২০. যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন

যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন

যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন সেই চেয়ারে চিত্ৰলেখা বসে আছে। প্রথম দিন অস্বস্তি লেগেছিল–এরপর আর লাগে নি। এমন ব্যস্ততায় তার দিন কাটছে যে অস্বস্তি লাগার সময়ও ছিল না। ব্যস্ত মানুষদের অস্বস্তি বোধ করার সময় থাকে না। চিত্ৰলেখার দিন কাটছে বাবার কর্মপদ্ধতির মূল সূত্রগুলো ধরতে। তাকে কেউ সাহায্য করছে না। যাদের সাহায্য করার কথা তারা এক ধরনের নীরব অসহযোগিতা করছেন। অফিসের প্রধান প্রধান কর্তব্যক্তিরা এগিয়ে আসছেন না। তাদের প্রশ্ন করেও তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না। এ রকম কেন হচ্ছে চিত্ৰলেখা বুঝতে পারছে না। তারা কি চান না। সব আগের মতো চলুক?

চিত্ৰলেখার সামনে তিন কর্মকর্তা বসে আছেন, জিএম আবেদ আলি, এজিএম ফতেহ খান এবং প্রোডাকশান ম্যানেজার নুরুল আবসার। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা বিমর্ষমুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আবেদ আলি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। চিত্ৰলেখা বলল, আপনি সিগারেট ধরাবেন না। সিগারেটের ধোঁয়া আমার পছন্দ না। বন্ধঘরে ধোঁয়া যেতে চায় না। অসহ্য লাগে।

আবেদ আলি সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রাখলেন। তার মুখ আরো গভীর হয়ে গেল।

চিত্ৰলেখা বলল, আমি যদি কারো চাকরি টাৰ্মিনেট করতে চাই আমাকে কী করতে হবে বলুন তো?

আবেদ আলি কিছু বললেন না, ফতেহ খান বললেন, আপনি যা করবেন কোম্পানি আইন মোতাবেক করবেন। কোম্পানি আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা মালিকদের দেয়া হয় নি। মালিক চেয়েছেন বলে চাকরি নেই এই ব্যবস্থা এখন নেই।

প্রাইভেট কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা তো থাকতেই হবে। সেই ব্যবস্থাটা জানতে চাচ্ছি।

ফতেহ খান বললেন, আপনাকে ল’ইয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। কোম্পানির নিজস্ব ল’ইয়ার আছে তার কাছে জেনে নিন।

আপনারা কিছু জানাবেন না?

আমরা তেমন জানি না।

আপনি জানেন না সেটা বলুন। আমরা বলছেন কেন? আবেদ আলি সাহেব হয়তো জানেন, নূরুল আবসার সাহেবও হয়তো জানেন। অন্যদের দায়িত্ব নেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

নুরুল আবসার বললেন, মিস চিত্ৰলেখা আপনাকে একটা কথা বলি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না, আপনি একসঙ্গে সবকিছু বুঝে ফেলতে চেষ্টা করছেন। আমাদের এই কোম্পানি অনেক বড় কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা দীর্ঘদিন থেকে জড়িত। বছরের পর বছর কাজ করে আমরা যা শিখেছি আপনি এক সপ্তাহে তা শিখে ফেলতে চান, তা কী করে হবে! ধীরে চলার একটা নীতি আছে সেই নীতি মেনে চলাই ভালো।

আমাকে ধীরে চলতে বলছেন?

অবশ্যই ধীরে চলতে বলছি।

আপনাদের ধারণা আমি ধীরে চলছি না?

আমাদের ধারণা। আপনি একসঙ্গে সব জেনে ফেলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। ছটফট করছেন।

আপনিও বললেন–আমাদের ধারণা। আপনি বলুন আমার ধারণা। নাকি আপনাদের তিন জনের ধ্যান-ধারণা সব এক রকম।

আমরা সব একজিকিউটিভ ডিসিশান মেকিঙে থাকি। আমাদের ধ্যান-ধারণা এক রকম হওয়ারই তো কথা।

গত মাসে কোম্পানি প্ৰায় এক কোটি টাকা লোকসান করেছে। কেন করেছে আবেদ আলি সাহেব। আপনি বলুন?

