২০. হুল্‌ হুল্‌ জুল্‌ জুল্‌ উম্‌কি বুস্‌বার জুর্‌

হুল্‌ হুল্‌ জুল্‌ জুল্‌ উম্‌কি বুস্‌বার জুর্‌

হজরত সৈয়দ আবুল কাশেম মুহম্মদ বদি-উজ-জামান আল্-হুসায়নি আল্-খুরাসানি জীবনের বাস্তবতাগুলিকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরতে বাজপাখির মতো বেঁকে মাটির দিকে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু বগতি সেই হেগুলি প্রতিবার ব্যর্থ হত। ভূমির স্ত্রীলোকটিকে ধরে ফেলল এবং তাকে তুলে নিয়ে আকাশে চলে গেল। কিন্তু বৃক্ষটি থেকে গেল। বদিউজ্জামান জানলেন, বৃক্ষটি তার বাহন ছিল। মৌলাহাটে বোঁদেব চৌকিদাব হাশেম সেই বাত্রে প্রচণ্ড ঝডেব মুখে পড়ে। অথচ আকাশে মেঘ ছিল না। সে চাঁদের আলো হলুদবর্ণ দেখে ভয় পায়। আব তারপর এবাদতখানাব প্রাঙ্গণে। একটি আকস্মিক ছিপছিপে গড়নেব অজানা গাছ দেখা যায়। সমস্ত গাছই ভুইফোড। কিন্তু এমন বাতাবাতি ভুইফোডেব দৃষ্টান্ত নেই। খববটি ক্রমে চাউব হয়! এবাদতখানায় বিনা হুকুমে ঢোকার উপায় ছিল না। তাই দূব থেকে গাছটি দেখাব জন্য ভিড হত। সেই ভিড এত বাড়তে থাকে যে হজবতে আলা গাছটি কেটে ফেলাব। জন্য হুকুম দেন! হোসেন কাঠবেকে তলব কব হয। সে গাছটিব খুঁড়িতে কুডলেব কোপ মাবলে চেবা গলায় একটি আর্তনাদ ও। কানে সুচের মতো বেঁধে সেই আর্তনাদ। চারদিকের গ্রামগুলিতে মানুষজন তা শুনতে পেয়েছিল। আব গাছটি থেকে বক্ত ছিটকে পড়ে। হোসেন কুড়ল ফেলে পালিয়ে যায়! তখন হজবত গাছটিব সামনে। গিযে এই দোয়াটি পাঠ কবেনঃ ‘হল হুল জুল জুল…..’ কাউকে প্রিয় ও বশীভূত কবতে হলে এই আবৃত্তিতে ‘বহুত ফায়দা হয়, কেতাবে এমত বর্ণিত হইয়াছে। গাছটি ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেটি এখনও এবাদতখানাব ধ্বংসস্তূপের শিবে দাডিযে আছে। তার গোড়ায় ক্ষতচিহ্নটি এখনও স্পষ্ট দেখা যায়। গাছটি কী, কেউ জানে না। এমন গাছ কোথাও কেউ দেখেনি।…..

কচি ।। দোয়াটা আবেকবার বলো না, দাদিমা!

দিলবুখ বেগম ।। হুল হুল জুল জুল উমকি বুসবাব জুব। কচি! কচি! এমন করে কোথায় যাচ্ছিস?

কচি ছুটে বেবিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বাদশাহি সড়কে পিচ পড়েছে। বাসস্টপে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেল রিকশো, দোকানপাট, ভিড় ঠেলে সে পাটোয়াবিজির আড়তঘরের পেছন দিয়ে আগাছাব জঙ্গলে ঢুকল। সামনে ধ্বংসস্তূপ। একটি প্রকাণ্ড পেয়ারাগাছ। ঝাঁকড়া কুলগাছ। উঁচু কবরটির শিয়রে সেই অচেনা লম্বা গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। কচি মনে-মনে আবৃত্তি করল দোয়াটি। তারপর গাছটির গায়ে হাত রাখল। শুধু এটুকু বুঝল সে, এই গাছের শিকড়গুলি মাটির তলা দিয়ে তার প্রপিতামহের হাড়গুলি ছুঁয়েছে। সে কবরটির দক্ষিণে গেল। হুজুরের নিষেধ ছিল, যেন তাঁর কবরে সাজবাতি জ্বালানো না হয়, কোনো মাজার তৈয়ার না করা হয়, কোনো ফলক বসানো না হয়– কারণ এগুলিন বেদাত কৰ্ম্ম। কিন্তু সবই হয়েছিল। মারবেল ফলকে ফারসি আর বাঙলায় জন্মমৃতুর সনতারিখ লেখা ছিল। ক্ষয়ে-ফেটে শ্যাওলা ধরে গেছে। আমবুশলতা ঢেকে ফেলেছে ফলকটিকে। শুধু পড়া যায়: ‘জন্ম হিজরি সন ১২৬১…..মৃত্যু হিজরি সন ১৩৪০….. জন্ম বাংলা সন ১২৫১….. মৃত্যু সন ১৩২৭-’ কচি মনে-মনে হিসেব করে অবাক হল। হিজরি সনের হিসেবে ৭৯ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তার প্রপিতামহ। কিন্তু বাঙলা সনের হিসেবে ৭৬ বছর হয়। হিজরি চান্দ্রসন, বাঙলা সৌরসন। এই গণ্ডগোলের কারণ কি তাই? কামালস্যারের মতে, হিজরি সনের হিসেবের চেয়ে বাঙলা সনের হিসেব বেশি নির্ভযোগ্য। তবে বিজ্ঞানসম্মত হিশেব খ্রীস্টীয় সন অনুসারে করা যায়। কামালস্যার তাকে একটি পঞ্জিকাসংক্রান্ত বই দিযেছেন। কচি হন্তদন্ত বাড়ি ফিরল! দিলবুখ বেগম উনুনে ভাত বসিয়ে শুকনো পাতা ঠেলে দিচ্ছিলেন। তাঁব নাতনিটি ছিটগ্রস্ত। আলি-আউলিযা-বুজুর্গদেব বংশ এবকম হয় হযতো। কচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উজ্জ্বল মুখে বলল, দাদিমা! তোমাদের হিসেব বোগাস! তোমার শ্বশুরের জন্ম ইংরেজি ১৮৪৫ সালে, মৃত্যু ১৯২০ সালে। দ্যাট মিস-উনি ৭৫ বছর বেঁচে ছিলেন।

কচি বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখে হাঁটু ভাঁজ করে চাপা স্বরে বলল, জান? গাছটার কাছে দোয়াটা পড়লাম। অমনি ওর সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। ও বলল –কী বলল বলো তো?

বৃদ্ধা একটু হাসলেন।…..আমি কি কাহিন আওরত যে গাছের কথা বুঝি?

গাছটা বলল, তোমার বড়োআব্বা আর আমি সুখের সংসার বেঁধে আছি।

তওবা! তওবা! গোনাহ হবে ভাই! ওসব বাত করতে নেই।

আঃ! তুমি জান না, ভালোবাসা এমন জিনিস– যাকে ভালোবাসি, সে যদি বুকে ছুরি মেরে খুন করে, তবু তাকে ভালো না বেসে উপায় থাকে না। আর দাদিমা, ভালোবাসা আর ঘৃণা একই প্রবৃত্তির দুটি দিক। বুঝলে কিছু?

আলুগুলান ফালি-ফালি করে কাট দিকিনি। তা’পরে পোস্তটুকুন বেঁটে দিবি। আমার অজুদে আর জোর নেই …..

গোরস্তানে বেশরা মস্তান আর বদু পিরের
বাহাছ আর বহুত জিনের জজের পর
বিবি কামরুন্নিসার গোর হইতে উঠার বয়ান ।।

হিজরি ১৩২৩ সনের রমজান মাসের ২৭ তারিখে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। আংরেজিনবিশ বড়োগাজি সইদুর রহমান, পরে যিনি জেলবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেন, তাঁর বার্ধক্যজনিত স্মৃতিবিভ্রম স্বাভাবিক। তবে তিনি বলে গেছেন, সেটি খ্রীস্টীয় সন ১৯০৫ এবং শীতকাল ছিল এবং তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ইসলামি শাস্ত্রে ওই তারিখের রাত্রিটির নাম ‘শবে কদর’ অর্থাৎ সম্মানের রাত্রি। কারণ ওই তারিখেই প্রথম আল্লাহের পবিত্র বাণী অমর্ত্যলোক থেকে মর্ত্যলোকে বহন করে আনেন ফেরেশতা জিব্রাইল, যা কোরান নামে পরে গ্রন্থিত হয়। তাই মুসলমানরা চান্দ্র মাসের ওই তারিখটিকে পবিত্র মনে করে। প্রার্থনা-দান-ধ্যানে সম্মানিত রাত্রিটিকে বরণ করে। হানাফি আমলে মৌলাহাট গোরস্তানে ওই রাত্রে মৃতদের জন্য প্রার্থনায় দলে-দলে জীবিতরা গিয়ে দাঁড়াত। ফরাজি আমলে সেই ট্রাডিশনে হুজুর বদিউজ্জামান কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। তবে পাকা কবর তৈরি নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া দেন। ফলে তার জননী কামরুন্নিসার কবরটি পাকা করার ইচ্ছা সত্ত্বেও শিষ্যরা নিবৃত্ত হয় এবং কবরটি কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। শুধু উত্তরশিয়রে একটি কুঁচফুলের ঘন ঝোঁপ কবরটির স্থান নির্দেশ করত। রমজান মাসে রোজা বা উপবাসব্রত। সূর্যাস্তের পর উপবাসভঙ্গ এবং সান্ধ্য নামাজ। হুজুরের কী ইচ্ছা হয়, মায়ের কবরজেয়ারতে বের হন এবাদতখানা থেকে। অলৌকিকক্ষমতাসম্পন্ন ময়ূরমুখো ছড়িটি তাঁর হাতে ছিল (কথিত আছে, যেহেতু জীবজন্তুর মূর্তি নিষিদ্ধ, তাই ছড়ির বাটটিকে আমজনতা ‘ময়ূর-মুখো’ বলে বর্ণনা করলেও হুজুরের মতে ওটি নিছক নকশা বা অলংকার মাত্র)। তখনও দিনের আলো মুছে যায়নি। হুজুরকে গোরস্তানের দিকে যেতে দেখে একদল লোক সম্মানিত দূরত্বে। তাঁকে অনুসরণ করে। এদের মধ্যে হরিণমারার বড়োগাজিও ঘটনাচক্রে উপস্থিত ছিলেন। হুজুর তাঁর মায়ের কবরের দক্ষিণে পৌঁছলে উত্তর থেকে কুঁচফলের ঝোঁপের গায়ে একটি ঢ্যাঙা জীবন্ত দ্বিপদ প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। তার গায়ে হুজুরের মতোই আলখেল্লা। কিন্তু সেটি কালো রঙের। তার গলায় পাথরের রঙিন মালা ছিল, যা নক্ষত্রের মতো জুজুগ করছিল। তার মাথায় আওরতদের মতো দীর্ঘ কেশ ছিল। তার হাতে একটি প্রকাণ্ড লোহার চিমটে ছিল। সেই চিমটের গোড়ায় আংটা পরানো। ছিল। সে চিমটেটি বুকে ঠুকছিল এবং ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছিল। হুজুর থমকে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে পারেন। তারপর আস্তে বলেন কে তুই? এখানে কী করছিস? সে পালটা পুছ করে, তুই কে? এখানে কী করছিস? হুজুর তার পাক আশবাড়ি (ছড়ি)। তোলেন এবং সেও তার চিমটেটি তোলে। এইবার ছড়ি ও চিমটের মুখ থেকে নীলরঙা। আগুন ঠিকরে পড়তে থাকে। লোকসকল ভয়ে দূরে অবস্থান করে।

হড়ি কহে অরে বেশরা মতন।
নাপাক করিতে আহলি পাক গোরস্থান।।
চিনিটা কহে আগে শুনি তোঁহার কিবা কাম।
লম্পট বুজরুগ হৈলি যাইবি জাহান্নাম।।
ছড়ি কহে চিনিলাম তুহি শা ফরিদ।
মুয়ে হক্‌ মওলা আর বগলমে ইট।।
এইভাবে শুরু হইল বহুত বড়া জঙ্গ।
মুন্সী মেরাতুল্লা ভনে কহন না জায় রঙ্গ।।

লোককবি মুন্সি মেরাতুল্লার বৃত্তান্ত অনুসারে এরূপ গালিগালাজের পর দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়। শরিয়ত এবং মারফতের সেই বাহাস একবর্ণও লোকেরা বুঝতে পারেনি। মুন্সিজির বৃত্তান্তে সেই মস্তান বাবার কালো আলখেল্লা দুদিকে সরে নাঙ্গা শরীরের প্রকাশ এবং চিমটে দিয়ে বাঁ স্তনের দুআঙুল নীচে জ্বলন্ত পিদিমের মতো ‘কলব’ প্রদর্শন, ডান স্তনের দুআঙুল নীচে লালরঙের ‘রুহ’ প্রদর্শন, বুকের মাঝখানে হলুদরঙের ‘খাফি’ প্রদর্শন, কপালের মাঝখানে শাদারঙের ‘সিরর’ প্রদর্শন, মাথার তালুতে নীলরঙের ‘আখফা’ প্রদর্শন এবং নাভিমূলের নীচে বিজলির ছটার মতো ‘নকস’ প্রদর্শনের বর্ণনা আছে। পক্ষান্তরে হুজুর শুধু ‘তৌহিদ’ (একত্ব) শব্দটি ছাড়া লা-জবাব ছিলেন। এরপর লোকসকল চর্মচক্ষে দেখে, সন্ধ্যাকালীন আকাশের দুইটি নক্ষত্র থেকে দুইদল শাদা জিন এসে দুইজনের পক্ষাবলম্বন করে। গোরস্তানে শনশন শব্দে ঝড় বইতে থাকে। ধুলো ওড়ে। বৃক্ষলতা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। জিনদের হাতে বিজলির তলোয়ার ছিল। তারা ধাতব কণ্ঠস্বরে দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করছিল। বহুত২ জল্প শুরু হয়ে গেলে লোকসকলের পায়ের তলায় (গোরস্তানে খালি পায়ে যাওয়ার নিয়ম) মাটি কাঁপতে থাকে। তারপর তারা দেখে, হুজুরের আম্মাজান কামরুন্নিসার কবরস্থল ফেটে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং বিবিজি শাদা কাফনপরা অবস্থায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি যুযুধান জিনেদের প্রতি চিৎকার করে বলেন, তফাত যাও! ভাগো! বিব্রত, শরমেন্দা ও ভীত জিনযোদ্ধারা নিজেদের নক্ষত্রাভিমুখে নিমেষে প্রত্যাবর্তন করে। আর বিবিজি প্রথমে উত্তর শিয়রে দাঁড়ানো মস্তানের কপালে সস্নেহে চুম্বন করেন, পরে দক্ষিণদিকে দাঁড়ানো ‘হুজুরে’র কপালে চুম্বন করেন। বিবিজি ক্রন্দন করতে থাকেন। দুইদিক থেকে দুই দ্বিপদ মর্ত্য-সন্তান তাঁর উদ্দেশে নত হন। তখন বিবিজি, শাদা কাফনটাকা মূর্তিটি, আসমানে উত্থিত হন। দুই মানুষ একই স্বরে হাহাকার করে ডাকেন, আম্মা! আম্মাজান! শাদা সেই মূর্তির মাথা আর নিম্নমুখী হয় না। ঊর্ধ্বে ঋজুগতিতে আসমানে বিন্দু হতে-হতে ছায়াপথের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। আর দুই দ্বিপদ মর্ত্যবাসীর মধ্যে বিচিত্র মিলন ঘটে। তাঁরা পরস্পরকে অলিঙ্গন করেন। ক্রন্দন করেন। তারপর মস্তান ও হুজুরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। মস্তান উত্তরে, হুজুর দক্ষিণে, এভাবে ক্রমশ, লোকসকলের প্রতি দৃকপাত না করে দুইজনে দুইদিকে যান। ইহাকে স্ব-স্ব স্থলে প্রত্যাবর্তন কহা যায়।

হিন্দু আওরতগণ মরদগণের সহিত মৌলাহাটে
আগমনকরতঃ ঈদগাহে মুছলমানদিগের হস্তে
রেশমীধাগা বাঁধিয়া দেয় তাহার বয়ান।।

“মাঠের ঈদগাহে সেই বৎসর কাতারে মুছল্লিদিগের জমায়েতে খুত্বপাঠের কালে এছলামের তরিকা (পন্থা) বুঝাইতেছি, আচানক দূরে বাদশাহী সড়কের দিকে নজর হইল। খামোশ রহিলাম। মুসল্লিগণ মুখ ঘুরাইয়া দেখিতে চাহিল, আমি আল্লাহের কোনও প্রকার নমুদ দেখিতেছি কি না। একটি মিছিল আসিতেছিল। বিগত কয়েক মাহিন যাবৎ গুজব রটিতেছিল, হিন্দুগণ মোছলেমদিগের উপর গোস্বা করিয়াছে। বাংলা মুলুক দুই অংশে পৃথক করা হইয়াছে। বড়লাট কারজেন বাহাদুর এবং ঢাকার নবাববাহাদুর ছলিমুল্লাছাহেব পরামর্শকরত এরূপ খণ্ডন করিয়াছেন এবং মোছলেমগণ ইহাতে নাকি অধিক২ ধনদৌলত লাভ করিবে। হিন্দুদিগের গোস্বা হইতেই পারে। তবে আমি ফতোয়া দিয়াছিলাম, আংরেজশাহী বেমতলবে কিছু করে না। তাই হুঁশিয়ার হওয়ার দরকার আছে। বড় গাজীছাহেব এবং দিদারুলের তবলীগ-উল এছলাম সমিতির ভিতর ইহা লইয়া কাজিয়ার কথা শুনিয়াছি। কিন্তু আমি ফতোয়া জারি করি জে এই জিলার মোছলেম বেরাদানের কোনও সুফল নাই। ইহারা কমজোর হইয়া পড়িবে। সেই কারণবশত চালাক আংরেজ-শাহীকে মদত না দেওয়ার জরুরত রহিয়াছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রাম এবং গঞ্জ এবং শহরের হানাফিরা আংরেজশাহীকে মদত দিতেছে। ইহাতে হিন্দুরা মোছলেমদিগের দুশমন হইয়া উঠিতেছে। সুতরাং ওই মিছিল আর ঝাণ্ডা দূর হইতে দেখিয়া বুঝিলাম উহারা হিন্দু, দেলে উর বাজিল। জামাতের সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। কেহ কহিল জে কাফেরগণ আমাদিগের সহিত জঙ্গ করিতে আসিতেছে। পলকে জামাত লণ্ডলঙ হইল। বিস্তর লোক গ্রামের দিকে ছুটিল। আওয়াজ দিতে থাকিল, নারায়ে তকবির। আল্লাহ আকবর! উহারা ঢালতলোয়ার লাঠিবল্লম আনিতে গেল। সেইসময়ে দেখিলাম, মিছিলে আওরত লোকও রহিয়াছে। হট্টগোল থামাইতে চিৎকার করিয়া কহিলাম ‘খামোশ হও!’ উপস্থিত সকলে খামোশ রহিল। তখন কানে আসিল, মিছিল হইতে আওয়াজ আসিতেছে, ‘বন্দে মাতরং!’ জামাতে গাজীভ্রাতা দুইজনাই হাজের ছিলেন। তাঁহারা কহিলেন, হরিণমারার বাবুদিগের দেখা যাইতেছে। বড়গাজী কহিলেন, ডর নাই। উহারা মোছলেম ভ্রাতাদিগের হস্তে রাখী পরাইতে আসিতেছে। মিছিল ঈদগাহের। দিকে ঘুরিল। আনিসুর সর্দারকে হুকুম দিলাম, শীঘ্র জাইয়া মোছলেমদিগের নিবৃত্ত করুন। তিনি ছুটিয়া গেলেন। মিছিলের সম্মুখে বালিকাসকল ছিল। তাহাদের হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা ঝিলমিল করিতেছিল। তাহাদিগের মুখে হাসি ছিল। মাশাল্লাহ!…..

“সেই হিজরী ১২৭৪ সনে আমার আব্বার জওয়ান বয়স এবং আমার বালক বয়সে একবার তামাম হিন্দুস্তানে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহী আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া জঙ্গ লড়িয়াছিল। আমার অজুদ শিহরিত হইল; কাঁপিয়া উঠিলাম। মিম্বার হইতে নামিয়াঁ গেলাম। আমার পেছনে মোছলেমগণ, আমি সম্মুখে। হিন্দুগণ আওয়াজ দিলেন, ‘বন্দে মাতরং!’ আল্লাহের কুদরত! একটি বালিকা, মনে হইল বেহেশতের হুরী হইবেক, ছুটিয়া আসিয়া আমার দক্ষিণ হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা বাঁধিয়া শের (মাথা) বুকাইবামাত্র তাহার দুই কাঁধ ধরিয়া বুকে টানিলাম। আবেগবশত আমার চক্ষু সিক্ত হইল। কহিলাম, ‘বেরাদনে ঔর বহিনে হিন্দুস্তান! আজ পাক খুশির দিবসে পুনরায় আংরেজশাহীর ফেরেববাজির (প্রতারণা/ধূর্তামি) বিরুদ্ধে আমরা মিলিত হইলাম। আল্লাহ আমাকে জে বাড়তি চশম্ (চক্ষু দিয়াছেন, উহা দ্বারা নজর হইতেছে আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে বহুত বড় জঙ্গের জামানা আসিতেছে। তামাম হিন্দুস্তানে সমুন্দরের আওয়াজ উঠিবেক! আপনারা তৈয়ার থাকুন!…..

“বালিকা যুবতী, প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা সকল হিন্দু আরও মোছলেমদিগের হস্তে রেশমী ধাগা ও তকমা বাঁধিয়া দিতেছিল। বালক, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধেরাও সেই কর্মে রত থাকিলেক। তাহার পর উহারা আচানক (গান) গাহিয়া উঠিলেক। দুই কর্ণে অঙ্গুলি পুঁজিব জে হস্ত উঠিল না। বাকরহিত দাঁড়াইয়া রহিলাম। উহারা গাহিতে গাহিতে গ্রাম অভিমুখে গমন করিলেক। পরে গানটি বড়োগাজী আমাকে লিখিয়া দেন। উহা এইরূপ :

বাঙলার মাটি বাঙলার জল
বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান…

“উহারা চলিয়া গেলে আবার ঈদের জামাত শুরু হইল। তৎকালে স্মরণ হইল জে আমি গানা শুনিয়াছি। উহার কৈফিয়ৎ দেওয়া আবশ্যক। তখন পাক হাদিছের একটি বৃত্তান্ত শুনাইলাম। এক দিবস মদিনাশহরে দফ (বাদ্য) বাজাইয়া একটি লোক গানা করিতেছিল। রসুলে আল্লাহ (সাঃ) সেইসময় রাস্তা দিয়া জাইতেছিলেন। তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর দুইকদম বাড়াইয়া কহিলেন জে সম্মুখে ভিড় করিয়া পঁড়াইলে পিছনের কেহ উহাকে দেখিতে পাইবে না। তোমরা যাহারা সম্মুখে আছে, উপবেশন কর। অতএব বেরাদানে এছলাম! কোনও২ কালে গানা জায়েজ। কিন্তু উহার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিতে হয়। উহার উদ্দেশ্যসমুদায় চিন্তা করিতে হয়। এই জে আমি দোয়া পাঠ করি, উহাও একপ্রকার গানা নহে কি? মুয়াজ্জিন জে আজান হাঁকে, উহার সুর আছে। সেই সুর আল্লাহের সৃষ্ট কুলমখলকাতকে (বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে) নাড়া দেয়। বনু-আদম আল্লাহপাকের দিকে মুখ ঘুরায় এবং ছেজফারত হয় নাকি?’…..।

“সেই দিবস ঈদের পর সড়কে দাঁড়াইয়া বড়গাজি আমাকে কহেন জে ওই গানটি শাইরি করিয়াছেন জনৈক বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিও তৌহিদের প্রচারক। তাঁহারা ‘ব্রাহ্ম’, পুছ করিলে বড়গাজি যাহা বলেন, শুনিয়া তাজ্জব হইয়া জাই। ব্রাহ্মগণও ‘লাশরিকালাহু’ এই মতে বিশ্বাসী! তাহারা আল্লাহকে নিরাকার ব্রহ্ম কহেন। বুতপরস্থির পৌত্তলিকতার) নিন্দা করেন। মাশাল্লাহ! ওই ‘শাইর’ বাবুকে দেখিতে বড় ইচ্ছা হইল। শুনিলাম জে তিনি বীরভূম জিলার বোলপুর সন্নিকটে। এবাদতখানা বানাইয়া বাস করেন এবং তিনি ওই এবাদতখানা এলাকায় বুত-পরস্তি হারাম বলিয়া হুকুম জারি করিয়াছেন। মারহাবা! মারহাবা!”…..

‘ওয়া দারু লাহাবির রাকমাতায়নে কা আন্নাহা
মারাজিয়ো ওয়ালমিন ফি নাওয়াশের মি সামী—’
–জয়াহের বিন-আবুসালমা*

[* প্রাক-ইসলাম যুগের আরব কবি।]

বালকটি এবাদতখানার পূর্বদিকের জঙ্গল থেকে খুঁড়ি মেরে এসে নীচু পাঁচিলে উঁকি দিচ্ছিল। সে ভাবল, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। পাঁচিল ডিঙিয়ে সে ঢুকে পড়ল। তখন চিনতে পারলাম, মনিরুজ্জামানের ছেলে। মুখ টিপে হেসে নজর রাখলাম দেখি সে কী করে। আনার (ডালিম) গাছের ভেতর ঢুকে গেলে বুঝলাম সে কী করবে! কিছুক্ষণ এবাদতখানার দিকে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে রইল সে। তারপর গাছটা নড়তে থাকল। তখন পাকশালার কিনারা ঘুরে ফুলঝোঁপের আড়াল দিয়ো চুপিচুপি কাছে গেলাম। সে আনারটি ঘেঁড়ার চেষ্টা করছিল। খপ করে হাত ধরে ফেলে বললাম, কমবখত! চোট্টা! হো হো করে হাসছিলাম। সে ভড়কে গিয়েছিল। এবার লাজুক হেসে মুখ নামাল। বললাম, আনার এখনও পাকেনি। এসো, আঞ্জির পেয়ার) পেড়ে দিই। পাশের আঞ্জির গাছ থেকে ডাঁসা কয়েকটা আঞ্জির পেড়ে দিলাম। সে কোর্তায় সেগুলি কোঁচড় করে রাখল। বলল, দাদাজি! আনার কবে পাকবে? বললাম, আর দেরি নেই। এসো, দুভাই মিলে আঞ্জির খেতে-খেতে বাতচিত করি। সে বলল, আম্মা বকবেন। বললাম, বলবে দাদাজির সঙ্গে আঞ্জির খাচ্ছিলাম। তখন। বলল, দাদিজি বকবেন। বললাম, সবাই তোমাকে বকে বুঝি? সে মাথা দোলাল। বললাম, আব্বা বকেন না? বলল, না।…..মুনিরুজ্জামানের ছেলেকে খুব নজর করে দেখে আসছি। ওর দেহে একটুও খুঁত নেই। আল্লাহের কুদরত। তবে বড়ই শরমেন্দা। কিন্তু ঘাটেব সিঁড়িতে বসে আঞ্জির খেতে-খেতে সে আজ জবান খুলে দিল। গেরস্থালি ও দৈনন্দিন যা কিছু ঘটে, সবই খুঁটিয়ে বর্ণনা করল। বুঝলাম, তার সঙ্গে আঞ্জির খাচ্ছি বলে সে আমার সম্পর্কে অস্বস্তি কাটিয়ে ফেলেছে। বলল, কুলসুমবুড়ি (ছাগল) শেয়ালের মুখে মারা পড়েছে। আপনি একটা জিন পাঠাননি কেন, দাদাজি? দাদিজি দুদিন কেঁদেছেন, জানেন? হুঁ, কুলসুমকে বাচ্চা থেকে বড়ো করেছিল সাইদা। ওর দুঃখটা বুঝি। বললাম, তোমার দাদিজিকে বোলো, শেয়ালটাও জিন্দা নেই। তাকেও জিন মেরে ফেলেছে। সে হঠাৎ ফিক করে হাসল। বলল, দাদাজি! কাল খালাআম্মা এসেছিলেন। দাদিজি বলছিলেন, বেটি! তোমার খুশিবেটির সঙ্গে রফির শাদি দেব। আম্মা খুব রাগ করেছিলেন। খাল-আম্মা চলে গেলে বললেন, কেন ওকে ওকথা বললেন? আম্মা কেঁদে ফেললেন।…..হুঁ, এই বালকটি বড় জবান-তোড় (মুখর)। সত্যই সে লাজুক নয়। নুরুজ্জামানের মেয়ে শামিম-আরা ওরফে খুশির সঙ্গে নিজের শাদির কথা নিজের মুখে বলে খুব হাসতে লাগল। বললাম, অ্যাই বেশরম! এখনই শাদির কথা কেন তোমার? বড়ো হও। পাস করো। এলেমদার হও– তবে না শাদি? রফিকুজ্জামান বলল, খুশিকে আমি শাদি করব বুঝি? দাদাজি, আপনি যেন কী। খুশি বড় জংলি, জানেন? আম্মা বলেন, একেবারে ওর নানাজির মতো। দাদাজি, আপনি জানেন তো? এবার আমি প্রাইমারি মক্তব পাস করেছি! দাদিজি বলেছেন, আমি বড়োগাজির মতো কলকাতা। পড়তে যাব। কলকাতা গেছেন আপনি?…হুঁ, সাইদা বেশ গুছিয়ে বসেছে সংসারে। শুধু একটাই ওর কষ্ট –শফিউজ্জামান। পানির দিকে তাকিয়ে রইলাম। উলটো দুনিয়াটি নজর হল। বুক কেঁপে উঠল। তারপর ডাকলাম, কমরুজ্জামান! বালক অবাক হয়ে তাকাল। বলল, কে কমরুজ্জামান? আমি তো রফিকুজ্জামান। একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ– রফিকুজ্জামান! তো তোমার মাথা নাঙ্গা কেন? টুপি পর ্না কেন? হরঘড়ি মাথা ঢেকে থাকবে। বালক বলল, কেন দাদাজি? বললাম, নাঙ্গা শের দেখলে কালা জিন তার টুপি পরিয়ে দেয়। তখন মানুষ খারাপ হয়ে যায়।বলে তার মাথায় দোয়া পড়ে ফুঁ দিলাম। বালক বলল, দাদাজি! লোকে বলে আপনি মাটিছাড়া হয়ে আসমানে উড়তে পারেন। সত্যি?–চুপ করে আছি দেখে সে তাগিদ দিল, বলুন না দাদাজি? শ্বাস ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ রফিকুজ্জামান। আমি দুনিয়াছাড়া হয়ে আসমানে ভেসে আছি। দেখতে পাচ্ছ না? পাবে। আরও বড়ো হও। জানতে পারবে আমার তকলিফ শী। বালকটি কি কিছু বুঝল? কী করে বুঝবে? হঠাৎ সে চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল, এই রে! আম্মা আমাকে বকবেন। নুন আর দেশলাই কিনতে পয়সা দিয়েছেন। সে কোর্তার পকেট থেকে একটা তামার। পয়সা বের করে দেখাল। তারপর দৌড়ে চলে গেল। সেই সময় মনে ভেসে এল। প্রাচীন এক আরব কবির একটি কবিতা। সুন্দরী রমণীর দেহে আঁকা উল্কির মতো সুন্দর ওই মরুবালুকার ওপর তোমার তাঁবুখানি। প্রাচীন আরবে মেয়েরা উল্কি দেগে নিত দেহে। সাইদা! তোমার জীবনের মরুবালুকার ওপর সুন্দর তাঁবু বেঁধেছ। আর আমি আকাশের ওপর ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি জীবনভর। আমি এক অলীক ঘোড়ার সওয়ার, তার দুটি ডানা আছে। “সফেদ জিনগুলান আমাকে আসমানে উঁচা জায়গায় শাহী তখতে বসাইল। লেকিন আমার দেল বনু-আদমের থাকিয়া জাইল! উহা গোন্ত আর খুন দ্বারা তৈয়ারী।”….

বাবু গোবিন্দরাম আসিয়া ছফির
বৃত্তান্ত কহেন আর হুজুর পুত্রকে
রক্ষার জন্য জিন ভেজেন তাহার
বয়ান ।।

জালালুদ্দিন বলল, হজরতে আলা! কিছু কেতাবে গায়েবি (অদৃশ্য) দুনিয়ার কথা লেখা আছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

বদিউজ্জামান একটি গাছের দিকে ছড়ি তুলে বললেন, ওটি কী?

একটি গাছ।

তুমি কি পুরা গাছটি দেখতে পাচ্ছ?

জি, হ্যাঁ।

বদিউজ্জামান একটু হাসলেন।…কথাটা ঠিক হল না জালালুদ্দিন। তুমি কখনই পুরা গাছটিকে দেখতে পাচ্ছ না।

জালালুদ্দিন অবাক হল।…কেন হজরতে আলা?

জালালুদ্দিন! গাছটি আসমানে ভেসে নেই। মাটির তলায় ওর শেকড়-বাকড় আছে। কিন্তু তুমি তা দেখতে পাচ্ছ না। তাহলে দেখো, গাছটির এক অংশ দেখতে পাচ্ছ, সেটা জাহের (দৃশ্য)। অপর অংশ দেখতে পাচ্ছ না, সেটা বাতেন। তাকেই বলে গায়েব।

হুজুরে আলা! এ তো তাহলে মারফতি তত্ত্ব হয়ে গেল!

উঁহু। ওরা জাহেরকে স্বীকার করে না। বলে, জাহের অংশ চোখের ভুল। গায়েব অংশই সত্য। কিন্তু আমি বলি, জাহির-গায়েব উভয়ই সত্য। জাহির হল শরিয়ত, গায়েব হল মারফত।

কিন্তু ইমাম শরিফ বলেছেন–

বাধা দিয়ে হজরত বদিউজ্জামান বললেন, আমি ইমাম শাফির মজহারু (সম্প্রদায়)-ভুক্ত। কিন্তু সেটা শরিয়ত বিষয়ে। জালালুদ্দিন! মারফত বিষয়ে আল্লাহ। আমাকে দিনে-দিনে ইম্ (প্রজ্ঞা) দান করেছেন। গায়েবি দুনিয়া আমার নজর হয়। শরীর আর তার ছায়া যেমন, প্রথমে সেইরকম মালুম হত। তারপর ছায়াকেই আসল জানতে পারলাম।

জালালুদ্দিন খুশি হয়ে বলল, হজরত! আফলাতুনের (প্লেটো) কেতাবে ঠিক এই তত্ত্ব পড়েছি বটে!

আফলাতুনের চেয়ে ইলমদার দুনিয়ায় কমই ছিলেন।

এই সময় আনিসুর সর্দারের মৃদু কাশির শব্দ শোনা গেল। হুজুর ইশারায় ডাকলেন তাঁকে। সম্ভাষণ-বিনিময়ের পর আনিসুর বললেন, সেই জমিদারবাবুর লোক বাবু গোবিন্দরাম হুজুরের মোলকাত মাঙছেন।

বদিউজ্জামান তাঁকে নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন। বাবু গোবিন্দরাম ফটকে ঢুকেই কুঁকে এবাদতখানার একটু মাটি মাথায় রাখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে প্রাঙ্গণে দাঁড়ালেন। হুজুর বললেন, বেটির জিনটি কি আবার জ্বালাতন শুরু করেছে বাবু?

গোবিন্দরাম বললেন, আজ্ঞে না, পিরসাহেব! আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।

জালালুদ্দিন এবং আনিসুর সঙ্গে-সঙ্গে এবাদতখানা থেকে পেরিয়ে গেলেন। হুজুর বললেন, আসুন বাবু, ঘাটে বসে কথা শুনি।

ঘাটের মাথায় মুখোমুখি বসার পর গোবিন্দরাম আস্তে বললেন, আপনি আপনার কনিষ্ঠ পুত্র শফির খবর রাখেন কি?

বদিউজ্জামান মাছের চোখে তাকিয়ে বললেন, সে আমার কাছে মুর্দা (মৃত), বাবু!

গোবিন্দরাম আস্তে বললেন, জেলার কালেকটর বাহাদুর শফিকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসন-দণ্ড জারি করেছেন। এ জেলায় তাকে দেখলেই পুলিশকে গুলি করে মারার হুকুমও জারি হয়েছে।

বদিউজ্জামান ফের একই স্বরে বললেন, সে মুর্দা।

পিরসাহেব! গোবিন্দরামের চোখের কোনায় একফোঁটা জল দেখা গেল। ধরা গলায় বললেন, তার মতো মহদয় যুবক দেখা যায় না। সে জেদি, খেয়ালি, বেপরোয়া বটে। নরহত্যায় তার হাত কাঁপে না। কিন্তু তবু বলব, তার গুণের অত নেই। বিদ্বান পণ্ডিতও এ জেলায় তার তুল্য দেখি না। তার তুল্য সেবাব্রতীও দেখা যায় না। অমন দেশপ্রেমিকও দুর্লভ। গোবিন্দরাম শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আমি নেমকহারাম নই। কিন্তু আমার মালিক জমিদার বাবু অনন্তনারায়ণ ত্রিবেদী বড়ো অত্যাচারী, মদ্যপ এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন। আমি দুবছর হল, চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছি। গত বছর জমিদারবাবু খুন হয়েছেন। তাঁর খুনী কে আমি তাও জানি। কিন্তু–

শফি? বদিউজ্জামান আস্তে বললেন।

গোবিন্দরাম জবাব দিলেন না এ প্রশ্নের। বললেন, শফির বিরুদ্ধে কালেকটর বাহাদুরের ওই হুকুমজারির পিছনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের বড়োমানুষরা

আছে। এমন কী, হরিণমারার বড়োগাজিও আছেন।

বদিউজ্জামান চমকে উঠলেন। ফের আস্তে বললেন, তিনি আর আমার কাছে আসেন না। শুনেছি, সদরশহরে থাকেন। মোছলেম লিগ না কিসের মাথা হয়েছেন।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন। গোবিন্দরাম একটু চুপ করে থেকে বললেন, জেলায় আপনার নামযশ আছে। আপনি এর বিহিত করুন।

কী করব?

আপনি খত লিখে দিন। বড়োগাজিকে লিখুন। খানবাহাদুর দবিরউদ্দিনকে লিখুন। আর একখানা লিখুন কালেকটার বাহদুরকে। আমি সেই খত নিয়ে যাব। হ্যাঁ, আর-একখানা খত লিখুন দিদারুলকে। তিনিও একজন নামকরা লোক। মুসলিম লিগের জিলা সেক্রেটারি।

দিদারুল! বদিউজ্জামান ক্ষুব্ধভাবে বললেন। সে তবলীগ-উল-এছলাম সমিতি ভেঙে দিয়েছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এখন তিনি মুসলিম লিগের নেতা। বদিউজ্জামান গম্ভীরমুখে বললেন, আমি আজকাল বাইরের দুনিয়ার খবর রাখি । এবাদত-বন্দেগিতে কাটাই। আর শফি আমার কাছে মুর্দা! সে মুসলমানি ছেড়ে আপনাদের জাতি হয়েছে শুনেছি।

গোবিন্দরাম একটু হাসলেন। পিরসাহেব! হিন্দু হওয়া যায় না। হিন্দু হয়ে জন্ম নিতে হয়!

বলেন কী! তাজ্জব কথা!

আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে গোবিন্দরাম সোনার বোম সাজানো পানজাবির পকেট থেকেট একটি চিঠি বের করে দুহাতে দিলেন। খতখানি পড়ে দেখুন!

কার খত?

কৃষ্ণপুরের জমিদারবাবুর মেয়ে– যার জিনকে আপনি ভাগিয়েছিলেন। সে এখন জমিদারির মালিক হয়েছে। তবে দু-তিনটি মহাল বাদে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। সব নীলাম হয়ে গেছে।

চিঠিটি আরবি ভাষায় লেখা। মাত্র দুলাইনের চিঠি? সম্বোধনহীন, বেনামি। “শফিকে রক্ষার জন্য শীঘ্র একজন জিন পাঠান।”

বদিউজ্জামান হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বেটি পাগলি! জমিদারি চালায় কীভাবে?

গোবিন্দরাম বললেন, কর্মচারীরা চালায়। তবে কতদিন এভাবে চলবে জানি । মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব? সত্যই সে এক উন্মাদিনী। হিংস্র প্রকৃতির মেয়ে। তার ভবিষ্যৎ ভেবে ভয় করে।

বদিউজ্জামান কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললেন, দেখছি।

গোবিন্দরাম বললেন, আমাকে এখনই ফিরতে হবে। খতগুলি দয়া করে যদি–

বদিউজ্জামান হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বললেন, শফি মুর্দা। আমি মুর্দার জন্য জিন্দাদের কাছে খত লিখব না, বাবু! আপনি আসুন।

গোবিন্দরাম ক্ষুব্ধভাবে উঠে দাঁড়ালেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, আপনার ইচ্ছা। তারপর বেরিয়ে গেলেন।

বদিউজ্জামান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এবাদতখানায় ঢুকলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে গালিচার বসলেন। বিকেলের আলো কমে যাচ্ছে। ঘরে আবছা আঁধার! কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ক্রন্দনের পর দুইহাত তুলে মৃদুস্বরে প্রার্থনা করলেন, “আল্লাহ! তুমি জিন ও ইনসান (মানুষ) পয়দা করিয়াছ। আমি এই জিন্দেগিতে কিছু চাহি নাই তোমার কাছে। এক্ষণে মাত্র একজন জিনকে ভিখ মাঙিতেছি। তাহাকে পাঠাইয়া দাও, মালেক!”….

আবরুকে ব-সুদ্‌-দ খুন-এ-জিগর্‌ হস্ত দিহদ্‌
ব-উমিদ-এ-করম-এ-খাজা ব-দারোয়াঁ মা-ফারোশ–

রোজ নানা জায়গা থেকে অসংখ্য চিঠি আসে। মৌলাহাটে ডাকঘরের অন্য দরখাস্ত গেছে। শুনেছি মনজুর হয়ে যাবে। এখনও ডাকঘর ওই হরিণমারায়। দুপুর নাগাদ ডাকপিত্তন এবাদতখানার ফটকে এসে হাঁক মারে, ‘চিঠ্‌ঠি’! লোকটির মাথায় লাল পাগড়ি, গায়ে খাকি ঢোলা কোর্তা, পরনে ধুতি, পায়ে বেঢপ জুতো। তার গোঁফখানা দেখার মতো। নাক ও কান বেজায় লম্বা। তার কাঁধে ঝোলে চামড়ার প্যাটরা। সে হিন্দু। কিন্তু বুজুর্গদের প্রতি ভক্তিপরায়ণ। বারদুতিনও হাঁকে কখনও। অপেক্ষা করে। তার ভক্তিই তাকে ধৈর্যশীল করে। আমাকে দেখামাত্র সে ব্যস্তভাবে জুতো খুলে ফেলে। বাভিলবাঁধা চিঠিগুলো দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে গেলে সে চিঠির বান্ডিলটা আমার পায়ের কাছে রাখার জন্য নত হয়। তাকে নসিহত করেও ফায়দা হয়নি। সে কি আমাকে ছুঁতে হবে বলে এমন করে? প্রথম-প্রথম এই কথাই ভাবতাম। পরে মনে হয়েছিল, ধারণাটা ঠিক নয়। এর আগেও কত জায়গায় বসবাস করেছি এবং চিঠি এলে হিন্দু ডাকপিওন আমার হাতেই তা তুলে দিয়েছে। কিন্তু সেইসব চিঠি এইসব চিঠি নয়। উর্দু, ফারসি, বাঙলায় লেখা প্রশস্তি, দোয়াপ্রার্থনা, হুজুরের নামে পাঠানো নজরানার টাকা পৌঁছেছে কি না, কার কী কঠিন অসুখ এবং আমার ‘পাক খেদমতে হাজির’ হওয়ার জন্য অনুমতি কিংবা কোনো শরিয়তি বিষয়ে মছলা বা ফতোয়া চাওয়া, এইসব নানা ধরনের চিঠি। মানুষের কত যে সমস্যা! রাগ লাগে, দুঃখ হয়, হাসি পায়। চিঠিগুলি আমাকে নিয়ে অথবা আমি চিঠিগুলি নিয়ে খেলা করি। কোথাকার এক আওরত আমাকে প্রায় স্বপ্নে দেখে। হাসতে হাসতে গম্ভীব হই। এই চিঠির জবাব দিই না। তবু তার চিঠি আসে। বুকে ডর বাজে, কবে না এসে সামনে দাঁড়ায়! তবু এইভাবে যে চিঠি আসে, সেও, বুঝি আল্লাহের কুদরত! শেষ পর্যন্ত এই হয়ে উঠল তাজা, জিন্দা, ছটফটে– হয়তো যন্ত্রণায়, হয়তো আনন্দে চঞ্চল যে দুনিয়া আর জীবন, তাকে দেখার জানালা। এই জানালা দিয়ে মানুষের জীবনের স্পন্দন টের পাই। হাজার-হাজার মুখ। হাজার হাজার আশাষণ-খাহেস। যেন ঘরে বসে বাইরে ঝড় দেখছি। মিছিল দেখছি। সমুন্দর দেখছি। উথাল-পাথাল ঢেউ দেখছি। ছলাৎছলাৎ ঢেউগুলি কি আমাকেও এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে না? ওই ঝড় কি আমাকেও ঝাঁপটা মারছে না? হুঁ–আমিও তো মানুষ। আমার নির্লিপ্ততার আলখেল্লা ফরিদুজ্জামানের কালো পোশাকটির মতোই দুভাগ হয়ে যায়, নাঙ্গা রক্তমাংসের শরীর থরথর করে ওঠে। সেদিন একটি চিঠি পেলাম: ‘আমার ছোট ভাই, তিনবৎসর বয়স, ইন্তেকাল করিয়াছে। হুজুর দোয়া করুন, সে যেন বেহেতে ঠাঁই পায়।’ হাতের লেখা দেখে মনে হল বালিকাই হবে। জবাব দিলাম বাচ্চাদের ইন্তেকাল হইলে বেহেশত সুনিশ্চিত জানি! ‘শোক করিবা না। উহা হারাম।’ চিঠিগুলি বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যেন গোপন সাঁকো তৈরি করেছিল আমার জন্য। তাই দুপুর হলেই ঘাটের সিঁড়ির মাথার উদ্‌গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বাদশাহি সড়কে দুরে লালপাগড়ি নজর হলেই বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে। আজ কী চিঠি আসছে? কার কী খবর নিয়ে আসছে? শফি –আল্লাহ তার জন্য নিশ্চিত কোনো শক্তিশালী জিন পাঠিয়েছেন। তবু মানুষের মন– আমি মানুষ! ডাকপিত্তন এসে পায়ের কাছে বান্ডিলবাঁধা চিঠির তাড়া রাখল। মানিঅর্ডার ফরম রাখল, তার ওপর কিছু টাকা। তার কানে খাগের কলম গোঁজা ছিল। ছিপিআঁটা একটি দোয়াত ছিল চামড়ার প্যাটরায় একটি খোপে। সবই সসম্ভ্রমে রাখল। দস্তখত করে টাকা চিঠির বান্ডিল তুলে নিলাম। সে ফরম, দোয়াত, কলম তুলে নিল। তারপর মাটি থেকে ধুলো খিমচে মাথায় রাখল! মানুষ মানুষের কাছে কেন ওভাবে নত হবে পাই ভেবে নে। টাকাগুলি এতিমখানার জন্য কয়েকজন পাঠিয়েছেন। এবাদতখানার বারান্দায় বসে চিঠিগুলি পড়তে থাকলাম। একটি পোস্টকার্ড, লাল কালিতে লেখা ফারসি দুলাইন কথা, একটি বয়েং : আবরু-কে ‘রক্ত দিয়ে কেনা ইজ্জত, হে সম্মানিতজন, কোনো স্বার্থের বদলে দারোয়ানের কাছে বেচে দিও না।’ তলায় শুধু ফরাসি ‘রে’ হরফ। র-কে এই ‘র’? আচানক নড়ে উঠলাম। আমার নাম ঠিকানা সাধারণ কালিতে লেখা এবং আংরেজিতে! র, রত্নময়ী! কৃষ্ণপুরের সেই জমিদারকন্যা। বুঝলাম আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শফির কথা। কিন্তু এই বয়েৎ কেন? তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আবিষ্কার করলাম, কালির রঙ সাধারণ লাল নয়। একটু কালচে। জায়গায়-জায়গায় ধ্যাবড়া। ইয়া আল্লাহ! এ কি খুন! রক্ত দিয়ে লিখেছে? কিন্তু কেন এই বয়েৎ লিখল সে? আমি নিজের বা কারুর ইজ্জত কোন্ দারোয়ানের কাছে বিকিয়ে দিতে যাচ্ছি যে এমন হুঁশিয়ারি দিল? মন তোলপাড় হয়ে রইল। শফির বিরুদ্ধে সরকারি হুকুম আমি সাইদাকে গোপন করে রেখেছি। জানি না, ইতিমধ্যে সে-খবর মৌলাহাটে রটেছে কি না। রটলে কেউ না-কেউ আমাকে কি জানাবে না? নাকি শফি হিন্দু হয়ে গেছে এবং আমার কাছে সে মৃত সাব্যস্ত হওয়ায় কেউ একটা আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না? না? দিনটা বড়ো বেসামাল কেটে পেল। সারারাত ঘুম হল না। পরদিন বিকেলে দেখি, বাদশাহি সড়কে একটি কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে কোনো সওয়ার আসছে। ঘোড়সওয়ার এবাদতখানার ফটকের দিকে এসে থামল। একটি গাছে ঘোড়া বেঁধে ফটকের সামনে দাঁড়াল। চিনতে পারলাম। দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি। শুনেছিলাম যে কবে নাকি একদিন এসেছিল। বউবিবিদের মায়ের সম্পত্তির বণ্টননামা করে গেছে। কিন্তু মেজবউবিবি মায়ের সম্পত্তি নেয়নি। খুশি হয়েছিলাম শুনে। আত্মহত্যাকারিণীর সম্পত্তি হারাম। মেজবউবিবি বড় নেককার (পুণ্যবতী) মেয়ে। চৌধুরি লোকটিকে দেখে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। এগিয়ে গিয়ে বললাম, বেশরা, মোছলেমনামধারী লোকদের জন্য এবাদতখানার দরোয়াজা বন্ধ। লোকটিকে রুগণ দেখাচ্ছিল। পোশাকও আংরেজের মাফিক। পাতলুনের ভেতর কামিজ গোঁজা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললাম, কী চাই আপনার? আবার কী নিতে এসেছেন আমার কাছে? যান –আর কিছু দেবার নেই আপনাকে। আমার গলা কাঁপছিল। চোখ ভিজে যাচ্ছিল। ফের বললাম, বলুন কী চাই এবার? বারি। চৌধুরি আস্তে বললেন, হজরত! কিছুই চাই না। আপনার কাছ থেকে যা নিয়ে গিয়েছিলাম, তা আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপনার একটি দস্তখত চাই। বললাম, শফি মুর্দা।বারি চৌধুরি বললেন, আপনার কাছে মুর্দা। কিন্তু জেলার হাজার হাজার মানুষের কাছে সে জিন্দা। তারা তাকে চায়। তারা দস্তখত দিয়েছে। কিন্তু আপনার দস্তখতের দাম তাদের চেয়ে বেশি। কালেকটার সাহেব বলেছেন, যদি শফির আব্বা জিম্মাদার হন যে, ছেলেকে তিনি সরকার-বিরোধী কাজ থেকে দূরে রাখবেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে হুকুম তুলে নেওয়া। হবে। হজরত । আপনাকে জিম্মাদার সত্যিই হতে হবে না, শুধু নামকাওয়াস্তে একটা দস্তখত দিন। শফির আসল জিম্মাদার থাকব আমি।– বারি চৌধুরি চোখ মুছে ফের বলল, সে বেপরোয়া। সে জেলায় মাঝে-মাঝে যাতায়াত করছে। আমার ভয় হয়, কখন পুলিশের সামনে পড়লে তাকে গুলি করে মারবে। তাই তার শুধু বেঁচে থাকার জন্য আপনার দস্তখত চাইছি। কালেকটারসাহেব আপনার নামযশের কথা জানেন। তিনি জানেন, আপনি বুজর্গ পির। আপনি দয়া করে শুধু একটা দস্তখত দিন। শিলমোহরও দিন। বলে সে একটা কাগজ বের করল পকেট থেকে। কাগজটি হাত বাড়িয়ে নিয়েই মনে পড়ে গেল রত্নময়ীর রক্তে লেখা বয়েটি। সঙ্গে-সঙ্গে কাগজটি ছিঁড়ে ফেললাম। দ্রুত পিছন ফিরে চলে এলাম। এবাদতখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কতক্ষণ বসে ছিলাম, স্মরণ হয় না। দরজায় ধাক্কা মারল কেউ। তারপর সাইদার সাড়া পেলাম। ভাবলাম, সে দুখুকে সঙ্গে নিয়ে খানা এনেছে। দরজা খুলে চমকে উঠলাম। সাইদার বোরখার মুখের পর্দা তোলা। দুচোখে কান্না এবং আগুন। আপনি এমন বেদিল (হৃদয়হীন) এমন বেহরম (নির্দয়)! বলে আমার জোব্বা খামচে ধরে বুকে মাথা ভাঙতে লাগল। বুঝলাম, বারি চৌধুরি সাইদাকে সব বলেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেই পোস্টকার্ডটি তুলে সাইদার চোখের সামনে ধরলাম। বয়েটি আবৃত্তি করে বললাম খুন দিয়ে এক হিন্দু মেয়ে এটি লিখেছে। সারা জিন্দেগি খুন দিয়ে কেনা ইজ্জত দারোয়ানের পায়ে বিকিয়ে দিতে বল সাইদা? তখন সাইদা চুপ করে রইল।

I met a lady in the meads,
Full beautiful- a faery’s child.
Her hair was long, her foot was light,
And her eyes were wild.
-Keats.

“এইসনে আনারগাছটিতে বহুত আনার ফলিয়াছে। আল্লাহের নেয়ামত থরেবিথরে ঝলমল করিতেছে। কোথায় ছিল এইসকল মেওয়া? আল্লাহ বেহেস্ত হইতে কি একটুকুন নমুদ দৰ্শাইতেছেন বনু-আদমকে? তাহাই বটে! গায়েবী দুনিয়ার নমুদ জাহেবী দুনিয়ার পদুছিয়াছে। আফলাতুন সঠিক কহিয়াছেন! নাকি পাক আল্লাহ যাহা ছিল, না, যাহা নাই সমুদায় সৃষ্টি করেন? বড় ধন্দে পড়িলাম দেখিতেছি।

“অন্যমনস্কভাবে চাহিয়া আছি। আচানক নজর হইল, একটি ক্ষুদ্র হাত, উহাতে একগাছি চুড়ি ঝিলমিল করিতেছে, একটি আনার আঁকড়াইয়া ধরিল। অমনি আওয়াজ দিলাম। দেখিলাম গাছটির আড়ালে কিছু আন্দোলন ঘটিতেছে। উঠিয়া পড়িলাম। একটি বালিকা দৌড়াইয়া জঙ্গলে ঢুকিতেছে। দুইখানি ক্ষুদ্র পা হরিণীর সদৃশ, চুল উপচাইয়া পিঠে পড়িয়াছে এবং একবারের জন্য সে মুহ ঘুরাইয়া বুঝিতে চাহিল জে আমি তাহাকে তাড়া করিতেছি কি না। আমার চক্ষে ছটা বাজিল। বেহেশতের হুরী দেখিলাম কি? কে এই খুব সুর বালিকা? বয়ঃক্রম ছয়-সাত বৎসর হইবে মালুম হয়। দ্বিতীয় দফা পুষ্করিণীর উত্তরপূর্ব কোণে বিজলীর ঝিলিক মারিয়া সে গায়েব হইয়া গেল। তবে এতিখানারই কোন এতিম বালিকা হইবে। শরমেন্দা বোধ করিলাম। এই ঘাটে দাঁড়াইয়া উত্তরের পাড়ে এতিমখানার ঘাটে নজর রাখিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে এতিমখানার খিদমতগার-বাবুর্চি ইরফান এবং মকবুল দেগচি তৈজসাদি ধুইতে বাহির হইল। ইশারায় ডাকিলাম। তাহারা দৌড়াইয়া পশ্চিমের সড়ক ঘুরিয়া এবাদতখানার সদর ফটকে হাজির হইল। পূর্বের জঙ্গল ইলাকায় আমার বিনা হুকুমে কেহ পা দেয় না। লোকসকল জানে জে আমি ওই জঙ্গলে গাছ-লতা-পশু-পাখি সকলের সহিত কথাবার্তা কহি এবং কখনওই জেনদিগের সঙ্গেও মুলাকাত করি।–

“ইরফান এবং মকবুল বহত তাজ্জব হইল। নিজ হস্তে আনার পাড়িতে পুছ করিলাম, এতিমখানায় কতজন এতিম আছে? উহারা কহিল, ‘একুশ জন।’– ‘কম বোধ হইতেছে কেন?’ –’হজরত! উহার, আসে এবং পলাইয়া যায়। কোন মাহিনা পঞ্চাশজন, আবার কমিয়া দশজনও হয়। বুঝিলাম, জিম্মাদাররা কারচুপি করিতেছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা করা দরকার। নয়টি পাকা আনার পাড়িয়া কহিলাম, ‘মাথায় লম্বা চুল, খুবসুরত একটি লেড়কি আছে, হাল্কা দুলা –উহাকে পুরা একটি আনার দিবে। বাকিগুলিন সমান টুকরা করিয়া বাঁটিয়া দিবে। তোমরাও হিস্যা লইও।’ আনারগুলিন দুইজনে লইয়া গেল। উহাদের চেহারায় মালুম হইল জে তাজ্জব এবং খুশী হইয়াছে। আর মনে হইল, এইজন্যই আনার গাছটির জন্ম হইয়াছিল এবং সে এত অধিক মেওয়া ফলাইয়াছিল। এক্ষণে সে নিজেকে খালি করিয়া খুশি হইয়া মিটিমিটি হাসিতেছে। কেন একথা মনে হইল, আল্লাহ জানেন–

“কিছুদিবস বাদ জঙ্গলে ঢুকিয়াছি! আচানক দেখিলাম, জঙ্গল ইলাকার শেষে খোলা টুকরা জমিনে সেই বালিকাটি আপন মনে খেলিতেছে। ঘুরিয়া আমাকে দেখিবামাত্র স্থির হইয়া গেল। বালিকাটির-এ কি দেখিতেছি –চক্ষু দুইটি পিঙ্গলবর্ণ, রোশনি ঝিকমিক করিতেছে! পলকে হরিণী গায়েব হইল। সেইবোজ মগরেব বাদ এতিমখানায় জাইয়া হুকুমজারি করিলাম, ‘ওই লেড়কি জেন না পলাইয়া যায়। আর দেখ, উহাকে বাগদাদী কায়দাবহি (আরবি বর্ণপরিচয়) কিনিয়া দিবে। জালালুদ্দিন উহার শিক্ষার ভার লউক।’ জালালুদ্দিন হাজির ছিল! কহিল, হজরতের হুকুম তামিল করিতে ঢুটি ঘটিবে না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *