রামমোহন ও বিদ্যাসাগর : প্ৰাণদাতা ও জীবনদাতা
মানুষের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী চক্রান্তে হিন্দু পিতৃতন্ত্র অনন্য; আর কোনো পিতৃতন্ত্রে অভিজাতশ্রেণী সমাজের অধিকাংশ মানুষকে এমন নিপুণভাবে পীড়ন ও পর্যুদস্ত করতে পারে নি। হিন্দু পিতৃতন্ত্র সমাজকে শুধু চার বর্ণে বিভক্ত করে নি, অভিজাতমগুলি অনভিজাতদের ওপর শুধু নির্মম পীড়ন চালায় নি; হিন্দু পিতৃতন্ত্র পীড়িত হওয়াকে পরিণত করেছিলো নিম্নবর্ণের ধর্মে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে অধিকাংশ মানুষ মর্ষকামিতার শিকার, মর্ষকাম তাদের পুণ্য ধর্ম। উৎপীড়িত হওয়া মানুষের শোচনীয়তার লক্ষণ নয়, ওই উৎপীড়ন মেনে নেয়াই মানুষের শোচনীয়তার লক্ষণ; এবং মানুষকে হিন্দু পিতৃতন্ত্র এমন শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলো যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ উৎপীড়িত হওয়াকেই ভক্তি করেছে। ধর্ম ব’লে। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে অধিকাংশ পুরুষই যেখানে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বলি, সেখানে নারীর অবস্থা যে হবে চূড়ান্ত শোচনীয়, তার অস্তিত্বই যে অস্বীকার করা হবে, তাকে যে শারীরিকভাবে পীড়ন করা হবে, তা ধরে নেয়া যায়; এবং হিন্দু পিতৃতন্ত্র নিষ্ঠুরতায় ছাড়িয়ে গেছে সমস্ত সীমা। অন্যান্য পিতৃতন্ত্র নারীকে মনে করেছে দাসী ও ভোগ্যসামগ্ৰী, আর হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীকে গণ্য করেছে বলির পশু; নারীকে ধারাবাহিকভাবে বলি দিয়েছে পুরুষেব যুপকাঠে। হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীকে সম্পত্তির অধিকার দেয় নি, পুরুষকে করেছে নারীর ঈশ্বর, পুরুষকে দিয়েছে অবাধ নারীঅপব্যবহারের অধিকার, বিধবাকে দেয় নি বিয়ের অধিকার, এবং নারীপোড়ানোকে ক’রে তুলেছে। ধর্ম। হিন্দু পিতৃতন্ত্রে নারীর প্রাণের মূল্য নেই, জীবনেরও অধিকার নেই; নারী শূদ্রের থেকে শূদ্ৰ, যদিও এ-পিতৃতন্ত্রই নারীকে কপট স্তব করেছে। দেবীরূপে। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৯) গভীর ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদসদ্বিবেচনা নাই..আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’; তিনি আর্তনাদ করেছিলেন, ‘হা অবলাগাণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি ন!’ নারীর জন্যে নিষ্ঠুরতম ভূভাগের নাম ভারতবর্ষ, নিষ্ঠুরতম ব্যবস্থার নাম হিন্দু পিতৃতন্ত্র।
যেখানে ধর্মহীনতা বেশি সেখানেই জন্ম নেয়। ধর্মপ্রবর্তকেরা, আর যেখানে পীড়ন বেশি সেখানেই ঘটে ত্ৰাতাদের আবির্ভাব। নারী সবচেয়ে পীড়িত ছিলো ভারতে, তাই এখানেই প্রথম দেখা দেন নারীত্ৰাতারা; রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর। রামমোহন নারীকে বঁচিয়ে রাখার জন্যে সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবাৰ্ত্তকের সম্বাদপ্রথম প্রস্তাব প্রকাশ করেন। ১৮১তে, দ্বিতীয় প্রস্তাব ১৮১৯-এ; এ-বিষযে তার শেষলৈখা সহমরণ বেরোয় ১৮২৯-এ। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্ৰচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক- প্ৰথম প্রস্তাব প্রকাশ করেন। ১৮৫৫তে, এবং একই বছর প্রকাশ করেন দ্বিতীয় প্রস্তাব। পৃথিবীর আর কোথাও তাদের, অন্তত রামমোহনের, আগে নারীর পক্ষে কোনো পুরুষ কিছু লেখে নি, লড়াইয়ে নামে নি। বিলেতে নারীর পক্ষে প্রথম যে-পুরুষ বই লেখেন, তিনি দার্শনিক উইলিয়াম টমসন; তাঁর বই মানবজাতির অর্ধেক, নারীদের আবেদন মানবজাতির অপর অর্ধেক, পুরুষদের দুরূহঙ্কারের বিরুদ্ধে বেরোয় ১৮২৫-এ; কিন্তু তিনি হন উপহাসের পাত্র। পশ্চিমে নারীর পক্ষে পুরুষের লেখা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বই জন স্টুয়ার্ট মিলের নারী-অধীনতা বেরোয় ১৮৬৯-এ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর পৃথিবীর দুই আদি নারীবাদী পুরুষ, মহাপুরুষ। তাঁরা কর্মবীর হিশেবেও অসামান্য; তারা বই লিখেই থেমে যান নি, যাওয়ার উপায় ছিলো না; তারা আইন প্রণয়ন করিয়ে বাস্তবায়িত করেছিলেন নিজেদের স্বপ্ন। পৃথিবীর নারীবাদের ইতিহাসে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নাম স্বর্ণলিপিতে লেখা থাকার কথা।
তবে রামমোহন ও বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি বা নারী-স্বাধীনতার কথা বলেন নি, মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা বলা যায় সভ্য সমাজে:- যেমন বলেছেন মিল, তারা নারীর জন্যে দাবি করেছেন দুটি সামান্য জিনিশ;–বেঁচে থাকা ও জীবনযাপনের অধিকার, যা তখন হিন্দু নারীদের জন্যে ছিলো মুক্তির থেকেও অনেক বড়ো। হিন্দু পিতৃতন্ত্রের নৃশংসতা সম্পর্কে তারা ছিলেন সচেতন; বিদ্যাসাগর হিন্দু পিতৃতন্ত্রকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করেছেন, একে নিকৃষ্টতম বলতে তিনি দ্বিধা করেন নি, এবং হাহাকার করেছেন বার বার। নারীপুরুষের সম্পর্ক যে লৈঙ্গিক রাজনীতি, তা বুঝেছেন তারা দুজনেই, যদিও এর ওপর জোর দেন নি। হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীর ওপর বলপ্রয়োগে নির্মম, নারীর নিন্দায় মুক্তকণ্ঠ; রামমোহনের প্রবর্তকের কণ্ঠে কথা বলেছে হিন্দু পিতৃতন্ত্র। প্রবর্তক বা পিতৃতন্ত্রের অভিযোগের উত্তরে নবর্তক বা রামমোহন (১৮১৮, ২০২) বলেছেন :
‘স্ত্রীলোককে যে পৰ্যন্ত দোষান্বিত আপনি কহিলেন, তাহা স্বভাবসিদ্ধ নহে।. স্ত্রীলোকেরা শারীবিক পরাক্রমে পুরুষ হইতে প্ৰায় নূ্যন হয়, ইহাতে পুরুষেরা তাহারাদগকে আপনা হইতে দুৰ্ব্বল জানিয়া যে ২ উত্তম পদবীর প্রাপ্তিতে তাহারা স্বভাবত যোগ্য ছিল, তাহা হইতে উহারদিগের পূৰ্ব্বািপব বঞ্চিত করিযা আসিতেছেন। পবে কাহেন, যে স্বভাবত তাহাবা সেই পদ প্রাপ্তির যোগ্য নহে।‘
লৈঙ্গিক রাজনীতিটি এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন রামমোহন। একগোত্র বলপ্রয়োগে আরেক গোত্রকে পরাভূত ক’রে কেড়ে নিয়েছে তার সমস্ত অধিকার, নারীর যা পাওয়ার কথা ছিলো তা তাকে না দিয়ে রটিয়ে দিয়েছে যে নারী ওসবের অযোগ্য, এ-রাজনীতি ধরা পড়েছে রামমোহনের চোখে, যদিও তাঁর পক্ষে তখন এ-রাজনীতিক লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিলো না। তার রাজনীতি ছিলো বাঁচিয়ে রাখার রাজনীতি, নারীর বেঁচে থাকাই ছিলো রাজনীতি। বিদ্যাসাগরও (১৮৭১,৮৪৩) বলেছেন :
‘স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সামাজিকনিয়ম্দোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাহারা পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালাহরণ করিতেছেন। প্রভূতপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যাদৃচ্ছিাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সর্ব প্রদেশেই স্ত্রীজাতির ঈদৃশী অবস্থা।‘
বিদ্যাসাগরের বর্ণনায়ও নারী রাজনীতিকভাবে, শারীরিক দুর্বলতাবশত, পরাভূত জাতি; যেনো পুরুষের থেকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনার্যের মতো ভিন্ন ও পরাভূত জাতি; তাই তারা ‘পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালাহরণ’ করছে, যেমন করেছে ইংরেজের অধীনে ভারতীয়রা। পুরুষজাতি বিদ্যাসাগরের চোখে নৃশং স্বৈরাচারী, যাদের অত্যাচার ও অন্যায় আচরণ নারী মেনে নিয়েছে নিরুপায় হয়ে। দুজনেই পুরুষনারীর সম্পর্কের ভেতরে দেখেছেন রাজনীতি, লৈঙ্গিক রাজনীতি, যদিও আর এগোন নি। কেননা তারা নারীমুক্তির যুদ্ধে নামেন নি, তারা দাবি করেছেন নারীর জন্যে সামান্য অধিকার, যা নিশ্বাসের মতো সামান্য, জীবনযাপনের মতো সামান্য।
রামমোহন হিন্দু নারীকে দিয়েছেন প্ৰাণ, বিদ্যাসাগর দিয়েছেন জীবনী; রামমোহনের যেখানে শেষ, বিদ্যাসাগরের সেখানে শুরু। রামমোহন চেয়েছেন শুধু বিধবার প্রাণটুকু, আর বেশি কিছু নয়; কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে ওই প্ৰাণটুকু যথেষ্ট নয়, নারীর জন্যে তার দরকার জীবন, যা শুধু নিশ্বাসপ্রশ্বাস নয়, উপভোগের। বিধবা বেঁচে আছে, চিতার আগুনে ছাই হয়ে যায় নি, সে পেয়েছে ব্ৰহ্মচর্য পালনের অধিকার, এ-ই যথেষ্ট রামমোহনের জন্যে; তাঁর পক্ষে আর কিছু চাওয়া সম্ভব ছিলো না, হিন্দু পিতৃতন্ত্রের কাছে তা মনে হতো বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবার ব্ৰহ্মচর্য এক ধরনের চিতাগ্নিতে দগ্ধ হওয়াই, তা জীবন নয়, তা বাঁচা নয়। মানুষ শুধু নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে না। রামমোহন (১৮১৮, ১৭০) বারবার বলেন ও প্রমাণ করেন, ‘পতির মৃত্যু হইলে পবিত্র যে পুষ্প মূল ফল তাহার ভোজনের দ্বারা শরীরকে কৃশ করিবেন এবং অন্য পুরুষের নামও করিবেন না। আর আহারাদি বিষয়ে নিয়ামযুক্ত হইয়া এক পতি যাহাদের অর্থাৎ সাধবী স্ত্রী তাহদের যে ধৰ্ম্ম তাহার আকাঙক্ষা করিয়া যাবজীবন ব্ৰহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক থাকিবেন।’ তিনি চেয়েছেন শুধু বিধবার ব্ৰহ্মচর্যোবে অধিকব। ওই ব্ৰহ্মচর্যও অত্যন্ত নৃশংস : নারী শুধু মৃত পতির ধ্যান ক’রে ফলমূল খেয়ে ও না খেয়ে বেঁচে থাকবে; তার রক্ত থাকবে না মাংস থাকবে না, জীবন থাকবে না। তবে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের কাছে এও ছিলো এক অনুমোদন অযোগ্য আবদার। বিদ্যাসাগরের কাছে নিশ্বাসপ্রশ্বাস যথেষ্ট নয়, ব্ৰহ্মচর্যে তিনি বিশ্বাসই করতেন না; তার দাবি জীবন। রামমোহনের নারী শুধু নিশ্বাসপ্রশ্বাস; বিদ্যাসাগরের নারী রক্তমাংসের সজীব মানুষ, যার একটি শরীর আছে, আর ওই শরীরের রয়েছে আগুনের থেকেও লেলিহান ক্ষুধা। বিদ্যাসাগর যখন বিধবার বিয়ের কথা বলেন, তখন বিধবার শরীরটিকে বাস্তব ও সত্য ক’রে তোলেন; নারীকে ফিরিয়ে দেন তার হারানো অস্বীকৃত শরীর। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৯) যখন বলেন :
‘তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না;… দুৰ্জয় রিপুবৰ্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়।‘
তখন বড়ো হয়ে ওঠে নারীর শরীর, শরীরই হয়ে ওঠে নারী। যার নিজের শরীরের ওপর অধিকার নেই, তার আর কোনো অধিকার নেই। বিদ্যাসাগর একথা বুঝেছিলেন, তাই তিনি পড়েন আমূল নারীবাদীদের শ্রেণীতে, যারা শুধু নারীর আর্থস্বাধীনতাকেই নয়, শরীরকেও মনে করেন গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক বই দুটিতে তিনটি শব্দ- বৈধব্যযন্ত্রণা’, ‘ব্যভিচার্দোষ’ ও ‘ভ্রূণহত্যাপাপ’-ধ্রুবপদের মতো পুনরাবৃত্ত হয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে নারীর শরীরকে। তাঁর বর্ণনা পড়ার সময় উনিশ শতকের সমস্ত হিন্দু বাল্যবিধবার আচরিতাৰ্থ কাম দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। এতেই প্রকাশ পেয়েছে বিদ্যাসাগরের অকপট আধুনিকতা। এ-সম্পর্কে তার রচনায় পাই :
