২০. রাত বাজছে নটা

রাত বাজছে নটা। ইমন পুরানো ঢাকার একটা বোর্ডিং হাউসে। বোর্ডিং হাউসের নাম ঢোকার সময় পড়া হয় নি, মনে হয়। এই বোর্ডিং হাউসের কোন নাম নেই। গলির ভেতর গলি, তার ভেতর গলি বেয়ে বেয়ে শোভনের সঙ্গে যে বাড়ির সামনে এসে সে দাঁড়িয়েছিল, সেই বাড়ি এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই রহস্য। ইমন বলল, ভাইয়া ভূতের বাড়ি না-কি?

শোভন বলল, ভূতের বাড়ি হবে কেন? বোর্ডিং হাউস।

তুমি কি আগে এখানে থাকতে?

মাঝে মাঝে থাকতাম। আমার কোন পার্মানেন্ট এড্রেস নেই। খুব যারা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তাদের পার্মানেন্ট এড্রেস থাকে না। আমি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।

বোর্ডিং হাউসে ঢোকার পর বোঝা গেল শোভন আসলেই একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। প্রায় ছোটাছুটি পরে গেল। ম্যানেজার এসে জড়িয়ে ধরলেন। বাকি যারা আসছে তাদের বেশির ভাগই পা ছুঁয়ে সালাম করছে। শোভন বলল, ঘর আছে?

ম্যানেজার হতভম্ব গলায় বলল, ঘর থাকব না কি কন?

গরম পানি লাগবে, গোসল করব।

খানা কখন দিব?

একটু রাত করে দিবেন। ঘর খুলে দেন। তিন নম্বর ঘর খালি আছে?

খালি নাই। খালি করতেছি। পাঁচটা মিনিট সময় দেন। একটা সিগারেট ধরান শোভন ভাইয়া। সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই ঘর রেডি হয়ে যাবে।

ইমন তিন নম্বর ঘরের খাটের উপর বসে আছে। ঘরটা বড়। ডাবল খাট, চেয়ার টেবিল। মেঝেতে কাপেট। খাটের পাশের সাইড টেবিলে টেলিফোন। তবে ঘরের দেয়াল ময়লা, কার্পেট ময়লা, খাটে বিছানো চাদরও ময়লা। মাথার উপরে ছাদে মাকড়শার বুলি জমে আছে। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার এই ঘরে কোন জানালা নেই। দিনে আলো না জুলিলে কিছু দেখা যাবে না। তিন নম্বর ঘরের এত নাম ডাক কি জানালা না থাকার কারণে? নাকি এই বোর্ডিং হাউসের বিশেষত্ব হচ্ছে এর কোন ঘরেই জানালা নেই।

অনেকক্ষণ হল ইমন বসে আছে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম নেই। গোসল করার জন্য শোভন তোয়ালে সাবান নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছে, প্ৰায় এক ঘণ্টা হল এখনো ফিরছে না।

অসম্ভব রোগা একটা ছেলে কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকে টেবিলের উপরে কিছু জিনিসপত্র রেখে গেছে। যা দেখে ইমনের বুকের ধ্বক ধ্বকানি বেড়ে গেছে। দুটা গ্লাস, পানির বোতল, বরফ ভর্তি একটা বাটি এবং পেট মোটা চ্যাপ্টা সাইজের একটা বোতল। বোতলের ভেতর কি আছে তা লেবেল না পড়েও বলে দেয়া যাচ্ছে।

শোভন ঘরে ঢুকল মাথা মুছতে মুছতে, একটা তোয়ালে তার কোমরে জড়ানো, অন্য একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে। সে আনন্দিত গলায় বলল, এমন আরামের গোসল আমি লাইফে করিনি। তুই গোসল করবি? গোসল করলে বল গরম পানি দিতে বলি।

ইমন বলল, না।

আরাম করে গোসল কর। আজ রাতে বাসায় ফিরে কোজ নেই, থেকে যা আমার সঙ্গে। গল্প করি।

মা চিন্তা করবে।

করুক কিছু চিন্তা। মাদের চিন্তা করা দরকার। চিন্তা না করলে তাদের হজমের অসুবিধা হয়।

ভাইয়া আমি চলে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে। খাওয়া দাওয়া করে যা। রাত যতই হোক কোন অসুবিধা নেই। সঙ্গে লোক যাবে। বাড়ির গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। একটু গলা ভিজাবি?

না।

এই জিনিস আগে কখনো খেয়েছিস?

উহুঁ।

তাহলে চামচে করে এক চামচ খেয়ে দেখ। সব কিছুর অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। খারাপের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। ভালর অভিজ্ঞতাও থাকা দরকার।

ভাইয়া তুমি খাও। আমি খাব না।

থাক খেতে না চাইলে খেতে হবে না। তুই বরং একটা ঝাল লাচ্ছি খা। কাঁচা মরিচ দিয়ে লবণ দিয়ে এরা অসাধারণ একটা লাচ্ছি বানায়। বলব দিতে?

বল।

শোভন লাচ্ছির কথা বলে খাটে আরাম করে বসল। বরফ, পানির বোতল গ্রাস সাজিয়ে সে বসেছে। ইমনের দেখতে ভাল লাগছে। বেশ ভাল লাগছে।

মদ খাওয়াটা মনে হচ্ছে বিরাট আয়োজনের ব্যাপার। শোভন ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, এমন হা করে কি দেখছিস?

ইমন বলল, তোমাকে দেখছি। গোসলের পর তোমার চেহারাটা সুন্দর হয়ে গেছে।

শোভন হো হো করে হেসে ফেলল। ইমন বলল, ভাইয়া তুমি একটা গান করা শুনি।

শোভন বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস না-কি? আমি গান করব মানে, আমি কি হেমন্ত না-কি?

তোমার গলা হেমন্তের গলার চেয়েও সুন্দর।

এ রকম কথা বললে কিন্তু জোর করে তোকে মদ খাইয়ে দেব।

তুমি যে এতক্ষণ বাথরুমে গোসল করলে তখন গান করনি?

হুঁ করেছি।

ঐ গানগুলি কর।

শোভন সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু করল–

মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখা একা দ্বারের পাশে।।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে।।

ইমনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। মানুষের গানের গলা এত সুন্দর হয়? শোভন গান থামিয়ে গ্লাসে আবারো হুইস্কি নিল। ইমন কোমল গলায় ডাকল, ভাইয়া।

শোভন তাকাল। ইমন বলল, তোমার গানের গলা যে কত সুন্দর তা তুমি জান না।

আমার জানতে হবে না। তুই যে জেনে গেছিস তাতেই হবে। খাবি এক ঢোক?

খেলে হয় কি?

খেয়ে দেখ কি হয়। খানিকটা পেটে পড়লে আমার এই গান যত সুন্দর লাগছে তারচে হয়ত আরো বেশি সুন্দর লাগবে। হয়ত গান শুনতে শুনতে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবি। তোর ভালবাসার কেউ থাকলে তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে। সে রকম ইচ্ছা করলে কথা বলতে পারবি। টেলিফোন আছে।

ইমন বলল, গ্লাসে সামান্য একটু দাও খেয়ে দেখি।

খাবি যখন ভালমত খা, সাধ মিটিয়ে খা। আর কোনদিন না খেলেই হবে।

রাত দুটায় বেবীটেক্সী ইমনকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিল। সঙ্গে যে লোক এসেছিল সে বলল, স্যার, আপনাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হবে না নিজে নিজে যেতে পারবেন?

ইমন বলল, খুবই বমি আসছে।

বমি আসলে বমি করেন, তারপর ঘরে যান। বসে পড়ুন। বসে বমি করুন।

বসতে পারছি না।

ইমন লক্ষ্য করল সে যে বসতে পারছে না। তাই না, সে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছে না। চারদিক কেমন দুলছে। মনে হচ্ছে সে নৌকার ছাদে বসে আছে। পাল তোলা নৌকা। নৌকা দ্রুত চলছে, এবং খুব দুলছে। একবার ডান দিকে কাত হচ্ছে, একবার বাম দিকে।

লোকটা বলল, স্যার গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করুন দেখবেন আপনার ভাল লাগছে। বাসায় গিয়ে গরম পানিতে গোসল করে কড়া করে এক কাপ কফি খাবেন।

বাসায় কফি নেই।

বলতে বলতে ইমন বমি করল। বমি খানিকটা পড়ল। রাস্তায়। খানিকটা তার গায়ে। লোকটা বলেছিল বমি করলে ভাল লাগবে, কিন্তু ভাল লাগছে না। বরং আরো খারাপ লাগছে। যে নৌকাটায় সে দাঁড়িয়ে আছে, সেই নৌকাটা এখন অনেক বেশি দুলছে। ইমন চোখ মেলে থাকতে পারছে না। চোখের পাতা অসম্ভব ভারী। বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যে লোকটা তাকে নিয়ে এসেছে সে কলিং বেল টিপছে। বেবীটেক্সিওয়ালা তাকিয়ে আছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটের গন্ধে ইমনের পেটের ভেতর আবার পাক দিয়ে উঠল। সে আবারো বমি করল।

দরজা খুলেছে। ইমন দেখল। দরজার পাশে মা, মায়ের পাশে মিতু। মিতু এখানে কোথেকে এল। এত রাতে মিতুরতো এ বাড়িতে থাকার কথা না। মিতু লোকটার সঙ্গে কথা বলছে। মিতু এগিয়ে আসছে। না মিতু না, পাশের বাড়ির মেয়েটা। মেয়েটার নাম মনে পড়ছে না, তবে ম দিয়ে শুরু—ময়না, মায়া, মেরী, ও হ্যাঁ মুন্নী, মেয়েটার নাম মুন্নী।

মুন্নী এসে ইমনের হাত ধরল। ইমন বলল, মুন্নী কেমন আছ?

মুন্নী বলল, জ্বি আমি ভাল আছি। আসুন আপনি ঘরে আসুন।

দূর থেকে দেখে আমি ভাবলাম তুমি মিতু। মিতু হচ্ছে আমার মামাতো বোন।

জ্বি আমি জানি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন না—আসুন।

বেবীটেক্সীর ভাড়া দিতে হবে। মুন্নী তোমার কাছে টাকা আছে? লোকটা বলল, বেবীটেক্সীর ভাড়া আপনাকে দিতে হবে না। আপনি ঘরে যান।

সুরাইয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কোন কথা বলতে পারছেন না। ইমন মাকে দেখে সহজ গলায় বলল, তুমি এখনো জেগে আছ কেন মা? মুন্নী আছে-ও যা করার করবে। তুমি শুয়ে পড়।

সুরাইয়া বললেন, তুই কি খেয়ে এসেছিস?

ইমন হাসি হাসি মুখে বলল, তুমি যা সন্দেহ করছ, তাই খেয়েছি। এখন তুমি নিশ্চয়ই বিরাট বক্তৃতা শুরু করবে—তোর বাবা এই জিনিস কোনদিন ছয়ে দেখেনি। মা শোন, বাবা এই জিনিস ছুঁয়ে দেখেনি বলে যে আমিও ছুঁয়ে দেখব না। তাতো না। একেক মানুষ একেক রকম। এই মেয়েটা দেখতে মিতুর মত হলেও এ মিতু না। এর নাম মুন্নী।

মুন্নী বলল, খালা আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি দেখছি।

সুরাইয়া চলে যাচ্ছেন। তিনি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মুন্নী ইমনকে বাথরুমে নিয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, আপনি ট্যাপের নিচে বসুন। আমি ট্যাপ ছেড়ে দিচ্ছি। খুব ভাল করে সাবান মেখে গোসল করুন। আপনার সারা গায়ে বমি।

