণেই, আমরা দুনিয়াদারির লোক, আর তারা আল্লাহর পথের লোক। আমার মায়া হয় এ বাড়ির সবার জন্য। আল্লাহর পথে বড় বিভ্রম, বড় ফাঁকি। ফাঁকি দিয়ে আমাদের সবাইকে সারা দুপুর বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফাঁকি দিয়ে আল্লাহ রসুলের বাণী শোনানো হয়েছে। আমাদের কথা দেওয়া হয়েছে মেয়ে-মৌলবি দেওয়া হবে, সেই কথা রাখা হয়নি। আল্লাহর এই পথটি বড় মিথ্যেয় ভরা। মেয়ে-মৌলবি তো আমাদের পাওয়া হয়নিই, বরং অযথা সময় নষ্ট হয়েছে। প্রথমেই যদি বলে দেওয়া হত মেয়ে-মৌলবি পাওয়া যাবে না, আমরা ফিরে যেতে পারতাম কিন্তু আমাদের আশা দিয়ে বসিয়ে মাথায় মস্তিষ্ক ধোয়ার জল ঢালা হয়েছে। আর কার জানিনা, আমার মস্তি−স্কর ব্যাপারে আমি অন্তত এইটুকু জানি,এটি এখন আর কোনও জলে নষ্ট হবে না। সাফিনাজ হালিদা আর পারুল বুঝে পায় না এই অদ্ভুত জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্কে কি। ওদের সামনে লজ্জা হয় আমার। এই শহরের এই অদ্ভুত পীরবাড়িটির এই অদ্ভুত জগত সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না ওদের।

ঘটনাটি মার কাছে বলি। মা বলেন, মিলাদ পড়াইতে পারে এমন মহিলা খুঁজনের জন্য ওই বাড়িতে গেলি কেন? ওরা তো কেউ ওই এরিয়ার বাইরে যায় না। বাইরে গিয়া মিলাদ পড়ায় না কোনওদিন। যা করে, সব এরিয়ার ভিতরে করে। তা ঠিক, ওদের সঙ্গে ওই পীরবাড়ির এলাকার বাইরের কোনও মসজিদ মাদ্রাসার সঙ্গেও সম্পর্কে নেই। ওদের সঙ্গে ওই পীরবাড়ির বাইরের কোনও আল্লাহরসুল মানা কোনও মানুষেরও সম্পর্কে নেই। নানা নিজে একজন হাজি মানুষ, সুদূর মক্কা গিয়ে হজ্ব করে এসেছেন, হযরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে এসেছেন, মদিনায় হজুরের রওজা শরিফ জিয়ারত করে এসেছেন, জীবনে কোনও রোজা তিনি বাদ দেননি, কোনও নামাজ কাজা করেননি, প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে কোরান পড়েন—সেই নানাও পীরবাড়িতে কোনও সম্মান পান না। কারণ পীর আমিরুল্লাহর মুরিদ না হলে কাউকেই গ্রাহ্য করা হয় না ও বাড়িতে, কাউকেই পীরবাড়ির কেউ মনে করে না যে সত্যিকার ঈমানদার। নানা কোনওদিন ওই পীরবাড়িকে পরোয়া করেননি। নিজের ধর্ম নিজে পালন করে গেছেন। পীরবাড়িতে মার যাওয়া নিয়েও তিনি বলেছেন, আল্লাহরে নিজের ঘরে বইয়া ডাকো,আল্লাহ শুনবেন। দৌড়াদৌড়ি করার দরকার নাই।

 

মেয়ে-মৌলবি আনতে যাওয়া চারজন ডাক্তার হতে যাওয়া মেয়েকে আল্লাহর পথে যাওয়ার দীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যথর্ হওয়ার কোনও খবর রাষ্ট্র হয় না, তবে ওই এরিয়ায় অন্তত এমন বলার সুযোগ হয়েছে যে আজকাল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সবার চোখ খুলছে, দুনিয়াদারিতে মেতে থেকে যে আখেরাতে কোন ফল পাওয়া যাবে না, তা তারা বুঝে গেছে বলে আল্লাহর পথে আসার চেষ্টা করছে। ওসব ছেদো কথা আমি কানে দিই না। তবে পীরবাড়ির যে কথাটি শুনে আঁতকে উঠি তা হল পীর আমিরুল্লাহ একটি বিয়ে করেছেন। নিজের চেয়ে চল্লিশ বছর বয়সের ছোট এক মেয়েকে। আইবুড়িদের মধ্য থেকে একজনকে।

কি মা, তার না বউ আছে। আরেকটা বিয়া করল কেন? ঠোঁটে বাঁকা হাসি আমার।

মা ইতস্তত করেন উত্তর দিতে, থেমে থেমে বলেন,—মাওই সাবের বয়স হইয়া গেছে। এখন আর তালই সাবের যত্ন করতে পারেন না তাই।

তার যত্ন করার লাইগা বাড়ি ভর্তি মানুষ। বিয়া কইরা নিতে হয় নাকি যত্ন করতে হইলে?

তালই সাবরে এখন ধইরা ধইরা পেশাবপায়খানায় নিতে হয়। রাইতেও যাইতে হয় ঘরের বাইরে। এই সব পরিষ্কারের জন্য একজন তো লাগে!

কেন, কাজের লোকের ত অভাব নাই ওই বাড়িতে, তারাই তো করতে পারে। আর তার নাতি নাতনিতে বাড়ি ভরা। তারা করতে পারে।

তাদের কাজ আছে না?

কী কও এইসব!পীরের কাজই ত তাদের আসল কাজ। পীরের কাজ করলেই ত আল্লাহর কাজ করা হয়।

রাতের বেলায় ত ঘুমায় ওরা!

সারা রাত কি তোমার হুজুর পেশাবপায়খানা করে নাকি?

বাজে কথা কইস না।

এক ঘরেই তো থাকে তারা দুইজন। এক বিছানায় তো শোয়, তাই না? খালি গু মুত ফালায় নতুন বউ তাতো না।

মা অপ্রস্তুত। আমার বিশ্বাস মা নিজেও হয়ত পীরের শেষ বয়সে এই বিয়ে করার ব্যাপারটির কোনও কারণ খুঁজে পাননি। কারণ না পেলেও পীরের পক্ষ নেওয়া মার একরকম দায়িত্ব।

এত চুক্ষা চুক্ষা কথা কইস না আল্লাহর ওলি সম্পকের্। গুনাহ হইব। মা বলেন।

গুনাহ গুনাহ গুনাহ। এই গুনাহ শব্দটি আমি বহুকাল শুনে আসছি। গুনাহ শব্দটিকে একসময় খুব ভয় হত, শব্দটির ওপর পরে রাগ হয়েছে, এখন ভয় রাগ কিছুই হয় না।

গুনাহ হোক। গুনাহ হইলে তো ভালই। গুনাহ হইলে দোযখে যাব। দোযখে গেলে তো তোমার প্রিয় দিলীপ কুমার মধুবালা, তোমার উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনরে দেখতে পাবো। তোমার ছবি বিশ্বাস পাহাড়ি সান্যালকে দেখতে পাবো। আর তুমি যে বেহেসতে যাইবা, দেখবা তো সব কাঠমোল্লাদেরে। চাইরটা বিয়া করা শয়তান বদমাশ মোল্লাদেরে দেখবা। মানুষরে কষ্ট দিছে, হিংসামি করছে, কুটনামি করছে, মানুষরে খুন করছে। একশ একটা ধষর্ণ করছে, বউদেরে জ্বালাইছে, পিটাইছে, কিন্তু সারাদিন আল্লাহ আল্লাহ জপছে বইলা বেহেসত পাইছে। কি সুখটা পাইবা তুমি শয়তানগুলার সাথে থাকতে! তারচে গুনাহ কইরা দোযখের খাতায় নাম লেখাও। আইনস্টাইনের মত পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী পাইবা, নেলসন ম্যান্ডেলারে পাইবা, পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় গায়ক, নায়ক সবার সান্নিধ্য পাইবা। আর বেহেসতে গিয়া তো দেখবা বাবা বাহাত্তরটা হুরির সাথে লীলা করতাছে। আর তুমি পাইছ এক বাবারেই, যে তোমার দিকে সারাজীবন ফিইরা তাকায় নাই। এক রাজিয়া বেগমের সাথে বাবার সম্পর্কে তুমি সহ্য করতে পারো না, বেহেসতে ওই বাহাত্তরটার সাথে বাবার সম্পর্ক সহ্য করবা কেমনে? কোন সুখ পাওয়ার আশায় বেহেসতে যাইতে চাও? কিসের জন্য নামাজ রোজা কর?

