২০. লজ্জাহীনতা

তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাস বাজেয়াপ্ত

গতকাল শনিবার এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অঙ্গনে বিঘ্ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রবিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় তসলিমা নাসরিন রচিত লজ্জা (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ৯৩ পার্ল পাবলিকেশন্স, ৩৮/২, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ হতে প্রকাশিত) বইটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯- ক (৯৯-অ) ধারার ক্ষমতাবলে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং এর সকল কপি বিক্রয়, বিতরণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১১ই জুলাই, ১৯৯৩

রবিবারের পত্রিকায় প্রথম পাতায় খবরটি ছাপা হয়। খবরটি আমাকে বিস্মিত করে, আমাকে চমকিত করে, আমাকে স্থবির করে আবার চঞ্চলও করে। লজ্জা বইটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটিয়েছে, এরকম অপবাদ কখনও কোথাও শুনিনি। বইটির গদ্য ভাল নয়, বইটি উপন্যাস হয়নি, তথ্যে ঠাসা বইটি বার বারই মনোযোগ নষ্ট করে, এসব শুনেছি। মানিও। বইটিতে ত্রুটি আছে, অবশ্যই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে লেখা। প্রকাশকের চাপে বইয়ের গুণগত মানগত ব্যপারগুলো নিয়ে ভাবার জন্য মোটেও সময় পাইনি। কিন্তু যত দোষই দাও, বইটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিঘ্ন ঘটাবে এই দোষ তুমি দিতে পারো না মাননীয় সরকার। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব বলেই বইটি লেখা, যেন সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়, যেন কোনও মানুষের ওপর তার ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের কারণে কোনও রকম নির্যাতন না হয়। শরীরে একটি মস্ত ঘা হয়েছে, এই ঘাটি খুলে দেখানোর উদ্দেশ্য একটিই, যেন চিকিৎসা পাওয়া যায়। এর মানে কি এই যে ঘাএর কথা বলে আমি শরীরের অপমান করেছি! যদি আমার নির্বাচিত কলাম আজ বাজেয়াপ্ত করা হত, আমি এত অবাক হতাম না। যদি নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্যকে নিষিদ্ধ করা হত, অবাক হতাম না। কারণ এই বইগুলোয় আমি ধর্ম সম্পর্কে আমার নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছি, যে মত এ দেশের বেশির ভাগ লোকেরই সয় না। লজ্জায় আমি ধর্ম নিয়ে কোনওরকম মন্তব্য করিনি। বরং সব ধর্মের মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার আছে, এবং তা থাকা উচিত, সে কথাই বলেছি। হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে, কোথায় কী করে নির্যাতিত হচ্ছে, কেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, কেন তারা নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে, তাদের কষ্টের কথা, তাদের গভীর গোপন যন্ত্রণার কথা তাদের হয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করেছি।

লজ্জা বাজেয়াপ্ত হওয়ার কদিন পর একটি দীর্ঘ চিঠি আমার হাতে আসে। চিঠির শুরুতে লেখা গোপনীয়। চিঠিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো, পাঠানো হয়েছে ঢাকা সেনানিবাস থেকে। সেনাবাহিনীর মহাপরিচালকের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার এম.এ.হালিম চিঠিটি লিখেছেন। সেনাবাহিনীতে, শুনেছি, দুটো দল আছে। এক দল ধর্মীয় চরমপন্থী, আরেক দল নরমপন্থী। চরমপন্থীরাই এই আদেশটি পাঠিয়েছে সরকারের কাছে। লিখিত ভাষাটিকে আদেশ বলে মনে না হলেও এটি আদেশ। সেনাবাহিনীর সীমাহীন ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের কোনও দ্বিধা থাকা উচিত নয়। সেনাবাহিনীর নিতম্বই এই স্বাধীন বাংলাদেশের গদি সবচেয়ে বেশিকাল স্পর্শ করেছে। অ-সেনা কিছু সরকারের মাথার পেছনে বন্দুকের নল ছিল, সে কথাও আমরা জানি। সেনাবাহিনী জানে, যে কোনও সময় তারা বন্দুক হাতে নিয়ে চলে আসতে পারে দেশ শাসন এবং শোত্র করতে। যে প্রধানমন্ত্রী এখন মহাসমারোহে ক্ষমতায় বসেছেন, তাঁর গাড়ির বহরও সেনানিবাস থেকেই যাত্রা করে। তিনি সেনা-স্ত্রী। সেনা থেকে নিস্তার নেই জনগণের। আমার থাকবে কেন! সেনাবাহিনী থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে লজ্জা নিষিদ্ধ করার, সুতরাং লজ্জাকে নিষিদ্ধ হতেই হবে। বন্দুকের সামনে মাথা নুয়ে আছে দেশের যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তনেলেওয়ালাগণ।

চিঠিটির শুরুতে লজ্জার গল্পটি সংক্ষেপে বর্ণনা করে এবং লজ্জা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে শেষদিকে, শেষপৃষ্ঠায় লেখা, ‘এতদাঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবচেয়ে অটুট। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হলে দুএকটি বিচ্ছিত ঘটনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার ঘটনা এই নয় যে, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই। সংখ্যালঘু হিন্দুরা চাকুরিতে সর্বক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে এবং কতক ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্যে হিন্দুদের অবস্থান সুসংহত। কিন্তু জনাবা তসলিমা নাসরিন বইটিতে হিন্দু নির্যাতনের কাল্পনিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। চাকুরি সংক্রান্ত ব্যপারে ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। বইটির মাধ্যমে লেখিকা হিন্দুদের দারুণভাবে উসকে দিয়েছেন। আর একজন মুসলমান লেখিকার এহেন লেখা থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বাংলাদেশে হিন্দুদের নাগরিক অধিকার হরণ ও তাদের উপর নির্যাতনের অলীক ধারণাকে সত্য বলে ধরে নেবে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে সহাবস্থানের মনোভাব ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

কারও লিখিত বই দ্বারা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টির অবকাশ থাকলে সে সকল বই বাজারে প্রকাশিত হতে না দেয়াই শ্রেয়। জনাবা তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কটাক্ষ করে লজ্জা বইটি লিখে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছে বিধায় বইটি নিষিদ্ধ করণ ও বাজার হতে এর সকল কপি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আপনার সদয় অবগতি এবং যথাসমীচীন কার্যক্রমের জন্য প্রেরিত হল।

কোত্থেকে প্রেরিত হল? প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর থেকে। ১৩০০/১৬৪/ডি/সি.আই.বি। তারিখ, আষাঢ় ১৪০০/ ০৩ জুলাই,১৯৯৩

এ চিঠি লেখার পর সাতদিনের মধ্যেই লজ্জা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার বইয়ের বাজারে যত লজ্জা পাওয়া গেছে, সব তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। কেবল তাই নয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ দল বাংলাবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে যত লজ্জা ছিল, সব লজ্জা ট্রাক ভরে নিয়ে গেছে, এমনকী ৬ নম্বর ওয়াল্টার রোডে বই বাঁধাই এর দোকানে গিয়ে আধ-বাঁধানো আর না বাঁধানো বইগুলোকেও রেহাই দেয়নি। কেবল ঢাকায় নয়, দেশের সমস্ত বইয়ের দোকানে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে যত লজ্জা ছিল, পুলিশ সবই বাজেয়াপ্ত করেছে। বই বেরিয়েছে সেই ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রকাশের পাঁচ মাস পর বই নিষিদ্ধ। এর মধ্যে ষাট হাজার বিক্রি হয়ে গেছে। সপ্তম সংষ্করণ চলছিল। আর এখন কী না বইটি নিষিদ্ধ হল! এই সরকার কাকে পড়তে দিতে চায় না বইটি। স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বছরের পর বছর রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করে স্বৈরাচার উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করল, আর এই কি না গণতন্ত্রের চেহারা!

কবি শামসুর রাহমান লজ্জা বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। পত্রিকায় কেবল বিবৃতি দিয়েই তিনি দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে মনে করেননি, ভোরের কাগজে লিখলেন, ‘তসলিমা নাসরিন প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে আক্রমণ করা হচ্ছে বহুদিন থেকে। একটি কি দুটি ইসলামী সংগঠন তাঁর ফাঁসির দাবি জানিয়েছে। সরকারকে বলেছে তাঁকে গ্রেফতার করার জন্যে। সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেনি কিন্তু বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাঁর লোকপ্রিয় উপন্যাস লজ্জা। উপন্যাসটি আমি আদ্যেপান্ত পড়েছি। নান্দনিক দিক থেকে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করলেও আমার কাছে এই উপন্যাসের কোনও কিছুই আপত্তিকর মনে হয়নি। তসলিমা নিদ্বির্ধায় সত্য প্রকাশ করেছেন এবং সত্য প্রকাশ করাই একজন লেখকের প্রধান কর্তব্য। তসলিমা নাসরিন একজন মুক্তমতি, অসাম্প্রদায়িক লেখক। কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার প্রবণতা তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে না, পাঠকদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা থেকেই নিজেকে তিনি বিরত রেখেছেন সবসময়। কোদালকে কোদাল বলতেই পছন্দ করেন তিনি। যা বলেন, সাফ সাফ বলেন, রেখে ঢেকে কিছু বলেন না। এক যুবক আমাকে কিছুদিন আগে জানিয়েছেন যে লজ্জা উপন্যাসটি পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যেন তিনি নিজেই উপন্যাসটির নায়ক সুরঞ্জন। এ রকম একটি বই বাজেয়াপ্ত করার যৌক্তিকতা কোথায়? যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি ডক্টর আহমদ শরীফ। তিনি বলেছেন, লজ্জায় তথ্যের কোনও বিকৃতি নেই।

জনগণের রায়ে নির্বাচিত সরকার দেশে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা প্রায়শই বলে। কে না জানে, বাক স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত। অথচ সরকার একজন সৃজনশীল লেখকের বই বাজেয়াপ্ত করে বাক স্বাধীনতা হরণ করেছে। অথচ একটি বই, যা তসলিমা নাসরিনকে হত্যা করার জন্যে সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করছে, বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। কাউকে হত্যার প্ররোচনা দেওয়া মস্ত অপরাধ। এই বইয়ের দিকে সরকার নজর দিচ্ছে না কেন? মৌলবাদীদের বই বলে?

ব্যক্তিগত ভাবে আমি কোনও বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পক্ষপাতি নই। কারণ, আমি মনে করি না কোনও বইই সমাজের ক্ষতি করতে পারে। যে বই মানুষকে হত্যা করতে প্ররোচণা এবং উৎসাহ জোগায়, ফ্যাসিবাদের গুণ গায়, সে বইয়ের কথা আলাদা। যে দেশে ওষুধেও ভেজাল দেওয়া হয়, চোরাচালান কায়েম রয়েছে, খাদ্যদ্রব্য বিষাক্ত করা হয় ভেজাল মিশিয়ে, যে দেশে ক্ষতিকর লোকদের অবাধ বিচরণ, সে দেশে একজন সত্যান্বেষী মুক্তমতি লেখকের বই নিষিদ্ধ করা হয় কেন? একজন লেখক নিরীহ বলেই কি? তসলিমা নাসরিনর লজ্জা উপন্যাসটিকে মুক্ত ঘোষণা করার জন্য আমরা যারা লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাঁরা সরকারের কাছে দাবি জানাই। আশা করি, সরকার লজ্জার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে প্রমাণ করবেন যে প্রকৃতই তারা বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।’

১৯ জুলাই তারিখে লেখাটি ছাপা হয় ভোরের কাগজে। তার পরদিনই ছাপা হল প্রাক্তন বিচারপতি কে এম সোবহানের লেখা। বাজার থেকে লজ্জা তুলে নেওয়ার জন্য সরকার যে বিপুল পুলিশবাহিনী নামিয়েছে দেশে, তা দেখে তিনি মন্তব্য করেছেন ..‘এই পুলিশী তৎপরতা যদি চালানো হত গত ডিসেম্বরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তা হলে হয়ত বইটি লেখার দরকারই হত না। বইটিতে যেসব বক্তব্য আছে তা বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে উস্কানিমূলক বলে কোনও পাঠক মনে করবেন না যদি না সেই পাঠক ঐ সন্ত্রাসীদেরই একজন বা তাদের প্রতি সহানূভূতিসম্পণ্ন হয়।’

কে এম সোবহান ‘সরকারের লজ্জা ধর্মীয় চরমপন্থীরাঞ্চ এই শিরোনামে আরও একটি কলাম লিখেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দলের যে গলায় গলায় মিল আছে একটি ব্যপারে, তা বলেছেন। জ্ঞস্বৈরাচারী সরকারের ওপর মৌলবাদী চরমপন্থীদের প্রভাবের কারণে ও তাদের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চালানো হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের অন্যান্য কাজের প্রতি সরকারি দলের অসন্তুষ্টি থাকলেও ঐ কাজটি তাদের পছন্দসই ছিল কেন না স্বৈরাচারীর সঙ্গে এখানে তাদের মতের সম্পূর্ণ মিল। তাই গ্লানি নামের সংকলনটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই লজ্জা নিষিদ্ধ।’ বর্তমান সরকার নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেই, কে এম সোবহান বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক হওয়া যায় না।’

এই যে ধুম করে বইটি নিষিদ্ধ করে দিল সরকার আর এই যে গতমাসেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে গিয়ে বলে এলেন, যে ‘আমাদের রাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে এবং সেই কারণে এর অংশ হিসেবে মানবাধিকারের নীতিগুলোর প্রতিও সরকার অনুগত। এটা আমাদের সংস্কৃতি ও সংবিধানের অংশ। আমাদের দেশে গণতন্ত্র কার্যকরী হয়েছে এবং আমাদের কাজে আছে পূর্ণ য়চ্ছত!। সরকার জনগণ ও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। প্রেস সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং বিরোধী দল তাদের অবস্থানে দৃঢ়। সেই কারণে আমরা নীতিগতভাবে মানবাধিকার পালন করব। ..’ এই কি পালন করার নমুনা! কথা এবং কাজের মধ্যে আদৌ কি কোনও মিল আছে এই সরকারের! সংবিধানে যে বেশ স্পষ্ট করে লেখা আছে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কথা, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা! তা কে মানে! কে দেখে সংবিধান। সরকারি দল মনে করে রাষ্ট্র তারা দখল করে নিয়েছে। ইচ্ছে করলেই তারা ডাংগুলি খেলতে পারে রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে। সংবিধানকে সঙ সাজিয়ে রাস্তায় ন্যংটো করে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে ইচ্ছে করলেই। কে এম সোবহান ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ‘দেশের সবোগচ্চ আইনের সংবিধানে এই বিধান থাকা সত্ত্বেও সরকারের একটি বিভাগ মৌলবাদী ও চরমপন্থীদের প্ররোচনায় বইটি বাজেয়াপ্ত করেছে। এই মৌলবাদী দলটি ও ধর্মীয় চরমপন্থীরা সরকারি দলের কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে বসেছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ আজ এই মৌলবাদী ও ধর্মীয় চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তা থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও দূরে নেই। মিশর, তুরস্ক, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, মরককো সর্বত্রই এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেবল বাংলাদেশের সরকারি দল ক্ষমতায় আসার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই তাদের কথামত কাজ করছে। মৌলবাদী এই দলটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য। সরকারকে এটা বুঝে এই মৌলবাদী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। সরকারগুলোর দূর্বলতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল গত ডিসেম্বরে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করা। তসলিমা নাসরিনকে তাঁর পাঠকবর্গ অভিনন্দন জানাবেন এই মৌলবাদী ও চরমপন্থী ও তাদের ধারককে জনগণের সামনে চিহ্নিত করার জন্য।’

অভিনন্দন আমার জোটে কিছু। তার চেয়েও বেশি জোটে অভিসম্পাত। অভিযোগের শেষ নেই। মুসলমানদের বারোটা বাজিয়েছি, মুসলমান হয়ে মুসলমানের দুর্নাম করেছি, বাংলাদেশে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই, যা লিখেছি মিথ্যে লিখেছি, হিন্দুরাই তাদের অবস্থার জন্য দায়ী, সামান্য ধমকেই কোঁচা তুলে ভারতে পালায়, আমার কাণ্ডজ্ঞান নেই, হিন্দুদের হাতের পুতুল হয়েছি, হিন্দু মৌলবাদীরা আমাকে পুরস্কার দিয়েছে, তারা আমাকে দিয়ে লজ্জা লিখিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মৌলবাদীরা তো বলেই কিন্তু বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত আহমদ ছফা বললেন, ‘লজ্জা একটি ইতরশ্রেণীর উপন্যাস।’ এই বইটি ভারতে তাঁর জাতভাই মুসলমানদের বিপদ ঘটাবে বলে তাঁর বিশ্বাস, সুতরাং তিনি জাতভাইদের যেন কোনও বিপদ না ঘটে তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করছেন। লিখেছেন ‘তসলিমা সবসময় মন্দ অংশটাকেই বড় করে দেখে। তসলিমার লজ্জাকে নর্দমার জরিপকারী রিপোর্ট মনে হয়েছে। তার বাকি উপন্যাসগুলো ইতর শ্রেণীর রচনা। ভদ্রলোকের স্পর্শের অযোগ্য।’ হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ‘তসলিমার লেখা অত্যন্ত নিম্নমানের.। তার লেখা অনেকাংশে অসততাপূর্ণ পুনরাবৃত্তিতে ভরা এবং বাজারের মুখ চেয়ে লেখা।’

কিন্তু সবকিছুর পরও স্বস্তি হয় যে অনেক লেখকই প্রতিবাদ করছেন বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, আলাপ হয়নি। লন্ডনে বসে কলাম লেখেন তিনি। ভোরের কাগজে কলাম লিখলেন ‘তসলিমার সাহিত্য, বক্তব্য ও মতামতের সমালোচনা নয় বরং ব্যক্তি তসলিমাই সবার আলোচনার বিষয়ঞ্চ, এই শিরোনাম দিয়ে। আমার ব্যক্তিজীবন, আনন্দ পুরস্কার পাওয়া, লজ্জা লেখা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যা ঘটেছে দেশে, সেসব নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন, ‘..তসলিমা নাসরিনের লেখা নিয়ে কোনও বিতর্ক নয়, বিতর্কের নামে আসলে যা শুরু হয়েছে, তা তসলিমার বিচার সভা। এই বিচারসভার স্ব-নিযুক্ত বিচারক হিংস্র এবং ঘাতক মৌলবাদীরা। পেছনে তাদের মদদদাতা ক্ষমতাসীন সরকার। আর জুরির আসনে বসা আমাদের সেক্যুলার ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের একাংশও দ্বিধান্বিত এবং দ্বিধাবিভক্ত। তাঁদের কারও লেখা পড়ে মনে হয়, তসলিমার প্রতি তাঁদের কারও রয়েছে ব্যক্তিগত অসূয়া, কারও রয়েছে আনন্দ পুরস্কার না পাওয়ার অব্যক্ত হতাশা ও ক্ষোভ, কারও রয়েছে তসলিমাকে হেয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দানের চতুর বাসনা। তাই তাঁদের লেখায় বিষয়ের চাইতে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে, একটি সুস্থ বিতর্কের বদলে গ্রাম্য বিচারসভার মোড়লপনাই বেশি প্রকট হয়ে পড়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার বর্তমান ভূমিকা সাম্প্রদায়িক নয়, এদের বর্তমান ভূমিকা গণতান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক মুনাফার। বাংলাদেশের একটি জাতীয় সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমি কলকাতার একটি ব্যক্তিগত প্রকাশনা সংস্থার অর্থ সাহায্য গ্রহণ না করে ভাল করেছেন, তাই বলে ঢাকার কোনও শিল্পী বা সাহিত্যিকের এই পুরস্কার গ্রহণ না করার কোনও অর্থ হয় না। আনন্দ পুরস্কার প্রদানে পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য নেই। তসলিমার নির্বাচিত কলামে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মের বিধানকেই আক্রমণ করা হয়েছে। আনন্দ পুরস্কার সম্ভবত এই অসাম্প্রদায়িক সাহসিকতাকেই পুরস্কৃত করেছে, কেবল বইটির সাহিত্য মূল্যকে নয়।

যে সাহিত্যকর্মের উদ্দেশ্য কোনও আন্দোলন, সংস্কার বা বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তাতে সবসময় চিরায়ত সাহিত্যের কাঙ্ক্ষিত শিল্পগুণটি থাকে না। যে নাজিম হিকমত বা মায়াকভস্কিকে নিয়ে আমরা এত হৈ চৈ করি, তাদের অধিকাংশ রাজনৈতিক কবিতার শিল্প মূল্য আছে কি?.তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাস সমাজের একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রয়োজনের তাৎক্ষণিক সাহসী সাহিত্য কর্ম। তাতে বনেদী সাহিত্যের স্থায়ী প্রসাদগুণ আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আশা করেন কিভাবে? বিজেপি তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসকে তাদের রাজনৈতিক প্রচারণার স্বার্থে ব্যবহার করেছে, এটাও নাকি তসলিমার অপরাধ। সম্প্রতি লন্ডনে বিজেপির একটি ছোট প্রচার পুস্তিকা আমার হাতে এসেছে । নাম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাতে বিজেপির কোনও নিজস্ব বক্তব্য নেই। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মন্দির ভাঙার ছোট বড় পঁচিশটি খবর হুবুহু পূণর্মুদ্রণ করা হয়েছে। এই পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাওলানা মান্নানের ইনকিলাবও রয়েছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে এই পত্রিকাগুলো বিজেপির প্রচারপত্র অথবা বিজেপির টাকা খেয়ে এই খবরগুলো ছেপেছে! বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধে বর্তমান সরকারের ইচ্ছ!কৃত ব্যর্থতায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ যত না লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ, তার চাইতে বেশি লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ তসলিমা লজ্জা উপন্যাস লেখায়। সেলুক্যাস, কি বিচিত্র এ বঙ্গ দেশ।’

বিরানব্বই সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়েছিল গ্লানি নামের একটি সংকলন। গ্লানিতে ছিল নব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের কিছু চিত্র, ভাঙা মন্দিরের ছবি আর হিন্দুদের ওপর মৌলবাদীদের নির্যাতনের কিছু তথ্য। সেই গ্লানি নিষিদ্ধ করল সরকার। লজ্জাও নিষিদ্ধ হল। সেলিনা হোসেন, নামী লেখক, লিখেছেন গ্লানি এবং লজ্জা নিয়ে। ‘দুটো বইয়ের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে এগুলো পাঠকের মনে সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে ইন্ধন যোগাবে। অতএব, বই দুটো পাঠকের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেল। ভাবখানা এই যে, এই বইদুটো লুকিয়ে রাখলেই দেশের অস্থিতিশীল সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

জাতীয় কবিতা উৎসব ৮৯ এর শ্লোগান ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, আমরা বিশ্বাস করি কবিতার জন্ম ঘটে প্রীতি আর মানবিকতা থেকে, কবিতা কোনও সম্প্রদায় স্বীকার করে না। .. এখন মানবিকতার, অসাম্প্রদায়িকতার কাল। আমরা আমাদের প্রতিটি পর্ব ও পংক্তি, প্রতিটি উপমা উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, আমাদের স্বর, আমাদের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করি অসাম্প্রদায়িক মানুষের নামে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবিকতার অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়াবেন।

এই সাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনাই এই ভূখণ্ডের মানুষের অহংকার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে বর্তমান বাংলাদেশের সরকারের যা ভূমিকা তা একদিকে যেমন গ্লানিকর, তেমনি লজ্জাজনক। সরকার নিজের অজান্তেই গ্লানি এবং লজ্জা শব্দদুটো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সরকার চাইলেই এই গ্লানি এবং লজ্জা হতে মুক্ত হতে পারবে কি?’

লজ্জা নিয়ে আমার যে লজ্জা আর গ্লানি ছিল, ছিল এই কারণে যে উপন্যাস বলতে এটি কিμছু হয়নি, সেটি খানিকটা দূর হয় বুদ্ধিজীবিরা যখন কলম ধরলেন বইটির পক্ষে। ডঃ মুহম্মদ আনিসুল হক লিখেছেন, ‘তসলিমা নাসরিনের লজ্জা বইটি আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক পাশবিকতার বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। .. এই বই স্বভাবতই এদেশে কারও কারও গাত্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জঘন্যতম ভুমিকায় লিপ্ত হয়েছে তারা তো ক্ষেপবেই। প্রকৃতপক্ষে সত্য চিরকালই সত্য। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেই সত্য মিথ্যে হয়ে যায় না।’ নিজে তিনি একদিন বাড়িতে এসে তৃতীয় ধারা দিয়ে গেলেন, যে পত্রিকাটিতে লেখাটি ছাপা হয়েছে। যাবার সময় বললেন, ‘আজ বসনিয়ায় সার্বরা মসজিদ ভাঙাছে, আমাদের মৌলবাদিরা এখন কি এদেশের কোনও গির্জা ভাঙতে যাবে? যাবে না। সরকারও দেবে না গির্জা ভাঙতে, কারণ তাহলে তো ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা নাখোশ হবে।’

হাসান ফেরদৌস একজন সাহসী সাংবাদিক। আমেরিকায় থাকেন। নিয়মিত বাংলাদেশের কাগজে লেখেন তিনি। তিনিও লিখলেন, ‘বইকে গলা টিপে হত্যা করা যায় না। কিন্তু নিষিদ্ধ করা যায়, পুড়িয়ে ফেলা যায়। বই যে সত্যকে উদ্ধার করে, তা নিয়ে যখন সন্ত্রস্ত হয় কেউ, তাকে নিষিদ্ধ করার, তাকে পাঠকের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। সত্যের মুখোমুখি হবার চাইতে তার টুঁটি টিপে রাখা, তাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা অনেক সহজ, তাই। ক্ষমতাধর মানুষ ও তাদের সমাজ এই চেষ্টা করেছে চিরকাল। চেষ্টা করেছে, পারেনি। সক্রেটিসকে হত্যা করা গেছে, কিন্তু যে সত্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, তাকে লুকিয়ে রাখা গেছে কি? বইএর বহ্নুৎসব করেছে হিটলার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে সে নিজে। লজ্জা কেবল বিরানব্বই এর দাঙ্গার কাহিনী নয়। এটি বাংলাদেশে সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার একটি প্রামাণ্য দলিল।’

যতীন সরকার আজকের কাগজ পত্রিকায় কলাম দীর্ঘ কলাম লিখলেন লজ্জার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে। লিখেছেন, ‘লজ্জা বাজেয়াপ্ত করে তাঁরা নিজেদের লজ্জাহীনতার অকুণ্ঠ প্রমাণ রাখলেন। লিখেছেন বে আইনি কাজ তাঁরা করেননি। বই বাজেয়াপ্ত করার আইন তাদের আছে। এই আইন তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছ থেকে। সেই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে এবং এ রকম বহু ত্যাগের বিনিময়ে ঔপনিবেশিকতা দূর করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আবার সেই স্বাধীনতাও যখন স্বৈরাচারিতার নিগড়ে বন্দী হয়ে গেছে, তখন তার হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্যও মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। এরপর স্বৈরাচারমুক্ত দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণসমর্থন নিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁদের হাতেও শাসনের হাতিয়ার রূপে সেই স্বৈরাচারীদের আইনগুলোরই ব্যবহার ঘটে। বলা উচিত, অপব্যবহার ঘটে। এখানেই দেশের জনগণের লজ্জা। অথচ, জনগণের মাথার ওপর শাসক হয়ে বসে আছেন যাঁরা, তাঁদের কোনও লজ্জা নেই। লজ্জা যদি থাকতো, তবে ঘৃণ্য উপনিবেশবাদী ও স্বৈরাচারীদের তৈরি আইনের প্রতি তাঁদের ঘৃণাও থাকতো। এবং থাকতো জনমতের প্রতি ভয়ও।’

লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়— এই মন্ত্রটি শাসকেরা ঠিক ঠিক রপ্ত করে নিয়েছেন। তাই ‘সেই মানবিক লজ্জা, পবিত্র ঘৃণা ও মহৎ ভয় অন্তরে জাগ্রত থাকলে ঔপনিবেশিক পূর্বসুরিদের অন্যায় আইন ব্যবহার করে কোনও লেখকের বই বাজেয়াপ্ত তো তাঁরা করতেনই না, বরং সে সব আইনেরই উচ্ছেদ ঘটিয়ে বিবেকী লেখকের লেখার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতেন কিন্তু তেমনটি করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ লজ্জার মানবিকতা, ঘৃণার পবিত্রতা ও ভয়ের মহত্ত্বকে ধারণ করার মত হৃদয় তাঁদের নেই। আমরা আগেই দেখেছি, লজ্জা ঘৃণা ও ভয়কে তাঁরা বহু পূর্বেই জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তাই, অপরের লজ্জাও তাঁরা সহ্য করতে পারেন না।

লজ্জা আমার লজ্জা নয়, এটি আসলে জাতির লজ্জারই ভাষারূপ। এত বড় একটি কথাও তিনি লিখেছেন। যতীন সরকার বিশ্বাস করেন না বাঙালি কোনওকালেই সাম্প্রদায়িক কোনও জাতি। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িকতাকে জাতীয়সত্তার অবিচ্ছেদউ অঙ্গে পরিণত করে নিয়েছে। কিন্তু সকল জাতির মধ্যে চাঁদের কলংকের মত কিছু কুলাঙ্গার থাকে, বাঙালি জাতির মধ্যেও এরা ছিল ও আছে। এই কুলাঙ্গাররা স্বাধীনতা সংগ্রামেও জাতির বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পরও এরা প্রতিনিয়ত জাতির মুখে কলঙ্ক লেপন করতে ব্যস্ত। এরা সংখ্যায় নগণ্য। এই সংখ্যালঘু দুর্জনদের ঘৃণ্য কার্যকলাপই সংখ্যাগুরু সজ্জনদের তথা সমগ্র জাতিকে কলঙ্কিত ও লজ্জিত করেছে।’

লজ্জা লিখে সেই কলঙ্ক ও লজ্জা মোচন আমি কতটুকু করতে পেরেছি! ভাবি। যে গল্প আমি লিখেছি, সে গল্প তো সকলেই জানে। এ তো নতুন কিছু নয়। অনেক বলা অনেক জানা কথাগুলোই আমি বলেছি। যে ভাবনাগুলো প্রতিদিন ভাবি, যে কথাগুলো আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে সকাল সন্ধে বলছি, যে প্রতিবাদগুলো ব্যক্ত করছি, যে ক্ষোভগুলো প্রকাশ করছি প্রতিদিন, যে প্রতিরোধের আগুনগুলো ঝরছে আমাদের হৃদয় থেকে, লজ্জাতে তার অতি সামান্যই প্রকাশ পেয়েছে। আমি জানি, আমার প্রগতিশীল বন্ধুরা জানেন, আমাদের সামনের পথটি কণ্টকাকীর্ণ, কিন্তু জানি আমরা থেমে থাকলে পথে আরও কাঁটা জমা হবে, পথ আরও বন্ধুর হবে। জানি ও পথে আমাদের যেতেই হবে, যে পথে সাহস নেই সবার যাবার। কারও সঙ্গে বা কিছুর সঙ্গে আমাদের আপোস করলে চলবে না। এখন স্পষ্টতই দুটি পক্ষ। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল, আরেকদিকে প্রগতিশীল। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সমাজকে পিছিয়ে দিতে চায় হাজার বছর। অন্ধতা কুসংষ্কার, হিংসা,বিদ্বেষ, ভয় ভীতি ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের মধ্যে। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত শক্তিশালি করতে সাহায্য করছে আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার। তাদের হাতে আছে অস্ত্র আর অর্থ। আমাদের শূন্য হাত। কিন্তু বিশ্বাসে পূর্ণ হৃদয়। সমতা আর সাম্যের বিশ্বাস।

এদিকে প্রতিদিনই মৌলবাদিদের পত্রিকায় আমাকে দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী বলে গাল দেওয়া হচ্ছে। মৌলবাদিরা গাল দেবেই জানি, কিন্তু মৌলবাদি নয় বলে যারা দাবি করে, প্রগতিশীল মুখোশ পড়ে আমাদের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে, তাদের কিছু কিছু মুখকে আমরা চিনতে পারছি, নতুন করে, আরও গভীর করে চিনছি। ফরহাদ মজহার আর আমহদ ছফা দিব্যি লজ্জাকে দোষ দিয়ে লিখেছেন, ‘লজ্জা দুইবাংলার মানুষদের মিলনের মধ্যে বাঁধা। খোঁচা দিয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার মত পরিবেশ সৃষ্টি করছে।’ আর ফরহাদ মজহার তো আরও কয়েককাঠি এগিয়ে গিয়ে বলে দিলেন, ‘কলমের এক খোঁচায় বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললাম, আর আজ আমরাই হিন্দু ভারত নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদি খতিয়ে দেখি তাহলে দেখবো বাবরি মসজিদ ভাঙার শর্ত তৈরি করে দেবার পেছনে অনেকাংশে আমরাই দায়ি।’ বিজেপি, ভারতের হিন্দুবাদী দল, তাঁর ধারণা ‘কিছ কিছু বাংলাদেশীদের দিয়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ার ফোলানো ফাঁপানো বিবরণ দিয়ে উপন্যাস কাহিনী গল্প গুজব রচনা করাচ্ছে।’ ঠিক এই দোষটিই আমাকে দিচ্ছে মৌলবাদিরা। বিজেপি নাকি আমাকে টাকা দিয়ে লিখিয়েছে লজ্জা। ফরহাদ মজহারের মত লোকের অভাব নেই দেশে, তাঁর আবার কিছু উচ্চশিক্ষিত ভক্তবৃন্দ বিরাজ করছে। মাশআল্লা। শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘মুখোশের আড়ালে আমরা সবাই নিজ সম্প্রদায়ভুক্ত স্বধর্মপ্রাণ। শিক্ষিত বাঙালি নিজেকে আধুনিক বলে দাবী করলেও তার জীবন ও ইতিহাসে এই স্বীকৃতির চিহ্ন দুর্লভ। বাঙালি আজও তার হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব অতিক্রম করে মনুষ্যত্বের পরিজ্ঞান অর্জন করেনি।’ কথাটি সফি আহমেদও মানেন। কী আশ্চর্য স্বীকারোক্তি সফি আহমেদের, তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার এই গলদ আমাদের প্রায় সবার। এই দগদগে ঘা কে ঢেকে রাখলেই অথবা নেই বললেই তাকে অনস্তিত্বে আনা যায় না। তাকে স্বীকার করার সৎ সাহস থাকা চাই। অসুখকে জেনে নিয়েই তবে চিকিৎসা। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আমাদের জন্ম। তারপর আজ ছেচল্লিশ বছর আমরা তারই ভেতর দিয়ে চলেছি, চেতনে অচেতনে তার ভেতরেই বহমান। শুধু ক্ষমতাশীল শোষকের শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই নয়, মুখোশের আড়ালে আমরা প্রায় সবাই একে পোষণ করি, লালন করি।’