ঠান্ডা লাগছেতো।

ঠাণ্ডা লাগলেও কিছু করার নেই। আমি বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি গায়ের সব কাপড় খুলে গোসল করুন। আমি লুঙ্গি দিয়ে যাচ্ছি। গোসল শেষ হলে লুঙ্গি পরে আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দেব।

তুমি এই ব্যাপারটা মিতুকে বলবে না। মিতু শুনলে খুব রাগ করবে। ও ভয়ংকর রাগী।

আমি মিতুকে কিছুই বলব না।

মুন্নী তুমি কি গান জান?

না।

শোভন ভাইয়া খুব ভাল গান জানে। পুরো গান অবশ্যি কোনটাই জানে না। দুই লাইন, চার লাইন।

আপনি খুব ভাল মত সাবান ডলে গোসল করুন।

লাইফবয়ের এডের মত করে?

হ্যাঁ।

মুন্নী!

জ্বি।

মিতু গত চার মাস ধরে আমার সঙ্গে কথা বলে না।

হয়ত কোন কারণে রাগ করেছেন। রাগ কমে গেলে কথা বলবেন।

ও কারো উপর রাগ করে না।

তাহলে হয়ত কোন কারণে উনার অভিমান হয়েছে।

মিতু খুবই ভাল মেয়ে। তোমার চেয়েও ভাল।

আমিতো বলিনি। আমি ভাল মেয়ে।

তুমি না বললেও মা বলেন। মার খুব ইচ্ছা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেন।

আপনি রাজি হচ্ছেন না?

আমি কখনো বিয়ে করব না। মিতুকেও এটা বলেছি। সে বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা আমার সঙ্গেই তার বিয়ে হবে।

আমারো তাই ধারণা।

তোমার ধারণা ভুল। মিতুর বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একটু ঝামেলা হয়েছিল, এক শুক্রবারে পান চিনির কথা হয়েছিল। বর পক্ষের কেউ আসে নি। পরের সপ্তাহে এসেছে। মিতুকে আঙটি পরিয়ে দিয়ে গেছে।

উনি আপত্তি করেন নি?

না, মিতু খুব অন্য ধরণের মেয়ে।

বুঝতে পারছি। আপনি এখন পানি ঢালা বন্ধ করে তোয়ালে দিয়ে গা মুছুন।

আচ্ছা।

আপনি কি বাথরুম থেকে নিজে নিজে বের হতে পারবেন?

অবশ্যই পারব।

তাহলে আপনি শোবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

নোংরা কাপড়গুলো ধুয়ে তারপর যাই।

আপনাকে কাপড় ধুতে হবে না। আপনি গা মুছে বের হয়ে আসুন।

তুমি কি খুব কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে? দুধ চিনি ছাড়া।

পারব।

তুমিতো আসলেই খুব ভাল মেয়ে। তোমার প্রসঙ্গে খুব খারাপ কথা মাকে বলেছি। এখন তার জন্যে খারাপ লাগছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও।

আমার সম্পর্কে কি খারাপ কথা বলেছেন।

তোমাকে কাছুয়া বলেছি।

কাছুয়াটা কি?

কাছুয়া হচ্ছে রক্ষিতা। রক্ষিতার ইংরেজি হল Kept. আমার ধারণা. আচ্ছা থাক তুমি রাগ করবে।

আপনি শোবার ঘরে যান। আমি চা নিয়ে আসছি।

মুন্নী চা বানাতে বানাতে খুব কাঁদল। চা বানানো শেষ করে চোখ মুছে কাপ নিয়ে ইমনের শোবার ঘরে ঢুকে দেখে ইমন মরার মত ঘুমুচ্ছে।

 

জামিলুর রহমান সাহেব আলাদা শোবার ব্যবস্থা করছেন। দোতলার একটা ঘর তাঁর জন্যে ঠিক করা হচ্ছে। ঘরে কিছু থাকবে না, শুধু একটা খাট। খাটের পাশে সাইড টেবিল। সাইড টেবিলে থাকবে পানির বোতল। তাঁর অষুধ পত্র। কাপড় চোপড় রাখার জন্যে একটা আলনা। খাটে তোষকের উপর চাদর থাকবে না। শীতল পাটি থাকবে। শীতল পাটিতে অনেক দিন ঘুমানো হয় না।

লোক লাগানো হয়েছে। তারা ঘর ধোয়া মুছা করছে। জামিলুর রহমান আজ অফিসে যান নি। বারান্দার চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ছাদে উঠে গাছে পানি দেয়া দরকার। ছাদে উঠার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। মাথা সামান্য ঘুরছে। শীতল পাটিটা দোকানে গিয়ে নিজে পছন্দ করবেন বলে ভেবেছিলেন, এখন মনে হচ্ছে তাও পারবেন না।

ফাতেমা গ্লাসে করে ডাবের পানি নিয়ে বারান্দায় এলেন। বাড়ির পেছনে তিনটা নারকেল গাছে প্রচুর ডাব। তিনি লোক দিয়ে গত সপ্তাহে ডাব পাড়িয়েছেন। বাসায় কেউ ডাব খেতে চাচ্ছে না।

জামিলুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকালেন, কোন কথা না বলে গ্লাস হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। ফাতেমা বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।

জামিলুর রহমান স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই বললেন, বল।

ভেতরে চল।

যা বলার এখানেই বল। ভেতরে যেতে পারব না। চেয়ারে বস, তারপর বল।

তুমি ভেতরে যাবে না?

না।

ফাতেমা চেয়ারে বসলেন। তার মুখ থমথম করছে। তিনি কয়েক দিন থেকেই বড় রকমের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঝগড়া শুরু করার সময়টা বের করতে পারছিলেন না। আজ মনে হচ্ছে সময় হয়েছে। ফাতেমা বললেন, তুমি আলাদা শোবার ব্যবস্থা করছি কেন?

উপরের ঘরটা বড়, খোলামেলা। আলো বাতাস আসে এই জন্যে।

আসল কথাটা বলছি না কেন?

আসল কথাটা কি?

আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার সঙ্গে ঘুমুতে তোমার এখন ঘেন্না লাগে।

ঘেন্না লাগবে কেন?

কেন ঘেন্না লাগছে সেটা আমি জানব কি ভাবে। সেটা তোমার জানার কথা।

তোমার ধারণা ভুল। ঘেন্নার কোন ব্যাপার না। একটা বয়সের পর মানুষ খানিকটা একা থাকতে চায়…

একা থাকতে চাইলে ঘরে পড়ে আছ কেন? বনে জঙ্গলে চলে যাও।

জামিলুর রহমান আরেক চুমুক ডাবের পানি খেয়ে স্ত্রীর উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। ভাব এ রকম যে কথাবার্তা যা হবার হয়ে গেছে।

ফাতেমা বললেন, তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার কথার জবাব দাও।

প্রশ্ন কর জবাব দিচ্ছি। প্রশ্ন না করলে জবাব দেব কিভাবে?

ফাতেমা হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। অনেক প্রশ্ন তাঁর করার ছিল, কান্নার জন্যে কোনটিই করতে পারলেন না। জমিলুর রহমান ডাবের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। স্ত্রীর কান্নায় তাকে মোটেই বিচলিত মনে হচ্ছে না। ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার টাকার অভাব নেই, তোমার অনেক টাকা। তুমি কিছু না বললেও আমি জানি। তুমি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

জামিলুর রহমান বললেন, রাখব। টাকা খরচ করে যদি অনুরোধ রাখা যায় তাহলে রাখব। অনুরোধটা কি?

আমাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দাও। ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি ফ্ল্যাটে থাকব।

আচ্ছা কিনে দেব। পছন্দসই ফ্ল্যাটের খোঁজ এনে দাও আমি কিনে দেব।

মিতুর বিয়ের গয়না কিনব—সেই টাকা দাও। আমি গয়না দিয়ে আমার মেয়েকে মুড়িয়ে দেব।

কত টাকা লাগবে বল। আমি ব্যবস্থা করছি। ফরহাদকে বলে দিচ্ছি।

ফরহাদটা কে?

অফিসের নতুন ম্যানেজার।

ফাতেমার কান্না থেমে গেছে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার সব কথা মেনে নেয়া হয়েছে। ফাতেমার মনে হচ্ছে তিনি এখন যাই বলবেন তাই মানুষটা মেনে নেবে। কিন্তু তার পরেও নিজেকে পরাজিত মনে হবে। যুদ্ধে জয়ী হয়েও পরাজিত হওয়ার এই অভিজ্ঞতা তার ছিল না। ফাতেমা এখন কি বলবেন? মাথায় কিছুই আসছে না। তিনি ইতস্ততঃ গলায় বললেন, তোমার শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?

না, বেশি খারাপ লাগছে না। সামান্য খারাপ।

চল সিঙ্গাপুরে যাই ডাক্তার দেখিয়ে আসি। সিঙ্গাপুরে ভাল ভাল ডাক্তার আছে। দেশের বাইরে তো কোনদিন গেলাম না। এই সুযোগে বিদেশ দেখা হবে।

সিঙ্গাপুর বিদেশ না। সব সময় লোকজন যাচ্ছে। ভিসা লাগে না।

তুমি যেতে চাও আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাব না।

কেন তুমি যাবে না? আমার সঙ্গে যেতে কি তোমার ঘেন্না লাগে? আমি কি নর্দমার কেচো? না-কি কমোডের ভিতরে যে শাদা রঙের তেলাপোকা থাকে, সে রকম তেলাপোকা? তুমি আমাকে কি ভােব আজকে বলতে হবে। বলতেই হবে।

ফাতেমা আবারো কাঁদতে শুরু করলেন। জামিলুর রহমান স্ত্রীর কান্নার শব্দ পাচ্ছেন, কিন্তু সেই শব্দ তার মাথার ভেতরে ঢুকছে না। কান্নার অর্থ আছে, কান্নার পেছনে কারণ আছে, কান্নার ব্যাখ্যা আছে। অথচ ফাতেমার কান্নাটাকে তার কাছে অর্থহীন ধ্বনীর মত লাগছে—তিনি ভাবছেন সম্পূর্ণ অন্য কথা-গাজীপুর জঙ্গলের দিকে চল্লিশ বিঘা জমি কিনবেন। এক দাগের জমি। হিন্দুদের জমি না। তাদের জমিতে অনেক ভেজাল থাকে। একই জমি তিন চারজনের কাছে বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যায়। মুসলমানের জমি, এবং কাগজপত্র ঠিক আছে এমন জমি দরকার। জমির দাম বাড়ছে। পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে, জমি বাড়ছে না। জমি কিনে এক বছর ফেলে রাখলেই হবে। খামার বাড়ির মত করা যেতে পারে। হাঁস মুরগি পালবেন, গরু ছাগল পালবেন। গাছ লাগানো হবে। আজ গাজীপুর থেকে লোক আসার কথা। জমির বায়না নিয়ে কথা হবে। অফিস থেকে টেলিফোন এলেই তিনি চলে যাবেন। তবে শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে

না।

ফাতেমা কেঁদেই যাচ্ছেন। জামিলুর রহমান সেই কান্নার ভেতরই টেলিফোনের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করছেন। চল্লিশ বিঘা জমি— অনেকখানি জমি। এক মাথায় দাড়ালে আরেক মাথা দেখা যাবার কথা না… ।

 

অফিস থেকে টেলিফোন এসেছে। অফিসের নতুন ম্যানেজার ফরহাদ টেলিফোন করেছে। টেলিফোন ধরেছে মিতু।

কে কথা বলছেন? বড় আপা?

জ্বি আমি মিতু। আমাকে বড় আপা কেন বলছেন? বাসায় তো আর কোন আপা নেই।

স্যার কি বাসায় আছেন আপা?

হ্যাঁ আছেন। আপনি ধরে থাকুন বাবাকে দিচ্ছি।

না স্যারকে দেয়ার দরকার নেই। আমি আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আপনি স্যারকে দিয়ে দেন।

ম্যানেজারের গলায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কথাও যেন ঠিকমত বলতে পারছে না। জড়িয়ে যাচ্ছে। মিতু বলল, ভায়া মিডিয়াম কথা বলবেন কেন? বাবা আছেন, বারান্দায় বসে আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি।

আপা শুনুন, আমার ভয় লাগছে। আমি স্যারকে কিছু বলতে পারব না। আপনি বলে দিন—অফিসে কিছুক্ষণ আগে শোভন সাহেব এসেছিলেন। স্যারের বড় ছেলে শোভন।

ও আচ্ছা।

তিনি ক্যাশের টাকা নিয়ে গেছেন। অফিসের পিয়নকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। পিওনের মাথা টাথা ফেটে একাকার। টাকা বেশি নিতে পারেন নি।

কত টাকা নিয়েছে?

প্যাটি ক্যাশে যা ছিল সবই নিয়েছেন। নয়। হাজারের অল্প কিছু বেশি। দাঁড়ান। আমি এগজেক্ট ফিগার বলছি।

এগজেক্ট ফিগারের দরকার নেই। ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল, না ও একাই ছিল?

আরেকটা ছেলে ছিল। খুব সুন্দর চেহারা। নাম ইমন। উনাকে আমি আগে দেখিনি। ক্যাশিয়ার সাহেব বললেন উনি আপনার ফুপাতো ভাই।

ইমন কি করছিল? সেও কি পিওনকে মারছিল?

না। উনি কিছু করেন নি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড় আপা আপনি কি স্যারকে ঘটনাটা বলবেন। আমার বলতে সাহস হচ্ছে না। পিস্তল টিস্তল নিয়ে এসেছে। আমি প্ৰথমে ভাবলাম চাঁদাবাজ। স্যারের এই ছেলেকেও আমি আগে দেখিনি।

আচ্ছা আমি বাবাকে বলছি।

সবচে ভাল হয়। স্যারকে যদি অফিসে পাঠিয়ে দেন। গাজিপুর থেকে লোক এসেছে। ঘটনা ওদের সামনেই ঘটেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

বড় আপা আমি রাখি।

মিতু টেলিফোন নামিয়ে বারান্দায় এল। জামিলুর রহমান একা বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি শূন্য। তবে তাঁর বসে থাকার মধ্যে অপেক্ষার একটা ভঙ্গি আছে। সেই অপেক্ষা কিসের অপেক্ষা? মৃত্যুর? জন্মের পর থেকে মানুষ এই একটি অপেক্ষাই করে। কিন্তু কখনো তা বুঝতে পারে না।

বাবা।

জামিলুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

ঝিম মেরে বসে আছ কেন বাবা?

শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। মাথা সামান্য ঘুরছে।

ঝিম ধরে বসে থাকলে মাথা আরো ঘুরবে।

অফিস থেকে কোন টেলিফোন এসেছে?

আসার কি কথা?

হুঁ। গাজীপুর থেকে লোক আসার কথা।

জমি কিনবে?

হুঁ।

টাকাওয়ালা মানুষদের এই সমস্যা। তারা সবকিছু কিনে ফেলতে চায়। কি হবে বলতো?

জামিলুর রহমান মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, তুই একটা কাজ করতো মা, অফিসে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস কর গাজিপুর থেকে লোক এসেছে কি-না।

পারব না বাবা। আমার সিরিয়াস কাজ আছে।

কি কাজ?

তোমাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলব।

বল।

এখানে না ছাদে গিয়ে বলব। চল ছাদে যাই।

শরীরটা ভাল লাগছে না।

তোমাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যাব। সব কথা সব জায়গায় বলা যায়

না।

জামিলুর রহমান উঠে দাড়ালেন। মেয়েটা তাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগছে। মেয়েটা অনেক দূরে বাস করতো। হঠাৎ সে কাছে চলে এসেছে। জামিলুর রহমানের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে অনেক দিন পর কোন এক অদেখা ভুবন থেকে সুপ্ৰভা চলে এসেছে। মিতু না, সুপ্ৰভাই তাকে ধরে ধরে ছাদে নিয়ে যাচ্ছে।

বাবা।

কি মা?

ধনবান মানুষরা একটা বড় সত্যি জানে না, সেই সত্যটা কি তোমাকে বলব?

বল।

পৃথিবীর সবচে আনন্দময় জিনিসগুলির জন্যে কিন্তু টাকা লাগে না। বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন ধর জোছনা, বর্ষার দিনের বৃষ্টি, মানুষের ভালবাসা…। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?

জামিলুর রহমান ক্লান্ত গলায় বললেন, ক্ষুধার্তা মানুষের কাছে জোছনা কোন ব্যাপার না মা। তারপরেও তোর কথা বিশ্বাস করছি—পৃথিবীর সবচে সুন্দর জিনিসগুলির বিকি-কিনি হয় না। কথাটাতো মা ভাল বলেছিস।

ছাদে উঠে জামিলুর রহমান মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গোলাপে বাগান আলো হয়ে আছে। এক দিনে এত ফুল ফুটেছে। কি আশ্চর্য।

বাবা?

কি মা?

তুমি যখন প্রথম দিকে গোলাপের টব জোগাড় করতে শুরু করলে তখন আমার খুবই রাগ লাগছিল। মনে হচ্ছিল খোলামেলা ছাদটা তুমি নষ্ট করছ। এখন নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

তোর জরুরী কথাটা কি বল শুনি।

মিতু খুব সহজ গলায় বলল, বাবা আমি ইমনকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।

জামিলুর রহমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। মিতু বলল, আমার ওকে তেমন দরকার নেই। কিন্তু ইমনের আমাকে দরকার।

তোর তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। গত সপ্তাহে পান চিনি হয়ে গেল।

মিতু হালকা গলায় বলল, আমাদের এই পৃথিবী কখনো স্থীর হয়ে থাকে না। সারাক্ষণ ঘুরছে। এই জন্যে পৃথিবীর কোন কিছুই ঠিক থাকে না। বাবা তোমার কি আপত্তি আছে?

তুই যা মনে করছিস, সেটার ভাল হবার সম্ভাবনা আছে।

বাবা শোন, তোমাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। কেন বললাম বুঝতে পারছি না। আমি কখনো মিথ্যা বলি না।

মিথ্যা কথাটা কি?

আমি বলেছিলাম না-আমার ইমনকে দরকার নেই, ইমনের আমাকে দরকার। এটাই মিথ্যা। আসলে ইমনের আমাকে দরকার নেই, আমারই ওকে দরকার।

জামিলুর রহমান অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর মেয়ে কাঁদছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হল বাগান ভর্তি গোলাপ ফুলের দৃশ্যটা যেমন সুন্দর, তাঁর মেয়ের চোখ ভর্তি জলের দৃশ্যটাও তেমনি সুন্দর। গোলাপের টবগুলি কেনার জন্যে তাঁকে টাকা খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু মেয়ের চোখের জলের অপূর্ব দৃশ্যটির জন্যে অর্থ ব্যয় করতে হয় নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *