পরের দিন বিকেলে ফোনে সোমনাথকে ডেকে পাঠালেন নটবর মিত্তির।
বেজায় খুশী মনে হচ্ছে ভদ্রলোককে। নিজের টাকে হাত বুলিয়ে নটবর বললেন, “আপনার কপাল বোধহয় খললো মিস্টার ব্যানার্জি। গোয়েঙ্কাকে যা-বলবার বলে এসেছি।”
ভীষণ উৎসাহিত বোধ করছে সোমনাথ। প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানালো নটবরবাবুকে।
নটবরবাবু দার্শনিকভাবে বললেন, “শুধু টাকাতেই সব কাজ হাসিল হয় না, মিস্টার ব্যানার্জি। আমাদের এই লাইনে টাকার ওপরেও জিনিস রয়েছে। সুপ্রীম কোর্টের পরেও যেমন আছে রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন।”।
এবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন নটবর মিটার। বললেন, “গোয়েঙ্কা সম্পর্কে একটু বাইরে খোঁজখবর নিলম। ফরেনে একেই বলে ফিল্ড রিসার্চ। গোপন অনুসন্ধানের খবর অনুযায়ী গোয়েঙ্কার নাড়ি টিপতেই সুড়সড় করে সব খবর বেরিয়ে এলো। ইউ উইল বি প্ল্যাড টু নো গোয়েঙ্কার মনে অনেক দুঃখ আছে। পয়সার লোভে কেজরিওয়ালের খোঁড়া মেয়ে বিয়ে করেছে। অমন কার্তিকের মতো চেহারা, কিন্তু শরীরের অনেক সাধআহJদ পূরণ হয় না।”
কান লাল হয়ে উঠছে সোমনাথের। নটবরবাবু তা লক্ষ্য করলেন না। তিনি বলে চললেন, “কমবয়সী মেয়েদের ওপর খু-উব লোভ আছে। কিন্তু ভীষণ ভয়ও আছে। আমিও চান্স বুঝে টোপ ফেলে দিয়েছি, আপনার নামে। চালাক লোক তো-আন্দাজে সব বুঝে নিয়েছে। বলেছি, যেদিন কলকাতায় আসবেন, শুধু দয়া করে ফোনটা তুলে ব্যানার্জিকে জানিয়ে দেবেন। আর সন্ধ্যেটা ফ্রি রাখবেন।
নটবর মিত্তির আশা করেছিলেন, সোমনাথ এই দুরহ কাজের জন্য তাকে ধন্যবাদ দেবে। তিনি বলতে গেলেন, “অনেক সস্তায় কাজ হয়ে যাবে আপনার। সব ব্যবস্থা করে দেবো আমি—আপনার কোনো চিন্তা থাকবে না।”
প্রায় আতিনাদ করে উঠলো সোমনাথ। “এ আপনি কী করলেন, মিস্টার মিটার? এসব কথা আপনাকে কে বলতে বললো। ভদ্রলোকের ছেলে ব্যবসায় নেমেছি।”
নটবরবাবু মোটেই উত্তেজিত হলেন না। শান্তভাবে সোমনাথকে বললেন, “এ-লাইনে কে ভদ্রলোকের ছেলে নয়, বলুন? আমি, শ্রীধরজী, মিস্টার গোয়েঙ্কা সবাই। ভদ্দরলোকের ছেলেরাই তো এদেশের পলিটিকস, গভরমেন্ট এবং বিজনেস চালাচ্ছে। শুনেন মশাই, আমি যে প্রপোজাল গোয়েঙ্কার কাছে দিয়ে এসেছি তার মধ্যে একটুও অভদ্রতা নেই—যস্মিন, দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার।”
“অসম্ভব, দাঁতে দাঁত চেপে সোমনাথ বললো। অন্য কেউ হলে এতোক্ষণ লোকটার থ্যাবড়া নাকে এক ঘষি বসিয়ে দিতো সোমনাথ।
নিজেকে বহু কষ্টে শান্ত করে সোমনাথ বললো, “এসব নোংরামির মধ্যে আমাদের বংশে কেউ কখনও থাকেনি। আপনি লোকটাকে এখনই বারণ করে দিন।”
মুখের হাসি বজায় রেখে নটবরবাবু বললেন, “লাও বাবা! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! যাকগে। বলা যখন হয়ে গেছে, তখন চারা নেই। গোয়েঙ্কা যেদিন আপনাকে ফোন করে জানাবেন আসছেন, টেলিফোনে সোজাসুজি বলে দেবেন—আপনি ব্যস্ত আছেন, সন্ধ্যেবেলায় কোনোরকম কো-অপারেশন করতে পারবেন না। তাহলে গোয়েঙ্কাজী বুঝে নেবেন।”
সোমনাথ আর এক মুহূর্তও দেরি না করে নটবরবাবুর অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। রাগে তার সর্বশরীর জলছে।
কিন্তু যার কোনো মুরোদ নেই, তার শরীর জললে দুনিয়ার কী এসে যায়? যে সাপের বিষ নেই, তার কুলোপানা চক্করে কে ভয় পাবে—মা বলতেন। কোন দিকে যায় সোমনাথ? ইচ্ছে করছে, কোথা থেকে যদি একটা এটম বোমা পাওয়া যেতো মন্দ হতো না—চানক সাহেবের এই জারজ সৃষ্টির ওপর বোমাটা ফেলে দিতো সোমনাথ। চিরদিনের মতো সমস্যার সমাধান হতো। কিন্তু শক্তি কোথায়? এটম বোমা তো দুরের কথা, কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে দ-একটা হারামজাদার গালে থাপড় মারবার মতো সাহসও ঈশ্বর দেননি সোমনাথকে।
মনের ঠিক এমন অবস্থার সময় সেনাপতি ডাকলো, “বাবু আপনার ফোন।”
“হ্যালো, আমি তপতী বলছি।”
তপতী আর ফোন করবার সময় পেলো না? সোমনাথের গম্ভীর গলা শোনা গেলো, “বলো।”
“একটু আগেও তোমাকে ফোন করেছিলাম—শুনলাম, তুমি কোন এক মিস্টার নটবর মিত্রের অফিসে গিয়েছে।”
“অনেক কাজ-কর্ম থাকে, তপতী।” ওর প্রশ্নটা সোমনাথ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো।
তপতী বললো, “কই সেদিনের পর তুমি তো আমার খোঁজ করলে না?”
কী বলবে সোমনাথ? শেষ পর্যন্ত উত্তর দিলো, “তপতী, কয়েকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মিটিং চলছে—ওঁরা বসে রয়েছেন। পরে একদিন দেখা করা যাবে।”
“কাল আমি থাকছি না। শ্রীরামপুরে যাচ্ছি। অলমোস্ট যেতে বাধ্য হচ্ছি। পরশ, তোমার ওখানে যাবো। দেখা হলে, সব বলবো। বেশ সিরিয়াস।”
ফোন নামিয়ে রাখলো সোমনাথ। ইংরাজী ও বাংলা তারিখ মেশানো ক্যালেন্ডারটা দেওয়ালে সামনেই ঝলছে। পরশ, ১৬ই জন। অর্থাৎ ১লা আষাঢ়।