‘[ক] কত শত বিধবারা, ব্ৰহ্মচৰ্যনির্বাহে অসমর্থ হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত ও ভূণহত্যাপাপে লিপ্ত হইতেছে; এবং পতিকুল, পিতৃকুল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা, ব্যভিচারদোষ ও ক্রুণহত্যাপাপের নিবারণ ও তিন কুলের কলঙ্ক নিরাকবণ হইতে পাবে। যাবৎ এই শুভকরী প্রথা প্রচলিত না হইবেক, তাবৎ ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত, কলঙ্কের প্রবাহ ও বৈধব্যযন্ত্রণার অনল উত্তরোত্তর প্রবল হইতেই থাকিবেক বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০৬]।
[খ] দুৰ্ভাগ্যক্রমে যাহারা অল্প বয়সে বিধবা হয়, তাহারা যাবজীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, এবং বিধবাবিবাহেব প্রথা প্রচলিত না থাকাতে, ব্যভিচার্দোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত যে উত্তরোত্তব প্রবল হইয়া উঠিতেছে, ইহা, বোধ করি, চক্ষকৰ্ণবিশিষ্ট ব্যক্তিমাত্ৰেই স্বীকার করিবেন। অতএব, হে পাঠক মহাশয়বর্গ। আপনারা অন্ততঃ কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত, স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া বলুন, এমন স্থলে, দেশাচারের দাস হইয়া, শাস্ত্রের বিধিতে উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্বক, বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত না। করিয়া, হতভাগা বিধবাদিগকে যাবজীবন অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করা, এবং ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হইতে দেওয়া উচিত; অথবা দেশাচারের অনুগত না হইয়া, শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত কবিয়া, হতভাগা বিধবাদিগের অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণা নিরাকরণ এবং ব্যভিচাব্দোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোত নিবারণ করা উচিত বিদ্যাসাগর [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮)]।
[গ] তোমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮)]।
[ঘ] হতভাগা বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হওয়া কঠিন এবং ব্যভিচারদোষের ও ভূণহত্যাপাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। তোমরা প্রাণত্তুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্ৰণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ, তাহারা, দুর্নিবাররিপুবশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ, ধর্মলোপভায়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ক্রুণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্যযন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে… সন্মত নহ। [বিদ্যাসাগর (১৮৫৫খ, ৮৩৮-৮৩৯)]।
বিদ্যাসাগরের রূপকগুলো লক্ষ্য করার মতো : শরীর জ্বলে উঠেছে লেলিহান আগুনের মতো, পাপ বয়ে চলেছে নদীস্রোতের মতো;–যাবজীবন অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানল’, ‘ব্যভিচারদোষের ও ভ্রাণহত্যাপাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত’ প্রভৃতি রূপক চোখের সামনে নারীর অতৃপ্ত শরীরটিকে যেমন উপস্থিত করে, তেমনি হাজির করে ভারতীয় কামোর্ত লম্পট পুরুষ জাতিটিকে। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন জীবন হচ্ছে কাম, ব্ৰহ্মচর্য জীবন নয়। বিদ্যাসাগর ‘ব্যভিচারদোষ’ ও ‘ত্ৰাণহত্যাপাপের স্রোত’-এর কথা বলেছেন, এজন্যে তিনি বিধবাকে দায়ী করেন নি; বিধবাকে তিনি তার সময়ের ধর্মপ্ৰাণ সামাজিকদের মতো একেকটি সম্ভাব্য বারাঙ্গনা মনে করেন নি, তিনি দায়ী করেছেন সমাজকেই। বিদ্যাসাগর এ-রূপকগুলো ব্যবহার ক’রে স্বীকৃতি জানিয়েছেন নারীর শরীরকে, শরীরকে ক’রে তুলেছেন জীবনী; এবং এগুলো দিয়ে আক্রমণ করেছেন তাঁর সময়ের ভণ্ড সমাজকে। বিধবা একা ব্যভিচার করতে পারে না, একা জন্ম দিতে পারে না ভুণ, তার জন্যে দরকার কোনো ধাৰ্মিক পুরুষ, তিনি তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রামমোহন উদার নারীবাদী; আর বিদ্যাসাগর আমূল নারীবাদী, যিনি শরীরকে ক’রে তুলেছেন জীবন।
রামমোহন ও বিদ্যাসাগর সহমরণ নিবারণে, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণে বিষ দিয়ে বিষ ক্ষয়ের চেষ্টা করেন : শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে বাতিল ক’রে প্রবর্তন করেন নববিধান। তারা কি বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে? রামমোহন হয়তো কিছুটা করতেন, কিন্তু বিদ্যাসাগরের ওই শাস্ত্ৰে বিশ্বাস ছিলো না বিন্দুমাত্ৰ; কিন্তু তারা জানতেন মধ্যযুগীয় এ-অঞ্চলে এটাই উপায়। যুক্তি এখানে মূল্যহীন, মূল্যবান এখানে পুরোনো শ্লোক। বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৬৯৫-৬৯৬) বলেছেন, যদি যুক্তিমাত্র অবলম্বন করিয়া, ইহাকে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন কর, তাহা হইলে, এতদেশীয় লোকে কখনই ইহা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিবেন না। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন। এরূপ বিষয়ে এদেশে শাস্ত্ৰই সর্বপ্ৰধান প্ৰমাণ, এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে।’ তাই তাঁরা দুজনেই ঘেঁটেছেন শাস্ত্ৰ, শাস্ত্র থেকে নিয়েছেন সে-সব অংশ, যা তাদের পক্ষে। তারা শাস্ত্রকে প্রমাণ হিশেবে নিয়েছেন এজন্যে নয় যে তারা ওই শাস্ত্রের সাথে একমত, তারা ওই শাস্ত্ৰ নিয়েছেন কেননা ওই শাস্ত্ৰ তাদের সাথে একমত। তাদের দুজনের জন্যে এটা ছিলো বিশেষ সুবিধাজনক; পাণ্ডিত্যে ও মেধায় তারা তাদের প্রতিপক্ষের থেকে এতো শ্রেষ্ঠ ছিলেন যে তাদের পরাজিত করা ছিলো অসম্ভব। তারা শাস্ত্ৰে বিশ্বাস করতেন না, বিশ্বাস করতেন আইনে, তাই শাস্ত্ৰ দিয়ে তাঁরা প্রথাগ্রস্ত দেশবাসীদের কাবু ক’রে প্রবর্তন করেন আইন। তারা জানতেন আইন ছাড়া অসম্ভব হবে। সহমরণ নিবারণ, বা বিধবাবিবাহ প্রবর্তন; এবং এও জানতেন যদি তাদের দেশবাসী তাঁদের যুক্তি মেনে নেয়, কিন্তু আইন প্রণীত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আবার দেখা দিতে পারে সহমরণপ্ৰথা, নিষিদ্ধ হতে পারে বিধবাবিবাহ। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর যদি উনিশ শতকে ওই আইন পাশ না করাতেন, তাহলে বিশশতকে গান্ধির ভারতবর্ষে ওই আইন কখনো প্রবর্তিত হতো না; কেননা বিধবা হতো দুষ্ট রাজনীতিকদের জন্যে চমৎকার রাজনীতি। বিদ্যাসাগর (১৮৭১, ৮৮৪-৮৮৫) কেনো আইন চেয়েছেন, তা শোনার মতো :
‘কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন… বহুবিবাহ সামাজিক দোষ; সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কাৰ্য সে বিষয়ে গবৰ্ণমেণ্টকে হস্তক্ষেপ করিতে দেওয়া কোনও ক্রমে বিধেয় নহে।
এই আপত্তি শুনিয়া আমি, আমি কিয়াৎ হাস্য সংবরণ করিতে পারি নাই। সামাজিক দোষের সংশোধন সমাজের লোকের কার্য, এ কথা শুনিতে আপাততঃ অত্যন্ত কর্ণসুখকর …
যাহারা এই আপত্তি করেন, তাহারা নবা সম্প্রদায়েব লোক। নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যাহারা অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ ও বহুদশী হইয়াছেন, তাহারা অর্বািচীনের ন্যায়, সহসা এরূপ অসার কথা মুখ হইতে বিনিৰ্গত করেন না। হই যথাৰ্থ বটে, তাহারাও এক কালে অনেক বিষয়ে অনেক আস্ফালন কবিতেন,… কিন্তু এ সকল পঠদ্দশার ভাব। তাহাবা পঠদ্দশা সমাপন করিয়া বৈষয়িক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে ক্রমে, পঠদ্দশার ভাবের তিরোভাব হইতে লাগিল। অবশেষে, সামাজিক দোষের সংশোধন দূরে থাকুক, স্বযং সেই সমস্ত দোষে সম্পূর্ণ লিপ্ত হইয়া, সচ্ছন্দ চিত্তে কালব্যাপন করিতেছেন।‘
বাঙলা ও বাঙালি এখনো এমনই আছে; ছাত্রজীবনেই তারা প্ৰগতিশীল পরে প্রতিক্রিয়াশীল। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন। এদের বিশ্বাস করেন নি, বিশ্বাস করেছেন আইনে। আইনই নতুন কালের শাস্ত্ৰ।
রামমোহন লিখেছেন সম্বাদ, তিনি তাঁর প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেছেন পুরোনো দার্শনিক সংলাপের কাঠামোতে; বিদ্যাসাগর লিখেছেন প্রস্তাব, তিনি সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে। রামমোহনের সময় বাঙলা গদ্যের, এবং রামমোহন নিজের বাঙলা গদ্যোর, যে-অবস্থা ছিলো, তাতে বিদ্যাসাগরের মতো সরাসরি তীব্র গবেষণাধর্মী প্ৰস্তাব লেখা সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে: তাই তিনি প্রবর্তক-নিবর্তকের বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিপাদন করেছেন যে শাস্ত্রে রয়েছে বিধবার বেঁচে থাকার বিধান। শুধুই বেঁচে থাকা, এর বেশি নয়; বিধবা বেঁচে থেকে পালন করবে ব্ৰহ্মচর্য, আর কিছু নয়। রামমোহনের প্রবর্তক হচ্ছে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের উনিশশতকী দেশাচারগ্রস্ত রূপটি, যেটি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো সব দিকে, এবং রামমোহন তাদো করেছেন দুর্বল থেকে দুর্বলতর } রামমোহন প্রবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের পুরোনো সমস্ত কথা; নিবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের সাথে মানবতাবাদী যুক্তি, যার আক্রমণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে প্রবর্তক। সম্বাদ-এর শুরুতেই রামমোহন (১৮১৮, ১৬৯) প্রবর্তকের সংলাপে পেশ করেছেন। পুরোনো সংস্কার :
‘স্বামী মবিলে পর যে স্ত্রী ঐ পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতী যে বশিষ্ঠের পত্নী তাহার সমান হইয়া স্বর্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বৰ্গে বাস করে। আর যেমন সৰ্পগ্রাহকেরা আপন বলের দ্বারা গৰ্ত্ত হইতে সর্পকে উদ্ধার করিয়া লয় তাহার ন্যায় বলের দ্বারা ঐ স্ত্রী স্বামীকে লইয়া তাহার সাহিত সুখ ভোগ করে। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন কবে সে মাতৃকুল পিতৃকুল এবং স্বামিকুল এই তিনি কুলকে পবিত্র করে। আর অন্য স্ত্রী হইতে শ্ৰেষ্ঠ এবং শ্ৰেষ্ঠ ইচ্ছাবতী আর স্বামীর প্রতি অত্যন্ত শ্ৰদ্ধাযুক্ত যে ঐ স্ত্রী সে পতির সহিত তাবৎ পৰ্যন্ত স্বর্গ ভোগ করে যাবৎ চতুৰ্দশ ইন্দ্ৰপাত না স্থায়; আর পতি যদি ব্ৰহ্মহত্যা করেন। কিম্বা কৃতঘ্ন হয়েন কিম্বা মিত্রহত্যা করেন তথাপি ঐ পতিকে সৰ্ব্বপাপ হইতে মুক্ত করে ইহা অঙ্গিরামুনি কহিয়াছেন। স্বামী মরিলে সাধী স্ত্রী সকলের অগ্নি প্ৰবেশ ব্যতিরেকে আর অন্য ধৰ্ম্ম নাই।‘