এক কোটি টাকা না–সত্তর হাজার পাউন্ড। একটা বিশেষ খাতে লোকসান হয়েছে। সেই লোকসান আমরা সামলে উঠব। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। বিজনেস হচ্ছে এক ধরনের গ্যামলিং।

লাভ-লোকসান ব্যবসায় থাকবে তাই বলে ব্যবসা গ্যামলিং হবে কেন? আমরা তো জুয়া খেলতে বসি নি।

আবেদ আলি ভুরু কুঁচকালেন। মনে মনে বললেন–ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।

চিত্ৰলেখা বলল, আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাই নি–এত বড় একটা লোকসান হলো কেন?

যথাসময়ে এলসি খোলা হয় নি। তারপর আমাদের কিছু ক্রটি ছিল যার জন্যে পেনাল্টি দিতে হয়েছে।

কী ক্রটি?

ম্যাডাম বিষয়টা তো জটিল–চট করে বোঝাতে পারব না। সময় লাগবে।

সময় আপনাকে দিচ্ছি–আপনি বোঝাতে শুরু করুন। কাগজ-কলম লাগবে?

আবেদ আলি বললেন, মিস চিত্ৰলেখা, বসের কন্যাকে প্রাইভেট পড়ানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না। তারপরও আমি আপনাকে বোঝাব। তবে এখন না। এখন আমাকে যেতে হবে। আমার জন্যে লোকজন অপেক্ষা করছে। আপনাকে আরো একটা কথা বলি মিস চিত্ৰলেখা, যখন-তখন আপনি মিটিং ডাকবেন না। এতে সবারই কাজের ক্ষতি হয়। মিটিং যখন ডাকবেন–এজেন্ডা ঠিক করে ডাকবেন। এজেন্ডা জানা থাকলে আমাদের তৈরি হয়ে আসতে সুবিধা হয়।

আবেদ আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। শুধু ফতেহ খান বললেন, ম্যাডাম তাহলে যাই? চিত্ৰলেখা বলল, আচ্ছা যান। তাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করা হলো তবে সে অপমান গায়ে মাখল না। সে বাবার চেয়ারে কিশোরী মেয়েদের মতো খানিকক্ষণ দোল খেল। তারপরই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলল।

কিছু মজার মজার ফাইল এই ড্রয়ারে আছে। ফাইলগুলো বাড়িতে ছিল সে নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনই সে খুব মন দিয়ে পড়ে। হিশামুদ্দিন সাহেব তার অফিসের প্রতিটা কর্মচারী সম্পর্কে আলাদা আলাদা নোট রেখে গেছেন। পড়তে পড়তে চিত্ৰলেখার প্রায় মনে হয়-বাবা যেন জানতেন একদিন চিত্ৰলেখা এই ফাইল পড়বে। পড়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

ফাইল তৈরি করা ছাড়াও হিশামুদ্দিন সাহেব আরো একটা কাজ করে গেছেন। কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কে দীর্ঘ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। চিঠির মতো করে লেখা এই নির্দেশনামা চিত্ৰলেখা বলতে গেলে প্ৰতিদিনই একবার করে পড়ছে।

মা চিত্ৰলেখা,
তোমার মাথায় বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার মাথায় তিন মণ ওজনের পাথর চেপে বসেছে? তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না?
যদি এ রকম মনে হয় তুমি পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আমি একটি কর্মকাণ্ড শুরু করেছি। আমার মৃত্যুর পরেও তা চলতে থাকবে এ জাতীয় চিন্তাভাবনা আমার কোনো কালেই ছিল না। এই পৃথিবীতে সবকিছুই সাময়িক।
অবশ্য পুরো ব্যাপারটা তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দেখতে পার। আমার ধারণা তোমার সেই যোগ্যতা আছে। যদি তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও তাহলে তোমাকে আমার কিছু উপদেশ দেবার ইচ্ছা।
পুরনো কালে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধবিগ্ৰহ চলত। দু দল যুদ্ধ করছে। সেনাপতিরা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এই সময় হঠাৎ যদি কোনো কারণে কোনো একদলে সেনাপতি নিহত হয় তখন সেই দল সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। এই ব্যাপারটা এখনো আছে৷ এখনো সেনাপতির মৃত্যু মানে যুদ্ধে পরাজয়। সৈন্যরা এখনো যুদ্ধ করে তাদের নিজেদের জন্যে না–যুদ্ধ করে তাদের সেনাপতির জন্যে।
সেনাপতিকে সৈন্যদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কাজটা সবচে
কঠিন। তুমি তা পারবে। ভালোভাবেই পারবে।
কোম্পানি পরিচালনা শুরুতে তোমার কাছে জটিল মনে হবে–কাজটা কিন্তু জটিল নয়। ঘোড়ার পিঠে চড়া এবং ঘোড়াটাকে দৌড়ানো শুরু করাটা জটিল, কিন্তু একবার যখন ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে তখন জটিলতা কিছু থাকে না। শুধু দেখতে হয়–পথ ঠিক আছে কি না। পথে কোনো খান্দা-খন্দ পড়ল কি না। অবশ্য আরেকটা জিনিস দেখতে হয় তোমার শেষ সীমাটা কোথায়? গোলটী কী?
তুমি অবশ্যই কোমল হবে। সেই কোমলতার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নির্মমতাও তোমার মধ্যে থাকতে হবে। যেখানে নির্মম হওয়া দরকার সেখানে কখনো কোমল হবার চেষ্টা করবে না। দয়া, করুণা এইসব মানবিক গুণাবলি কোম্পানি পরিচালনার কাজে আসে না বরং কাজ শ্লথ করে দেয়। মনে কর কেউ একটা অন্যায়। করল, কিংবা কারো কোনো কাজে কোম্পানি ক্ষতিগ্ৰস্ত হলো। তুমি যদি তার শাস্তি না দাও। তাহলে এই অন্যায়টি সে আবারো করবে। সে ধরে নেবে যে সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। শুধু সে না। অন্যরাও তাই ভাববে। You have to be cruel, only to be kind. কাজের পুরষ্কার যেমন থাকবে তেমনি অন্যায়ের শাস্তিও থাকবে।
ক্ষমা অত্যন্ত মহৎ গুণ। কোম্পানি পরিচালনায় ক্ষমা একটা বড় ত্রুটি।
কোম্পানির কার্যপ্ৰণালীর প্রতিটি খুঁটিনাটি তোমাকে জানতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি:–কোম্পানির অতি তুচ্ছ কাজ যে কজন করে তাদের একজন হলো রশীদ। রশীদ হলো সাইকেল পিয়ন। তার একটা সাইকেল আছে। হাতে হাতে চিঠি পাঠাতে হলে চিঠি এবং ঠিকানা দিয়ে রশীদকে বললেই সে চলে যাবে। তুমি কি জান রশীদ তার এই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে। তাকে তুমি ঠিকানা লিখে চিঠি দেবে এবং তা সে পৌঁছাবে না। এটা কখনো হবে না।
একবার কী হয়েছে শোনা –সে একটী চিঠি নিয়ে গেল। যার চিঠি সে বাসায় ছিল না। রশীদ বাসার সামনে রাত তিনটা পর্যন্ত বসে রইল। কোম্পানি ঠিকমতো তখনই চলবে যখন যার যা কাজ তা ঠিকমতো করা হবে।
তোমাকে দায়িত্ব গ্ৰহণ করার পর একটি অপ্রিয় কাজ করতে হবে–কাজটা হচ্ছে জেনারেল ম্যানেজার পদে নতুন কাউকে আনা। অবশ্যই তোমাকে আবেদ আলিকে অপসারণ করতে হবে। কাজটা আমিই করে যেতাম। তোমার জন্যে রেখে গোলাম। আবেদ আলি অত্যন্ত কর্মঠ। সে নিজের কাজ খুব ভালো জানে। তার সমস্যা হলো সে নিজেকে এখন অপরিহার্য বিবেচনা করছে। যখন এই কাজটা কেউ করে তখন নানান সমস্যা হতে থাকে। সে নিজের স্বার্থটিকে প্ৰাধান্য দেয়। কাজকর্মেও হেলাফেলা ভাব চলে আসে। সে তার প্রতি অনুগত একটা শ্রেণীও তৈরি করে নেয়। আবেদ আলি তাই করেছে।
আবেদ আলির চাকরির টার্মিনেশন লেটার আমি তৈরি করে রেখেছি। আইনগত কিছু জটিলতা আছে বলেই তৈরি করে যাওয়া। তুমি যদি কোম্পানির দায়িত্ব নাও তাহলে এই টার্মিনেশন লেটার সই করে তুমি তাকে দেবে। আর তুমি যদি দায়িত্ব না নাও তাহলে যেমন আছে তেমনি থাকবে। তোমার অনুপস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে…

