অধ্যায় ২০. যিশু এলেন রোমে
গভীর রাতে তারা যিশুকে গ্রেফতার করতে এসেছিলেন। গোপন পুলিশ সবসময়ই যে-সময়টিকে এই ধরনের কাজ করার জন্যে বেছে নেয়। যখন পুরো শহর শান্ত থাকে, মানুষের শক্তি যখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে, তখনই তারা আক্রমণ করেন। ব্যক্তিগত মালিকাধীন একটি বাগানে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, যেখানে তার গোপন অবস্থান চিনিয়ে দিয়েছিলেন তারই ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি।
প্রতীকী আচরণ করার ক্ষেত্রে যিশু অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। যখন তিনি তার আধ্যাত্মিক মুক্তির আন্দোলনটি শুরু করেছিলেন, তিনি ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাননে প্রবেশ করার সেই ঘটনাটির প্রতিধ্বনি করেছিলেন। বাইবেল আমাদের বলেছে যে, তাদের প্রতিশ্রুত ভূমির জন্যে মিশর থেকে সংগ্রাম করে যে-ইহুদিরা পালিয়ে এসেছিলেন তারা মোট বারোটি গোত্রে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, যারা পরিচিত ইজরায়েলের ‘টুয়েলভ ট্রাইবস’ নামে। সুতরাং যিশু তার অনুসারীদের মধ্যে থেকে বারো জনকে নির্বাচন করেছিলেন, যারা তার এই খুব ভিন্নধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করতে পারবেন। তিনি তাদের বলতেন ‘আপোস্টল’, গ্রিক যে-শব্দটির অর্থ হচ্ছে বার্তাবাহক। তাদের বার্তাটি ছিল সুসংবাদ, ঈশ্বরের ন্যায় এবং শান্তির রাজ্য খুব শীঘ্রই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এই অ্যাপোস্টলরা কেউ নজরে পড়ার মতো তেমন কোনো বিশেষ ব্যক্তি ছিলেন না। তাদের মধ্যে বিখ্যাত দুইজনই ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিলেন, পিটার এবং জুডাস। পিটার হৃদয়বান ছিলেন, কিন্তু দুর্বল। যিশু বন্দি হবার পরই তিনি তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, আর জুডাস রোমের পুলিশদের নিয়ে এসেছিলেন সেই বাগানে, যেখানে যিশু লুকিয়ে ছিলেন। আমরা নিশ্চিত নই, কেন তিনি এমন একটি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছিলেন! বিশ্বাসঘাতকতার জন্য যাজকরা তাকে ত্রিশটি রুপার মুদ্রা দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কাজটি শুধুমাত্র টাকার জন্যে। করেছিলেন, এমন সম্ভাবনা বেশ কম। হয়তো তিনি হতাশ হয়েছিলেন, তিনি যেমন মেসাইয়া প্রত্যাশা করেছিলেন, যিশু তেমন ছিলেন না। ইজরায়েলে দরিদ্র আর নিপীড়িতদের মধ্যে তার বিস্ময়কর সংখ্যক অনুসারী ছিল, কিন্তু তারপরও তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেননি। এই ধরনের একটি ধাক্কা কি তাকে প্ররোচিত করতে পারত প্রতিশ্রুত সেই রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে সবাইকে স্বশস্ত্র হয়ে উঠতে? সেটাই কি জুডাসের উদ্দেশ্য ছিল? আমরা জানি না। হয়তো তিনি নিজেও সেটি জানতেন না।
ম্যাথিউ আমাদের বলেছিলেন গেথসেমানে বাগানে আটক হবার হবার যিশুর সাথে যা কিছু ঘটেছিল সেটি জুডাসের হৃদয় ভঙ্গ করেছিল, এবং তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তবে তার সেই কাজটির প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে যিশু রোমের সৈন্যদের হাতে বন্দি।
রোমের সৈন্যরাও খুব দক্ষ ছিল প্রতীকী আচরণে। রোমান-কর্তৃপক্ষ যখন জিসাসকে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, সৈন্যরা তার মাথার উপর একটি কাঁটার মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল এবং তার গায়ে রাজকীয় বেগুনি রঙের একটি চাদর জড়িয়ে দিয়েছিল। সবাই দেখো, ইহুদিদের রাজা’, তারা উপহাস করেছিলেন যখন তারা সেই পাহাড়ের উপর তাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্রুশবিদ্ধ করার স্থানে। কুশের সাথে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করে ধীরমৃত্যু, রোমের সবচেয়ে হিংস্রতম শাস্তি ছিল। এই শাস্তিতে দণ্ডিতরা মরে যাবার আগে বেশ কয়েকদিন ধরে তীব্র যন্ত্রণায় এভাবে ঝুলে থাকতে পারতেন। ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন স্পার্টাকাস ক্রীতদাসদের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রোমে, খুব হিংস্রভাবে দাসদের সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল। এবং বিদ্রোহ দমন করা হয়ে গেলে, রোমান সেনাপতি ক্রাসাস, ছয় হাজার বিদ্রোহী দাসকে ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, এবং রোম থেকে কাপুয়া যাবার মহাসড়কের পাশে ক্রুশের উপর তাদের বহু মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। যিশুর জন্যে মৃত্যু বেশ দ্রুত এসেছিল। তিনি ক্রুশের উপর মাত্র ছয়ঘণ্টা বেঁচেছিলেন, এর কারণ সম্ভবত সৈন্যরা তাকে এত হিংস্রভাবে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে ছিল, তিনি অর্ধমৃত ছিলেন যখন তারা তাকে ক্রুশের কাঠের উপর পেরেক দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
ক্রুশবিদ্ধ হয়ে ঝুলে থাকার সময় তিনি কী ভাবছিলেন? ঈশ্বর তাকে যা বলেছিলেন বলে তিনি মনে করেছিলেন, তিনি কি তার সেই ভাবনায় প্রতারিত হয়েছিলেন? নাকি, তিনি তার মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলেন ঈশ্বরের পরিকল্পনার একটি অংশ হিসাবে? দুটি প্রস্তাবনাই করা হয়েছে। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, যিশু খুব স্থিরবিশ্বাসে পৌঁছেছিলেন, যখন তিনি কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করার প্রক্রিয়ায় তীব্রতম বিপদের মুহূর্তে পৌঁছাবেন, ঈশ্বর কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করবেন। এটি সেই তত্ত্ব থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়, যা দাবি করেছে যিশুকে কোনো একটি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতেই জুডাস চেষ্টা করেছিলেন। যিশুও কি ঈশ্বরকে এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করতে চাইছিলেন? তিনি কি ভেবেছিলেন, এমন একটি রাজ্যের দাবি করার মাধ্যমে, যে-রাজ্য এই পৃথিবীতে অভূতপূর্ব, এবং এর জন্যে মরতে প্রস্তুত হবার মাধ্যমে, ঈশ্বর স্বয়ং ইতিহাসে তার সমস্ত শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হবেন, সব শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন? যদি সেটাই তিনি প্রত্যাশা করে থাকেন, এমন কিছু ঘটেনি। রোমানদের শোষণ থেকে তাদের কেউ উদ্ধার করেনি। তার সেই যন্ত্রণা লাঘব করার জন্যে কোনো পদক্ষেপ নিতে ইতিহাসে ঈশ্বর হঠাৎ করে প্রবেশ করেননি। শুধুমাত্র সেখানে কুশই ছিল এবং নিশ্চয়তা ছিল যে, তিনি এর উপরেই মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন। তিনি কী অর্জন করতে পেরেছিলেন? কিছুই না। মার্ক আমাদের বলেন, তার শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনি হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ঈশ্বর, আমার ঈশ্বর, কেন তুমি আমাকে পরিত্যাগ করলে?’
অন্য গসপেল লেখকরা এই ক্রুশবিদ্ধ হবার ঘটনাটিকে খানিকটা ভিন্নরূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা প্রস্তাব করেছিলেন, সবসময়ই পরিস্থিতিটি যিশুর নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তার মৃত্যু শুরু থেকেই ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ ছিল। তিনি জানতেন এটাই তার সাথে ঈশ্বরের যে সমঝোতা হয়েছিল তারই একটি অংশ। এবং যখন জনের গসপেলটি লেখা হয়েছিল, এটাই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত কাহিনিতে পরিণত হয়েছিল। জনের বিবরণে যিশুর শেষ উচ্চারণটি হতাশ কোনো আর্তনাদ নয়, বরং বিজয়ের উল্লাস : ‘কাজটি সম্পন্ন হয়েছে’!
এমন কিছু অনুভূত হয়নি যে তার কোনো অনুসারীরা এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে সেটি প্রত্যাশা করতে পেরেছিলেন। অনুগত নারীদের একটি ছোটদল ছাড়া, তারা সবাই তাকে পরিত্যাগ করেছিল, যখন রোমের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। কারণ তারা ভয় পেয়েছিল পরবর্তীতে এই শাস্তি হয়তো তাদেরকেও দেওয়া হবে। ভোর হবার আগে আশাহীন ঘণ্টাগুলোয় তারা দরজায় পুলিশের টোকা শোনার জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সেটি কখনোই আসেনি। তবে যা এসেছিল সেটি তাদের বিস্মিত করেছিল। স্বয়ং যিশু এসেছিলেন, যদিও তাদের হয়তো বলার কোনো ক্ষমতাই ছিল না, ঠিক কীভাবে তারা জেনেছিলেন যিশু এসেছে। করিন্থবাসীদের প্রতি লেখা পলের চিঠিতে তিনি এই বিস্ময়টির বিবরণ দিয়েছিলেন। এবং তিনি পূর্ণ একটি তালিকা দিয়েছিলেন সেইসব মানুষদের নামসহ, যাদের সামনে যিশু আবির্ভূত হয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর। সবশেষে, তিনি বলেছিলেন, ‘যিশু আমার সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং আমরা দামাস্কাস অভিমুখে সেই রাস্তায় ফিরে যাই, যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল। এটি ছিল পরবর্তী বিস্ময়, যা তার অ্যাপোস্টলদের হতবাক করে দিয়েছিল।
যিশুর এই আবির্ভাবগুলো পিটার ও অন্যান্য অ্যাপোস্টলদের ক্রমশ আরো সাহসী করে তুলেছিল। যিশুর গ্রেফতারের পর তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু পরে তারা আবার একত্রিত হয়েছিলেন এবং তাদের নেতা হিসাবে পিটার আবার তার সাহসিকতার পরিচয় দিতে শুরু করেছিলেন। যদিও তারা নিশ্চিত ছিলেন না ভবিষ্যতে কী হবে, তবে তারা স্বদেশি ইহুদিদের বলতে শুরু করেছিলেন যে কী ঘটেছিল। আরো বেশি সাহসিকতার সাথে তারা তাদের সেই বিশ্বাসটির পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, যিশু, যদিও তিনি এমন একটি মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন, বাইবেল যাকে বলে অভিশপ্ত, কিন্তু তিনি ছিলেন তাদের সেই প্রতিশ্রুত মেসাইয়া। মৃত্যুর পর তার ফিরে আসার এই ঘটনাগুলোই ছিল তার প্রমাণ।
কিন্তু পৃথিবীতে যে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে তারা এখন বিশ্বাস করছেন, সেটি ঘটবার সময়সূচি তাহলে কী? এটিকে আর বেশি দীর্ঘায়িত করা যাবে না, তারা ভেবেছিলেন। তারা সবাই তাদের জীবদ্দশায় সেটি দেখতে পারবেন। এবার আর আগের মতো কোনো ভুল হবে না। যখন যিশু ফিরে আসবেন, এটি তার মৃত্যুর পর আবির্ভূত হবার মতো গোপন কিছু হবে না। পরের বার তার রাজ্যে পূর্ণ রাজকীয়তা নিয়েই তিনি আসবেন। পল এটি প্রকাশ করার সবচেয়ে সেরা উপায়টি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যিশুর পুনরুত্থান ছিল সেই একটি বিশাল ফসলের ফলনের প্রথম আঁটি, যে ফসল আমরা খুব শীঘ্রই ঘরে তুলব।
যিশুর মূল অনুসারীরা তখনো সল থেকে ধর্মান্তরিত হওয়া পলকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। তাদের সবচেয়ে বড় নিপীড়নকারী থেকে, সল যে এখন পল নামে পরিচিত, এখন তাদের সবচেয়ে বিরক্তিকর ঝামেলায় রূপান্তরিত হয়েছিল। তার এই ধর্মান্তরিত হবার ঘটনার প্রথম ধাক্কাটি সামলে নেবার পর, দামাস্কাসের রাস্তায় যিশু তাকে আহ্বান করেছিলেন বলে নিজেকে যিশুর আরেকজন অ্যাপোস্টল বলার দাবিটির ব্যাপারে সম্মতি দেবার পরেও, তার সাথে কাজ করা তাদের বেশ কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল। যিশুর মতোই, তার অনুসারীরা সবাই ইহুদি ছিলেন, এবং চেয়েছিলেন সবকিছুই সেভাবেই থাকুক। তার ফিরে আসার সাথে যা কিছুই সংশ্লিষ্ট থাকুক না কেন, আর যখনই সেটি ঘটুক না কেন, তারা নিশ্চিত ছিলেন তেমন কিছু শুধু জেরুজালেমেই ঘটবে, ঈশ্বরের এই পবিত্র শহর হবে সেই পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু। আর সে-কারণেই যেখানে তারা ছিলেন, সেখানেই তারা যিশুর জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আর তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেখানে বসেই তারা, যিশু একজন মেসাইয়া ছিলেন এবং তিনি খুব শীঘ্রই আবার ফিরে আসবেন, সেটি প্রচার করা অব্যাহত রাখবেন, তবে তারা শুধুমাত্র ইহুদিদের মধ্যে সেটি করবেন।
‘না’, হুঙ্কার করে বলেছিলেন পল। তোমরা কি বুঝতে পারোনি ঈশ্বর সেই পুরনো চুক্তি ছিঁড়ে ফেলেছেন এবং নতুন একটি চুক্তি প্রকাশ করেছেন? পুরনোটি তার প্রয়োজন মিটিয়েছে, এবং এটির মহান একটি উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু এটির সময় শেষ হয়েছে। সেটি ছিল শৈশবে স্কুলে যাবার মতো। খুবই জরুরি যখন আমরা ছোট, কিন্তু এটি শেষ হয়ে যায়, যখন আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হই। এবং এখানে আরো কিছু বিষয় আছে। এই নতুন প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র ইহুদিদের জন্যে নয়। এটি সবার জন্যে। সারা পৃথিবীর জন্যে।
এভাবে একসাথে জেরুসালেমে বসে, নিষ্ক্রিয়ভাবে যিশুর জন্য অপেক্ষা করা উচিত না তোমাদের, পল তাদের বলেছিলেন, তোমাদের বাইরে বের হয়ে পুরো পৃথিবীকে জানানো উচিত, যিশুর পথ অনুসরণ করতে আপনার ইহুদি হবার দরকার নেই। আমরা অবশ্যই আমাদের আচারে বিশ্বাসী ইহুদির মতো জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখব। কারণ এটাই আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু নিশ্চয়ই তোমরা ইহুদি নয় এমন কাউকে বলবে না যে, তারা যদি যিশুকে অনুসরণ করতে চায়, তাহলে তাদের খত্না করাতে হবে, কারণ বহু শতাব্দীব্যাপী খত্না করানোর মাধ্যমে ইহুদি বালকদের ঈশ্বরের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি, যা ঘটেছে আগে, কিন্তু বর্তমান ভিন্ন। যা এখন দরকার সেটি লিঙ্গের ত্যা করা না বরং হৃদয়ের খত্তা করা। আধ্যাত্মিক খনা। ইহুদি নয়, এমন ব্যক্তিরা তাদের জীবনযাপনের পুরনো পদ্ধতি কেটে ফেলে দেবে তাদের জীবন থেকে এবং যিশুর দেখানো পথে নতুন করে তারা বাঁচতে শুরু করবেন। আর এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছে দেবার মতো অনেক বেশি সময় আমাদের হাতে নেই। আপনারা যেভাবে ভাবছেন তার আগেই তিনি ফিরে আসবেন। ইতিমধ্যেই বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন, যারা তার সেই বার্তাটি শোনেননি। আমাদের খুবই দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে, নষ্ট করার মতো কোনো সময় আমাদের হাতে আর নেই।
এভাবেই পল তাদের কাছে বারবার এই আহ্বান নিয়ে গিয়েছিলেন, যতক্ষণ তাদের প্রতিরোধের দেয়ালটি ভেঙে পড়ে। কিন্তু পুরোপুরিভাবে তারা তার কথা মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং তারা জোড়াতালি দিয়ে একটি সমঝোতায় এসেছিলেন। যিশুর মূল অনুসারীরা জেরুজালেমেই থাকবেন। সেখানেই তারা তার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকবেন। এবং তারা সব ইহুদি-আচার আর ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকবেন। তারা পুরো বিষয়টি এখানেই ধরে রাখবেন। কিন্তু ইহুদি নয় এমন কাউকে যিশুর বার্তা জানাতে পল যেতে পারেন। এবং তিনি যাদের ধর্মান্তরিত করবেন তাদের ইহুদিবাদের আচার মানার প্রয়োজনীয়তা নেই। এবং পল তার লক্ষ্য নিয়েই পথে বের হয়েছিলেন। ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তে রোমের সব প্রদেশগুলোয় ধর্ম প্রচার করার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন, যেখানে ইহুদি নয় এমন বহু মানুষকে তিনি যিশুর অনুসারী বানিয়েছিলেন এবং যেখানেই গিয়েছিলেন সেখানেই তিনি চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আর সে-কারণে বলা হয় যিশু নয় বরং পলই খ্রিস্টধর্মের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে ছাড়া এই ‘যিশু’-আন্দোলনটি ইহুদিবাদের মধ্যে আরেকটি ব্যর্থ মেসিয়ানিক আন্দোলন হিসাবে ম্লান হয়ে হারিয়ে যেত। পলই এটিকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সত্যি, কিন্তু তার সাথে যিশুকেও তিনি এনেছিলেন। তিনি যিশুর কথাই প্রচার করতেন : যে যিশুর সাথে দামাস্কাস যাবার রাস্তায় তার একদিন দেখা হয়েছিল; সেই যিশু যিনি পৃথিবীর জন্যে ঈশ্বরের ভালোবাসার সুসংবাদ দিয়েছিলেন, সেই যিশু যিনি শীঘ্রই আবার ফিরে আসবেন, তাই নষ্ট করার মতো আর কোনো সময়ই নেই।
তবে, যিশু আর ফিরে আসেননি, আর যিশু এখনো ফিরে আসেননি, যদিও তিনি একদিন ফিরে আসবেন এই প্রত্যাশাটিরও কোনোদিন মৃত্যু হয়নি। এটাই খ্রিস্টধর্মের আনুষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের অংশ, যেখানে এই দিনটি সম্বন্ধে বলা হয়, তিনি তার সব মহিমা নিয়ে ফিরে আসবেন জীবিত এবং মৃত সবাইকে বিচার করতে।
পল অন্য অ্যাপোস্টলদের কাছ থেকে অনিচ্ছাসূচক একটি শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং তাকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল, ইহুদি নয় এমন মানুষের কাছে তার ধর্ম প্রচার এবং তার চার্চ প্রতিষ্ঠা করতে। ইহুদিবাদের আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের কাছে এই পরিস্থিতি খুব ভিন্ন ছিল। তারা তাদের দলের যোগ্য একজন মানুষ ও যিশুর অনুসারীদের নির্যাতনকারী এক দক্ষ ব্যক্তিকে হারিয়েছিল খ্রিস্টধর্মের কাছে। তারা তার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিল তাদের শত্রুকে অকার্যকর করতে, কিন্তু তিনি তার আনুগত্য বদলে তাদের সাথেই যুক্ত হয়েছিলেন। এখন তিনি হচ্ছেন তাদের শত্রু। সুতরাং তারাও তার ওপর একই তীব্রতার সাথে প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এসেছিল, যে তীব্রতা একদিন তাকে দামাস্কাস বরাবর রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল। তাকে প্রায় নিরন্তরভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে আরো নানা মেয়াদে তাকে শাস্তি খাটতে হয়েছিল। পাঁচবার তিনি উনচল্লিশটি বেতের বাড়ির আনুষ্ঠানিক শাস্তি পেয়েছিলেন। তিনবার তাকে লোহার দণ্ড দিয়ে প্রহার করা হয়েছিল। একবার তাকে পাথর ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করাও হয়। অবশেষে, এসব তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠেছিল, রোম-কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি আবেদন করেছিলেন : সর্বোপরি তিনি একজন রোমান নাগরিক, আর সে-কারণে তার বিরুদ্ধে আনীত যিশুর সুসংবাদ প্রচার করার অভিযোগটির সঠিক বিচার করা হোক।
রোম-কর্তৃপক্ষ অবশেষে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, রোমের একজন নাগরিক হিসাবে তার এই দাবি বৈধ, সুতরাং তারা তাকে রোমে নিয়ে এসেছিলেন বিচার করতে। সেখানে পৌঁছানোর পর তারা তাকে বন্দি করে রেখেছিল। কিন্তু যিশুর নামে ধর্মান্তরিত করার কাজ থেকে তারা কেউই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। পল এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তার বিশ্বাসের পক্ষে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার কাজটি কোনোভাবে থামাতে পারত না। এমনকি কারাগারেও। তার মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম রোমে প্রবেশ করেছিল। এটি ঘটেছিল নীরবেই, চোখের অন্ত রালে, যখন এই ক্ষুদ্রাকৃতির, ধনুকের মতো বাঁকা পায়ের মানুষটি, যার চোখে গভীর একটি চাহনি ছিল, রোমসাম্রাজ্যের রাজধানীতে বসতি গড়েছিলেন।
অনেক ঘটনা, যা চুপিসারে আসে, প্রায়শই সেগুলো পৃথিবী বদলে দেয়। এটি ছিল তেমন ঘটনাগুলোর একটি। এবং এটি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।