এরপরই লজ্জা প্রসঙ্গে বললেন, ‘কখনও যদি একে ধরে টান দেয়, খুলে দেয়, কোনও অকুতোভয় প্রাণ যদি বন্ধ অর্গল মুক্ত করে তাকে স্বাগত জানাই। উন্মোচন করেই লুকোনো লজ্জাকে নির্ভার নির্মল করতে হবে। লজ্জা দাঙ্গা আনবে না, বরং লজ্জাই আমাদের মেলাবে।’

যখন সরকারের খড়গ আমার ওপর খাড়া, তখন আমার পক্ষে বা লজ্জার পক্ষে লেখালেখি করা খুব সহজ কথা নয়। তারপরও সাহস করে অনেকে লিখছেন, যাঁরা লিখছেন না, হয় তাদের আমাকে পছন্দ নয়, নয়ত আমার লেখা পছন্দ নয়, নয়ত লজ্জার বক্তব্য পছন্দ নয়। তা হতেই পারে। আমার নিজের কাছেই আমার অনেক লেখা পছন্দ হয় না। লজ্জার বক্তব্য পছন্দ হলেও লজ্জা লেখার ধরণ আমার নিজেরই পছন্দ নয়। ঠিক এই কাহিনী নিয়ে খুব হৃদয়স্পর্শী একটি উপন্যাস লেখার সুযোগ ছিল। চরিত্রগুলোকে আরও মানবিক করা যেত। উপন্যাসের কোনও গভীরতা, কোনও বিপুলতা এই বইটিতে নিয়ে সে আমি জানি। জানি বলেই বইটি নিয়ে কারও কারও অতীব প্রশংসা আমাকে যেমন লজ্জা দেয়, তেমনি প্রেরণাও দেয়। নিজের শক্তি আর সাহসকে হারিয়ে না ফেলে আরও ভাল কিছু লেখার প্রেরণা। যদি দম্ভ আমাকে বিবেকহীন বানাতো, যদি আত্মম্ভরিতা আমাকে অন্ধও করে দিত, তবুও আমার মনে হয় না আমি কখনও ভাবতে পারতাম যে আমার এই সামান্য বইটি একদিন সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে খোঁজ করবে কেউ বা এই বইটি মানরক্ষা করবে জাতির। আমার বিশ্বাস আমার সম্পর্কে বা আমার বইটি সম্পর্কে অনেকে বাড়িয়ে লিখছেন, সম্ভবত বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে অথবা আমার ওপর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আক্রমণ খুব তীব্র বলে। বশীর আল হেলালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তিনি দেশের একজন প্রথিতদশা সাহিত্যিক। তাঁর একটি লেখা আমাকে সত্যিই চমকে দেয়। ‘হিন্দু মুসলমানের, মুসলমান হিন্দুর কথা লিখবে, এই তো স্বাভাবিক। সরকার কি মনে করেছেন এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়? না, ক্ষতি হয় না, লাভ হয়। ভারতে মুসলিম নির্যাতন হলে তখন আমরা দেখাতে পারব, দেখ, আমাদের লেখক আমাদের হিন্দুদের নিয়ে এই উপন্যাসখানা লিখেছেন। এই তো গৌরব, এই তো মনুষ্যত্ব। শাক দিয়ে মাছ তো ঢাকা যায় না, কিছুতেই যায় না। সাহিত্যের ইতিহাস লেখার সময় এই রকম বইয়েরই তো খোঁজ পড়বে। তসলিমা নাসরিন এ উপন্যাসখানা লিখেছেন বলেই না সেদিন মানরক্ষা হবে। নিষেধের সব অন্ধকার ভেদ করে এই উপন্যাসখানাই সেদিন মুখ উজ্জ্বল করে বেরিয়ে আসবে। আমি বলব, তসলিমা নাসরিন অসাধারণ একখানা উপন্যাস লিখেছেন এই লজ্জা। এ রকম আর এ দেশে লেখা হয়নি। বড় তীব্র এই উপন্যাস। আঘাত করে, কঠিন আঘাত করে। তবে, সত্য যা তাই তিনি লিখেছেন। কারো পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু এ সত্য, নিষ্ঠুর সত্য। সত্যপ্রীতির জন্য এই লেখকের ভোগান্তি হবে বলেই মনে হয়।’

ওদিকে লজ্জা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। লজ্জার নকল বই বেরিয়ে গেছে। হাটে বাজারে ট্রেনে বাসে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। ওখানেও লেখালেখি হচ্ছে লজ্জা নিয়ে। মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর যে নির্যাতন চলে তার বর্ণনা দিয়ে প্রশ্ন করেছেন কেন ভারতবর্ষে লজ্জার মত বই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিয়ে রচিত হয়নি। তাই লজ্জা তসলিমার নয়, লজ্জা ভারতবাসীর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘তসলিমার লজ্জাকে কোনও অবস্থাতেই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবা ঠিক হবে না।’ পশ্চিবঙ্গের কমিউনিস্টরা ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর যেন কোনও বিপদ না হয়, সে ব্যপারে সতর্ক। মুসলমান-প্রেম তাদের যত না আছে, তার চেয়ে বেশি আছে মুসলমান- ভোটের মোহ। লজ্জা বইটিকে মিথ্যে বলেও যদি পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, আমি বরং খুশীই হব। কমিউনিস্টদের মন্তব্যে আমার মন খারাপ হয় না। আমার মন খারাপ হয় যখন তাঁরা বলেন যে আনন্দবাজার গোষ্ঠী নয়ত বিজেপি আমাকে দিয়ে মুসলমান বিরোধী বই লিখিয়েছে। বইটি আমি বুদ্ধদেব গুহকে উৎসর্গ করেছি, এ নিয়েও আমাকে নিন্দা করা হচ্ছে। বুদ্ধদেব গুহ নাকি বিজেপির লোক, বিজেপির মেনিফেস্টো তিনি লিখেছেন। বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে আমার আলাপ আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে। এমন প্রাণচঞ্চল পুরুষ, এমন রঙ্গপ্রিয় রসরাজ, এমন সপ্রতিভ সৌখিন মানুষ খুব চোখে পড়ে না। বুদ্ধদেব আমাকে, তিনি যেখানেই থাকুন, যে নগরে বা যে জঙ্গলেই, নিয়মিত চিঠি লেখেন। চিঠিতে তাঁর জঙ্গল ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কথা থাকে, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর মমতার কথা থাকে। তিনি বিজেপির সমর্থক নাকি সিপিবির, তিনি ধর্মের পুজারি নাকি অধর্মের, কিছুই আমার জানা নেই। তাঁর একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছেন। কোনও লেখক তাঁর কোনও বই আমাকে উৎসর্গ করলেই যে বিনিময়ে আমার বই তাঁকে উৎসর্গ করতে হবে, এরকম কোনও কথা নেই। বুদ্ধদেব গুহর আমি মুগ্ধ পাঠক বলে, তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি বলেই তাঁকে আমার একটি বই উৎসর্গ করেছি।

লজ্জার প্রকাশক এসে মুখ চুন করে বসে থাকেন। তাঁর ব্যবসা হচ্ছে না। সপ্তম মুদ্রণ চলছিল লজ্জার। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ষাট হাজারের মত বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তাতেও আলতাফ হোসেন ওরফে মিনুর দুঃখ যায় না। তিনি এখন এ বঙ্গেও বিক্রি করতে পারছেন না, ও বঙ্গেও রফতানি করতে পারছেন না। লজ্জার পাণ্ডুলিপি পেয়ে মিনুর মুখে হাসি ফোটেনি। মিনুর চুন মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি ফুটেছিল মেলায় বই বিক্রি দেখে। সেই আকর্ণ হাসিটি উবে গিয়ে মিনুর মুখটি যথারীতি চুনে ফিরে এসেছে। তিনি বলছেন, ‘বই ত ব্যাণ্ড হইয়া গেল। আমার তো ব্যবসা পাতি কিছুই হইল না। এখন নতুন একটা বই দেন।’

আমি তখন বই দেব কী করে। আমি লজ্জা লিখছি। নতুন করে লিখছি। ঘটনা একই। তথ্য একই। কেবল ভাষার ভুলগুলো সংশোধন করা, আর চরিত্রগুলোকে আরও চলাফেরা করানো, কথা বলানো। কোনও উপন্যাস লিখে আজ পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাইনি। লিখেছি, ছাপা হয়েছে। কিন্তু পাতা উল্টোলেই বানান ভুল, বাক্যের ভুল ভাষার ভুল, বর্ণনার ভুল সব দাঁতকপাটি মেলে ধরেছে। মন খারাপ হয়ে যায়। প্রকাশক যখন ছাপাখানা থেকে বাঁধাই হওয়া তাজা বই খুশিতে নাচতে নাচতে আমার কাছে নিয়ে আসেন, সেই নাচ থেমে যায় আমি দুইএটি পাতায় চোখ বুলোনোর পরই। কারণ আমার তখন চুক চুক লেগেই আছে জিভে। প্রকাশক বলেন, ‘কি কি ভুল আছে, তা সংশোধন করে দেন, নেক্সট এডিশনে ঠিক করে দেব।’

আলতাফ হোসেন মিনু তাঁর চুন-মুখ খানিক পর পর খুলছেন, ‘আজকে খবর পাইলাম নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে লজ্জা বিক্রি হইতাছে। শুধু নিউমার্কেটে না।

বিজ্ঞানমেলায়, রাস্তাঘাটে, নিউজপেপার স্টলে, এমন কী ফুলের দোকানেও। কভার ছাড়া আশি টাকা, কভার নিয়া একশ টাকা।’

‘চল্লিশ টাকার বই একশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে! তার মানে পাঠক ষাট টাকা বেশি দিয়া বই কিনছে? বই ব্যাণ্ড করে তো পাঠকের ক্ষতি হল, আর কিছু না।’ আমি বলি।

‘আপনে আছেন পাঠকের ক্ষতি নিয়া। আমার ক্ষতির কথা ভাবতাছেন না। কলকাতা থেইকা দশ হাজার কপির অর্ডার ছিল। পাঠাইতে পারলাম কই!’

‘এই যে বললেন বই বিক্রি হচ্ছে এইখানে। এরা বই পাইল কি কইরা? আপনে তো বিক্রি করছেন না।’

‘আমি বিক্রি করব? আমার দোকানে দিনে দুইবার কইরা পুলিশ আসতাছে। সব বই তো নিয়াই গেছে। গোডাউন থেইকা নিছে। বুক বাউণ্ডারের কাছে যা ছিল নিয়া গেছে। এখন ত পাইরেট হইয়া গেছে বই।’

‘কলকাতায় শুনলাম পাইরেট হয়েছে। এইখানেও নাকি? ব্যাণ্ড করে তাইলে সরকারের লাভ কি হইল?’

‘যেইদিন ব্যাণ্ড করল বই, তার দুইদিন পরেই পাইরেট কপি বাজারে আইসা গেছে। বাংলাবাজারেই কেউ কেউ পাইরেট ব্যবসা করে। তাদের মধ্যেই কেউ করল কি না! এখনও কিছু খবর পাই নাই।’

‘পুলিশ এখন কি বলে? সরকার তো বই ব্যাণ্ড করল। কিন্তু বই যে ঠিকই বিক্রি হচ্ছে তা এখন দেখে না কেন?’

‘ওরা তো বই সামনে রাইখা বিক্রি করতাছে না। লুকাইয়া রাখে। আস্তে কইরা কানের কাছে মুখ নিয়া চাইলে পরে দেয়। কাগজে মুড়াইয়া দেয়। আমার লোক গিয়া তিনটা পাইরেট কপি কিনে আনছে।’

‘কেউ কেউ বলছে লজ্জার প্রকাশক কেন ব্যানের বিরুদ্ধে মামলা করছে না!’

‘মামলা?’ মিনুর মুখখানা হঠাৎ ছোট হয়ে যায়। পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকান। বুঝি, এ মামলা করতে হলে বুকের পাটা যত বড় থাকতে হয়, তত বড় তাঁর নয়।

‘মামলা কইরা কি কোনও কাজ হইব?’ মিনু মিনমিন করেন।

‘হতেও পারে। আর যদি ব্যান না তোলে, তারপরও তো একটা জিনিস ভাল যে আমরা মেনে নেই নাই সরকারের এই আচরণ। কারণ এই আচরণ বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে, মানুষের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে।’

মিনু অনেকক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকেন। শব্দ করে চায়ে চুমুক দেন। পরে চা টাও রেখে দেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বলে। এরপর নরম সুরে বলেন, ‘নতুন একটা বই লেইখা দেন।’ ‘নতুন বই? এখন? এখন তো লজ্জার কারেকশন নিয়া ব্যস্ত। এইতো আর দুএকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’

‘কয়দিন আর লাগে একটা বই লিখতে! বইবেন, শেষ কইরা উঠবেন। হুমায়ুন আহমেদ কত বই এক রাত্রে লিখছে!’

‘মিনু ভাই, আমি হুমায়ুন আহমেদের মত লিখতে পারি না। এক রাতে আবার বই লেখা যায় নাকি। তাছাড়া লজ্জাটা সংশোধনের কাজ এই তো শেষ হয়ে যাবে। তারপর অন্য বইয়ের কথা ভাবব!’

‘এক বই কতবার লিখবেন! তার ওপর ব্যান্ড বই। লিখতাছেন যে, আমি ত আর ছাপতে পারব না। জানেন ত আমি বই আমদানি রফতানির ব্যবসা বাদ দিয়া প্রকাশনায় নামছি। আমারে ডুবাইয়েন না।’

না, তাঁকে ডোবানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। আমি কথা দিই নতুন বই লিখব। কেবল কি আলতাফ হোসেন ওরফে মিনু তাড়া দিচ্ছেন! এখন প্রকাশকের চেহারা দেখলে প্রমাদ গুনি। মইনুল আহসান সাবের, ভাল গল্পলেখক, তিনিও দিব্যপ্রকাশ নামে একটি প্রকাশনী দিয়েছেন। বাড়িতে এসেছেন কদিন বই চাইতে।

‘নাসরিন তুমি যদি আমাকে কয়েকদিনের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে না দাও, আমি মারা যাবো।’

এতজনকে কি করে রক্ষা করি। প্রকাশকদের ভিড় দিন দিন বাড়ছে। আমার তো কেবল লেখাই কাজ নয়। সকাল সন্ধে চাকরি। সংসারের সাত রকম ঝামেলা। সাত পত্রিকায় কলাম লেখা। সাপ্তাহিক বৈঠক। অবশ্য এটিকে সাপ্তাহিক বললে ভুল হবে। বৈঠকটি যে কোনও দিন যে কোনও সময় হতে পারে। আমাদের এই আড্ডায় নারী পুরুষ সকলেই আছেন, বয়সের তারতম্য কোনও ব্যপার নয়, সাহিত্যিক অসাহিত্যিক কোনও ঘটনা নয়, পেশা কোনও ঘটনা নয়, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত থাকতে পারে, সেও কোনও বিষয় নয়, কে কোন ধর্মের মানুষ সে তো কোনও বিষয়ই নয়, আসলে ধর্মে বিশ্বাসী কেউ আমাদের এই বৈঠক বা আড্ডায় নেই। একটি ব্যপারে আমাদের পরিষ্কার হতে হয় আমরা মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত কি না। আমাদের বিশ্বাস আছে কি না গণতন্ত্রে অথবা সমাজতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায় অথবা সেক্যুলারিজমে, ব্যক্তি স্বাধীনতায়, বাক স্বাধীনতায়, মুক্তচিন্তায়, মুক্ত প্রচারমাধ্যমে, সবার জন্য অন্ন বস্ত্র খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থের সুযোগ প্রদানে, সেক্যুলার শিক্ষা প্রসারে, নারী মুক্তিতে, নারী পুরুষের সমানাধিকারে, বৈষম্যহীন আইনে, দারিদ্র দূরীকরণে, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস দূরীকরণে, সবার জন্য নিরাপত্তা বিধানে, বাঙালিত্বে, বাঙালি সংস্কৃতিতে, সুষ্ঠু রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থ নৈতিক ব্যবস্থায়, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি কুসংস্কার আর মৌলবাদ নির্মূলে, সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদে। আমাদের আলোচনার বিষয় সবই, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম, কখনও কখনও শিল্প সাহিত্য। আমরা কোনও দিন ক্ষণ ঠিক করে রাখি না কখন বৈঠক হবে, আমরা কোনও বিষয় ঠিক করে রাখি না কোন বিষয়ে কথা হবে। যে কোনও বিষয়ে, যখন যার ইচ্ছে আলোচনার ডাক দিতে পারে। কোথায় বসবে এই বৈঠক, তাও নির্দিষ্ট করা নেই। যে কোথাও হতে পারে। আমার যেহেতু স্বামী সন্তানের ঝামেলা নেই, আমার বাড়িটিই একটি চমৎকার জায়গা। আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড উদ্দীপনা। আমাদের চোখে সুন্দরের স্বপ্ন। আমরা শঙ্কিত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ধীরে ধীরে শক্তিমান হতে থাকায়। আমরা জানি এই অপশক্তিটি আমাদের সর্বনাশ করতে এগিয়ে আসছে। আমরা জানি আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। পূরবী বসু আমেরিকার বড় পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রাণের টানে চলে এসেছেন নিজের দেশে। এখানে বেক্সিমকো কোম্পানিতে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। অবসরে গল্প লেখেন। আর এখন এই নৈরাজ্যের সময় গল্প লেখক, কী ঔপন্যাসিক কী কবি সকলেই যখন রাজনৈতিক কলাম লিখছেন, তিনিও লিখছেন। বাঙালি সত্ত্বাটি মানুষের যায় যায় করছে বলে তিনি বাঙালি নামে একটি প্রবন্ধের বই সম্পাদনা করলেন, সঙ্গে সাংবাদিক হারুন হাবীব ছিলেন। বাঙালি বেরোনোর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সফি আহমেদ কে নিয়ে এখনও গেল না আঁধার নামে একটি বিশাল বই সম্পাদনা করছেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেশে যে কটা দিন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলেছে, সে বিষয়ে পত্রিকার খবর আর নিবন্ধগুলোর একটি সংকলন। সফি আহমেদ ছায়ার মত থাকেন পূরবী বসুর সঙ্গে। অনেকটা জ্যাঁ পল সাষর্ন আর সিমোন দ্য বোভোয়ার কথা মনে হয় ওঁদের দেখলে। অসাধারণ দার্শনিক বন্ধুতা। ফরহাদ মজহার, যাঁকে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে ধরা হয়, তিনিই যখন হিন্দুদের ওপর মুসলমানের অত্যাচারকে অত্যাচার বলতে রাজি নন এবং দাবি করেন, এই বাংলার সংষ্কৃতি ইসলাম, এটিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে, তখন আমাদের পিলে চমকে ওঠে। মূর্খ দেখলে আমরা ততটা আতঙ্কগ্রস্ত হই না, ধূর্ত দেখলে যত হই। আমরা আরও বেশি তাগিদ অনুভব করি দলবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ করার, শক্তিগুলোকে একত্রিত করার। পূরবী বসু জরুরি তলব করলেন আমাকে। এসবের প্রতিবাদ করতে হবে, চল এক কাজ করি, আজ আমি লিখব, কাল হারুন লিখবে, পরশু তুমি লিখবে, তরশু সফি লিখবেন। আমরা তাই করি। বসে নেই আমরা কেউই, তারপরও মনে হয়, যথেষ্ট যেন কিছু হচ্ছে না। চোখের সামনে সকলেই দেখছে দেশটির গায়ে পচন ধরছে, দেখেও খুব বেশি কেউ পচন সারাবার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে না। আমরা আসলে সংখ্যায় কম। মুখ বুজে থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি।

লজ্জার সংশোধন শেষ হল খুব দ্রুত। কাজটি হল সম্পূর্ণ শুয়ে থেকে, বিছানায় নয়, মেঝেয় শুয়ে। মেরুদণ্ডে তীব্র ব্যথা হয়েছিল কদিন। হাড়ের ডাক্তার আমার মেরুদণ্ড পরীক্ষা করে পিঠের এক্সরে করিয়ে বলে দিলেন হাঁটাহাঁটি করা নিষেধ, পেচ্ছাব পায়খানায় যাওয়া নিষেধ, তিন মাস মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে, এমনকী ডানে বামে কাত হওয়া নিষেধ। এই হল চিকিৎসা। অসুখটি কি জানতে চাই। অসুখটি হল, আমার মেরুদণ্ড খুব সোজা। এটিই হল অসুখ। এ আমার জন্ম থেকেই। সোজা মেরুদণ্ড নিয়ে জন্মেছি। মেরুদণ্ড সোজা হওয়ার কারণে যখনই আমি উপুড় হই বা মেরুদণ্ড বাঁকা করি, তখনই চাপ লেগে হাড় বেরিয়ে আসতে চায় বাইরে, একটির তল থেকে আরেকটি। মেরুদণ্ডের হাড় কখনও কারও একটি সরল রেখায় থাকে না, পিঠের নিচদিকে ঢেউএর মত খেলে যায়। কিন্তু আমার মেরুদণ্ডে ঢেউ বলে কোনও ব্যপার নেই। সোজা মেরুদণ্ডের চিকিৎসা চলতে থাকে, চিকিৎসা করে এটিকে অন্য সবার মেরুদণ্ডের মত করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু বেরিয়ে আসতে থাকা হাড়টিকে ভেতরের সরলরেখায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য শুয়ে থাকা। তিন মাস এই চিকিৎসার পর যখন দাঁড়াবো, হাঁটবো, সারাজীবনের জন্য আমার উপুড় হওয়া চলবে না, হাতে ভারী কিছু বহন করা চলবে না, শুতে হলে শক্ত বিছানায় শুতে হবে। সোজা মেরুদণ্ডকে সোজাই রাখতে হবে। টানা তিনমাস শুয়ে থাকার চিকিৎসা মেনে চলা আমার দ্বারা সম্ভব যে হবে না, সে আমি ভাল করে জানি। তবু হাসপাতাল থেকে দু সপ্তাহের ছুটি নিয়ে শোবার ঘরের মেঝেয় শুয়ে থাকি। কমপিউটার মেঝেয় নামিয়ে, উপুড় হয়ে (লেখার অবসরে চিৎ) কীবোর্ড টিপেছি, মেরুদণ্ড বাঁকা হচ্ছে না এটি ছিল সান্ত্বনা। লেখা শেষ হলে কমপিউটার থেকে ছেপে নিলাম পুরো লজ্জা। আগের চেয়ে দ্বিগুণ। লিখে উঠে আমার এক বদঅভ্যেস, পুরো লেখাটা একবারও পড়ে দেখি না। পড়লে একশ একটা ভুল বেরোবে, বিশেষ করে বাক্য গঠনের ত্রুটি, বেরোলেই আবার নতুন করে পুরোটা লিখতে ইচ্ছে হবে। জীবনেও আর কোনও বই শেষ হবে না। লজ্জাকে একটু টেনে লম্বা করে আমার অন্তত একটি স্বস্তি হয়, যে, কিছু তথ্য বিস্তারিত বর্ণনা করা গেল। কিন্তু কলকাতায় পাণ্ডুলিপি পাঠাবো কী করে আমি! আমার বাড়ির সামনে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুতিনটে লোক দাঁড়িয়েই থাকে। পোস্টাপিসে গেলে পিছু নেবে এরা, নিষিদ্ধ জিনিস পাচার করার অপরাধে জেলে ভরে রাখবে। কলকাতায় কেউ কি নিয়ে যেতে পারে পাণ্ডুলিপিটি! আমার তো দেশ থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। কে যাচ্ছে কলকাতায়, কে যাবে খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে-ই যাচ্ছে লজ্জার পাণ্ডুলিপি নেওয়ার কোনও সাহস কারওরই নেই। এই দুঃসময়ে একজন আমাকে উদ্ধার করলেন, তার নাম মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামাল লোকটি সাদাসিধে। বিস্তর কথা বলেন। তাঁর ভাই ফেরদৌস ওয়াহিদ একজন নামকরা গায়ক। ভাই নাম করলেও মোস্তফা কামাল নাম করেননি কিছুতে। তাঁকে আমি প্রথম দেখি কলকাতায়। আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠানের পর খাওয়া দাওয়ার উৎসব হচ্ছিল কেনিলওয়ার্থ হোটেলে, সেখানে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম দেখা কোট টাই পরা কামাল আমার বাড়িতে টিশার্ট স্যাণ্ডেল পরে একদিন চলে এলেন। এসেই হৈ রৈ করে বলতে শুরু করলেন, ‘দেখতে আসলাম কেমন আছ (কোনও আপনি টাপনির বালাই নেই।) খবর কি, বল। আমি ত কলকাতা থেকে আসলাম পরশুদিন। জানো তো আমি কলকাতায় গেলে সুনীলের বাড়িতেই থাকি। সুনীল আর স্বাতী তো আমারে অন্য কোথাও থাকতেই দেয় না। সুনীল বলছিল তোমার কথা। তো আমি সুনীলকে বললাম, যাবো দেখি একবার তসলিমার বাসায়। নবনীতার সাথে তোমার আলাপ আছে? নবনীতা দেব সেন! চিনো তো নিশ্চয়ই। আমারে বলছিল তার বাড়িতে যেতে, কিন্তু আর হইল না। তা তোমার খবর কি বল। কবে যাচ্ছ কলকাতায়। ওইখানে তো তোমার নাম বললেই সবাই চেনে। বাদলের কাছ থেকে তোমার একটা বই নিয়া আসার কথা ভাবছিলাম। সময়ই পাই নাই।’ একাই দীর্ঘক্ষণ বকতে পারেন মোস্তফা কামাল। ‘সুনীল তো আমাকে নিয়া একটা বই লিখছে, বইটা পড়ছ? আমি যা যা বলছি সুনীল রেকর্ড কইরা নিছে। তার পর তো পুরা একটা বইই লিইখ্যা ফেলল।’ বকবক বকবক। ‘ফেরদৌসের সাথে ত আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ভাই হইলে কী হইব, আমি কেয়ার করি না।’ বকবক। হঠাৎ হঠাৎ মোস্তফা কামাল আমার বাড়িতে এরকম উদয় হয়ে যতক্ষণ থাকেন মাতিয়ে রাখেন বাড়ি। যেন আমার সঙ্গে তাঁর হাজার বছরের বন্ধুত্ব, যেন আমি তাঁর চারপাশের সবাইকে চিনি, এমন ভাবে বলতে থাকেন তাঁর আত্মীয়রা, পাড়া পড়শিরা, বন্ধুরা কে কী করল, কে কী বলল। নিজের পাঁকে পড়া, পাকে পড়া আর ডুবে যাওয়ার গল্পও অনায়াসে করতে পারেন। ‘ডোরারে বিয়া করলাম, কানাডায় নিয়া গেলাম, পরে ডোরা তো আমারে ছাইড়া চইলা গেল। আমি পোড়া কপাল নিয়া জন্মাইছি বুঝছ! যে ব্যবসাই ধরি, সব ব্যবসায় ফেল মারি। দেখি আরেকটার কথা চিন্তা ভাবনা করতাছি। মালোশিয়ায় চাকরানি সাপ্লাই দিব। এইটার ডিমাণ্ড আছে। .. আমার ত বাড়ি নাই গাড়ি নাই। টাকা পয়সা আজ আছে, কাল নাই। ..আমার ভাইগুলা সব ভাল অবস্থায় আছে, থাকুক। আসলে কি জানো, আমরে কেউ পছন্দ করে না, একটু পাগল পাগল আছি ত তাই।’ তিনি একদিকে গর্ব করছেন যে নামি দামি লোকের সঙ্গে তার খাতির আছে, আবার নিজে যে কিছুই না, নিজে যে একটি ঘোড়ার ডিম সেকথাও দ্বিধাহীন বলে যান। এই মোস্তফা কামালই আমার নিরূপায় অবস্থার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘পাণ্ডুলিপি দিতে চাও, ঠিক আছে আমি নিয়া যাবো।’

‘ঠিক তো!’

‘ঠিক।’

‘কোনও অসুবিধা হবে না তো!’

‘কেন, কী হবে, কে কি করবে?’

ডাক্তার রশীদ ছিলেন পাশে। বললেন এ বাড়িতে যারাই আসে, এ বাড়ি থেকে যারাই বেরোয়, সবার পেছনে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক ঘোরে। লজ্জার পাণ্ডুলিপি হাতে ধরা পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। লজ্জা তো শুধু বিক্রিই নিষিদ্ধ নয়, লজ্জার সংরক্ষণও এ দেশে নিষিদ্ধ। মোস্তফা কামালের মুখটি সাদা হয়ে যায় মুহূর্তে। তিনি পাণ্ডুলিপি কলকাতায় বাদল বসুর হাতে পৌঁছে দেবেন, এ কথা যখন বুক ফুলিয়ে বলেছেন, এটি তিনি ফেলে দেন না, তবে এ বাড়ি থেকে পাণ্ডুলিপি তিনি বেরোবেন না, তাঁকে কাল ভোর ছটায় বিমান বন্দরের রাস্তায় পাণ্ডুলিপি যেন দেওয়া হয়। কে এই দায়িত্ব নেবে! পাণ্ডুলিপি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোবে কে? ডাক্তার রশীদ বললেন, তিনি। কোন রাস্তা, কোন মোড়, কী পোশাক, কী থেকে নামা, ডানে না বামে, কালো ব্রিফকেস, কালো চশমা ইত্যাদি ব্যপার স্যপারগুলো দুজন বসে সেরে নেন। ফিসফিস। দেওয়ালেরও কান আছে। পাণ্ডুলিপি থেকে বইএর নাম লেখকের নাম সব বিদেয় করা হল। রাতের অন্ধকারে ধড়ফড় বুক কম্পমান পা ঘর্মাক্ত গা আর ধুসর পাণ্ডুলিপিখানি নিয়ে রশীদ বেরোলেন, আল্লাহ বিশ্বাস করলে আল্লাহর নাম জপতেন। রাতে ডাক্তার রশীদ পাণ্ডুলিপিখানি তাঁর বালিশের তলে রেখে নির্ঘুম রাত পার করে ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে গেছেন। মহাখালির সাত রাস্তার মোড় পার হয়ে যে বিন্দুতে তাঁর দাঁড়ানোর কথা ছিল সেই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, কোত্থেকে যাদুমন্ত্রে অনেকটা অন্য গ্রহ থেকে আসা কারও মত কালো চশমার আচম্বিতে উদয় হলে, তাঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতরের বাদামি প্যাকেটটি যেন এক ঠোঙা টোস্ট বিস্কুট নয়ত নতুন শুরু করা কোনও গার্মেন্টসের স্যাম্পল—চলে যায় কালো ব্রিফকেসে। নিঃশব্দে কাঁধে ঝোলা দক্ষিণে যান, কালো চশমা উত্তরে। দুজনের জন্যই অপেক্ষারত দ্রুত যানে অদৃশ্য হয়ে যান দুজন, কারও অনুসরণের শিকার হওয়ার আগেই।

লজ্জা চলে গেল সীমানা পেরিয়ে।

পশ্চিমবঙ্গে ছাপার উদ্দেশে আমি লজ্জা লিখিনি। লজ্জা বাংলাদেশের জন্য। লজ্জা নামে যে একটি বই লিখেছি তা আনন্দ পাবলিশার্সের গোচরে এসেছে ওখানে বাংলাদেশের লজ্জা সংস্করণটি নকল হওয়ার পর। শেষ অবদি পুলিশ লাগিয়ে আনন্দ পাবলিশার্সের কর্মকর্তারা কয়েকজন নকলবাজকে জেলে পুরেছেন। তাঁরা কতটা নীতির কারণে করেছেন, কতটা ব্যবসার কারণে তার খোঁজ নিইনি। মোস্তফা কামালের নিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিটি কলকাতায় পাঠানো লজ্জার প্রথম পাণ্ডুলিপি। লজ্জা ছাপা হচ্ছে কলকাতায়। নিষিদ্ধ ব্যপারটি বোধহয় সংক্রামক। খবর ছাপা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় লজ্জা বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওখানে বইটি নিষিদ্ধ করার কী কারণ থাকতে পারে তা আমি জানি না। লজ্জা সম্পর্কে আলোচনার কোনও শেষ নেই। আলোচনা চলছেই। আলোচনা রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে বাসে, ঘরে বারান্দায়, আপিসে আদালতে, দোকানে ময়দানে…।

আমার বাড়িতে শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ বেলাল চৌধুরীরা বসে যখন কথা বলছিলেন, কথা গড়াতে গড়াতে লজ্জার দিকে গেল।

‘বিজেপি নাকি লজ্জা ছেপেছে। অনুবাদও করেছে।’ বেলাল চৌধুরী বললেন ইনকিলাব পত্রিকাটি চোখের সামনে মেলে ধরে।

নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘বিজেপি ছেপেছে বা অনুবাদ করেছে বলে যে মোল্লাগুলো তসলিমার দোষ দিচ্ছে, এটা কি তসলিমার দোষ? আমার কবিতা যদি গোলাম আযমের খুব পছন্দ হয়, সে কি আমার দোষ?’

আমি বলি, ‘বিজেপি পুরো বই অনুবাদ করবে কি করে? বইয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে অনেক কথা লেখা আছে। জামাতে ইসলামি আর বিজেপিকে এক কাতারে ফেলা হয়েছে।’

শামসুর রাহমানের মতে লজ্জায় সব ঠিক আছে কেবল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দেশে যে আন্দোলন হয়েছে তার পুরো চিত্রটি নেই, এ দেশে যে অসাম্প্রদায়িক মানুষ আছেন, তা লজ্জা পড়ে বোঝা যায় না। আমি শামসুর রাহমানের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বলেছি যে আমি একজন ক্ষুব্ধ হিন্দু যুবকের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বর্ণনা করতে চেয়েছি, তার চোখে তখন অসাম্প্রদায়িক কোনও কিছু পড়ছে না।

শামসুর রাহমান বিজেপির প্রসঙ্গে বললেন, ‘একটি অসাম্প্রদায়িক বইকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা হচ্ছে কি রকম দেখ! কলকাতায় দেবেশ রায় ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের পক্ষে উপন্যাস লিখেছেন, সেটি কি এদেশের মুসলমানদের চোখে পড়ে না!’

নির্মলেন্দু গুণ জোরে হেসে উঠে বললেন, ‘মোল্লারা প্রচার করছে, লজ্জা লেখার জন্য তসলিমাকে নাকি পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা দিয়েছে বিজেপি। তা কই? আমাদেরও কিছু ভাগ দাও তসলিমা। একা একা সব টাকা খাবে নাকি!’

আমি হেসে বলি, ‘ইনকিলাবে লেখা হচ্ছে এই টাকার কথা। এখন সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে যে সত্যি সত্যিই আমাকে বিজেপি টাকা দিয়েছে।’

শামসুর রাহমান বললেন, ‘টাকা দিয়েছে, বলেই খালাশ! প্রমাণ করছে না কেন? নির্বাচনের আগে বিএনপি বলেছিল হাসিনাকে নাকি ভারত পাঁচশ কোটি টাকা দিয়েছে। আওয়ামী লীগও বলেছিল খালেদাকে পাকিস্তান থেকে ছশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টাকা নেওয়ার প্রমাণ কেউ কিন্তু এখনও হাজির করতে পারেনি।’

আমি বলি, ‘একই রকম লজ্জা লেখার জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে বলে যারা প্রচার করছে, তারা প্রমাণ করতে পারবে না এর সামান্য সত্যতা। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা অপপ্রচার করছে কেন? তারা কি তবে কংগ্রেসের টাকা খেয়েছে? নাকি সিপিএমএর?’

বেলাল চৌধুরী ইনকিলাব পত্রিকাটি ধুত্তুরি বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘লজ্জা লিখে হিন্দুদের যতটা উপকার করেছে তসলিমা, তার চেয়ে বেশি করেছে মুসলমানের উপকার। মুসলমান কত মানবিক হতে পারে তার একটি উদাহরণ লজ্জা। মেজরিটি কমিউনিটি থেকে মাইনরিটির পক্ষে কথা বলা, তাও আবার এমন জোরে সোরে, সে খুব একটা দেখা যায় না। মুসলমানরা এটি সময় সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে পারে, বলবে, দেখ দেখ, মুসলমান কত উদার হতে পারে।’

আমি হেসে উঠি, ‘বেলাল ভাই, নাস্তিক মানুষটিকে খুব যে মুসলমান বানিয়ে ফেলছেন।’

‘নাস্তিক তো আমরা সবাই। কিন্তু যেহেতু মুসলমান নাম ধারণ করছ, তাই মুসলমানের গোত্রেই তোমাকে ফেলবে। এখানে নাস্তিক বলে কাউকে তো ধরা হয় না। হয় তুমি মুসলমান, হয় তুমি হিন্দু। নয় বৌদ্ধ, নয় খ্রিস্টান। যেন ধর্ম থাকতেই হবে।’

‘অশিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্ম আর শিক্ষিত মানুষের ধর্ম হচ্ছে সংষ্কৃতি। কি বলেন রাহমান ভাই! ঠিক না!’ তাকাই শামসুর রাহমানের দিকে।

শামসুর রাহমান বললেন, ‘শিক্ষিত কারা? গোলাম আযমও তো শিক্ষিত, ফরহাদ মজহারও শিক্ষিত। দুজনেরই ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে।’

‘না, না, একাডেমিক শিক্ষার কথা বলছি না। কোনও দিন ইশকুল কলেজে যায়নি, এমন মানুষও তো শিক্ষিত হতে পারে। আরজ আলী মাতব্বুরের কথাই ধরুন না।’

বেলাল চৌধুরী উত্তেজিত আরজ আলীর প্রসঙ্গে। ‘আরজ আলী গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক। অথচ কী আশ্চর্য সুন্দর বই লিখেছেন তিনি। তাঁর বই ইশকুলের পাঠ্য হওয়া উচিত।’

শামসুর রাহমান সায় দিলেন, আরও খানিকটা যোগ করে, ‘কেবল ইশকুলেই নয়, কলেজ ইউনিভার্সিটির সিলেবাসেও থাকা উচিত। এ বই পড়লে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে। অনেককেই নাস্তিক হওয়ার প্রেরণা পাবে।’

ট্রেতে চা দিয়ে যায় কুলসুম। সকলের হাতে চায়ের কাপ। এর মধ্যে নিঃশব্দে ডাক্তার রশীদ এসে আসন গ্রহণ করেন। ডাক্তার রশীদ এককালে জাসদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, এখন অক্রিয়। সাম্প্রদায়িকতা ধর্মান্ধতা কুসংস্কার এসবের প্রচণ্ড বিরোধী। চিন্তা ভাবনা তুখোড়। চায়ে চুমুক দিয়ে একটি প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দেয়, মুসলমানরা যদি সব নাস্তিক হয়ে যায়, তবে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! আমার মন বলে, হবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস গোলাম আযম একজন নাস্তিক। জামাতের সবগুলো নেতাকেই আমার নাস্তিক মনে হয়, আস্তিক হল তারা যারা গোলাম আযমের অনুসারী, বোকা, বুদ্ধু। যাদের নাকে ধর্মের রশি লাগিয়ে গোলাম আযম রাজনীতির খেলা দেখাচ্ছেন। আমি চা রেখে শামসুর রাহমানকে বলি, ‘আমার কিন্তু মনে হয় গোলাম আযম একজন নাস্তিক। এরশাদের কথাই ধরেন, এরশাদ কি ধর্ম মানত নাকি? এই যে হুট করে সংবিধান পাল্টো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে দিল, এটা কি ইসলামের প্রতি ভালবাসায় করেছে? মোটেই তো তা নয়। ক্ষমতার লোভে ধর্মকে ব্যবহার করেছে।’

‘হ্যাঁ পলিটিক্যাল ইসলাম তো এরকমই। আমারও বিশ্বাস ধর্মকে যারা রাজনীতিতে ব্যবহার করে, তারা খুব ভাল করেই জানে ধর্ম হচ্ছে মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখার আর মুর্খ বানিয়ে রাখার অস্ত্র। অস্ত্রটি যারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে, তারা আসলে আদৌ ধর্মে বিশ্বাস করে কি না সন্দেহ আছে।’

‘ধরেন যদি করেই বিশ্বাস, তারপরও কিন্তু তারা ইসলামের আদর্শই মানছে। কারণ ইসলামে আছে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, একটি হচ্ছে দারুল ইসলাম আরেকটি দারুল হারব। দারুল হারব মানে বিধর্মীদের অঞ্চল, দারুল ইসলাম মানে ইসলামের অঞ্চল। মুসলমানের কাজ হল দারুল হারবের বাড়িঘর ভেঙে চুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অমুসলমানদের যেমন করে সম্ভব মুসলমান বানিয়ে, অথবা সম্ভব না হলে ওদের খুন করে দারুল হারবকে দারুল ইসলাম বানানো। তার মানে টার্ণেট হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে দারুল ইসলাম বানানো। তাহলে বাংলাদেশে মুসলমানরা যা করছে, এ তো কোনও ইসলামনীতিবিরুদ্ধ কাজ নয়। ইসলাম তো এ কাজটি সমর্থনই করে।’

‘এ তো কেবল ইসলামের নীতি নয়। খ্রিস্টানদেরও তো ও একই নীতি ছিল, তা না হলে ওই ধর্ম কোথায় শুরু হয়েছিল, আর কতদূর বিস্তৃত হয়েছে, দেখ।’

‘তা ঠিক। একেশ্বরবাদগুলোর অতীত ইতিহাস বড় জঘন্য। কিন্তু রাহমান ভাই, এখনও কেন? এই বিংশ শতাব্দির শেষে এসে এখনও কেন দেখতে হচ্ছে মধ্য যুগের সেই নির্মমতা!’

‘মানুষ এখনো মানুষ হয়নি বলে!’

‘কিন্তু ক্রিশ্চানদের মধ্যে তো বিধর্মীকে মেরে ফেলো, এই ব্যপারগুলো আর নেই। মুসলমানদের মধ্যে রয়ে গেছে কেন!’

‘কারণ মুসলমান রাষ্ট্রগুলো সেভাবে সেকুলার হয়নি, যেভাবে ক্রিশ্চানদের দেশগুলো হয়েছে।’

‘কিন্তু মুভমেন্ট তো ছিল। প্যান আরব মুভমেন্টএর কথাই ধরেন। এ তো সেকুলার দলের আন্দোলন। এর মধ্যে প্রায় সবাই তো আরবদেশগুলোর মুসলমান।’

‘আরব দেশের সেকুলার মুভমেন্ট নষ্ট হওয়ার পেছনে কিছু কিছু বদ আরব নেতার অবদান আছে, অবশ্য তারাও ঔপনিবেশিক শক্তির চক্রান্তের শিকার। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বড় কোনও মুভমেন্ট তাদের কলোনিগুলোতে বরদাস্ত করেনি, বিশেষ করে যে মুভমেন্ট ওই শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।’

‘কিন্তু রাহমান ভাই, প্যান আরব মুভমেন্ট তো কলোনিয়লিস্টরা চলে যাওয়ার পর হয়েছে।’

ডাক্তার রশীদ বললেন, ‘ইমপেরিয়ালিস্টরা আর কতদূর গেছে! তেলের লোভে যে করেই হোক থেকে গেছে মিডল ইস্টে। তেল কারা কন্ট্রোল করেছে? সে তো ব্রিটিশই। পরে আমেরিকা ব্রিটিশের ভূমিকা নিল। প্যান ন্যাশনালিজমের নেতারা তেলের ইন্ডাস্ট্রি ন্যাশনালাইজ করার জন্য কম আন্দোলন করেছে!..’

‘ইসলামিক ব্রাদার হুড এই জাতীয় মৌলবাদী আন্দোলনও তো গড়ে উঠল ইমপেরিয়ালিস্টদের বিরুদ্ধে। এদেরও একটা ভুমিকা আছে সেকুলার আন্দোলন নষ্ট করার।’ আমি বলি।

‘আরব নেতাগুলোর পরষ্পরের প্রতি বিরোধ থাকার কারণেই তারা এক হতে পারেনি। মিশরের নাসের চেয়েছিল সব আরবদেশগুলোকে এক করে ফেলতে। কিন্তু অন্য ন্যাশনালিস্টরা আবার তা চায়নি। আজ আরব দেশগুলোর মধ্যে যদি ইউনিটি থাকত, তবে কোনও আমেরিকান বা ব্রিটিশের ক্ষমতা থাকত না ওখানে কোনও পাপেট বসিয়ে কলকাঠি নাড়ার।’ ডাক্তার রশীদ মন্তব্য করেন। তিনি উত্তেজিত। ঢক ঢক করে ঠাণ্ডা চা গিললেন।

‘এখন যে ইসলামি মৌলবাদ বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে, এর কারণ কি আরব মুল্লুকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইজরাইলি সন্ত্রাস? নাকি বার্লিন ওয়াল? বার্লিন ওয়াল ভেঙে গেছে, ধর্মহীন সোভিয়েতের পতন হয়েছে, এর মানে ধর্মহীনতার পতন হয়েছে। সুতরাং হে ধর্ম জেগে ওঠো। ওহে ইসলাম ..।’

বেলাল চৌধুরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইণ্ডিয়ান সাবকণ্টিনেণ্টের ইতিহাস আলাদা, এখানে মৌলবাদ শক্তিশালী হওয়ার পেছনে সরকারি মদদটাই বেশি।’

‘তা তো অবশ্যই। কিন্তু মৌলবাদ সংক্রামকও বটে। এক জায়গায় বাড়লে আরেক জায়গায় বাড়ে। …’

শামসুর রাহমান রাগী মুখে বললেন, ‘বাংলাদেশের হারামজাদা জামাতিগুলো পাকিস্তানের দিকে মুখ করে.. .’

হঠাৎ দরজায় শব্দ হয়। শামসুর রাহমান তাঁর অসম্পূর্ণ বাক্যটি শেষ না করেই দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ডাক্তার রশীদ উঠে গেলেন দরজায়। আমাদের চোখ নাক কান দরজায়। কোনও অচেনা আগন্তুকের এ বাড়িতে ঢোকা উচিত নয়, এ কথা সকলে জানেন। প্রতি শুক্রবারে মসজিদের খুতবায় আমার বিরুদ্ধে গালিগালাজ চলছে। তসলিমার ফাঁসি চাই বলে মিছিল বেরোচ্ছে। এ সময়, যে কোনও ধর্মপ্রাণ মুসলমান আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকে নির্মম কোনও আশীর্বাদ করতে পারেন। সে রকম কেউ দরজায় কি? তা না হলে রশীদ কেন ঢুকতে দিচ্ছেন না আগন্তুককে! দরজা আগলে দাঁড়িয়ে তিনি কথা বলছেন আগন্তুকের সঙ্গে। কিছুক্ষণ কথা বলে দরজা খোলা রেখেই রশীদ দু পা এগিয়ে এলেন আমার দিকে, বললেন, ‘শনির আখড়া থেকে চারটে ছেলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।’

‘কি নাম? কেন এসেছে?’

‘তুমি চিনবে না, একজনের নাম শংকর রায়।’

গুণ বলে উঠলেন, ‘ঢুকতে দেবেন না। দরজা বন্ধ করে দেন। কে না কে হিন্দু নাম নিয়ে এখানে অন্য মতলবে এসেছে হয়ত।’ বলে আবার হেসে উঠলেন বলতে বলতে, ‘হিন্দুদেরই বা বিশ্বাস কি?’

রশীদ এবারও দু পা ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে মৃদু কণ্ঠে কী কথা বলে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘শোনো, এরা খুব সাধারণ মানুষ। একবার তোমাকে প্রণাম করতে এসেছে। করেই চলে যাবে।’

আমি প্রণামের লোভে নয়, কেন এসেছে, কে তারা, এই উৎসাহেই, অথবা এতগুলো মানুষ এখানে বসে আছে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এরা ঠেকাবেন এই সাহসেই বললাম, ‘ঠিক আছে, আসতে বলেন।’

চার যুবক ঢুকল ঘরে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। সাদাসিধে কাপড় পরনে, স্যাণ্ডেল পায়ে। দরজার কাছে স্যাণ্ডেলগুলো খুলে চারদিক একবার দেখে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে হাত বাড়ালো আমার পায়ের দিকে। আমি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কোনও প্রশ্ন করার আগেই শংকর নামের ছেলেটি করজোড়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদি, আপনি আমাদের দেবী। আপনাকে দেখতে পেয়ে জীবন আমাদের সার্থক হল। অনেক কষ্ট করে আপনাকে খুঁজে পেয়েছি, দিদি। আপনাকে একবার প্রণাম করতে দেন।’ পা ছুঁতে গেলে আবার আমি সরিয়ে নিই পা। শংকর তিনজনের মধ্যে দুজনকে দেখিয়ে বলে, ‘এরা দুজন আমার কাজিন,’ বাকি লাল শার্ট পরা একজনকে দেখিয়ে, ঞ্চআর এ হল আমার বন্ধু। আমরা কলেজে পড়ি দিদি।’

আবারও মাথা আমার আমার পায়ের দিকে নাবাতেই বলি, ‘না না প্রণাম করতে হবে না। আমি এসব পছন্দ করি না। কিছু বলার থাকলে বলেন।’

‘দিদি, আপনার লজ্জা বইটা আমরা পড়েছি দিদি। আমাদের কথা আগে কেউ এমন করে বলে নাই দিদি। দিদি আপনি যা করেছেন, তা যে কত বড়.. আমাদের মনের কথাটা আপনি লিখেছেন।’

‘শোনেন, হিন্দু মুসলমান এখানে বড় ব্যপার না। আমি মানষ হয়ে মানুষের কষ্টের কথা বলেছি। এই যে এখানে দেখছেন যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা সবাই লেখেন, সবাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।’

‘দিদি আমার কাজিনদের বাড়ি ভেঙে ফেলেছে জামাতিরা। আর আমার এই বন্ধু, সমীরণ, সমীরণের এক ভাইকে খুন করেছে ওরা।’

বলতে বলতে চার যুবক আমি বাধা দেওয়ার পরও আমার পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মহা সমস্যায় পড়ি। না পারছি ওদের টেনে তুলতে, না পারছি পা সরাতে। এক শরীর অস্বস্তি নিয়ে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি।

কেঁদে, চোখ মুছে, শংকর তার ভাই বন্ধু সহ বিদায় হল।

ওরা চলে গেলে নির্মলেন্দু গুণ খুব ধীরে খুব গাঢ় স্বরে বললেন, ‘লজ্জা লিখে আসলে তসলিমা বাংলাদেশের হিন্দুদের অপকার করেছে, উপকার নয়।’

‘মানে?’ আমার বিস্মিত চোখ গুণের নির্বিকার মুখে।

আর সকলের চোখেও দেখি একই রকম বিস্ময়।

‘অপকারটা কিরকম শুনি!’ আমি উদগ্রীব শুনতে।

গুণ খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘হিন্দুদের মনে যে তীব্র আগুন জ্বলছিল, সেটিকে তসলিমা নিভিয়ে দিয়েছে। যে ক্ষোভ তাদের জমা ছিল বুকে, যে ক্ষোভের কারণে তারা ভয়ংকর কিছু করতে পারত, সেটিকে কমিয়ে দিয়েছে। তারা এখন ভাবতে পারছে তাদের পক্ষ হয়ে লড়বার মানুষ আছে, তারা একা নয়। দুর্বলের পাশে সবলের পক্ষ থেকে কেউ দাঁড়ালে দুর্বল কিন্তু দমে আসে। তারা যে আগুন লাগাতে চায়, সে আগুন তারা আর লাগায় না।’

আমরা আমাদের শূন্য চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে থাকি। অনেকক্ষণ একটি বিষণ্ন নিস্তব্ধতা আমাদের দখল করে রাখে।

শান্তিবাগের বাড়িতে এরপর খুব বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় না। কারণ বাড়িঅলা আমার দিকে অন্যরকম চোখে তাকাতে শুরু করেছেন। পাঁচবেলা নামাজ পড়া লোক বাড়িঅলা, বাড়িতে ইনকিলাব পত্রিকা রাখেন। জুম্মাহর নামাজ পড়তে মসজিদে যান, যে মসজিদে নামাজের পর ইমাম খুৎবা পড়েন, খুৎবা না তো, মিলন বলেন, আপনের গিবৎ পড়ে। মিলনও মাঝে মাঝে শুক্রবারে শান্তিবাগের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আসে আর শুনে আসে ইমামের গালি। ‘তসলিমা নামে এক কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েছে এদেশে, ভাইয়েরা আমার, এই তসলিমা ইসলামবিদ্বেষী, মুসলমান হয়ে মুসলমানের সর্বনাশ করছে। হিন্দুদের ঘুষ খেয়ে এই পাপীনি একটা বই লিখেছে। বই টা আপনারা যদি না পড়ে থাকেন, ভাল কাজ করেছেন, সওয়াবের কাজ করেছেন। ওই বইএ লিখেছে মুসলমান জাতি নাকি জঘন্য জাতি। মুসলমান নাকি হিন্দুদের খুন করে রাস্তা ঘাট ভাসিয়ে দিয়েছে রক্তের বন্যায়। এই মহিলা নারীজাতির লজ্জা। নারীজাতিকে প্ররোচনা দিচ্ছে পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেলা করতে। স্বামীদেরে ত্যাগ করতে। এই মহিলা ধর্ম বিশ্বাস করে না। বলে আল্লাহ বলতে কিছু নাই। বলে, মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইসসালাম, আল্লাহর পেয়ারা নবী, তিনি নাকি কামুক, তিনি নাকি বদমাইশ লোক। তওবা তওবা। ভাইয়েরা আমার, সরকারের কাছে দাবি করেন, এই কুলাঙ্গার পাপীনির যেন একটা বই না, যতগুলা বই সে লিখেছে, সব যেন আগুনে পোড়ায়, সব যেন নিষিদ্ধ করে। তার ফাঁসির দাবি করেন। এই পাপীনির ফাঁসি হলে এই দেশ বাঁচবে, ইসলাম বাঁচবে।’

আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে মোনাজাত হয়, মোনাজাতে তসলিমার ফাঁসি দিয়ে দেশ ও মুসলমান জাতিকে রক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয়। কোনও কোনওদিন লিফলেট বিলি হয় এসব কথার। এ সবও শোনেন বাড়িঅলা। রাস্তায় মিছিল বেরোয় তার ভাড়াটের ফাঁসির দাবিতে, তাও তিনি দেখেন, না দেখলেও পত্রিকায় পড়েন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে আমি নিজেই দুদিন পড়েছি মিছিলের সামনে। একদিন পাশ কাটিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গেছি। আরেকদিন সে সুযোগ পাইনি। রিক্সা থেমে আছে, রাস্তায় বিশাল মিছিল যাচ্ছে। আমার রিক্সার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে টুপিঅলারা চিৎকার করতে করতে তসলিমার ফাঁসি চাই, দিতে হবে। আমার ওড়না নেই যে ওড়নায় মুখ লুকোনো। জামা পাজামার ওপর এপ্রোন পরা। আমি প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকি রিক্সায়। যেন ধুলো এড়াতে নাক মুখ ঢাকছি, এভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রাখি মুখের অর্ধাংশ, চোখ নামিয়ে রাখি রিক্সার পাদানিতে। যেন লজ্জাশীলা মেয়েমানুষ আমি পর পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকাই না। মিছিলের কেউ একজন যদি আমাকে চিনে ফেলে, সে যদি চেঁচিয়ে তার সগোত্রীয়দের জানিয়ে দেয় যে আমাকে হাতে নাতে পাওয়া গেছে, তখন আমার ছিন্নভিন্ন অস্থি মজ্জা মাংস এই রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে, সে ব্যপারে আমার কোনও সন্দেহ থাকে না। মিছিল শেষ হলে রিক্সাঅলা যখন চালাতে শুরু করে, খানিকটা পথ গেলে আমি জিজ্ঞেস করি, কিসের মিছিল গেল?

তসলিমার মিছিল।

তসলিমার মিছিল মানে?

তসলিমার ফাঁসি চাইতাছে লোকেরা।

কেন ফাঁসি চায়? তসলিমা কি করছে?

তসলিমা মসজিদ ভাইঙ্গা দিছে।

কোন মসজিদ, জানেন?

বাবরি মসজিদ।

একটা মেয়েমানুষ কি কইরা একটা মসজিদ ভাঙল?

তা জানিনা কি কইরা ভাঙছে।

কোথায় শুনলেন এই সব।

আমরা শুনি। দেলোয়ার হোসেন সাইদির ক্যাসেট বাজে রাস্তাঘাটে। মিছিল দেখছি।

আপনিও চান তসলিমার ফাঁসি।

হ। চামু না কেন? সবাই যখন চায়, আমিও চাই।

শান্তিবাগে বাড়ির গেটের কাছে থেমে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে দিই। ভাল যে গেটে ঝোলানো সাইনবোর্ডটি আগেই তুলে নিয়েছি।

যেদিন মিছিলের সামনে পড়ি, সেদিনই ছোটদা আসেন তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার খুব ভাল লাগে ছোটদাকে দেখে। ছোটদা সাধারণত আমার বাড়িতে আসেন না। তাঁর বাড়িতে গীতার দুর্ব্যবহার সইতে আর সুহৃদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না বলে যাই না। ছোটদা যে বন্ধুটি নিয়ে আমার বাড়িতে আসেন, তাঁর নাম শফিক। তিনি ছোটদার সঙ্গেই বিমানে চাকরি করেন। তিনি একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। অনুরোধটি হল বিমানবালাদের যে পঁয়ত্রিশ বছর পর চাকরি থেকে বিদায় দিয়ে দেওয়া হয়, তারা যে গর্ভবতী হওয়ার পর ন মাস ছুটি পাওয়ার কথা, তা পায় না, এবং কোনও কোনও পেনশন থেকেও বঞ্চিত হয় সে বিষয়ে আমি যেন কিছু লিখি। কথায় কথায় যখন ছোটদা জানালেন যে শফিক গাড়ির ব্যবসা করে, জাপান থেকে ব্যবহৃত গাড়ি এনে এখানে বিক্রি করে, আমি বললাম, আমি কিনব গাড়ি। আজই। তুই চাইলে তো তরে শফিক অনেক কম টাকায় দিতে পারব। তবে আগে কিছু টাকা দিতে হইব। ঠিক হল, আজই আমি কিছু আগাম টাকা দিয়ে দেব, গাড়ি এসে যাবে দু সপ্তাহের মধ্যে। গুণে গুণে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিই। বাকি তিন লক্ষ টাকা দেব গাড়ি পাওয়ার পর। টাকাটা কাকলী পাবলিশার্সের মালিক সেলিম আগের দিন দিয়ে গেছেন বইয়ের অগ্রিম, যে বই এখনও লেখা হয়নি, এখনও ভাবা হয়নি, সে বইয়ের অগ্রিম। সেটাকা নিয়ে শফিক চলে গেলেন। গাড়ি ছাড়া আমার চলাফেরা যে নিরাপদ নয়, সে আমি নিশ্চিত। তাই এই ব্যবস্থা। বিমানবালাদের নিয়ে আমার লেখা ঠিকই হয়, যায় যায় দিন পত্রিকায় তা ছাপাও হয়। কিন্তুৃ সেই গাড়িটি আমার কখনও পাওয়া হয় না এবং সেই টাকাটিও আমাকে আর ফেরত দেওয়া হয় না। বাড়ি থেকে বেরোনোই মানে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বেরোনো। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে তো আমার চলবে না। আমাকে বেরোতেই হবে। বাড়ির বাইরে যেমন অসন্তোষ বাড়ছে, বাড়ির ভেতরেও তেমন। বাড়িঅলা যে আমাকে তাড়ানোর জন্য মনস্থির করে ফেলেছেন তা আমি টের পাই। বাড়িঅলা এবং তাঁর স্ত্রীর ভ্রূকুঞ্চন, তাঁদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, আমাকে দেখেও না দেখে চলে যাওয়া আমাকে বুঝিয়ে দেয় তাঁরা আমার সঙ্গে আর খাতির জমাতে চাইছেন না। বুঝি তাঁরা আশঙ্কা করছেন যে কোনও একটি মিছিল যে কোনও একদিন এ বাড়ির দিকেই আসবে এবং বাড়িটির ওপর পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে মিছিলের লোকেরা। এই ঝুঁকিটি যে বাড়িঅলা নিতে চান না, তা আমি অনুভব করি সকাল বিকাল। দুশ্চিন্তায় ছটফট করি। বাড়িঅলা আজ আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি যাবো কোথায়! কোনও আশ্রয় নেই আমার। কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই। নিশ্চয়তা নেই। আমাকে কোনও বাড়িঅলাই বাড়িভাড়া দেবে না। আমার এই নামটি এখন ভয়ংকর একটি নাম। ভদ্রলোকেরা নাম শুনে আঁতকে ওঠেন। ইশকুল কলেজের যে মেয়েরা ছেলেদের ধমক দিয়ে কথা বলে, মাথা উঁচু করে গট গট করে হাঁটে, বেহায়া বেপরোয়া, তাদের তসলিমা বলে ডেকে টিটকিরি দেওয়া হয়। আমি বুঝে ওঠার আগেই তসলিমা নামটি সাধারণের সমাজে একটি পাপের কলঙ্কের ব্যাভিচারের স্বেচ্ছাচারিতার অনৈতিকতার বিপথগামিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। শান্তিবাগের রাস্তা ছেড়ে মালিবাগ পাড় হয়ে শান্তিনগরের মোড়ে যে দশ তলা দালান উঠছে ইস্টার্ন হাউজিংএর, সেদিকে যেদিন চোখ পড়ে, সেদিনই বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং এসটেটের মতিঝিল আপিসে গিয়ে বাড়ি না দেখে, কারও সঙ্গে না বুঝে, কত দাম এত দাম, কোনটা তৈরি আছে, ন তলা, এক নম্বর বিল্ডিং, কত দিতে হবে এখন, এত দিতে হবে, এই নিন চেক, এই নিন বাড়ির দলিল করে একটি বাড়ি কিনে ফেলি। ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ধার নিতে হল, সে ব্যবস্থা ওরাই করে দিল, বাকি কিছু টাকা শোধ করতে হবে কিস্তিতে। বাড়ি কিনলে বাড়ির মালিকরা জিজ্ঞেস করে না আমি কাকে নিয়ে থাকব, আমার স্বামী আছে কি না। জানতে চায় না আমি করি কি, খবর নেয় না আমার নামে মিছিল বেরোচ্ছে কি না। ওরা কেবল দেখতে চায় আমার টাকা আছে কি না বাড়ি কেনার, টাকা থাকলে আমার স্বামীহীন জীবন, আমার লেখালেখি, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা গিবৎ, আমার বই বাজেয়াপ্ত, আমার বিরুদ্ধে ফাঁসির মিছিল নিয়ে ভাবে না। বাড়ি কেনা ছাড়া আমার উপায় কিছু ছিল না। প্রকাশকদের দিয়ে যাওয়া টাকা, যা ভেবেছিলাম ব্যাংকে রেখে ইন্টারেস্ট যা পাবো মাসে মাসে, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালাবো, চাকরির টাকা আর কত! সেই নিরাপত্তা নির্বাসনে দিয়ে যা টাকা দিয়েছেন প্রকাশকরা আর যা ছিল জমা, সব ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে আমার বাড়ি কেনা হল। বাড়ির দাম সাতাশ লক্ষ টাকা। বারো লক্ষ টাকা নগদ দেওয়া হল। ব্যংকের ঋণ যত দেরিতে শোধ করব, তত দিতে হবে সুদ। বাড়ি কেনার খবর পেয়ে প্রকাশকরা হুড়মুড় করে আরও অগ্রিম রয়্যালটি ঢালতে শুরু করলেন। কাকলী প্রকাশনী তিন লক্ষ টাকা দিয়ে গেছেন খবর পেয়ে পার্ল পাবলিকেশন্সএর মিনু পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে এলেন। ব্যাংকের টাকা খুব দেরি হয়নি শোধ করতে। এক লক্ষ টাকার জন্য বাবার কাছে হাত পাততে হয়েছিল। অবশ্য ধার হিসেবে নিয়েছি। তিনি দিয়েছেন। জমি কেনা বাড়ি কেনা বিষয়ে বাবা বরাবরই খুব উৎসাহী। দলিল পাওয়ার পরই ঠেলাগাড়ি ডেকে এনে শান্তিবাগ থেকে শান্তিনগরে জিনিসপত্র উঠিয়ে নিলাম। আমার কষ্ট হচ্ছিল শান্তিবাগের বাড়িটি ছেড়ে যেতে। স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। আমি আর আমার দীর্ঘশ্বাস কালো গেটটি পেরিয়ে যাই।

লজ্জা নিয়ে হৈ চৈ মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, কমছে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাঝমাঠে গিয়ে পড়েছে লজ্জা। লেখালেখি হচ্ছে, বাম দলের লোকেরা বলছে, এ একটা বাজে বই। এমন কী বামপন্থী চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন বললেন, লজ্জাকে বই না বলে দুর্গন্ধ-আবর্জনা বলা ভাল। আবার চরমপন্থী হিন্দুরা বলছে এ হচ্ছে পবিত্র গ্রন্থের মত। বাংলাদেশের চিত্রের ঠিক উল্টো চিত্র ভারতে। এদেশে বামপন্থী উদারপন্থী সেকুলারিস্টরা বলছেন, এটি একটি মূল্যবান বই (অবশ্য বদরুদ্দিন ওমর ছাড়া)। ওদিকের একই মানসিকতার মানুষ বলছেন এটি আবর্জনা ছাড়া কিছুই নহে। পশ্চিমবঙ্গের খুব অল্প কিছু মানুষ, হাতে গোণা, বাম ঘেষাঁ হয়েও বইয়ের পক্ষে বলছেন। একটি উপন্যাস কী করে রাজনীতির গুটি হয়ে যায়, আমাকে সবিস্ময়ে তা দেখতে হল। কিন্তু ভাল যে আমাকে আরও কাছ থেকে তা দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু আচমকা একদিন কলকাতার আজকাল পত্রিকা থেকে বাহারউদ্দিন এসে উপস্থিত। বাহারউদ্দিনের আগের সেই গদগদ ভঙ্গিটি, সেই গলে যাচ্ছি গলে যাচ্ছি হাসিটি নেই। বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার আপদমস্তককে এমন হানে যে মনে হয় এ বুঝি বায়তুল মোকররম মসজিদ থেকে গোলাম আযমের সাক্ষাৎ পুত্রটি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। আজকাল পত্রিকাটি বামপন্থীর পত্রিকা। আমি আনন্দপুরষ্কার পাওয়ার পর আজকাল আমাকে নিয়ে প্রশংসায় মেতেছিল। বুঝি, মুসলমান মেয়ে বলেই মেতেছিল। আর যেই না দেখল মুসলমান মেয়েটি মুসলমানদের গাল দিয়ে একটি বই লিখেছে, তখনই বেজার হয়ে গেল আজকাল। তবে তো এখন আর আমার গুণ গাওয়া চলবে না। গুণ গাওয়া বাদ দিয়ে বরং তসলিমাকে যত পারে ছি ছি দিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে লজ্জা যখন বিজেপির লোকেরা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বাহারউদ্দিন এসেছেন আমার কাছে জবাব চাইতে, কেন আমি লজ্জা লিখেছি। বাহারউদ্দিন আসামের লোক, ওখানের এক কলেজে আরবির শিক্ষক ছিলেন। একসময় সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে স্বাতী নামের এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে লালন নামের একটি পুত্রের জন্ম দিয়ে সুখের অথবা অসুখের সংসার করছেন। নিজে তিনি গদ্য পদ্য রচনা করেন। বইও বেরিয়েছে কিছু। বলতে দ্বিধা নেই যে বাহারউদ্দিন বেশ চমৎকার গদ্য লেখেন। তিনি ধর্ম মানেন না। ধর্মকে মুখে বেশ আচ্ছ! করে গাল দেন। ধর্ম নিয়ে যারা মাতম করে, তাদেরও। ওখানে হিন্দুদের অবহেলা অবজ্ঞা পাওয়া সংখ্যালঘু মুসলমানের জন্য আবার মায়া আছে তাঁর। আমার সঙ্গে তাঁর বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি হয়, যখন দেখেন হিন্দু ধর্মবাদী দল আমাকে দেবী করে তুলছে এবং এ কারণে দোষটি তিনি আমাকে দেন। যে কথাটি বাহারের বোঝা সম্ভব হয় না, তা হল, আমি কোন দেশে বসে কাদের কথা লিখেছি, এবং কেন লিখেছি। বাহারউদ্দিন যত বামপন্থী হন, যত নাস্তিক হন, তিনি সংখ্যালঘুদের একজন। তিনি অত্যাচারী হিন্দু দেখেছেন, অত্যাচারিত হিন্দু দেখেননি। যা দেখে অভ্যেস নেই, তার চিত্র কল্পনা করা সবার জন্য সহজ হয় না। তিনি কলকাতা থেকে উড়ে এসেছেন বলে এই করুণায় নয়, লজ্জা নিয়ে ভুল ভাবনাগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য বাহারের সঙ্গে আমি কথা বলতে রাজি হই। আজকাল পত্রিকায় লজ্জা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। বাদ প্রতিবাদ তুঙ্গে। মুসলমান মৌলবাদিরা নয়, প্রগতিশীল শিবিরের এমনকী স্বনামধন্য বামপন্থী লেখক এবং নেতারা মন্তব্য করেছেন, ক. আমি উস্কানিমূলক লেখা লিখেছি। খ. আমি সচেতন বা অসচেতনভাবে বিজেপি- আরএসএস মার্কা হিন্দু মৌলবাদের স্রোতে ভেসেছি। এমনকী দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তার শিকার হয়েছি। গ. উপন্যাস হিসেবে লজ্জা দুর্বল। পলায়নবাদী দৃষ্টিকোণে সমগ্র রচনাটি আচ্ছন্ন।

বাহার আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘লজ্জা নিয়ে আপনি তো নিশ্চয়ই এখন বিব্রত। তাই না?’

কপালে আমার বিরক্তির ভাঁজ পড়ে প্রথম প্রশ্নটি শুনেই।

‘আশ্চর্য তো! কেন বিব্রত হব। মোটেও আমি বিব্রত নই।’

‘লজ্জা কিংবা আপনার কোনও লেখা নিয়েই কি আপনি বিব্রত নন, বলতে চান?’

‘হ্যাঁ বলতে চাই। আমার লেখার বিষয় নিয়ে আমি কখনও বিব্রত হই না। আমার দুর্বল বর্ণনা নিয়ে, ভাষা ব্যবহারের অপরিপককতা নিয়ে, চরিত্রের গভীরে যথেষ্ট না পৌঁছোনো নিয়ে অবশ্য বিব্রত হই।’

‘লজ্জাকে বাংলাদেশে ইসু করেছে মোল্লারা, সরকারও। পশ্চিম বাংলায় এবং ভারতের আরও অন্যান্য রাজ্যগুলোয় আপনার অসতর্কতার ফায়দা তুলেছে বিজেপি। আপনার কি মনে হয় না সংঘ পরিবারের হাতে আপনি বিপজ্জনক অস্ত্রটি তুলে দিয়েছেন?’

‘প্রথমেই আপনার অসতর্ক শব্দ নিয়ে আমি আপত্তি করছি। লজ্জা লিখবার সময় আমি মোটেও অসতর্ক ছিলাম না। লজ্জায় আমি স্বীকার করছি কাঠামোগত দুর্বলতা, শিল্পগুণের অভাব প্রচুর আছে কিন্তু লজ্জার বিষয় বা বক্তব্যে কোনও ত্রুটি নেই। আমি অকপটে সত্য কথা লিখেছি। বাংলাদেশ সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করতে গিয়ে একবারও কিন্তু বলেনি বইয়ের কোনও তথ্য ভুল। বিজিপি যদি ফায়দা তোলে সেটি বিজিপির অসততা, সেটি নিশ্চয়ই লজ্জার কোনও ত্রুটি নয়। সঙ্ঘ পরিবারের হাতে আমি অস্ত্র তুলে দিয়েছি বলে যারা প্রচার করছে, তারা আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষের একটি বই নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়। তারা বিজেপি আর সঙ্ঘ পরিবারের নিন্দা না করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখা একটি বই এবং বইয়ের লেখকের নিন্দা যখন করে, আমার সন্দেহ হয় আদৌ তারা আমার বইটি পড়েছে কী না। ধর্মীয় মৌলবাদীর পক্ষে একটি শব্দও কি ওই বইয়ে আছে? নেই। আবারও বলছি, সঙ্ঘ পরিবার যদি আমার বইটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে, এটি তাদের অসততা। লজ্জার বা তার লেখকের নয়। তারা নিশ্চয়ই জানে যে লজ্জার বক্তব্য তাদের পক্ষে যায় না। ধর্মের অপর নাম মনুষ্যত্ব হোক, এই কথাটি লজ্জার প্রথম পাতায় লেখা।’

‘আর এসএসের পাঞ্চজন এবং অর্গানাইজারে আপনার উপন্যাসের বিশেষ বিশেষ অংশ ছাপা হচ্ছে। বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেই উপন্যাসটিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল, পরদিনই দেখা গেল, কলকাতার রাস্তায়, ফুটপাতে, পানের দোকানে দোকানে লজ্জা বিক্রি হতে শুরু হল। কেউ কি আপনার উপন্যাস ছাপার অনুমতি নিয়েছে?’

‘অবশ্যই না। কোনও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলকে আমি দিই নি লজ্জা ছাপতে, দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কেবল লজ্জা কেন, আমার কোনও বই ছাপার কোনও অধিকার তাদের নেই।’

‘তাহলে আপনি পাঞ্চজন্য আার অর্গানাইজারের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না কেন?’

‘মামলা করবে আমার পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক, যারা লজ্জার সত্ত্ব কিনে নিয়েছেন। তাদেরই দায়িত্ব অন্য ভাষায় অনুবাদ করার আর ছাপার অনুমতি দেওয়া। এতে যদি কোনও রকম সমস্যা হয়, তবে তারা মামলা করবেন। করেছেনও তো এর মধ্যে। যারা অবৈধভাবে লজ্জা ছেপেছিল, তাদের পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।’

‘আমাদের মনে হয় আপনার উপন্যাস এখানকার হিন্দু আর ওখানকার মুসলমানদের অসুবিধেয় ফেলছে।’

‘আপনাদের মনে হওয়ার পেছনে কিছু গণ্ডগোল আছে। আমি এ দেশের এক প্রগতিবাদী শিক্ষিত পরিবারের গল্প বলেছি লজ্জায়। যে পরিবারটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার এবং যে পরিবারের একটি নাস্তিক যুক্তিবাদী ছেলে ক্রমে ক্রমে হিন্দু হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, নষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র তাকে নষ্ট করে, সরকার নষ্ট করে, দিনে দিনে বেড়ে ওঠা ধর্মীয় মৌলবাদ তাকে নষ্ট করে। সে পরাজিত হয়। এ দেশের অনেক হিন্দুই ধীরে ধীরে মানুষ থেকে হিন্দু হয়ে উঠছে, তারা পরাজিত হচ্ছে রাষ্ট্রধর্মের কাছে, তারা পরাজিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসা বাণিজ্যের ধর্মীয় বৈষম্যের কাছে। তারা এ দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সত্য কথা বলব না কেন? সত্য চিরকালই সম্মানিত হবে। সত্য নিয়ে অঘটন যারা ঘটায়, দোষ তাদের, দোষ সত্যের নয়। যারা সত্যকে দোষ দেয়, তারাই ওই অঘটনঘটানেওয়ালাদের সমর্থন করে। এখানকার হিন্দু অসুবিধেয় পড়বে, এটি একটি বাজে এক্সকিউজ। যারা সুবিধের জন্য মুখ বুজে থাকা মঙ্গল বলে মনে করে, তারা মানুষের শক্তি ও সাহসকে ধ্বংস করে দেয়। তারা ভীতু,ভোগী। তারাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে ক্ষতির কারণ। তারা ভাবে ভুলগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে বিপদ হবে। ওখানকার মুসলমানদের অসুবিধের প্রসঙ্গে একই কথা খাটে।’

‘অদূর ভবিষ্যতে আপনার লেখাকে কেন্দ্র করে কোনও অঘটন যদি ঘটে, কী করবেন? লজ্জার দায় মেনে নেবেন?’

‘লজ্জার কারণে অঘটন ঘটবে কেন? অঘটন ঘটবে অঘটন যারা অহরহ ঘটায় তাদের দ্বারা। লজ্জা হচ্ছে একটি মানবিক আবেদন, আর যেন অঘটন না ঘটে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ যেন থাকে। ধর্মের অপর নাম যেন মনুষ্যত্ব হয়।’

‘আপনার উপন্যাস একদর্শী। আপনি দাঙ্গা, ধর্ষণ, হত্যা ও উপাসনাগৃহের ভাঙচুরের বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি। ওগুলো ঘটেছে বলে দিয়েছি। আমি তো কিছু বানিয়ে দিইনি।’

‘দাঙ্গার বিরুদ্ধে সুস্থ মানুষের প্রতিরোধের বয়ান নেই কেন? এটি কি ইচ্ছাকৃত?’

‘একটি পরিবারের স্মৃতি স্বপ্ন আনন্দ বেদনার কথা লজ্জায়। সেই পরিবারের লোকেরা যেভাবে ঘটনাগুলো দেখেছে, সেভাবেই বর্ণনা করেছি। তারা যেটুকু প্রতিরোধ দেখেছে, নিশ্চয়ই সেসব প্রতিরোধের কথা আছে লজ্জায়। মানববন্ধনের কথা আছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল হচ্ছে, সে কথা আছে। মুসলমান ছেলেরা সুরঞ্জনকে নানাভাবে সাহায্য করে এসবও আছে। সুধাময় তাঁর ছেলে সুরঞ্জনকে বলেন, এ দেশের মানুষ কি রাস্তায় নামছে না? প্রতিবাদ করছে না? কাগজে তো বিস্তর লেখা হচ্ছে। এখনও তো অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ কথা বলছে। এই শক্তিটি কি সব দেশে আছে? প্রতিবাদ করার অধিকার কি সবাই পায়। এখানে তো হচ্ছেই প্রতিবাদ।

আসলে কী জানেন, এ দেশে সাতই ডিসেম্বর থেকে শুরু করে একটানা সাতদিন যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটে গেছে তার তুলানায় সুস্থ মানুষের প্রতিরোধ খুবই সামান্য। যদি সন্ত্রাস যেটুকু ঘটেছে, ঠিক সেটুকুই যদি প্রতিরোধের বয়ান করতাম, তবে মিথ্যাচার হত। জিজ্ঞেস করেছেন, এটি ইচ্ছ!কৃত কী না। হ্যাঁ ইচ্ছ!কৃত। আমি সত্য বয়ান করতে খুব ইচ্ছ! করি। আমি ভেবে দেখি না, কারা এই সত্য নিজ স্বার্থে ব্যবহার করবে, কারা অনুবাদ করবে, কারাই বা অন্যের ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে কুৎসা রটাবে।’

‘শুনেছি, আমরা খবরও করেছি, আপনি উপন্যাসটিকে আরও বড় করে লিখেছেন। এতে কি ঘটনা ও চরিত্রের রদবদল ঘটেছে? দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিখুঁত ছবিটি কি আশা করব?’

‘লজ্জাকে খানিকটা বড় করেছি। এতে মূল ঘটনায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু চরিত্র বেড়েছে। চরিত্রগুলোর সংলাপ বেড়েছে। সন্ত্রাসের খবর আরও আছে, আরও কষ্ট, আরও বেদনা আছে। প্রতিবাদও আছে, যেটুকু হয়েছে প্রতিবাদ সেটুকই আছে।’

‘নতুন করে লেখার কারণটি কি?

‘আমি খুব কম সময় নিয়ে লজ্জা লিখেছিলাম। ভেতরের কষ্টগুলো যেন বুক ছিঁড়ে বেরিয়েছিল। পরে, যখন বই হয়ে বেরোবার পর পড়ে দেখলাম, দেখলাম অনেক জায়গায় ভাষার দুর্বলতা রয়ে গেছে। ভাষায় কি আর সব প্রকাশ করা যায়। সব ক্রন্দন? তো, বাক্যগুলো সংশোধন করতে গিয়ে ভাবলাম, আরও কিছু চরিত্র ঢোকালে মন্দ কী!’

‘আপনার উদ্দেশ্য মহৎ আমরা বিশ্বাস করি। আপনার কি কখনও মনে হয় না, তাৎক্ষণিক আবেগ ও তাড়াহুড়োয় আপনি ভুল কৌশলের শিকার হয়েছেন! যেমন অহিন্দু সুরঞ্জন হিন্দু হয়ে উঠল, বাংলাদেশকে গালি দিল,দেশ থেকে পালিয়ে যেতে চাইল, ধর্ষণের মত অপরাধ করে বসল। আপনার লেখায় আগে এমন পরাজয়মনস্কতা দেখিনি। আপনিও কি হার মানছেন?’

‘আমি কৌশলে বিশ্বাসী নই। ডিসেম্বরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আমি নিজ চোখে দেখেছি। লজ্জা আমার তাৎক্ষণিক আবেগের ফসল নয়। এটি আমাদের সকলের পরাজয়ের ইতিহাস। এটি আমাদের সবার লজ্জা। সবার গ্লানি। যে কোনও সুস্থ সচেতন মানুষের জন্য এই পরাজয় অত্যন্ত মর্মান্তিক। মানুষ সুরঞ্জন হিন্দু হয়ে উঠছে, মানুষ হায়দার মুসলমান হয়ে উঠছে, দুটোই একই রকম গ্লানিকর। মনুষ্যত্বের চেয়ে ধর্ম যখন প্রধান হয়ে উঠছে, আমি তখনই দায়িত্ব অনুভব করেছি প্রতিবাদের। লজ্জা লেখার অনেক আগে থেকেই আমি প্রতিবাদ করছি এসবের। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লজ্জা হচ্ছে তীব্র প্রতিবাদ। লজ্জায় সুরঞ্জনের বাংলাদেশকে গালি দেওয়া মানে ভাষা আন্দোলন করা, মুক্তিযুদ্ধ করা সাহসী প্রত্যয়ী সেকুলার বাংলাদেশের ধীরে ধীরে ইসলামি হয়ে ওঠা, সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠাকে গালাগাল। রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে সত্যিকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঝরে গেলে সুস্থ সচেতন যে কোনও মানুষ সে কায়সার হোক, সুরঞ্জন হোক বাংলাদেশকে গালি দিতেই পারে। তারা দেশকে ভালবেসেই দেশের সমালোচনা করছে। তারা দেশকে গড়বে, আর দেশ যদি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, তবে গালি দেবে না! আসলে দেশ তো আর আপনাতেই নষ্ট হয় না, কিছু লোক নষ্ট করে দেশকে। কিন্তু সেই কিছু লোক যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষকে প্ররোচিত করে নষ্ট করতে, তখন দেশের সৌন্দর্য বলে কিছু আর থাকে না। দেশ আর দেশ থাকে না। সুরঞ্জন তার দেশকে ভালবাসে বলেই কষ্ট পায়, গাল দেয়। এ তার মাতৃভূমি বলেই সে দাবি করে নিরাপত্তা, মান সম্মান। সুরঞ্জনের ব্যর্থতা, পালিয়ে যাওয়া, মুসলমান মেয়ে ধর্ষণ করা, এগুলো কি আমি চাই? চাই না। চাই না বলেই আমি তার অধঃপতনের, তার সর্বনাশের প্রতিবাদ করি। চাই না বলেই আমাকে লজ্জা লিখতে হয়। আমারও তো প্রশ্ন, সুরঞ্জনরা যাচ্ছে কেন? বাংলাদেশকে অনেক হিন্দু ভারতে চলে গিয়ে হিন্দু মৌলবাদী দলে নাম লেখাচ্ছে। কেন? সুরঞ্জনের মত প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক ছেলে কেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়? ্‌দেশে থেকে লড়াই করবার মনোবল সুরঞ্জনরা হারাচ্ছে কোথায়? আমার জিজ্ঞাসা তো এটিই। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর সরকারের কাছে নেই বলে লজ্জা নিষিদ্ধ করতে হয়। ছাই দিয়ে ঢাকতে হয় আগুন।

আমি পরাজয় মানিনা। মানিনা বলেই আমাকে লজ্জা লিখি। লজ্জা আমার সমাধান নয়। লজ্জা আমার প্রতিবাদ। পরাজয়মনস্ক কখনও ছিলাম না। এখনও নই। বৈষম্য তুলে ধরবার কারণ, এই বৈষম্য আমি মানতে চাই না। মানব না।’

‘সত্যি কি এভাবে হিন্দুরা বাংলাদেশকে গালি পাড়ে? কথায় কথায় অভিশাপ দেয়?’ ‘সুরঞ্জন আর সাধারণ হিন্দুর মত ছিল না। সুরঞ্জনের কোনও ধর্ম বিশ্বাস ছিল না। নাস্তিক ছিল সে। কিন্তু সুরঞ্জনকেই হিন্দু বলে চিহ্নিত করেছে তার আশেপাশের সাম্প্রদায়িক লোকেরা। দেশ নিয়ে সুরঞ্জনের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সুরঞ্জনের মন এমনই বিষাক্ত হয়ে ওঠে যে সে দেশকে গাল দেয়। সুরঞ্জন কোনও বৈষম্য মানতে চায় নি বলে গাল দিয়েছে। অনেক হিন্দুই আছে, বৈষম্য দেখেও মুখ বুজে থাকে। মনে মনেও দেশকে গাল দেওয়ার সাহস নেই। হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, গাল দেওয়াকে আমি পছন্দ করি কী না। না অবশ্যই না। কিন্তু সুরঞ্জন দেয় কেন গালি, যে সুরঞ্জন তার দেশকে খুব ভালবাসত! এর পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে, কারণগুলো আলোচনা না করে একটি বিভ্রান্ত শোকে দুঃখে ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে যাওয়া এক প্রতারিত ছেলে মুখে কি উচ্চারণ করল, সেটি বড় বিষয় হয় কেন!’

‘আমাদের মনে হয় গোটা উপমহাদেশ আজ ভয়ংকর অসুখে আক্রান্ত। বিবেক কোথাও কোথাও স্তব্ধ। বিভ্রান্ত। বিভ্রান্তির হাত থেকে আপনারও কি রেহাই নেই?’

‘লজ্জায় আমার বিবেক সবচেয়ে বেশি শুদ্ধ। পরিষ্ফুট। স্পষ্ট।’

মাত্র সাতদিন আগে সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদ একটি ফতোয়া দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। ফতোয়া প্রসঙ্গও তোলেন বাহারউদ্দিন।

‘রুশদি নিজের লেখার পক্ষে দাঁড়ান নি। ক্ষমা চাইলেন। কলমা পড়ে মুসলমান হলেন। আপনার অবস্থা রুশদির চেয়ে করুণ। আপনার পাশে সরকার নেই। বিরোধীরাও নেই। লেখকরাও মুখটি সেলাই করে বসে আছে। আপনি এত একা কেন? একাকীত্ব, ভেতর বাইরের চাপ আপনাকে যদি ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে, কী করবেন?’

‘আমি একা নই। হাজার হাজার পাঠক আছে আমার। আমি যে কথা লিখি, তা সরকারের কাছে যেরকম অগ্রহণযোগ্য, বিরোধীদলের কাছেও সেরকম। দু দলের কেউই ধর্ম বিসর্জন দেবে না। ধর্ম তাদের খুব বড় হাতিয়ার। প্রগতির পক্ষের লেখকরা মুখ সেলাই করে বসে আছেন, এ কথা সত্য নয়। লেখক শিবির, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেটের ফতোয়াবাজ মৌলানাদের তীব্র নিন্দা করেছে। লজ্জা নিষিদ্ধ হওয়ার পর অনেক লেখকই সরকারের সাম্প্রদায়িক আচরণের প্রতিবাদ করেছেন। যারা মুখ খোলে না, তারা কোনও কিছুতেই মুখ খোলে না। কোনও ঝুঁকিই নেয় না। উজানে চলবার মন সবার থাকে না। যেদিকে হাওয়া সেদিকে ছুটবার প্রবণতা বেশির ভাগ মানুষের। ক্ষমা আমি কোনওদিনই চাইব না। রুশদি চেয়েছেন, সে রুশদির নির্বুদ্ধিতা। আমি মরে যাবো, কিন্তু কখনও ক্ষমা চাইব না।’

‘বিপদ এলে দেশ ছেড়ে পালাবেন, অন্য কোনও দেশে আশ্রয় খুঁজবেন?’

‘আমি কি কম বিপদের মধ্যে আছি! যত বিপদই আসুক, আমি কখনও দেশ ছেড়ে পালাবো না। আমার ফাঁসির জন্য মোল্লারা একজোট হচ্ছে। আমি তবু শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আদর্শে আমি চিরদিনই অটল থাকব।’

‘আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশে লড়াইয়ের শক্ত জমিটি নড়বড়ে হয়ে উঠছে? ঘাতক জামাতের হাতে আপনার কি মনে হয় না তুলে দিলেন নৃশংস একটি অস্ত্র?’

‘শক্ত জমিটি খুব নড়বড়ে হয়ে গেছে — এ কথা আমি মানি না। চারদিকে যখন বিরুদ্ধ পরিবেশ, একটি বিন্দু থেকেও তখন লড়াই হয়। হতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তা-ই প্রমাণ করে। আমরা যারা মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদ ও মানববাদে বিশ্বাসী, তারা লড়াই করছি। লড়াই আমাদের থামবে না। জামাতে ইসলামির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছি, এ কথা এখানকার কোনও শত্রুও বলে না। আপনারাই বলছেন। একই রকম লজ্জা সম্পর্কে এখানকার মৌলবাদিরা যা বলছে, ঠিক একই কথা ওখানে আপনারা বলছেন। স্বাধীনতার শত্রু জামাতিদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি। লজ্জা তাদের মাথা তুলে দাঁড়াবার অস্ত্র নয়, লজ্জা তাদের মাথা নুইয়ে দেবার অস্ত্র। দেশ জুড়ে জামাতে ইসলামির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠছে। এই ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের টাকা আর অস্ত্র, তারা নতুন প্রজন্মের হাতেও অস্ত্র আর টাকা দিচ্ছে অঢেল, বিভ্রান্ত করছে আমাদের যুব সমাজকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন শিবিরের সন্ত্রাস ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আমরা বাহান্নর ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করা জাতি, আমরা কিছুতেই এই মাটিকে অপবিত্র হতে দেব না।’

এ তো গেল। কিন্তু তারপরও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু বামপন্থী লজ্জা উপন্যাসটির নিন্দা এতটুকু কমাননি। কিন্তু এঁদের মুখই হাঁ হয়ে থাকে, যখন কমিউনিস্টদের গুরু, স্বয়ং নাম্বুদ্রিপাদ লজ্জাকে একটি খুব মূল্যবান বই বলে উল্লেখ করেন। সংখ্যাগুরুর মানুষ হয়ে সংখ্যালঘুর পক্ষে দাঁড়িয়েছি, এই ব্যপারটিকে তিনি অভিনন্দন জানান। এবং নান্দনিক বিচারে যারা বলছিল বইটি নিকৃষ্ট, তাদের গালেও তিনি একটি শক্ত চড় কষিয়ে দেন। (নাম্বুদ্রিপাদ নান্দনিক বিষয় আমার চেয়ে ভাল বোঝেন হয়ত, কিন্তু আমার যতটুকু জ্ঞান আছে, তাতে আমি স্পষ্ট বুঝি যে বইটি নান্দনিক বিচারে সত্যিই নিকৃষ্ট।)

আনন্দবাজার পত্রিকা এবং আজকাল এদুটো পশ্চিমবঙ্গের বড় পত্রিকা। আজকাল পত্রিকাটি বামঘেঁষা, আনন্দবাজার ঠিক কী ঘেঁষা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। তবে একটি জিনিস টের পাই, আনন্দবাজারের নাক খানিকটা উঁচু। আজকালের চেয়ে বেশি চলে বলে সম্ভবত। আনন্দবাজার লেখক তৈরি করে না, তৈরি হওয়া লেখকদের ছাপে।

এদিকে বাংলাদেশের মৌলবাদী দল, কেবল মৌলবাদী নয়, আহমদ ছফা এবং ফরহাদ মজহারের যৌগবাদী দলও যাঁরা আনন্দবাজার গোষ্ঠীকে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী বলে বিশ্বাস করে, এবং আমি আনন্দ পুরষ্কার পেয়েছি বলে আমাকে হেন কুকথা নেই যে বলেননি, তাঁরা নিশ্চয়ই পড়ার সুযোগ পাননি আনন্দবাজার পত্রিকার ১৫ অক্টোবর তারিখের সম্পাদকীয়। শিরোনাম তসলিমা ও সঙ্ঘ পরিবার। ‘বাবরি মসজিদের পর ভারতীয় জনতা পার্টি এবার আর এক খেলায় মাতিয়াছে। শুধু ভারতীয় জনতা পার্টি নয়, সঙ্ঘ পরিবার এবার বাংলাদেশের প্রতিবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনকে লইয়া এক হীন চক্রান্ত শুরু করিয়াছে। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা নামক উপন্যাসটি সরকারি হুকুমে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বই। ভারতীয় জনতা পার্টি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, লেখকের অনুমোদন না লইয়া এই বইটি হিন্দিতে অনুবাদ করিয়া নিজেদের এক পত্রিকায় প্রকাশ করিতেছে। এই চৌর্যবৃত্তিতে তাহাদের বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নাই। বরং আগাম জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে, বইটির ইংরাজি অনুবাদও তাহারা দলীয় পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিবে। শুধু তাহাই নহে, এই দল এবং তাহার অনুগামী বা পুরোগামী হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি নাকি চারটি রাজ্যের আসন্ন অন্তর্বর্তী নির্বাচনে তসলিমা নাসরিনের উপন্যাসটিকে কাজে লাগাইতে পারে। গান্ধী যুগের পর ভারতীয় রাজনীতিতে নীতিবোধ আদর্শনিষ্ঠা, সততা বা শুদ্ধাচার অবশ্যই ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। নীতিহীন রাজনীতি কোন পর্যায়ে নামিতে পারে তাহার নতুন প্রমাণ রচনা করিল হিন্দু মৌলবাদীদের এই সব গোষ্ঠী এবং দল। যে সাহসী লেখক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া লড়াই চালাইতে গিয়া কার্যত গৃহবন্দী, মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী যাঁহার প্রাণদণ্ডের দাবিতে সরব, যাঁহার দেশের সরকার এ ব্যপারে নির্বাক দর্শকের ভূমিকায়, তাঁহাকে প্রতিবেশী দেশের হিন্দু মৌলবাদীরা যখন নিজেদের হীন মতলব হাসিল করিবার জন্য কাজে লাগাইতে উদ্যত তখন বুঝিতে হয়, কপটতা এবং মিথ্যাচার ভারতে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে কীভাবে গ্রাস করিয়াছে। এই উপমহাদেশে এবং দেশের বাহিরে তসলিমা নাসরিনের লক্ষ লক্ষ পাঠক জানেন, তাঁহার দুঃসাহসিকতার লড়াই শুধু নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, মানবতার মহত্তম আদর্শে অনুপ্রাণিত এই লেখক সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার এবং হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন সংগ্রামী। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশে যাহারা ধ্বনি তুলিয়াছিলেন, আযম আডবাণী ভাই ভাই, তসলিমা নাসরিন সেই মুক্তদৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক মৈত্রীকামী এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রগতিশীল বাংলাদেশিদেরই একজন। সঙ্ঘ পরিবার কোন নৈতিকতার বলে তাঁহার রচনাকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করিতে দুঃসাহসী? এই নির্লজ্জ আচরণের তুলনা নাই। অথচ আশ্চর্য ঘটনা এই, তসলিমা নাসরিনের উপন্যাস লইয়া বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার যখন অভিসন্ধিমূলক যদৃচ্ছ অপকর্মে ব্যস্ত, এ দেশের গণতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি তখন সম্পূর্ণ নীরব। তসলিমা নাসরিনের মাথার দাম ঘোষিত হইবার পর এ দেশের অনেক মহিলা সংগঠন এবং লেখক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়াছেন। কিছু কিছু বিক্ষোভ বিবৃতিও দেখা গিয়াছে। তাহা যথেষ্ট কি না সে প্রশ্ন অবশ্য থাকিয়াই যায়। কিন্তু সঙ্ঘ পরিবার তাঁহার বইটিকে লইয়া যে কদর্য কাণ্ড চালাইতাছে, এ যাবৎ তাহার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ হইয়াছে বলিয়া শোনা যায় নাই। অথচ ভারতীয় জনতা পাটিং এবং সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে নাকি আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলগুলি খুবই তৎপর! সঙ্ঘ পরিবারের এই কৌশলটি তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া গেল, কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিকারের কথা কোনও মহল হইতে উচ্চারিত হইল না, ইহা কি বিস্ময়কর নয়? তসলিমা নাসরিন অযোধ্যাকাণ্ডের পর যদি কিছু সত্য উচ্চারণ করিয়া থাকেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও অবশ্যই উঠিতে পারে, সেদিনের বাংলাদেশের ওই পরিস্থিতির জন্য সঙ্ঘ পরিবারের যে স্থূল হাত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করিয়াছে তাহাও কি দায়ী নয়? শুধু বাংলাদেশ কেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এই দেশে যত কিছু কাণ্ড ঘটিয়াছে তাহার দায়ই বা হিন্দু মৌলবাদীরা অস্বীকার করিবে কেমন করিয়া? অথচ এই ভণ্ডদের এমনই ঔদ্ধত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের তরফে তসলিমা নাসরিনের সাহসী, মানবিক দলিলটি আজ তাহারা এ দেশের তথাকথিত হিন্দু জাগরণের সপক্ষে ইস্তাহার হিসাবে ব্যবহার করিতে চায়? তসলিমা নাসরিন স্পষ্ট ভাষায় ওই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা হইতে শুরু করিয়া শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত জানাইয়া গিয়াছেন, লজ্জার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ সব ধর্মের মৌলবাদীদের অধার্মিক এবং অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে। দুঃখের বিষয়, কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং বিজ্ঞ কলমধারী এই পরিণতির জন্য দায়ী করিতেছেন লজ্জার লেখক তসলিমা নাসরিনকেই। তাঁহাদের একটি বক্তব্য, তসলিমা নাসরিন কি এ সময়ে এ বই না লিখিলেই ভাল করিতেন না? আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আজ কোন পর্যায়ের জীবে পরিণত, এই একটি ধারণা হইতেই তাহার ইঙ্গিত মেলে। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের এই পরামর্শ যদি সর্বদেশে সর্বকালে অতি অসাবধানী লেখকরা মানিয়া লইতেন, তবে পৃথিবী হয়ত অনেক যুগান্তকারী রচনা হইতেই বঞ্চিত হইত। তাঁহাদের আর এক বক্তব্য, তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে তাঁহার গ্রন্থে পরোক্ষে অপমান করিয়াছে। ইহাও অসত্য। সত্য ঘটনা এই, তাঁহাদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সাহসিকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের একাংশ বাবরি মসজিদের ঘটনার পর অপমানিত, অত্যাচারিত। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের আপৎকালে যে সীমাবদ্ধতা বারবার দেখা যায়, তসলিমা নাসরিনের রচনা সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বস্তুত, তাঁহার বিরুদ্ধে বি জে পির পৃষ্ঠপোষণার অভিযোগ না আনিয়া আমাদের অতিবুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের বোধহয় উচিত ছিল সন্ধানী আলোটি একবার নিজেদের দিকে ঘোরানো। তসলিমা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি উদঘাটন করিয়াছেন। আমরা কি এ দেশে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারিতাম না? দাঙ্গার সময় এ দেশের সংখ্যালঘুদের মানসিক অনুভূতি কী, সে কথা আমরা কয়জন বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছি? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে আমরা মিছিল করি, বিবৃতি দিই, পোস্টার ছাপাই, ইস্তাহার বিলি করি – সবই ঠিক। প্রগতিশীল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানুষের সংখ্যা অগণ্য, ইহাও ঠিক। তাহা সত্ত্বেও বামপন্থী রাজত্বের মধ্যেও সেদিন কি এই রাজ্যেই বেশ কিছু মানুষ দাঙ্গায় প্রাণ হারান নাই? এই প্রশ্ন তুলিলে যদি আমাদের দেশের প্রগতিশীল শক্তি এবং বুদ্ধিজীবী মহলের অবমাননা না হয়, তবে তসলিমা নাসরিনের বেলাতেই বা তাহা অপরাধ হইবে কেন? তসলিমা নাসরিন অতএব আমাদের লজ্জা নয়, আমাদের প্রকৃত লজ্জা বুদ্ধি এবং কপট যুক্তির ছলে ভাবের ঘরে এই চুরি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *