অধ্যায় ২০
লিটু নীলক্ষেত থেকে ফিরে এসেছে। তার হাতে হাসানের ডায়রি আর সেটার ফটোকপি। স্পাইরাল বাইন্ডিং করে ফেলেছে সে। যদিও তার বোন বলেছিলো শুধু ফটোকপি করতে।
বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পর তার বোন দরজা খুলে দিলো। মলির চোখমুখ ফোলাফোলা । সারারাত তার ঘুম আসে না। হাসান খুন হবার পর থেকেই এরকম চলছে । লিটু জানে না কবে তার বোন এই শোক কাটিয়ে উঠবে ।
“সবগুলো পাতা ফটোকপি করেছিস তো?”
লিটু ঘরে ঢুকতেই জানতে চাইলো মলি । তার হাতে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা কপিটা। “হ্যাঁ, সবগুলো পাতাই করেছি।”
“ওই ভদ্রলোককে ফোন করেছিস?”
“না।”
“কেন?”
“তুমি না বললে ফটোকপি করার পর ফোন করতে…”
“হ্যাঁ, ফটোকপি তো হয়েই গেছে, জলদি কল কর, আব্বা আসার আগেই ওদেরকে বিদায় করতে চাই,” তাড়া দিলো মলি ।
“চিন্তা কোরো না, আব্বার আসতে অনেক দেরি হবে।”
কথাটা বলেই বোনের কাছে মোবাইল ফোনটা চাইলো সে। মলি ফোনটা তার হাতে দিলে পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো লিটু। এটা সহকারী ইনভেস্টিগেটর জামানের। তার সাথে কথা বলার একফাঁকে এই নাম্বারটা দিয়েছিলো ভদ্রলোক।
কানে ফোন চেপে রেখেছে লিটু। পাশেই উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে মলি।
রিং হচ্ছে…
.
কাজি হাবিব লোকটা বিশালাকৃতির। বয়স মধ্য-চল্লিশে হবে । কুস্তিগীরের মতো শরীর। তবে জেফরি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো লোকটার বেশ বড়সড় ভুড়িও আছে । ফিজিক্যাল ট্রেইনারদের ভুড়ি কেন থাকে সে জানে না।
তাদের স্কুলের পিটি স্যারেরও বেশ বড়সড় বপু ছিলো। এজন্যে তারা আড়ালে আবডালে স্যারকে পেটালি’ বলে ডাকতো। পরে দেখেছে, শুধু তাদের স্কুলেই না, আশেপাশের অনেক স্কুলেই পিটি স্যারকে পেটালি বলে ডাকে ছাত্ররা।
তবে সেন্ট অগাস্টিনের মতো অভিজাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পিটি স্যারকে ছাত্ররা এই নামে ডাকে কিনা বুঝতে পারলো না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো বেশি সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটায় এ ক্ষেত্রে।
অরুণ রোজারিও যে-ই না জেফরির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালো সে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর অমনি কাজি হাবিবের মুখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা উধাও হয়ে গেলো।
জেফরির পাশেই বসলো ভদ্রলোক। মাথার চুল একেবারে ছোটোছোটো করে ছাটা। নাকের নীচে বেশ পুরু গোফ। দেখলেই মনে হয় জাঁদরেল একজন । কিন্তু জেফরির সামনে চুপসে যাওয়া বেলুন মনে হচ্ছে তাকে।
“সামনে কি ইন্টারস্কুল বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট?” পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার জন্য অন্যরকম কথাবার্তা দিয়ে শুরু করলো জেফরি বেগ।
কাজি হাবিব একটু অবাক হলো প্রশ্নটা শুনে। “জি।”
“আপনাদের টিম কেমন করবে বলে আশা করছেন?”
অরুণ রোজারিও চোখ পিটপিট করে জেফরির দিকে তাকাতে লাগলেন। জেফরি কি খুনের তদন্ত করতে এসেছে নাকি স্পোর্টস জার্নালিস্ট হয়ে ইন্টারভিউ নিতে এসেছে! মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না।
জামান খেয়াল করলো কাজি হাবিব নামের লোকটাও যারপরনাই বিস্মিত।
“ভালোই করবে মনে করছি, গতবার তো আমরা রানার্স-আপ হয়েছিলাম।”
“দ্যাটস গুড।”
“আমাদের অনেক ভালো প্লেয়ার আছে, ন্যাশনাল লেভেলে কমপিট করার মতো প্লেয়ার তারা…”
“আপনাদের কোনো প্লেয়ার কি ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে?”
অরুণ রোজারিওর চেহারাটা দেখার মতো হলো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না।
“না, তা নেই…তবে আশা করছি খুব জলদিই আমাদের দুএকজন প্লেয়ার ফার্স্টক্লাসে খেলতে পারবে,” বললো কাজি হাবিব।
“গুড,” কথাটা বলেই জেফরি তাকালো অরুণ রোজারিওর দিকে । “আপনার স্কুল দেখছি খেলাধুলায়ও বেশ ভালো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো তো…আমরা সব বিভাগেই ভালো করার চেষ্টা করি, তাই না, মি: হাবিব?”
“জি, স্যার…”
“আচ্ছা মি: হাবিব, গত বৃহস্পতিবার অ্যাঞ্জেলস টিমের এক কোচ এসেছিলো স্কুলে, সেটা কি আপনি জানেন?”
কাজি হাবিব একটু অবাকই হলো কথাটা শুনে। “হ্যা! কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”
অরুণ রোজারিও অস্থির হয়ে তাকালেন কাজি হাবিবের দিকে। “এসেছিলো নাকি?”
“জি, স্যার, প্রিন্সিপ্যালকে বললো কাজি হাবিব।
“ওই লোক কি স্কুলে আসার আগে আপনার সাথে দেখা করেছিলো?”
“তা। প্রথমে ফোন করে বললো তাদের নাকি প্লেয়ার শর্ট…কার কাছ থেকে যেনো শুনেছে আমাদের স্কুলে বেশ কয়েকজন ভালো প্লেয়ার আছে…তো আমি বললাম ঠিক আছে, নো প্রবলেম…আসুক, আমাদের প্লেয়ারদের দেখুক…সমস্যা কি? অ্যাঞ্জেলসের মতো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন টিমে স্কুলের কেউ চান্স পেলে সেটা তো দারুণ ক্রেডিটের ব্যাপার হবে, তাই না?”
“অবশ্যই,” বলেই জামানের দিকে চকিতে তাকালো জেফরি। ছেলেটা আগ্রহভরে তাদের কথা শুনে যাচ্ছে। আমি আসলে সেই কোচের সম্পর্কেই আপনার কাছে কিছু জানতে চাচ্ছিলাম।”
“কি জানতে চান, বলুন?” কাজি হাবিব বললো।
“ওই লোকটা স্কুলে কখন ঢুকেছিলো?”
“ওরা মনে হয় তিনটার পর ঢুকেছিলো-”
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো জেফরি বেগ, “ওরা মানে?”
“ওরা দুজন ছিলো…একজন কোচ, আরেকজন সম্ভবত টিমের কোনো কর্মকর্তা হবে।”
জামানের ফোনটা বেজে উঠলো এমন ক্লাইমেক্সের সময়। বিরক্ত হয়ে তাকালো জেফরি। বসের বিরক্তি দেখে জামান সবার কাছ থেকে এক্সকিউজ চেয়ে চলে গেলো বাইরে।
“হ্যাঁ, তারপর, বলুন?” জেফরি তাড়া দিলো কাজি হাবিবকে।
“ওরা আমার সাথে যোগাযোগ করে বুধবার। আমি ওদেরকে পরদিন আসতে বলি।”
“যোগাযোগটা কি ফোনে হয়েছিলো?” জানতে চাইলে জেফরি ।
“হ্যাঁ।”
“তারপর, বলুন?”
“আমি দুপুরের লাঞ্চ করি স্কুলের বাইরে, তো বৃহস্পতিবার লাঞ্চ করতে গেলে ওদের সাথে আমার রেস্তোরাঁয় দেখা হয়ে যায়। ওরাও ওখানে লাঞ্চ করছিলো। লাঞ্চ শেষ করে আমাকে সঙ্গে নিয়েই গাড়িতে করে স্কুলে চলে আসে ওরা।”
“ওই লোকগুলো আপনাকে কিভাবে চিনলো? আপনিই তো বললেন ফোনে যোগাযোগ হয়েছিলো আগের দিন?”
কাজি হাবিব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। “সেটা তো আমি জানি না । ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে নি।”
বুঝতে পারলো জেফরি। খুবই পেশাদার লোকজনের কাজ। দীর্ঘদিন। নজরদারি আর রেকির ফল হলো এই হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সামান্য একজন ক্লার্ককে খুন করতে এতো বড় পরিকল্পনা কেন?
মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেললো সে। পরে এ নিয়ে ভাবরে। “ওদের সাথে গাড়ি ছিলো?” জানতে চাইলে জেফরি।
“হুম।”
“গাড়িতে করে আপনারা তিনজন চলে এলেন স্কুলে?”
“জি।”
“তারপর?”
“আমার সাথে কথাবার্তা বললো, স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টটা ঘুরেটুরে দেখলো। ওদেরকে আমি বললাম স্কুল ছুটির পর ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্টের জন্য সিলেক্ট করা ছেলেরা প্র্যাকটিস করবে। ওরা বললো, ঠিক আছে। সেখান, থেকেই কিছু প্লেয়ারের সাথে কথা বলবে।”
“তারপর?” কৌতূহলী হয়ে উঠলো জেফরি।
“শুনেছি আমাদের একজন স্টুডেন্টকে তারা টিমে নিয়েছে।”
“শুনেছেন মানে? আপনি ওদের সাথে ছিলেন না?”
“না, আমার তো থাকার দরকার ছিলো না, ওরা ওদের মতো করে প্লেয়ার সিলেক্ট করেছে।”
“অর্থাৎ তারা বিকেলের দিকে কোর্টে প্র্যাকটিস করতে থাকা ছেলেদের মধ্য থেকে একজনকে সিলেক্ট করে চলে যায়?”
“হুম।”
“এরপর আপনার সাথে তারা আর যোগাযোগ করে নি?”
“না।”
“তাহলে আপনি কিভাবে জানলেন একজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে?”
“আমাকে দিপ্রো আর সায়েম নামের দুটো ছেলে এ কথা বলেছে।”
“কাকে সিলেক্ট করেছে জানেন?”
এমন সময় জামান এসে চুপচাপ জেফরির পাশে বসে পড়লো।
তুর্যকে,” বললো কাজি হাবিব ।
জেফরি লক্ষ্য করলো তুর্য নামটা শোনামাত্রই অরুণ রোজারিও কিছুটা চমকে উঠলেন ।
থুতনীর নীচে চুলকে নিলো জেফরি । একটু ভেবে বললো, “ওই লোকগুলো কি আপনাকে তাদের নাম বলেছে?”।
“বলেছে। কোচের নাম ম্যাকি, আর কর্মকর্তার নামটা যেননা কী…” মনে করার চেষ্টা করলো কাজি হাবিব ।
“ভুলে গেছেন?”
“আসলে আমার যা কথা হয়েছে ঐ কোচের সাথেই হয়েছে, কর্মকর্তার সাথে খুব একটা কথা হয় নি।”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ । তার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট : অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ সেজে দু’জন লোক সেন্ট অগাস্টিনে প্রবেশ করে। আর তার পর পরই খুন হয় জুনিয়র ক্লার্ক হাসান। তারা শুধু কোচের পরিচয়টাই ব্যবহার করে নি, সত্যিকারের কোচের নামটাও ব্যবহার করেছে । এটাও একটা কু। যারাই খুন করে থাকুক, তারা ম্যাকিকেও ভালো করে চেনে।
“লোক দুটোর বয়স কেমন হবে?”
“কোচের বয়স ত্রিশের মতো, আর কর্মকতার বয়স হবে তারচেয়ে একটু বেশি, ভদ্রলোকের মুখে চাপদাড়ি ছিলো,” বললো কাজি হাবিব।
“স্যার।”
জামানের দিকে ফিরলো জেফরি ।
“মিসেস হাসান আমাদেরকে উনার বাসায় আসতে বলছেন, গলা নামিয়ে অনেকটা চাপাকণ্ঠে বললো জামান। “খুবই নাকি জরুরি।”
মিসেস হাসান! “জরুরি?!” আস্তে করে বললো জেফরি ।
অধ্যায় ২১
নিহত হাসানের ডায়রিটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বসে আছে জেফরি বেগ । নোটবুক সাইজের একটি ডায়রি ।
একটু আগে হাসানের শ্যালক লিটু ফোন করে জামানকে। জেফরি তখন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল আর পিটি স্যারের সাথে কথা বলছিলো ।
মলি বলছে ডায়রিটা সে গতকাল রাতে পেয়েছে । আলমিরাতে হাসানের কাপড়চোপরের ভেতরে। হাসান যে ডায়রি লিখতো সেটা মলি জানতো তবে স্বামী হারানোর শোকে এ কথাটা ইনভেস্টিগেটরকে বলতে ভুলে গেছিলো । মলির কাছে মনে হয়েছে, ডায়রিটা থেকে হাসানের অনেক কথাই জানতে পারবে তারা।
নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে পুলকিত হলো জেফরি । খুব দ্রুত, একের পর এক কু আর নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছে সে। এই ডায়রিটা হয়তো গুরুত্বপূর্ন কিছু দিক নির্দেশনা দেবে ।
মলি আর তার ছোটো ভাই লিটু বসে আছে বিছানার উপর। জেফরি আর জামান দুটো চেয়ারে।
“হাসান সাহেব কি প্রতিদিনই ডায়রি লিখতেন?” জিজ্ঞেস করলো জেফরি।
“আমি ঢাকায় আসার পর থেকে নিয়মিত লিখতো না। তবে ওর কাছ থেকে শুনেছি এর আগে নাকি নিয়মিতই লিখতো,” মলি বললো।
“ডায়রিটা আপনি পড়েছেন?”
জেফরির দিকে তাকালো মলি । “না।”
“ডায়রি পড়ার মতো মনমানসিকতা আপার নেই, বুঝতেই পারছেন,” লিটু আস্তে করে বললো। “আমি অবশ্য আপাকে পড়তে বারণ করেছিলাম। ওটা পড়লে খামোখাই মন খারাপ হতো…”।
জেফরি কিছু বললো না। চেয়ে রইলো লিটুর দিকে। তা ঠিক। কয়েকদিন আগে খুন হওয়া স্বামীর ডায়রি পড়াটা মোটেও সুখকর কিছু হতো না।
“আমি চাই হাসানের খুনি ধরা পড়ক…তার উপযুক্ত শাস্তি হোক, তাই ভাবলাম আপনাকে এটা দিয়ে দিলে হয়তো তদন্তে সাহায্য করা হবে,” মলি বললো ।
“খুব ভালো কাজ করেছেন। আমি নিশ্চিত, এই ডায়রি থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো।”
“তদন্তের কাজ কতোদূর এগোলো? কিছু বের করতে পেরেছেন?” মলি জানতে চাইলো।
জেফরি একটু ভেবে নিলো । “মাত্র তদন্ত শুরু করেছি, কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। আশা করছি খুব জলদিই আসামী ধরতে পারবো।”
মলি আর লিটু চকিতে একে অন্যের দিকে তাকালো।
“আপনার বাবা কোথায়…উনি কি চলে গেছেন?”
“না। হাসান ভায়ের কবর জিয়ারত করতে গেছেন,” বোনের হয়ে জবাব দিলো লিটু।
“আপনি নাকি দেশের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন?” জেফরি বললো নিহত হাসানের স্ত্রীকে।
মাথা নীচু করে ফেললো মলি। “জি।”
“কবে যাচ্ছেন?”
মুখ তুলে তাকালো লিটুর বোন । “কাল-পরশু।”
একটু গাল চুলকে নিলো জেফরি। “আপনার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাবেন। আপনার সাথে আমাদের কথা বলার দরকার হতে পারে।”
“ঠিক আছে।”
কথাটা বলেই মলি তার নাম্বারটা বলে দিলে জামান সেটা তার ফোনে টুকে নিলো।
“ঠিক আছে, উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ। “আমরা তাহলে উঠি।” ডায়রিটা বেশ ছোটো হওয়ায় জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে ওটা রেখে দিলো।
তাদেরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো লিটু।
জামানকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় জেফরির চোখ গেলো পাশের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে। থমকে দাঁড়ালো সে।
ব্যাপারটা জামানও খেয়াল করলো। তাদের মধ্যে চোখাচোখি হতেই জেফরি বললো, “চলো দেখি, মিলন সাহেব এসেছে কিনা…”
দরজায় টোকা মারলো জামান। মনে মনে সে আশা করলো মিলন সাহেবের অদ্ভুত দুই স্ত্রীদের একজনকে। আজকে না জানি কী করে তারা।
কোনো সাড়াশব্দ নেই। জামান আবারো দরজায় টোকা দেবে এমন সময় সেটা আস্তে করে খুলে গেলো। টোকা মারতে উদ্যত হাতটা সরিয়ে নিলো জামান।
স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স প্যান্ট পরা এক যুবক দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ পেশীবহুল শরীর। দেখতেও সুপুরুষ। ভুরু কুচকে চেয়ে আছে তাদের দিকে।
“কাকে চাই?” জেফরি আর জামানকে আপাদমস্তক দেখে বললো যুবক।
“মিলন সাহেব আছেন?”
জামানের কথাটা শুনে যুবক একটু চুপ করে থেকে মাথা দোলালো। “না। বাসায় নাই।”
“উনার স্ত্রীরা আছে?” জামান বললো।
“একজন মার্কেটে গেছে, আরেকজন বাথরুমে …” যুবক কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো। “আপনারা কারা?”
“আমরা হোমিসাইড থেকে এসেছি…”
“কি সাইড?” বুঝতে না পেরে বললো যুবক।
“পুলিশ ডিপার্টমেন্ট,” পাশ থেকে বলে উঠলো জেফরি বেগ।
“পুলিশ?!” স্বাভাবিকভাবেই ভড়কে গেলো যুবক। “ঘটনা কি?”
“তার আগে বলুন, আপনি কে?” জেফরি জানতে চাইলো।
“আমি সুমন, মিলনের দ্বিতীয় ওয়াইফের বড় ভাই,” যুবক কথাটা বলেই গাল চুলকালো।
জেফরির কাছে কেন জানি মনে হলো কথাটা সত্যি নয়। ছেলেটাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। মাথার চুল উসকোখুসকো। এই শীতের দিনেও গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, মিলন সাহেবের তরুণী স্ত্রীর সাথে সুমন নামের এই যুবকের কোনো সম্পর্ক আছে, তবে সেটা রক্তসম্পর্ক নয়। হয়তো স্বামীর অনুপস্থিতিতে গোপন প্রেমিককে বাড়িতে ডেকে আনা হয়েছে।
“মিলন সাহেব কি ঢাকায় ফেরেন নি?” জানতে চাইলো জামান। জেফরি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সুমন নামের যুবককে ।
“না।”
“কবে ফিরবে, বলতে পারেন?”
ঠোঁট উল্টালো সুমন। “আমি কিভাবে বলবো!…আমি তো মাত্র এলাম এখানে।”
“আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?”
“বগুড়া।”
“কি করেন?”
“আমি জাপানে ছিলাম। আট দিন আগে দেশে এসেছি।”
“ও,” বললো জামান। তার বস জেফরির দিকে তাকালো ।
“কেসটা কি?” কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলো সুমন।
“পাশের ফ্ল্যাটের হাসান সাহেব কয়েক দিন আগে খুন হয়েছেন, আমরা সে ব্যাপারে মিলন সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
জামানের কথা শুনে যুবক অবাক হলো। “বলেন কি!” একটু ঢোক গিলে আবার বললো, “কোথায় খুন হয়েছে? ওই ফ্ল্যাটে?”
“না,” জামানও কিছুটা বিরক্ত এখন। “উনি যেখানে কাজ করতেন, সেই স্কুলে…”
“তাহলে মিলনরে কেন খুঁজছেন?”
“উনার সাথে এ ব্যাপারে আমরা একটু কথা বলবো,” এর বেশি বলতে চাইছে না জামান। পাশ থেকে জেফরি আস্তে করে জামানের কঁনুই ধরে টান দিলো। খামোখা কথা বলে কী লাভ। চলে যাওয়াই ভালো ।
“বাপরে…খুনখারাবির কেসে মিলনরে খুঁজছেন..আমার তো শুনেই ভয় করছে।”
“ঠিক আছে, আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত,” বললো জামান।
“ওকে ওকে,” বললো সুমন । তার চোখমুখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটে নি । কিন্তু জেফরির কাছে কেন যেনো মনে হলো যুবকটি বিস্মিত হবার ভান করছে। যাইহোক জামানকে নিয়ে যে-ই না ঘুরে দাঁড়াবে অমনি ঘরের ভেতর থেকে একটা ফোন বাজার শব্দ হলো।
পেছন ফিরে তাকালে সুমনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো জেফরির। একটা হাসি দিলো সে।
ঘুরে দু’পা সামনে এগোতেই জেফরি শুনতে পেলো ভেতর থেকে একটা নারী কণ্ঠ নাকি সুরে বলছে : “অ্যাই মিলন…তুমার ফোন!”
ততোক্ষণে জামান সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে চলে গেছে। আচমকা জেফরির গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো । ঘুরে দাঁড়ালো সে । আবারো সুমন নামের যুবকের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। দরজা ফাঁক করেই দাঁড়িয়ে আছে, তবে এবার তার চেহারায় আর হাসি দেখা গেলো না । স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেফরির দিকে ।
পুরো ব্যাপারটার স্থায়ীত্ব বড়জোড় দু’সেকেন্ডের মতো হবে ।
জেফরি বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেলো দরজার দিকে। সুমন নামের যুবকটি প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলেও পারলো না। ছুটে এসে নিজের ডান পায়ের পাতাটা দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে জেফরি। সেজন্যেই দরজা বন্ধ করা সম্ভব হয় নি ।
সুতীব্র ব্যাথায় নাকি জামানের মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে, ঠিক বোঝা গেলো না, জেফরি বেগ চিৎকার করে উঠলো।
সিঁড়ির উপর থমকে দাঁড়ালো জামান । মুহূর্তে ঘুরে দেখতে পেলো তার বস্ দরজার ভেতরে এক পা ঢুকিয়ে দু’হাতে দরজাটা ঠেলে যাচ্ছে সে। তবে ভেতর থেকে সুমন নামের সেই যুবক গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করছে ।
জামান দৌড়ে এসে হাত লাগালো। সজোরে ধাক্কা দিলো দরজায় । কিন্তু যুবকের গায়ে যেনো অসুরের মতো শক্তি। দরজাটা ঠেলে কয়েক ইঞ্চির বেশি ফাঁক করতে পারলো না জামান। জেফরি বেগ নিজের পাটা সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনলো। ব্যাথায় চোখমুখ কুচকে গেলো তার।
জেফরি তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে শোল্ডারহোলস্টারে রাখা পিস্তলটা দ্রুত বের করে নিলে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেললো সেই যুবক। এক ঝটকায়, প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে। শক্তিতে জামান পেরে উঠলো না তার সাথে ।
“লাথি মারো!” চিৎকার করে বললো জেফরি । তার নিজের পায়ের অবস্থা খুব খারাপ।
জামান লাথি মারলো দরজায় ।
“এই লোকটাই মিলন!” জেফরি চিৎকার করে বললো। জামান আরেকটা লাথি মারলো, কিছুই হলো না।
জেফরি বাম হাতে জামানকে সরিয়ে একটু পিছিয়ে গেলো, তারপর ডান কাঁধটা দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারলো বন্ধ দরজায় । ঘ্যা করে শব্দ হয়ে দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে জামান তাকে সরিয়ে দিয়ে লাথি মারতেই হুরমুর করে খুলে গেলো দরজাটা। এরইমধ্যে জামানও পিস্তল হাতে তুলে নিয়েছে। জেফরির আগে সে-ই ঢুকে পড়লো ভেতরে ঢোকার আগে চিৎকার করে বললো, “স্যার, আপনি ব্যাকআপে থাকেন…”
একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জেফরি বেগও ঢুকে পড়লো ভেতরে।
অধ্যায় ২২
ঘরে কোনো বাতি জ্বলছে না। একটা ভোলা জানালা আর মিউট করা টিভির আলোয় স্পষ্ট দেখা গেলো মেঝেতে একটা মেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। গায়ে তোয়ালে পেচানো। কাছে আসতেই জেফরি চিনতে পারলো । মিলনের প্রথম স্ত্রী। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে তার। পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি অবশ্য।
মিলন তার স্ত্রীকে প্রচন্ড জোরে ঘুষি মেরে চলে গেছে ভেতরের ঘরে। মহিলার বোকামির জন্য রেগেমেগে মনের ঝাল মিটিয়েছে সে।
জামান তার পেছন পেছন ছুটে গেলো ভেতরের ঘরটায়। একটু পরই খোঁড়াতে খোঁড়াতে জেফরিও চলে এলো সেই ঘরে।
অবাক করা ব্যাপার, ঘরে কেউ নেই । যেনো উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই তারা বুঝতে পারলো । ঘরের পূর্ব দিকে একটা বেলকনি আছে। এটা এই বাড়ির পেছন দিক । জামান আর জেফরি বেলকনিতে এসে দেখলো নীচে একটা একতলা বাড়ি। সেই বাড়ির ছাদে অনায়াসে নেমে গেছে মিলন।
চারপাশে দ্রুত দেখে নিলো জেফরি। জামানও অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে।
জেফরির চোখেই ধরা পড়লো প্রথম।
নীচের একতলা বাড়ির ছাদে একটা বড়সড় পানির ট্যাঙ্কি । ডান দিকের একটা তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে এক অল্পবয়সী ছেলে একবার ট্যাঙ্কি আরেকবার পিস্তল হাতে জেফরি এবং জামানের দিকে তাকাচ্ছে অবাক চোখে।
ট্যাঙ্কির পেছনে!
“ট্যাঙ্কির পেছনে?” একটু জোরেই বললো জেফরি । সঙ্গে সঙ্গে জামান তাকালো সেদিকে । জেফরি কিছু বলার আগেই জামান তার পিস্তলটা কোমরে খুঁজে বেলকনি থেকে নেমে শরীরটা ঝুলিয়ে দিলো।
“জামান!” জেফরির মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলে ঝুলে থাকা অবস্থায় জেফরির দিকে তাকালো জামান। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না । হাতটা ছেড়ে দিতেই ধপাস করে নীচের একতলার ছাদে নেমে পড়লো সে।
জেফরি ট্যাঙ্কির দিকে তাকালো । মিলন বুঝতে পেরে ট্যাঙ্কির পেছন থেকে দৌড়ে চলে যাচ্ছে পাশের একটা টিনের ছাদের দিকে।
জামান দ্রুত পিস্তলটা কোমর থেকে হাতে নিয়ে ছুটে চললো মিলনের পেছন পেছন ।
বেলকনি থেকে দৃশ্যটা দেখে যাচ্ছে জেফরি বেগ।
আশেপাশে অনেকগুলো বাড়িই একতলা, আর অনেকগুলোরই টিনের ছাদ। মিলনের গায়ে একটা টি-শার্ট। ঘরে ঢুকে দ্রুত পরে নিতে ভুল করে নি সে ।
জামানও এখন টিনের ছাদে চলে এসেছে। মিলনের থেকে তার দূরত্ব বড়জোড় বিশ গজ। অ্যাফেক্টিভ রেঞ্জের মধ্যে আছে টার্গেট।
“গুলি করো!” বেলকনি থেকে চিৎকার করে বললো জেফরি ।
জামান সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলটা তাক করে ফেললো। কিন্তু জামানের মতো মিলনও জেফরির কথাটা শুনতে পেয়েছে। চট করে সে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে বসলো। জামান আর জেফরি কয়েক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারলো না। এরপরই জামান দৌড়ে চলে গেলে সেখানে যেখান থেকে মিলন লাফ দিয়েছে। একটু উপুড় হয়ে দেখেই পেছন ফিরে জেফরির দিকে তাকালো সে।
“স্যার! নীচে একটা গলি আছে…গলিতে নেমে গেছে!”
কথাটা বলেই জামান আবারো পিস্তলটা কোমরে খুঁজে নিলো । জেফরি কিছু বলার আগেই মিলনের মতো লাফ দিয়ে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেলো সে। জেফরি কয়েক মুহূর্ত ভেবেই উল্টো দিকে ছুটে গেলো । খোঁড়া পায়ে অনেকটা দৌড়েই চলে এলো মিলনের স্ত্রী যেখানে পড়েছিলো সেখানে। মহিলা এখন উঠে বসেছে। হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে কাঁদছে নিঃশব্দে।
পিস্তল হাতে জেফরিকে ছুটে আসতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালে তার দিকে । জেফরি অবশ্য থামলো না । সোজা চলে গেলো দরজার দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় টের পেলো পায়ের পাতাটা খুব সম্ভবত মচকে গেছে।
তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। সেই যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে নেমে এলো নীচ তলায় ।
বাড়িটার পেছন দিকে যে গলিটা চলে গেছে সেখানে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে গেলো সে। কিছু লোক দৃশ্যটা দেখে ভয়ে সরে গেলো। এক মোটামতো মহিলা হেলেদুলে আসছিলো, জেফরির সামনে পড়ে যেতেই কানফাটা চিৎকার দিয়ে উঠলো, এসব কিছু আমলে না নিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে চললো জেফরি বেগ ।
হঠাৎ একটা গুলির শব্দ ভেসে এলো ।
শুলি!
খুব কাছ থেকেই আওয়াজটা এসেছে, জেফরি নিশ্চিত । পায়ের ব্যাথাটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে ছুটে গেলো সেখানে ।
সে অনেকটাই নিশ্চিত মিলনের কাছে কোনো পিস্তল নেই। তার মানে গুলিটা করেছে জামান।
আতঙ্কগ্রস্ত লোকজনের চিৎকার শুনতে পেলো সে।
এবার আরেকটা গুলির শব্দ।
জেফরির মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। জামান আর জেফরি ব্যবহার করে নাইন এমএম ক্যালিবারের পিস্তল । এটার ফায়ারিংয়ের শব্দ জেফরির কাছে বেশ পরিচিত।
কিন্তু শেষ গুলিটার যেরকম শব্দ হয়েছে সেটা তার কাছে একদম অচেনা।
মাই গড!
অধ্যায় ২৩
একটা টিনের ছাদ থেকে মিলন লাফ দিয়ে নেমে পড়লে জামানও লাফিয়ে নেমে পড়ে নীচের সংকীর্ণ একটি গলিতে। তবে মিলনের মতো জামান দক্ষতার সাথে ল্যান্ড করতে পারে নি। প্রায় আট ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ার কারণে তার ডান পায়ের গোড়ালি কিছুটা মচকে যায়।
পরিস্থিতির কারণেই হোক আর মিলনকে ধরার দৃঢ়প্রতীজ্ঞ মনোভাবের জন্যই হোক, প্রথমে সে কিছুই টের পায় নি। চোখের সামনে মিলনকে দৌড়ে যেতে দেখে সেও তার পিছু নেয় ।
গলিটা একদম নিরিবিলি ছিলো ।
মিলন আচমকা ডান দিকে মোড় নিলে জামানও তাই করে, আর তখনই বুঝতে পারে তার ডান পায়ের গোড়ালিতে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। চিনচিনে ব্যাথাটা আমলে না নিয়ে মিলনের পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে সে। আচমকা, তাকে একেবারে অপ্রস্তুত করে দিয়ে গলির বাম দিকের একটা বৈদ্যুতিক পিলারের আড়ালে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় মিলন।
ঠিক তখনই জিনিসটা জামানের চোখে পড়ে ।
লোকটার হাতে পিস্তল।
তার ধারণাই ছিলো না এর কাছে পিস্তল থাকতে পারে। ভড়কে গেলেও জামান দেরি না করে গুলি চালায় তাকে লক্ষ্য করে । গুলিটা অব্যর্থই ছিলো, যদি না অস্ত্রধারী লোকটার সামনে একটা পিলার থাকতো।
জামান যখন দেখলো গুলিটা টার্গেটকে ঘায়েল করতে পারে নি তখনই বুঝে যায় একদম অরক্ষিত অবস্থায় আছে সে। দ্বিতীয় গুলি না চালিয়ে বুদ্ধিমানের মতো গলির বাম দিকের একটা বাড়ির দেয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
একটু দেরি হলেই গুলিটা তার শরীরে বিদ্ধ হতো। লক্ষ্যচ্যুত হবার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। একেবারে নাকের সামনে দিয়ে উত্তপ্ত বুলেটটা যখন চলে যায় সেটার ঝাঁপটা টের পেয়েছিলো জামান।
গুলির শব্দ প্রকম্পিত করে তোলে সংকীর্ণ গলিটা ।
মিলন আরেকটা গুলি করার আগেই জামান দেখতে পায় তার ঠিক সামনেই একটা বাড়ির সদর দরজা খোলা। মুহূর্ত দেরি না করে এক লাফে ঢুকে পড়ে সেই দরজার ভেতরে।
মিলন গুলি করতে গিয়েও কেন যে গুলি করে নি জামান সেটা জানে না । তার ধারণা ছিলো একটা সুযোগ সে নেবে । কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমাণ করে আর কোনো গুলি করে নি।
যে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো জামান, সেই বাড়িতে লোকজনের আতঙ্কগ্রস্ত চিৎকার শুনতে পায়। হঠাৎ কাবোর পায়ের শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে ওঠে সে।
কেউ দৌড়ে চলে যাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে জামান দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পায় পিলারের আড়ালে মিলন নেই ।
পালিয়েছে।
জামান পিস্তল হাতে বের হয়ে আসে, গলি দিয়ে আবারো দৌড়াতে শুরু করে, তবে এবার তার গতি আগের মতো দ্রুত নয়, কারণ সে জেনে গেছে মিলনের হাতে পিস্তল আছে ।
চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগোতে শুরু করে জামান।
গলিটা বড়জোর পাঁচ-ছয় ফুট চওড়া । দু’পাশে সারি সারি বাড়িঘর । মাঝেমধ্যেই আরো সংকীর্ণ গলি চলে গেছে ডানে-বায়ে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিত। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে অস্ত্রধারী সামনে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।
নাকি সটকে পড়েছে?
নিশ্চিত হতে পারে নি জামান।
হঠাৎ তার মনে হয় চারপাশ থেকে এতোক্ষণ ধরে যে চাপা আর্তনাদ আর ভয়ার্ত মানুষের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো সেটা যেনো অদৃশ্য কোনো ইশারায় থেমে গেছে। শুধু ভো-ভো শব্দ হচ্ছে তার কানে।
মাথাটা দু’পাশে ঝাঁকিয়ে পরিস্কার করে নেয়। তার সন্দেহ হয়, প্রচণ্ড নাভার্সনেস আর টেনশনের কারণে শ্রবণশক্তিতে ব্যঘাত ঘটছে হয়তো।
ঠিক তখনই টের পায় দম ফুরিয়ে রীতিমতো হাফাচ্ছে। এতোক্ষণ দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকার কারণে ব্যাপারটা খেয়াল করে নি ।
নিজের হৃদস্পন্দনটা কানে শুনতে পায় জামান।
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে সে। আস্তে আস্তে হেঁটে এগোতে থাকে সামনের দিকে। পিস্তলটা দু’হাতে ধরে নাক বরাবর তুলে তাক করে রাখে । একটু মুভমেন্ট নজরে এলেই গুলি চালাবে ।
কিন্তু অস্ত্রধারী না হয়ে যদি সাধারণ কোনো লোকজন হয়ে থাকে?
কথাটা মনে পড়তেই নিজেকে আরো বেশি অসহায় মনে করে সে।
একটু একটু করে এগোতে এগোতে গলির শেষ মাথায় এসে পড়ে । একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে দুদিক দিয়ে । সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে নি। অস্ত্রধারী যদি গলির শেষ মাথায় এসে ঘাপটি মেরে থাকে?
কিন্তু কোন্ দিকে?
ডানে? বায়ে? সে জানে না।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
দ্রুত বাম দিকে পিস্তল তাক করে ডান দিকে পিঠ দিয়ে আড়াআড়িভাবে গলি থেকে বেরিয়ে আসে সে।
কেউ নেই!
বড় রাস্তাটা বাম দিক দিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। কিন্তু অস্ত্রধারীর টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না।
ডান দিকে, তার পেছনে কিছু একটা নড়ে উঠতেই সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে সে বুঝে যায় মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে ।
হায় আল্লাহ্!
এক ঝটকায় ডান দিকে ঘোরার চেষ্টা করতেই মাথার পেছনে শক্ত কিছু এসে আঘাত হানে। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে একটা শক্ত হাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান হাটুতে পেছন থেকে সজোরে লাথি মারা হলে সে বসে পড়ে। হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়ে যায়।
আরেকটা আঘাত নেমে আসে তার উপর।
কিডনি বরাবর একটা ঘুষি!
সঙ্গে সঙ্গে মাথার তালুর চুল খপ করে ধরে একটা হেচকা টান।
পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে । জামান কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পায় রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার দিকে ঝুঁকে আছে সুমন নামে পরিচয় দেয়া মিলন। পিস্তল তাক করে রেখেছে সে। মুখে ক্রুড় হাসি। লোকটার নার্ভ একদম স্বাভাবিক।
“একদম নড়বি না!” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে কথাটা। জামান টের পায় তার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে। লোকটার ভাবভঙ্গি খুবই বিপজ্জনক।
গুলির আওয়াজটা শোনার আগে জামানের শুধু মনে হয়, এই লোকটাই সম্ভবত হাসানের খুনি। এখন সেও হাসনের মতো ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে ।
তারপরই কান ফাঁটা শব্দ।
.
গুলির শব্দটা জেফরি বেগকে উদভ্রান্ত করে ফেলেছে। সে জানে এটা জামানের পিস্তল থেকে ছোঁড়া হয় নি।
তাহলে?
এ নিয়ে তার মনে কোনো দ্বিধা নেই । মিলন নামের লোকটাই ফায়ার করেছে। জামানের যদি খারাপ কিছু না হয়ে থাকে তাহলে তো পাল্টা গুলির আওয়াজ আসতো! বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে জামান।
এক পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যতোটা দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব দৌড়াচ্ছে সে । সমস্যা হলো ঠিক কোন্ গলিতে ঢুকবে বুঝতে পারছে না। এর আগে ঢাকা শহরের এই জায়গায় কখনও আসে নি। এখানকার পথঘাট তার একদম অচেনা । তবে পুরনো ঢাকায় মানুষ হবার কারণে অলিগলির ব্যাপারে তার ভালো ধারণাই আছে। কোটা কানাগলি আর কোন গলিটা বড় রাস্তার সাথে গিয়ে মিশেছে সেটা গলির ধরণ দেখলেই বুঝতে পারে।
তার হাতে পিস্তল দেখে গলির আশেপাশে কিছু বাড়ি থেকে ভয়ার্ত মানুষ উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা তার নজর এড়ালো না ।
হাসানের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুটা এগোবার পরই ডান দিকে চলে গেছে গলিটা । তারপর আবারো অল্প একটু ডানে গিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে । সে জানে, মিলন উত্তর দিকের একটা গলিতেই লাফ দিয়েছে।
সোজা কিছুটা পথ এগিয়ে যাবার পর আরেকটা গুলির শব্দ প্রকম্পিত করলো চারপাশ। সংকীর্ণ গলিতে সেটা আরো ভয়াবহ শোনালো।
এটাও জামানের নয়! সে একদম নিশ্চিত। কারণ গুলির শব্দের পর পরই জামানের আর্তনাদটা তার কানে বজ্রপাতের মতো আঘাত করলো ।
মৃত্যু যন্ত্রণার আর্তনাদ!
জামান। তার ভেতরের কণ্ঠস্বরটা চিৎকার করে বললো । মুহূর্তেই এক পাশবিক শক্তি এসে ভর করলো তার মধ্যে। বুঝতে পারলো আওয়াজটা কোত্থেকে এসেছে।
সামনের ডান দিকে মোড় নিয়েছে গলিটা । সেখানে ছুটে গেলো সে। একটু এগোতেই দেখতে পেলো মিলন নামের লোকটি পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা গলির মোড়ে। কিন্তু তারচেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো মিলনের পায়ের সামনে তার সহকারী জাযান পড়ে আছে।
জামান গুলিবিদ্ধ!
মিলন খেয়ালই করছে না জেফরিকে। তার সমস্ত মনোযোগ জামানের দিকে । জামানকে কিছু একটা বলছে সে । ছেলেটা মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতমাচ্ছে।
দু’হাত তুলে বাধা দিতে চাইছে।
কিংবা প্রাণ ভিক্ষা!
যদিও মিলনের হাতে পিস্তলটা জামানের দিকে তাক করা নেই, তারপরও দূর থেকে জেফরি বুঝতে পারছে লোকটার ভাবভঙ্গি খুবই বিপজ্জনক।
প্রায় নিঃশব্দে কয়েক পা এগিয়ে গেলো জেফরি বেগ। তার হাতের পিস্তলটা মিলনের দিকে তাক করা । খুব সম্ভব অ্যাফেক্টিভ রেঞ্জের ভেতরে চলে এসেছে এখন।
“ফ্রিজ!” ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে গর্জে উঠলো জেফরি বেগ।
মিলন চমকে তার দিকে তাকাতেই পিস্তল ধরা হাতটা তোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু জেফরি সতর্ক ছিলো। “একদম নড়বে না!” আবারো গর্জে উঠলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।
মিলন বরফের মতো জমে গেলো। লোকটার দুচোখে যেনো আগুন। জেফরি জানে, যেকোনো মুহূর্তে মিলন তাকে গুলি করার চেষ্টা করবে। সতর্ক হয়ে উঠলো সে। মিলনকে কোনো সুযোগ দেবে না। একটু নড়াচড়া করলেই সোজা গুলি করে দেবে। একটা নয়, অনেকগুলো। যতোক্ষণ না তার দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনা থাকে।
মিলনও বুঝতে পারছে একটু নড়লেই জেফরি তাকে গুলি করে দেবে। সে আস্তে করে বাম হাতটা তুলে জেফরিকে আশ্বস্ত করলো ।
“পিস্তলটা ফেলে দাও!” ধমকের সুরে বললো জেফরি । “কোনো চালাকি করবে না!”
মিলন আবারো বাম হাতের তালু উঁচিয়ে জেফরিকে আশ্বস্ত করলো। একটু ঝুঁকে নীচু হয়ে পিস্তলটা মাটিতে নামিয়ে রাখতে যাবে অমনি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে থমকে গেলো সে। কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। জেফরির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো তার চোখমুখ কুচকে গেছে। সেই চোখের ভাষা পড়তে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না মিলনের। জেফরির দৃষ্টি অনুসরণ করে একটু পেছনে তাকালো।
একদল যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে!
তাদের সবার হাতে লাঠি । চোখে কালো চশমা!
একটা ক্রুড় হাসি ফুটে উঠলো মিলনের ঠোঁটে ।
জেফরি বেগের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো এমন একটি অবস্থায় পড়ে গেছে যেখানে সে খুবই অসহায়।
কিন্তু তারচেয়েও বড় বিপদ হলো, তার সামনে থাকা মিলন নামের ভয়ঙ্কর লোকটি সেটা বুঝে গেছে । পিস্তলের মুখেও তার ঠোঁটে বাঁকা হাসির আভাস দেখতে পাচ্ছে সে ।
মিলনের পেছনেই ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে লোকগুলো।
তাদের সবার হাতে লাঠি । চোখে কালো চশমা । সবাই যুবক { লাঠিগুলো একসাথে রাস্তার কংক্রিটে ঠকঠক শব্দ করছে। শব্দটা জেফরির কানে হাতুড়ি পেটার মতো শোনাচ্ছে এখন ।
এরা এখানে কেন? এতোগুলো একসাথে!
মিলনের দিকে তাকালো সে। লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পিস্তল ধরা হাতের দিকে তাকালো জেফরি । সেই হাতটা উঠে আসছে ধীরে ধীরে।
জেফরি অসহায়। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কেবল । কিছুই করতে পারলো না।
চশমা পরা লাঠি হাতে লোকগুলো মিলনের ঠিক পেছনে চলে এসেছে। এখন। জেফরি জানে সে গুলি করতে পারবে না। কখনই পারবে না।
কিন্তু মিলন?
এখনও তার ঠোঁটে বাঁকা হাসির আভাস লেগে রয়েছে । আস্তে করে পিস্তল ধরা হাতটা জেফরির দিকে তাক করে চোখ টিপে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে প্রকম্পিত হলো সংকীর্ণ রাস্তাটি।
জেফরির শুধু মনে হলো কেউ তার বুকে সজোরে হাতুড়ি চালিয়েছে। ঠিক বুকের বাম দিকে। যেখানে হৃদপিণ্ড থাকে!
গুলির আঘাতে কয়েক পা পেছনে টলে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেলো কংক্রিটের রাস্তার উপর ।
আমি গুলি খেয়েছি।
টের পেলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। পিস্তলটা আর তার হাতে নেই । কোথাও ছিঠকে পড়ে গেছে। খুকখুক করে একটু কেশে উঠলো, কিন্তু বুঝতে পারলো না মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়েছে কিনা।
সংকীর্ণ রাস্তার দু’পাশে থাকা সারি সারি চার-পাঁচ তলার বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ দেখতে পেলো । সেই আকাশে নিঃসঙ্গ এক চিল উড়ে বেড়াচ্ছে আয়েশি ভঙ্গিতে ।
তার কানে লোকজনের কোলাহলের শব্দটা এলো। চিৎকার চেঁচামেচি আর ছোটোছুটির আওয়াজ। তবে সব আওয়াজ ছাপিয়ে যাচ্ছে একটা কণ্ঠ।
“স্যার!…স্যার!…”
প্রাণপণে, জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে জামান চিৎকার করে যাচ্ছে।
জেফরি জানে একটু পরই এই শব্দটা আর শুনতে পাবে না । উপরের আকাশটাও আর দেখতে পাবে না । লোকজনের যে হৈহল্লা হচ্ছে সেটাও নিঃশব্দ হয়ে উঠবে।
তারপর সব কিছু অন্ধকার!
কিন্তু সব কিছু অন্ধকার হবার আগে জেফরি বেগ চমৎকার একটি দৃশ্য দেখতে পেলো।
বাম দিকের একটি চার-পাঁচ তলার উপরে, বারান্দার রেলিং থেকে অল্পবয়সী এক ছেলে নিষ্পাপ আর ভীত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।
অধ্যায় ২৪
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছে হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদের গাড়ি। খবরটা শোনামাত্র অস্থির হয়ে পড়েছে ভদ্রলোক। রমিজ লস্কর যদিও জানিয়েছে জেফরির কিছু হয় নি কিন্তু তার মন বলছে খারাপ একটা ঘটনা ঘটে গেছে। হয়তো বেশি মর্মান্তিক কিছু, আর তাই দুঃসংবাদটি তাকে এখনও জানাচ্ছে না।
রমিজ শুধু বলেছে কিছুক্ষণ আগে জেফরি আর জামান নিহত হাসানের বাড়ি থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাতপরিচয়ের এক দুষ্কৃতিকারীর হামলার শিকার হয়েছে। তারা দুজনেই এখন মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে রয়েছে ।
তেমন কিছু না হলে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নেয়া হবে কেন?
মহাপরিচালকের এ কথায় রমিজ লস্কর আমতা আমতা করে বলেছে, জামান গুলিবিদ্ধ হয়েছে ।
মাই গড! আর জেফরির?
রমিজ বলেছে তার তেমন কিছু হয় নি। কিন্তু মহাপরিচালকের মন বলছে তার কাছ থেকে বড় একটা দুঃসংবাদ লুকানোর চেষ্টা করছে তার অধীনস্তরা। সঙ্গে সঙ্গে জেফরি বেগের সেলফোনে কল করে সে, কিন্তু সেটা বন্ধ । জেফরির চিন্তায় রীতিমতো অস্থির হয়ে ওঠে ভদ্রলোক।
রমিজকে নাকি জেফরি নিজে ফোন করে জানিয়েছে এই খবরটা, তবে সেই ফোনটা ছিলো স্থানীয় থানার এক এসআইয়ের ।
জেফরির যদি কিছু না হয়ে থাকে তাহলে তার ফোনটা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কেন?
রমিজ লস্কর এর কোনো সদুত্তর দিতে পারে নি । ছেলেটার আচার আচরণ বেশ সন্দেহজনক ঠেকেছে ফারুক আহমেদের কাছে, সেজন্যে নিজেই ছুটে যাচ্ছে হাসপাতালে।
রমিজ বার বার বলেছে, তার যাবার দরকার নেই, হোমিসাইড থেকে এরইমধ্যে দু’তিনজন চলে গেছে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে । কিন্তু ফারুক আহমেদ কোনো কথাই শোনে নি ।
গাড়িতে ওঠার পর রমিজ যেটুকু বলেছে তাতে মনে হচ্ছে পরিস্থিতি খুবই সিরিয়াস। বিশ্বাসই হতে চাইছে না তার দু’দু’জন কর্মকর্তা তদন্তের কাজ করতে গিয়ে এভাবে…
“স্যার?”
ফারুক আহমেদ আর ভাবতে পারলো না। তার গাড়িটা কখন হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমের সামনে এসে থেমে গেছে বুঝতে পারে নি। পাশে বসা রমিজ লস্কর তার মনোযোগ আকর্ষণ করলে ভাবনায় ছেদ পড়লো।
ইমার্জেন্সি রুমের দিকে যাবার সময় দেখতে পেলো হোমিসাইডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মহাপরিচালককে আসতে দেখে দ্রুত সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ালো সবাই। ফারুক আহমেদ কারো সাথে কোনো কথা না বলে রমিজ লস্করকে নিয়ে চুপচাপ ঢুকে পড়লো সেই রুমে।
একজন ডাক্তার বসে আছে। বয়স বড়জোর ত্রিশের মতো হবে। ফারুক আহমেদকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো ।
“হোমিসাইডের মহাপরিচালক,” ডাক্তারের সাথে তার বসকে পরিচয় করিয়ে দিলো রমিজ লস্কর।
“কি অবস্থা, ডাক্তার?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো ফারুক আহমেদ।
“অপারেশন চলছে, চিন্তার কিছু নেই…আপনি বসুন, চেয়ার দেখিয়ে বললো ডাক্তার।
“গুলি লেগেছে কোথায়?”
“পায়ে,” বললো ডাক্তার। “তবে মাথাসহ বেশ কিছু জায়গায় মারাত্মক আঘাতও আছে।”
“সত্যিকারের অবস্থাটা বলুন, ডাক্তার?” ফারুক আহমেদ উদ্বিগ্ন বাবার মতো জানতে চাইলো ।
“স্যার, আপনি?”
ফারুক আহমেদ চমকে ঘুরে তাকালো।
“তুমি!” তারপরই জড়িয়ে ধরলো জেফরি বেগকে।
জেফরি কিছুটা অবাক হলো। তার বস সব সময় ভারিক্কি সাজার চেষ্টা করে, কিন্তু এখন যেনো সেসবের বালাই নেই।
জেফরিকে ছেড়ে দিয়ে বললো ফারুক আহমেদ, “তোমার কিছু হয় নি?!” বিস্মিত ভাবটা এখনও কাটে নি তার।
“না, স্যার, তবে আমারও গুলি লেগেছিলো”
“কি?” জেফরি কথাটা শেষ করার আগেই বললো হোমিসাইডের মহাপরিচালক। “কোথায়?”
“বুকে-”
“হোয়াট!” ফারুক আহমেদ যারপরনাই বিস্মিত। “তাহলে তুমি…?!
জেফরি বেগ গুলিবিদ্ধ হবার কিছুক্ষণ পরই টের পায় তার তেমন কিছু হয় নি । শুধু বাম পাঁজরে তীব্র ব্যাথা । হাত পা নড়াতে পারছে, দৃষ্টিশক্তিও ঠিকঠাক আছে। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে । আস্তে করে বুকে হাত দিয়ে বুঝতে পারে ঘটনাটা ।
তার জ্যাকেটের ভেতরের বাম পকেটে ছোট্ট একটা ডায়রি রাখা ছিলো। নিহত হাসানের স্ত্রী মলির কাছ থেকে এটা নিয়েছিলো সে । আর সেই ছোট্ট ডায়রিটাই বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। মিলন নামের ভয়ঙ্কর লোকটার গুলি তার বুকে বিদ্ধ হবার আগে বিদ্ধ হয়েছে সেই ডায়রিটায়।
মিলন নামের লোকটাকে বাগে পেয়েও সে কিছুই করতে পারে নি। তার হাতে পিস্তল ছিলো, আর মিলনও অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিলো কিন্তু তখনই একদল অন্ধ চলে আসে মিলনের পেছনে। কাছেই একটা অন্ধদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তারা দল বেধে ফিরছিলো। মিলন বুঝে যায়, জেফরি ইচ্ছে করলেই তাকে আর গুলি করতে পারবে না । কতোগুলো নিরীহ অন্ধ ছেলে তার জন্য অনেকটা মানবঢাল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সে। গুলি চালিয়ে বসে জেফরিকে লক্ষ্য করে। একটা গুলি করেই সে সটকে পড়ে ঘটনাস্থল থেকে ।
উঠে দাঁড়ানোর আগেই জেফরি দেখতে পায় তার সামনে ছুটে এসেছে একদল পুলিশ।
স্থানীয় থানার একটি টহলদল আশেপাশেই ছিলো, তারা গোলাগুলির শব্দ শুনে দ্রুত চলে আসে ঘটনাস্থলে।
পুলিশের গাড়িতে করেই পায়ে গুলিবিদ্ধ জামানকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসে জেফরি বেগ । পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে হোমিসাইডে কল করতে গেলে দেখতে পায় সেলফোনটা ভেঙে গেছে। ওটা দিয়ে আর কাজ হবে না। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ার কারণে এমনটি হয়েছে। অগত্যা টহলদলের এক এসআইয়ের ফোন থেকে রমিজ লস্করকে কল করে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানায়, সেইসাথে এও বলে দেয়, ফারুক আহমেদকে যেনো কিছু না বলে। খামোখা টেনশনে পড়ে যাবে তাদের বস। এমনিতেই তার প্রেসারের অবস্থা ভালো না । কিন্তু রমিজ তার কথা রাখে নি ।
ফারুক আহমেদ সব শুনে যারপরনাই বিস্মিত হলেও দারুণ খুশি হলো। তবে জামানের অবস্থা কেমন, তার কি অবস্থা, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে জেফরি তাকে আশ্বস্ত করে জানালো, জামানের অবস্থা ভালো। ডান পায়ের পেশিতে একটা গুলি লেগেছে। ডাক্তাররা ইতিমধ্যেই এক্সরে করে দেখেছে, গুলিটা হাঁড়ে লাগে নি।
এ যাত্রায় জামান অল্পের জন্য বেঁচে গেছে বলা যায়। তবে বেডরেস্টে থাকতে হবে বেশ কয়েক দিন। তার হাটু মচকে গেছে। মাথার পেছনেও আঘাত পেয়েছে।
অধ্যায় ২৫
স্থানীয় থানার পুলিশ সিজ করে ফেলেছে মিলনের পরিত্যাক্ত ফ্ল্যাটটি। খুব দ্রুত, বলতে গেলে চোখের নিমেষেই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা নিজেদের আসবাব আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ফেলেই পালিয়ে গেছে ।
জামানের অপারেশন শেষ হবার পরই হাসপাতাল থেকে সোজা মিলনের ফ্ল্যাটে চলে এলো জেফরি বেগ। জামানকে তিন-চারদিন হাসপাতালে থাকতে হবে । লোকাল অ্যানেস্থিয়া ব্যবহার করার কারণে ছেলেটার জ্ঞান ছিলো । অপারেশন শেষে জেফরি আর হোমিসাইডের মহাপরিচালকের সাথে তার কথাও হয়েছে। জেফরিকে অক্ষত দেখে ছেলেটার চোখেমুখে যে আনন্দ দেখেছে সেটা কোনো দিন ভুলবার মতো নয়।
জামান বলেছে, মিলন তার পায়ে গুলি করার পর একটা কথা জানতে চেয়েছিলো। পুলিশ কেন হাসানের খুনের জন্য তাকে খুজছে? জামানকে বার বার তাড়া দিচ্ছিলো মিলন, কোন তথ্যের উপর ভিত্তি করে পুলিশ তার পেছনে লেগেছে। জামান পিস্তলের মুখে বলেছে, হাসান সাহেবের সাথে তার সখ্যতা ছিলো, সেজন্যে তারা মনে করছে হাসান সাহেবের ব্যাপারে সে হয়তো কিছু। তথ্য দিতে পারবে ।
জামান বলেছে, কথাটা শুনে মিলন বিশ্বাস করতে পারে নি। জামান তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়ে জীবনের ভয়ে মিলনকে বার বার এ কথা বললেও মনে হয় না ওই সন্ত্রাসী তার কথা বিশ্বাস করেছে ।
মিলনের দরজার সামনে দু’জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে এখন। দরজায় তালা মারা ছিলো, পুলিশই সেই তালা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হাসানের স্ত্রী আর ছোটো ভাই জানিয়েছে, জেফরিরা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই মিলনের ঘর থেকে তার স্ত্রী তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায় একটা লাগেজ নিয়ে। মহিলাকে একাই বের হতে দেখেছে, তার বোন অর্থাৎ মিলনের শ্যালিকাকে দেখে নি। যদিও মেয়েটা তাদের সাথেই থাকতো।
শ্যালিকা!
হাসানের স্ত্রী মলি যা বলেছে তাতে মনে হচ্ছে, মিলন নামের লোকটা তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে শ্যালিকা পরিচয় দিতো ফ্ল্যাটের সবার কাছে। লোকটার অনেক কিছুই রহস্যময়, তারচেয়েও বড় কথা, সে একজন পেশাদার সন্ত্রাসী। সম্ভবত হাসানের হন্তারক । কিন্তু হাসানকে কি কারণে সেন্ট অগাস্টিনে গিয়ে খুন করলো সে?
পাশের ফ্ল্যাটের একজন, যার সাথে প্রায়ই ছাদে বসে সিগারেট খাওয়া হতো, তাকে খুন করার জন্য এতো নাটক কেন করা হলো?
মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কাজে মন দিলো জেফরি বেগ। এ নিয়ে পরে ধীরেসুস্থে চিন্তা করা যাবে।
স্থানীয় থানার এক এসআই’র সাহায্যে মিলনের পুরো ঘরটা তল্লাশি করা হলো । তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। আসবাবপত্র আর ব্যবহার্য টিভি-ফুজ এসব বাদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। হোমিসাইড থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমকে আসতে বলেছে সে। এই ঘরে মিলনের আঙুলের ছাপ রয়েছে, জেফরি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। মিলনের পরিচয় জানার জন্য আঙুলের ছাপ খুব গুরুত্বপূর্ন ।
মোবাইল ফোন, পাসপোর্ট, কাগজপত্র কোনো কিছুই নেই। সব নিয়ে সটকে পড়েছে মিলনের স্ত্রী।
জেফরিকে গুলি করার পরই সে হয়তো পালিয়ে গিয়ে তার স্ত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে। তৎক্ষণাত বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেয়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর কিছু কাপচোপড় নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে তারা।
স্থানীয় থানার এসআই ছেলেটা, বয়স বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে, বেশ উৎসাহ নিয়ে জেফরির সাথে কাজ করে যাচ্ছে। দু’জন কনস্টেবল নিয়ে তন্ন তন্ন করে ঘরগুলো তল্লাশি করছে সে।
ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে জেফরি। তার মধ্যে জেঁকে বসেছে এক ধরণের ঔদাসিন্য। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসার পর একটু বৈরাগ্য ভাব পেয়ে বসেছে তাকে। বলতে গেলে, এই যে এখনও বেঁচে আছে সেটা নেহায়েতই ভাগ্যক্রমে । হাসানের ডায়রিটা যদি জ্যাকেটের বুক পকেটে না রাখতে, আর গুলিটাও যদি ঠিক সেখানে বিদ্ধ না হতো তাহলে আজ এখানে বসে থাকা সম্ভব হতো না।
জীবন আর মৃত্যুর মাঝে একচুল ব্যবধান নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে । স্বপ্ন দেখে । একটু পর কি করবে, আগামীকাল কি করবে, কিংবা ভবিষ্যতে কি করবে সবই সে ভাবে মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
“স্যার?”
এসআই ছেলেটার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো সে। মুখ তুলে তাকালো ।
একটা প্লাস্টিকের কার্ড বাড়িয়ে দিলো ছেলেটা। “এটা ড্রয়ারের কাপড়চোপরের মধ্যে পেয়েছি।”
জিনিসটা হাতে তুলে নিলো জেফরি বেগ । মিলনের প্রথম স্ত্রীর ন্যাশনাল আইডিকার্ড । দারুণ!
একটা কিছু তাহলে ফেলে রেখে গেছে । জেফরি জানে এ ঘরের বাসিন্দা খুব তাড়াহুড়া করে চলে গেছে। সুতরাং অনেক কিছুই যে ফেলে গেছে সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
“আরেকটু খুঁজে দেখো, আমার ধারণা আরো কিছু পাওয়া যাবে,” এসআইকে ইন্সট্রাকশন দিলো সে ।
এসআই ছেলেটা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবার।
আইডিকার্ডটা দেখলো জেফরি : আম্বিয়া খাতুন, বয়স ত্রিশ, ঠিকানা ১৪৭, দীননাথ সেন রোড, গেন্ডারিয়া। স্বামী, ইসহাক আলী।
মহিলার ছবিটা বাজেভাবে তোলা । বেশিরভাগ আইডিকার্ডের ছবির এমন করুণ হাল। ভালোমতো চেহারা বোঝা যায় না। তবে সমস্যা নেই। জেফরি এই মহিলাকে সামনাসামনি দেখেছে। বেশ ভালোমতোই দেখেছে। কথাও বলেছে।
তারচেয়েও বড় কথা সন্দেহভাজন মিলনকেও সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। তার চেহারাটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে এখন। হোমিসাইডের পোর্ট্রেট আর্টিস্টের সাথে একটা সিটিং দিতে হবে, ভাবলো সে।
তবে এই আইডিকার্ডটাও কাজে দেবে। মিলনের প্রথম স্ত্রীর অনেক কিছুই জানতে পারবে এর সাহায্যে । হয়তো মিলনের আইডিকার্ডের নাম্বারটাও জানা যাবে। সাধারণত পরিবারের লোকজনের কার্ড-নাম্বার কাছাকাছি সিরিয়ালেই থাকে। এই কার্ডটার আশেপাশে কিছু নাম্বারের কার্ড চেক করে দেখলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে, আর এই কাজটা করতে তার সময় লাগবে খুবই কম।
তবে তার ধারণা অন্য একটা জিনিস তাকে অনেক বেশি ক্লু দিতে পারবে।
নিহত হাসানের ডায়রিটা!
অধ্যায় ২৬
সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল অরুণ রোজারিও গতকাল রাতে ঘুমান নি। এমনিতেও হাসানের খুনের পর থেকে তার চোখে ঘুম নেই। রীতিমতো স্লিপিং পিল খেয়ে জোর করে দুচোখের পাতা এক করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু কাল রাতে তিনটা পিল খাওয়ার পরও কোনো কাজ হয় নি। চার নাম্বার পিলটা খাওয়ার কথা ভাবলেও সেটা আর করেন নি শেষ পর্যন্ত ।
তুর্যের কথা জেনে গেছে জেফরি!
সারা রাত ভেবে গেছেন এই ব্যাপারটা নিয়ে। হয়তো ঘটনাচক্রে নামটা চলে এসেছে। মনে হয় না ছেলেটাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে জেফরি। এই ভাবনার পরক্ষণেই তার মাথায় চলে আসে অন্য একটি ভাবনা।
জেফরি সব জেনে যায় নি তো?
না। অসম্ভব। স্কুলের হাতেগোনা কয়েকজন জানে। তাদের সবার সাথে জেফরির কথা হয় নি। বিশ্বজিৎ সন্ন্যালের সাথে তার কথা হলেও অরুণ রোজারিও নিশ্চিত, বাবু এই ঘটনাটি জেফরিকে বলে নি।
হয়তো জেফরি এটা জানে না। নিছক ঘটনাচক্রে তুর্যের নামটা চলে এসেছে।
নাকি জেফরি সব জেনে না জানার ভান করছে?
মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলেন। তাকে এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজে মন দিতে হবে। অনেক বড় একটা ঝামেলায় পড়ে গেছেন, যদিও এসবের সাথে তার কোনোই লেনদেন নেই কিন্তু ঘটনার জালে তিনি জড়িয়ে পড়ছেন ধীরে ধীরে।
ডেস্কের পেপারওয়েটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, এমন সময় তার ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। কে ফোন করেছে তিনি জানেন না, তবে কয়েক দিন ধরে এই ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলেই তার মধ্যে ধুকফুকানি শুরু হয়ে যায়।
পাঁচবার রিং হবার পর রিসিভারটা তুলে নিলেন অরুণ রোজারিও।
“হ্যালো?” আস্তে করে বললেন তিনি। ওপাশ থেকে যে কণ্ঠটা শুনতে পেলেন সেটা চিনতে একটুও বেগ পেতে হলো না। খুবই কর্তৃত্বপূর্ণ একটি কণ্ঠ । কয়েক দিন ধরেই তাকে নানা রকম হুকুম দিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অরুণ রোজারিওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
.
রাতে বাড়ি ফিরে হাসানের ডায়রিটা প্রথম থেকে কিছু পৃষ্ঠা পড়েছে জেফরি বেগ, কিছু পায় নি । সাদামাটা একজন ক্লার্কের জীবন যেরকমটি হবার কথা সেরকমই । বাড়ি থেকে অফিস, অফিস থেকে বাড়ি । অফিসের ব্যাপারে খুব কম কথাই আছে । তবে সবচাইতে বেশি যার কথা আছে সে হাসানের তরুণী স্ত্রী। অবশ্য খুব বেশি পড়তে পারে নি, কারণ গতকাল সারাটা দিন তার মুড অফ ছিলো।
মিলনের বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র রিকভার করে অফিসে ফিরে আসে সে। মিলনের প্রথম স্ত্রী আম্বিয়া খাতুনের ন্যাশনাল আইডি নাম্বারের আশেপাশের আইডি নাম্বারগুলো চেক করে দেখেছে, কিছু নেই। স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিক্রমপুরের যে গ্রামের ঠিকানা দেয়া আছে খুব সম্ভবত সেখানকার কিছু নারী-পুরুষের আইডি ওগুলো।
হয়তো আম্বিয়া খাতুনের আত্মীয়স্বজন হবে। তবে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অনেক কিছু জানা যেতো। সমস্যা একটাই, ওইসব লোকজন এখন কোথায় আছে কে জানে। তারপরও রমিজ লস্করকে বলে দিয়েছে, ওইসব লোকজনকে যেনো স্থানীয় পুলিশ খুঁজে বের করে। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য জেনে নেয়।
জেফরির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো এ সময় ।
রেবা ।
গতকালকের ঘটনা রেবাকে বলে নি। এমনিতেই মেয়েটা তার বাবাকে নিয়ে ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছে, তার উপর জেফরির ঐ ঘটনার কথা শুনলে যারপরনাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।
“হ্যালো…কি খবর?”
“তুমি আমাকে কালকের ঘটনাটা কেন বলো নি?” রীতিমতো জবাবদিহি চাইবার সুরে বললো রেবা ।
জেফরি বুঝতে পারলো না কী বলবে। রেবা এটা জানলো কী করে!
“গতকাল মানে—”
“মিথ্যে বলার চেষ্টা কোরো না, প্লিজ…” একটু চুপ থাকলো রেবা ।
“না, মানে, তুমি জানলে কিভাবে?” যতোদূর সম্ভব নরমকণ্ঠে বললো সে।
“আমি কোত্থেকে জানলাম সেটা কি গুরুত্বপূর্ণ?”
“না, তা না…” আর কিছু বলতে পারলো না।
“জামান এখন হাসপাতালে, সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তুমি নিজেও নাকি আহত-”
জামান মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে! বলে কি! “আরে শোনো, আমার কথা। এসব ফালতু গল্প কোত্থেকে জেনেছো?”
“আগে বলো, ঘটনা সত্যি কিনা?”
“পুরোপুরি সত্যি না…”
“তাহলে কতোটুকু সত্যি?”
“জামান মোটেও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে না। আর আমি একদম ঠিক আছি।”
“তাহলে পত্রিকায় কি ভুল লিখেছে?” রেগেমেগে বললো রেবা।
পত্রিকা! অসম্ভব। প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলোতে এই ব্যাপারে কোনো নিউজ ছাপা হয় নি। জেফরি নিশ্চিত। তার অফিসে কমপক্ষে আট-নয়টি
জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়।
“কোন পত্রিকায়?” সন্দেহের সুরে বললো ।
“আসমানজমিন।” কাটাকাটাভাবে বললো রেবা।
ওহ। একটা পত্রিকাই বটে, মনে মনে বললো জেফরি । এই সস্তা ট্যাবলয়েড পত্রিকাটি অবশ্য তার অফিসে রাখা হয় না। রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না সে। ফালতু সব খবর ছাপা হয়। “তুমি তো জানোই, ওরা সব সময় উল্টাপাল্টা কথা লেখে…”
“তুমি বলতে চাচ্ছো, কিছুই ঘটে নি?…একটু আগে না বললে পুরোপুরি সত্যি বলে নি? তার মানে নিশ্চয় কিছুটা সত্যতা আছে?” রেবার কণ্ঠে ক্রোধ ।
একটু চুপ করে থাকলে সে । তারপর বললো, “তুমি কি একটু শান্ত হয়ে আমার কথা শুনবে?”
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই।
“প্লিজ?”
“আচ্ছা বলো।”
“আসলে ঘটনা তেমন কিছু না,” একটু মিথ্যে করেই বললো জেফরি । রেবাকে দুশ্চিন্তায় রাখতে চায় না ।
“তেমন কিছু না?!” রেবার বিস্ময়মাখা জিজ্ঞাসা ।
“মানে পত্রিকাগুলো যেরকম বলেছে সেরকম কিছু না, একটু থেমে আবার বললো সে, “আমি আর জামান একটা কেসের তদন্তে গেছিলাম…আচমকা সেখানে একজন সন্দেহভাজনকে পেয়ে গেলে সে পালানোর চেষ্টা করে…জামান তার পিছু ধাওয়া করলে তাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। জামানের পায়ে গুলি লেগেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই। সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে না। ইচ্ছে করলে তুমি জামানকে গিয়ে দেখে আসতে পারো…এখনও হাসপাতালে আছে সে।” এক নিঃশ্বাসে সত্যের সাথে কিছু মিথ্যে মিশিয়ে বলে গেলো জেফরি।
“তোমার কিছু হয় নি?” রেবার সন্দেহগ্রস্ত প্রশ্ন।
“না,” মিথ্যেটা বলতে জেফরির একটুও খারাপ লাগলো না। ভালো করেই জানে সত্য বললে রেবা কীরকম টেনশন করবে। এটা হলো নিদোষ মিথ্যে । হোয়াইট লাই।
“সত্যি?”
“না, পুরোপুরি সত্যি না ।
“মানে?”
“বুকে একটু আঘাত পেয়েছি।”
“কিভাবে? কিসের আঘাত?” আৎকে উঠে বললো রেবা ।
“একটা ধিঙ্গি মেয়ে আমাকে বিশ্বাস না করে ফালতু ট্যাবলয়েড পত্রিকার খবরকে বিশ্বাস করছে।” কথাটা বলেই মুখ টিপে হেসে ফেললো জেফরি।
“আহা রে…” মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলো রেবা। “বেচারা। খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“হুমম।”
“আচ্ছা, দেখা হলে আদর করে দেবো।”
“না। এখনই করো।” ছেলেমানুষি আব্দারের সুরে বললো জেফরি বেগ।
“না। এখন করবো না। দেখা হলে সামনাসামনি করবো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে এই কথাগুলো আবার বলবে । তখন বুঝতে পারবো পুরোপুরি সত্যি বলেছো কিনা। মনে রেখো, তোমাদের মতো পলিগ্রাফ মেশিন আমার কাছে না থাকলেও আমি কিন্তু একজন ধ্যাঙ্গা ছেলের সত্যি-মিথ্যে ভালোমতোই ধরতে পারি।”
এটা ঠিক, রেবার সামনে মিথ্যে বলতে পারে না জেফরি বেগ। অনেকবারই চেষ্টা করেছে। বার বারই একই ফল । হয়তো আবারো ধরা খাবে।
“এসব কথা রাখো । এবার বলো, তোমার বাবার খবর কি?” প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো সে।
একটু চুপ মেরে গেলো রেবা । তারপর শান্তকণ্ঠে বললো, “বাবা বিদেশে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাতে চাচ্ছে না।”
“কেন?”
“এতো টাকা খরচ করে নাকি কোনো লাভ হবে না। তার ধারনা ফোর্থ স্টেজের ক্যান্সার ভালো হয় না। খামোখা এতোগুলো টাকা খরচ করে কী হবে…এইসব বলছে,” কথাটা শেষ হলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রেবার মুখ দিয়ে ।
“কী হবে না হবে সেটা তো ডাক্তারই ভালো বলতে পারবে…উনাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে দিও না। একটু চেষ্টা করতে হবে না?”
“হুম।” রেবা আর কিছু বললো না।
“তুমি আর তোমার মা মিলে উনাকে বোঝাও…উনি বুঝবেন।”
“সেটাই করছি।”
“গুড।”
একটু চুপ থেকে বললো রেবা, “আচ্ছা, আজকে কি আমাদের দেখা হচ্ছে?”
মনে মনে কাজের শিডিউলটা খতিয়ে দেখলো জেফরি বেগ। জামানকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসতে হবে। যেতে হবে সেন্ট অগাস্টিনেও। তারপর অবশ্য কোনো কাজ নেই। “হুম…সন্ধ্যায় ফ্রি আছি । ছ’টার দিকে?”
“ঠিক আছে।”
“তাহলে আমি তোমাকে বাসা থেকে পিক করছি…ওকে?”
“ওকে।”
“বাই।” ফোনটা রেখে উদাস হয়ে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ।
বেশ কয়েক দিন যাবত চুমু খাওয়া হয় না । আজ অনেক চুমু খাবে। নতুন করে প্রাণশক্তি নিতে হবে। এই বয়সে চুম্বন ছাড়া বেশিদিন থাকলে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো লাগে নিজেকে। সমস্যা একটাই। রেবার মুড অফ হেয় আছে। তার বাবার অসুখই এর কারণ।
তারপরও চুম্বন হবে আজ। দীর্ঘ আর গাঢ় চুম্বন।
অধ্যায় ২৭
হাসানের বিধবা স্ত্রী সত্যি সত্যি দেশের বাড়িতে চলে যাচ্ছে তার বাবার সাথে । মলির কোনো পরিকল্পনা ছিলো না এতো তাড়াতাড়ি যাবার। ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে ডায়রিটা দেবার সময় অবশ্য বলেছিলো, বাবার সাথে দেশের বাড়িতে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্যি ছিলো না। আরো এক সপ্তাহ পরে যাবার ইচ্ছে ছিলো তার কিন্তু ডায়রিটা দেবার পর পরই পাশের ফ্ল্যাটে যে কাণ্ড ঘটে গেছে তারপর আর মলির বাবা ঢাকায় থাকাটা নিরাপদ মনে করেন নি।
পুলিশ বলছে, মিলন সাহেব নাকি হোমিসাইডের দু’জন কর্মকর্তাকে দেখামাত্র পালানোর চেষ্টা করে। প্রথমে সে নিজের পরিচয় লুকালেও ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ বুঝে যায়। এরপরই মিলন নামের লোকটি পালাতে গেলে তাকে ধাওয়া করে হোমিসাইডের দুই ইনভেস্টিগেটর। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে গোলাগুলিও হয়।
ভাগ্যের গুনে দু’জন ইনভেস্টিগেটর বেঁচে গেলেও মিলনকে ধরা সম্ভব হয় নি। সে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে তার দুই স্ত্রীও।
এসব কথা শুনে মলি বিশ্বাসই করতে পারে নি। দুই দু’জন স্ত্রী!
তারা তো এতোদিন জানতো, পাশের ফ্ল্যাটের মিলন নামের লোকটি বউ আর শালি নিয়ে থাকে, যেমন হাসান থাকতে বউ আর শ্যালককে নিয়ে।
তবে মলি বুঝতে পারছে না, মিলন কেন পালালো । কেন সে ইনভেস্টিগেটরদের গুলি করলো । তার সাথে হাসানের হত্যাকাণ্ডের কি কোনো সম্পর্ক আছে?
না। মলি ভালো করেই জানে, হাসানের খুনের সাথে মিলনের কোনো সম্পর্ক নেই। ডায়রিতে সে যে কথা জেনেছে, তাতে করে একদম নিশ্চিত, এর সাথে মিলনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।
তাহলে মিলন এমন কাজ করতে গেলো কেন?
বাসটা আচমকা ব্রেক কষলে সব যাত্রিদের মতো মলি আর তার বাবাও প্রচণ্ড ঝাঁকি খেলো। সম্বিত ফিরে পেলো সে।
রাস্তার মাঝখান দিয়ে একটা গরু পার হচ্ছিলো। ড্রাইভার গরুকে কুত্তারবাচ্চা বলে গালি দিয়ে আবারো গাড়ি চালাতে শুরু করলে মলির বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন।
“লিটুরে নিয়ে চিন্তা করিস না, মা,” আস্তে করে বললেন স্কুলশিক্ষক ভদ্রলোক। “ও ভালোই থাকবে।”
লিটুকে একা ফেলে আসতে মন চাইছিলো না, কিন্তু কিছু করার নেই। পাশের ফ্ল্যাটে ওই ঘটনা ঘটে যাবার পর মলির বাবা আর মেয়ের কোনো কথা শোনেন নি। লিটু তাকে বলেছে, তার কোনো সমস্যা হবে না। সে নাকি তার এক বন্ধুর বাসায় কয়েকটা দিন থাকবে, তারপর একটা মেসে উঠে যেতে পারবে।
মলির বাবা হয়তো ভাবছেন, লিটুকে নিয়েই সে ভেবে যাচ্ছে। আসলে তার ভাবনা জুড়ে হাসানের হত্যাকাণ্ড আর গতকালের সেই ঘটনা।
“না, বাবা,” আস্তে করে বললো মলি। “লিটুর কথা ভাবছি না।”
স্কুলশিক্ষক বাবা আর কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।
মলির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
তারা এখন ঢাকা শহর ছেড়ে চলে এসেছে। পেছনে ফেলে এসেছে হাসানের সাথে করা তার কয়েক মাসের সংসার। ফেলে আসা সেই শহরের মাটিতেই চিরকালের জন্য শুয়ে আছে তার স্বামী।
হাসানের মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে যে বিচ্ছেদের সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা যেনো পূর্ণতা পাচ্ছে এখন। দূরত্বটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।
হাসান আমি তোমাকে কখনও ভুলতে পারবো না!
অধ্যায় ২৮
অফিসে কিছু কাজ সেরে লাঞ্চের সময় হাসপাতালে গিয়ে জামানকে দেখেই জেফরি বেগ সোজা চলে গেলো সেন্ট অগাস্টিনে।
জামান ভালো আছে। তার ডান পায়ের পেশীতে যে গুলিটা বিদ্ধ হয়েছিলো সেটা হাঁড়ে কোনো ক্ষতি করে নি, শুধু ক্ষত তৈরি করা ছাড়া। ডাক্তার জানিয়েছে, আর মাত্র একদিন পরই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হবে।
হাটুর আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়। কিছুদিন বিশ্রাম নিলে সেটাও সেরে যাবে। আর কিডনির আঘাতটা ছিলো একেবারেই সাময়িক। তার কিডনি পুরোপুরি সুস্থ আছে।
জামানের মা-বাবা আর আত্মীয়স্বজনে হাসপাতালের কেবিন গিজগিজ করছিলো। যাইহোক, জামানের অবস্থা দেখে জেফরির খুব ভালো লেগেছে। সন্ধ্যার সময় রেবার সাথে দেখা করার পর নিশ্চয় আরো ভালো লাগবে।
অরুণ রোজারিও একটা কাজে উপরতলায় গেছে, জেফরি বসে আছে তার অফিসে। একটু আগে ফোনে কথা হয়েছে তার সাথে । এক ছেলে এসে এক কাপ চা দিয়ে গেছে তাকে, সেটাতে চুমুক দিয়ে হাসানের কেসটা নিয়ে ভাবতে লাগলো সে।
পাশের ফ্ল্যাটে মিলন নামের নোকটা কেন এমন করলো? এই প্রশ্নের একটাই সহজ জবাব হতে পারে : হাসানের হত্যাকাণ্ডের সাথে মিলন কোনো
কোনোভাবে জড়িত। কিন্তু ঘটনা অন্য রকমও হতে পারে। হতে পারে ঘটনাচক্রে মিলন একজন সন্ত্রাসী হবার কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে । তবে জেফরির দৃঢ় বিশ্বাস, ঘটনাচক্রে মিলন নামের সন্ত্রাসীর সাথে তাদের মোকাবেলা হয় নি।
মিলন যদি হাসানকে খুন করে থাকে তাহলে আরেকটা সহজ প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে : পাশের ফ্ল্যাটের একজনকে খুন করার জন্য মিলন কেন সেন্ট অগাস্টিনে গেলো? খুব সহজেই তো হাসানকে খুন করতে পারতো সে!
“সরি, ব্রাদার।” অরুণ রোজারিও তার অফিসে ঢুকে বললেন।
মুখ তুলে হাসিমুখে তাকালো জেফরি। “খুব ব্যস্ত নাকি?”
নিজের ডেস্কে বসতে বসতে বললেন অরুণ রোজারিও, “না, তেমন কিছু না। স্কুলের রুটিনমাফিক কিছু কাজ।” একটু চুপ থেকে আবার বললেন তিনি, “তা বলো, তোমার কি খবর?”
“ভালো।” চায়ের কাপে চুমুক দিলো জেফরি ।
“গুড। কেসটার কি অবস্থা?”
মিলনের সাথে তাদের মোকাবেলার ঘটনাটা না বলার সিদ্ধান্ত নিলো জেফরি । “ভালো। এগোচ্ছে। তবে আরো সময় লাগবে।”
“হাসানের বউ তো দেশের বাড়িতে চলে গেছে, জানো কিছু?”
জেফরি এটা জানে । হাসানের স্ত্রী মলি তাকে ফোন করে জানিয়েছে । “হুম।” ।
“আমার সাথে কাল কথা হয়েছে। হাসানের চলতি মাসের বেতন আর বিভিন্ন ফান্ডের টাকা সামনের মাসে দিয়ে দেয়া হবে। আমরা স্কুল থেকে হাসানের পরিবারের জন্য কিছু কমপেনসেশনের ব্যবস্থাও করেছি।”
“ভালো।” ছোট্ট করে বললো জেফরি বেগ।
“আমাকে বলেছে, সামনের মাসে এসে টাকাগুলো নিয়ে যাবে।”
জেফরি কিছু বললো না। অরুণ রোজারিও হয়তো আসমানজমিন নামের ফালতু পত্রিকাটি পড়ে না। জামান যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে খবর তার জানা নেই।
“অরুণদা, আমি একজনের সাথে কথা বলতে চাই,” আস্তে করে বললো সে।
কথাটা শুনেই সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যালের মুখ কালো হয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে বললেন, “কার সাথে কথা বলতে চাও?”
“তুর্যের সাথে।”
জেফরি লক্ষ্য করলো কথাটা শোনামাত্রই অরুণ রোজারিওর দু’চোখের ফোকাস এলোমেলো হয়ে গেলো। নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলেও বরাবরের মতোই ব্যর্থ হলেন।
“তু-তুর্য…মানে, ওর সাথে কথা বলবে কেন?” একটু তোতলালেন অরুণ রোজারিও।
“দরকার আছে। ওই ছেলেটার সাথেই অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ কথা বলেছে। তাকে নাকি সাইনও করিয়েছে। অথচ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ এই স্কুলে আসে নি।”
“ছাত্রদের খুনের কেসে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কি রিঅ্যাকশন হবে, বুঝতে পারছো?”
“আমি তাকে খুনের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবো না। শুধু জানতে চাইবো ঐ কোচের সাথে তার কি কথা হয়েছে।”
জেফরি লক্ষ্য করলো অরুণ রোজারিওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে।
“কিন্তু হোমিসাইডের একজন ইনভেস্টিগেটর কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে এটা জানাজানি হলে-”
“আমি হোমিসাইডের পরিচয় দেবো না,” অরুণ রোজারিওর কথার মাঝখানে বললো জেফরি ।
“তাহলে?” ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন প্রিন্সিপ্যাল ।
“এ নিয়ে আপনার চিন্তার কিছু নেই। আমি অন্য পরিচয়ে কথা বলবো। ছেলেটা বুঝতেই পারবে না।”
অরুণ রোজারিও চিন্তায় পড়ে গেলেন।
“ছেলেটাকে আপনার রুমেই ডেকে আনুন। এখানেই কথা বলবো ওর সাথে । আপনিও নিশ্চয় সেরকমই চান, তাই না?”
“কিন্তু…” অরুণ রোজারিও ইতস্তত করলেন।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ । “কি?”
“ছেলেটা তো আজ স্কুলে আসে নি।”
“স্কুলে আসে নি?” অবাক হলো জেফরি। এর আগেও তার সহপাঠিরা তাকে জানিয়েছে ছেলেটা স্কুলে আসে নি। আজও অনুপস্থিত।
“হুমম…”
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো জেফরি। শতশত ছাত্রের মধ্যে একজন অনুপস্থিত হলে সেটা প্রিন্সিপ্যাল কিভাবে জানবে?
“আপনি কি করে জানলেন সে স্কুলে আসে নি?” মনে হলো প্রিন্সিপ্যালের পাছায় কেউ আলপিন দিয়ে খোঁচা দিয়েছে।
“না, মানে…ইয়ে,” কথাটা বলতে বেগ পেলেন তিনি । যেনো গলার কাছে এসে আর্টকে গেলো। “ওই ফিজিক্যাল ট্রেইনার মি: কাজি বললেন, ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্টে বস্কেটবল টিম থেকে তুর্যকে বাদ দেয়া হয়েছে, ছেলেটা নাকি অ্যাবসেন্ট আছে কয়েক দিন ধরে।” অরুণ রোজারিও নিজেও অবাক হলেন এতো দ্রুত কিভাবে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারলেন তিনি।
“ও,” জেফরি চেয়ে রইলো তার স্কুলের বড়ভায়ের দিকে। অরুণ রোজারিওর ভাবভঙ্গি তার কাছে খটকা লাগছে । লোকটা এরকম করছে কেন?
“মনে হয় অ্যাঞ্জেলস টিমে চান্স পেয়ে খুশিতে আত্মহারা…টিমের সাথে হয়তো প্র্যাকটিস করছে,” জেফরিকে চুপ থাকতে দেখে বললেন তিনি।
“অরুণদা, ঐ লোকটা কিন্তু অ্যাঞ্জেলস টিমের কোচ ছিলো না। সে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে স্কুলে ঢুকেছিলো।”
জেফরির কথাটা শুনে বরফের মতো জমে গেলেন অরুণ রোজারিও।
“সুতরাং টিমে চান্স পাওয়া, প্র্যাকটিস করা, এসবের প্রশ্নই ওঠে না।”
গাল চুলকালেন সেন্ট অগাস্টিনের প্রিন্সিপ্যাল। “তাহলে?” বোকার মতো বলে ফেললেন।
“সেটাই তো এখন খুঁজে বের করতে হবে।”
অরুণ রোজারিও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন জেফরির দিকে।
.
সেন্ট অগাস্টিন থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে নিয়েছে। জেফরি বেগ । লাঞ্চের সময় অবশ্য অনেক আগেই পেরিয়ে গেছিলো। প্রচণ্ড ক্ষিদে লাগলে হালকা কিছু খেয়ে এক কাপ চা পান করে। তারপর আবারো চলে আসে সেন্ট অগাস্টিনে। তবে এবার আর প্রিন্সিপ্যালের অফিসে নয়, সোজা চলে এসেছে বাস্কেটবল কোর্টে।
ঐদিনের মতোই পাঁচ-ছয়জন ছাত্র প্র্যাকটিস করছে। এটাই সে চেয়েছিলো। সামনেই ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্ট। ছেলেগুলো বেশ মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে ।
কোর্টের কাছে আসতেই ছেলেগুলো তাকে দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলতে শুরু করলো। নাফি হাজ্জাদ নামের ছেলেটা বার বার তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। জেফরি হাত তুলে ‘হাই’ জানালে অনিচ্ছায় হাত তুলে জবাব দিলো ছেলেটা। মুচকি হাসলো জেফরি বেগ।
খেলতে খেলতে দিপ্রো নামের ছেলেটি এক সময় তার কাছে চলে এলে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো।
“কেমন আছো?” হেসে বললো জেফরি বেগ।
“জি, ভালো আছি,” পাল্টা হাসি দিয়ে দিপ্রো বললো।
“তোমার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?”
অবাক চোখে চেয়ে রইলো দিপ্রো। তারপর কাঁধ তুললো। “ওকে।”
দিপ্রো তার বাকি সঙ্গিদের দিকে ফিরে হাত তুলে কিছু একটা ইশারা করলে নাফি হাজ্জাদ নামের ছেলেটা বিরক্ত হয়ে তাকালো জেফরির দিকে।
“বলুন…কি বলবেন?” হাফাতে হাফাতে বললো দিপ্রো ।
“তুর্য তোমাদের সাথে প্র্যাকটিস করছে না?”
“না।”
“কেন?”
“ও তো স্কুলেই আসে না…অ্যাঞ্জেলস টিমে চান্স পাবার পর থেকে গন উইথ দ্য উইন্ড…”
“ও,” ছোট্ট করে বললো জেফরি । ভালো করেই জানে, সেন্ট অগাস্টিনের মতো স্কুলে কথায় কথায় অনুপস্থিত থাকা যায় না। তুর্য নামের ছেলেটা কী কারণ দেখিয়ে স্কুলে আসছে না? নিশ্চয় সে কর্তৃপক্ষকে বলে নি, অ্যাঞ্জেলস টিমে চান্স পাবার কারণে আসছে না। তাছাড়া, এটা কোনো কারণও হতে পারে না। এরকম ঘটনা আদতে ঘটেই নি ।
“ও কি আসলেই অ্যাঞ্জেলস টিমের সাথে প্র্যাকটিস করছে নাকি অন্য কোনো কারণে স্কুলে আসছে না?”
“কে জানে?” দিপ্রো বললো।
“কেন, তোমাদের সাথে ওর ফোনে যোগাযোগ হয় নি?”
“না।” দিপ্রো একটু কাটাকাটাভাবে বললো কথাটা ।
“কোনো রকম ছুটি না নিয়ে স্কুলে আসছে না, এটা তো ঠিক হচ্ছে না, তাই না?”
“হু কেয়ারস…” কাঁধ তুললো দিলো।
“তোমাদের স্কুলের নিয়মকানুন খুব কড়াকড়ি, তাহলে ও এভাবে অ্যাবসেন্ট আছে কি করে?”
দিপ্রো ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো জেফরির দিকে । “আপনি আসলে কে, বলুন তো?”
“বলেছি না, আমি তোমাদের প্রিন্সিপ্যালের গেস্ট।”
“আচ্ছা,” কথাটা টেনে টেনে বললো সে।
“তাহলে আপনি এসব জানতে চাচ্ছেন কেন?”
“দরকার আছে,” বললো জেফরি।
জেফরির দিকে চেয়ে রইলো দিবো। “কি দরকার?”
“সেটা তোমাকে বলা যাবে না।”
ঠোঁট ওল্টালো দিপ্রো। “দেখুন, আমার সাথে চালাকি করবেন না। আমি জানি আপনি কেন এসব জানতে চাচ্ছেন।”
অবাক হলো জেফরি বেগ । “কেন জানতে চাচ্ছি?”
“আপনি ঐ মার্ডার কেসটার ইনভেস্টিগেশন করছেন,” বেশ দৃঢ়ভাবে বললো দিপ্রো।
মাথা দোলালো জেফরি । তার মুখে হাসি । “তোমার ধারনা আমি পুলিশের লোক?”
“না। আপনি হোমিসাইডে আছেন। আপনার নাম জেফরি বেগ!”
অধ্যায় ২৯
অরুণ রোজারিও অফিস থেকে বের হয়ে পার্কিংলটের দিকে যাচ্ছেন। তার গাড়িটা ওখানেই আছে। পার্কিংলটে এসে বাস্কেটবল কোর্টের দিকে তাকালেন তিনি । দূর থেকেই দেখতে পেলেন তার প্রিয় ছোটো ভাই জেফরি এক ছেলের সাথে কথা বলছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।
অফিস থেকে বের হবার আগেই এক চাপরাশি পাঠিয়ে জানতে পেরেছিলেন জেফরি এখানে আছে। খবরটা শোনার পর থেকে অস্থির হয়ে আছেন। জেফরিকে কিছু বলা যাবে না, তাহলে তাকেও সন্দেহের তালিকায় ফেলে দেবে। এমনিতেই অনেক ঝামেলার মধ্যে আছেন । মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব সামলাতে হবে। একটুও ভুল করা যাবে না।
চেষ্টা করে যাচ্ছেন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে কিন্তু সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় মিথ্যে বলতে গেলে, অভিব্যক্তি লুকিয়ে ফেলার সময়। তিনি লক্ষ্য করেছেন, জেফরি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে । হয়তো কিছুটা খটকা লেগে গেছে তার মনে।
এখনও একটা ছেলের সাথে কথা বলে যাচ্ছে জেফরি । কী এতো কথা? অরুণ রোজারিও বুঝতে পারছেন না। এসব খুনখারাবির সাথে বাস্কেটবলের কোচ, ছাত্র এরা কিভাবে জড়ায়! ঘটনা তো আসলে অন্যরকম।
ড্রাইভার তাকে ডাক দিলে ফিরে তাকালেন। জেফরির দিকে আরেকবার তাকিয়ে প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে । এই কেসের পরিণতি কি হবে কে জানে!
তার গাড়িটা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো স্কুল থেকে।
.
পত্র-পত্রিকাগুলো সব সময়ই জেফরির চক্ষুশূল, এখন রীতিমতো শত্রু বলে মনে হচ্ছে তার কাছে।
সে তো কোনো সেলিব্রেটি না। বিরাট গায়ক, নায়ক, মডেল কিংবা কবি সাহিত্যিকও নয়। তাহলে তার ছবি ছাপানোর কী মানে আছে?
তার কাজ হলো হত্যা-খুনের রহস্য উন্মোচন করা, প্রকৃত দোষিদের খুঁজে বের করা। এই কাজে তাকে সফল হতেই হবে। এখানে ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই। তাহলে আলোচিত কোনো খুনের কেস সমাধান করলে পত্রিকাগুলো কেন তার ছবি ছাপিয়ে দেবে? চটকদার হেডলাইন করবে তাকে নিয়ে?
এ দেশই হলো একমাত্র দেশ যেখানে স্বাভাবিক কাজকর্ম করেও বাহবা পাওয়া যায়। ফাঁকি না দিলেই কৃতিত্ব পাওয়া যায়।
কয়েক মাস আগে লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যখন ঘটনাস্থল থেকে লেখকের তরুণী স্ত্রীর প্রেমিককে গ্রেফতার করলো তখনই এই কাণ্ডটা করে বসে আসমানজমিন। এরপর ব্ল্যাক রঞ্জুর কেসটার বেলায় এই পত্রিকা একই কাজ করেছে। খুব সম্ভবত আসমানজমিন আবারো তার ছবি ছাপিয়ে দিয়েছে ।
অনেক ক্ষেত্রেই ক্রাইমসিনে তার আগমনের সময় কিছু সাংবাদিক ফটোগ্রাফার উপস্থিত থাকে। জেফরি তখন ডুবে থাকে কাজের মধ্যে। আশেপাশে কে তার ছবি তুলছে সেটা তখন খেয়াল থাকে না।
শালার আসমানজমিন, মনে মনে বললো জেফরি বেগ। দিপ্রো হয়তো এই আজগুবি খবরের পত্রিকাটা পড়ে তাকে চিনতে পেরেছে।
কিন্তু সত্যি কথা হলো, দিপ্রো এটা জেনেছে দাড়োয়ান আজগরের কাছ থেকে। যখনই তারা জানতে পারলো সে কোনো কোচ নয় তখনই তাদের একটু কৌতূহল হয়। দাড়োয়ান আজগরকে জিজ্ঞেস করলে সে জানিয়ে দেয় জেফরির আসল পরিচয়টা ।
জেফরি ঠিক করলো সে আর নিজের পরিচয়টা অস্বীকার করবে না।
“ওহ্, আমি যে এতো পপুলার সেটা তো জানতাম না,” কৃত্রিমভাবে হেসে বললো ইনভেস্টিগেটর।
“শুধু আমি না…আমাদের সবাই আপনাকে এখন চেনে,” পেছন ফিরে বাকিদের দিকে ইঙ্গিত করলো দিপ্রো।
“ওয়াও, গ্রেট, জেফরি বেগ মুখে এটা বললেও মনে মনে বললো, শিট শিট-শিট!
“আর কিছু জানতে চান, মি: ইনভেস্টিগেটর?” একটু বাঁকাভাবে বললো দিলো।
“তুর্যের সাথে আমি দেখা করতে চাই, তুমি কি তার বাড়ি চেনো?”
দিপ্রো আবারো বাঁকা হাসি হেসে চেয়ে রইলো জেফরির দিকে। যেনো তার সাথে ঠাট্টা করা হয়েছে। “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুর্য কে আপনি চেনেন না।”
অবাক হলো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “তাকে কি আমার চেনার কথা?” পাল্টা বললো সে।
“অবশ্যই চেনার কথা।”
“তাই নাকি,” কথাটা বলে জেফরিও বাঁকা হাসি হাসলো তবে বুঝতে পারছে না দিপ্রো কী বলতে চাচ্ছে।
“কি কারণে তোমার মনে হলো তুর্য নামের ছেলেটাকে আমার চেনার কথা?”
“আপনি আবারো চালাকি করছেন, মিস্টার,” বললো দিপ্রো। “আমাদের সাথে গেম খেলবেন না…”
বোকার মতো হেসে ফেললো জেফরি বেগ । “তুমি কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
দিপ্রো নিজেও অধৈর্য হয়ে উঠলো। “লুক মিস্টার, আপনার এইসব ট্রিক্স অন্য কোথাও অ্যাপ্লাই করবেন…ওকে,” বলেই ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো সে।
“প্লিজ, শোনো, আমি এখনও বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছো?” জেফরি পেছন থেকে ডাক দিলো।
ঘুরে দাঁড়ালো দিপ্রো। তার ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি । “ইন দ্যাট কেস, ফর ইওর কাইন্ড ইনফর্মেশন…তুর্য হোমমিনিস্টারের ছেলে। এটা সবাই জানে!” দিপ্রো দৌড়ে চলে গেলো তার বন্ধুদের কাছে।
পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইলো জেফরি বেগ।
হোমমিনিস্টারের ছেলে?!