চিত্ৰলেখা আবেদ আলির চাকরির টাৰ্মিনেশন লেটারে নিজের নাম সই করল। তারিখ বসাল। ইন্টারকমে বলে দিল–সাইকেল পিয়ন রশীদকে যেন পাঠানো হয়।

রশীদ এসে দাঁড়াল মাথা নিচু করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মালিক শ্রেণীর কারো দিকে চোখ তুলে তাকানো বোধহয় তার অভ্যাস নেই। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।

কেমন আছ রশীদ?

ভালো।

এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়ে এসো।

জ্বি আচ্ছা।

তোমার সাইকেলটি ঠিক আছে?

বেল নষ্ট।

বেল ঠিক করার ব্যবস্থা কর।

কোযারটেকার স্যারকে বলেছিলাম।

উনি ব্যবস্থা করেন নি?

রশীদ চুপ করে রইল। সে কখনো তার ওপরওয়ালাদের বিষয়ে কোনো নালিশ করে না।

আচ্ছা আমি বলে দেব।

আমি চলে যাব? চিঠি দিয়ে এসে আপনাকে রিপোর্ট করব?

দরকার নেই। তুমি যাও। চিত্ৰলেখা কেয়ারটেকারকে ডেকে পাঠাল। কেয়ারটেকারের নাম সালাম। সে

ভীতমুখে সামনে এসে দাঁড়াল।

কেমন আছেন সালাম সাহেব?

জ্বি, আপা ভালো। কাজকর্মে মন বসছে না আপা।

মন বসছে না কেন?

স্যার নাই। কী কাজ করব কার জন্য করব?

আমার জন্যে করবেন।

তা তো অবশ্যই। . আমাদের যে সাইকেল পিয়ন রশীদ তার সাইকেলের বেল নষ্ট। বেল ঠিক হচ্ছে না কেন?

আমাকে তো আপা সে কিছু বলে নাই।

সে বলেছে। যেহেতু আপনার কাজকর্মে মন নাই আপনি শুনতে পান নি। বাবার মৃত্যুতে আপনি এতই ব্যথিত যে, কোনো কিছুই আপনি এখন মন দিয়ে শুনছেন না। আচ্ছা। আপনি যান–আমাদের জিএম সাহেবকে একটু আসতে বলে দিন।

জ্বি আচ্ছা। চিত্ৰলেখা ঘড়ি দেখল। তিনটা বাজে। অফিস আরো এক ঘণ্টা চলবে। সে অফিস থেকে ঠিক চারটায় বের হবে। আজ তার পরিকল্পনা হলো রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটা।

আবেদ আলি বিরক্তমুখে ঢুকলেন।

আমাকে ডেকেছেন?

চিত্ৰলেখা বলল, আবেদ আলি সাহেব বসুন।

মিটিঙের মাঝখান থেকে উঠে এসেছি।

কীসের মিটিং?

এলসি খোলার দেরি এবং ইরেগুলারিটি বিষয়ে একটা তদন্তের ব্যবস্থা করছি।

ও আচ্ছা।

কী জন্যে ডেকেছিলেন?

একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গের জন্যে ডেকেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন, তারপর বলছি।

আবেদ আলি বসলেন। তার ভুরু কুঞ্চিত। চিত্ৰলেখা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় বলল, কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে একটি অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। আপনার সার্ভিস আমাদের আর প্রয়োজন নেই। আমাদের কাছে মনে হচ্ছেকোম্পানির স্বাৰ্থ আপনি এখন আর আগের মতো দেখছেন না। সত্তর হাজার পাউন্ডের যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে—তার দায়-দায়িত্বও সম্পূর্ণ আপনার।

কী বলছেন?

যা সত্যি তা বলছি।

আমাকে ছাড়া আপনি তো সাত দিনও চলতে পারবেন না। আপনি তো সামান্য মানুষ আপনার বাবারও আমি ডানহাত ছিলাম।

আমার বাবা যেহেতু নেই; আমার বাবার ডানহাতেরও প্রয়োজন নেই তাই না? নিন এটা হচ্ছে আপনার জব টামিনেশন লেটার। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন, এই চিঠি বাবাই লিখে টাইপ করে রেখে গেছেন। আমি শুধু নাম সই করেছি। কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুর পরেও তাদের উপস্থিতির ব্যবস্থা রেখে যায়।

আবেদ আলি চিঠি পড়ছেন। তার হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অপ্ৰত্যাশিত।

আবেদ আলি সাহেব!

জ্বি।

আপনার দায়িত্ব আপনি এজিএম সাহেবকে বুঝিয়ে দেবেন।

ম্যাডাম ব্যাপারটা কি আরেকবার কনসিন্ডার করা যায় না?

জ্বি না, যায় না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে। আপনি এখন আসুন।

আপনি বিরাট সমস্যায় পড়বেন। হাতেপায়ে ধরে আবার আমাকেই আপনার আনতে হবে।

আনতে হলে আনব। এই মুহুর্তে আপনাকে আমাদের দরকার নেই।

 

চিত্ৰলেখা আরেক কাপ চায়ের কথা বলল। অফিসে বসার পর থেকে তার খুব ঘনঘন চা খাওয়া হচ্ছে। অভ্যাসটা কমাতে হবে। মাথা ধরেছে। মাথাধরা কমানোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওষুধ খেতে ইচ্ছা করছে না। খোলা বাতাসে বসা দরকার। এসি দেয়া বদ্ধঘরে এক সময় দম আটকে আসে। চিত্ৰলেখা এসি বন্ধ করল। জানালার পরদা সরাল। জানালা খুলল। দিনের আলো নিভে আসছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘ বলেছে যাব যাব? মেঘেরা কোথায় যেতে চায়? হিমালয়ের দিকে না। অন্য কোথাও? মানুষের পাখা থাকলে ভালো হতো। মেঘদের সঙ্গে উড়ে বেড়াত। মেঘদের সঙ্গে বাস করলেই জানা যাবে মেঘেরা কোথায় যেতে চায়।

আসব?

চিত্ৰলেখা জানালা থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, আসুন। রশীদ তাহলে আপনাকে খুঁজে পেয়েছে। বসুন।

হাসান বসল। সে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই বিশাল অফিসে এই প্রথম এসেছে। তার চোখে বিস্ময়।

চা খাবেন?

জ্বি না।

খেয়ে দেখতে পারেন। এরা চা খুব ভালো বানায়। দার্জিলিঙের চা পাতা এবং বাংলাদেশের চা পাতা সমান সমান নিয়ে একটা মিকচার তৈরি হয়। সেই মিকচার দিয়ে চা বানানো হয়।

তাহলে দিতে বলুন।

আপনাকে ডেকেছি। কী জন্যে জানেন?

জ্বি না।

আপনাকে ডেকেছি। কারণ আজ বিকেলে আপনাকে নিয়ে ঘুরব। গাড়িতে করে না।—হণ্টন।

বৃষ্টি আসছে তো!

আসুক। আমার একটা রেইনকোট আছে–আপনার জন্যে ছাতা আনিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টির সময় রেইনকোট পরে হাঁটা আমার খুব পুরনো অভ্যাস। নোট করছেন তো?

হাসান বিস্মিত হয়ে বলল, কী নোট করব?

কথাবার্তা যা বলছি। এইসব–এই যে একটু আগে বললাম, আমার পুরনো অভ্যাস হচ্ছে বৃষ্টিতে রেইনকোট পরে হাঁটা। আমি তো আগে একবার আপনাকে বলেছিবাবার মতো আমিও আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে পে করব। কাজেই আপনি যত বেশি সময় আমার সঙ্গে কাটাবেন ততই আপনার লাভ।

হাসান তাকিয়ে আছে। চিত্ৰলেখাকে কেমন যেন অস্থির লাগছে।

হাসান সাহেব!

জ্বি।

অকারণে আপনাকে ডেকে আনায় আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?

জ্বি না।

বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। আমি মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।

আপনার এরকম অবস্থা যখনই হবে খবর দেবেন–আমি চলে আসব।

বৃষ্টি মনে হয় আসছে—তাই না?

জ্বি।

চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *