২০. শীতটা বেশ জোর পড়েছে

কুড়ি

শীতটা বেশ জোর পড়েছে। বনের পথে পথে আবার ট্রাকের একটানা গোঙানি শুরু হয়েছে। বাঁশ বোঝাই হয়ে, কাঠ বোঝাই হয়ে, দিনে রাতে ট্রাক চলেছে। দিনেই বেশি চলে। রাতে খুব একটা নয়। ফিকে লাল সিঁদুরের মতো ধুলোর আস্তরণ পড়েছে পথের দু-পাশের গাছগুলিতে।

ভোরবেলা শিশিরে ভিজে থাকে চারদিক। রোজ বন্দুক হাতে করে প্রাতঃভ্রমণে বেরোই। আজকাল জন্তু-জানোয়ারের ভয় আগের মতোন করে না, তবে বন্দুক নিতে হয় যশোয়ন্তের সাবধানবাণী শুনে। যশোয়ন্তের জগদীশ-বন্ধুরা যে কখন কোন সুযোগ নিয়ে বসেন, তা কে জানে।

অন্য লোক হলে হয়তো এই ব্যাপারটা এত বড় করে দেখত না, কিন্তু নিজে একজন জঙ্গলের ঠিকাদার। বন-বিভাগের সঙ্গে কেসে হেরে গেলে তার এমনি যা শাস্তি হবে, হবেই; কিন্তু বিড়িপাতা, লাক্ষা এবং কাঠের যে প্রকাণ্ড ব্যবসা তার আছে এ অঞ্চলে, তা উঠে যাবে বললেই চলে। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে না—তা সে জানে এবং সে কারণে যেন-তেন প্রকারেণ সে চেষ্টা করছে যাতে যশোয়ন্তকে শায়েস্তা করতে পারে। তা ছাড়া ওর এবং যশোয়ন্তের হাবভাব দেখে মনে হয়, ওদের দু’জনের মধ্যে কোনও ব্যক্তিগত বৈরিতা আছে।

ইতিমধ্যে কিন্তু আর একবারও তারা রাতের সহলে আসেনি। এলে অন্তত যশোয়ন্তের কাছে খবরটা পৌঁছাত।

সকালে পথের নরম পেলব পুরু ধুলোয় নানা জন্তু-জানোয়ারের রাতের পায়ের দাগ দেখি। আজ ভোরে বেরিয়ে দেখি, শম্বরের দল রাস্তা পার হয়েছে। দুটি নীল গাই পথের উপরেই বসেছিল অনেকক্ষণ; তার দাগ। একটি চিতা রাস্তা ধরে প্রায় আধ মাইল সোজা আমার বাংলো থেকে যবটুলিয়া বস্তির দিকে হেঁটে গেছে। আমার সামনেই একদল মোরগ-মুরগি রাস্তার উপর কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল, আমাকে আসতে দেখেই বাঁ-দিকের খাদে নেমে গেছে। তাদের পায়ের দাগ ধুলোর উপর টাটকা রয়েছে। কখনও কখনও বড় জাতের সাপ রাস্তা পার হয়েছে যে, তার চিহ্ন দেখি। টাবড় একদিন বলছিল, ওগুলো শঙ্খচূড়।

যবটুলিয়াতে ওরা সেদিন একটা শঙ্খচূড় সাপ মেরেছিল। বিরাট লম্বা। সবজে সবজে দেখতে, পেটের দিকটা হলদে। এ অঞ্চলের লোক এই সাপকে বড় ভয় পায়। শঙ্খচূড় নাকি মানুষকে আধ মাইল তাড়া করে গিয়ে কামড়েছে, এমন ঘটনাও ওদের জানা আছে। লেজে ভর করে দাঁড়িয়ে উঠে বুকে, মুখে, মাথায় ছোবল দেয়। যাকে কামড়ায়, তার চোখে দিনের আলো প্রথমে হলদে হয়ে যায়; তারপর মিলিয়ে যায়। অব্যক্ত যন্ত্রণার সঙ্গে অন্ধকার নেমে আসে।

সুহাগী নদীর পাড়ে যে খাড়া পাহাড়টা উঠে গেছে—যার নাম বাগুং, সেখানে নাকি শঙ্খচূড়ের আড্ডা। ওদিকে বড় কেউ যায় না। এমনকী, গরমের সময় জঙ্গলের আনাচে-কানাচে গরিব লোকেরা শেষরাত থেকে মহুয়া কুড়িয়ে বেড়ায়, তখনও ওই পাহাড়কে ওরা এড়িয়ে চলে। আসলে আমার মনে হয়। সাপ সব পাহাড়েই আছে। কিন্তু ওই পাহাড়ে নাকি দুর্যাগিয়া দেওতার মতো কোনও বনদেও আছেন, তাই সাপেরা নাকি তাঁর ঠাঁই সব সময় ঘিরে থাকে। কেউ বনদেওতার থানের কাছাকাছি গেলেই তাকে তাড়া করে।

বেত্‌লার চেকনাকার পেত্নীর ঘটনা টাবড়ের কাছ থেকে শোনার পর থেকে এদের কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভূততত্ত্ব সম্বন্ধে অনেক কিছু শুধিয়েছিলাম। সে ভারী মজার।

ওরা বলল, ‘দারহা’ বলে এক রকমের ভূত নাকি অত্যন্ত বিপজ্জনক। রাস্তার কেউ সন্ধের পর একলা যাচ্ছে—হঠাৎ পাহাড়ের নীচে দেখতে পেল, একটি ছোটখাটো দুবলা-পাতলা লোক আসছে। সে হঠাৎ সামনা-সামনি আসতেই পথ জড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল যে, তার সঙ্গে কুস্তি লড়তে হবে। কুস্তি সে লড়ল তো ভাল, না লড়লে সেই দারহা ভূত হঠাৎ শাল গাছের মতো লম্বা হয়ে যাবে আবার পরক্ষণেই লুমরীর মতো বেঁটে হয়ে যাবে। এমনই সার্কাস করতে থাকবে। এবং যার হৃদয় সবল নয়, সে তো সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই মরবে, এবং যার হৃদয় সবল, সেও দরদর করে ঘামতে থাকবে।

এই রকম করে দারহা মিনিট পাঁচেক ভয় দেখিয়ে চামচিকে কি খাপু পাখির রূপ ধরে আকাশে উড়ে যাবে।

কতরকম গল্পই যে শুনি এদের কাছে, তার আর শেষ নেই। তার কিছু বিশ্বাস করি; কিছু করি না। আমার কাছে এ যেন এক আশ্চর্য, নতুন অনাবিল জগৎ। যবটুলিয়া বস্তির গম-ভাঙা কলের পুপপুপানি, বিকেলের বিষণ্ণ রোদের সান্ত্বনার আঙুল, রাতের বনের অতর্কিত হায়নার হাসি—এ-সব মিলিয়ে আমার মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। এ ক’মাস শহুরে মনটাতে একটা অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেছে। অনবধানে।

আমার কাজ আবার জোর কদমে শুরু হয়েছে।

কোনও বাঁশের ঝাড়ে আটটার কম বাঁশ থাকলে কাটা বারণ। তবুও কখনও সখনও কাটতে হয়। কিন্তু তাহলে আলকাতরা দিয়ে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হয় সে সব ঝাড়ের। সেই সব ঝাড়ের জন্যে আলাদা রেজিস্টার রাখতে হয়। যদি কোনও ঝাড়ে আটটার কম অথচ শুকনো, অপুষ্ট এবং বিকলাঙ্গ বাঁশ থাকে, তাহলে তাও কাটা যায়। প্রতি ঝাড়েরই বাইরের দিকের বাঁশ কাটতে হয়। কখনও-সখনও ঝাড়ও কাটা হয়। তখন বাঁশের কচি গোড়া এবং তার সঙ্গে একটি করে বাঁশ ছেড়ে যেতে হয়। এ অঞ্চলের বাঁশ সাধারণত পরিধিতে আধ ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চির মধ্যেই হয়। উচ্চতায় কুড়ি থেকে ষাট-সত্তর ফুট অবধি হয়। যেখানে বাঁশ হয়, সেখানে সাগুয়ান গাছ বড় বেশি দেখা যায় না—অন্যান্য রকমারি গাছের জঙ্গল হয় সেখানে।

এখন মাঝে মাঝেই জঙ্গলে যাই। পথে নানা ঠিকাদারের সঙ্গে দেখা হয়। কাঠের কাজ করছেন যাঁরা। কোন ক্যুপে ক্লিয়ার ফেলিং হচ্ছে, কোন কুপে কপিসিং ফেলিং হচ্ছে। কোথাও হরজাই জঙ্গল কাটা হচ্ছে।

রমেনবাবু মাঝে মাঝেই বলেন, কী হবে চৌধুরী সাহেব পরের খিদ্মদগারি করে। চলুন, আমি আর আপনি মিলে একটা বিজনেস করি। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। আমি তো লেখাপড়া জানি না, কিন্তু বাঁশ এবং এই জঙ্গলকে ভাল করেই জানি। আমি জঙ্গল সামলাব আর আপনি সাহেব সামলাবেন। দেখবেন, কোয়েলের বানের মতো হুড়মুড়িয়ে টাকা আসছে।

আইডিয়াটা মন্দ না। রমেনবাবু নানাভাবে উপার্জন করে হাজার পনেরো টাকা জমিয়েছেনও শুনতে পাই, কিন্তু আমার যে এক পয়সাও পুঁজি নেই।

এ-রকম নানা প্ল্যানের কথা উনি বলেন। বসে বসে শুনতে ভাল লাগে, কল্পনা করতেও ভাল লাগে: আমার ব্যবসা আমার বাড়ি, আমার গাড়ি। ব্যস ওই পর্যন্তই। এ জীবনে কল্পনা করা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না। মোটামুটি খেয়ে পরে দিন কেটে গেলে এই কল্পনার জগতেই আমি সুখী—আর রুমান্ডির মতো এমন জায়গায় যদি বাকি জীবনটা কল্পনায় বুদ হয়ে কাটাতে পারি, তবে তো কথাই নেই।

দিনগুলি রাতগুলি কেটে যায়, কিন্তু মাঝে মাঝেই বড় একা একা লাগে। এত একা যে, কী বলব। নিজের বুকের ভিতরে একটি অতল গহ্বর অনুভব করি। শীতের সন্ধ্যায় সূর্য যখন হেলে পড়ে, হরতেলের ঝাঁক যখন ফল খেয়ে বট গাছের আশ্রয় ছেড়ে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যায়, সুহাগী বস্তির সব ক’টি গরু মোষ যখন কাঠের ঘণ্টার বিষণ্ণ আওয়াজ নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে, কূপ-কাটা কুলিরা যখন দিন শেষে টাঙ্গি কাঁধে ফিরে এসে সঙ্গিনীর সঙ্গে পা ছড়িয়ে বাজরার রুটি খেতে বসে, তখন নিজের মধ্যে একটা তীব্র একাকিত্বের বেদনা অনুভব করি।

শীতের সন্ধ্যার একটি আশ্চর্য হৃদয়স্পর্শী রূপ আছে। হলুদ আলোয় ক্রন্দনরতা শীতের বন থেকে, ঘাস থেকে, ফুল থেকে একটি করুণ শৈত্য উঠে আমার বুকে এসে বাসা বাঁধে। বুকের মধ্যে একটা অনামা রাগের, অনামা বাজনার বিচ্ছিন্ন আলাপ গুমরে গুমরে ওঠে।

কৃষ্ণচূড়ার নীচে, রামধানিয়া একটা চালাঘর বানিয়েছে। চারটে শালের খুঁটি পুঁতে এবং উপরে বাঁশের উপর শালপাতা বিছিয়ে। রাত হয়ে গেলে তার নীচে বসি। রোজ সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই সেখানে আগুন করা হয়। আগুনের পাশে বসে বই পড়ি, নতুবা ওরা যা গল্প করে শুনি, তখন ঘরের মধ্যে বড় একটা থাকি না। আগুনের পাশে বসে শরীর গরম করে নিয়ে, গরম গরম যা রান্না হয় খেয়ে শুয়ে পড়ি লেপের তলায়।

রামদেওবাবুদের পঞ্জাবি ট্রাক ড্রাইভার গুরবচন সিং মাঝে মাঝে রাতে আমার বাংলো পেরুবার সময় ট্রাক থামিয়ে আগুন পুইয়ে যায়—আঙুলগুলোকে টেনেটুনে ঠিক করে নেয়—কোনও কোনও দিন ওকে চা কিংবা গরম কফি খাওয়াই-বেচারা কুটকু থেকে ডালটনগঞ্জে যায় প্রতি রাতে। গুরবচনের পুরনো ট্রাকের জানালার কাঁচ মোটে ওঠে না—হু হু করে হাওয়া ঢোকে।

পথে কোন দিন কী জানোয়ার দেখল, তার গল্প করে গুরবচন। ও আজকাল আর পঞ্জাবি নেই, বিহারি হয়ে গেছে। যশোয়ন্তের মতো। বহু বছর থেকে এখানে আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফৌজে ছিল—বিদেশে যুদ্ধ করেছে। কোনও কোনও দিন তার গল্প করে। গুরবচন সিং এক জাঁদরেল ডাকসাইটে ব্রিগেডিয়ারের গল্প করে—তার মতো সিপাহি কেউ নাকি দেখেনি। শত্রুর স্পাই এক সুন্দরী মেয়েকে ভালবেসে সেই ব্রিগেডিয়ার নাকি নিজে মরেছিল। এবং অনেক সৈন্যকেও মেরেছিল।

আগুনে গুরবচন সিং-এর চোখ দুটো চকচক করত। ও গল্প করতে করতে আমায় শুধোত, বাহাদুর আদমি কি কমজৌরি কিস মে হ্যায়, জানতে হো বাবুজি?

আমি শুধোতাম, কিস মে?

গুরবচন সিং কনভিকশনের সঙ্গে বলতো, আওরৎ মে।

নানান গল্প হত। রামধানিয়া ওখানেই বসে রামায়ণ পড়ত গুনগুনিয়ে—সেই শীতার্ত রাতের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তারা-ভরা আকাশের নীচে বেশ লাগত সেই গুনগুনানি।

ইতিমধ্যে রাংকা থেকে ঘুরে এসে শিরিণবুরুতে গেছিলাম এক শনিবার বিকেলে। রাতটা থেকে আবার রবিবার রাতে ফিরে এসেছিলাম। মারিয়ানা সত্যিই খুশি হয়েছিল। মারিয়ানার স্বভাবে এমন একটা সহজিয়া স্বচ্ছতোয়া সুর আছে, যা সহজে যে কোনও লোককে আপন করে নিতে পারে। অনর্গল হাসে—হাসি লেগেই আছে ওর মুখে। চমৎকার কথা বলে—প্রতিটি পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত এমনকী সদ্য-পরিচিত লোকের প্রতিও সুন্দর সপ্রতিভ ব্যবহার করে। ফলে, অনেক বোকা লোক সেই ব্যবহারকে অন্য কিছু ভেবে মনে মনে দুঃখ পেয়ে মরতে পারে। ভারী ইচ্ছে হয় মারিয়ানার বন্ধু সুগতকে দেখতে।

সেদিন বড় আদর-যত্ন করেছিল মারিয়ানা। আমরা কোথায়ও বেরুইনি। কোনও কাজ করিনি। যে ক’ ঘন্টা ছিলাম, কেবল রাতে শোবার সময় ছাড়া মুখোমুখি বসে খালি গল্প করেছি। আমাদের যে এত কথা বলার ও শোনার ছিল, ওখানে যাবার আগে তা বুঝতে পারিনি।

ও আমার কোনও নিত্য প্রয়োজনে আসেনি। আসবেও না কোনওদিন; তবু যে নীলকণ্ঠ পাখিটি রুমান্ডিতে রোজ সন্ধ্যার আগে এসে রাধাচুড়োর ডালে বসে দোল খায়—আর আমি বসে বসে তাকে দেখি, কেন জানি না তারই মতো মনে হয় মারিয়ানাকে। জাগতিক কারণে সেই পাখিটিকে আমার কোনও প্রয়োজন নেই—সে এলে, এসে বসলে, সুন্দর ঠোঁটে নিক্কণ তুলে রেশমি ডানা পরিষ্কার করলে আমার ভাল লাগে। সে উড়ে গেলেই রুমান্ডিতে রাত নেমে আসে।

টোরী-ডালটনগঞ্জের রাস্তায় জগলদহ কলিয়ারি বলে একটি কলিয়ারি আছে। সেই কলিয়ারির কাছে থাকতেন মিহিরবাবু, যিনি পুজোর সময় টোরিতে ছিলেন এবং আমাদের অষ্টমীর দিন সাদর আপ্যায়ণ করেছিলেন। গেলেই ভারী আদর যত্ন করেন ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা। খাওয়ান-দাওয়ান। গল্প-গুজব করেন। বলেন, এই জঙ্গলের সব ভাল, কেবল এই সঙ্গীর অভাব ছাড়া। ছেলেমেয়ে দুটো তো একরা-কেকরা হিন্দী শিখেছে—আমাদের সঙ্গেও মাঝে মাঝে ওই ভাষায় কথা বলতে আসে। ধমক দিয়ে নিবৃত্ত করতে হয়।

ওখানে গেলেই ওঁরা ধরে পড়েন, তাস খেলুন। আমি লজ্জা পাই। কবে কোন ছোটবেলায় একবার পুজোমণ্ডপে বসে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে রঙ-মিলানো শিখেছিলাম, সেও ভুলে গেছি। তাই তাদের আড্ডা জমে না।

একদিন মিহিরবাবুর ওখান থেকে চা খেয়ে রুমান্ডিতে ফিরে আসছি, এমন সময় দেখি, সুহাগী বস্তির কয়েকটি মুখচেনা লোক একটি ডুলি কাঁধে হনহনিয়ে পাকদণ্ডী রাস্তা বেয়ে-লাতেহারের দিকে চলেছে।

জিপ থামিয়ে কী ব্যাপার শুধোতেই শুনি, শেষ বিকেলে গরু চরাচ্ছিল একটি ছেলে—সুহাগী নদীর পাশের সবুজ ঢালে। থোকা থোকা জংলি কুল পেকে ছিল মাঠময়। ছেলেটির এক হাতে পাচন, এক হাতে বাঁশি। পাচন আর বাঁশি এক হাতে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে কুল ঝোপ থেকে কুল পেড়ে খাচ্ছিল আর গরুগুলো তার চার পাশে গলার কাঠের ঘণ্টা দুলিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল।

এমন সময়, ঝোপের অপর প্রান্ত থেকে বলা নেই, কওয়া নেই, এক বিরাট ভাল্লুক বেরিয়ে এসে ওকে আক্রমণ করে এবং বুক থেকে কোমর অবধি নখ দিয়ে সমস্ত মাংস নাড়ি-ভুড়ি সুদ্ধ চেঁছে ফেলার মতো করে টেনে নামায়। জংলি পাতার রস লাগিয়ে কোনওক্রমে ওরা নিয়ে যাচ্ছিল ওকে লাতেহারে।

ছেলেটির কোনও জ্ঞান ছিল না তখন।

ছেলেটির বাবা দাদা এবং আরও একজন মুরুব্বি গোছের লোককে জিপে তুলে নিলাম। ওরা ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বসল। ডুলিতে ছেলেটির কমপক্ষে চারঘণ্টা লাগত লাতেহার পৌঁছতে। বাঁচবার আশা যদিও কিছু থেকে থাকে, তাও থাকবে না। বাকি লোকদের বললাম বস্তিতে ফিরে যেতে। তারপর যথাসম্ভব জোরে অথচ, ওর গায়ে ঝাঁকুনি না লাগে এমনি করে জিপ চালিয়ে লাতেহারে পৌঁছলাম।

হাসপাতালের ডাক্তারবাবুও তখন একজন বাঙালি ছিলেন। চাটুজ্যে বাবু। আলাপ হল। অল্প বয়সী ভদ্রলোক। ছেলেটির জন্যে খুব যত্ন করে যা যা করণীয় করলেন এবং বললেন, আজ রাত না কাটলে কিছুই বলা যাচ্ছে না—তবে আমি যথাসাধ্য করছি আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

লাতেহার থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় আটটা হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু বললেন, কাল সকালে ছেলেটির আত্মীয়-স্বজনদের পাঠিয়ে দিতে। ছেলেটির বাবা ও দাদা লাতেহারেই রয়ে গেল। আমি দশটা টাকা দিয়ে এলাম ওদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি খরচ বাবদ। ভারী কৃতজ্ঞ হল ওরা। আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

মনে হয় আমাদের মতো আজন্ম শহরে-পালিত লোকেরা কৃতজ্ঞতা কী, তা ভুলে গেছি। অন্য লোকে যদি কিছু আমাদের জন্যে করেও, তাকে আমরা পাবার অধিকারে পাচ্ছি—করবে না তো কী? এই মনোভাবেই গ্রহণ করি। কৃতজ্ঞতার মতো মহৎ অনুভূতি আমাদের অভিধান থেকে বোধহয় উধাও হয়ে গেছে।

জোরে জিপ চালিয়ে ফিরে আসছিলাম। সঙ্গে সুহাগী গ্রামের অবশিষ্ট লোকটি। সে পেছনে বসে আছে।

রুমান্ডির কাছাকাছি চলে এসেছি—এমন সময়ে সুহাগী নদীর কিছু আগে পথটা যেখানে হঠাৎ একটা বাঁক নিয়েছে সেখানে গিয়ে জিপটা পৌঁছতেই জিপের আলোয় পথের পাশে একজোড়া বড় বড় সবুজ চোখ জ্বলে উঠেই দপ করে নিবে গেল—কারণ জিপের মুখটা আবার সোজা হয়ে গেল রাস্তা বরাবর। পেছনের লোকটি উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল, মারিয়ে হুজৌর ইয়ে ভালকো। বহত বড়া ভাল্। ঔর এ্যাহি জাগেমেই ত উ লেড়কাটা পাক্‌ড়াহিস থা—সায়েদ এহি ভালভি হোনে শেকতা।

ছেলেটাকে আমি দেখেছিলাম। একটি সুন্দর ওঁরাও কিশোর। চোখ দুটো বোজা। সারা শরীর থকথকে রক্তে ভেজা।

জিপটা থামালাম। বললাম, চলো দেঁখে উসকো। সামনের সিটে আমার পেছনে বন্দুকটা লম্বালম্বি করে শুইয়ে রেখেছিলাম। পকেট থেকে দুটি বুলেট বের করে পুরলাম।

লোকটি বলল, জিপোয়া কো স্টার্ট মতো বন্ধ কিজিয়ে হুজৌর।

কিন্তু জিপের স্টার্ট বন্ধ করেই দিলাম। তারপর টর্চটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, আও, বাত্তি দেখলাও গে ঠিকসে—ডান কাঁধের উপর দিয়ে কি করে আলো দেবে তা ওকে দেখিয়ে দিলাম। তারপরে বললাম, ডরনা মৎ।

এত পাঁয়তারা কষা সত্ত্বেও, ভাল্লুকটা পালাল না। রাস্তা ছেড়ে আমরা জঙ্গলে নেমে গেলাম। জায়গাটা ফাঁকা-ফাঁকাই। এখানে সেখানে কুল ঝোপ, মাঝে মাঝে পুটুসের ঝোপ। তা ছাড়া বড় বড় সেগুন গাছ। খুব সাবধানে ভাল্লুকটার যেদিকে যাওয়ার কথা, সেদিকে এগোতে লাগলাম।

একটু এগিয়ে আন্দাজ করে আলো ফেলতেই দেখি, ভাল্লুক যেখানে ছিল, সেখান থেকে একটু বাঁ-দিকে সরে গিয়েছে মাত্র। চোখ দুটো গাঢ় সবুজ—গায়ের কুচকুচে কালো লোম—আলোয় একেবারে জেল্লা দিচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে প্রায় চল্লিশ গজ হবে।

কী করব ভাবতে না ভাবতে অদ্ভুত ভঙ্গি করে একটি কালো অতিকায় ফুটবলের মতো ভাল্লুকটি আমাদের দিকে বিষম জোরে দৌড়ে এল। তার পরেই পেছনের দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

সঙ্গীটি যদি টর্চ নিয়ে পালাত, তবে অন্ধকারে আমার অবস্থা ওঁরাও ছেলেটির মতোই হত। কিন্তু বোধহয় ভগবানের ইচ্ছা নয় যে এত তাড়াতাড়ি মরি। সঙ্গী নির্ভয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্কম্প হাতে আলো ধরে রইল আক্রমণকারী ভালুকের উপরে। আমি লক্ষ স্থির করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে বুক লক্ষ করে গুলি করলাম।

কী হল বুঝলাম না, কেবল একটি বন-কাঁপানো উঁ উঁ আওয়াজ করতে করতে ভাল্লুকটা আরও বেগে আমাদের দিকে এগিয়ে এল; আমরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে ডানদিকে একটু ফাঁকা জায়গায় দৌড়ে গেলাম; ততক্ষণে আমাদের স্থান পরিবর্তন করতে দেখে ভাল্লুকটি আরও চটে গিয়ে আমাদের দিকে মুখ করে আবারও দাঁড়াবার সময়ে একমাত্র অবশিষ্ট গুলিটি মহার্ঘ্য নিবেদনের মত ভাল্লুকের বুক লক্ষ করে ঠুকে দিলাম।

ভাল্লুকটি ওইখানেই পড়ে গেল। এবং অবিকল মানুষের মতো চিৎকার করতে লাগল। সে চিৎকার কানে শোনা যায় না।

একটা জিনিস অনুভব করে ভাল লাগল যে, আমি একটুও ভয় পেলাম না। অবশ্য এর জন্য আমার নিজের কোনও বাহাদুরি নেই—সঙ্গী লোকটি ভয় পায়নি বলেই আমি ভয় পাইনি। পরিবেশে ভীরু মানুষও সাহসী হয়ে ওঠে।

কাছে গিয়ে দেখি, দুটো গুলিই লেগেছে। প্রথমটা বুকে লাগেনি, লেগেছে মাথার উপরে ঝাঁকড়া চুলে; গুলিটা চুলে বিলি কেটে সোজাসুজি চলে গেছে। পরের গুলিটা একেবারে গলার নীচে, বুকে লেগেছে। সেটিই মোক্ষম মার হয়েছে।

পরে যশোয়ন্তের কাছে শুনেছিলাম যে, বাঘ বা ভাল্লুককে কখনও মাথা লক্ষ করে মারতে নেই। ওদের খুলির আকার নাকি এমন—এবং খুলি নাকি এমন হেলানো যে, অনেক সময় আমরা যেমন ফুটবলে হেড দিই, তেমনই হেড দিয়ে গুলি হটিয়ে দেয়। অর্থাৎ খুলির উপরের দিকে লাগলে গুলি পিছলে বেরিয়ে যায়।

দুজনে মিলে এতবড় ভাল্লুককে জিপে তোলা যাবে না। তাই আমরা সুহাগীতেই গেলাম। ওরা সবাই খুব খুশি। কেউ কেউ বলতে লাগল যে, এটাই সেই ভাল্লুক, যেটা ছেলেটাকে আক্রমণ করেছিল। ওরা এও বলল যে, খয়ের বানাতে যে মাল্লারা এসেছে গয়া জেলা থেকে, তারা একটি ভাল্লুকীর দুটি বাচ্চা ধরেছে দুদিন হল; কেউ কেউ বলল, এইটিই সেই ভালুকী হতে পারে। বাচ্চা ধরাতে, খেপে উঠে এমন করে বেড়াচ্ছে।

ওরা যখন সকলে মিলে গিয়ে ভাল্লুকটাকে নিয়ে এল, তখন কিন্তু সত্যিই দেখা গেল যে সেটা একটা ভাল্লুকীই—ভাল্লুক নয়। এবং এইটিই যে সন্তানহারা ভালুকী, তাও গাঁয়ের লোকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বলে দিল।

মনে মনে বেশ আত্মপ্রসাদ বোধ করলাম। ছেলেটির আক্রমণকারীর সঙ্গে যদি এই ভালুকীর কোনও যোগ থেকে থাকে—এই ভেবে।

আমার এই আনন্দ আর একটু বেশি স্থায়ী হলে ভাল হত। কিন্তু পরদিন বেলা আটটা নাগাদ ছেলেটির দাদা এসে সুহাগীতে খবর দিল যে, ছেলেটি মারা গেছে শেষ রাতে। জ্ঞানই নাকি আর ফেরেনি।

ডাক্তারবাবু একটি ছোট চিঠি পাঠিয়েছেন ওর হাতে। ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম, কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না। তবে প্রথম থেকেই অজ্ঞান হয়েছিল—কাজেই নতুন করে কিছু কষ্ট পায়নি।’

খয়ের বানাতে যে মাল্লারা এসেছিল এবং ভালুকীর বাচ্চা দুটি ধরেছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করে বলব ভাবলাম যে, তাদের অপরিণামদর্শিতার জন্যই এমন কাণ্ড হল। ছেলেটির মুখটা বার বার মনে পড়ত কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

একদিন কাজকর্ম সেরে মৃত ওঁরাও ছেলেটির দাদাকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলের শুড়িপথে ঢুকে গেলাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট পাতার কুঁড়ে বানিয়ে মাল্লারা আছে। প্রায় মাইল তিনেক পায়ে-হাঁটা পথ।

সেখানে পৌঁছে ওদের সেই দুর্ঘটনার কথা বলতেই ওরা এত দুঃখ প্রকাশ করল ও অনুশোচনা জানাল যে, আর কিছু বলতে পারলাম না। মনের রাগ মনেই রইল। এমনকী, ছেলেটির দাদাও বলতে লাগল যে, তোমরা আর কী করবে ভাই? ওর কপালে ছিল, তাই অমনভাবে মরল। সবই কপালের লিখন।

ওরা আমাদের একটা শাল গাছের গুঁড়িতে বসতে দিল। গুঁড়িটা ওরা বসবার বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছিল। দেহাতি আখি গুড়ের সঙ্গে পাহাড়ি ঝরনার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা জল শালপাতায় করে খেতে দিল। এইভাবে অতিথি আপ্যায়ন করল।

ওখানে বসে বসে ওরা কী করে খয়ের বানায়, তা দেখলাম—শুনলাম। দেখলাম ওরা তীর-ধনুক দিয়ে একটা চিতাবাঘকে মেরেছে কাল—সেটার চামড়াটাকে একটা বাঁশের খোঁটার সঙ্গে গেঁথে মাটিতে বাঁশটিকে পুঁতে রেখেছে। বাঘের লেজটা মাটি অবধি ঝুলে আছে।

মাল্লারা বলল যে, ওরা প্রথমে খয়ের গাছের ছাল ছাড়িয়ে নেয়, তারপর বাইরের দিকে যে সাদাটে অংশ থাকে গাছের গায়ে, তাও তুলে নেয়—তখন দগদগে ক্ষতের মতো গাছের লাল শরীর বেরিয়ে পড়ে। সেই দগদগে গায়ে আঠার মতো আস্তরণ জমে। জমবার পর সেগুলো টুকরো টুকরো করে কাটে ওরা। কেটে এনে মাটিতে গর্ত করে বড় উনুন বানিয়ে সেই উনুনের গনগনে আঁচে বারো থেকে ষোলো ঘণ্টা জলে ফোটায়। তাতে যে আরকের মতো পদার্থ সৃষ্টি হয়, সেটিকে অন্য পাত্রে ঢেলে আবার উনুনে চড়ানো হয়। যতক্ষণ না সেই আরক বেশ ঘন হয়ে ওঠে, ততক্ষণ পর্যন্ত উনুনে চড়ানোই থাকে। ঘন হয়ে গেলে, একটি গোলাকার মৃৎপাত্রে ঢেলে থিতোতে দেওয়া হয়। সমস্ত রাত ধরে থিতানো হয়। তার পরদিন ভোরে বড় ঝুড়িতে ঢেলে ফেলা হয় ছাঁকবার জন্যে। যেটুকু ঝুড়িতে জমা হয়, সেটুকু দিয়ে ভাল খয়ের হবে, ওরা সেই খয়েরকে বলে ‘পাখড়া’। আর যে জলীয় পদার্থ ঝুড়ি থেকে বাইরে এল, সেটিকে মাটিতে একটি গর্ত করে ঢেলে দেয়। তা দিয়েও এক রকমের নিকৃষ্ট খয়ের তৈরি করবে ওরা; তাকে ওরা বলে ‘খয়রা’।

ঝুড়িতে যা থাকে, তা প্রায় এক মাস ধরে ফেলে রাখা হয় শুকোবার ও শক্ত হবার জন্যে। তারপর প্রায় শুকনো হয়ে এলে সেগুলো মাটিতে ছাইয়ের উপর ঢেলে ফেলে। ওরকমভাবে আট দশদিন থাকবার পর সেগুলো বেশ শক্ত হয়ে ওঠে। তখন সেগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে নিয়ে ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করে ওরা।

গরমকালে খয়ের বানানো যায় না, কারণ গরমে খয়ের শক্ত হয় না মোটে—শুকনোও না। তাই শীতকালে কাজ আরম্ভ করে, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই পাততাড়ি গুটিয়ে ওরা চলে যায়। বনবিভাগকে ওদের রয়্যালটি দিতে হয় এই খয়ের তৈরি করার জন্যে।

বেশ লাগে ওদের এই যাযাবর জীবনের কথা ভাবলে। ঝরনাতলায় রাঁধে-বাড়ে—সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে। শীতের রাতে যখন টুপ-টুপিয়ে শিশির ঝরে পাতা থেকে, তখন ওরা গোল হয়ে ওদের অনির্বাণ উনুনের সামনে বসে গল্প করে, গান করে, তারপর সেই আগুনের পাশেই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।

রাতে বাঘ টহলে বেরিয়ে ওদের দেখে যায়—বাঘের চোখ ওদের ঝুপড়ির আশেপাশে আগুনের গোলার মতো জ্বলতে থাকে। কখনও-সখনও হাতির দল আসে। দূর দিয়ে ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে চলে যায়। ওদের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে উঠে বসে। ক্যানেস্তারা পিটোয়, আগুনে নতুন করে কাঠ গুঁজে আগুন জোরালো করে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

এদিকে সন্ধ্যা নেমে এল। প্রায় তিন মাইল পথ যেতে হবে। উঠলাম আমরা। ওরা বার বার বলল, আবার আসবেন। আমরা গেছিলাম বলে আন্তরিক আনন্দিত হল। ছেলেটির মৃত্যুতে বার বার দুঃখ প্রকাশ করল। ভাল্লুকীর বাচ্চা দুটিকে দশ টাকা করে এক ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে ওরা। গরিব লোক। দশ টাকা ওদের কাছে অনেক টাকা।

পথ চলতে চলতে সুহাগীর ছেলেটি বলছিল, ভারী ভাল বাঁশি বাজাত নাক ওর ভাই। ওই বয়েসের ছেলেদের মধ্যে অত ভাল বাঁশি-বাজিয়ে চতুর্দিকে দশ-পনেরোটা বস্তিতে কেউ ছিল না।

আমরা প্রায় বড় রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছি, এমন সময়ে আমাদের একেবারে পথ জুড়ে একদল চিতল হরিণের দেখা পেলাম। ওরা এই শুঁড়ি পথের পাশের পাহাড়তলির একটা সুন্দর মাঠে চরে বেড়াচ্ছিল। এদিকটাতে আমলকি গাছ অনেক। আমলকি খেতে এসেছিল কি না জানি না।

একদলে যে এত হরিণ থাকে বা থাকতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। ছোট বড়, মাদি, শিঙ্গাল সব মিলিয়ে কমপক্ষে দুশো হরিণ হবে। আমাদের দেখা মাত্র তারা এমনভাবে বন-পাহাড় ভেঙে খুরে খুরে খটাখট শব্দ তুলে উড়িয়ে পালাল, সে কী বলব? এখনও মাঝে মাঝে সেই শেষ বিকেলের সোনা-আলোয় হলদে সাদায় বুটি বুটি হরিণের ঝাঁকের পলায়মান ছবি চোখে ভাসে।

রাতে জিপে আসতে যেতে মাঝে মাঝে হরিণের ঝাঁকের সঙ্গে দেখা যে হয় না, তা নয়। বড় বড় ঝাঁকের সঙ্গেও দেখা হয়। তখন গাড়ির আলোয় জোনাকির মতো ওদের চোখ জ্বলে আর নেবে। কিন্তু দিনের আলোয় যেমন দেখায় তেমনটি রাতে দেখায় না। রাতে জঙ্গলের মধ্যে সব কিছুই কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হয়। পথের পাশের বড় পাথর বা ঝোপের অপস্রিয়মাণ ছায়ামাত্রকেই গুঁড়ি-মেরে-বসা বাঘ বলে ভ্রম হয়। টিটি পাখির ডাক—নাইটজারের সংক্ষিপ্ত অতর্কিত তীক্ষ আওয়াজ—জিপের বনেট ফুঁড়ে ফরফরিয়ে ওড়া খাপু পাখির ক্রমান্বয়ে খাপু-খাপু-খাপ খাপু ডাকে—সব মিলিয়ে রাতে বনে জঙ্গলে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব থাকে।

কে জানে! অমন পরিবেশেই এখানের লোকেরা ‘দারহার’ দর্শন পায় কিনা? চেকনাকায় কেনাকায় পেত্নীরা তাই জল চেয়ে বেড়ায় কি না?

একুশ

দেখতে দেখতে বড়দিন এসে গেল। সুগতবাবু এসেছেন শিরিণবুরুতে। সেখান থেকে মারিয়ানা এবং উনি গিয়ে কুটকুতে থাকবেন দিন কয়েক নিরিবিলি বিশ্রামের জন্যে। কুটকুতে ছুলোয়া শিকারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে পয়লা জানুয়ারি। আমরাও যাব।

ইদানিং আমার বাংলোর সামনের রাস্তা দিয়ে অচেনা জিপের আনাগোনা বেড়ে গেছে। জবরদস্ত শিকারের পোশাক পরা শহুরে শিকারিরা দামি দামি রাইফেল বন্দুক কাঁধে প্রায় প্রতিটি বাংলো দখল করেছেন এসে। জঙ্গলের পাহাড়ে যেখানে-যেখানে হাটিয়া বসে, সেখানে-সেখানে হাটিয়ার দিনে ‘ড্যাঞ্চি বাবুরা নধর পাঁঠা থেকে শুরু করে পেতলের মল, সব কিছু পাচ্য ও অপাচ্য জিনিস দর করে ও কিনে বেড়াচ্ছেন।’

দুপুরবেলায় এবং কখনও গভীর রাতেও এ-বাংলো সে-বাংলো থেকে রেকর্ডপ্লেয়ারে ইংরিজি জাজ বা ওয়ালট্জ-এর রেকর্ড বাজছে।

রুমান্ডি থেকে শর্টকাটে কুটকু যাবার দুটি রাস্তা আছে। প্রথমটি বারোয়াড়ি হুটার-মোড়োয়াই হয়ে কুটকু। অন্য রাস্তাটি ছিপাদোহর হয়ে। রুমান্ডি থেকে একটি জানোয়ার চলা শুঁড়িপথের মতো পথ চলে গেছে। তাতে জিপ কষ্টেসৃষ্টে যায়। লাত থেকে সইদূপ ঘাট হয়ে ছিপাদোহর।

লাতে একটি ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস আছে। লাত্ থেকে কুজরুম হয়ে কুটকু। এই দুটি পথই অতি দুর্গম। জিপ চালাতে রীতিমতো কসরৎ করতে হয়—সারা রাস্তা গোঙাতে গোঙাতে চলে জিপ। দুই পথেই রুমান্ডি থেকে কুট্‌কু পৌঁছতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইল পড়ে।

অতখানি কষ্টকর পথ পার হয়ে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে যখন আমরা মোড়োয়াই থেকে কুটকুতে এসে পৌঁছালাম, তখন সবে পুবের আকাশ লাল হয়েছে। সূর্য ওঠেনি, কিন্তু লাল আভা কুয়াশার জাল ভেদ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই শিশু-সূর্যের সমস্ত অন্তর ধরা পড়েছে কোয়েলের জলে। নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে নদীর একেবারে গা-ঘেঁষে উঁচুতে, ছোট্ট একটি বাংলো।

এই কুটকু। দুদিকে চেয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। কোয়েল যে কী কলরোলা, কী সুন্দরী নয়নভুলানো নদী, তা কুটকুতে না এলে বুঝি জানতাম না।

চারিদিকে পাহাড় ঘেরা, তার মাঝে কোয়েল একটি অভিমানী বাঁক নিয়েছে। নদীতে জল খুব বেশি নেই। জিপের চাকায় জল ছিটোতে ছিটোতে নদী পেরুলাম আমরা। নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছালাম। তারপর একটি বাঁক ঘুরে এসে বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়লাম।

এতক্ষণ বুঝি বোঝা যাচ্ছিল না, বুঝি দেখা যাচ্ছিল না, জায়গাটা কতখানি সুন্দর। বাংলোর সামনে, হাতের সীমানা থেকে প্রলম্বিত একটি কাঠের বারান্দা আছে নদীর একেবারে উপরে। তিন পাশে লোহার শিকলের বেড়া। সেখানে দাঁড়িয়ে কোয়েলের সুন্দরী মুখের সবটুকু চোখে পড়ে। মনে হল, এত কষ্ট করে, ওই ঠাণ্ডায় শেষ রাতে উঠে এতদূর আসা সার্থক হল।

মারিয়ানা ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, বারান্দায় বসুন; আসছি এক্ষুনি। আমরা দুজনে বারান্দায় না বসে বাংলোর হাতায় পায়চারি করতে লাগলাম। ওই রাস্তায় অতখানি জিপে এসে কোমর ধরে যাবার উপক্রম। পায়চারি করতে করতে দেখলাম, গ্যারেজে একটি জিপ এবং জিপের পাশে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি ট্রেলার রাখা আছে।

বাংলোর বাঁ পাশে যে আকাশ-ছোঁয়া পাহাড়টি আছে, তার উপর থেকে এই সাত সকালেই একটি কোটরা থেমে-থেমে ডাকছে ব্বাক ব্বাক করে। আর সেই ডাক, ভোরের কোয়েল বেয়ে বহুদূর অবধি চলে যাচ্ছে, তারপর আবার ওই দূরের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।

নদীর ওপারে কেঁদ গাছের নীচে কী একটি জানোয়ার জল খাচ্ছিল মনে হল, হঠাৎ হুড়মুড় করে জঙ্গল ঠেলে পালাল। ময়ূর ডাকতে থাকল ওপার থেকে।

যশোয়ন্ত বলল, কপালে থাকলে সুগতবাবুর এবারে একটি বড় বাঘ হয়ে যেতে পারে। যা খবর আছে, তাতে ছুলোয়াতে বাঘ যে বেরোবেই, তাতে আমি নিঃসন্দেহ। যদি সে এক দিনের মধ্যে এই জঙ্গল ছেড়ে অন্য কোনওখানে সরে না পড়ে।

আমরা পায়চারি করছি। এমন সময় বাংলোর বারান্দা থেকে ভদ্রলোক ডাকলেন আমাদের, আরে আসুন-আসুন, এদিকে আসুন, চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখছি।

তাকিয়ে দেখলাম মারিয়ানার বন্ধু সুগতকে। লম্বা সুগঠিত চেহারা—বেশ সুপুরুষই বলা চলে। তবে সুন্দর বলতে যা বোঝায় তা নয়। পরনে পায়জামা ও ঘিয়ে ফ্লানেলের পাঞ্জাবি; তার উপরে একটি শাল জড়িয়েছেন। চুলগুলো এলোমেলো। সব মিলিয়ে চেহারা এবং চশমাপরা চোখ দুটির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা মানুষকে প্রথম নজরেই আকৃষ্ট করে। খুব হাসিখুশি ভদ্রলোক।

চৌকিদার অন্য দিক দিয়ে ঘুরে এসে চা দিয়ে গেছে। আমরা চেয়ার টেনে বসলাম। যশোয়ন্ত আলাপ করিয়ে দিল সুগত রায়ের সঙ্গে আমার। ফর্মালি। তাঁর চুরি-করে-পড়া চিঠির মাধ্যমে তাঁকে আমি আগেই চিনতাম।

ভদ্রলোক এমন প্রাণখোলা হাসতে পারেন, এমনভাবে চোখ তুলে তাকান, যেন মনে হয়—বুকের মধ্যেটা অবধি দেখতে পাচ্ছেন।

মারিয়ানাকে লেখা চিঠি পড়ে ফেলেছিলাম বলেই হয়তো, আমার বারবার মনে হল এই এলোমেলো চুল-ভরা মাথা ও কালো চশমার আড়ালে গভীর চোখের অতলতায়, কোথায় যেন একটা বোবা কান্না আছে।

মারিয়ানা ওদিকের দরজা খুলে এল। একটি কালো সিল্কের শাড়ি পরেছে, মধ্যে লাল লাল ফুল তোলা। গায়ে একটি সাদা শাল জড়িয়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়েই যশোয়ন্তকে হেসে বলল, কি? এলেন তো জ্বালাতে? সুগতবাবু যশোয়ন্তের পক্ষ টেনে বললেন, জ্বলতে চাও যে সেটাও স্বীকার কর। নইলে ওকে নেমন্তন্নই বা করবে কেন? মারিয়ানা বলল, আমি মোটেই জ্বলতে চাই না।

মারিয়ানা সুগতের দিকে চেয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, এই যে, এঁর কথাই তোমাকে গল্প করেছিলাম।

সুগতবাবু চায়ের পেয়ালা মুখ থেকে নামাতে নামাতে বললেন, বুঝলেন মশাই, আপনার গল্প শুনে শুনে প্রায় এ কদিনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। মারিয়ানা আপনার খুব বড় অ্যাডমায়ারার।

যশোয়ন্ত তড়াক করে সোজা হয়ে বসে বলল, আর আমার? আমার অ্যাডমায়ারার নয় বুঝি?

মারিয়ানা দুষ্টুমিভরা গলায় বলল, আজ্ঞে না মশাই।

কিছুক্ষণ সময় আমরা চুপচাপ বসে রইলাম, সুগতবাবু বললেন, শেষবারের মতো একটা ময়ূর মারা যাক, বুঝলেন যশোয়ন্তবাবু। ময়ূর তো শিগগিরি ন্যাশনাল বার্ড হয়ে যাচ্ছে।

যশোয়ন্ত বলল, যাই বলুন, এমন মাংস আর খেলাম না।

মারিয়ানা বলল, রোদ উঠেছে, চলুন আমরা নদীর উপরের ওই বারান্দাতে গিয়ে বসি। এমন সুন্দর সকাল; কোথায় চুপ করে বসে থাকবেন, চোখ ভরে দেখবেন—না, সকাল থেকে মাংস খাবার গল্প শুরু হল। আপনারা সত্যিই পরের জন্মে জল্লাদ হয়ে জন্মাবেন।

আমরা গিয়ে ভোরের নরম রোদে ওই বারান্দায় বসলাম। একটা কনকনে হাওয়া আসছে নদীর উপর দিয়ে—মারিয়ানার অলকগুলো কানের পাশে কাঁপছে—সুগতবাবুর এলোমেলো চুলগুলো বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে—সিগারেটটা ঠিক করে কিছুতেই ধরাতে পারছেন না—হাওয়া এসে বারবার দেশলাই নিবিয়ে দিচ্ছে।

সুগতবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হল, ওই মুহূর্তবাহী আগুনের সঙ্গে মারিয়ানার প্রতি সুগতবাবুর ভালবাসারও একটা মিল আছে হয়তো। যতবারই পরিশ্রমের সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে জ্বালতে চান, ততবারই হাওয়ার ফুঙ্কারে নিবে যায়। যা থাকে, তা পোড়া বারুদের গন্ধ।

সুগতবাবু সিগারেট ধরাচ্ছিলেন, মারিয়ানা দেখছিল। অবশেষে একটা কাঠি নিবল না, সুপুরুষ হাতের মুঠোর মধ্যে আগুনটাকে বন্দি করে ফেলে সুগতবাবু সিগারেটটা ধরালেন।

যশোয়ন্ত শুধোল, মিসেস রায়কে নিয়ে এলেন না কেন?

সুগতবাবু যেন একটু বিব্রত বোধ করলেন, বললেন, আসতে বলেছিলাম অনেকবার, কিন্তু ওঁর এক খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ছবির এগজিবিশান আছে এই সময়ে আর্টিসট্রি হাউসে—তা ছাড়া উনি জঙ্গল-টঙ্গল, শিকার-টিকার বিশেষ পছন্দ করেন না, তবে অবশ্য আমার পথে কোনও বাধাও দেন না। নানা কারণে এক সঙ্গে আসা হল না আর কী।

এইটুকু বলে, সুগতবাবু মারিয়ানার দিকে চাইলেন।

মারিয়ানা চোখ নামিয়ে নিল।

কুজরুমের দিকে একটি বস্তিতে কুলথি লাগানো হয়েছে—যেখানে রোজ রাতে সম্বর আসছে। এই শীতকালে পাহাড়ি বস্তিগুলোর চারিদিকে কাড়য়া আর সরগুজায় পাহাড়ের ঢাল আর উপত্যকা সব একেবারে হলুদ হয়ে গেছে। এমন হলুদের সমারোহ বড় একটা দেখা যায় না। শান্ত সবুজের পটভূমিতে এই নরম হলুদ বড় চোখ কাড়ে।

সকলে মিলে ঠিক করা হল, বিকেলে হেঁটে-হেঁটে মুরগি, তিতির, বটের, আসকল, কালি-তিতির এবং হরিয়াল, যা পাওয়া যায়, তাই শিকার করা হবে। তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া আটটা নাগাদ সেরে কুজরুমের রাস্তায় কুলথি খেতে সম্বরের অপেক্ষায় পাতার ঝোড়ায় বসে থাকা হবে।

রাত বেশি না হলে সম্বর সচরাচর পাহাড় থেকে না, না; তবে বরাত ভাল থাকলে প্রথম রাতেও অনেক সময় পাওয়া যায়। যাই হোক, আমি বললাম, পাহাড়ের উপত্যকায় শালপাতার ঝোড়ায় বসে এই ঠাণ্ডায় তো প্রাণ যাবার উপক্রম হবে—ওর মধ্যে আমি নেই। তোমরা যাও।

যশোয়ন্ত বলল, সে কথা মন্দ নয়, তা ছাড়া মারিয়ানারও একা-একা লাগবে। কত রাতে আমরা ফিরব তার তো ঠিক নেই। তুমি নাই বা গেলে।

বিকেলে মারিয়ানা বাংলোতেই ছিল। চুলটুল বেঁধে মুখ-হাত পরিষ্কার করে সেজেগুজে সেই ঝুল বারান্দাটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখনও বেশ বেলা ছিল। আমি যশোয়ন্ত এবং সুগতবাবু তিনজনে তিন দিকে বন্দুক হাতে ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়েছিলাম।

জঙ্গলের মধ্যে এদিক-ওদিকে কিছু দূর হাঁটাহাঁটি করার পর বাংলোর উল্টোদিকে একটা কেঁদ গাছের নীচের একটা বড় কালো পাথরে আমি পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম।

এপার থেকে ওপারের কুটকু বাংলোটিকে দেখা যাচ্ছিল। সেই নদীর ওপারের কাঠের বারান্দায় মারিয়ানা দাঁড়িয়ে আছে একটা নীল শাড়ি পরে। আমি দেখছিলাম। কোয়েলের গেরুয়া পাহাড়ের পটভূমিতে মারিয়ানাকে মনে হচ্ছিল একটি একান্ত একলা ছোট্ট নীল পাখি, যে সরগুজার হলুদ ক্ষেতে পথ-ভুলে ঢুকে পড়েছে, তারপর হলুদে চোখ বেঁধে গেছে, আর বেরিয়ে আসতে পারছে না।

শিকার করতে বেরিয়েছিলাম বটে, কিন্তু শিকার করতে ইচ্ছে করে না। প্রথম প্রথম রুমান্ডিতে আসার পর যশোয়ন্ত বলেছিল, জঙ্গলকে ভালবাসতে শেখো—তারপর দেখবে বন্দুক হাতে বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালে দিলখুশ হয়ে যাবে। এ ক’দিনে জঙ্গলের সম্বন্ধে যে অহেতুক ভয়টা ছিল, সেটা সত্যিই কেটে গেছে। বন্দুক চালাতে শিখিয়েছে যশোয়ন্ত আমাকে। গুলি লাগাতে শিখিয়েছে। আমার নিজের ওপর এখন আস্থা জন্মেছে। তাই সত্যিই আজকাল বনে-পাহাড়ে নির্ভয়েই চলাফেরা করি, কিন্তু শুধুই শিকার করতে আর ইচ্ছা করে না।

এই কুটকুর আসন্ন সন্ধ্যায় যে সুর, যে রঙ, যে ছবি—তার সঙ্গে বন্দুকের আওয়াজের যেন কোনও মিল নেই। যে আশ্চর্য শান্ত সুর জলের কুলকুলানিতে এবং মসৃণ পাতার চিকনতায় এখানে অনুরণিত হচ্ছে, তাতে বন্দুকের আওয়াজ হলে সেই মেজাজটি যেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

হঠাৎ আমার ডানদিকে কঁক্-কঁক্ করে আওয়াজ হল, শুকনো পাতা সরানোর সড়সড় খস-খস আওয়াজ—তারপরেই দেখলাম একটি প্রকাণ্ড মোরগ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমাকে দেখতে পায়নি। বন্দুকটা আমার কোলে শোয়ানো আছে। মোরগটা গলা উঁচু করে আত্মবিশ্বাস ও কিঞ্চিৎ গর্বের সঙ্গে ডাকল কঁকর-ক্ক-ক্ক-ক্ক-কঁ-কর-ক্ক। এমন সময় একটা মেটে-রঙা আঁট-সাঁট গড়নের টাইট করে কোমরে সেপটিপিন-আটকানো শাড়ি পরা মুরগি এসে তাকে কুর্-কুর্ করে কী বলল—তক্ষুনি যৌবনমদে মত্ত মোরগটা আবার মুরগির সঙ্গে আড়ালে চলে গেল। আমার গুলি করা হল না। গুলি করার কথা মনেই পড়ল না।

আমার পেছনে এবং নদীর ওপারে বাংলোর দিক থেকে আগে-পরে দু-তিনটে বন্দুকের আওয়াজ হয়েছিল।

জানি না যশোয়ন্ত বা সুগতবাবু কী মারলেন।

বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। একটু পরেই কোয়েলের জল থেকে রেফ্রিজারেটার খুললে যেমন ঠাণ্ডা ধোঁয়া বেরোয়, তেমনই ধোঁয়া উঠতে আরম্ভ করবে। সূর্য প্রায় হেলে পড়েছে। বাংলোয় গিয়ে মারিয়ানার হাতে বানানো এক কাপ কফি খাব।

কোয়েলের জল পেরিয়ে বাংলোয় ফিরতেই মারিয়ানা বলল, কী মারলেন? আমি বললাম, কিছুই মারলাম না। ওই পারে গিয়ে চুপ করে একটা পাথরে বসেছিলাম। সেখান থেকে আপনাকে দেখা যাচ্ছিল।

মারিয়ানা চোখ তুলে বলল, সত্যি? আমি কী করছিলাম?

আমি বললাম, আপনি কৃষ্ণচূড়ার ডালের নীল পাখির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই জঙ্গল-পাহাড়-নদী; এই অস্তগামী সূর্য—সব মিলিয়ে যে ছবিরই সৃষ্টি হয়েছে, সেই ছবির একটি আঙ্গিক আপনি।

মারিয়ানা খুশি হল। বলল, থাক, আমাকে নিয়ে কাব্যি করতে হবে না। পারেনও আপনি। হাতে বন্দুক নিয়ে অত কাব্যি আসে?

বললাম, কাব্যের অনুপ্রেরণা থাকলে আসে। তবে ঠাণ্ডায় কাব্য হিম; জমে আইসক্রিম হয়ে যাচ্ছে—এক কাপ গরম, খুব গরম কফি চাই।

সত্যিই? একটু বসুন, আমি এক্ষুনি চৌকিদারকে জল বসাতে বলে আসি।

যশোয়ন্ত একটা খরগোশ মেরেছে। বলল, ব্যাটাকে বাঁশ-পোড়া করব কাল। সুগতবাবু একটি আসকল এবং একটি কালি-তিতির মেরেছেন।

ঠাণ্ডাও পড়েছে। অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। বড় নদীর পাশে বলে ঠাণ্ডা আরও বেশি। যশোয়ন্ত ঢক-ঢক করে আধ বোতল র’ রাম খেয়ে বোতলটি ট্যাঁকস্থ করে জিপে উঠেছে। সুগতবাবু ডিনারের আগে দু’ পেগ হুইস্কি খেয়েছিলেন যশোয়ন্তের অনুরোধ এবং মারিয়ানা বারণ করা সত্ত্বেও। খাওয়া-দাওয়ার পর সুগতবাবু কালো, ভারী ওভারকোটটা পরে নিয়েছিলেন। ভাল করে ফ্লানেল দিয়ে রাইফেলটা মুছেছিলেন; তারপর যশোয়ন্তের সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

আমি আর মারিয়ানা জিপ অবধি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম ওঁদের। মারিয়ানা বলেছিল, সুগত বেশি রাত করবে না কিন্তু। ঠাণ্ডা লাগলেই তোমার ফ্যারেঞ্জাইটিস বাড়ে।

পাটা জিপে তুলতে-তুলতে সুগতবাবু বললেন, তুমি যখন বলছ, তাই হবে। মারিয়ানা ঠোঁট উল্টে বলল, ঈস, আমার সব কথাই তো সব সময়ে শুনছ।

যশোয়ন্ত জিপটা স্টার্ট করল। হেডলাইটটা জ্বালল, তারপর ইঞ্জিনের গুনগুনানি জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। কুজরুমের পথে হেডলাইটের নৃত্যরত বৃত্তটি দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল।

চাঁদ উঠেছিল, কিন্তু শিশিরে চাঁদের আলো কেমন ঘোলাটে-ঘোলাটে লাগছিল। একটি নাইট- জার চি-র-প্-চি-র-প্ করে উড়ে-উড়ে কী যেন দুঃখের খবর ছড়াচ্ছিল।

এক অতীন্দ্রিয় শান্তি। এ এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য নির্জনতা। কান পাতলে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনা যায়। কোনও কারণে যদি বুকের রক্ত ছলাৎ-ছলাৎ করে ওঠে, কাছে যে থাকে, সেও সে শব্দ শুনতে পায়।

মারিয়ানা শুধোল, এক্ষুনি শোবেন?

বললাম, শুলে মন্দ হয় না। ঘুমটা বেশ জমিয়ে আসছে।

ও বলল, আমি তো দুপুরে আজকে অবাক কাণ্ড করেছি। আপনারা যখন রোদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন খাওয়ার পর, আমি তখন বেশ একটু ঘুম…বলে চোখেমুখে দুষ্টুমি মেখে হাসল। তারপর বলল, চলুন আমার ঘরে বসি। আপনি তো আবার যশোয়ন্তবাবুর মতো ঢকঢকিয়ে হার্ড ড্রিংকস খেতে পারেন না।

কফি বানিয়ে, কফির পেয়ালায় এক চুমুক দিয়ে মারিয়ানা বলল, একটা কথা শুধোচ্ছি, কিছু মনে করবেন না আশা করি। কেন না, আমার ও আপনার সম্পর্কটা এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে অনেক কথা অকপটে বলা চলে। তাই বলছি। আচ্ছা লালসাহেব, আপনি কখনও কাউকে ভালবেসেছেন?

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

বললাম, দেখুন, ভালবাসার মানে যদি কাউকে স্তুতি করা, কাউকে চাওয়া হয়, তাহলে ভালবেসেছি। এমন মানুষ কোথায় যে, কখনও না কখনও কাউকে না কাউকে চায়নি? তবে ভালবাসায় যে পাওয়ার দিকটা থাকে, সে বাবতে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। তাই ভালবেসেছিও বলতে পারেন, আবার ভালবাসিনিও বলতে পারেন। যদি কাউকে ভালবেসে থাকি, তাকে জোর করে অধিকার করার সাহস হয়নি।

মারিয়ানা হাসল। বলল, আশ্চর্য।

তারপর বলল, তাহলে আমার প্রশ্নটা আর একটু খুলেই বলি। আপনি কি মনে করেন, ভালবাসা মানসিক ব্যাপারের মতো একটা জৈবিক ব্যাপার—এ কি শুধুই মানসিক হতে পারে না? আমি এবং আমার মতো অন্য অনেক মেয়েই বিশ্বাস করি যে, ভালবাসাটা একটা সম্পূর্ণ মানসিক অবস্থা বিশেষ। এর সঙ্গে দেহের কোনও সম্পর্ক সব সময় নাও থাকতে পারে।

আমি বললাম, দেখুন, এ প্রসঙ্গটা এত পুরনো ও ঘোরালো, তাতে অন্য লোকের মতামত না নিয়ে নিজের-নিজের মতো নিয়ে থাকাই ভাল—তবে আমার মতো যদি জানতে চান, তাহলে বলতে হয় শরীরকে পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই বোধ হয়। আমি যদি কাউকে কোনওদিন ভালবেসে থাকি, তাহলে তার মনটার চেয়ে শরীরটাকেও কম বাসিনি। তাকে যখন পেতে চেয়েছি, তার বুদ্ধিমতী মানসিক সত্তার সঙ্গে তার সুগন্ধি শারীরিক সত্তাকেও সমানভাবে চেয়েছি। জানি না, হয়তো এ আমার নিজের কথা।

মারিয়ানা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, আপনারা মানে পুরুষরা কেমন অন্যরকম। আপনাদের এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকই তফাত। আশ্চর্য! অথচ আমরা এক শিক্ষা পাই, এক বাবা-মার কাছে মানুষ হই। অথচ কেন এমন হয় বলতে পারেন?

আমি হেসে বললাম, মাপ করবেন, বলতে পারব না।

মারিয়ানার ঘরে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে, চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম, নিন শুয়ে পড়ুন দরজা বন্ধ করে।

মারিয়ানা বলল, কম্বলের তলায় আরাম করে শোবো বটে, ঘুম আসবে না। বই পড়ব। তারপর দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, দেখুন, রাতে ওরা ফিরলে আমাকে জাগাবেন কিন্তু প্লিজ। যদি কফি-টফি খেতে চায়। সুগতর গলার পেইন্টটা আমার ঘরে আছে, যদি দরকার হয়।

বাইশ

ছুলোয়া শিকারের সব আয়োজন প্রস্তুত।

গত রাত্রে ওরা বৃথাই শীতে কষ্ট পেয়ে মরল। রাত আড়াইটে-তিনটে নাগাদ ফিরে এসেছিল। শম্বর আসেনি কুলথি খেতে। তবে কোয়েলের দিক থেকে একটা বাঘের গোঙানির আওয়াজ শুনেছে ওরা। শম্বরের ডাক শুনেছে তার অব্যবহিত পরেই। ডাকতে ডাকতে দৌড়ে গেছে শম্বরের দল নদীর দিক থেকে পাহাড়ে।

মাচা বাঁধা হয়েছে চারটে। প্রথমে যশোয়ন্ত, তারপর সুগতবাবু, তারপর আমি এবং সর্বশেষে টিগা বলে স্থানীয় একজন ওঁরাও দেহাতি শিকারি।

ছুলোয়া করবার ভার যে নিয়েছে, তাকে দেখলেই বেশ অভিজ্ঞ যে, তা বোঝা যায়। কুজরুম বস্তির লোক সে। ছুলোয়া করনেওয়ালারা বেশির ভাগই কুজরুমের লোক।

দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোতে বেরোতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। সকালে ছুলোয়া করলেই ভাল হত; কিন্তু রাত তিনটেয় ফিরে যশোয়ন্ত আর সুগতবাবু ঘুম থেকে উঠেছেন প্রায় এগারোটা বাজিয়ে। তারপর খুব তাড়াতাড়ি করা সত্ত্বেও বাংলো থেকে বেরোতে বেরোতেই প্রায় দুটো হয়ে গেল।

প্রথম ছুলোয়া যখন আরম্ভ হল তখন প্রায় পৌনে তিনটে বাজে। দেখতে দেখতে ছুলোয়া করনেওয়ালারা এগিয়ে এল। উত্তেজনা বাড়তে লাগল। হাতের তালু ঘামতে লাগল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। একদল ময়ূর না-উড়ে মাটিতে মাটিতে দৌড়ে গেল আমার মাচার তলা দিয়ে। তারপরই যশোয়ন্তের মাচার দিক থেকে ও ট্রিগার মাচার দিক থেকে পরপর রাইফেল ও বন্দুকের দুটি আওয়াজ পেলাম। কী মারল জানি না।

এমন সময় আমার একেবারে সোজাসুজি জঙ্গল ঠেলে একটি অতিকায় দাঁতাল শুয়োর বের হল। অতবড় শুয়োর যে হয়, নিজে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। আমার মাচা বোধ হয় বরাহপ্রবরের নজরে পড়েনি। আরো দু-পা এগিয়ে আসতেই আমি বন্দুক তুলে গুলি করলাম এবং গুলি লাগল গিয়ে ঘাড়ের পেছনে, মেরুদণ্ডে। গুলিটা লাগামাত্র শুয়োরটা চার-পায়ে মাটি ছিটকোতে ছিটকোতে ঘুরপাক খেতে লাগল ওই জায়গাতেই। চরকিবাজির মতো। প্রথম গুলিটা জব্বর হল কি হল না, বুঝতে না পেরে, বাঁ ব্যারেলে যে এল. জি. ছিল সেইটাও দুরগুম করে দেগা দিলাম। একটু দৌড়ে গিয়েই পড়ে গেল শুয়োরটা। পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করল, তারপর স্থির হয়ে গেল।

শুয়োরের সঙ্গে গতজন্মে শত্রুতা ছিল কিনা জানি না, কিন্তু শুয়োরের বাচ্চারা ভালবেসে বারবার আমারই সামনে হাজির হবে। কি বনে, কি শহরে।

ছুলোয়া শেষ হলে নেমে গিয়ে দেখি যশোয়ন্ত একটি চৌশিঙা হরিণ মেরেছে—। টিগা মেরেছে একটি শিঙাল চিতল। সুগতবাবু বললেন, আমার এত ঘুপ পাচ্ছে ভাই যে, কী বলব—আমি তো মাচায় বসে গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—আপনাদের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙল। তলা দিয়ে কিছু গেল কি না, তাও জানি না। আজকাল মোটেই রাত জাগতে পারি না। বড় কষ্ট হয় রাত জাগলে।

ওই এক মাচাতেই উল্টোমুখে বসে আর একবার শিকার হবে। এই শেষ ছুলোয়া। এই ছুলোয়া শেষ হতেই রাত হয়ে যাবে প্রায়।

তাড়াতাড়ি করে প্রথম ছুলোয়ার শিকারগুলি টেনে একটা দোলা-মতন জায়গায় নামিয়ে রেখে ছুলোয়াওয়ালারা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে একটা পাকদণ্ডী পথে ছুটে গেল। পনের-কুড়ি মিনিট পরেই মুখিয়া একটি কেঁদ গাছে উঠে কু’ দিল। নালার ওপাশের পাহাড় থেকে আওয়াজ হল ‘কু-উ-উ-উ’। শুরু হল ছুলোয়া।

যশোয়ন্ত বলছিল যে, এই ছুলোয়াতে বাঘের আশা বেশি। কারণ, এখানের লোকদের ধারণা যে, মধ্যবর্তী পাহাড়ের নালাতেই বাঘের আস্তানা। যতদূর জানা গেছে, তাতে একটি বাঘ আছেই। গতকাল রাতের গোঙানির আওয়াজে যশোয়ন্তের সে বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে। যদিও ছুলোয়া খুব তাড়াতাড়ি করে করা হল, তবু বাঘ বেরোনো মোটেই আশ্চর্য নয়।

রোদের তেজ প্রায় নেই বললেই চলে। কাঁধে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। দূরের টাঁড় থেকে তিতিরের কান্না ভেসে আসছে, টি—হা—র্টিঁউ টিঁউ—টি—হা। একটা বড় কাঁচপোকা আমার মাচার কাছে ঘুরে-ঘুরে গুনগুন করে উড়ছে। বিদায়ী সূর্যের সোনালি ফালি পাতার ফাঁকে ফাঁকে এসে সারা বনে এক মোহময় বিষণ্ণ আবেশের সৃষ্টি করেছে। কোয়েলের উপরে দক্ষিণের আকাশে একদল লালশির পোচার্ড উড়ে যাচ্ছে ডানা ঝটপটিয়ে। সব মিলে এমন একটা নিস্তব্ধ নির্লিপ্তি যে, কী বলব।

ছুলোয়া শুরু হল। গাছের গায়ে টাঙ্গি দিয়ে হালকাভাবে মারায় ঠকাঠক শব্দ, ছুলোয়াওয়ালাদের মুখ-নিঃসৃত নানারকম বিচিত্র শব্দলহরী কানে এসে পৌঁছচ্ছে।

ধীরে ধীরে ওরা এগিয়ে আসছে। কাছে আসছে, আরও কাছে। মনে হল, ছুলোয়াওয়ালাদের দূর থেকে শোরগোল করে কী যেন বলল, উমমে যাতা হ্যায়। বড়কা বাঘোয়া বা। অন্য একজন বলল, ডাবল বাঘোয়া বা। আরেকজন বলল, সামহাল হো। বড়া বাঘ।

এমন সময় সুগতবাবুর মাচার দিক থেকে একটি রাইফেলের গুলির অতর্কিত আওয়াজ শোনা গেল—এবং তার বোধহয় পাঁচ-ছয় সেকেন্ড বাদেই একটা অত্যন্ত তীব্র ও বুককাঁপানো আর্ত চিৎকারে কানে এল। চিৎকার শুনে সেটা যে মানুষেরই চিৎকার, প্রথমে তা মনে হল না—বুকফাটা এমন একটা আঁক—আঁ-আর-র-র আওয়াজ যে, শুনে গলা শুকিয়ে গেল। কিন্তু আগে কি পরে আর কোনও আওয়াজ হল না।

সেই ক্ষণস্থায়ী নিরুদ্ধ আওয়াজের পরই সমস্ত বন-পাহাড় আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আবার কাঁচপোকাটার গুনগুনানি শোনা যেতে লাগল কানের কাছে—গুন-গুন-গুন-গুন।

কী করব ঠিক করতে পারলাম না। যশোয়ন্তের কড়া নিষেধ ছিল যে, ছুলোয়া চলাকালীন মাচা থেকে যেন না নামি। তা ছাড়া ভয়ও করছিল। সত্যিই যদি বাঘ হয়। ওই আওয়াজটা কীসের তা বুঝে উঠতে পারলাম না—বাঘের, না মানুষের।

কেন জানি মনে কু ডাক দিল যে, সুগতবাবু নিশ্চয়ই আক্রান্ত হয়েছেন। মাচা থেকে নামব কি নামব না ভাবতে ভাবতে ওই দিক থেকে আর একটি রাইফেলের গুলির আওয়াজ পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার নাম ধরে অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় যশোয়ন্ত আমাকে ডাকছে শুনলাম।

এদিকে ছুলোয়া করনেওয়ালারা প্রায় মাচার কাছ অবধি পৌঁছে গেছে। মাচা থেকে নামতে নামতে শুনলাম, যশোয়ন্ত চেঁচিয়ে বলছে, ছুলোয়া বনধ করো, বন্ধ করো। খাতরা বন গিয়া—খাতরা বন গীয়া—খাতরা বন গীয়া।

যশোয়ন্তের কথা শুনে ছুলোয়াওয়ালারা একে অন্যকে হাঁক দিয়ে বলতে লাগল—খাতরা বন গীয়া হো-খাতরা বন গীয়া হো।

ঘন বনের মধ্যে শীতের বিকেলে সেই থমথমে কুসংবাদটি গমগম করে কেঁপে কেঁপে ভেসে বেড়াতে লাগল বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। খা-ত-রা—বন—গী-য়া—হো—খা-ত-রা—বন—গীয়া-অ-আ-আ…

গাছ থেকে নেমে দৌড়ে সুগতবাবুর মাচার দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালাম।

মাচা থেকে সুগতবাবুর শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বাইরে ঝুলছে। কপাল মাথা ও চুল গড়িয়ে দরদর করে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে নীচে মাটিতে পড়ছে এবং একটি মাঝারি আকারের বাঘ মাচার পেছনে মুখ-থুবড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। মাচার লতার বাঁধন খুলে গেছে। দু তিনটি কাঠ খুলে নীচে পড়ে আছে।

আমাকে আসতে দেখে যশোয়ন্ত ওর রাইফেলটাকে ভূ-লুণ্ঠিত বাঘের গায়ে শুইয়ে তরতর করে মাচায় উঠে আমাকে নীচে দাঁড়াতে বলল। আমি দাঁড়াতেই সুগতবাবুকে ধরে আলতো করে আমার সাহায্যে মাটিতে নামাল।

ততক্ষণে হাঁকোয়া সবাই এসে গেছে। আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করছে। টিগা কোথা থেকে দৌড়ে কী কতগুলো পাতা ছিঁড়ে এনে সেই রস নিঙড়ে দিতে লাগল সুগতবাবুর গলায়। সুগতবাবুর ডান কাঁধ এবং গলার কিছু অংশ ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে বাঘটা—। নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে গলার ফুটো দিয়ে রক্ত ও ফেনা বেরোচ্ছে। ফরসা মুখটা এবং এলোমেলো চুলগুলো গাঢ় ঘন রক্তে থকথক করছে। চশমাটা মাচার নীচে পড়ে আছে। একটা কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে।

অত রক্ত দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল।

টিগা এবং তার অনুচরেরা বিনা বাক্যব্যয়ে দু’ মিনিটের মধ্যে শলাইগাছের ডাল কেটে লতা দিয়ে বেঁধে একটা স্ট্রেচারের মতো বানিয়ে ফেলল। আমি এবং যশোয়ন্ত সুগতবাবুর অচৈতন্য শরীরটাকে ধরাধরি করে তাতে তুলে দিলাম। যশোয়ন্ত সুগতবাবুর রাইফেলটাকে আনলোড করে নিজের কাঁধে নিল। তারপর আমরা হনহনিয়ে জিপের দিকে চললাম। কিছু লোক রইল বাঘের তত্ত্বাবধানে।

এতসব কাণ্ড যে ঘটে গেল—সে সব বড় জোর দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে। জিপে পৌঁছে আমি আর টিগা জিপের পেছনের সিটে সুগতবাবুকে যতখানি পারি সাবধানে কোলে শুইয়ে নিয়ে বসলাম। রক্তে আমাদের গা-হাত-পা মাখামাখি হয়ে গেল। যশোয়ন্ত জিপের স্টিয়ারিং-এ বসল। ওখান থেকে কুটকু বাংলো জিপে বেশি দূরের পথ নয়।

যশোয়ন্ত বলল, বাঁচবে বলে মনে হয় না হে লালসাহেব।

আমি যেন চমকে উঠলাম। জখম হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, সব বুঝছি, সব দেখেছি, কিন্তু এই সুগতবাবু—মারিয়ানার এত আদরের সুগত, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, আমার ও টিগার কোলে শুয়ে আছেন, এখনও নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রাণের বার্তাবাহী রক্ত ও ফেনা বেরোচ্ছে—তিনি যে সত্যি সত্যিই মরে যাবেন, তা ভাবা যায় না।

মানুষ কী করে চোখের সামনে, কোলের মধ্যে মরে, তা জানি না কখনও—জানতে চাইওনি, এই মুহূর্তেও জানতে চাই না।

মানুষের এবং সদ্বংশজাত মানুষের রক্তেও তো কম দুর্গন্ধ নয়। চ্যাট-চ্যাট করছে। এ রক্তে শম্বরের রক্তের মতোই বদবু—ঈস যে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে জিপে পড়ছে, জমে যাচ্ছে, সে রক্ত কোনও চিতল হরিণের নয়, শুয়োরের নয়; সে রক্ত যে সুগতবাবুর, তা ভাবতে পারছি না।

যশোয়ন্ত বলল, বাঘটাকে সামনা-সামনি গুলি করেই ভুল করেছিলেন উনি। বাঘটা নিশ্চয়ই একেবারে মুখোমুখি আসছিল। কিন্তু ওঁর গুলি বাঘের বুকে লাগা সত্ত্বেও বাঘ সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে মাচায় উঠে ওই মরণ-কামড় দিয়েছিল।

ও বলল, আমি চিৎকার শুনেই দৌড়ে গেছিলাম এবং দূর থেকে দেখি, বাঘ কাজ শেষ করে মাচা থেকে লাফিয়ে পড়ছে। কিন্তু মনে হল, পালাবার চেষ্টা করেও পারছে না। ওই অবস্থাতেই আমি বেশ দূরে থাকা সত্ত্বেও একটি গুলি করলাম এবং তাতেই দেখলাম বাঘ শুয়ে পড়ল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুগতবাবু হার্ড-নোজড বুলেট ব্যবহার করেছিলেন, সফট-নোজড বুলেট হলে বাঘ লাফিয়ে হয়তো মাচায় উঠতে পারত না। ডাবল ব্যারেল রাইফেল থাকলে হয়তো আর একটি গুলি করতে পারতাম, বাঘ মাচায় ওঠার আগে। যাক, সেসব আলোচনা করে এখন আর কী হবে। কী লাভ?

আমি বললাম, সব তো বুঝলাম, সব তো বুঝলাম, এখন মারিয়ানাকে গিয়ে কী বলবে যশোয়ন্ত? মারিয়ানাকে গিয়ে কী বলব?

যশোয়ন্ত উত্তর দিল না। রাস্তায় চোখ রেখে গাড়ি চালাতে লাগল।

দেখতে দেখতে কুটকু বাংলোয় পৌঁছে গেলাম আমরা; যশোয়ন্ত বলল, একটা কম্বল, মারিয়ানার একটা শাড়ি এবং অ্যান্টিসেপটিক যদি কিছু বাংলোয় থাকে তো এক্ষুনি নিয়ে এসো। মারিয়ানাকেও সঙ্গে নিয়ে এসো। এক্ষুনি। নষ্ট করার মতো সময় নেই।

টিগার কোলে সুগতবাবুর মাথাটা দিয়ে দৌড়ে গেলাম বাংলোয়। যশোয়ন্ত জিপটা হাতার মধ্যে ঢোকালেও বাংলো থেকে একটু দূরে রেখেছিল।

মারিয়ানা ঘরে নেই। বাবুর্চিখানায় কী যেন করছে। বাবুর্চিখানার দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই উঁচু উনুনের উপরের কড়াইয়ে কী একটা নাড়তে নাড়তে ও বলল, কি মশাই? ফিরেছেন? এত তাড়াতাড়ি? তারপর আমুদে গলায় বলল, আপনাদের জন্য চিঁড়ের পোলাও রান্না করালাম। সুগত খুব ভালবাসে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

উত্তর না দিয়ে আমি ডাকলাম, মারিয়ানা—।

মারিয়ানার মনে আমার সেই ডাক নিশ্চয়ই কোনও হিমেল ভয় পৌঁছে দিয়েছিল। এক মোচড়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েই ও আমার রক্তাক্ত চেহারা দেখে আঁতকে উঠল। চমকে উঠে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে লালসাহেব?

বললাম সংক্ষেপে; যা বলার। মনে হল, মারিয়ানার সেই চমক কেটে গেল। ওর চোখ দুটি নিথর হয়ে গেল। দৌড়ে ঘরে গিয়ে একটা সাদা শাড়ি, এক শিশি ডেটল এবং একটি কম্বল নিয়ে এল। আমি আর এক দৌড়ে ওর ঘরে ঢুকে ওর শালটি নিয়ে এলাম। তারপর আমরা দুজনে দৌড়ে এসে জিপে উঠলাম।

টিগা ও চৌকিদার বন্দুক রাইফেলগুলো নিয়ে ঘরে গেল। ওরা বাংলোর জিম্মাদারিতে রইল। সুগতবাবুর যে ড্রাইভার, সে খাস বেয়ারাও বটে। সে লোকটি ভীষণ কাঁদতে লাগল—কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল—বাবু, আমার দাদাবাবুকে বাঁচান, আপনারা যেমন করে পারেন বাঁচান, নইলে আমি কোন মুখ নিয়ে বউদির কাছে ফিরব?

ওকে যশোয়ন্তের কাছেই বসতে বললাম, জিপের সামনের সিটে।

যশোয়ন্ত জিপ স্টার্ট করল।

অন্ধকার হয়ে গেছে। হেডলাইটের আলোটা জংলি পথে ছলছল চোখে চলতে লাগল। পথও তো কম নয়। ছিপাদোহরে ডাক্তার আছেন, কিন্তু এইরকম রুগীর চিকিৎসার সাজসরঞ্জাম নেই। তাই উপায় নেই কোনও। ডালটনগঞ্জেই যেতে হবে। কোয়েলের জল পেরিয়ে ওপারে পৌঁছল জিপ। তারপর গোঙাতে গোঙাতে চলল।

মারিয়ানা কিন্তু কাঁদল না একটুও। ভেবেছিলাম কাঁদবে। একবার অস্ফুটে শুধু বলেছিল, সুগত—উঃ…।

সাদা শাড়িটা সুগতবাবুর কাঁধে ও গলায় জড়িয়ে তার উপরে জবজবে করে ডেটলের পুরো শিশি উপুড় করি দিলাম। যশোয়ন্ত জিপের ড্যাশ বোর্ডের ড্রয়ার থেকে রামের শিশিটা বের করে মুখ হাঁ করে ঢেলে দিতে বলল। দিলামও বটে, কিন্তু কিছুটা কষ বেয়ে গড়িয়ে গেল এবং কিছুটা গলার ফুটো দিয়ে বেরিয়ে এল।

তাতে ভাল হল কি মন্দ হল কে জানে?

পাছে ঠাণ্ডা লাগে, তাই আধখানা কম্বল দিয়ে সুগতবাবুকে ঢেকে দিয়েছি। আর আধখানা নীচে দিয়েছি। আমার কোলের উপর কোমর ও পা রেখেছি, মারিয়ানার কোলে মাথা। পায়ের কিছুটা বেরিয়ে আছে পেছনে, পাঁজাকোলা করে শোয়ানো সত্ত্বেও। অতবড় লম্বা-চওড়া মানুষটা।

যশোয়ন্ত যত সাবধানে পারে জিপ চালাচ্ছে, যাতে ঝাঁকুনি কম লাগে। কিন্তু এদিকে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো দরকার। মারিয়ানা কোনও কথা বলছে না। মাঝে মাঝে মুখটা দিয়ে সুগতবাবুর কম্বলে ঢাকা বুকটার কাছে রাখছে। বোধ হয় হৃৎপিণ্ডের রায় শুনছে। একেবারে সোজা হয়ে দৃঢ় ঋজু শালগাছের মতো বসে আছে মারিয়ানা।

উল্টো দিক দিয়ে একটা ট্রাক আসছিল। যশোয়ন্ত জিপটা বাঁ দিক করল, ওই ট্রাকের হেডলাইটের আলোয় জিপের ভেতরটা ভরে গেল। সেই আলোয় দেখলাম, মারিয়ানা জিপের পরদায় হেলান দিয়ে সোজা হয়ে বসে আছে। দু চোখ বেয়ে নিঃশব্দ ধারায় জল বইছে। চোখে চোখ পড়তেই, দাঁতে ঠোঁটটা কামড়ে ধরল ও।

হুটারের কাছাকাছি গিয়ে যশোয়ন্ত এক সেকেন্ডের জন্যে জিপটা থামাল, একটা চুট্টা ধরাবে বলে। দেশলাই জ্বালতেই মারিয়ানা ঘৃণার সঙ্গে বলল, যশোয়ন্তবাবু, একটা লোক মরতে বসেছে আর আপনার চুট্টা না খেলেই হত না।

যশোয়ন্ত অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি চুট্টাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার জিপে স্টার্ট দিল।

এমন সময় সুগতবাবুর গলা থেকে একটা জোর ঘড়-ঘড়ানি আওয়াজ হতে লাগল। একটানা মিনিটখানেক—তারপরই আওয়াজটা হঠাৎ থেমে গেল।

মারিয়ানা কেঁদে উঠে শুধোল, কী হল? এমন হল কেন? যশোয়ন্তবাবু, কী হল?

যশোয়ন্ত দৃঢ় গলায় ধমকের সুরে বলল, কিছুই হয়নি। ভাল করে শোয়ানো হয়নি সুগতবাবুকে। ওঁর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। যশোয়ন্তের কথামতো আমরা ওঁকে একটু নাড়াচাড়া করে ভাল করে শোয়ালাম।

ডালটনগঞ্জের হাসপাতালে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত প্রায় ন’ টা। যশোয়ন্ত দৌড়ে গেল হাসপাতালের ভিতরে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুজন ওয়ার্ড বয় একটা স্ট্রেচার নিয়ে এল। আমরা দুজন সুগতবাবুকে সাবধানে তাতে তুলে দিলাম। রক্ত জমে মারিয়ানার শাড়িতে একেবারে থকথক করছে। আমাদের প্রত্যেকের গায়েই রক্ত। আমরা সকলেই সঙ্গে সঙ্গে গেলাম।

অপারেশন থিয়েটারের টেবিলের উপর ওঁকে রাখা হল। সাহেব ডাক্তার এসে স্টেথিস্কোপ লাগালেন বুকে। নার্সরা ডিসইনফেকট করার যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখতে লাগল ট্রেতে। কিন্তু সকলকে হতভম্ব করে ডাক্তার বললেন, আই অ্যাম স্যরি জেন্টেলমেন, হি মাস্ট হ্যাভ ডায়েড অ্যাট লিস্ট অ্যান আওয়ার ব্যাক।

যশোয়ন্ত সুগতবাবুর হাত থেকে রিস্টওয়াচ ও হিরের আংটিটা খুলে নিল। বুকপকেট থেকে পার্স এবং কতকগুলো কাগজপত্র যা ছিল, তা আমি নিয়ে আমার কাছে রাখলাম। কিছুক্ষণ পর মারিয়ানাকে আমরা জোর করে নিয়ে সুমিতাবৌদির কাছে রেখে এলাম।

কিছুতেই যেতে চাইছিল না ও সুগতবাবুকে ছেড়ে।

বিকেলবেলার হাসিখুশি সুপুরুষ রাতের বেলার রক্তাক্ত শব হয়ে গলে।

সুমিতাবউদির বাড়ি থেকে ফিরবার সময় যশোয়ন্ত বলল, একটু চোখ রেখো চারদিকে। এখানে বাঘ নেই বটে, তবে জগদীশ পাণ্ডে আছে। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে।

যশোয়ন্ত বাইরে গেল আবার। কলকাতায় মিসেস রায়ের কাছে ট্রাঙ্ককল বুক করে হাসপাতালের অফিসেই আমি বসে রইলাম।

ডালটনগঞ্জ শহরে যশোয়ন্তের প্রতিপত্তি ও প্রচুর জানাশুনা থাকাতে ডেথ সার্টিফিকেটটা বের করতে আমাদের বেগ পেতে হল না। পুলিশের হাত থেকেও সহজেই। নিস্তার পাওয়া গেল। পোস্টমর্টেম করল না। যশোয়ন্ত বলল, ভেবেছিলাম জগদীশ পাণ্ডের ডেথ-সার্টিফিকেট নিতে আসব—তা না; কী হল।

বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। গতকাল সকাল থেকে আজকের রাত, এর মধ্যে কত কী ঘটে গেল। এই সামান্য সময়ের মধ্যে। রাংকায় যশোয়ন্ত বলেছিল আমাকে, লালসাহেব, বাঘ যে কী জিনিস তা একদিন জানবে। তা যে এমন করে এবং এত তাড়াতাড়ি জানতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।

পকেট থেকে সুগতবাবুর পার্সটা বের করলাম। ভিজিটিং কার্ড রাখবার জায়গায় একটি ফোটো। মারিয়ানা এবং অন্য এক ভদ্রমহিলার, খুব সম্ভব মিসেস রায়ের। পাঁচটা একশো টাকার নোট। পনেরোটা এক টাকার নোট গোছানো। নটা দশ টাকার নোট। কলকাতার দুটি দোকানের ক্যাশমেমো। রাইফেল বন্দুকের লাইসেন্স যে বন্দুকের দোকানে রিনিউ করতে দেওয়া রয়েছে, তার রসিদ।

অন্য কাগজগুলি রক্তে প্রায় মাখামাখি হয়ে গেছে। প্রথম কাগজটিই একটি চিঠি। এবং আশ্চর্যের কথা, মারিয়ানাকেই লেখা।

হাসপাতালের দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক করতে লাগল। একা একা বসে আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।

কুটকু

৩০/১২

আমার মারিয়ানা,

তুমি আমার পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছ কিনা জানি না। তুমি আমার পাশেই আছ, অথচ এত দূরে আছ যে, তোমাকে চিঠি লিখতে হচ্ছে।

আগামিকাল তোমার বন্ধুরা আসবেন শিকারে। তাঁদের সামনে বলবার ইচ্ছে থাকলেও হয়তো তোমায় কিছু বলতে পারব না। তা ছাড়া, তুমি যখন একলা থাকো, তখনই বা বলতে পারি কই? অবশ্য নতুন করে তেমন কিছু বলার নেইও। তবু তোমার সঙ্গে একা একা আরও দু-একটা দিন কাটাতে পারলে ভাল লাগত। তোমার বন্ধুদের যোগ্য সম্মান দিয়েই বলছি, যে…(তারপর এত রক্ত লেগে আছে যে পড়া যাচ্ছে না।)

মারিয়ানা, বড় গাছ আমার খুব ভাল লাগে। ইচ্ছে করে, আমি কোন উষ্ণ গ্রীষ্ম সন্ধ্যায় দারুণ ক্লান্ত হয়ে আমার সর্বস্ব এলিয়ে কোনও গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্তি অপনোদন করি।

আমার ইচ্ছে করে, তুমি কোনও গাছ হও। কোনও চেরি গাছ, কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছ কিংবা কোনও জ্যাকারাণ্ডা গাছ, যার সুগন্ধি ছায়ায় বসে আমি বাঁচবার তাগিদ পেতে পারি।

তুমি হতে পারবে সে গাছ? পারবে না, পারবে না, পারবে না। আমি জানি যে তুমি তা পারবে না। অথচ কোনও দিন পারবে না বলেই হয়তো মনে মনে সব সময় আশা করি যে, তুমি পারবে, পারবে, পারবে। বলতে পারো? কেন এমন উইশফুল থিংকিং? যা কোনওদিন পাব না, তার জন্যে আর কতদিন এমন কাঙালপনা করব বলতে পারো?…|

তোমার বন্ধু মহুয়া আজকাল আমাকেই প্রাঞ্জলভাবে বলে যে তাকে ছাড়া আমার আর প্রায়ই কাউকে (অর্থাৎ তোমাকে) ভালবাসা চলবে না। আমার সবটুকু ভালবাসা পাবার মনোপলি-রাইট যে তাকে সমাজ দিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে সচেতন। সে যে আমাকে অকৃত্রিম ভালবাসে না, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। সেটা সেও যেমন জানে, আমিও জানি। অথচ তুমি বলো, মুখে না বললেও হাবেভাবে বলল যে, আমারও একমাত্র ধর্মপত্নীকেই ভালবাসা উচিত। তোমাকে ভালবাসা আমার পক্ষে পাপ। তোমার পক্ষে আমাকে কোনও কিছুই দেওয়া সম্ভব নয়। শারীরিক তো নয়ই; মানসিকও নয়।

তুমি এবং তোমার বন্ধু দুজনে দুজনের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছ। তুমি বন্ধুর স্বার্থ দেখছ এবং বন্ধু তোমার স্বার্থ দেখছ। মধ্যে আমি বোকার মতো দুজনকে সমানভাবে ভালবেসে অন্তর্দ্বন্দ্বে ও অপূর্ণতার গ্লানিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি।

তুমি লেখাপড়া শিখেছ, কিন্তু বৃথাই। বাইরে অনেক পুঁথি ওলটালে কী হয়, মনে মনে গোঁড়া মেয়েটিই আছ। সংস্কার-মুক্তি হয়নি। তোমার সংস্কার-মুক্তি হয়নি।

তোমার বন্ধুকে আমার যা ছিল সব দিয়েও সন্তুষ্ট করতে পারিনি কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি যে, সে কথা সে জানে। তোমার কাছ থেকে কাঙালের মতো চেয়ে তোমাকে শুধু বিরক্তই করেছি—তোমাকেও কণামাত্র আনন্দিত করতে পারিনি।

বরাবর জেনে এসেছি যে, অন্য কাউকে দুঃখী না করে নিজে সুখী হওয়া যায় না। কিন্তু আজ জানছি যে, নিজে পরম দুঃখী হয়েও অন্য কারওকেও কণামাত্র সুখী করা যায় না। আমার মতো লোক দুঃখ পেতেই জন্মায়, দুঃখ হয়তো তাদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

জানো মারিয়ানা, আজকাল মাঝে মাঝে কেমন একটা আত্মহত্যার ইচ্ছা মনের মধ্যে উঁকি দেয়। অথচ আমার মতো এমন তীব্রভাবে বাঁচতে বোধ হয় আর কেউ চায়নি। তবু, আজকাল আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

আমার মৃত্যুর পর অন্তত নিরুচ্চারে মনে মনে বোলো যে, তুমি আমাকে ভালবাসতে, কিন্তু তা দেখাতে পারোনি। তুমি আমাকে অনেক কিছু দিতে চাইতে, কিন্তু দিতে পারোনি। কারণ সমাজ তোমাকে সেই মুক্তি দেয়নি। এ যদি সত্যি নাও হয়, তবু মিথ্যে করে, ভান করেও বলো। আমি অশরীরী সত্তায় এসে কান পেতে সেই কথা শুনব। তুমি যখন ঘুমোবে, তখন এসে তোমার ঘুমন্ত চোখের পাতায় চুমু খেয়ে যাব। তাতে নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি হবে না।

কেন জানি না। কেবলই মনে হয় যে, আমার দিন ফুরিয়েছে। আজ সন্ধ্যাবেলা নদীর উপরের বারান্দায় বসে তোমার ‘দিন ফুরালো হে সংসারী’ গানটি শুনে বড় ভয় লাগল। একে কী বলব? Premonition?

জানি না মারিয়ানা সোনা। আমার বড় ভয় করে। মরতে আমার বড় ভয় করে।

ইতি—তোমার সুগত

তেইশ

আবার আমার পুরনো রুমান্ডিতে ফিরে এলাম। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরলাম। কুটকুতে যখন যাই, তখন আমাদের সামনে অত বড় একটা শোকাবহ ঘটনা অপেক্ষা করে আছে বলে জানতাম না। মারিয়ানার কথা ভাবলেই বুকের মধ্যে ভারী কষ্ট হয়।

কলকাতা থেকে সুগতবাবু ও মিসেস রায়ের আত্মীয়স্বজন ট্রাঙ্ককল পেয়েই গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। মৃতদেহ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন। মারিয়ানাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন ওঁরা। হয়তো না গেলেই পারতেন। কারণ মারিয়ানার বন্ধু মহুয়া, পরোক্ষে তাঁর এত বড় সর্বনাশের মূলে যে মারিয়ানাই, এমন কথা হয়তো সেই শোকতপ্ত মুহূর্তে মুখ ফসকে বলেও ফেলবেন মারিয়ানাকে।

তা যদি বলেন, সেটা মারিয়ানার কাছে দুর্বিষহ বলেই ঠেকবে। উনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে, সুগতবাবুর সমস্ত পাগলামি, ছেলেমানুষের মতো কাঙালপনা সত্ত্বেও, আন্তরিক ও সর্বাঙ্গীণ চাওয়া থাকা সত্ত্বেও, এক কণাও না দিয়ে মারিয়ানা তাকে নির্মমভাবে বারে-বারে ফিরিয়েই দিয়েছে। নিজেকে বড় বড় কথার বুলি দিয়ে ভুলিয়েছে। নিজেকে বুঝিয়েছে, বন্ধুর স্বামীকে ছিনিয়ে নেওয়া বিশ্বাসঘাতকতা।

তবু এও সত্যি যে, সুগতবাবুর মৃত্যুতে মারিয়ানার মতো বোধ হয় আর কেউই বোঝেনি যে সে সুগতকে তার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসত।

সুগতবাবুর পার্স এবং অন্যান্য সবকিছু কাগজপত্র তাঁর বড় দাদার হাতে দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। কেবল সেই রক্তমাখা চিঠিখানি দিতে পারিনি। সেটি এখনও আমার কাছেই আছে। মারিয়ানা যখন শিরিণবুরুতে ফিরবে, তাকে গিয়ে দিয়ে আসব। যদি সে আর না ফেরে, তাহলে ভেবেছিলাম, সে চিঠি কোয়েলের জলে ভাসিয়ে দেব। আবেগভরা পাহাড়ি নদীর উন্মত্ত উচ্ছাসের সঙ্গে সুগতবাবুর অসামাজিক প্রেম বাহিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ক্যালেন্ডারে একদিন হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম, সময়টা একটা ঘাসফড়িং-এর মতো লাফাতে লাফাতে কখন জানুয়ারির মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে।

প্রথম এখানে আসার পর দেখেছিলাম, মহুয়া-ডাঁরের মেলায় লোক যাচ্ছে দলে দলে। তারপর কত যে মেলা হল। পালামৌ যেন মেলারই জায়গা। প্রতি মাসে কিছু না কিছু কোথায়ও না কোথায়ও লেগেই আছে। অনেক রকম জিনিস মেলে এই মেলাগুলিতে। ওঁরাওদের হাতে-বোনা সবুজ ও লাল কাজ করা দোহর। খুব একটা সুরুচির ছাপ আছে। মেয়েদের গলায় হাতে এবং পায়ে পরার পেতলের গয়না। কাঠের কাঁকই—আরও কত কী দেখার জিনিস, কেনার জিনিস।

বছরের প্রথম মেলা হয় জানুয়ারির প্রথম দিকে হির-হিঞ্জে, বালুমঠ থানায়। তারপর ডালটনগঞ্জিয়া মেলা—ফেব্রুয়ারির প্রথমে। চাঁদোয়া থানায় চাকটার মেলাও ছোট নয়—ফ্রেব্রুয়ারির শেষাশেষি বসে। মার্চের প্রথমে মানাতু থানার শরিকদলে, এবং মাসের শেষে নগর-উন্টারীতে, উন্টারী থানায়। এপ্রিল ও মে-তে একটি করে মেলা। ভওনাথপুরের কিতারে এবং মহুয়াডাঁরে।

বর্ষাকালে যাতায়াতের অসুবিধার জন্যই বোধ হয় মেলাটেলা বিশেষ নেই। সেই নভেম্বর মাসে আবার বসে। সবশেষের মেলা ডিসেম্বর মাসে—কের থানায় বালুমঠে।

জানুয়ারিতেই শীতের প্রকোপটা সবচেয়ে বেশি। এখন পাহাড়ে বনে টাটকা তরিতরকারির অভাব হয় না। সব কিছুরই যেন স্বাদ আলাদা। প্রতি বৃহস্পতিবারে যবটুলিয়াতে যে হাটিয়া বসে, সেই হাটিয়ার মুরগিগুলো যেন অনেক বেশি স্বাদু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে হাটে বগারী ভাজা পাওয়া যায়। বগারী পাখির ঝাঁকে একসঙ্গে শয়ে শয়ে পাখি থাকে। দেখতে চড়ুইয়ের মতো, কিন্তু চড়ইয়ের চেয়েও অনেক ছোট। এখানকার লোকেরা টাঁড়ে জাল পেতে ধরে। ঝুড়িতে জ্যান্ত পাখি নিয়ে বসে থাকে উনুন সামনে করে। অর্ডার হলেই সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে ভেজে দেয়। নুন আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়া দিয়ে খেলেই হল। ওঁরাও, খাঁরওয়ার, ভোগতা, মুণ্ডা, কাহার—সকলে যে কী উপাদেয় জ্ঞানে খায়, কী বলব! খেতে সত্যিই ভাল।

শিকার করতে শেখার পর থেকে মুরগি বড় একটা কিনি না। আর এখন বুনো মুরগিরও যা স্বাদ। ধান খেয়ে খেয়ে পুরু চর্বির আস্তরণ পড়েছে। শেষ বিকেলে ধানখেতে যখন মুরগির ঝাঁক চরতে নামে সোনালি পাখনায় দ্যুতি ছড়িয়ে, তখন দেখতে ভারী ভাল লাগে। মুরগি নিধন তো দৈনন্দিন কর্মে দাঁড়িয়েছে এখন। তা ছাড়া খাবার জন্যে হরিয়াল, তিতির, কালিতিতির এবং আসকলও মারি। কালি-তিতিরের মাংস নয় তো, মনে হয় মাছ খাচ্ছি। বটেরও মারি। দেখে মনে হয়, তিতিরের বাচ্চা বুঝি।

আজকাল নিজে নিজে মাঝে মাঝে মুরগি রাঁধি। যশোয়ন্ত কি ঘোষদা কি রমেনবাবু এলে, একটা মনগড়া বিরাট নাম দিয়ে দিই—রাশ্যান—আমেরিকান—নাম একটা হলেই হল। নাম যাই দিই না কেন, খেয়ে কেউ খারাপ বলে না। যশোয়ন্ত বলে, দ্যাখো লালসাহেব, তোমার মধ্যে যে এত গুণ সুপ্ত ছিল, তা কি এই রুমান্ডিতে না এলে জানতে পেতে?

হাসতে হাসতে বলি, যা বলেছ।

সেদিন ঘোষদা এসেছিলেন—অবিশ্বাস্য খবর নিয়ে। ওঁদের বিয়ের পর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে—কোনও সন্তান-সন্ততি হয়নি এ পর্যন্ত। কিন্তু সেদিন ঘোষদা জিপ থেকে নেমেই এক গাল হেসে বললেন, শিগগিরই ছেলের বাবা হচ্ছি হে, এই ছ’-সাত মাস বাদে—সন্দেশ খাওয়াও, সন্দেশ খাওয়াও। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, কনগ্রাচুলেশান্স। বললাম, এ তো সন্দেশের খবর নয়। আপনাকে শাণ্ডিল্লা লাডডু খাওয়াব।

খবরটা আনন্দের বটে। কিন্তু সত্যি বলতে কী আমার আনন্দ হল না শুনে। পুরনো সুমিতাবউদিকেই আমরা দেখে অভ্যস্ত, হই হই করা, ফুর্তিবাজ, রাতের পর রাত আড্ডা-মেরে-কাটানো। সুমিতাবউদির ছেলে হলে সেই বউদিকে তো আর পাব না। তা ছাড়া, কোলের কাছে কেউ ছিল না বলে প্রবাসী ছেলেগুলোকে এমন দিদির মতো যত্নআত্তি করতেন। ছেলে না শত্তুর। আমার ভাল লাগল না। শুনলাম, সুমিতবউদির এই পাহাড়ি পথে জিপে করে আমার এখানে আসা একেবারে বারণ। তা ছাড়া সুমিতাবউদি শিগগিরই কলকাতায় চলে যাবেন ওঁর মায়ের কাছে। একেবারে ছেলে কোলে করে ফিরবেন। দশ বছর ছাড়া চলল তো এক্ষুনি ছেলের কি এত দরকার ছিল, বুঝি না।

যাই হোক, ভাল করে মুরগি রেঁধে টেকো বুড়োকে অগ্রিম সাধের নেমন্তন্ন খাইয়ে দিলাম।

ঘোষদা খেয়েদেয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তোমাকে সেদিন কেচকিতে যা বলেছিলাম, মনে আছে তো?

উত্তরে আমি চুপ করে রইলাম।

চব্বিশ

রবিবার, বাগানে বসে আছি আলোয়ান মুড়ে সকালবেলার রোদ্দুরে, এমন সময় একটি বছর পনেরো বয়সের ওঁরাও ছেলে দৌড়োতে দৌড়োতে আমার বাংলোয় ঢুকল। আমার সামনে এসে নমস্কার করে যা বলল তার সারাংশ হচ্ছে, তাদের বাথান ভেঙে কাল রাতে একটা বড় চিতা তাদের আদরের বাছুরটিকে মেরে, টেনে নিয়ে গেছে জঙ্গলে। তার একটি বিহিত করা দরকার।

গ্রামে টাবড় শিকারি থাকতে আমার তলব পড়ল কেন বুঝলাম না। পরে জানলাম, ওদের গাদা বন্দুকের চেয়ে টোপিওয়ালা বন্দুকের উপর শ্রদ্ধা বেশি। তা ছাড়া জেনে ভাল লাগল যে, শিকারি হিসেবে আমার বেশ সুখ্যাতি হয়েছে। অবশ্য সেটা আমার কোনও রকম চেষ্টা বা গুণ ব্যতিরেকেই। যশোয়ন্তবাবুর সাকরেদ, সুতরাং ভাল শিকারিই হবেন এমন একটা ধারণাই এর মূলে।

জামা-কাপড় পরে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটির সঙ্গে এগোলাম।

সুহাগী বস্তির একেবারে শেষ বাড়ি তাদের—সুহাগী নদী থেকে বেশি দূরে নয়। ওঁরাওদের বাড়ি যেমন হয়—অদ্ভুত ধাঁচের। চৌকো নয়।

বাড়ির লাগোয়া বাথান। কাঠের খুঁটি পোঁতা, উপরে শলাই কাঠের ছাউনি। তার উপরে শন চাপা দেওয়া। কাঠের খুঁটি পোঁতা, উপরে শলাই কাঠের ছাউনি। তার উপরে শন চাপা দেওয়া। চিতাটা সামনে দিয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে বাছুরটাকে মেরে আবার সামনে দিয়েই বাছুরটাকে মুখে করে জঙ্গলে ঢুকে নদীর দিকে চলে গেছে। বাথানে যখন ঢোকে, তখন গরুটা দড়ি ছিঁড়ে এসে চিতাটাকে শিং দিয়ে গুতোবার চেষ্টা করেছে। পা দিয়ে চাঁট মারারও চেষ্টা করেছে, কিন্তু দড়ি ছিঁড়তে না পারায় কিছুই করতে পারেনি। অবশ্য দড়ি ছিঁড়লে তার অবধারিত ফল হত যে, গরুটাও চিতার হাতে মরত। গরুটাকে মারা চিতাটার পক্ষে মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু অত ভারী জানোয়ারটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারব না বলে অথবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, গরুটাকে মারেনি।

থাবার দাগ দেখে বুঝলাম, বেশ বড় চিতা এবং বিলকুল মস্ত্। ঘষটানোর দাগ দেখে দেখে আমরা প্রায় তিনশো গজ গিয়ে বাছুরটার হদিশ পেলাম। পেছনের দিক থেকে খেয়েছে সামান্যই। পেটটা ফুলে ঢোল। যেখানে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, সেখানটায় অনেকগুলো পুটুস ও করৌঞ্জের ঝোপ। তার পাশে বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা। বড় গাছ নেই। ঘাসে ভরা বিস্তীর্ণ টাঁড়।

সময়টা শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় বন্দুক দিয়ে গুলি করতে মোটে অসুবিধা হয় না, রাইফেল থাকলেই বরং অসুবিধে হয়। তাই ঠিক করলাম একটা অর্জুন গাছে বসব। গাছটা সেই ফাঁকা জায়গার একেবারে গা-ঘেঁষা। ফাঁকা জায়গাটা অর্জুন গাছটি থেকে বড় জোর পনেরো হাত দূরে। একটি খয়ের গাছ ছিল সেখানে।

আমার সঙ্গে সেই ছেলেটি এবং সুহাগী গ্রামের আরও দুটি লোক এসেছিল। তাদের বললাম, অর্জুনগাছে একটা ছোট চারপাই উল্টো করে বেঁধে মাচা বানাতে।

সুগতবাবুর মাচায়-শায়ীন রক্তাক্ত শরীরটির স্মৃতি এখনও মন থেকে পুরোপুরি মোছেনি। চিতাবাঘ অবশ্য গাছ বেয়েই উঠতে পারে। তাই উঁচু বা নিচু করে মাচা বাঁধা অবান্তর। তবে মাচা বেশি উঁচুতে বাঁধলে গুলি করতে খুব অসুবিধা হয়। তাই মাঝামাঝি উচ্চতায় বাঁধতে বললাম। গরুটাকে টেনে এনে সেই খয়ের গাছের গুঁড়িতে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধাব রাতে। নইলে চিতা দড়ি ছিঁড়ে নিয়ে যেতে পারে।

ওরা চুপচাপ আমার কথামতো কাজ করল।

সেখানেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকলাম। ঘাসের উপর পায়ের দাগ ভাল বোঝা যায় না। তবু যতদূর বুঝলাম চিতাটা নদী পেরিয়ে নয়াতালাওর দিকে চলে গেছে। গরুটাকে ঠিক করে বাঁধা হলে উপরে পাতাসুষ্ঠু ডাল চাপা দিয়ে রাখা হল, যাতে শকুনের নজর না পড়ে।

তারপর ফিরে এলাম।

বিকেলবেলা, বেলা থাকতে থাকতে গিয়ে মাচায় বসলাম। সঙ্গে ছেলেটি ও তার বাবা এসেছিল। গরুর গা থেকে ডালপালা সব কিছু সাবধানে সরিয়ে নিয়ে খয়ের গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে, তারা কথা বলতে বলতে গ্রামের দিকে ফিরে গেল।

সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। একটি বিষণ্ণ সোনালি আভায় সমস্ত বনস্থলী ভরে গেছে। জঙ্গলের মধ্য থেকে মোরগ ও ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে। সুহাগী গ্রামের মোরগগুলো দিন-শেষের ডাক ডাকছে গলা ফুলিয়ে। গলায় কাঠের ঘণ্টা ডুং ডুং করে বাজিয়ে গাঁয়ের কাঁড়া বয়েল ফিরে গেছে। যবটুলিয়া বস্তির গম-ভাঙা কলের পুপ-পুপানি থেমে গেছে। গাছে গাছে পাখিরা আসন্ন রাতের জন্য তৈরি হচ্ছে। বিস্তীর্ণ টাঁড়ের সোনালি সায়ান্ধকারে তিতিরগুলো সমস্বরে ডাকছে। আজকাল তিতির কাঁদলেই মনে হয় ওরা বলছে, ফাঁকি-দিয়া, ফাঁকি দিয়া, ফাঁকি-দিয়া।

সুহাগী নদীর দিক থেকে একটা লক্ষ্মীপেঁচা দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে তিনবার ডেকে উঠল। তার এখন সকাল হল। রোঁদে বেরুবে। কোথায় ইদুর, কোথায় ব্যাঙ সেই ধান্দায়। দুটি টিটি পাখি টিটির টি—টিটির টি করতে করতে মাঠটা পেরিয়ে কোনাকুনি উড়ে গেল। মাচার পিছনেই মাটিতে একদল ছাতারে আলো থাকতেই ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে তাবৎ জাগতিক ব্যাপারের উপর অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছিল। অন্ধকার নেমে আসতে তারাও নির্বাক হয়ে গেল। কিন্তু পিটিসের ঝোপের ভিতরে তাদের উসখুসানি, নড়ে-চড়ে বসার আওয়াজ কুরকুর-খুরখুর অনেকক্ষণ অবধি শোনা গেল।

তারপর হঠাৎ দেখলাম, একটি উষ্ণ ভরন্ত সুরেলা দিন একটি সিক্তা রুপোলি হিমেল রাতে গড়িয়ে গেল।

দিনের আলো থাকতে থাকতে চিতাটা আসবে আশা করছিলাম। এখন কপালে ভোগান্তি আছে। যা শীত—তা বলার নয়। একটু পরেই পাতা বেয়ে হয়তো শিশির পড়বে টুপটুপিয়ে।

চরাচর উদ্ভাসিত করে মোমের থালার মতো একটি হলুদ চাঁদ পাহাড়-বনের রেখা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে আকাশ বেয়ে উঠল। জঙ্গলের প্রতি আনাচে-কানাচে হলুদ আলো ছড়িয়ে গেল। যা অদৃশ্য ছিল, তা দৃশ্যমান হল। যা অস্পষ্ট ছিল, তা স্পষ্ট হল। ধারালো ঘাসের চিকন শরীরে আলো পিছলে পড়তে লাগল।

কোথা থেকে এল জানি না; দুটি বড় কানওয়ালা খরগোশ লাফাতে লাফাতে মাঠটি পার হয়ে চলে গেল। আধ ঘণ্টা পরে একটি লুমরি এল। হাওয়ায় রক্তের গন্ধ পেয়ে নাক তুলে নিশ্বাস নিল। তারপর বাছুরটার কাছে এসে, ঘোষদা যেমন করে আমার রান্না-করা মুরগির দিকে চেয়ে থাকেন, তেমনই করে চেয়ে রইল। ঘুরেফিরে দেখল। কাছে গেল, ফিরে এল।

এমন সময়ে হঠাৎ স্বপ্নোখিতের মতো এক লাফ মেরে লুমরিটা আমার মাচার নিচ দিয়ে পড়ি কি মরি করে পালাল। চোখ তুলে দেখলাম, একটি প্রকাণ্ড চিতা ঘাস ঠেলে এগিয়ে আসছে। সমস্ত শরীরটাকে যেন চারটি পায়ের খোঁটার মধ্যে ঝুলিয়ে নিচু করে বয়ে বেড়াচ্ছে।

একবার থেমে দাঁড়াল। চারিদিকে সাবধানে চাইল। তারপর বাছুরটা পূর্বস্থানে নেই দেখে খুব অবাক হল। ভেবেছিলাম খাওয়া আরম্ভ করল দেখেশুনে গুলি করব, কিন্তু আমার সন্দেহ হল, আদৌ না খেয়েও তো পালাতে পারে। চিতাটা আমার দিকে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটি নদীর উল্টোদিকে। নদীর দিক থেকেই এসেছে। নিথর হয়ে দাঁড়িয়েই আছে। চোখের পলকও পড়ছে না। যেন কার সঙ্গে ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ও হয়তো জানে না, হয়তো মৃত্যুর সঙ্গেই আছে।

খুব আস্তে আস্তে বন্দুকটা কাঁধে তুলে, নিশ্বাস বন্ধ করে চিতাটার কাঁধে নিশানা নিলাম। বন্দুকের মাছিতে এবং ব্যারেলে চাঁদের আলো চকচক করছিল। ট্রিগার টানলাম। ডানদিকের ব্যারেলে একটা পৌনে তিন ইঞ্চি লেথাল বল ছিল। কী হল বুঝলাম না। চিতাটি যেদিকে মুখ করে ছিল, সেদিকে মুখ করেই একটি প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সেই চন্দ্রালোকিত পটভূমিকায় তার লক্ষমান মূর্তি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। আমার মনে হল যে, গুলিটা লেগেছে।

চারিদিকে নজর রেখে বসে থাকলাম। একঘণ্টা কেটে গেল। ওরা মোষের শিং দিয়ে একরকমের শিঙে তৈরি করে। সেই রকম একটি শিঙে নিয়ে এসেছিলাম। কথা ছিল, আমার কোনও সাহায্যের দরকার হলে আমি শিঙে বাজাব। কী করব, বুঝতে পারলাম না। বাঘ যদি গুলি খেয়ে ওঁত পেতে বসে থাকে। তাহলে শিঙে বাজিয়ে যাদের এই রাতের জঙ্গলে ডেকে আনব, তাদের বিপদ অবধারিত।

আরও আধ ঘণ্টা কেটে গেল। শীত একেবারে অসহ্য। আর বসে থাকা যাচ্ছে না। বন্দুক শুইয়ে রেখে কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বসে আছি, তবুও মনে হচ্ছে জমে যাব।

অবশেষে থাকতে না পেরে ঠিক করলাম যে, মাচা থেকে নেমে হেঁটে যাব গ্রামে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম, হে ভগবান, যেন গুলি না লেগে থাকে। চিতা যেন বাড়ি চলে গিয়ে থাকে। গুলি খেয়ে আমার জন্যে যেন ওঁত পেতে বসে না থাকে নীচে।

অবশ্য এখন ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। চতুর্দিকে পায়ে-চলা জংলি পথ সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভগবানের নাম করে নামলাম মাচা খেকে, বন্দুক হাতে। নির্বিঘ্নেই নামলাম। মাচার উপরে থাকতেই ডান ব্যারেলে একটি এল-জি পুরে নিয়েছিলাম। বাঁ ব্যারেলেও এল-জি-ই আছে। কাছাকাছি হঠাৎ আত্মরক্ষার জন্যে ছুঁড়তে হলে বন্দুকে এল-জি-ই সব থেকে ভাল।

কম্বলটাকে বাঁ কাঁধে ফেলে, ডান কাঁধে বন্দুকটাকে শুটিং পজিশনে তুলে আস্তে আস্তে এগোলাম। আঁকাবাঁকা পথে বোধহয় পনেরো কুড়ি পা-ও যাইনি, বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল, চিতাটা একটা গাছের নীচে ওঁৎ পেতে আমার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। আমি জানি না, আমি কী করলাম—যন্ত্রচালিতের মতো দুটি ট্রিগার একই সঙ্গে টিপে দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য। চিতাটা নড়াচড়া কিচ্ছু করল না। যেমন ছিল, তেমনই রইল।

তখনই আমার সন্দেহ হল, চিতাটা লাফিয়ে এসে ওইখানে মরে পড়ে নেই তো? সন্দেহ হবার সঙ্গে সন্দেই দাঁড়িয়ে পড়লাম নিথর হয়ে। তবুও যখন চিতার কোনও ভাবান্তর হল না, তখন আমি ওইখানেই শিঙেয় ফুঁ দিয়ে কম্বল মুড়ে বসে পড়লাম। শীত-টিত কোথায় উবে গেল।

খুব আনন্দ হল। আমার প্রথম চিতা! প্রথম বাঘ। শিকারির খাতায় নাম উঠল। যশোয়ন্ত নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। কলকাতার মাখনবাবুর পক্ষে এক বছরের মধ্যে এত বড় উন্নতি সত্যিই অভাবনীয়।

পনেরো মিনিটের মধ্যে ওরা সকলে এসে হাজির। চিতাটা দেখে ওরা ভারী খুশি—‘বড়কা শোন চিতোয়া—বড়কা শোন চিতোয়া’ বলে খুব খানিক চেঁচামেচি হল।

চিতাটির কাছে গিয়ে আলো ফেলে দেখলাম, প্রথম গুলিটা ঠিক যে জায়গায় নিশানা করেছিলাম, তার চেয়ে একটু পিছনে লেগেছে এবং মাটিতেও চিতার গায়ের রক্ত জমে আছে। তার মানে, পরের গুলি দুটির একটিও লাগেনি চিতার গায়ে। যে কেঁদ গাছের গায়ে চিতাটি পড়েছিল, তার গুঁড়িতে গিয়ে গুলি লেগেছে। অর্থাৎ সত্যিই যদি চিতা আহত হয়ে ওঁৎ পেতে থাকত, তাহলে এ শিকার অন্য রকম হত; সুগতবাবুর রক্তমাখা মুখটার কথা নতুন করে মনে পড়ল।

পরদিন সকালে বাংলোর হাতায় সাড়ম্বরে চিতাটির চামড়া ছাড়াচ্ছিলাম। চতুর্দিকে পৃষ্ঠপোষক ও স্তুতিকার ভিড় করে আছে। এমন সময় ঘোড়া টগবগিয়ে যশোয়ন্ত এসে হাজির হল।

সুগতবাবুর মৃত্যুর পর বহুদিন ওর কোনও খোঁজ-খবর ছিল না। আমারও একটু একা থাকতে ইচ্ছা করত। মারিয়ানার জলে ভেজা চোখ দুটো কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারিনি এ ক’দিন। সুগতবাবুর মুখটিও বারবার মনে পড়েছে। ঘুমের মধ্যেও মনে পড়েছে। কিন্তু তবুও চুপ করে শুয়ে শুয়ে ওদের কথা ভাবতে ভাল লেগেছে; জানি না সত্যি সত্যি সুগতবাবু এসে মারিয়ানার ঘুমন্ত চোখের পাতায় চুমু খেয়ে গেছেন কিনা। আজকাল এ-রকম করে কেউ কাউকে ভালবাসে দেখিনি। যে যুগে ভালবাসা বিনা আয়াসেই কেনা যায়, সে যুগে এ হেন দুঃখী ভালবাসার কথা চিন্তা করাও আশ্চর্য।

যশোয়ন্ত ভয়ংকরকে গাছে বেঁধে এসে, সব শুনে, আমার পিঠে দু’ চড় মেরে বলল, সাবাস! দোস্ত গুড়-চেলা চিনি। তবে রাতে ওভাবে মাচা থেকে নামা তোমার অত্যন্ত মূর্খামি হয়েছে। ভবিষ্যতে এরকমভাবে আত্মহত্যা করতে যেয়ো না। এর চেয়ে অনেক সোজা পথ আছে আত্মহত্যার। বাতলে দেব।

যশোয়ন্ত আসতেই অপ্রয়োজনীয় লোকের ভিড় অনেক কমে গেল। ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হয়ে গেল।

যতক্ষণ না সব লোকজন চলে যায়, যশোয়ন্ত ততক্ষণ আমার কাছে বসে থাকল, তারপর হঠাৎ বলল, একটা জরুরি কাজে এসেছি। ভাল করে শোনো। তোমাকে বলিনি এতদিন; সুগতবাবুর মৃত্যুর পর একটা চাল চেলেছিলাম ডালটনগঞ্জে। শহরের যে সব লোকের সর্বত্রগতি, তাদের কাছে বলেছিলাম যে, আমি সুগতবাবুর স্ত্রীর কাছে কলকাতায় যাচ্ছি। সেখান থেকে দেরাদুন যাব অফিসের কাজে দেড়-দু’ মাসের জন্যে। তার আগে ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই। কথাটা রটিয়েছিলাম, যাতে জগদীশ পাণ্ডের কানে কথাটা যায়, তার জন্যেই। দেখছি, ফল হয়েছে! ও নিশ্চয়ই ডি, এফ. ও অফিসে খোঁজ করেছিল; কিন্তু সেখানেও ব্যাপারটা আন-অফিসিয়ালি ক্যামোফ্লেজ করা আছে। ডি. এফ. ও-র সই জাল করা চিঠি আছে! কেউ জানে না। একজন ডিলিং ক্লার্ক ছাড়া। জগদীশ ব্যাটা ধরতে পারেনি যে, ওটা আমার চাল। আমি তো ছুটিতে আছিই।

গম্ভীর মুখে যশোয়ন্ত বলল, শোন লালসাহেব, ওরা আগামিকাল রাতে আবার আসছে শিকারে। ও কেস-ফেসে কিছু হবে না। জগদীশ পাণ্ডে যেন-তেন-প্রকারেণ উপর মহলে ধর-পাকড় করে ও কেস্ চেপে দেবে। তখন আমাদের মান-ইজ্জত সব যাবেই—তদুপরি সেও আমাদের ছেড়ে দেবে না। ভোগান্তির শাস্তি চোরাই পথে ঠিকই দেবে। তাই ঠিক করলাম, এ সুযোগ ছাড়ব না। জগদীশ পাণ্ডেকে শিখলাব এই বেলা।

সুইদূপ ঘাট হয়ে ওরা এদিকে আসবে। অনেক ঘোরা পথে। খবর পেলাম যে ওরা বলেছে, স্পট লাইটে যে-জানোয়ারেরই চোখ দেখা যাবে, সেই সব জানোয়ারই মারবে। কী জানোয়ার তা বিচার করবে না, নর-মাদীন বিচার করবে না, শাস্তি দেবার জন্যে একেবারে ম্যাসাকার করবে। জানোয়ার মেরে-মেরে ওখানেই ফেলে রেখে যাবে। এবার ওরা শিকারে আসছে না, গতবারের অসম্মানের বদলা নিতে আসছে। আমাকে শিক্ষা দিতে আসছে। তা আসুক। আমার প্ল্যানও কিন্তু রেডি। শিগগির একবার তোমার জিপটা নিয়ে চলো, জায়গাটা দেখে আসি।

যশোয়ন্তের প্ল্যান কিছুই বুঝলাম না। তবে আমার মনে ডাক দিল যে, সামনেই আর একটি নিশ্চিত বিপদ বা বিপদের আশঙ্কা আছে। জিপের উইন্ডস্ক্রিনে যখন সেবারে গুলি লেগেছিল, তখন কেমন মনে হয়েছিল—এখনও তা ভুলিনি। রাগ যে আমার হয়নি তা নয়। তবে আমার মতো লোকের রাগ ইজি-চেয়ারে শুয়ে, মনে মনে শত্রু নিপাত করেই ফুরিয়ে যায়। যতখানি রাগ আমি বইতে পারি, তার চেয়ে বেশি রাগ হলে সে রাগ উপচে পড়ে যায়—ধরে রাখতে পারি না।

যশোয়ন্ত বলল, চলো লালসাহেব, আজ একটু স্কাউটিং করে আসি।

কুজরুম বস্তি পেরিয়ে সইদূপ ঘাট অবধি পৌঁছলাম আমরা লাত হয়ে। লাতের রেঞ্জার সাহেব ডালটনগঞ্জে গেছেন। পরশু ফিরবেন। বুঝলাম, জগদীশ পাণ্ডে সব রকম খবরাখবর নিয়েই আসছে। অবশ্য রেঞ্জার সাহেবে থাকলেই বা কী? শীতের রাতে জগদীশ পাণ্ডের মতো লোককে বাধা দিয়ে লাভ নেই এবং বাধা দিলে ওই জঙ্গলে যে, সে তাকে গুলি করে মেরে রেখে যেতে পর্যন্ত পারে, এই সাধারণ বুদ্ধি সমস্ত সুস্থ-মস্তিষ্ক লোকেরই আছে। সে বুদ্ধি নেই কেবল যশোয়ন্তের। ও একটা দাঁতাল একরা শুয়োর। গোঁ একবার চাপলে হয়। তখন লড়াই সে করবেই। যত বড় বাঘই হোক না কেন, তার সঙ্গে লড়াই না করে পালাবে না।

সইদূপ ঘাটের ঠিক নীচে একটি কাঠের সাঁকো ছিল, পাহাড়ি ঝরনার উপরে—পাহাড় থেকে রাস্তাটা বাঁকে বাঁকে নেমে এসেছে—চক্রাকারে। একটি বাঁক ঘুরেই সেই সাঁকোটি। ওইখানে খুব সাবধানে গাড়ি না চালাতে সাঁকোতে ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা, অথবা পথ থেকে নীচে গাড়ি-সমেত পড়ে যাবার সম্ভাবনা।

সে সময় সইদূপ ঘাটের রাস্তা অতি খারাপ ছিল। রাত হয়ে গেলে মাল-বোঝাই ট্রাক এই ঘাট দিয়ে মোটেই যাতায়াত করে না। খালি ট্রাকও সম্ভব হলে এড়িয়ে যায় এই ঘাটকে। একদিকে পাহাড় এবং অন্যদিকে খাদ—বাঁকগুলো এত ঘন ঘন ও রাস্তা এত সরু যে, ট্রাকের পক্ষে মোড় ঘোরা নিদারুণ অসুবিধা।

সেই সাঁকোটার সামনে যশোয়ন্ত নামল। আমাকে বলল, স্টার্ট বন্ধ করো গাড়ির। সাঁকোর উপরে চওড়া সেগুনের তক্তা পাতা আছে। বড় বড় বোল্টের সঙ্গে লাগানো। বোল্ট খোলার একটি বড় রেঞ্জ নিয়ে এসেছে যশোয়ন্ত। সেই রেঞ্জ দিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা কসরৎ করেও একটি বোল্ট খুলতে পারল না। তারপর বলল, ধ্যাৎ, এতে হবে না। অন্য বুদ্ধি করেছি।

তারপর, যশোয়ন্ত পথের পাশে, গাছের ছায়ায় একটি পাথরের উপর বসে আমাকে ওর সেই অন্য বুদ্ধি বোঝাল। বিস্তারিতভাবে।

সাঁকোর পাশে গাছতলার পাথরে পা ছড়িয়ে বসে একটা চুট্টা ধরিয়ে যশোয়ন্ত আমাকে আস্তে আস্তে ওর কমপ্লিকেটেড প্ল্যান বোঝাতে লাগল। ওর চোখ দুটো চকচক করতে লাগল।

জগদীশ পাণ্ডেরা ছিপাদোহর আসার আগে যে চেকনাকা পড়ে, তা পেরিয়ে আসবে। তখন ওরা নিশ্চয়ই ফরেস্ট গেটে কিছু একটা ধাপ্পা দিয়ে আসবে। সেই সময় ফরেস্ট গার্ড যশোয়ন্তের কথা অনুযায়ী বলবে যে, আজ ডি. এফ. ও সাহাব আনেওয়ালা হায় রাত মে। শুনে জগদীশ পাণ্ডে একটু অবাক হবে।

অন্যদিন হলে জগদীশ পাণ্ডে হয়তো ঝুঁকি না নিয়ে ফিরে যেত। কিন্তু ডি. এফ, ও সাহেব আসার আগে আগেই ও অবশ্যই সেদিন কাজ সেরে পালাবে। ডি. এফ. ও, সাহেব সজ্জন লোক—ওঁকে ভয় নেই, ভয় হচ্ছে বদতমিজ যশোয়ন্তকে। সে-ই যখন নেই, তখন সুযোগ জগদীশ হাতছাড়া করবে না।

ও আমাকে বলল যে, আমাকে জিপটি নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে হবে, সইদূপ ঘাটের অনেক আগে। ওদের জিপ সে জায়গা পেরিয়ে আসার পরে বেশ পরে, আমি জিপ স্টার্ট করে জোরে ওদের পেছনে পেছনে আসব, যাতে ওরা আমার জিপের হেড লাইটের আলো দেখতে পায় অথচ আমি বেশ দূরে থাকি। সইদূপ ঘাটের মতো পাহাড়ি পথে অন্য গাড়িকে পাশ দেবার জায়গা কম। হুড-খোলা জিপে বন্দুক-রাইফেল সমেত অবস্থায় ওরা আমাকে পাশ দিতে চাইবেও না। ডি. এফ. ও সাহেবের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে।

যশোয়ন্ত বলল, ডি. এফ. ও-র পোশাক পরে, ডি. এফ. ওর জিপের নাম্বার-প্লেট লাগানো জিপ চালিয়ে তোমাকে আসতে দেখলে ওদের প্রথম কাজ হবে যত জোর সম্ভব জিপ ছুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া। কুটকু পৌঁছে কোয়েল পেরিয়ে মোড়োয়াই হয়ে পালালে ধরবার জো-টি নেই। সইদূপ ঘাটে ওদের জিপ যত জোরে ছুটবে, আমাকেও তত জোরে জিপ ছোটাতে হবে এবং মাঝে মাঝে হর্ন বাজাতে হবে জোরে জোরে। তাতে ওরা ঘাবড়ে যাবে—ভাববে, ডি. এফ. ও যে বটেই, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই।

সেই সময় ভয় আছে, ওদের কাছ থেকে গুলি খাবার। কিন্তু সে সম্ভাবনা এই ঘাটে অপেক্ষাকৃত কম, কেন না রাস্তাটা ক্রমান্বয়ে পাহাড়ে পাক খেয়েছে। অনেকখানি জায়গা সোজা, বড় জোর পঁচিশ-তিরিশ হাতের বেশি আর দেখাই যায় না। তার চেয়ে বেশি পেছনে থাকলে, আমার জিপের আওয়াজ ও হেডলাইটের আলোই কেবল ওরা শুনতে ও দেখতে পাবে। আমাকে দেখতে পাবে না। তাই ওদের জিপে বসে বসেই আমার জিপের উদ্দেশে ওরা গুলি ছুঁড়তে পারবে না। এইরকমভাবে তীব্র বেগে নামতে নামতে যখন ওরা ঘাটের শেষ সীমায় নেমে আসবে, তখন, ন্যাচারালি, ওদের জিপের গতি আরও বেড়ে যাবে। শেষ বাঁক নিয়েই সামনে দেখবে সাঁকোটি।

ইতিমধ্যে আমার জিপের অফুরন্ত হর্ন শুনে যশোয়ন্ত সাঁকোর উপর আড়াআড়ি করে একটি শালের খুঁটি ফেলে দেবে। তার গায়ে লাল শালু আগে থেকেই বাঁধা থাকবে এবং সামনের দিকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের প্রকাণ্ড টিনের নোটিশ ঝুলবে। সাদার উপরে লালে লেখা থাকবে ‘ডেঞ্জার। সাঁকোর মুখে ওদের জিপ মোড় নেবার সঙ্গে সঙ্গে পথের বাঁ-দিকে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকা যশোয়ন্ত ওর ফোর-ফিফটি-ফোর হান্ড্রেড রাইফেল দিয়ে জিপের সামনের টায়ারে গুলি করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ডান দিকে খাদের দিকে ঝোঁক নেবে এবং ওই গতিতে, ওই আকস্মিকতায় এবং ওই সময়ের মধ্যে যত বড় গাঁ-প্রি ড্রাইভারই হোক না কেন জগদীশ পাণ্ডে, পুরো জিপ সুদ্ধ গিয়ে তাকে পড়তেই হবে ডানদিকের খাদে, নদীর পাথর ভরা কোলে, এবং ভগবান আমাদের সহায় হলে ওদের একজনও বাঁচবে না।

সব শুনলাম চুপ করে। যশোয়ন্ত চুট্টাটা ছুঁড়ে ফেলল।

আমি বললাম, কিন্তু এ যে কোল্ড-ব্লাডেড মার্ডার যশোয়ন্ত। যশোয়ন্ত বলল, হ্যাঁ। জরুর।

বললাম, তোমার রাগ তো জগদীশ পাণ্ডের উপর, দলের লোকদের মারবে কেন?

যশোয়ন্ত চোখ লাল করে আমার দিকে চেয়ে বলল, জগদীশের রাগও তো আমার উপরে, তোমার উপর গুলি চালাল কেন?

আমি কোনও উত্তর দিলাম না।

হঠাৎ মনে হতেই ওকে বললাম, টায়ারে গুলি করার পর যদি—তুমি যা ভাবছ তা না হয়? কোনওরকমে যদি গাড়ি ওরা থামিয়ে ফেলে, তাহলে কী হবে?

যশোয়ন্ত বলল, তাহলে আর কী হবে? আমাদের দুজনের লাশ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ওরা কোয়েলের বালিতে পুঁতে দেবে। ওদের প্রায় সকলের হাতেই ম্যাগাজিন রাইফেল। আমরা দুজনে ওদের সঙ্গে পারব না কোনওমতেই।

আমি বললাম, কী দরকার যশোয়ন্ত খামোকা এরকম করে—যদি সত্যিই ওরা জিপটা থামিয়ে ফেলে?

যশোয়ন্ত হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে আর একটা চুট্টা ধরাল। বলল, আরে ইয়ার, মরেগা তো এক রোজ জরুর। মগর, মরনাহি হ্যায় তো অ্যাইসেহি তামাসা করতে করতে। কুকুরের বাচ্চাটাকে শিখলাতে না পারা পর্যন্ত খেয়ে-শুয়ে যে আমার স্বস্তি নেই।

পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা জিরিয়ে নিলাম। শীতের বেলা। দেখতে দেখতে মনে হল, এই সন্ধে হল বুঝি। এক কাপ করে চা খেয়ে আমি আর যশোয়ন্ত বেরিয়ে পড়লাম।

সইদূপ ঘাটের কাছাকাছি যখন এলাম তখন সন্ধে হবো হবো। পথে কুজরুম পেরিয়ে এসেই আমরা একটা জায়গায় পথের পাশে পাথরের আড়ালে দাঁড়ালাম আমার পোশাক খুলে ফেলে দিয়ে সরকারি পোশাক পরে ডি. এফ. ও সাজলাম। তদানীন্তন ডি. এফ. ও. সাহেব মাথায় সবসময়—কি শীত কি গ্রীষ্মে—একটি শোলার টুপি পরে থাকতেন। যশোয়ন্ত সেরকম একটি টুপিও আমাকে বের করে দিল ওর ঝোলা থেকে।

যশোয়ন্ত জিপের নাম্বার প্লেটে ওয়াটার বটলের জলের সঙ্গে মাটি গুলে কাদা করে লেপে দিল। বলল, তাড়াতাড়িতে অন্য নাম্বার প্লেট করানো গেল না।

সাঁকোটার কাছে এসে যশোয়ন্ত নেমে গেল। ওর ঝোলা থেকে দু টুকরো লাল শালু বের করে পথের পাশ থেকে একটি শুকনো শাল বল্লা তুলে এনে আড়াআড়ি করে সাঁকোর উপর বসিয়ে দিল এবং ‘ডেঞ্জার’ লেখা টিনের বড় চাকতিটা একটুখানি শালুতে বেঁধে সেই শাল বল্লার গায়ে ঝুলিয়ে দিল।

হঠাৎ মোড় ঘুরেই এই রকম অবস্থায় সাঁকোটা দেখলে যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের লোকই গাড়ি নিয়ে এ সাঁকো পেরোবার চেষ্টা করবে না। যশোয়ন্তের বুদ্ধির তারিফ করছি। ঠিক এমনই সময় একটা ট্রাকের আওয়াজ শোনা গেল আমাদের পেছন থেকে। তাড়াতাড়ি আমরা দৌড়ে গিয়ে একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। কারণ আমাকেও এখন এ অঞ্চলের প্রায় সব ড্রাইভারই চেনে। ওই অকুস্থলে অমন অদ্ভুত পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই তাদের সন্দেহ হবে। লুকোবার আগে যশোয়ন্ত তাড়াতাড়ি করে শাল বল্লাটা সরিয়ে ফেলল এবং সাজসরঞ্জাম লুকিয়ে ফেলল।

ট্রাকটি চলে গেল।

যশোয়ন্ত আমাকে বলল, নাও আর দেরি কোরো না, এগিয়ে যাও। ঘাট থেকে মাইল দুয়েক আগে বাঁ দিকে কতকগুলো ঘন সেগুনের প্ল্যানটেশন আছে—তার সামনেটা পুটুস ঝোপে ভরা। সেইখানে জিপটা ঢুকিয়ে স্টিয়ারিং-এই বসে থেকো। রাস্তা ছেড়ে জিপটা যেখানে জঙ্গলে ঢোকাবে, সেখানে জিপ থেকে নেমে পথের ধুলোর উপর চাকার দাগটা পা দিয়ে ভাল করে মুছে দিয়ে। মনে থাকে যেন। যাও ইয়ার। গুড লাক। গুড হান্টিং।

এই বলে আমাকে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে ঝোলা থেকে রাম-এর বোতল বের করে যশোয়ন্ত ঢকঢকিয়ে খেতে লাগল।

আমি আস্তে আস্তে জিপ চালিয়ে চলে গেলাম।

অন্ধকার হয়ে গেল। বনের পাতায় পাতায় ঝিঁঝির ঝিনঝিন শুরু হল। সেগুন গাছের তলায় পিটিসের আড়ালে বসে বসে কোনও গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দই শুনতে পেলাম না এ পর্যন্ত। সাতটা বেজে গেল। খুব শীত করছে। মশাও বেশ আছে। জিপের পেছনে শুকনো পাতায় পা ফেলে ফেলে সাবধানে কী একটা জানোয়ার যেন আমায় নজর করছে। সঙ্গে আমার বন্দুক আছে। কিন্তু কোনও আলো নেই। আজ থেকে দেড় বছর আগে এই ঘাটে একটি নরখাদক বাঘ এসে আস্তানা গেড়েছিল এবং বহু মানুষ খেয়েছিল। তারপর এই ঘাটেই একজন স্থানীয় শিকারির হাতে সেই বাঘ মারা পড়ে। ইতিমধ্যে জগদীশ পাণ্ডের মতো ‘জিপারূঢ়’ শিকারির গুলিতে যে, অন্য কোনও বাঘও আহত হয়ে তারপর নরখাদক রূপান্তরিত হয়নি এমন গ্যারান্টি কোথায়? বেশ অস্বস্তি হতে লাগল।

রাত প্রায় পৌনে আটটা নাগাদ দূরাগত একটি জিপের এঞ্জিনের গুনগুনানি শোনা গেল। এ জায়গাটার রাস্তাটা বেশ সোজা এবং প্রায় সমতলের উপর দিয়ে।

টপ গিয়ারে জিপটা আসছে—বেশ জোরে চালিয়ে আসছে বোঝা গেল। দেখতে দেখতে আওয়াজটা নিকটবর্তী হল—কাছে এল, এবং আমার সামনে দিয়ে আলোর বন্যা বইয়ে হুড-খোলা জিপটা চলে গেল।

জিপটা আমাকে অতিক্রম করে যাবার মিনিটখানেক পরই আমি ইঞ্জিন স্টার্ট করে মাথার টুপিটা চেপে বসিয়ে দুর্গানাম জপ করে ওদের পিছু নিলাম। আমিও টপ গিয়ারে রীতিমতো জোরে চালিয়ে চললাম।

একটু যেতে না যেতেই দূরত্ব কমে আসতে লাগল। আমার হেডলাইটের আলোয় দেখলাম পাঁচ-ছ’জন আরোহী। হেডলাইটের আলোয় তাদের বন্দুক-রাইফেল চকচক করছে। দুটি জিপের দুরত্ব কমে আসছে। এদিকে ওরা সইদূপ ঘাটে উঠতে আরম্ভ করেছে। এমন সময় সামনের জিপ থেকে তীব্র এক ঝলক স্পট লাইটের আলো এসে আমার জিপের উইন্ডস্ক্রিনে পড়ল। কিন্তু তাতে ওরা বড়জোর আমার পোশাকটা দেখতে পেল। ওই গতিমান জিপ থেকে ওই দূরের অন্য গতিমান জিপের চালককে চেনা সোজা কথা নয়।

ওরা ঘাটে উঠছে। জিপটা পাক দিয়ে দিয়ে রীতিমতো জোরের সঙ্গে পাহাড়ে চড়ছে। অত্যন্ত পাকা ড্রাইভার—সন্দেহ নেই। নইলে ওই রাস্তায় অত জোরে গাড়ি চালাতে পারত না।

ঘাটে উঠেই, যশোয়ন্তের নির্দেশমতো আমি হর্ন বাজাতে বাজাতে ওদের ধাওয়া করলাম। ওই নির্জন পাহাড়ে বনে আমার জিপের ডাবল হর্নের আওয়াজ যশোয়ন্ত যে শুনতে পাচ্ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যশোয়ন্ত এখন কী করছে? আমার কেবল সেই কথাই মনে হতে লাগল। আমার জিপের গতিও ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগল। উত্তেজনাও বাড়তে লাগল। এবং জগদীশ পাণ্ডে ও আমি ঘাটে ঘাটে প্রায় সাঁকোর কাছাকাছি এসে গেছি বলে মনে হল।

কুকুর তাড়ানোর মতো করে জগদীশ পাণ্ডের দলকে তাড়াচ্ছি যে, এই কথাটা জেনেই মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল।

ঘাটের শেষ বাঁক নেবার সঙ্গে-সঙ্গে ওদের গাড়ির ব্রেক কষার জোর কিচকিচ শব্দ শুনলাম এবং সঙ্গে-সঙ্গে যশোয়ন্তের হেভি রাইফেলের গুলির আওয়াজ। তারপর কী হল বোঝার আগেই একটা প্রচণ্ড ঝন-ঝন আওয়াজ হল—পাথরের গায়ে লোহা আছড়ালে যেমন আওয়াজ হয় এবং সেই সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে আর্তনাদ এবং চিৎকার। এই সময় আমার জিপও অকুস্থলে পৌঁছে গেল। হেডলাইটের আলোয় দেখলাম, পথের ডানদিকের পাথরে ধাক্কা মেরে একটা শালের চারা গাছ ভেঙে ওদের জিপ গিয়ে কুড়ি বাইশ ফিট নীচের পাহাড়ি নদীতে পড়েছে।

আমি পৌঁছানো মাত্র যশোয়ন্ত বিনা বাক্যব্যয়ে শালবল্লা থেকে লাল শালুর টুকরো দুটো ও ডেঞ্জার লেখা টিনের চাকতিটা খুলে নিল। তারপর শাল-বল্লাটা যখন সরিয়ে পথের পাশে ফেলেছে ঠিক তক্ষুনি নদীর বুক থেকে একটা রাইফেলের গুলির আওয়াজ হল এবং আমাদের বেশ কাছ দিয়ে আমাদের পাশ কেটে গিয়ে একটা গুলি পাহাড়ে গিয়ে লাগল।

হেডলাইটটা সঙ্গে-সঙ্গে নিবিয়ে দিলাম। জিপ এগিয়ে যশোয়ন্তের কাছে পৌঁছাতেই যশোয়ন্ত এক লাফে ওর সম্পত্তি-সমূহ সমেত ডান দিকের সিটে উঠে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-তিনটি গুলির আওয়াজ হল। একটি গুলি এসে জিপের পেছনের পরদা এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। যশোয়ন্ত জিপের সাইড লাইটটাও হাত বাড়িয়ে নিবিয়ে দিল এবং আমাকে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, জোরে চলো। যত জোরে পারো।

প্রাণপণ জোরে অ্যাকসিলাটরে চাপ দিলাম—জিপটা উল্কার মতো সাঁকো পেরিয়ে এল—তারপর আবার আলো জ্বালিয়ে আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম কুজরুমের দিকে। পেছনে কী হল—ওরা বাঁচল কি মরল, কজন মরল, কজনের হাত-পা ভাঙল কিছুই বুঝলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম যে, একেবারে অক্ষত দেহে না হলেও বেশ বহাল তবিয়তেই দু-তিন জন আছে—নইলে অত তাড়াতাড়ি আমাদের উপর দমাদ্দম গুলি চলত না।

কুজরুমের আগে গিয়ে জিপ থামালাম। যেখানে জামা-কাপড় ছেড়েছিলাম। যশোয়ন্ত বলল, তাড়াতাড়ি জামা বদলে নাও। আমি চালাচ্ছি এবারে।

বাদবাকি রাস্তাটুকু যশোয়ন্ত একেবারে টিকিয়া-উড়ান করে জিপ চালাল। কুটকুর কাছে এসে কোয়েল পেরিয়ে এলাম। এই মাত্র ক’দিন আগেই সুগতবাবুকে নিয়ে রাতে আমরা এই পথেই ফিরেছি।

তারপর হুটার হয়ে, মোড়োয়াই হয়ে রুমান্ডির রাস্তায় বেঁকে গেলাম আমরা।

পথে অন্য কাগজ কোম্পানির একটি ট্রাকের সঙ্গে দেখা হল। জিপ দেখে, পাশ করে দাঁড়াল—আমরা বেরিয়ে গেলাম। ড্রাইভার আমাদের জিপের কাদা-মাখা নম্বর পড়তে পারল না।

রুমান্ডি পৌঁছেই যশোয়ন্ত হুইস্কির বোতল খুলে বসল।

আমার কেমন যেন নিজেকে খুনি খুনি মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে খুব ভয়ও করছিল। এই বুঝি পুলিশের লোক এল অ্যারেস্ট করতে—অথবা ওরাই বুঝি দল বেঁধে রাইফেল বন্দুক বাগিয়ে এসে হাজির হল এক্ষুনি।

যশোয়ন্ত কিন্তু নির্বিকার। ও বলল, মোড়োয়াই-এর আগে যে ট্রাকটির সঙ্গে দেখা হল, সেই ট্রাকটি যদি থামে অথবা উল্টো দিক দিয়ে যদি অন্য কোনও ট্রাক আসে, তবেই ওদের উদ্ধার করবে। নইলে শালারা সারা রাত ওখানেই পড়ে থাকবে।

যশোয়ন্ত এক-এক চুমুকে এক-এক পেগ শেষ করতে লাগল। অন্ধকারে ওর চোখ দুটো চিতাবাঘের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। মাঝে মাঝে বাঁ-হাতের তেলো দিয়ে গোঁফটা মুছে নিতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর যশোয়ন্ত ভয়ংকরের পিঠে চেপে নইহারের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *