২০. শনিবার বিকেলে ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছি

শনিবার বিকেলে ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছি আড্ডাবাজরা কে-কখন আসবেন তারই অপেক্ষায়। দিল্লি অনেক দূর। সেখান থেকে পঞ্চতন্ত্রের লেখা ঠিক সময়ে হাতে এসে না পৌঁছলেই চিত্তির। চোখে সর্ষে ফুল, এ-সপ্তাহে লেখা বুঝি বাদ গেল। বসে গেলাম চিঠি লিখতে, জোর তাগিদের চিঠি। সৈয়দদার ওই এক দোষ। নিত্যনিয়মিত তাগাদার তাওয়া গরম না রাখলে ওঁর হাতের আঙ্গুল চলে না, কলমের কালি বরফ। অগত্যা চিঠির কাগজ টেনে নিয়ে বসে গেলাম লিখতে। উপরোধ, অনুরোধ, উষ্ম, অভিমান সব কিছুর মসলা ঢেলে চিঠিটা যখন প্রায় বাগিয়ে এনেছি, এমন সময় গাল্পিক সাহিত্যিকের প্রবেশ।

সে কি! আর কেউ আসে নি?

চিঠির প্যাড থেকে মুখ না তুলেই বললাম—

না আসুক। তাই বলে এক্ষুনি পরচর্চা শুরু করতে পারব না। আগে চিঠিটা শেষ করে নিই।

টেবিলে কয়েকটা সদ্য প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ছিল। সেগুলি এগিয়ে দিয়ে আবার চিঠির কাগজে মনোনিবেশ করলাম। চিঠিটা প্রায় যখন শেষ করে এনেছি, এমন সময় একটি যুবক খুবই সঙ্কোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। অচেনা ব্যক্তিকে অসময়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন–আপনি কি-ইয়ে—

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম—আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমিই ইয়ে। আপনার কিছু বলবার আছে?

না।

তাহলে—

দেখতে এসেছি।

কী দেখতে এসেছেন?

আপনাকে।

চমকে উঠলাম। আমাকে দেখতে এসেছে। আর কোনও প্রয়োজন নেই শুধু দেখতে আসা। এ-রকম আগন্তুকের সঙ্গে এর আগে কখনও মুখোমুখি হবার সুযোেগ আমার হয় নি। দেখে তৃপ্ত হবে এমন কোন রূপ বা গুণ আমার চেহারায় নেই। তবু যুবকটি মুখে একটা পরিতৃপ্তির গদগদ হাসি এনে আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে, মুখে কোন কথা নেই। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, অপরিসীম অস্বস্তি।

গাল্পিক-সাহিত্যিক এতক্ষণ একটা মাসিক পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে মগ্ন ছিলেন, যুবকটির দিকে একবার তাকিয়েই বললেন—আমি একটু ঘুরে আসছি। নস্যি ফুরিয়ে গিয়েছে, কিনতে হবে।

ছোকরা আমার হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও ওঁর নিজে নস্যি কিনতে যাওয়ার গুরুত্ব বুঝতে বিলম্ব হয় নি। পাছে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন, তাই পলায়ন। একাকী যুবকটি সামনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটের কোণায় সলজ্জ মৃদু হাসি। ওঁর কোন বক্তব্য নেই, সে-তো আগেই জানিয়েছেন। তাই কথা কিছু বলছেন, শুধু চেয়ে আছেন। যেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ওঁর আর কোন কিছু করবার নেই। এমন অসহায় অবস্থায় আর কতক্ষণ থাকা যায়। অগত্যা বসতে বলে প্রশ্ন করলাম—আপনি কি কলকাতায় থাকেন?

না, আমি থাকি অনেক দূরে, চিরিমিরিতে। ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছি।

চিরিমিরি, সে তো মধ্য প্রদেশে। সেখানে কি করা হয়?

রেলওয়েতে চাকরি করি। ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসার অন্যতম উদ্দেশ্য আপনাকে একবার দেখা।

আবার সেই অস্বস্তিকর উক্তি। কথা অন্যদিকে ঘেরাবার জন্যে বললাম—

চিরিমিরিতে শুনেছি অনেক বাঙালী আছে।

তা আছে। প্রায় দুশ ঘর বাঙালী। তারা সবাই আপনাদের পত্রিকা আগ্রহের সঙ্গে পড়েন, আমিও আপনাদের পত্রিকার একজন ভক্ত পাঠক। তাই আপনাকে–

তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম—শুনেছি চিরিমিরির স্বাস্থ্য ভাল। বিশেষ করে ওখানকার জল অজীর্ণ রোগের পক্ষে খুবই উপকারী। আপনার কি মনে হয়?

তা স্বাস্থ্য ওখানে ভালই হয়। আগে ছিলাম বিলাসপুরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে চিরিমিরিতে এসেছি আজ মাস দেড়েক হল। আমার নিজেরই স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে।

ইতিমধ্যে গাল্পিক-সাহিত্যিক নস্যি কিনে এনে স্বস্থানে বসে পত্রিকার পাতা ওটাতে লাগলেন। যুবকটির ওঠার নাম নেই, তাকিয়েই আছে। অপর পক্ষের তরফ থেকে যদি কোন প্রশ্নই না থাকে তখন জলবায়ু আর খাওয়াদাওয়ার আলোচনা ছাড়া আর কি করা যায়। তার প্রয়োজন যদি ফুরিয়ে থাকে—অর্থাৎ আমাকে দেখার প্রয়োজন—তাহলে এখন বিদায় নেওয়াই উচিত। কিন্তু সে কথা তাঁকে জানাই কি প্রকারে। অগত্যা অসমাপ্ত চিঠির কাগজটা টেনে নিয়ে টেবিলের উপর ঝুকে পড়লাম, যেন কত জরুরী চিঠি এই মুহূর্তে শেষ করে ডাকে না দিলেই নয়। গাল্পিক-সাহিত্যিক ততক্ষণে পত্রিকার পৃষ্ঠায় মুখ ঢেকেছেন।

কোন ফল হল না। যুবকটি যেমন বসেছিল বসেই আছে। মিনিট দুই নীরবতার পর মনে হল এ-কী শাস্তি। আর থাকতে পারলাম না। ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলে সোজাসুজি তাকে বললাম-আপনার যদি সত্যই আমার কাছে কিছুই বলবার না থাকে তা হলে–

কথাটা শেষ করলাম না, ওটুকু উহ্য রেখে আবার চিঠির কাগজে মনোনিবেশ করলাম। বৃথা চেষ্টা। ব্যঞ্জনায় যে যুবকের কিছুমাত্র বুৎপত্তি নেই তার পরিচয় পেলাম ওর উঠে পড়ার কোন লক্ষণ না দেখে। বাধ্য হয়েই তখন অসমাপ্ত চিঠির প্যাডটা দেরাজের ভিতরে রেখে গাল্পিক সাহিত্যিককে বললাম

আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। কেউ যখন আজ আর আসছে না তখন উঠে পড়াই ভাল।

ছোকরা অমরকে টেবিলের কাগজপত্র তুলে রাখতে বলে কলম পেন্সিল দেরাজে ভরছি, এমন সময়ে যুবকটি একটু ইতস্তত করে বললে–

আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

হায়রে! চেয়ে দেখার সাধ কি এখনও মিটলো না? আরও কিছুকাল নীরবে বসে থাকতে হবে? ইলাস্টিক রবারের মত ধৈর্যকে টেনে অনেক লম্বা করা গিয়েছে। এবার ছিড়ে যাবার উপক্রম। কোন রকমে উষ্ম চেপে রেখেই বললাম—

এখনও যদি আপনার বলবার কথা থাকে বলুন, না থাকলে বিদায় নিতে অনুমতি দিন।

কথাটা বলার মধ্যে বোধ হয় একটু রূঢ়তাই প্রকাশ হয়ে থাকবে, তার জন্যে মনে মনে অনুশোচনাও যে জাগে নি তা নয়। আমার এক সাংবাদিক গুরু আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, সম্পাদকের দপ্তর সব সময় আগন্তুকের কাছে অবারিত-দ্বার থাকবে। পত্রিকার যে গ্রাহক বা পাঠক সে সব সময়েই মনে করে এ কাগজ তার নিজের। পত্রিকার দপ্তরে অবাধ যাওয়া-আসার অধিকার তার আছেই, যেমন নিজের বাড়িতে থাকে। কোন লেখক বা পাঠক দপ্তরে এলে, যত ব্যস্ততার কাজই হাতে থাকুক না কেন, দুই হাতে তা সরিয়ে রেখে এমন ভাবে অভ্যর্থনা করবে যেন তুমি এতক্ষণ ওঁরই শুভাগমনের প্রতীক্ষায় বসে আছ। এতকাল গুরুর উপদেশ যথাসাধ্য পালন কররার চেষ্টা করে এসেছি, আজই প্রথম ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিতে লাগলাম। এমন একজন ভক্ত সামনে উপস্থিত, যে সুদূর মধ্য প্রদেশ থেকে এসেছে শুধু আমাকে দেখবার জন্যই, আর কোন প্রত্যাশা তার নেই। এতে পুলকিত হয়ে ওঠবার কথা। আমার মধ্যেও সে-দুর্বলতা নেই তা নয়। তবু শনিবারের আড্ডার প্রাক্কালে এমন একজন অপরিচিত ভক্তের আগমনে উল্লসিত হতে পারি নি। সেই কারণেই বোধ হয় আমার কথায় খানিকটা অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠেছিল।

লক্ষ্য করলাম যুবকটির মুখের সেই দরবিগলিত হাসি ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে বিমর্ষ ভাব দেখা দিল। কম্পিত হস্তে শার্টের বুকপকেট থেকে একটি ভাজ করা কাগজ বার করে বললে– আপনাকেই দেখতে এসেছিলাম, কিন্তু খালি হাতে আসি কি করে। তাই একটা কবিতা লিখে এনেছি।

এবার আমার হাসবার পালা। নিঃস্বার্থ ভক্তির এমন পরাকাষ্ঠা এর আগে কখনও দেখি নি। আগন্তুকের প্রতি বিরূপ মনোভাবের জন্য যে গ্লানিতে এতক্ষণ পীড়িত হচ্ছিলাম, এক নিমেষে তা কেটে গেল। উল্লসিত হয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম—কবিতা এনেছেন তা এতক্ষণ বলেন নি কেন?

বিনয়ের সঙ্গে যুবকটি বললে-ওটা তো উপলক্ষ, তাই বার করতে সংকোচ বোধ করছিলাম। কবিতা আমি অনেকদিন থেকেই লিখছি, অনেক কবিতাই লিখেছি। সে-সব খাতা চিরিমিরিতেই রেখে এসেছি। আজ আপনাকে দেখতে আসবার আগে একটা আইডিয়া মাথায় এল, লিখে নিয়ে এলাম।

আড়চোখে গাল্পিক-সাহিত্যিকের দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ সম্পূর্ণ পত্রিকার খোলা পাতায় আবৃত, শুধু ভুড়িটা ঈষৎ দুলছে। একটা উদগত হাসি চাপবার কী করুণ প্রয়াস। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন বিশুদা। চোখ বড় করে কি একটা বলতে গিয়েই অপরিচিত যুবককে দেখে থেমে গেলেন। হারিসন রোড ও চিংপুরের মোড়ে ষাঁড়ের লড়াই বা পকেটমারকে নিয়ে মারপিট, এই ধরনের কিছু একটা গল্প রাস্তায় কেঁদে এসেছিলেন, বলা হল না। খালি-চেয়ারটায় হতাশ হয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন। একটু পরেই এলেন সব্যসাচী লেখক, তরুণ কবি, ইনস্যুরেন্স-এর কেষ্টবিষ্ট, অফিসার।

ঘর জমজমাট। যুবকটি এত লোকসমাগমে হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণে বোধ হয় বুঝতে পারল এবার উঠে পড়তেই হয়। চেয়ার থেকে উঠে নমস্কার জানিয়ে বললে

আপনার হাতে দিয়ে গেলাম, দেখবেন।

আমি বললাম—সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার হাতে যখন দিয়েছেন, গতি একটা কিছু হবেই।

আমার কথায় বিশেষ ভরসা পেল না যুবকটি। তাই আবার বললেদেখবেন, ফেরত যেন না আসে।

কথায় কথা বেড়েই চলবে এই আশঙ্কায় খোলাখুলি বললাম—না, ওকাজ আমরা কখনই করি না, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে। এটা ধরেই নিই যে কবিতার নকল রেখে সবাই পাঠায়।

তা হলে জানব কি করে?

তিন মাস অপেক্ষা করবেন। যদি মনোনীত হয়, ওই সময়ের মধ্যে সেই সংবাদবহনকারী চিঠি যাবে আপনার কাছে। আর যদি চিঠি না পান

তা হলে

–তা হলে কী।

—আবার আরেকটা পাঠাবেন।–ও বুঝেছি। নমস্কার।

হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল যুবকটি। আগমনীর হাসি বিদায়কালে বিষাদে রূপান্তরিত। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। কি করে এই যুবককে বোঝাই যে, প্রতিদিন দপ্তরে কবিতার সংখ্যা আসে সর্বাধিক। সেইজন্যেই নির্বাচনে নির্মম না হয়ে উপায় নেই।

আমাকে দেখতে আসার নাম করে কবিতা দিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আদ্যোপান্ত রসিয়ে গাল্পিক সাহিত্যিক বৈঠকের বন্ধুদের কাছে বললেন। বিশুদা শুনে বললেন–কবিতা ছাপাতে হবে, তা ডাকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়। হাতে-হাতেই যখন দেবার ইচ্ছে তখন ভণিতা না করে সোজাসুজি দিয়ে চলে যাওয়াই তো উচিত। শনিবারের অজ্ঞাটাই দিলে মাটি

বৈঠকের তরুণ কবি এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। সমমর্মীর প্রতি বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বললে-আপনারা তো কেউ কবিতা লেখেন না, লিখলে বুঝতেন ওর মানসিক অবস্থাটা। নতুন লেখকমাত্ৰই সম্পাদকের দপ্তরটাকে মনে করে একটা বাঘের খাঁচা। আমার কথাই বলছি। আমি যখন প্রথম কবিতা নিয়ে এই দপ্তরে পদার্পণ করি, তখন হৃৎপিণ্ডটি ধড়াস ধড়াস করেছে, পেটের ভিতর যেন একেবারে ফাঁকা। কবিতাটি হাতে তুলে দিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম ফাসির আসামীর মত। বিচারকের রায়ের উপর জীবনমরণ নির্ভর করছে। তখন বাধ্য হয়ে সম্পাদককে ইম্প্রেস করবার জন্য বলতাম-নরেনদা কি এসেছিলেন? গল্প-লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র যে আমার অগ্রজপ্রতিম এইটুকু জানান দিয়ে সম্পাদকের নেক নজরে পড়ার ক্ষীণ প্রয়াস। অর্থাৎ সম্পাদকের সবিশেষ পরিচিত বন্ধু গল্পলেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে আমারও যে দাদাভাই সম্পর্ক, সেটুকু জানান দেওয়া!

বিশুদা বললেন—সেই জন্যেই চিরিমিরির যুবক-কবি সম্পাদককে ইম্প্রেস করবার চেষ্টায় ঘরে ঢুকে বলেছিল—আপনাকে দেখতেই এসেছি।

সব্যসাচী লেখক এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। তরুণ কবির দিকে তাকিয়ে টিপ্পনী কাটলেন-গ্রেট পোয়েটস অ্যাক্ট অ্যালাইক।

আবার একটা ঝগড়ার সৃষ্টি হয় দেখে তাড়াতাড়ি কথা ঘোরার জন্যে গাল্পিক-সাহিত্যিককে অভিযোগ জানিয়ে বললাম-আপনার কাণ্ডটাই বা কি রকম। পত্রিকার পাতায় মুখ আড়াল করে ভুড়ি দুলিয়ে হাসা কি উচিত হচ্ছিল?

গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—চিরিমিরির কবির কথায় হাসি পেলেও চেপে রেখেছিলাম ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের একটা বিখ্যাত গল্প মনে পড়ায় হাসিটা ছিপিথোলা সোডার বোতলের মত ভুসভুসিয়ে উপরের দিকে ঠেলে উঠতে চাইছিল বলেই এই বিভ্রাট।

আর পায় কে বিশুদাকে। একটা রসালো গল্পের আভাস পেয়ে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল—কোথায় চা, কোথায় পান। সঙ্গে সঙ্গে গাল্পিক-সাহিত্যিককে সাবধান করে দিয়ে বললেন–নস্যি-টস্যি যদি আনাতে হয় এইবেলা আনিয়ে faali

পকেট থেকে নস্যির কৌটো বার করে গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—সে ভয় নেই, কৌটা আজ ভর্তি।

সব্যসাচী লেখক বললেন—তাহলে এই বেলা নাক ভতি নস্যি নিয়ে নিন। পরে গল্প থামিয়ে নস্যি নেওয়া কিন্তু চলবে না।

নস্যি নেওয়ার পর্ব সমাধা হল, ইতিমধ্যে ছোকরা অমর চা আর পান যারযার সামনে রেখে ঘরের কোণের ছোট্ট টেবিলে স্তুপীকৃত গল্প কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলি উৎকর্ণ হয়ে ফাইলবন্দী করতে বসে গেল।

চায়ের কাপে চুমুক মেরে গাল্পিক-সাহিত্যিক বললেন—ঘটনাটা ঘটেছিল বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-লেখক দীনেশচন্দ্র সেনকে নিয়ে। দীনেশ বাবু ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে বি-এ পাশ করে কুমিল্লাতে ভিক্টোরিয়া স্কুলে চাকরি নিয়েছেন, আর শহরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পুথি সংগ্রহ করেছেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বৈষ্ণব সাহিত্য গুলে খেয়েছেন, চণ্ডীদাস আর বিদ্যাপতি ওঁর নখাগ্রে। ওদিকে ইংরেজী ক্লাসিক সাহিত্যের দান্তে, হোমর, শেক্সপীয়রসৃষ্ট চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লিখে ফেলেছেন খাতার পর খাতা। লিখে তো চলেছেন, এখন সে-লেখা প্রকাশের কি উপায়। দীনেশবাবু ভালো করেই জানতেন তখনকার বাংলা সাহিত্যে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আর ডেপুটি কালেক্টরের রাজত্ব। সেখানে ওঁর মতন সামান্য বেতনের এক ইস্কুল মাস্টারের লেখা প্রবন্ধ কলকাতার নামকরা পত্রিকাগুলি ছাপবে কেন। সুতরাং সাহিত্য করতে গেলে এবং সাহিত্যিক খ্যাতি পেতে হলে পূর্ববঙ্গের মফস্বল শহরে পড়ে থাকলে চলবে না, কলকাতায় গ্যাট হয়ে বসা চাই।

মামাতো ভাই মতিলালকে ডেকে বললে-দ্যাখ মতিলাল, আমি ভাবছি সামনের গরমের ছুটিতে এক মাসের জন্য কলকাতায় যাব।

দীনেশবাবুর যে-কোন প্রস্তাবেই মতিলাল উৎসাহিত। নিজে লেখাপড়া খুব বেশি কিছু করে নি বলে দীনেশবাবুর পাণ্ডিত্যের উপর ওর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। দীনেশবাবুর মুখে সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন সম্বন্ধে বাল্যকাল থেকেই বড় বড় কথা শুনে এসেছে; তাই ওর ধারণা-চান্স পেলে ওর ভাই সাহিত্যে মাইকেল-বঙ্কিমকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, পাণ্ডিত্যে বিদ্যাসাগরকেও। মতিলাল উৎসাহিত হয়ে বললে—কলকাতায় যাবি, খুব ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ কলকাতায় কেন?

কলকাতায় না গেলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। এখান থেকে ভাল ভাল লেখা পাঠাঁইফেরত আসে। কলকাতার সম্পাদকরা বাঙালদের উপর বড় চটা। আমলই দিতে চায় না।

মতিলাল ক্ষেপে গেল। বললে—কি বললি? চল, আমিও যাব তোর সঙ্গে।

দুই ভাই মিলে অনেক পরামর্শর পর স্থির হল, প্রথমে দীনেশবাবু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করবেন কলকাতায় একটা চাকরির জন্যে। কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে না বসতে পারলে লেখক হবেন কি করে। এক মাসের ছুটিতে পদ্মাপার হয়ে সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করে চলে এলেই আউট অব সাইট, আউট অব, মাইণ্ড। লেগে থাকতে হবে ছিনে-জোকের মত। কুমিল্লায় চাকরি করে তো আর সে সম্ভব নয়।

১৮৯১ সালের কথা। জ্যৈষ্ঠ মাস। দীনেশবাবু মামাতো ভাই মতিলালকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেই এক শনিবার সকালে প্রথমেই গেলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে। বিদ্যাসাগর তখন থাকতেন বাদুড়বাগানে। সে-বাড়ির দোতলার মাঝের একটা ঘরে চারিদিকে বই-ভর্তি আলমারি। তারই মাঝে একটা টেবিল, তার পাশে খানকতক চেয়ার পাতা। বিদ্যাসাগর একটি চেয়ারে বসে মাথা গুঁজে কি কাগজপত্র দেখছিলেন। দীনেশবাবু নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বিদ্যাসাগরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই সন্ত্রস্ত হয়ে পা সরিয়ে নিলেন। মনে হল পা ছুঁয়ে প্রণাম করাটা ওঁর পছন্দ নয়। দীনেশবাবু তখন যুবক, চেহারার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি ভাব। দীনেশবাবুর দিকে তাকিয়েই বিদ্যাসাগর বললেন–কি চাস?

আজ্ঞে আপনার পায়ের ধূলো নিতে এসেছিলাম।

উহুঁ, বিশ্বাস হল না। মতলব কিছু-একটা আছে, বলেই ফেল।

প্রথম সাক্ষাতেই তুই সম্বোধনে দিনেশবাবু পুলকিত হয়ে উঠেছিলেন। অত বড় বিরাট ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মহাপুরুষ, অথচ কত সহজেই মানুষকে আপনার করে নিতে পারেন। সুতরাং উদ্দেশ্যটা খোলাখুলি বলতে আর সংকোচ রইল না। ইংরেজী অনাসসহ পাশ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা, কলকাতা আসার উদ্দেশ্য, একে একে সবিস্তারে জানানোর পর বললেন–আপনার স্কুলে আমাকে একটা চাকরি দিতেই হবে।

বাড়ি কোথায়?

আজ্ঞে, ঢাকা জেলায়।

তাই তো, তুই যে ঢাকার বাঙাল তা তো তোর কথার টানেই বুঝতে পেরেছি। এখানকার ছাত্র তোর টি জেলার ভিক্টোরিয়া স্কুলের ছাত্র নয় যে, তুই অনার পাশ, তা-ও ইংরিজীতে, শুনলে বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে পড়বে।

আপনি একবার পড়াবার চান্স দিয়েই দেখুন না স্যার।

এখানে বড় বড় ওস্তাদ শিক্ষকেরা ঘায়েল হয়ে যায়, ক্লাস সামলে উঠতে পারে না। তুই একে বাঙাল, তায় চেহারায় ছেলেমানুষ। তোকে তো একদিনে পাগল করে ছাড়বে।

দীনেশবাবুর তখন গো চেপে গিয়েছে। বললেন—আমাকে ক্লাস করতে দিয়েই দেখুন না। আর আমিও দেখতে চাই আপনার স্কুলের ছেলেরা বাঙালকে ঘায়েল করতে পারে কি না।

উত্তর শুনে বিদ্যাসাগর খুশী হয়েই বললেন–তোর তো বেশ সাহস আছে দেখছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না তুই পারবি। ও বাঙালের কর্ম নয়। যা হোক, তুই যখন চাচ্ছিস সোমবার দিন বেলা ১১টার সময় মেট্রপলিটান স্কুলে যাস। আমি সেই সময় যাব এবং তোকে ক্লাসে পড়াতে দেব।

বিদ্যাসাগরের বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়েই মতিলাল দুই চোখ বিস্ফারিত করে বললে—অতবড় লোকের সঙ্গে তুই সমানে পাল্লা দিয়ে কথা বলে গেলি, ভয়ে বুক কাঁপছিল না?

দীনেশবাবু বললেন—আরে আমরা হচ্ছি পদ্মাপারের লোক। ও-সব খাল, নদী, সাগর, মহাসাগর দেখে ভয় পেলে চলবে কেন।

দীনেশবাবুর প্রতি মতিলালের শ্রদ্ধা চড়চড় করে বেশ কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেল।

 

সোমবার দিন যথাসময়ে দীনেশবাবু মেট্রপলিটান স্কুলে এসে হাজির। মিনিট পনের পরেই উড়িয়াবাহকরা একটি পালকি এনে স্কুলের গেটের সামনে রাখল। পালকির ভিতর থেকে সাদা উড়ানি গায়ে চটি পায়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বেরিয়ে এলেন। দীনেশবাবুকে দেখেই বললেন—চল তোকে হেড মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই।

দীনেশবাবুকে সঙ্গে নিয়ে লাইব্রেরী রুমে গিয়েই হেড মাস্টারকে ডেকে পাঠালেন। গলাবদ্ধ কোট, কাঁধে পাটকরা চাদর, প্রৌঢ় বয়সী হেড মাস্টার মশাই আসতেই দীনেশবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন–তুমি একে প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণী পড়াতে দাও।

হেড মাস্টার মশাই দীনেশবাবুকে সঙ্গে করে ক্লাস রুমের দিকে নিয়ে যাবার সময় বললেন–আপনি দেখছি নিতান্তই ছেলেমানুষ। তা কোন সাবজেক্ট পড়াবেন?

দীনেশবাবু বললেন–ইংরেজী এবং ইতিহাস দুটোই আমি পড়াতে পারব।

স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছেলেরাই সাধারণত তুখোড় হয়। হেড মাস্টার মশাই প্রথমেই দীনেশবাবুকে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে হাজির করে দিয়ে চলে এলেন। সৌন্দর্য সম্বন্ধে শেলী ও কীটস-এর তুলনামূলক আলোচনার পরই বৈষ্ণব কবিদের প্রেমতত্ত্বে এসে গেলেন, সঙ্গে ডাইনে-বাঁয়ে ইংরেজী কবিতা ও বৈষ্ণব পদাবলীর উদ্ধৃতি। ছেলেরা গেল হকচকিয়ে। পড়া শেষ করে দীনেশবাবু ছাত্রদের বললেন—তোমাদের পড়া দেখছি খুব কমই হয়েছে। পরীক্ষা নিকটবর্তী, কি করে সবটা শেষ করবে? যিনি ইংরেজী পড়ান তিনি তো তোমাদের পড়া কিছুই এগিয়ে দেন নি দেখতে পাচ্ছি।

দীনেশবাবু হয়ত ভেবেছিলেন পূর্ববর্তী মাস্টারের পাঠন-পদ্ধতি সম্বন্ধে ছাত্রদের মনে অনাস্থা ঢুকিয়ে দিতে পারলে কাজ হাসিল হবে। পড়ানো শেষ করে ক্লাস-রুম থেকে বার হতে গিয়েই দেখেন দরজার পাশে হেড মাস্টার ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে পড়ানো শুনছিলেন এবং উনি জানতেন না যে, ওই শ্রেণীর ছাত্রদের এতদিন ইংরেজী পড়িয়ে এসেছেন হেডমাস্টার স্বয়ং। পরের ঘণ্টায় দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রদের ইতিহাস পড়ালেন, নির্বিঘ্নে ফাঁড়া কেটে গেল। ভিতরে ভিতরে অনুসন্ধান করে যখন জানতে পারলেন উভয় শ্রেণীর ছাত্ররা ওঁর পড়ানোতে খুশী, নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি গেলেন।

পরের দিন মঙ্গলবার খুব গর্বের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে যেতেই বিদ্যাসাগর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বার করে দেখালেন, তাতে হেডমাস্টারের মন্তব্য লেখা আছে-প্রথম শ্রেণীর ছাত্ররা খুশী হয় নাই। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্ররা ভালই বলিয়াছে।

দীনেশবাবুর মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। একে ঢাকার বাঙাল, তার উপরে অল্প বয়েস। রাগলে রক্ষে নেই। বিদ্যাসাগরের মত সম্মানীয় ব্যক্তির সামনেই বিশুদ্ধ দ্যাশের ভাষায় হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে যা-ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। শেষে দরজার আড্ডালে দাঁড়িয়ে ওঁর মন্তব্য চুরি করে শোনার কথাও সবিস্তারে জানিয়ে বললেন–হডমাস্টর আমার উপরে চেইত্যা গিয়া এই রিপুর্ট দিছে।

বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র বিরক্ত না হয়ে বললেন–তোর ভিতরে দেখছি তেজ আছে। অন্তত একটা ক্লাসের ছাত্রদের যখন খুশী করেছিস তখন তুই পারবি। বাঙাল মাস্টার পেলে তো ছেলেরা তাকে লাড্ডর মত ব্যবহার করে। যা হোক আমি তোকে যোগ্য বলেই মনে করছি। তবে কি জানিস, তোর আগে পাঁচ ছয় জন যোগ্যতা দেখিয়েছেন, এই দেখ তাদের নাম। এরা কাজ পেলে তারপর তোর পালা। আর দেড় দুই মাস পরে আমি তোকে নিতে পারব। তুই মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করিস।

দীনেশবাবু, এ-কথায় খুশী হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। বললেন–আমার যে কুমিল্লার স্কুল খুলে যাবে, দু-একদিনের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে। আপনি আমায় কাজ খালি হলে চিঠি দেবেন।

বিদ্যাসাগর ঘাড় নেড়ে বললেন–সে হবে না। তোর এখানেই থাকতে হবে। কাজ খালি হলে চিঠি লিখে অনাবার মত সবুর সইবে না। কে কোথা দিয়ে ঢুকে পড়বে। এখানে চাকরি প্রার্থীর অভাব নেই। কুমিল্লার চাকরি ইস্তফা দিয়ে যদি কলকাতায় থাকতে পারিস তবে কথা দিচ্ছি দুই মাসের মধ্যেই চাকরি পাবি।

বিদ্যাসাগর যে এক কথার মানুষ দীনেশবাবুর তা জানা ছিল না বলেই তার কথায় আস্থা রাখতে পারলেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যে চাকরি ইস্তফা দেওয়াটা সমীচীন মনে না হওয়ায় তিনি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন।

 

কলকাতায় থেকে সাহিত্যিক হবার প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেও নিরুদ্যম হন নি। এবার দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় অগ্রসর হওয়া যাক। অর্থাৎ এবার সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। যে-সে সম্পাদক নয়, একেবারে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র।

বঙ্গদর্শন তখন বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা। বঙ্কিমবাবুর নিজের লেখা উপন্যাস ও প্রবন্ধাদি প্রতি সংখ্যাতেই প্রকাশিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে তখনকার ইংরেজী শিক্ষিত বহু বিদগ্ধ ব্যক্তিকে তিনি বাংলা ভাষায় প্রবন্ধাদি লেখায় উৎসাহিত করেন। বঙ্গদর্শনকে ঘিরে তখন একটি সাহিত্যগোষ্ঠী আপনা থেকেই গড়ে ওঠে। বঙ্গদর্শনে তখন একটি লেখা প্রকাশ করতে পারলেই লেখক রাতারাতি সাহিত্যিক-খ্যাতি লাভ করতেন।

মামাতো ভাই মতিলালকে প্রস্তাবটা দিতেই সে লাফিয়ে উঠল। প্রাত:–স্মরণীয় বিদ্যাসাগরকে দেখেছে, এবার দেখবে বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। মতিলাল বললে—তা হলে কাল সকালে চল।

দীনেশবাবু বললেন–দাঁড়া, অত ব্যস্ত হলে চলবে না, তৈরি হয়ে নিই।

দেখা করতে যাবে তৈরি হবার কী আছে। কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না মতিলাল। দীনেশবাবু বললেন–সামনের রবিবার যাব। হাতে চারদিন সময় আছে, এর মধ্যে বই যোগাড় করে ভাল করে পড়ে নিতে হবে। ইমপ্রেস করতে হবে তো।

বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহিত্যের আলোচনায় একবার ইমপ্রেস করতে পারলেই বঙ্গদর্শন পত্রিকার নিয়মিত লেখক হবেন, এই আশায় চারদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সাহিত্যের মোটা মোটা বই পড়ে ফেললেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সবগুলি উপন্যাসের উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, ওদিকে হোমর, দান্তে, শেক্সপীয়র, দার্শনিক কেঁাৎ আরেকবার ঝালিয়ে নিলেন। কি কি বিষয় নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করবেন, বঙ্কিম রচিত উপন্যাসের কোন্ কোন চরিত্রের কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন তার একটা খসড়া মনে মনে প্রস্তুত করে ফেললেন। শুধু তাই নয়। বঙ্কিমবাবুর বিশেষ পরিচিত বন্ধু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কালীপ্রসন্ন সরকারের কাছ থেকে একটি পরিচয়পত্রও জোগাড় করে ফেললেন। কালীপ্রসন্নবাবু কুমিল্লায় থাকাকালে গীতার ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদের কাজে দীনেশবাবু তাকে সাহায্য করেছিলেন— পরিচয়পত্রে সে কথারও উল্লেখ ছিল। অর্থাৎ বঙ্কিমবাবুকে ইমপ্রেস করবার তাবং অস্ত্র শানিয়ে রবিবার বেলা দুটোয় মতিলালকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্কিমসঙ্গমে বেরিয়ে পড়লেন।

বঙ্কিমবাবু তখন থাকতেন কলেজ স্ট্রীট পাড়ার প্রতাপ চাটুজ্যের গলিতে। খোঁজ করতে করতে যখন তারা বাড়িটার সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ ভিতর থেকে প্রচণ্ড চিৎকার শোনা গেল

পাজি হতভাগা গাধা, বোজ দুপুরে কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমনো? ভেবেছিস আমি কিছু টের পাই নে? বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে নচ্ছার কোথাকার–দূর হয়ে যা।

সুর সপ্তমে তুলে গালি-গালাজ চলছে এক নাগাড়ে। যার প্রতি গালি বষিত হচ্ছে, সে পক্ষের তরফ থেকে কোন উচ্চবাচ্য নেই।

খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দীনেশবাবু দেখলেন এক নগ্নদেহ গৌরবর্ণ বৃদ্ধ তার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চাকরকে অনর্গল বকুনি দিয়ে চলেছেন। দুটি অপরিচিত যুবক দরজায় উঁকি মারছে দেখে বৃদ্ধ একটু

অপ্রস্তুত হয়ে চাপা গম্ভীর গলায় গৃহভৃত্যকে বললেন–

আচ্ছা তুই এখন যা।

ভৃত্য সামনে থেকে চলে যেতেই আগন্তুক যুবকদের দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনারা কাকে চান?

সপ্রতিভ হয়েই দীনেশবাবু বললেন—আমরা বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

বৃদ্ধ বললেন–কোত্থেকে এসেছেন, কি দরকার?

দীনেশবাবু বললেন—আমরা কুমিল্লা থেকে এসেছি, বঙ্কিমবাবুর শুধু একবার দর্শন পেতে চাই।

বৃদ্ধ তৎক্ষণাৎ দক্ষিণ দিকের একটা সিঁড়ি দেখিয়ে বললেন–ওই সিঁড়ি দিয়ে উপরের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, তাকে খবর দিচ্ছি।

যাক, তাহলে বঙ্কিমবাবুর দেখা পাওয়া যাবে। দুজনে হর্ষোৎফুল্ল হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন। মাঝারি মাপের ঘর। এক কোণায় একটি টেবিল অর চার পাশে চারটি চেয়ার। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নেই, বৈঠকখানা ঘর বলেই ওঁদের মনে হল। পাশাপাশি দুটি চেয়ার টেনে দুই ভাই অধীর আগ্রহে বসে আছেন বঙ্কিমবাবুর আগমন প্রতীক্ষায়।

দীনেশবাবু ধ্যানস্থ হয়ে মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছেন বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে সাহিত্যের কোন্ কোন্ বিষয়ে কি কি আলোচনা পর পর চালাবেন। মতিলাল অবাক হয়ে আসবাবহীন ঘরটার চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে আর ভাবছেএতবড় নামজাদা লেখক ও সম্পাদক অথচ ঘরে না আছে আসবাবপত্র, না আছে আলমারিভর্তি মোটামোটা সংস্কৃত আর ইংরেজী বই, এমন কি বঙ্গদর্শন পত্রিকার নতুন বা পুরোনো কোন সংখ্যাই ঘরের আনাচে-কানাচে কোথাও দেখতে পেল না। বিদ্যাসাগরের ঘরে ঢুকে চারিদিকের পাণ্ডিত্যের পরিবেশ দেখে ও যেমন বিস্মিত হয়েছিল, এখানে তার কোন পরিচয় না পেয়ে দমে গেল।

মিনিট তিন-চার নীরব প্রতীক্ষার পর হঠাৎ চটি জুতোর খসখস আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়েই দীনেশবাবু ও তার মামাতো ভাই মতিলালের চক্ষুস্থির। ইনিই সেই নগ্নদেহ বৃদ্ধ-রুদ্রমূর্তি ধারণ করে যিনি চাকরকে তারস্বরে বকুনি দিচ্ছিলেন। এখন আর নগ্নদেহ নেই, পরনে নতুন পাটভাঙ্গা শান্তিপুরী ধুতি আর গিলে-হাতা কামিজ। বুঝতে অসুবিধে হল

যে, যার দর্শনপ্রার্থী হয়ে এসেছেন ইনিই সেই স্বনামধন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ঘরে ঢুকেই বঙ্কিমবাবু টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বেশ ভব্যসব্য হয়ে বসলেন। মুখে প্রশান্ত গাম্ভীর্য, দৃষ্টিতে অতলান্ত সমুদ্রের গভীরতা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, দাড়ি-গোঁফ মসৃণভাবে কামানো, মুখের হাঁ একটু বড়, দীর্ঘাকৃতি।

চেয়ারে বসেই হাত বাড়িয়ে কালীপ্রসন্ন সরকারের চিঠি দীনেশবাবুর হাত থেকে নিয়ে এক নিশ্বাসে পড়েই প্রশ্ন করলেন—কালীবাবু কি এখনও কুমিল্লাতেই আছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি যে গীতার অনুবাদ করছিলেন—

কথা শেষ করতে না দিয়েই বঙ্কিমবাবু বললেন—ওঁর শরীর এখন সুস্থ আছে তো?

হ্যাঁ, শরীর ভালই। তবে গীতার ইংরেজী অনুবাদের কাজে আমরা দুজনে যে পরিশ্রম–

ওঁর যে মৈমনসিং-এ বদলি হবার কথা ছিল, তা হন নি দেখছি। কুমিল্লা জায়গাটা কেমন?

জায়গাটা মফস্বল শহর হিসেবে ভালই। তাছাড়া এই জেলার অনেক প্রাচীন পুথি আছে, আমি সংগ্রহ করেছি—

ওখানকার জলবাতাস কি রকম। শুনছি খুব বৃষ্টি হয়। তা হয়।

তবে সেইসব পুথিপত্রে প্রাচীন বাংলা কাব্যের যে সম্পদ

আচ্ছা, ওখানকার আবহাওয়া কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল? বঙ্কিমবাবুর দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে নিবদ্ধ।

বর্ষাকালটাই যা একটু খারাপ। অন্য সময় তো খুবই ভাল। আপনার কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে আপনি কাপালিকের যে চরিত্র এঁকেছেন—

কড়িকাঠের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বঙ্কিমবাবু বলে উঠলেন— ওখানে ধান চালের অবস্থা এখন কি রকম?

দীনেশবাবু বেশ একটু দমে গেলেও ওঁকে সাহিত্যের আলোচনায়-নামাবার চেষ্টা ছাড়লেন না। বললেন—ধান চাল ওখানে প্রচুর। আপনি বিষবৃক্ষ উপন্যাসে আমাদের সমাজে নারীর প্রেম সম্পর্কে যে সমস্যা তুলে ধরেছেন তার একটি সুন্দর সমাধান পাই বৈষ্ণব সাহিত্যে। চণ্ডীদাস এক জায়গায় বলেছেন–

খুব জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয় এতক্ষণ জানা হয় নি অবিলম্বে জেনে নেওয়া দরকার—এমনি একটা ব্যস্ততা চোখে মুখে এনে দীনেশবাবুর কথা থামিয়ে বলে উঠলেন-দর কত বললেন না তো।

বেশ একটু ঘাবড়ে গিয়ে দীনেশবাবু বললেন—কিসের দর?

কেন, ওই ধানচালের?

এবার দীনেশবাবু সত্যি সত্যিই একেবারে কুঁকড়ে গেলেন। যতবার উনি সাহিত্য সম্বন্ধে আলাপ করতে চেষ্টা করেন, ততবারই বঙ্কিমবাবু সে-কথা এড়িয়ে গিয়ে শুধু ধানচাল, লোকসংখ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে লাগলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে যে সব লাইন আলোচনা প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দিয়ে ইমপ্রেস করবেন বলে কণ্ঠস্থ করে এসেছিলেন সেগুলি একে একে মনে পড়তে লাগল। —ধীরে, রজনী ধীরে, অন্ধ অথচ কুঞ্চিত, বিকলা অথচ শীর্ণা, দূরাগত রাগিণীর ন্যায়, অবিকশিত কুসুম সুরভির ন্যায় রজনী ধীরে ধীরে জলে নামিতেছে। আবার মনে পড়ল সেই বিখ্যাত উক্তি—শোনন ওসমান, আবার বলি, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। কপালকুণ্ডলায় বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে কাপালিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন—অগ্নিদেব যাহার পা দুখানিকে কাষ্ঠভ্রমে চিবাইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিছুমাত্র রস না পাইয়া অর্ধদগ্ধ অবস্থায় ফেলিয়া গিয়াছেন। আবার মনে পড়ল—নির্জন সমুদ্রতীরে কপালকুণ্ডলার বীণাকণ্ঠ ধ্বনি—পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?

শুধু কি তাই? গয়টের ফাউস্ট আর শিলারের এপিসাইকিন থেকে যে-সব কবিতার অনর্গল উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিজের বিক্রম দেখাবেন বলে গত চারদিন আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে এত পরিশ্রম করলেন, সে সবই কি ব্যর্থ হবে? হতাশায় ক্ষোভে দুঃখে দীনেশবাবুর চোখ ছলছল করে উঠল। মুখে একটা বজ্রকঠিন গাম্ভীর্য এনে বঙ্কিমবাবু তখনও জানালার বাইরে নিম গাছটার কচি পাতার দিকে চেয়ে আছেন।

শেষ চেষ্টার সঙ্কল্প নিয়ে দীনেশবাবু প্রশ্ন করলেন-চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের মধ্যে আপনি কাকে গীতি-কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি বলে মনে করেন?

বঙ্কিমবাবু জানালার বাইরে দৃষ্টিনিবদ্ধ রেখেই বললেন–দুধ?

দীনেশবাবু এবার হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। গীতি-কবিতার সঙ্গে দুধের কি সম্পর্ক।

প্রশ্নটা ধরতে পারছেন না মনে করেই বঙ্কিমবাবু ভোলা করে বললেন–ওখানকার দুধের দর এখন কত তা তো বললেন না।

বাঙালের রাগ কতক্ষণ আর দমিয়ে রাখা যায়। ফোঁস করে উঠলেন দীনেশবাবু। বললেন–দেখুন, আপনি বোধ হয় আমার পদ্মাপারের কথার টানে এবং চেহারা দেখে মনে করেছেন আমি একটি কৃষক যুবক; সুতরাং লাঙ্গল গরু চাষাবাদ ছাড়া আর কোন বিষয়ে আলোচনার আমি মোগ্য নই। আপনার ধারণা ভুল।

গম্ভীর হয়ে বঙ্কিমবাবু বললেন—আমার ধারণার কথা ছেড়ে দিন। আপনার ধারণা যাতে ভুল না হয় সেইজন্য আমি সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় পারতপক্ষে নাবি নি।

অবাক হয়ে দীনেশবাবু বললেন–তার মানে?

মানে অতি সরল। বাইরে থেকে আপনাদের ধারণা আমি একজন মহাপণ্ডিত ব্যক্তি। ধারণাটা যাতে মিথ্যে না হয়, সেইজন্যই পণ্ডিতি আলোচনায় মুখ খুলি না। তাছাড়া আপনাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে দেখবার, আমার সঙ্গে বসে সাহিত্য আলোচনার নয়।

–যদি সাহিত্য আলোচনার উদ্দেশ্যই জানতাম?

তাহলে বলে দিতাম বঙ্কিমবাবু বাড়ি নেই।

কী সাংঘাতিক কৃথা! দীনেশবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন বঙ্কিমবাবুর দিকে, আর বঙ্কিমবাবু জানলার বাইরে দূর আকাশের দিকে নির্বিকার দৃষ্টি মেলে স্থির হয়ে বসে আছেন। আর মতিলাল? তার অবস্থা না বলাই ভাল।

মিনিট খানেক অস্বস্তিকর নীরবতার পর দীনেশবাবু চেয়ার থেকে উঠে পড়ে বললেন–আমরা এখন চললাম। অযথা আপনার খানিকটা সময় নষ্ট করেছি, মার্জনা করবেন।

বিদায় নেবার সময় পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে বাধা দিয়ে বঙ্কিমবাবু বললেন–এসে ছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে, ফিরে যাচ্ছেন অশ্রদ্ধা নিয়ে। সুতরাং পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আর আমার অপরাধ বাড়াবেন না।

এমন বিফল সাক্ষাৎকার দীনেশবাবুর জীবনে আর কখনও ঘটে নি এবং কল্পনাও করতে পারেন নি। গ্রীষ্মকালের অপরাহ্নের পিচগলা রাস্তায় নেমে দীনেশবাবু হনহন করে হেঁটে চলেছেন, পিছনে রয়েছে মুষড়ে-পড়া মতিলাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *