২১। সেশেনুর অরণ্য
‘আর কত ঘুমোবে? এখনি ওঠো, এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখো।’
বাকারির কথায় ঘুম ভাঙ্গল অগস্ত্যদের। সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। গতকাল অনেক রাত্রে ঘুমানোর কারণে তাদের ঘুম ভাঙতেও দেরী হল। ইরতেনসেনু দেখল চুপড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে উপলরা কিছু একটা দেখছে। নদীর পূর্ব প্রান্তে দুটি মন্দির। মন্দির দুটি আশ্চর্য প্রকৃতির। দুটি মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে জমজ ভাইবোনের মতো। দুটিকেই অবিকল একই রকম দেখতে। তাদের আকার, আয়তন, মন্দির গাত্রের স্তম্ভের গায়ের অলঙ্করণ সব এক।
বাকারি বলল, ‘এটি কোম ওম্বের মন্দির। গতবছর ফারাওয়ের একটি কার্যে এই মন্দিরে এসেছিলাম আমি। ডান দিকের যে মন্দিরটি দেখছ তা হল দেবতা হারো-এরিসের। ইনি দেবতা হোরাসের আরেকটি রূপ। আর বামদিকের মন্দিরটি স্থানীয় দেবতা সোবেকের। এখানে দুই দেবতাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে পূজা করা হয়। তাই যাতে একজন না রুষ্ট হয়ে যান তাই দুটি মন্দিরই বাইরে এবং ভিতরে অবিকল এক রকমের।’
‘সোবেক?’ প্রশ্ন করল উপল।
‘সোবেক হলেন নীলনদের দেবতা। কথিত আছে তিনি দেবী হাথোর এবং খনসুর সঙ্গে মিলে এই পৃথিবী তৈরি করেন। সোবেকের আশীর্বাদে জমি উর্বর হয়। ওই দেখ।’
বাকারির আঙুলের নির্দেশ লক্ষ করে মাটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল অগস্ত্যরা। সোবেকের মন্দিরটি নীলনদের একেবারে পাশেই। নদী থেকে একটি প্রশস্ত ঢালু পথ মন্দিরের দিকে উঠে গেছে। সেখানে সারি দিয়ে শুয়ে আছে দৈত্যাকার কুমিরের দল! তাদের এক একটি দৈর্ঘ্যে প্রায় দু’মানুষ লম্বা। কিছুটা দূর থেকে মুণ্ডিত মস্তক দুই পুরোহিত কুমিরগুলির দিকে মাংসের টুকরো ছুঁড়ে দিচ্ছেন।
কুমিরগুলি শূন্যে কিছুটা লাফিয়ে পড়ে গিলে নিচ্ছে টুকরোগুলিকে। কোন কোন টুকরোকে অপরের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাদের লেজগুলি ডুবে আছে নদীর জলে, সেই লেজের ঝাপটায় জলে আলোড়ন উঠছে। বাকারি বলল, ‘এরাই হলেন দেবতা সোবেক। সোবেকের মুখটি কুমিরের, দেহ মানুষের। এই মন্দিরে দিনে তিনটি বেলায় কুমিরদের এইভাবে ছাগের নরম মাংস খাওয়ানো হয়।’
অগস্ত্য বলল, ‘ভারতবর্ষে যে গঙ্গা নদী আছে, সেই দেবী গঙ্গার বাহন হল মকর। মকরের মাথাটি কুমিরের এবং দেহটি শুশুকের। সোবেকের কথা বলাতে আমার মকর দেবের কথা মনে পড়ে গেল।’
মাটিতে সোবেকের মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুরোহিতের তখন হাথোরেতের দিকে নজর গিয়েছে। থীবসের নদী প্রান্ত থেকে আশ্চর্য জাদুকরী যানের উড়ানের কথা তাদের অজ্ঞাত। আকাশের বুকে এমন অদ্ভুত দর্শন বস্তুকে ভেসে যেতে দেখে তাই তারা যারপরনাই বিস্মিত হল। মাথার উপরে দু’হাত তুলে উচ্চকণ্ঠে কিছু একটা বলতে লাগল তারা। এত উপর থেকে তাদের কথাগুলির কিছুই শোনা গেল না, শুধু কিছু অস্পষ্ট স্বর ভেসে এল।
ইরতেনসেনু একটি থলি থেকে একটি গোটানো প্যাপিরাস বার করে আনল। প্যাপিরাসটি একটি পাথরের টুকরোর সঙ্গে সুতা দিয়া বাঁধা। ইরতেনসেনু প্যাপিরাসটিকে পুরোহিতদের লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল। বলল, ‘পুরোহিতরা মনে হয় দেবতা সোবেকের নাম নিয়ে আমাদের অভিসম্পাত করছেন। ওই প্যাপিরাসে ফারাওয়ের নির্দেশবাণী লেখা আছে। ওতে লেখা আছে আমরা দেব আজ্ঞায় নদীর উৎস স্থলে যাত্রা করছি। ফেরবার সময়ে তারা যেন আমাদের সাহায্য করেন।
উপল এখন আবার নিজের কার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। উপল জানে যে নুবিয়দের গ্রাম অবধি নীলনদের গতিপথ মোটমুটি সোজাই। তবে বায়ুর অভিমুখের সামান্য বদলের জন্য রাতে হাথোরেত নদী থেকে কিছুটা সরে গিয়েছিল। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই উপল উঠে পড়েছিল। ধীরে ধীরে সে আবার হাথোরেতকে নীলনদের কাছে নিয়ে এসেছে। এখন দিকযন্ত্রটিকে আবার চালনা করে সে বায়ুর গতিপথ পরীক্ষা করল একবার। তারপর বলল, ‘বাতাসের মুখ বদল হচ্ছে এবারে, হাথোরেতের অভিমুখ বদলাতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবে নদীর প্রথম জলপ্রপাতকে। তারপরই শুরু হয়ে যাবে নুবিয়দের রাজত্ব।’
এই বলে উপল উড়ানবায়ু ভরা কাপড়ের উল্টানো অশ্রুবিন্দু সদৃশ অংশটির দিকে এগিয়ে গেল। যে রজ্জু দিয়ে এর মুখটি বাঁধা ছিল সেই রজ্জুটি এবারে সামান্য আলগা করল সে। সঙ্গে সঙ্গে শোঁ-শোঁ শব্দে তা থেকে বায়ু নির্গত হতে থাকল। কিছুটা বায়ু বার করে দেওয়ার পরই উপল আবার রজ্জুটিকে শক্ত করে বেঁধে দিল। বায়ু বেরিয়ে যাওয়ার দরুন হাথোরেত নীচের দিকে নেমে এল। এবারে আরও একবার দিগযন্ত্রে বায়ু অভিমুখ পরীক্ষা করল উপল।
এই পরীক্ষা করতে করতে উপল বলল, ‘ভারত মহাসাগরে বর্ষাকালে বাতাসের অভিমুখের পরিবর্তন হয়। তাই যে পথে সমুদ্রযাত্রা করা হয় সেই পথেই পুনরায় ফিরে আসা যায় না ভারতবর্ষে। নাবিকদের তাই বায়ুর দিক নির্ণয়ের বিদ্যা শিখতে হয়। এই অঞ্চলের বায়ুর গতিপ্রকৃতিও আমার আয়ত্তে এসেছে। এখানে বায়ু মূলত প্রবাহিত হয় উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে, তা না হলে নদীর উৎস সন্ধানে আমাদের যাত্রা করা সম্ভবই হতো না। তবে সর্বদা একেবারে সোজাসুজি বয় না এই বায়ু। উপরের দিকে যত উঠতে থাকবে ততই বাম দিকে প্রবাহের জোর বেশি হবে। আবার নিচের দিকে নামতে থাকলে ডান দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে এই বাতাস।’
দিকযন্ত্রের পরীক্ষার পর সন্তুষ্ট হয়ে যন্ত্রটিকে থামাল উপল। খানিকক্ষণ পর দেখা গেল হাথোরেত এগিয়ে চলেছে একটি শুভ্র বর্ণ ঘন মেঘের দিকে। মেঘটি যেন মাটির খুব কাছাকাছি জমাট বেঁধে আছে। এই দু’দিনে আকাশের মেঘের ভিতর দিয়ে এসেছে হাথোরেত, তখন মনে হয় যেন কুয়াশার আস্তরণের মধ্য দিয়ে চলেছে তারা। কিন্তু এখন হাথোরেত অনেকটাই নীচে নেমে এসেছে। এখানে মাটির এত কাছে কীভাবে মেঘের সৃষ্টি হয়? এরই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে গমগম শব্দের গর্জন। সেই গর্জন ক্রমে আরও বাড়তে লাগল।
হাথোরেত সেই মেঘের দিকে আরও এগিয়ে গেল। একসময় প্রবেশ করল তার মধ্যে। এবারে অগস্ত্যরা বুঝল এই মেঘের আসল পরিচয়। তাদের সবার গায়ে এসে লাগল সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জলবিন্দুর কণা। তারা এসে পড়েছে নীলনদের জলপ্রপাতের উপরে। জলপ্রপাতটি প্রস্থে প্রায় কুড়ি পুরুষের সমান, উচ্চতায় ত্রিশ পুরুষের কাছাকাছি। এত উপর থেকে বিপুল জলরাশি আছাড় খেয়ে পড়ছে নীচের পাথরের উপরে। তখন জল ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হচ্ছে। এই জলকণাগুলি বাতাসে ভাসমান হয়ে সৃষ্টি করেছে ঘন মেঘের, যার মধ্য দিয়ে এখন হাথোরেত ভেসে চলেছে।
মুখে চোখে ঠান্ডা জলের বিন্দু জমা হয়ে আরামবোধ হতে থাকল। হাথোরেতে যেটুকু জল আছে তা পান করার জন্য নির্দিষ্ট। চুপড়ির একটি কোণ শণের কাঠির আচ্ছাদন দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। সেখানে শৌচকর্ম সমাধা করা হয়, বর্জ্য ত্যাগ করা হয় নদীর জলে। এই কার্যেও ব্যবহৃত হয় সামান্য জল। তাই মুখ এবং শরীর প্রক্ষালনের জন্য কোন জলই নেই। ইরতেনসেনুরা জলপ্রপাত থেকে বিচ্ছুরিত এই শীতল জলকণাকেই মুখে, চুলে, হাতের অনাবৃত অংশে মেখে নিতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে জলপ্রপাতটিকে পার করে এগিয়ে চলল হাথোরেত। অগস্ত্য এই সময়ে মাথা নীচু করে দেখল নদী যেন ক্রমশ তাদের বাম দিকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু হাথোরেত তো আর নদীকে লক্ষ করে এগোচ্ছে না।
‘আমরা মনে হয় নদীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি উপল। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীপথকে হারাব।’
‘চিন্তা কোরো না অগস্ত্য। সেশেনুর জঙ্গল অবধি নদীর গতিপথ আমি হাতের তালুর মতো চিনি। এই দেখ।’
এই বলে উপল অগস্ত্যকে একটি প্যাপিরাসের টুকরো দেখাল। তাতে কালো কালিতে একটি নকশা আঁকা। বোঝা যায় তা নীলনদের।
‘নদী পথে থীবস থেকে সেশেনু অবধি যাত্রা করে আমি এই নকশাটিকে এঁকেছি। এই দেখো একদম উত্তরে থীবস, যেখান থেকে আমরা অভিযান শুরু করলাম। এখান থেকে নদী মোটামুটি সোজাই প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলের এই স্কুল বিন্দুটি প্রথম জলপ্রপাত, যা কিছুক্ষণ আগেই আমরা পেরিয়ে এলাম। এরপরই নদী বেঁকে গেছে বাম দিকে। তারপর প্রকৃতির কোন এক অজানা খেয়ালে পিছনের দিকে প্রবাহিত হয়েছে বেশ কিছুটা। এরপরে আবার দিক বদল করে বইতে শুরু করেছে ডানদিকে। তারপর একসময় ফিরে এসেছে তার আগের গতিপথে। আমরা এখন সোজাই চলব, চারদিনের মধ্যেই দেখবে আমরা আবার নদীর এই গতিপথে ফিরে এসেছি। ভরসা রাখো আমার উপরে, আমি জানি আমি কী কাজ করছি।
এক সময় বাম দিকে সরতে সরতে নীলনদ অদৃশ্য হয়ে গেল উঁচু-নীচু মালভূমির আড়ালে। হাথোরেত এবারে বয়ে চলল স্থলভূমির উপর দিয়ে। শুরু হল নুবিয়দের রাজত্ব। নুবিয়রা মিশর দেশে বাস করলেও তারা থীবস, মেমফিস বা গিজাবাসী মিশরীয়দের মতো একেবারেই নয়। তারা কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায় কিন্তু পেশীবহুল দেহের অধিকারী। নুবিয় নারীরা নিজেদের গলায় রংবেরং এর পাথরকুচির মালা পরে। নুবিয়রা মিশরীয় দেবতাতেও বিশ্বাসী নয়, তাদের নিজের দেবতা আছে, তাঁর নাম আনহুর।
তবে ছ’শো বছর আগে নুবিয়রা ফারাওয়ের বশ্যতা স্বীকার করে। এখন নির্দিষ্ট সময় পর পর তারা রাজস্ব পৌঁছে দেয় ফারাওয়ের কাছে। কখনও কখনও যদিও বা এদের কোন জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে বসে তখন সেই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। ইরতেনসেনুর মনে পড়ে গেল ফারাও মেন্তুহোতেপের কথা। তিনি এই নুবিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করেই উত্তর এবং দক্ষিণ মিশরকে এক করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করেছিল পুন্তের অধিবাসীরা এবং এক আশ্চর্য দৈত্য কামারু। নুবিয়দের অধিকৃত এই অঞ্চলের নাম হল আবিদোস।
আবিদোসের উপর দিয়ে তিনদিন ধরে বয়ে চলল হাথোরেত। এই তিন দিনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল অগস্ত্যদের। নুবিয়দের বসতি পাথরের নয়। তারা ঘর বানায় নদীর পলিমাটি দিয়ে। শুকনো কাঠের কাঠামো তৈরি করে তার উপরে দেয় পলিমাটির প্রলেপ, গৃহের মাথায় দেয় খড়ের ছাউনি। একশো বা দুশোটি গৃহ নিয়ে তৈরি হয় এক-একটি গ্রাম।
কখনও কোন নাম না জানা গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল ছুটতে শুরু করেছে হাথোরেতের পিছুপিছু। কখনও বা আবার শত্রু ভেবে তাদের দিকে উড়ে এসেছে তীক্ষ্ণ বর্শার সারি। যদিও তাদের কোনটিই হাথোরেতের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। ইরতেনসেনু প্রতিটি জনপদে ছুঁড়ে দিয়েছে রানির নির্দেশবাণী। নুবিয়দের ভাষা অন্য হলেও প্রতিটি গ্রামের মোড়লের ফারাওয়ের হরফ পড়তে পারার কথা। এই অভিযানের শেষে যদি ইরতেনসেনুরা সেশেনুর জঙ্গল থেকে ফিরে আসতে পারে তাহলে এই নুবিয়রা হবে তাদের সহায়ক।
তৃতীয় দিনের সকালের তৃতীয় প্রহরে তারা এসে পড়ল আনহুরের মন্দিরের কাছে। এই মন্দিরটি পাথর দ্বারা নির্মিত। তবে মন্দিরের নির্মাণ কৌশল মিশরীয়দের থেকে আলাদা। মন্দিরগুলির শীর্ষদেশ ত্রিকোণা, সূঁচালো। অনেকটা মেরের শীর্ষদেশের মতো। এই মন্দিরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় বাকারি বলল, ‘আনহুর দেবতাকে সাপের মতো দেখতে। এই আবিদোসের জঙ্গলে ময়াল সাপ পাওয়া যায়, তাদেরকে নুবিয়রা আনহুরের নামে পূজা করে।
‘আনহুর পাতাললোকের দেবতা। সূর্যদেব রা এর সঙ্গে নাকি তাঁর প্রবল যুদ্ধ চলে রাত্রিবেলায়। বিগত কয়েকশো বছর ধরে নুবিয়রা ফারাওয়ের বশ্যতা স্বীকার করলেও তাদের ধর্ম বিশ্বাসে কখনও আঘাত হানেননি কোন ফারাও। বছরে একবার নুবিয়রা আনহুরের বিগ্রহ নিয়ে আসে থীবস নগরীতে। তখন কার্নাক মন্দিরের প্রধান কক্ষে সেই বিগ্রহকে রেখে পূজা করা হয়। এই সময় আয়োজন করা হয় এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার। যা ওপেতের উৎসবের থেকে কোন অংশেই কম নয়।
এই সময় উপল বলল, ‘আনহুরের এই মন্দির নুবিয় রাজ্যের সীমান্তের কাছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখ আবার নীলনদের দেখা মিলবে।
সত্যিই তাই হল। আনহুরের মন্দির ছাড়িয়ে আরও একটু এগোবার পরই দেখা গেল নীলনদকে। সে যেন পথে হারিয়েছিল। এখন আবার ফিরে আসছে নিজের চেনা ঠিকানায়। নদী একটু একটু করে এগিয়ে আসতে আসতে একসময় আবার হাথোরেতের নিচ দিয়ে বইতে লাগল। এতক্ষণ তাদের নীচের জমি ছিল শস্য শ্যামলা সবুজ। কিছু ছোট ছোট অরণ্যের উপর দিয়েও উড়ে এসেছে তারা। কিন্তু অগস্ত্য লক্ষ করল আর কিছুটা দূর গেলেই এই দৃশ্যপট বদলে যাবে। কিছুটা দূরেই অপেক্ষা করছে আরও একটি জলপ্রপাত। তার পিছনে কে যেন গাঢ় সবুজ প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে।
সেই প্রাচীরের গাত্র প্রস্তর নির্মিত নয়, বিরাট বৃক্ষরাজি ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে রচনা করেছে এই প্রাকারকে। এই হল সেশেনুর অরণ্য। অগস্ত্য উপলের দিকে তাকাল। দেখল তার চোয়াল শক্ত, ঋজু শিরদাঁড়া নিয়ে যেন কোন যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে সে। অগস্ত্য তার ডান হাতটি রাখল উপলের কাঁধে। উপল চিন্তান্বিত গলায় বলল, ‘এত অবধি যাত্রাপথ আমার পরিচিত ছিল অগস্ত্য। কিন্তু সেশেনুর জঙ্গল শুরু হওয়ার পর কী হবে তা আমি জানি না। যে কোন রকমের বিপর্যয়ের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। এই অরণ্যের মধ্যে আমাদের একমাত্র চেনা সঙ্গী নীলনদ। কিছুতেই তাকে নজরের আড়াল করা চলবে না।’
সেশেনুর অরণ্য শুরু যখন হল তখন দিগন্তে সূর্য অস্তগামী। বিকালের নরম আলোয় বৃক্ষের পাতাগুলি গাঢ় সবুজ বর্ণের লাগছিল। তারা ক্রমে যেন আরও ঘন হয়ে এল। অযুত কোটি শাখাপ্রশাখার আড়ালে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকল নীলনদ। উপল এবার প্রমাদ গুনল। দিনের আলোয় তবুও নদীকে খুঁজে নেওয়া যাবে। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে কী করবে সে! অরণ্যের মধ্যে কখনও যদি নীলনদ বাঁক নিয়ে নেয়? হাথোরেত তো বায়ুর টানে এগিয়েই চলবে। এই অরণ্যে প্রবেশ করে কেউ ফিরতে পারেনি কখনও। তার কারণটা এখন উপল ভালো মতোই বুঝতে পারছে।
পাতার ফাঁক দিয়ে যতটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে যে এই অরণ্যের ভূমি উঁচু-নীচু, প্রশস্ত বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু মাটি দেখা যাচ্ছে তাও ঘন গুল্মে ভরা। স্বাভাবিক ভাবেই এই পথে গমন করাটা আত্মহত্যারই সমান। আকাশপথে যাত্রা করে তারা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবছিল। এখন উপল মনে হচ্ছে তাদের কোন বুদ্ধিই আর যথেষ্ট নয়। সেশেনুর অরণ্য যে এতটাই ঘন তা তার ভাবনার বাইরে ছিল। রাত্রের অন্ধকারে নীলনদকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন অদৃষ্টই ভরসা।
সূর্যের শেষ কিরণ এক সময় দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাখির দল কলরব তুলে হাথোরেতের নীচ দিয়ে দল বেঁধে বাসায় ফিরতে লাগল। গোধূলির ক্ষীণ আলোয় শেষবারের মতো নীলনদকে দেখতে পেল অগস্ত্যরা। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকার নেমে এল চরাচরে। তখনই এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। উত্তেজিত স্বরে বাকারি ডাক দিল উপলকে, ‘উপল! দেখো! এটা কী!
মাথা ঝুঁকিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে উপলেরা যা দেখল তাতে তাদের বিস্ময়ের অন্ত রইল না। নীচের ঘন কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি ক্ষীণ আলোক রেখা! রেখাটি খুবই দুর্বল। জোনাকি পোকাকে নরম মাটির নীচে চাপা দিলে এমন ক্ষীণ আলোর আভা নির্গত হয়। অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে ক্রমে সেই আলোকরেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বিস্ময়াবিষ্ট গলায় অগস্ত্য বলল, ‘নীলনদ!’
‘কিন্তু কীভাবে? যেন মনে হচ্ছে কেউ ক্ষীণ দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছে নদীর বুকে।’
বাকারির বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি।
‘কীভাবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু এটি যে নীলনদই তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভালো ভাবে লক্ষ করে দেখো, আলোটি অল্প অল্প কাঁপছে। নদীর স্রোতের কারণে এমনটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এমন কিছু এক পদার্থ মিশে আছে নদীর জলে যা থেকে এই আলো নির্গত হচ্ছে।’
‘তাহলে হাথোরেতের আর দিগভ্রষ্ট হওয়ার কোন কারণই নেই!’ উপলের গলার স্বরে আনন্দের উচ্ছ্বাস স্পষ্ট।
‘একদমই নেই! তবে আজ রাতে আমরা সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। গোটা রাত্রি কাউকে না কাউকে জেগে থাকতেই হবে। মাঝে মাঝে প্রদীপের আলোয় দিকযন্ত্রটিকে পরীক্ষা করে বায়ুর গতিপথ দেখে নিতে হবে। এই অরণ্যের মধ্যে বায়ু কেমন আচরণ করবে তা আমরা কেউ জানি না। প্রথম প্রহরটি আমি জাগছি, তারপর যথাক্রমে বাকারি, ইরতেনসেনু এবং উপল।’
আকাশে তখন পঞ্চমীর চাঁদ। নীচের নিকষ কালো অন্ধকারকে সেই চাঁদের আলো স্পর্শটুকু করতে পারছে না। নীলনদের থেকে নির্গত ওই রহস্যময় আলোটুকুই সম্বল এখন। অগস্ত্য দিকযন্ত্রের ধাতব পাতটিকে আলগা করল। যান্ত্রিক শব্দ করে ঘুরতে লাগল গোলকটি। রাত্রি এখনও অনেক বাকি। নীলনদের উৎসে কি আগামীকাল পৌঁছতে পারবে তারা? পারবে তারা পুন্তের হারানো শহরকে খুঁজে বার করতে? কী আছে তাদের অদৃষ্টে? এই প্রশ্নগুলির একটিরও উত্তর অগস্ত্যর কাছ নেই। সে তাকিয়ে রইল তারা খচিত আকাশের দিকে।