প্রবর্তক গ্ৰহণ করেছে। হারীত, অঙ্গিরার মত; রামমোহন গ্ৰহণ করেছেন। মনুর মত। রামমোহন বারবার যে-শাস্ত্ৰবাক্যটির হাতুড়ি পিটিয়েছেন, সেটি মনুর : ‘স্ত্রীলোক পতির কাল হইলে পর ব্ৰহ্মচয্যের দ্বারা মোক্ষ সাধন করিবেন।’ রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ভাগ্য ভালো যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পরস্পরবিরোধী বিধানের সমষ্টি; ওই পরস্পরবিরোধী বিশাল ভাণ্ডার থেকে বচন উদ্ধার ক’রে যে-কোনো কিছুকে শাস্ত্রসম্মত বলে প্রমাণ করা সম্ভব, অপ্রমাণও সম্ভব। রামমোহনের আশ্রয় মনু, যে-মনু নারীকে বহু তিরষ্কার ক’রে একটিমাত্র কৃপা করেছিলেন : ব্ৰহ্মচর্য পালন ক’রে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছিলেন দ্র। ‘দেবী ও দানবী’, ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। রামমোহন স্বীকার করেছেন শাস্ত্ৰে সহমরণের বিধান রয়েছে, কিন্তু তিনি নির্ভর করেছেন বিকল্পবিধানের ওপর। তিনি (১৮১৯, ১৯০) শাস্ত্ৰবাক্যকে ব্যাকরণবিদ-যুক্তিশাস্ত্রীর মতো ভেঙে ভেঙে বের করেছেন বিকল্প বিধানটি :
‘পতি ১ মরিলে ২-ব্ৰহ্মচৰ্য্য ৩ অথবা ৪ সহগমন ৫। অতএব ব্ৰহ্মচর্য্যের প্রথম গ্রহণ দ্বারা ব্ৰহ্মচৰ্য্য বিধবার শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম হয়।‘
বিধবার সহমরণও রামমোহন মেনে নিতে প্ৰস্তুত ছিলেন, যদি তা স্বেচ্ছাসহমরণ হয়। নিবর্তক (১৮১৮, ১৭৩) প্রশ্ন করেছে : ‘তোমাদের রচিত সংকল্পবাক্যেতে স্পষ্ট বুঝাইতেছে যে পতির জ্বলন্ত চিতাতে স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক আরোহণ করিয়া প্ৰাণ ত্যাগ করিবেক কিন্তু তাহার বিপরীত মতে তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ় বন্ধন কর পরে তাহার উপর এত কাষ্ঠ দেও যাহাতে ঐ বিধবা উঠিতে না পারে।’ তিনি স্বেচ্ছাসহমরণ মেনেছেন, কেননা তিনি জানতেন অধিকাংশ নারী স্বেচ্ছাসহমরণে যায় না। বা যাবে না; তাদের বাধ্য করা হয় সহমরণে। প্রবর্তক সহমরণ চায় কলঙ্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্যে, তার কাছে নারী হচ্ছে সম্ভাব্য কলঙ্ক। প্রবর্তকের (১৮১৮, ১৭৪) মতে, ‘স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সহমরণ করিলে এ আশঙ্কা থাকে না জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও যদি জীবৎকালে জানিতে পারে তবে তাহারো মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনো চিন্তা হয় না।’ সম্ভাব্য কলঙ্ক থেকে বাচার উপায় বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা; যেনো তারা কোনো মানুষকে পোড়ায না, পোড়ায় কলঙ্ককে!
রামমোহন প্রথম সম্বাদ শেষ করেছেন। সহমরণ সম্পর্কে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের মনকে কিছুটা কোমল ক’রে; কিন্তু তার মন অতো সহজে গলার বস্তু নয়। তাই রামমোহনকে লিখতে হয় দ্বিতীয়, দীর্ঘতর, প্রস্তাব; এতে তাঁর একটিই প্রতিপাদ্য : ‘ভৰ্ত্তার মৃত্যু হইলে পর, স্ত্রী ব্ৰহ্মচৰ্য্য করবেন।’ রামমোহন বিধবাকে বঁচিয়ে রাখার জন্য মেনে নিয়েছেন নিষ্কাম ধর্ম, কামনাকে গণ্য করেছেন পাপ; এমনকি স্বৰ্গকামনাও তাঁর কাছে পাপ। পিতৃতন্ত্র নিজের স্বাৰ্থ উদ্ধারের জন্যে নারীকে যে-কোনো স্তব করতে পারে, দেখাতে পারে যে-কোনো প্রলোভন। তিনি (১৮১৯, ১৯২) প্রশ্ন করেছেন, ‘স্বর্গের প্রলোভ দেখাইয়া এরূপ অবলা স্ত্রীবধেতে প্ৰবৰ্ত্ত হওয়াতে কি স্বাৰ্থ দেখিয়াছেন?’ আবার (১৮১৯, ১৯৪) প্রশ্ন করেছেন, তবে বিধবাকে স্বৰ্গ কামনাতে প্রলোভ কেন দেখান? মুক্তিসাধন নিষ্কাম কৰ্ম্মে কেন প্ৰবৰ্ত্ত না করান?’ স্বর্গের প্রলোভন দেখানো যে প্রতারণা রামমোহনের কাছে তা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। স্বর্গের প্রলোভনে নারী যদি সহমরণে না যায়, তখন হিন্দু পিতৃতন্ত্র কী করে? তখন বিধবাকে ‘বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ’’’ করে, এটা ‘দেশাচারপ্রযুক্ত সৎকৰ্ম্ম। রামমোহন বলেছেন, এটা দসু্যুবৃত্তি। যেভাবেই হোক হিন্দু পিতৃতন্ত্রকে মুক্তি পেতে হবে বিধবার ভার থেকে, তাই তার শেষ যুক্তি হচ্ছে নারীনিন্দা রামমোহন (১৮১৮, ২০১)] :
‘স্ত্রীলোক স্বভাবত অল্পবুদ্ধি, অস্থিরান্তঃকরণ, বিশ্বাসের অপত্র, সানুবাগা, এবং ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্য হয়। স্বামীর পরলোক হইলে পর, শাস্ত্রানুসারে পুনরায় বিধবার বিবাহ হইতে পারে না, এককালে সমুদায় সাংসারিক সুখ হইতে নিরাশ হয়, অতএব এ প্রকার দূর্ভাগা যে বিধবা তাহার জীবন অপেক্ষা মরণ শ্ৰেষ্ঠ।‘
রামমোহন একটি একটি করে উত্তর দিয়েছেন এসবের। তার উত্তরের মধ্যে ধরা পড়েছে বলতন্ত্রের পীড়নের রাজনীতিক রামমোহন (১৮১৮, ২০২)। রূপটি :
‘প্রথমত বুদ্ধির বিষয়, স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইযাছেন যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়। ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?’
আধিপত্যকারী শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অধীন শ্রেণীকে কোনো অধিকার, দায়িত্ব দেয় না; না দিয়ে দিয়ে তাদের ক’রে তোলে সম্পূর্ণ অযোগ্য, এবং শেষে ঘোষণা করে যে অধীনের সহজাতভাবেই অযোগ্য। তাদের দণ্ডিত করা হয় সে-অযোগ্যতায়, যে-যোগ্যতা তাদের অর্জন করতে দেয়া হয় নি। রামমোহন দেখিয়েছেন নারীর বুদ্ধিাচৰ্চা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়ে তাদের নিন্দিত করা হয়েছে নির্বোধ অল্পবুদ্ধি ব’লে, তবে এটা তাদের সহজাত স্বভাব নয়; পুরুষতন্ত্রের পীড়নেরই ফল। নারী কি ‘অস্থিরান্তঃকরণ’ ‘বিশ্বাসের অপাত্রে? ‘সানুরাগা’ অর্থাৎ পাবপুরুষাসক্ত? ‘ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্যা’ তিনি দেখিয়েছেন নারীর বিরুদ্ধে এগুলো মিথ্যে অভিযোগ; আর এসব দিকে নারী পুরুষের থেকে অনেক উ ৎকৃষ্ট। সে-উৎকৃষ্ট নারী পুরুষের দাসী (১৮১৮, ২০২-২০৩) : ‘স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জন, ভোজনাদি পাত্রে মার্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কৰ্ম্ম করিয়া থাকে; এবং সূপকারের কৰ্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাতিতে করে…।’ নারী এমন দাসী, যাকে উঠতে হয় প্রভুর চিতায়! তিনি স্বেচ্ছাসহমরণও মেনে নিয়েছেন, চেয়েছেন ‘এই পৰ্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনীদের যেনো বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ করা থেকে রক্ষা করা হয়।
রামমোহন তাঁর ‘সম্বাদ’ লিখেছেন নৈর্ব্যক্তিক রীতিতে; কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে তার সকাতর আবেগ। তার প্রস্তাবগুলো অভিসন্দর্ভ হিশেবে অসামান্য, কিন্তু তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কেঁপেছেন আবেগে। তিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে, ওই পিতৃতন্ত্র তার সাথে যে-নিষ্ঠুরতা করেছে, তা তিনি ভোলেন নি। তিনি নারীকে শুধু নিশ্বাসের অধিকার নয়, দিতে চেয়েছেন জীবনের অধিকার, তাই তাঁর লড়াই ছিলো আরো রক্তাক্ত। সহমরণ নৃশংস বলে তার নিবারণও সহজ, সহজেই মানুষ ও জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে নারীকে পোড়ানো নৃশংসতা। কিন্তু যাদের সংবেদনশীলতা আদিম, তাদের বোঝানো অত্যন্ত কঠিন যে ব্ৰহ্মচর্য পালন করে বেঁচে থাকা চিতায় ছাই হওয়ার থেকেও মর্মান্তিক। নারীর আর্থ ও অন্যান্য স্বাধীনতা চাওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিলো না, তিনি তা চান নি; চেয়েছেন জীবনযাপনের অধিকার। তিনি নারীর দেহকে মূল্য দিয়ে, নারীর দেহকে স্বীকার ক’রে হয়ে উঠেছেন একজন আমূল নারীবাদী; এবং উনিশশতকের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ। একটি আদিম পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি একজন আধুনিক মানুষ দাঁড়ালে তাকে যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তার সবখানিই ভোগ করেছেন বিদ্যাসাগর; তাঁর বুকে ক্ষোভও জেগেছে অশেষ। হিন্দু পিতৃতন্ত্র তাকে সহ্য করে নি; অমূল্যচরণ বসু জানিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভুক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে। কলিকাতার কোন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুৰ্বত্তেরা প্রভুর আজ্ঞা পালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদগণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ-প্ৰহারের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন’ (বিনয় (১৯৭৩, ২৬৮)। এ হচ্ছে বিপন্ন পিতৃতন্ত্রের ইতির আচরণ। প্রিয় বালিকা প্রভাবতীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (প্ৰভাবতী সম্ভাষণ, ৪১৯) :
‘তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয, আমার বোধে অতি সুবোধের কার্য কবিযািছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয় ত, অদৃষ্টদ্বৈগুণ্যবশতঃ অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জীবনযাত্রাব সমাধান কবিতে পারিতে না।‘
বেঁচে থাকার চেয়ে ভারতে নারীর ম’রে যাওয়াও তার কাছে মনে হয়েছে ‘সুবোধের কাৰ্য’; বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব-এ (১৮৫৫খ, ৮৩৯) বলেছেন, ভারতবর্ষে যেনো ‘হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’, আর্তনাদ করেছেন, ‘হা অবলা গণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর।’ এ-ক্ষুব্ধ বিলাপ থেকেই বোঝা যায়। এ-মহৎ আমূল নারীবাদীকে কতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিলো নির্বোধ হিন্দু পিতৃতন্ত্র।
নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে বিদ্যাসাগর লিখেছেন ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামের একটি প্রবন্ধ, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব-প্রথম পুস্তক (১৮৫৫), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব- দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার-প্রথম পুস্তক (১৮৭১), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত। কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার—দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩) নামের চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্ৰন্থ, এবং ব্রজবিলাস (১৮৮৪) নামের একটি বিদ্রুপাত্মক প্ৰতিআক্রমণাত্মক বই। বিদ্যাসাগরের রচনাবলির এক বড়ো অংশ নারীকল্যাণমূলক রচনা, এবং ওগুলো মানবিকতা, পাণ্ডিত্য, ও যুক্তিতে অসাধারণ। শাস্ত্ৰে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু শাস্ত্ৰ দিয়েই তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিলো যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, বহুবিবাহ শাস্ত্রবিরোধী। আধুনিক কালের এক বড়ো ট্র্যাজেডি হচ্ছে একে চলতে হয় পুরোনো কালের বিধান দিয়ে, কেননা তা স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত কল্পিত ফলমৃগতৃষ্ণায় মুগ্ধ’, এবং বিদ্যাসাগরকে তা ঘেটে দেখাতে হয়। বর্তমানকালসন্মত বিধান, যদিও তাতে তাঁর বিশ্বাস নেই, ও তিনি নিজেই লিখতে পারতেন ওই সব পুরোনো বস্তুর থেকে অনেক উৎকৃষ্ট শাস্ত্ৰ। নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে তিনি শুরু করেছেন শেকড় থেকেবাল্যবিবাহ থেকে; কেননা বাল্যবিবাহই বলবিধবা উৎপাদনের প্রধান ব্যবস্থা। তার মতে, অল্প বয়সে যে বৈধব্যদশা উপস্থিত হয়, বাল্যবিবাহই তাহার মুখ্য কারণ; সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় ও নৃশংসের কর্ম’ (‘বাল্যবিবাহের দোষ’, ৬৮৫); ‘বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার। এবং এই বিচিত্ৰ সংসার তাহার পক্ষে জনশূন্য অরণ্যাকার’ (ওই, ৬৮৪)। বিধবাকে তিনি জনশূন্য বনবাস থেকে মুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানবিক সংসারে।
বিদ্যাসাগর শাস্ত্ৰ মেনেছেন, কেননা লোকে শাস্ত্ৰ মানে, এবং তিনি শাস্ত্রে পেয়েছেন তাঁর প্রস্তাবের সমর্থন। যদি তিনি সমর্থন না পেতেন। শাস্ত্রে, তাহলে কী করতেন বিদ্যাসাগর? তিনি কি শাস্ত্ৰকেই শেষ কথা বলে মানতেন? না, তিনি বাতিল ক’রে দিতেন। শাস্ত্রকে; হয়তো দেখাতেন। ওই সব শাস্ত্রের কাল শেষ কয়ে গেছে, ওই সব শাস্ত্ৰ কলিকালের জন্যে নয়। শাস্ত্র কী? বিদ্যাসাগর প্রথমে দেখান শাস্ত্র হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র; আর মনু, অত্রি, বিষ্ণু, হারােত, যাজ্ঞবল্ক্য, উশনাঃ, আঙ্গিরা, যম, আপস্তম্ব, সংবর্ত, কাত্যায়ন, বৃহস্পতি, পরাশর, ব্যাস, শঙ্খ, লিখিত, দক্ষ, গোত, শাতাতপ, বশিষ্ঠ প্রমুখ ধর্মশাস্ত্ৰকৰ্তা। এর মাঝে উনিশটিকে বাতিল ক’রে বিদ্যাসাগর রেখেছেন একটিকে, কেননা সেটি তাকে সমর্থন করে; যদি সমর্থন না করতো তাহলে সেটিকেও বাতিল করতেন। তিনি। তিনি স্বীকার করেছেন। পরাশর সংহিতাকে। মনু বলেছেন, ‘কলিযুগের ধর্ম অন্য’, আর পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ে আছে : ‘পরাশরনিরূপিত ধৰ্ম কলিযুগের ধর্ম।’ পরাশর বলেছেন ব’লেই বিদ্যাসাগর তাকে মেনেছেন, তা নয়; তিনি পরাশরকে স্বীকার করেছেন, কেননা তাতে রয়েছে বিধবার বিয়ের বিধান। তাই তিনি অন্য সব শাস্ত্ৰ বাতিল ক’রে বলেছেন, ‘কলিযুগের লোক পূর্ব পূর্ব যাগের ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে অক্ষম’ (১৮৫৫ক, ৬৯৭); স্থির করেছেন : ‘পরাশরসংহিতা কলিযুগের ধর্মশাস্ত্ৰ’ (১৮৫৫ক, ৬৯৯)। বাতিল অন্য সব শাস্ত্র। পরাশর বলেছেন বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) :
‘স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগেব পুনর্বাবে বিবাহ করা শাস্ত্ৰবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বৰ্ণলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বৰ্গে বাস করে।‘
স্বৰ্গলাভের কোনো মোহ তার ছিলো না, নারী বিয়ে কবতে পারলে স্বর্গের কোনো দরকার বোধ করবে। ব’লেও তার মনে হয় নি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ‘রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে।’ পরাশরের বিধানের বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) দিয়েছেন। এ-ভাষ্যে :
‘পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন, বিবাহ, ব্ৰহ্মচৰ্য, সহগমন। তন্মধ্যে, বাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে বিবাহ ও ব্ৰহ্মচৰ্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্ৰহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন কবিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান পরাশব সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন।‘
পরাশর প্রথমেই দিয়েছেন বিয়ের বিধি। প্রশ্ন জাগে রামমোহন কেনো খুঁজে পান নি। পরাশরের এ-বিধিটি, তাকে কেনো সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো মনুর বিধি নিয়েই যে বিধবা ব্ৰহ্মচর্য পালন করবে বা সহমরণে যাবে? রামমোহন কি পেয়েও এড়িয়ে গিয়েছিলেন বিধিটিকে? তিনি কি, ১৮১৮-তে, মনে করেছিলেন যে প্ৰাণই যথেষ্ট নারীর জন্যে, ব্ৰহ্মচৰ্যই নারীর জীবন? রামমোহন কি মনে করেছিলেন বিধবার জন্যে প্ৰাণের বেশি কিছু চাইতে গেলে পণ্ড হবে সব কিছু, বা তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন যে বিধবার বিয়ে হওয়া ঠিক নয়? কিন্তু আটত্রিশ বছরেই দেখা যায় প্রাণই যথেষ্ট নয়- ‘কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।’ যে-বিধবা ছিলো সামান্য নিশ্বাস, মাত্র আটত্রিশ বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগর দাবি করেন যে তার রয়েছে একটি শরীর, তার রয়েছে কামনাবাসনা, আর ওই শরীরে রিপুরা অন্যান্য শরীরের মতোই সক্রিয়। বিধবাদের বৈধব্যযন্ত্রণা ছাড়াও ছিলো আৰ্থনিরাপত্তাহীনতার সমস্যা; তাদের অধিকাংশের জীবনই ছিলো অবহেলিত দাসীর জীবন। বিদ্যাসাগর সে-সব প্রসঙ্গ তোলেন নি, মনে করেছেন বিয়ে হ’লে ওগুলো মিটবে। বিধবাকে বিয়ে দিয়ে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সম্পূর্ণরূপে: তাই তাদের ও সন্তানদের কী মর্যাদা হবে, তাও দেখিয়েছেন শাস্ত্র ঘেটে। তার চোখে কুমারী ও বিধবার কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু হিন্দু পিতৃতন্ত্র কেনো মেনে নেবে এ-মানবিকতা? তার পাণ্ডারা কি কোলাহল করবে না? মেতে উঠবে না। শাস্ত্রের শুদ্ধ-অশুদ্ধ ব্যাখ্যায়? তারা মেতে ওঠে; এবং তাকে লিখতে হয় দীর্ঘ দ্বিতীয় পুস্তক, যাতে প্রতিপাদ্য একই, কিন্তু শ্লোক আর যুক্তি অনেক বেশি। কিন্তু তিনি জানতেন শুধু শ্লোকে কাজ হবে না, আইন পাশ করাতে হবে। তা তিনি করিয়েছিলেন, বিধবাবিবাহের আইন পাশ হয় ১৬ জুলাই ১৮৫৬তে।
নারীকে সংসারে সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সুপরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যাসাগর কাজ শুরু করেছিলেন: তাই বিধবাবিবাহ প্রচলনের পর তার কাজ হয় বহুবিবাহ রহিত করা। এ-লড়াইয়ে নামতে হয়েছে বিদ্যাসাগরকে, কেননা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ না হ’লে তার নারী পুরুষতন্ত্রের পীড়ন থেকে বাঁচে না। বহুবিবাহ বিষয়ক তাঁর বই দুটি আকারে অনেক বড়ো, গবেষণা হিশেবে অসামান্য; এবং এ-দুটিতে তিনি হিন্দু কুলবিন্যাস ও পুরুষের কুৎসিত রূপ তুলে ধরেছেন বিস্তৃতভাবে। তিনি বিয়ে দিয়েছেন বিধবাকে, কিন্তু ওই বিয়ে জিনিশটি কী? বিয়ে হচ্ছে নারীর জন্যে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হওয়া; তিনি বলেছেন, ‘এ দেশে বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে বহুবিধ অনিষ্ট হইতেছে’ (১৮৭১, বিজ্ঞাপন। বহুবিবাহ নিষেধেও তিনি শাস্ত্ৰকেই নিয়েছেন প্রমাণ হিশেবে, কিন্তু তিনি শাস্ত্রের শেষে চেয়েছেন আইন। বহুবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকে তিনি প্রমাণ করেছেন : স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, নির্দিষ্ট নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যাদৃচ্ছিাক্রমে পুনরায় সবর্ণবিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত নহে’ (১৮৭১,৮৪৭)। তিনি দেখান যে ‘বল্লাল গুণ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; দেবীবর দোষ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছেন’ (১৮৭১, ৮৫৮)। দেবীবর ঘটক কুলীনদের দোষের তালিকা ক’রে যে-কুলবিন্যাস করেন, তাকে বলা হয় ‘মেলবন্ধন’, এবং এরই ফলে দেখা দেয়। বহুবিবাহ। আগে অনেক বেশি ঘরে নারীদের বিয়ে দেয়া যেতো, কিন্তু মেলবন্ধনের ফলে বিয়ে দেয়ার মতো ঘরের সংখ্যা ক’মে যায়। কিন্তু নারীদের বিয়ে দিতেই হবে; তাই দেখা দেয় বহুবিবাহ! কুল কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়; তিনি দেখিয়েছেন, ‘কুলীন মহাশয়েরা যে কুলের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আছেন, তাহা বিধাতার সৃষ্টি নহে’ (১৮৭১,৮৬২), নিতান্তই দেবীবর ঘটকের সৃষ্টি। বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘যদি ধর্ম থাকেন, রাজা বল্লাল সেন ও দেবীবর ঘটকবিশারদ নিঃসন্দেহে নরকগামী হইয়াছেন।’ (১৮৭১, ৮৬৮)। বিদ্যাসাগর দিয়েছেন কুলীনদের অমানুষিক বর্বরতার পরিচয়; বলেছেন, ‘এ দেশের ভঙ্গকুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই’ (১৮৭১, ৮৬৯)। তাঁর এ-পুস্তক হিন্দু পিতৃতন্ত্রের পরোহিতদের উত্তেজিত করে, তারা শাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন বিদ্যাসাগরের ওপর। তখন তিনি লেখেন। দ্বিতীয় প্রস্তক; একে একে তর্কবাচস্পতিপ্রকরণ, ন্যায়রত্নপ্রকরণ, স্মৃতিরত্নপ্রকরণ, সামশ্রমিপ্রকরণ, কবিরত্নপ্রকরণ প্রভৃতি পরিচ্ছেদে খণ্ডন করেন পিতৃতন্ত্ররত্নদের শ্লোক ও যুক্তি। কিন্তু তিনি বহুবিবাহ রহিত করতে পারেন নি।
রামমোহন হিন্দু বিধবার প্রাণদাতা, বিদ্যাসাগর জীবনদাতা; তবে প্ৰাণ দেয়ার চেয়ে জীবন দেয়া অনেক কঠিন। বিধবাকে এখন আর চিতায় উঠতে হয় না, যদিও ভারতে আবার সহমরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু হিন্দু বিধবা আজো জীবনে স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা পায় নি। এখনো বিধবার বিয়ের কথায় হিন্দু পিতৃতন্ত্র বিচলিত হয়ে ওঠে; এমনকি বিধবারাও কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে। প্রথাবাদের ভারতীয় অঞ্চলে জীবনের থেকেও শক্তিশালী প্রথা।