মা অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর দুচোখে আতঙ্ক।

তুই কি আল্লাহরে একটু ডরাস না? ভয়াতর্ কণ্ঠে বলেন মা।

আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি,—আল্লাহ কি ভাল কাজটা করছে যে আল্লাহরে ডরাইয়াম? মেয়েদের স্থান পুরুষের স্থানের চেয়ে নিচে, এইটা আল্লাহর নিজের কথা। যেহেতু পুরুষ টাকা কামাই করে, তাই পুরুষের অধীনে থাকতে হবে মেয়েদের। আজকে যদি মেয়েরা টাকা কামাই করে, তাইলে মেয়েদের অধীনে পুরুষদের থাকার কথা তো আল্লাহ কয় নাই!

কি কইতাছস এইগুলা নাসরিন? তর ত ঈমান নষ্ট হইয়া গেছে!! মার বিস্ফারিত চোখ।

বিস্ফারিত চোখের সামনেই বিস্ফোরণ ঘটে আমার, ভেতর থেকে −শ্লষ কণ্ঠে,ঘণৃা কণ্ঠে আমি বলে যেতে থাকি–

আমি বুঝি না তুমি মেয়ে হইয়া কি কইরা মেয়েদের প্রতি এত অপমান মাইনা নেও। পুরুষেরা কোরান হাদিস মাইনা চলতে পারে, তাদেরে মর্যাদা দেওয়া হইছে। মেয়ে হইয়া কি করে মানো? মেয়ে হইয়া কি কইরা মানো যে তুমি পুরুষের চেয়ে নিম্নমানের। তোমার স্বামীর তোমারে পিটানোর অধিকার আছে। তোমার বাপের সম্পত্তি তোমার ভাই যা পাবে, তা তোমার পাওয়ার অধিকার নাই। কি কইরা মানো যে পুরুষেরা তালাক কইলে মেয়েদের তালাক হইয়া যাবে। আর তোমার তালাক কওয়ার অধিকার নাই। কি কইরা মানো যে তুমি বাহাত্তরটা সঙ্গী পাইবা না বেহেসতে, তোমার স্বামী পাইব শুধু যেহেতু সে পুরুষ! কোটের্ সাক্ষী দিতে যাও, তোমার একার সাক্ষীতে হবে না, দুইজন মেয়ে সাক্ষী লাগবে। অথচ পুরুষ সাক্ষী হইছে দুইজন পুরুষ লাগে না, একজন হইলেই চলে। ইহজগতেও পুরুষের জাত সুখে থাকবে, পরকালেও। তোমার জন্য, আমার জন্য, মেয়েদের জন্য এই জগতেও আল্লাহ ভোগান্তি রাখছে, ওই জগতেও। এই হইল তোমার আল্লাহর বিচার। এই আল্লাহরে নমো নমো করো কি বুইঝা?

মা আমাকে থামান ফুঁপিয়ে কেঁদে। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, যা কইছ কইছ আর কইও না। এখন যাও অযু কইরা আসো, আল্লাহর কাছে তওবা করো।

তওবা করবো কেন? আমি তো কোনও ভুল করি নাই।

 

মা নিশ্চিত আমি দোযখের আগুনে পুড়ে মরব। আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আর দেখেন না মা, দেখেন গনগনে আগুনে আমি জ্বলছি পুড়ছি। পুঁজ আর পচা রক্ত পান করছি। সাপ বিচ্ছু কামড়াচ্ছে আমার সারা শরীর। মাথার একহাত ওপরে সূর্য নেমে এসেছে। ফুটন্ত পানিতে আমাকে চোবানো হচ্ছে। এই হৃদয় বিদীর্ণ করা দৃশ্যটি কল্পনা করে মা আতঙ্কে কেবল ফুঁপিয়ে নয়, হাঁউমাউ করে আড়াই বছরের বাচ্চার মত কেঁদে ওঠেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *