শফিক এবং সিআইডি ইন্সপেক্টর শেখ হাসানুজ্জামান খান।
স্থান : পুলিশ হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ। তারিখ ২৭ নভেম্বর। সময় সন্ধ্যা সাতটা।
শফিকের চোখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ফাঁসির সময় যে ধরনের কালো টুপি আসামিকে পরানো হয়, সেরকম একটা টুপি শফিককে পরানো। শফিকের কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে নানান ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলেই কি এত শব্দ? ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিশ্চয়ই ঘুঘু বাসা বাঁধবে না।
আপনার নাম?
শফিক।
শুধু শফিক? আগে পেছনে কিছু নেই। মোহাম্মদ কিংবা আহমেদ।
পেছনে আহমেদ আছে স্যার, শফিক আহমেদ।
প্রশ্ন করলে এমনভাবে জবাব দেবেন যেন দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করতে না হয়। আমার সময় তেমন মূল্যবান না, তারপরেও সময় নষ্ট করবেন না।
জি আচ্ছা।
টেবিলে আলপিন দেখতে পাচ্ছেন?
জি-না, পাচ্ছি না। আমার চোখ বন্ধ।
চোখের কাপড় সরিয়ে দিচ্ছি। এখন বলুন, কয়টা আলপিন?
একজন পেছন থেকে শফিকের মাথার টুপি সরিয়ে দিল। শফিকের চোখে ধাঁধা লেগেছে। মনে হচ্ছে ঘরে সার্চলাইট জ্বলছে। সে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, স্যার, নয়টা আলপিন।
ভালোমতো শুনে বলুন। স্যার দশটা।
কোনো প্রশ্নের মিথ্যা উত্তর দিলে একটা আলপিন নখের নিচে এক ইঞ্চির মতো ঢুকিয়ে দেব। দশটা ভুল উত্তর দেবেন, দশ আঙুলে দশটা আলপিন নিয়ে হাজতে ফিরে যাবেন। বুঝতে পারছেন?
জি স্যার।
কর্নেল তাহেরকে চেনেন?
জি-না।
নাম শুনেছেন।
জি-না।
কর্নেল তাহেরের কোনো আত্মীয়স্বজনকে চেনেন?
জি-না।
আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা। কেন্দুয়া থানা।
পূর্বধলার নাম শুনেছেন?
জি।
পূর্বধলার কাজলা গ্রামে কখনো গিয়েছেন?
জি-না।
আপনি পাঁচটা প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়েছেন। প্রথম ভুল উত্তর হলো—আপনি কর্নেল তাহেরকে চেনেন না বলেছেন।
স্যার চিনি, তবে পরিচয় নাই।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি কোন পা হারিয়েছেন?
বাম পা।
আপনি তো তাকে ভালোমতোই চেনেন। ভালোমতো না চিনলে বলতে পারতেন না কোন পা। কর্নেল তাহেরের এক ভাই আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁকে চেনেন?
জি-না। আনোয়ারের নাম এই প্রথম শুনলাম।
উনি দু’বার আপনার প্রেসে এসেছিলেন। একবার রাতে আপনার সঙ্গে থেকেও গিয়েছিলেন। আপনি বললেন, আনোয়ার নাম এই প্রথম শুনলাম।
এখন থেকে আর মিথ্যা বলব না স্যার। সত্য বলব। আনোয়ার আমার বন্ধু মানুষ। আমি ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথমেটিকসে আবার ভর্তি হতে চাই। আনোয়ার
এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করছে।
আমি এখন আপনার ডান হাতের তর্জনীতে একটা আলপিন ঢুকাব। আবার কিছু প্রশ্ন করব। আমার ধারণা তখন সত্য উত্তর পাব।
স্যার, আলপিন ঢুকাতে হবে না। এখন থেকে আমি সত্য কথা বলব। একটাও মিথ্যা বলব না। কর্নেল তাহেরের পরিবারের সঙ্গে আমি ভালোমতো পরিচিত। পূর্বধলার কাজলা গ্রামে আমার নানার বাড়ি। কর্নেল তাহেরের পরিবারের কাছে আমার নানাজানের পরিবার নানানভাবে ঋণী। কর্নেল তাহেরের মায়ের নাম বেগম আশরাফুন্নিসা। তার এক বোনের নাম…।
স্টপ।
স্যার আমি স্টপ করব না। কর্নেল তাহেরের মা’কে আমিও মা ডাকি। কর্নেল তাহেরের এক বোনের নাম শেলী…।
[প্রশ্নোত্তর বন্ধ। আচমকা শফিকের তর্জনীতে আলপিন ফুটানো হয়েছে। শফিক শুরুতে একটা বিকট চিৎকার দিল। তারপর পশুর মতো গোঙাতে লাগল।]
ব্যথা পেয়েছেন? [উত্তর নেই। চাপা গোঙানি।]
রাজসাক্ষী হবেন? কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হচ্ছে সেখানে সাক্ষ্য দেবেন। আপনাকে কী বলতে হবে তা শিখিয়ে দেব।
এই কাজ আমি কখনোই করব না।
বুড়ো আঙুলে আরেকটা আলপিন ঢুকানো হলে আনন্দের সঙ্গে রাজসাক্ষী হবেন।
আমি রাজি হব না। আঙুলে ঢোকান।
[আবারও আর্তচিৎকার। আবারও গোঙানি।]
রাজসাক্ষী হবেন?
না। আরও আলপিন ঢোকাতে চাইলে ঢোকাতে পারেন। আমি আর যা-ই হই, মীরজাফর হব না।
আপনার সাহস দেখে ভালো লাগল।
আমি মোটেই সাহসী মানুষ না। আমি ভীতু। তবে মাঝে মাঝে সময় ভীতুদের সাহসী করে তোলে।
সুন্দর কথা বলেছেন।
কথাটা আমার না স্যার। পুশকিনের। আলেকজান্ডার পুশকিন। স্যার, আপনি কি পুশকিনের নাম শুনেছেন?
পুলিশে চাকরি করলেই মানুষ মূখ হয় না। আমি পুশকিনের লেখা ক্যাপ্টেনের মেয়ে’ বইটা পড়েছি।
স্যার, আপনি কি তুর্গেনিভ পড়েছেন।
আমরা এখানে সাহিত্য আলোচনায় বসি নি।
তুর্গেনিতের একটি উপন্যাসে আমার এখন যে অবস্থা তার নিখুঁত বর্ণনা আছে। সেখানে জারের পুলিশ কমিশনার একপর্যায়ে সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। বন্দিকে এক পেয়ালা কফি আর একটা মাখন মাখানো টোস্ট খেতে দেন।
আপনি কি টোস্ট এবং কফি খেতে চান?
না।
চা খান, চা দিতে বলি?
জি-না স্যার।
আপনি যে উপন্যাসটির কথা বলছেন সেখানে গরম কফি এবং মাখন লাগানো টোস্ট খাইয়ে বন্দিকে বরফের মধ্যে খালি পায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে জারের পুলিশরা গুলি করে মারে।
স্যার, আপনি অনেক পড়াশোনা জানা মানুষ। আপনি আমাকে যে শারীরিক কষ্ট দিলেন তার জন্যে আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।
[সিআইডি ইন্সপেক্টর শেখ হাসানুজ্জামান খান হো হো করে হেসে উঠলেন। তবে এই মানুষটির একক চেষ্টায় ডিসেম্বরের চার তারিখ শফিক পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পায়। কাকতালীয়ভাবেই ডিসেম্বরের চার তারিখ শফিকের জন্মদিন।]
মুক্তি পাওয়া শফিক কিছু অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড করে। যেমন, এক ছড়া কলা কিনে সর্বসাধারণে কলা বিতরণ। কলা বিতরণ শেষে সে তার মাকে দেখার জন্যে বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়ে। ট্রেন চালু হওয়ামাত্র মনে পড়ে যে তার মা ঢাকায়, আদর্শলিপি প্রেসের দোতলায় থাকেন।
ক্লান্ত শফিক ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করে না। সে ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এক কামরায় সে বসে আছে। তার সামনে একটা খালি কাঠের কালো রঙের চেয়ার। চেয়ারের হাতলে ঘুঘু পাখি বাসা বেঁধেছে। মা ঘুঘু তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছে। বাচ্চা দুটি কাঁদছে। মা ঘুঘু ইংরেজিতে বলছে, Baby do not cry.
শফিকের মা আদর্শলিপি প্রেসের দোতলায় নেই। তিনি আছেন অবন্তিদের বাড়িতে। শফিকের গ্রেফতার হওয়ার পর প্রেসের লোকজনই তাঁকে এই বাড়িতে রেখে গেছে। অবন্তি তাকে নিজের শোবার ঘরে রেখেছে। তার জন্যে আলাদা খাট পাতা হয়েছে। শফিকের মা অবন্তিকে ডাকেন নীলু। নীলু তার একমাত্র মেয়ে যে সাত বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মারা গেছে।
অবন্তি তার নতুন নামকরণ সহজভাবেই নিয়েছে। তাকে নীলু ডাকলে সে সহজভাবেই বলে, জি খালা! কিছু লাগবে।
অবন্তিকে হতভম্ব করে রাত তিনটায় শফিক সত্যি সত্যি উপস্থিত হলো। অবন্তি মনে মনে বলল, Oh God! Oh God! Oh God!
সেই রাতেই অবন্তি তার মাকে দীর্ঘ চিঠি লিখল–
মা!
যতই দিন যাচ্ছে আমি ততই দিশাহারা হচ্ছি। আমি কখনোই অদৃষ্টবাদী ছিলাম না। এখন অদৃষ্টবাদী হয়েছি। আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই বিশেষ একজনের খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছুই না। কেন তিনি আমাদের নিয়ে খেলছেন? আমি জানি না। আমার জানতে ইচ্ছা করে।
এই পর্যন্ত লিখেই অবন্তি চিঠি ছিঁড়ে কুচি কুচি করল। মাকে এই ধরনের চিঠি লেখা অর্থহীন। তার নর্তকী মা বিষয়টা বুঝবেন না। তার মা’র জগৎ আলো ঝলমল গানবাজনা এবং নৃত্যের জগৎ। সাত কোর্স লাঞ্চ, এগার কোর্সের ডিনারের জগৎ। ডিনারের আগে তিনি ওয়াইন গ্লাসে রেডওয়াইন ঢালবেন, গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলবেন, বাহু এই ড্রাই ওয়াইনের কী চমৎকার ফুটি ফ্লেভার! আনন্দে তার মুখ ঝলমল করে উঠবে। এতে দূষনীয় কিছু নেই। সব মানুষের আনন্দ আহরণ প্রক্রিয়া এক না।
দরজায় ধাক্কার শব্দে অবন্তি চমকে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত একটা পঁচিশ বাজে। এত রাতে কে তার দরজায় ধাক্কাচ্ছে। বাড়িতে মানুষ বলতে আর একজন আছে, শফিক স্যার। তিনি এত রাতে কেন দরজা ধাক্কাবেন। কোনো সমস্যা।
অবন্তি দরজা খুলল। শফিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পারকিনসন্স রোগীর মতো তার হাত কাঁপছে। অবন্তি বলল, স্যার, কোনো সমস্যা?
শফিক বলল, তুমি সদর দরজা লাগিয়ে দাও, আমি বাইরে যাচ্ছি।
এত রাতে বাইরে যাচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন?
শফিক বিড়বিড় করে বলল, চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকব। আমার খুব অস্থির লাগছে। মাথার ভেতর পাগলাঘণ্টি বাজতে শুরু করেছে। এখন আস্তে বাজছে। পরে জোরে বাজবে।
অবন্তি বলল, আপনার সব কথা হেঁয়ালির মতো লাগছে। কী ঘটনা পরিষ্কার করে বলুন।
শফিক বলল, জেলখানায় আমি একবার পাগলাঘণ্টি শুনেছিলাম। এই ঘণ্টি আবার বাজছে। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে।
অবন্তি বলল, আপনি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকলে কি ঘন্টা বাজা বন্ধ হবে।
শফিক বলল, তা জানি না, তবে শরীরের জ্বলুনি কমবে।
শরীরের জ্বলুনি কমবে তা কীভাবে বুঝলেন?
শফিক বলল, আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বলুনি কমবে।
অবন্তি বলল, বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে বাড়ির ছাদে চলে যান। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতে হবে কেন?
শফিক ক্লান্ত গলায় বলল, সেখানে আমার সঙ্গে কালাপাহাড় থাকবে। সে আমাকে ঘিরে চক্কর দিবে। অবন্তি, আমি যাই?
অবন্তি বলল, যান। বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফিরে আসুন। আপনার মা যেমন মানসিক রোগী, আপনিও তা-ই। আপনাদের দু’জনেরই ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন।
ঝুম বৃষ্টি পড়ছে।
চায়ের দোকানের বেঞ্চে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শফিক শুয়ে আছে। সে আছে আধো ঘুম আধো জাগরণে। তার গায়ে বৃষ্টি পড়ছে কি পড়ছে না, তাও সে জানে না।
কালাপাহাড় তাকে ঘিরে সত্যি সত্যি পাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘরর’ শব্দ করছে। কালাপাহাড় যতবার এই ধরনের শব্দ করছে ততবারই শফিক মাথা তুলে বলছে—চুপ করে থাক। কোনো কথা না।
ছাদে প্রাস্টিকের চেয়ারে অবন্তি বসে আছে। সেও ভিজছে। অবন্তি ঠিক করল সারা রাত যদি বৃষ্টি হয় সে সারা রাতই ছাদের চেয়ারে বসে ভিজবে।